![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লব একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। নানা কৌশলে এই ইতিহাস থেকে এই প্রজন্মকে বিরত রাখা হয়েছে অথবা ভুল ইতিহাস শেখানো হয়েছে। ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের নায়কদের বিরোধী ছিলেন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি তিনি৷ সেনাবাহিনীর ভারতপন্থী অফিসার হিসেবে তার খ্যাতি ছিলো৷ তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে খালেদ ও তার দলবল আরেকটা অভ্যুত্থান ঘটায় ও এর ফলে মোশতাক উৎখাত হবার পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দী হন। দুর্ভাগ্যবশত, খালেদের এই বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের স্থায়িত্ব ছিলো মাত্র ৩ দিন৷ এ সময় খালেদের নির্দেশে জিয়ার বাসভবনের টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এ সময় দৃশ্যপটে আগমন ঘটে কর্নেল তাহেরের, যিনি একজন কমিউনিস্ট ছিলেন৷ সৈনিক-অফিসার বৈষম্যের ঘোর বিরোধী তাহের শত শত জাসদ কর্মী নিয়ে পালটা অভ্যুত্থান সৃষ্টি করে আর ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে। কর্নেল তাহেরের পরে ফাঁসি হওয়ায় দিনটিকে আওয়ামী লীগ মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস হিসেবে পালন করে। অথচ কর্নেল তাহেরের একটা বিখ্যাত উক্তি ছিলো এরকম, "শেখ মুজিবকে কবর দিতে অ্যালাও করা ঠিক হয়নি। এখন তো সেখানে মাজার হবে। উচিত ছিল লাশটা বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেয়া।" - এর পরও আওয়ামী লীগ এতটা তাহেরপ্রেমী কিভাবে হয়ে উঠলো, তাও ভাবনার বিষয়। আসলে এই জাসদের শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডেও হাত ছিলো। ইনুর ট্যাংকনৃত্য সেই কথারই প্রমাণ দেয়। জিয়াউর রহমানকে ইসলামপন্থী অফিসার ভাবা হতো, তাই সিপাহী জনতা তাকেই সেনাপ্রধান বা চীফ অফ স্টাফ হিসেবে পছন্দ করেছিলো। রাস্তায় সৈন্যরা নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবার বলে শ্লোগানও দেয় সেদিন। সেই আমলের একজন সেনা কর্মকর্তার বইয়ে উল্লেখিত বয়ানে তুলে ধরার চেষ্টা করবো এই দিনের সেই সময়ের কিছু ঘটনা৷ লেখকের নাম লে.কর্নেল এম এ হামিদ। বইয়ের নাম "তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা"।
"৭ নভেম্বর ১৯৭৫ সাল। রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সংঘটিত হলো ঐতিহাসিক সেপাই-বিদ্রোহ। স্থান ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। প্রচণ্ড গোলাগুলি, চিৎকার আর হট্টগোলের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হলো শতাব্দীর এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। রেড টেপ্ অফিসারদের দাপটে শিহরিত আধুনিক পেশাদার সেনাবাহিনীতে বর্তমান যুগেও যে ভয়াবহ সেপাই বিদ্রোহ ঘটতে পারে, তা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। অথচ তাই ঘটে গেল।
সেপাইদের পদভারে প্রকম্পিত ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। অফিসাররা ভয়ে কম্পমান। ১৮৫৭ সালের ২৯শে মার্চ ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল এই উপমহাদেশের প্রথম সেপাই বিদ্রোহ। কলকাতার ব্যারাকপুর থেকে শুরু হয়েছিল বিদ্রোহের প্রথম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, তারপর ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। দিল্লি, আগ্রা, লখনৌ, মীরাট, কানপুর সর্বত্র। বিদ্রোহী সেপাইরা শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে দিল্লির সিংহাসনে বসাতে চেয়েছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয় তাদের অভ্যুত্থান। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলে প্রাণ বলি দেয় শত শত সৈনিক। শতাব্দীর ব্যবধানে এই উপমহাদেশে সংঘটিত হলো দ্বিতীয় সেপাই বিদ্রোহ। রাত ১২টা। সুবেদার মেজর আনিসুল হকের ইঙ্গিতে টু-ফিল্ড রেজিমেন্টের লাইন থেকে একটি ট্রেইসার বুলেট আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে অন্ধকার ভেদ করে আকাশে উঠল। এটাই ছিল সংকেত। ক্যান্টনমেন্টের উত্তরপ্রান্তে 38 LAA রেজিমেন্ট প্রচণ্ড শব্দে আকাশে এ্যাক এ্যাক গান ফায়ার করে তার জবাব দিলো। ব্যাস আর যায় কোথায়! সারা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বাইরে চতুর্দিক থেকে হাজার হাজার বুলেট ছুটে গেল আকাশে। শুরু হলো উপমহাদেশের দ্বিতীয় সেপাই বিদ্রোহ।
এক মুহূর্তেই অন্ধকারের আবরণে ঘুমিয়ে থাকা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সচল হয়ে উঠল। চারিদিকে বুলেট আর বুলেট। ফায়ার আর ফায়ার। আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল সারা ক্যান্টনমেন্ট। চারিদিকে গুলি আর গুলি। দূরে চতুর্দিকে মানুষের উল্লাস আর চিৎকার ধ্বনি। আলোর ছটায় আকাশ লালে লাল। আমার বুঝতে বাকি রইল না। এটাই সেই প্রত্যাশিত সেনা-অভ্যুত্থান। যার পদধ্বনি আমরা গত ক'দিন ধরেই শুনতে পাচ্ছিলাম। এটি ছিল তিন মাসের ব্যবধানে ঢাকা সেনানিবাসে তৃতীয় সেনা-অভ্যুত্থান। চতুর্দিকে অবিরাম গোলাগুলি আর চিৎকার ধ্বনি। অবস্থা ভালো করে পরখ করার জন্য আমি হামাগুড়ি দিয়ে দোতলার উঁচু ছাদে উঠলাম। লক্ষ করলাম এয়ারপোর্ট, ইব্রাহিমপুর, বনানী ও ক্যান্টনমেন্টের উত্তর প্রান্তে ইঞ্জিনিয়ার্স, সিগন্যাল লাইনের দিক থেকে বহু লোক একসাথে আকাশে বাতাসে গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমার বাসা বরাবরই এগিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে শত শত মানুষের চিৎকার আর গুলির শব্দ একেবারে আমার বাসার কাছে এসে পৌঁছে গেল। এরই মধ্যে দেখি বড় বড় রাস্তা দিয়ে একটি জিপ মাইক নিয়ে শ্লোগান দিয়ে ছুটে চলছে, "সেপাই সেপাই ভাই ভাই"। জেনারেল জিয়ার বাসা আমার বাসা থেকে দুশো গজের মধ্যে। ছাদের ওপর থেকে পুরো দৃশ্যই দেখা যাচ্ছিল। দেখলাম উন্মত্ত সৈনিকবৃন্দ তাঁর বাসার দিকে যাচ্ছে। জিয়ার বাসার গেইটের কাছেই সবাই জমায়েত হয়ে ক্রমাগত শ্লোগান দিচ্ছে আর গুলি ছুড়ছে। সেপাই বিদ্রোহের চরম মুহূর্ত। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। "সেপাই সেপাই ভাই ভাই। জেনারেল জিয়া জিন্দাবাদ।"
বন্দি জিয়াউর রহমানকে খালেদ মোশাররফ -শাফায়েত জামিল তাঁর বাসভবনেই ফার্স্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন গার্ড দিয়ে আটকে রেখেছিল। রাত বারোটায় সেপাই বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। তখন থেকেই বিপ্লবীরা এবং সেপাইরা বিভিন্ন ইউনিট থেকে বেরিয়ে এসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জিয়ার বাসভবনের চারপাশে সমবেত হতে থাকে। সবারই লক্ষ্যস্থল ছিল জিয়ার বাসভবন।
সবাই সেখানে একত্র হয়ে দুর্গ ভেঙে বন্দি জিয়াকে বের করে আনবে, এই ছিল প্রতিজ্ঞা। সারাদিন ধরে চলে গোপন প্রস্তুতি। বাইরে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা এসে যোগাযোগ করে যায় বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিক, এনসিও, জেসিওদের সাথে। জিয়াকে উদ্ধার করতে বিভিন্ন ইউনিট নিজেদের উদ্যোগেই বিশ্বস্ত লোক নিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল গঠন করে।
টু-ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির এরকম একটি দল মেজর মহিউদ্দিন, মোস্তফা ও সুবেদার মেজর আনিসুল হকের নেতৃত্বে প্রস্তুত থাকে। রাত বারোটায় সেপাই বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সাথে সাথে এই গ্রুপটিই প্রথম জিয়ার বাসভবনের গেইটে গিয়ে হাজির হয়। এই একটি মাত্র গ্রুপের অফিসার থাকায় তারা অন্যদের টেক্কা দিয়ে তড়িৎ প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে পারে, বাকিরা পৌঁছুবার আগেই। তারা জিয়ার বাসভবনের গার্ডদের বুঝিয়ে বলল, 'সেপাই সেপাই-ভাই ভাই।' এখন থেকে সেপাই বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। আমরা সবাই জিয়াকে মুক্ত করতে এসেছি। তোমরা গেইট খুলে দাও। ততক্ষণে আশেপাশে বেশকিছু সৈনিক শ্লোগান তুলতে শুরু করেছে। বিপ্লবী ভাইদের ডাকে সাধারণ সৈনিকরাও ব্যারাক ছেড়ে ছুটে আসছে রাস্তায়। 'সেপাই সেপাই-ভাই ভাই! জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ।'
মধ্যরাতে জিয়াউর রহমানকে কিছুটা কমান্ডো স্টাইলে বিনা বাধায় মুক্ত করার পর সকালবেলা বিপ্লবীদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে শত শত সৈনিক তাদের ইউনিটের ট্রাকে চেপে শ্লোগান দিতে দিতে শহরের দিকে ছুটতে থাকে। শহরে পৌঁছে তারা অবাধে আনন্দমুখর জনতার সাথে মিশে গিয়ে উল্লাস করতে থাকে। নতুন শ্লোগান উঠে 'সেপাই জনতা-ভাই ভাই'। অদ্ভুত এ্যাডভেঞ্চার। রাস্তায় রাস্তায় শ্লোগানমুখর জনতা বেরিয়ে আসে সৈনিকদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে।
দেখতে দেখতে সেপাই বিপ্লব মোড় নেয় ঐতিহাসিক 'সেপাই-জনতার' বিপ্লবে। শহরের রাস্তায় মানুষের ঢল। 'সেপাই জনতা-ভাই ভাই।' ভোরবেলা বেঙ্গল ল্যান্সারের ট্যাংকগুলো প্রবল বেগে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো। সারা রাত তারা শান্তভাবে ক্যান্টনমেন্টের উত্তর কোণে বসে বসে ঘটনা পরখ করছিল। বিপ্লবী সুবেদার সারওয়ারের ডাকে ভোর পাঁচটার দিকে তারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে শহরের দিকে ধেয়ে যায়। রাস্তায় রাস্তায় ট্যাংক। জনতা প্রবল উল্লাসে ট্যাংকগুলো ঘিরে ধরে সেপাইদের সাথে মিশে গিয়ে নৃত্য করতে থাকে। সেপাই জনতার উল্লাস ব্যাপক উন্মাদনায় রূপ নেয়। সর্বত্র এক অবর্ণনীয় দৃশ্য। 'সেপাই জনতা-ভাই ভাই। সেপাই বিপ্লব জিন্দাবাদ!'
খবর পেলাম, শহরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, শহীদ মিনার প্রভৃতি এলাকায় সিপাহী-জনতার মিছিল মিটিং চলছে। তাজ্জব ব্যাপার! সি.এম.এইচ. থেকে ফিরে আমি জিপ নিয়ে শহরের এই অদ্ভূত অবস্থা স্বচক্ষে পরখ করতে বেরিয়ে পড়লাম। শহরে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে। হাইকোর্টের সামনে আর যেতে পারলাম না। হাজার হাজার মানুষ জিপ দেখে 'আল্লাহু আকবার' বলে ছুটে আসলো। আমি বিপদ ভেবে ড্রাইভারকে তাড়াতাড়ি জিপ ঘুরাতে বললাম। কিছুটা শান্ত দেখে কাকরাইলের রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলাম সেদিকেও একই অবস্থা। মিলিটারি গাড়ি দেখলেই আনন্দের আতিশয্যে জনতা তা ঘিরে ধরছে আর "জিন্দাবাদ" ধ্বনি দিচ্ছে। রেসকোর্সের কাছে কয়েকটি ট্যাংকের ওপর বহু সিভিলিয়ান চড়াও হয়ে ফুর্তি করছে দেখলাম। আমি আর গুলিস্তানের দিকে যাওয়ার সাহস পেলাম না। কাকরাইল থেকেই ঘুরে পুনরায় শাহবাগ হয়ে দ্রুতগতিতে ক্যান্টনমেন্টে ফিরে এলাম। রাস্তায় রাস্তায় সর্বত্র জনতার ঢল। আনন্দ উল্লাস!
একটি ব্যাপার লক্ষ্য করলাম, জনতার বেশিরভাগ ছিল ইসলামপন্থী। তারা ক্রমাগত নারায়ে তাকবীর - আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিচ্ছিলো। সবাই ছুটছে এক অপূর্ব আবেগে, মুক্তির আনন্দে। অভূতপূর্ব দৃশ্য!
শহরের রাস্তার বিভিন্নস্থানে দেখলাম, সৈনিকরা বিভিন্ন ইউনিট থেকে ট্রাক বের করে এনে রাস্তায় সিভিলিয়ানদের সাথে মিশে মিছিল করছে আর শ্লোগান দিচ্ছে, 'আল্লাহু আকবার। সেপাই জনতা-ভাই ভাই।'
সেপাই-জনতার বিজয় মিছিল। চতুর্দিকে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেপাই-জনতার এমন মিলন দৃশ্য ইতিপূর্বে আর কখনো দেখিনি। সেপাই বিদ্রোহের সাথে জনতার একাত্মতা ঘোষণা, এক ঐতিহাসিক ঘটনা বটে। রাস্তায় কোথাও কোনো অফিসারকে দেখলাম না। দিনটি ছিল যথার্থই সেপাইদের দিন। তাদের জন্য এক বিরাট এ্যাডভেঞ্চার। শতাব্দীর এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
নতুন প্রজন্মের অবশ্যই বইটি পড়া উচিত! ইতিহাস জানা থাকা জরুরি, তাহলে আওয়ামী লীগের মতো কেউ মিথ্যে ইতিহাস চাপিয়ে দিতে পারবে না।
©somewhere in net ltd.