![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ইনসমনিয়াক
এক
আজকে আমার মনটা খুব ভাল। সুন্দর একটি দিনে সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গলে ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় খুব ভাল লাগে। বিশেষ করে আগের রাতে যদি ভাল ঘুম হয় - তাহলে তো সোনায় সোহাগা। অনেকদিন পর ঘুমের ঔষধ খাওয়া ছাড়াই খুব ভাল ঘুম হল। এমন রাত বেশী আসে না - মাসে একবার।
ঘুমের ঔষধ খাওয়া শুরু করেছিলাম মেডিকালে থাকার সময়। পড়ালেখার চাপ আর পরীক্ষার চাপে বাধ্যই হয়েছিলাম বলা চলে। একদিকে পরীক্ষা, অন্যদিকে সেই পরীক্ষার পড়া। এদিকে আবার না ঘুমালে পরের দিন ভাইভা বোর্ডে মুখ খোলাই কঠিন হয়ে যাবে। ঘুমের ঔষধ ছাড়া উপায় কি?
শুরু করে ছিলাম মিডাজোলাম দিয়ে - খুব ভাল ঔষধ। কিন্তু একটানা খেতে খেতে মাস দুয়েক পরেই কাজ করা বন্ধ করে দিল। এরপর এটা সেটা খেয়ে খেয়ে এখন আমার অবস্থা বেশ খারাপই বলা চলে। যে ঔষুধ খেলে মানুষ তো দূরে থাক হাতিরও ঘুমিয়ে পড়ার কথা, সেটি খেয়ে আমি জেগে থাকি।
প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম সমস্যা বুঝি আমার টেনশন করা। কিন্তু ঘুম না আসার আসল কারণ আবিষ্কার করলাম, যখন ইন্টার্ণশীপ শুরু হল। আমাদের মেডিকেলটা একটু প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কিন্তু আসে পাশে আর কোন বড় মেডিকেল না থাকায়, আমাদেরটায় রোগীর চাপ হত অস্বাভাবিক। রোগী ভর্তি হবার দিন কুলিয়ে উঠতে পারতাম না। মাসে দশ দিন আমাদের ইউনিটে রোগী ভর্তি হত। এই দশদিন আর তার পরের দশছিল ছিল স্রেফ বিভীষিকা। আট ঘন্টার জায়গায় ষোল ঘন্টা ডিউটি করতে হত। মাঝে মাঝে হয়ত তার চেয়েও বেশী।
এক নাইটে আমরা দুই জন ইন্টার্ণ মিলে হাসপাতাল সামলাচ্ছি। যেহেতু আমরা ছেলে, আর আমাদের ব্যাচে মেয়ের সংখ্যা ছিল বেশী, অধিকাংশ নাইট আমাদেরকেই করতে হত। রোগীর চাপ খুব বেশী। হিমশিম খাচ্ছি কুলাতে। বিকালের দিকে একটু বাজে পরিস্থিতিও ঘটে গিয়েছে। এক অতি পাকনা রোগির লোক এসে ঝামেলা করেছে। এরকমই হয়, সারাদিন খোঁজ খবর থাকে না। অফিসে যাবার সময়ভাবে - একটু ভাব দেখিয়ে যাই।
এমনভাব করে ডিউটি ডাক্তারের রুমে ঢুকেছে যেন বাপ-দাদার সম্পত্তি। এসেই হুকুম - রোগীর কি অবস্থা বলেন। ভাব ভঙ্গি দেখে আমাদের ডাক্তার সহপাঠিনীও জানতে চাইল রোগীর কি হন? উত্তরে দুর সম্পর্কের মামা শুনে বলল, ‘রোগীর ব্যাপারে রোগীর নিকটাত্মীয় ছাড়া কথা বলার নিয়ম নেই। আপনার কিছু জানতে হলে ওদের কাছ থেকে জেনে নিন।’ ব্যাস, লেগে গেল।
এড়ানো যেত হয়ত। কিন্তু এমন লোকের সংখ্যা এতই বেশী যে, এদেরকে পাত্তা দিলেই মাথায় চড়ে বসে। যাই হোক, দৌড়াদৌড়ির মাঝে এত ঝামেলার জন্য সবারই মেজাজ খারাপ। পরিস্থিত এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যে, আমরা দুই ছেলে মামলা খাবার হুমকী পর্যন্ত খেয়ে বসে আছি।
যাই হোক, নাইট করছি এমন সময় ভর্তি হল হার্টের রোগী। এই হার্টের রোগী সামাল দেয়া একটু কঠিন। যে কোন মুহুর্তে আবার হয়ে যেতে পারে এ্যাটাক। হলও তাই, ট্রিটমেন্ট দিয়ে ঔষধ কি কি লাগবে তা শুধু লিখে দিয়েছি, আবার এ্যাটাক হল। রোগীর লোককে বললাম, দ্রুত ঔষধ নিয়ে আসতে। কিন্তু বিধি বাম, ঔষধ আনার আগেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করল লোকটি।
চোখের সামনেই বলুন আর হাতের উপরেই বলুন, জলজ্যান্ত একটা মানুষের মৃত্যু নাড়া দিয়ে গেল। এর আগেও রোগী মারা গিয়েছে, কিন্তু তখন সবাই উপস্থিত ছিল। স্যার, বড় ভাই, ব্যাচের অন্যান্যরা। একা একা এই প্রথম মৃত্যু দেখতে পেলাম। রোগী ভিআইপি ছিলেন বলে, ভাইয়ারা সবাই চলে এলেন। আমাকে দেখে তাদের কি মনে হল জানি না। বললেন, ‘আবিদ, রুমে যা। আজকে আর ডিউটি করা লাগবে না।’ টলতে টলতে হোস্টেলে ফিরে এলাম।
সেই রাতে, দীর্ঘদিন পর আমার খুব ভাল ঘুম হল।
****
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে খুব ফ্রেশ মনে হল, মনে হল শরীরে কোন ক্লান্তিই নেই। অনেক দিন পর এমন আরামের ঘুম ঘুমাতে পারলাম। সেদিন বুঝি নি আমার ফ্রেশ ঘুমের কারণ, বুঝেছি তার এক সপ্তাহ পরে, যেদিন থেকে সাইক্রিয়াট্রিক ওয়ার্ডে ইন্টার্ণী শুরু হল।
খুব ভাল একজন স্যারের অধীনে ডিউটি করতাম। আমার সব টেনশন, সব কথা খুলে বলেছিলাম তাঁকে। ঔষধ দিয়েছিলেন, কিন্তু খেতে পারি নি। মাথা কাজ করত না, অথচ হাসপাতালের মত জায়গায় ডিউটি করার সময় মাথা কাজ করাটা খুবই জরুরী। একদিন আউটডোরে রোগী দেখছি, এমন সময় পুলিশের লোক এল। হাসপাতালে আসেই, কয়েদীরাও তো অসুস্থ হয়। কনষ্টেবল মামাকে ভালভাবেই চিনি। এবার এক ভায়োলেন্ট কয়েদী নিয়ে এসেছেন। খুনের আসামী, মানসিক ভারসাম্যহীন। স্যারের কথা শুনে বুঝতে পারলাম, খুব চাপের মাঝে থাকলে - মাঝে মাঝে এমন হয়। নিজের উপর মানুষ কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। তখন অপছন্দের কাউকে খুন করতেও বাঁধে না। প্রতিটি খুন করার পর এসব রোগী একধরণের মানসিক প্রশান্তিবোধ করে। স্যার এমন এক সিরিয়াল কিলারের কথা আমাদের বললেন, যে কিনা খুন করার পর জায়গায় ঘুমিয়ে পড়ত। ওকে ধরাও সম্ভব হয়েছিল এই কারণে। তখনও নিশ্চিত হই নি - কিন্তু মাথায় রয়ে গেল।
সাত দিনের ডিউটি শেষে ফিরে এলাম মেডিসিন ইউনিটে। আবার সেই চাপ, সেই নির্ঘুম রাত, সেই ঔষধ খেয়ে জেগে থাকা। ঘুমের কি মুল্য তা কেবল ইনসোমনিয়াকই বোঝে। এরই মাঝে একদিন সকালের ঘটনা। তখন ষোল ঘন্টা ডিউটি শেষে রুমে ফিরব। এমন সময় আবার হার্টের এক রোগী খারাপ হয়ে গেল। একই অবস্থা, একই পরিণতি। হাতের উপরে মারা গেল এই রোগীটিও। এবারও কোন ক্রমে টলতে টলতে রুমে এসে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল বিকেলে।
সেদিনই প্রথম মাথায় আসে - আচ্ছা, আমিও ... পরক্ষণেই ভাবি, আরে না! তা কি করে হয়।
পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ এসে গেল পরের সপ্তাহেই। সরকারী মেডিকেল। রোগীর কি অভাব আছে? মাত্র দুই জন নার্স। সবাইকে ঠিকমত ঔষধও দিতে পারে না। ততদিনে ওয়ার্ডের পরিচিত মুখ হয়ে গিয়েছি। নতুন ব্যাচ এসেছে, আমি তখন বড়ভাই সুলভ আচরণ করতে ব্যস্ত। একে এটা শিখাই, তো ওকে ওটা। নার্সের উপর থেকে চাপ কমাতে, প্রায়ই নিজের রোগীকে নিজেই ঔষধ, ইঞ্জেকশন দিয়ে দেই। এক দিন সকালে ঘুরে ঘুরে আমার বেডের রোগীদের দেখছি, এমন সময় এক জুনিয়র এসে ডাক দিল, ‘ভাইয়া, চার নাম্বার বেডের রোগীটি যেন কেমন করছে। আসেন তো একটু!’ দৌড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি শেষ অবস্থা। হাতুড়ে দেখিয়ে দেখিয়ে আর এ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে খেয়ে নিজের বারোটা বাজিয়ে এসেছে। এখন কোন কিছুই কাজ করছে না। যাই হোক, কি করব, রোগির শেষ চিকিৎসা হিসেবে স্টেরয়েড পুশের অর্ডার দিলাম। নিয়ে এল আমার জুনিয়র। সিরিঞ্জে নিয়ে পুশ করব, এমন সময় মাথায় এল - আচ্ছা, আমি তো ওমন হলেও হতে পারি। দেখি না একটা পরীক্ষা করে। এই রোগী এমনিও মরবে, ওমনিও মরবে। জুনিয়রকে বললাম, ‘যা, ভাইয়াকে ডেকে আন।’ জানি, মিনিট পনের আগে সে ভাইয়াকে খুঁজেই পাবে না। ভাইয়া যে প্রফেসর স্যারের সাথে ডিরেক্টরের রুমে।
হাতের সিরিঞ্জে ঔষধটুকু নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাগ্য ভাল, রোগীর লোককে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছি - আরও ঔষধ আনতে। আসে পাশে অন্যান্য রোগীর ভিড় কমাতে ধমক দিলাম একটা। কাজ হল - সরে গেল সবাই। পুশ করছি, এমন ভান করে বাইরে ফেলে দিলাম ঔষধটুকু। এবার অপেক্ষার পালা।
অল্পক্ষণ পরেই মারা গেল লোকটি। আর আমার গা যেন অবসন্ন হয়ে এল। মনে হল ওখানেই শুয়ে পড়ি। বুঝতে পারলাম, এতদিন যে ভয় করে এসেছি, তাই সত্য - আমি খুনী।
তবে, মিথ্যা বলব না। ঘুমাবার এক উপায় পেয়ে আমি মনে মনে খুব খুশীই ছিলাম।
ইন্টার্ণ অবস্থাতেই আরও কয়েকবার... ... আমার নিরবিচ্ছিন্ন ঘুমের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। গরীব, সম্বলহীন লোকেদের ধুঁকে ধুঁকে মরার চেয়ে একেবারে মরে যাওয়ায় ভাল না? যে ক্যান্সারের রোগীটি ছয়মাস পরে এমনিই মারা যাবে। আর যার এই ছয়মাস কাটবে অবর্ননীয় কষ্টে, তার কষ্ট লাগব করে দেয়াটাই কি মানবতা নয়?
সমস্যা শুরু হল যখন ইন্টার্ণশীপ শেষ হল তখন। ঢাকায় এসে তো চরম বিপদে পড়লাম। এখানে বেসরকারি মেডিকেলে স্যারদের কথার বাইরে একটা পেইনকিলার পর্যন্ত দেয়া যায় না - তা রোগী ব্যাথায় মারাই যাক না কেন। কি করি, কি করি। ঘুমের অভাবে দুই মাস পাগলের মত কাটালাম। দুই মাস পর সুযোগ পেলাম - ডায়াবেটিস রোগী। বোঝাই যাচ্ছিল গ্লুকোজ কমে গিয়েছে। তাও পুশ করে দিলাম ইনসুলিন। মাস দুই পরে অনেক আরামে ঘুমিয়েছিলা সে রাত।
আমার বাবা - মার কপাল ভাল, গ্রামের বাড়ীতে থাকেন। শহরেই থাকতেন, আব্বু রিটায়ার্ড করার পর গ্রামে চলে গিয়েছেন। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে, হয়ত কাছে থাকলে তাদেরকেই...
আমার নাম আবিদ। আমরা দুই ভাই বোন। বড় বোনটা থাকে সুইজারল্যান্ডে। দুই জনেই সেখানের ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার। ঢাকা শহরে তিন-চারটা ফ্ল্যাট কিনেছেন। আমি ওগুলোরই একটাই থাকি। বাকি গুলো খালিই পড়ে থাকে। আমিই দেখাশোনা করি।
আমার সৌভাগ্য - এত গুলো ফ্ল্যাটের চাবি আমার কাছে। এতগুলো ফ্ল্যাটকে আমি ব্যবহার করতে পারি।
দুই
মাঝে সাঝে দুই একজন রোগীকে পরপারে পৌছাতে সাহায্য করতে পারতাম বটে, কিন্তু এমন সুযোগ বেশী একটা মিলত না। মাসে দুই মাসে একবার। একবারের কথা মনে আছে, প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত আমি ঘুমাতে পারি নি। সুযোগই পাই নি। আমার সিরিয়াল কিলার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার শুরু সেবারই।
অনেক ভেবে চিনতে দেখলাম - এভাবে চলবে না। ঘুমাতে না পারলে পাগল হয়ে যাব তো। তাই ভাবলাম, কোন একটা সিস্টেম দাঁড়া করানো দরকার।
অনেক ভেবে চিন্তে সিস্টেম দাড়ও করিয়ে ফেললাম। না, খুব অসাধারণ কিছু না। যদিও, ডাক্তাররা সাধারণত অসাধারণ হয়। খুব সহজ সিস্টেম। শিকার হিসেবে বেছে নিলাম - পতিতাদের। সহজ শিকার। রাত দশটায় ডিউটি শেষ করে, কিছু একটা খেয়ে নিয়ে ঢাকার অগণিত স্পটের কোন একটায় ঢুঁ মারলেই হয়। নিজের গাড়ী আছে, কাল কাঁচ লাগানো। তাই করতে লাগলাম। ইভিনিং ডিউটি করে চলে যেতাম কোন খাবার দোকানে। সেখানে ঘন্টা খানেক খাবার-দাবার নিয়ে ছানাছানি করে চলে যেতাম কোন স্পটে। আমি তো আর নিজের জৈবিক চাহিদা মেটাতে যাচ্ছি না। কোন একজনকে পেলেই হল। নিয়ে আসতাম নিজের ঢেরায়। আমার বোনের সবগুলো এ্যাপার্টমেন্ট হাউসের মালিক জানত - আমি ডাক্তার। সবাইকে বলেছিলাম, আইসিইউ তে আছি। জানত, যে কোন সময় ডাক পড়তে পারে। তাই, পেছনের দরজার এক কপি চাবী আমার কাছে থাকত। তারপরও, দুই একদিন দারোয়ানের নজরে পড়েছি বৈ কি। পাঁচশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিতেই সব চুপ।
সবচেয়ে সুবিধা হয়েছিল, ঢাকার তিন জায়গায়, তিন ফ্ল্যাট হওয়ায়। মাস তিনেক পরপর একেকটা ফ্ল্যাটে যাওয়া পড়ত পতিতা নিয়ে। তাই...
কমদামী এসব পতিতাদের একটা ভাল দিক হচ্ছে - এরা অপরিষ্কার। ভাল দিক কেন? খুব সিম্পল - এদেরকে বাসায় নিয়ে এলেই এরা কেমন ইতস্ততবোধ করত। বুঝত, বাসার পরিষ্কার আবহাওয়ায় ঠিক মানাচ্ছে না। তাই, বেশী বার বলতে হত না। শাওয়ার নিতে বলতেই, রাজি হয়ে যেত। হয়ত মনে করত, বাথরুমে কি না কি দেখবে। আর আগে ওষুধ মেশানো শরবত খেতে দিতাম। আমার কোন অসুবিধা না হলেও, এই সব মেয়েদের উপর ভালই কাজ করত। কিছুটা অসংলগ্ন অবস্থায় ঢুকত বাথরুমে।আমিও ঢুকতাম সাথে। টাকার পরিমাণ বেশী থাকত বলেই হয়ত কিছু মনে করত না। আর মনে করারই বা কি আছে? রাতের জন্য দেহটি তো আমি কিনেই নিয়েছি। তাই না?
গোসলের এক পর্যায়ে বলতাম - ঘোর, তোমার পিঠে সাবান মাখিয়ে দেই। পিঠ আমার দিকে ফেরাতেই, মাথায় আঘাত হানতাম শক্ত কোন কিছু দিয়ে। একটার বেশী আঘাত করতে হয় নি কখনো।
গ্রাভিটির একটি মজার দিক হচ্ছে, সব কিছুকেই টানে। রক্ত, মাংস সব। তাই পা বেঁধে যখন মাথা নিচে দিয়ে ঝুলিয়ে দিতাম। সব রক্ত যেন নীচের দিকে ভিড় করত। মানুষের দেহে পাঁচ লিটারের মত রক্ত থাকে। শিরায় ফুটো করে সেই রক্ত ব্যাগে ভরতে আমার প্রায় ৭-৮ টা ব্যাগ লাগত। তবে মাথা নীচের দিকে থাকত বলে কোন অসুবিধা হত না, দ্রুতই ভরে যেত। কখনো কখনো জ্ঞান ফিরে পেত আমার ভিকটিম। তবে অধিকাংশ সময়ই মৃত্যু হত নিশব্দে।
এরপর লাশের ব্যবস্থা করা। আসলে, রক্ত না থাকলে লাশের ব্যবস্থা করা খুব সহজ। বড় বড় সাত-আট টুকরা করে ফেললেই হল। তবে, আগে আপনাকে সেগুলোকে একেবারে হীমশীতল করে নিতে হবে। শরীর থেকে সব রক্ত বের করে নেয়া কখনোই সম্ভব না। তা টিভিতে বা মুভিতে যাই দেখাক না কেন।
তিন ফ্ল্যাটে তিনটি বড় বড় ডীপ ফ্রিজ কিনে রেখেছিলাম। রাতে লাশ গুলোকে রাখতাম সেখানে। ভোররাতের দিকে টুকরা করতাম। তিন ফ্ল্যাটেই একটা করে ঘর ছিল যাতে সব ফার্নিচার রাখা ছিল। প্লাষ্টিক দিয়ে মোড়ানো। সেখানেই কাজ সারতাম। প্লাষ্টিক বিছিয়ে। সময় লাগত, কিন্তু কাজ ত সারতে হবে, নাকি?
ফজরের আজান দিলে, বের হতাম টুকরাগুলোকে প্লাষ্টিকের কালো ব্যাগে ভরে। সকালে সাধারণত সব দারোয়ানই ঘুমিয়ে থাকে। চাবি কাছে থাকায় কোন অসুবিধা হত না। একদিনে হল হল, না হলে নাহয় দুই তিন দিনই লাগত। ইট বেঁধে সব ফেলে দিয়ে আসতাম নদীতে।
এভাবেই চালিয়ে আসছি গত ছয় মাস ধরে। সাধারণত মাসে একবার। স্পট অনেক হলেও, অগুণতি তো নয়। তবে, মাঝে মাঝে মাসে দুবারও যেতে হয়েছে। কি করব - ঐ যে বললাম, না ঘুমালে পাগল হয়ে যাব যে।
তিন
ঢাকা শহরে নতুন খুনির আবির্ভাব হয়েছে। হেডলাইন দেখে প্রথমে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ধরে ফেলল না তো। পরে বিস্তারিত খবর পরে বুঝলাম যে না। অন্য রকম খুনি। কেবল খুনের ধরণ এক দেখে বোঝা যায় যে খুনী একই ব্যক্তি। না হলে, খুন হওয়া চার জনের মাঝে মিল মাত্র একটিই - এরা সবাই পুরুষ। অবশ্য সেদিক দিয়ে চিন্তা করলে আরও মিল পাওয়া যাবে - সবাই ব্যবসায়ী, বিবাহিত, আর খুনের দিন ঘরে কেউ ছিল না। শেষটা স্বাভাবিক - ঘরে কেউ থাকলে কি আর খুনী খুন করে?
মিল নেই বলতে বুঝাচ্ছি, এই চারজনের মাঝে কোন ধরনের সরাসরি সম্পর্ক নেই। চারজনের কেউ কাউকে চেনে না। এমনকি এদের কোন কমন ব্যবসায়ী প্রতিদ্বন্দিও নেই যে, পুলিশ তাঁকে সন্দেহ করবে। সবাই নিজ নিজ ব্যবসায় প্রতিষ্ঠিত। নিজস্ব বাড়ী না থাকলেও ঢাকা শহরে, ফ্ল্যাট আছে। পরকীয়া জাতীয় ব্যাপার স্যাপারও ঘেঁটে দেখা হয়েছে। এই খবরটুকু পড়ে নিজেই হাসলাম। পুলিশের কি ধারণা, চারজনেরই গোপন প্রেম একই মেয়ের সাথে? পঞ্চম কেউ খুন করেছে? এই যুগে দ্রৌপদী?
এদিকে আমারও সময় হয়ে এসেছে। শেষ খুন করেছি প্রায় এক মাস হতে চলল। জলদিই নতুন শিকার ধরতে হবে। নাহলে আবার সেই নির্ঘুম রাতের মুখোমুখি হতে হবে। ঠিক করে ফেললাম, আজ কালের মাঝেই শিকারে বের হব।
***
আজ সেই রাত। আজ রাতে আমি আরাম করে ঘুমাব। বরাবরের মতই রাতের খাবার বাইরে খেয়ে ফিরছি। এবারের স্পট ঠিক করেছি মোহাম্মদপুর ভেরি বাঁধ। কয়েক মাস হয়ে গেল ওখানে যাই না। কাছেই সংসদ ভবন ছিল, কিন্তু দুই মাস আগের শিকারটাকে ওখান থেকেই তুলে নিয়েছি। তাই এবার ওখানে যাওয়া যাবে না।
মহাখালী থেকে বিজয় সরণী হয়ে মিরপুর রোডে ঢুকেছি, এমন সময় গাড়ীর হেডলাইটের আলোয় এক পতিতার উপর নজর পড়ল। কি বলব, পতিতারাও যে এত সুন্দর হতে পারে কে জানত? রাতের আলোতেই অপ্সরীর মত লাগছে। একেবারে খাঁটি বাংলা কবিতার নায়িকাদের মত - আয়ত চোখ, ফর্সা মুখ, কমলার মত ঠোঁট। উঁচু বুক আর দুধে আলতা গায়ের রঙ বাদই দিলাম। হাঁটার সাথে সাথে সুগঠিত নিতম্ব দোল খাচ্ছে। প্রথমেই সন্দেহ হল - আসলেই পতিতা তো? কিন্তু সময় আর উত্তেজক পোষাক-আষাক সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। ভুলে গেলাম আমার খুনের নেশা। ভুলে গেলাম আমার সব সময়ের প্রতিজ্ঞা - আর যাই কর না কেন, কখনো কোন বেশ্যার সাথে নয় - ভুলে গেলাম। ভাবলাম, আজ রাতে একে নিয়েই .....
মেয়েটার গায়ে হেডলাইটের আলো ফেলে পার হয়ে রাস্তার ধাঁরে পার্ক করলাম। অনেকদিন পর নিজের ভিতরে একধরনের উত্তেজনা অনুভব করলাম। নারী সঙ্গ আমার জন্য নতুন কিছু না। কিন্তু, এই মেয়েটিকে কেন যেন মাথা থেকে সরাতে পারছি না।
মেয়েটি ইঙ্গিত বুঝল। পতিতাদেরকে ঢাকার চিরন্তন ইঙ্গিত। কাছে এসে নক করল জানালায়। নামিয়ে দিলাম জানালা, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কত?’
‘রাতের জন্য তিনহাজার। আর জায়গা আমার দিতে হলে চার।’ সুরেলা কন্ঠ কানে ভেসে এল।
‘উঠে পড়।’ এমনিতে দ্বিগুণ চাইলেও, দেরি করতাম না।
আধা ঘন্টা পরে মেয়েটিকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম আমার ফ্ল্যাটে, পিছনের দরজা দিয়ে। আমার রুটিন মোতাবেক ওষুধ খাওয়ানো বাদ দিলাম। কারণ - এই মেয়েকে খুন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ঘরের আলোতে আরও অপরুপ লাগছিল দেখতে। যে কোন হাই ক্লাস সোসাইটির মেয়ে হিসেবে দারুণ মানিয়ে যাবে। অন্যসব পতিতাদের মত নয় - আলাদা। নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। চাকচিক্য দেখে মুগ্ধ হয়েছে কিনা, বোঝার কোন উপায় নেই। বসার ভঙ্গি আর নিজেকে যেভাবে কন্ট্রোলে রেখেছে, তাতে মনে হচ্ছে - এসবে সে অভ্যস্থ।
তবে হেড লাইটের আলোয় যা দেখিনি, এখন তা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। খুঁত। একেবারে নিখুঁত হলে মনে খচখচ করত, তাই খুঁতটি খুঁজে পেয়ে একটু শান্তি শান্তি লাগছে। বাম কানের লতি নেই। মনে হচ্ছে - কিছু একটা কামড় দিয়ে ছিড়ে নিয়েছে।
‘কি হয়েছিল?’ কানে দিকে ইঙ্গিত করে বললাম।
চমকে উঠে তাকাল আমার দিকে। ইতস্তত করে বলল, ‘একটি জানোয়ার কামড়ে নিয়েছে।’
যা ভেবেছিলাম, ছোটবেলায় কুকুর-টুকুরের কামড় খেয়েছিল হয়ত।
‘আপনি কি করেন?’ এবার আমার চমকানোর পালা। এমন বিশুদ্ধভাবে কোন পতিতাকে আগে কথা বলতে শুনি নি।
‘ডাক্তার।’
‘তাহলে... আমার মত মেয়েকে...’
হাসলাম শুধু। কেন বিয়ে করছি না - এ প্রশ্ন নতুন নয়। আমার যে মানসিক অবস্থা, তাতে আমার সাথে কাউকে না জড়ানোই ভালো। না, আমাকে বিয়ে করে কারও কপাল পুড়বে - এ চিন্তা থেকে বলছি না। বলছি, কারণ - খুন করার মত কাউকে না পেলে হয়ত...
‘হাসপাতাল থেকে এসেছি তো। খুব নোংরা লাগছে। শাওয়ার নিব। আসবে?’ বললাম।
‘আজ রাতের জন্য আপনার যা মন চাইবে, তাতেই আমি রাজি।’ হেসে বলল মেয়েটি। মুখে হাসি, কিন্তু তা চোখ স্পর্শ করতে পারে নি।
মাথা নেড়ে ইঙ্গিগতে শুধু বুঝিয়ে দিলাম - কোনদিকে যেতে হবে।
আমার পিছু পিছু বাথরুমে ঢুকে গেল মেয়েটি।
কাপড় খুলে ফেললাম আমরা। বেশী কিছু বলব না - কামনায় গায়ে যেন আগুন ধরে গেল।
হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে শাওয়ার নেয়া আমার প্রতিদিনের অভ্যাস। যে দিন খুন করি সেদিনও বাদ পরে না। সাধারণত নিজের হাতে সাথে নিয়ে আসা মেয়েদের গায়ে সাবান মাখিয়ে দিলেও, আজ সাহস হল না। ভয় হল - যদি সামলাতে না পারি।
তাড়াহুড়ো করে মাথায় শ্যাম্পু দিলাম। বেশী তাড়াহুড়ো করলে যা হয়, চোখে জ্বলুনি শুরু হয়ে গেল। ‘পানির মগটা দাও তো।’ বললাম মেয়েটিকে। পরক্ষণেই মনে হল - এতক্ষণেও নাম জিজ্ঞাসা করা হয় নি। যদিও জানি আসল নাম বলবে না। তাও জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আচ্ছা তোমার নাম কি?’
উত্তরটা শোনা হল না। তখন কি আর জানি মেয়েটার নাম আমার কোনদিনই জানা হবে না? মাথায় আঘাত পেয়ে সেখানেই লুটিয়ে পড়লাম।
চার
কতক্ষণপর জ্ঞান ফিরল জানি না। বেশীক্ষণ হবার কথা নয়। কিন্তু এরই মাঝে দেখি মেয়েটি আমাকে একটি চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখেছে। মুখে রুমাল খোঁজা। আসে পাশে তাকিয়ে বুঝলাম - যে ঘরে আমি আমার খুনগুলো করি সেখানেই আটকে রেখেছে। চেষ্টা করেও বাঁধন খুলতে ব্যর্থ হলাম। কিন্তু, মেয়েটিকে নজরে পড়ল না। ফাঁকা ঘর।
সে এলো আরও কিছুক্ষণ পর। হাতে একটি লম্বা ছুরি। বুঝলাম, এর জন্যই উধাও হয়ে গিয়েছিল সে। আমার কাছাকাছি এসে আরেকটি চেয়ার টেনে পায়ের উপর পা তুলে বসল। আধো আলোতে, হাতে ছুরি থাকা সত্ত্বেও সুন্দর লাগছে দেখতে।
‘কানের কথা জানতে চেয়েছিলে না? তোমারই মত এক জানোয়ার কামড়ে নিয়েছে।’ বলল সে।
আমি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকালাম।
‘তোমাদের হাই সোসাইটির ব্যাপার আমি বুঝি না। টাকা আছে, ঘর আছে। কারও কারও তো বউও আছে। তাও অন্য মেয়ে দেখলে নিজেদের সামলাতে পারনা কেন?’
হঠাৎ করে সব পরিষ্কার হয়ে এল। এই মেয়েটিই পত্রিকায় পড়া সেই চার জনের খুনী। কারো বাসায় লোক ছিল না। সেই সুযোগে, ঐ চার জনের প্রত্যেকেই বেশ্যা নিয়ে এসেছিল ঘরে। আর এই মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়ে তাদের সবাইকে খুন করেছে।
‘ভাবছ, আমি কেন এরকম?’ মেয়েটি বলল, ‘আমি তো সবসময় বেশ্যা ছিলাম না। আমার বাব ছা-পোষা মানুষ ছিলেন। অল্প বেতনের চাকরী করতেন। আমি তিন বোনের মাঝে মেঝ। আমাদের মা খুব সুন্দরী ছিলেন। আমাকে যে দেখছ, তা আমার মায়ের রূপের ছিটেফোঁটাও না। কলেজে পড়তাম। ভাল ছাত্রী ছিলাম। সরকারী বৃত্তির জন্য, ঢাকার বেশ নামকরা বেসরকারীতেই পড়তাম। নজরে পরে যাই - তোমাদের মত কুলাঙ্গার হাই সোসাইটি ছেলেদের। অনেক দিন প্রেমের প্রস্তাব পাঠাবার পরও কোন উত্তর দেই নি দেখে, একদিন তুলে নিয়ে যায় আমাকে। গণ ধর্ষনের শিকার হই আমি। কানের এই অবস্থাও হয় সেদিন।
এরপর সব গতানুগতিক। লেখাপড়া বন্ধ। আমার জন্য আমার বড় বোনটারও বিয়ে হচ্ছে না। আমার বিয়ের কথা তো বাদই দিলাম। প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজনের গঞ্জনা সইতে না পেরে দুই বার আত্মহত্যার চেষ্টা চালাই। পারি নি। এরই মাঝে হটাৎ করে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায়। আচমকা। দুলাভাইকে আমরা সবাই ত্রাণকর্তা মনে করি। বিয়ের কয়েকমাস পড়, আমার বড় বোন আমাকে নিয়ে যায় ওর কাছে।
একমাস সব ঠিকভাবেই চলে। একদিন ওর শ্বাশুড়ি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ায়, দুলাভাই আর আমি বাসায় থেকে যাই। আমি চাচ্ছিলাম না। বারবার বলেছিলাম যেন আমাকেও হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু শোনেনি। সেই রাতেই আমার ধর্ষিত হই আমি।
বড় বোন বাসায় ফিরে এলেও এসব থামে না। দিনের পর দিন আমাকে ধর্ষণ করে যায় জানোয়ারটা। একদিন সইতে না পেরে পালিয়ে আসি লোকটাকে খুন করে। কপালকে মেনে নেই। হয়ে যায় পেশাদার।
প্রথম প্রথম বেশী মাথা ঘামাতাম না। ভাড়া খাটছি, কার সাথে বিছানায় যাচ্ছি তা দেখার কি দরকার? কিন্তু যখন দেখলাম - এদের অধিকাংশই হাই সোসাইটির। ঘরে বউ থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়েমানুষ নিয়ে ব্যস্ত। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ফলাফল...’ হাতের ছুরির দিকে ইঙ্গিত করল সে।
‘প্রথমে তোমাকে আলাদা ভেবেছিলাম। পরে দেখলাম, তুমিও একই ঝাঁকের মাছ। আসলে তোমরা জাত হারামীই। সব এক।’ হাতের ছুড়িটা বাগিয়ে এল আমার দিকে।
চীৎকার করে বলতে চাইলাম - আমি আর সবার মত না। বলতে চাইলাম, আমি আলাদা। হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছি। বয় স্কাউট ছিলাম কিনা। চাইলেই কাবু করে ফেলতে পারতাম মেয়েটিকে। একবার ভাবলামও।
কিন্তু মনে হল, কি দরকার? অনেক তো হল। অনেক দিন হল ঘুমাই না। কি দরকার?
চুপচাপ বসে তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির দিকে।
(বি.দ্র.-রহস্য পত্রিকায় প্রকাশিত)
©somewhere in net ltd.