![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দ্য অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ঈজিপশিয়ান টম্ব
মুলঃ আগাথা ক্রিস্টি
রূপান্তরঃ মোঃ ফুয়াদ আল ফিদাহ
এক
পোয়ারোর সাথে অনেকগুলো রোমাঞ্চকর আর নাটকীয় অভিযানে সঙ্গী হয়েছি আমি। সেই সব অভিযানের মাঝে একটির কথা আমার আজও মনে পড়ে, গা শিহরিয়ে ওঠে। ফারাও মেন-হার-রা এর সমাধি আবিষ্কার আর তা উন্মুক্ত হবার পর ঘটে যাওয়া একের পর এক খুনের রহস্যের অনুসন্ধান করার অভিজ্ঞতাটা আজও ভুলতে পারি নি।
লর্ড ক্যারনারভন, স্যার জন উইলার্ড আর নিউ ইয়র্কের মি. ব্লেইবনারের তুতানখ-আমেনের সমাধি আবিষ্কারের কথা কার না জানা আছে! কায়রোতে অবস্থিত গিজার পিরামিডের কাছেই খনন কার্য চালাচ্ছিলেন তাঁরা। হঠাৎ এক অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করে বসেন। আবিষ্কার করেন, সারি বাঁধা অনেকগুলো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কক্ষ। চারিদিকে সারা ফেলে দিয়েছিলেন তাঁরা এই আবিষ্কারের মাধ্যমে। অষ্টম রাজবংশের প্রায় অপরিচিত ফারাও মেন-হার-রা এর কবর বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল ঐ সমাধিকে। এই ফারাও বা তাঁর রাজত্বের সময়কালের ব্যাপারে খুব বেশী কিছু এখনও জানা যায় নি। তাই আবিষ্কারটা খবরের কাগজ অনেকদিন গরম করে রেখেছিল।
এই আবিষ্কারের খবর ঠাণ্ডা না হতেই আরেকটা খবর জনগনকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল-স্যার জন উইলার্ড হার্ট ফেইলরের কারণে আচমকা মারা গেলেন।
খবরের কাগজগুলো ওঁত পেতেই ছিল। মিশরীয় গুপ্তধন যে মন্দ ভাগ্য বয়ে নিয়ে আসে, তা ফলাও করে ছাপা শুরু হল। যত ধরণের কুসংস্কার আর গাল গপ্পো চালু ছিল এ ব্যাপারে, পত্রিকাগুলো সব ছাপা শুরু করল এক এক করে। ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অবস্থিত মন্দ ভাগ্য মমি এতদিন বিস্মৃত হয়ে ছিল। কিন্তু এবার চলে এলো সবার সামনে।
এর মাত্র দুই সপ্তাহ পর মারা গেলেন মি. ব্লেইবনার, তাও বিষাক্ত রক্তের কারণে। তারও মাত্র দিন কয়েক পর ভদ্রলোকের ভাগ্নে নিউ ইয়র্কেই আত্মহত্যা করল নিজের মাথায় গুলি করে। লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল ফারাও মেন-হার-রা এর অভিশাপের গল্প, জীবন ফিরে পেল অনেক আগেই গত হওয়া মিশরীয় আর তাদের অদ্ভুত জাদুর গল্পগুলো।
ঠিক এমন সময়, প্রয়াত লর্ড উইলার্ডের স্ত্রী লেডী উইলার্ড পোয়ারোকে একটা চিঠি লিখলেন। অনুরোধ করলেন, যেন সে দয়া করে ভদ্রমহিলার বাড়ি কেনসিংটন স্কয়ারে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করে। বলা বাহুল্য, আমিও পোয়ারের সাথে গেলাম।
লেডী উইলার্ড বেশ লম্বা আর চিকন স্বাস্থ্যের অধিকারী, পরনে শোকের পোশাক। মলিন চেহারা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে তিনি স্বামীর মৃত্যুতে কতটা আঘাত পেয়েছেন।
‘‘এত দ্রুত আসার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, মশিয়ে পোয়ারো।’’
‘‘এ তো আমার কর্তব্য, লেডী উইলার্ড। দয়া করে বলুন, এই অধম আপনাকে কিভাবে সাহায্য করতে পারে?’’
‘‘আমার জানামতে আপনি একজন গোয়েন্দা। কিন্তু শুধু সে জন্যই আমি আপনার পরামর্শ চাই ভাবলে ভুল হবে। আমি জানি আপনি অনেক কিছু দেখেছেন, শুনেছেন। জানি যে আপনার দুনিয়ার হাল চাল স¤পর্কে বেশ ভালই ধারণা আছে, আর মাথাটাকে খাটাতেও খুব পছন্দ করেন। আচ্ছা মশিয়ে পোয়ারো, বলুন তো অতিপ্রাকৃতের ব্যাপারে আপনার কি ধারণা?’’
উত্তর দেবার আগে একটু ইতস্তত করল পোয়ারো, যেন মনে মনে কোন হিসাব কষছে। অবশেষে বলল, ‘আমি চাই না আমাদের আলোচনার মাঝে ভুল বোঝাবুঝির কোন অবকাশ থাকুক, লেডী উইলার্ড। আপনি অতিপ্রাকৃতের ব্যাপারে আমার মত জানতে চাইছেন না। সম্ভবত ব্যাপারটার সাথে কোন ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে। সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি আসলে আপনার মৃত স্বামীর ব্যাপারটা বোঝাতে চাইছেন?’’
‘‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।’’ লেডী উইলার্ড স্বীকার করলেন।
‘‘আপনি কি চান যে আমি তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা খতিয়ে দেখি?’’
‘‘আমি চাই আপনি খুঁজে বের করুন যে, পত্র পত্রিকায় যা ছাপা হয়েছে তার কতটা উড়ো গুজব, আর কতটা সত্য। একটা, দুটো নয়...তিন তিনটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। আলাদা আলাদাভাবে, তিনটা মৃত্যুই সহজে ব্যাখ্যা করা যায়। কিন্তু, একের পর এক এরকম তিনটা মৃত্যু আর যাই হোক কাকতালীয় বলে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। তাও কিনা সমাধি খুলে দেবার মাত্র এক মাসের মাথায়! হতে পারে ব্যাপারটা শুধুই কুসংস্কার, আবার এমনও তো হতে পারে যে, আসলেই কোন প্রাচীন অভিশাপ আছে। যেটা আধুনিক বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করতে অক্ষম, এমন কোন উপায়ে কাজ করে চলছে। সে যাই হোক না কেন, তিনটা মৃত্যুকে তো আর হেসে উড়িয়ে দেয়া যায় না! আমি ভয় পাচ্ছি মশিয়ে পোয়ারো, খুব ভয় পাচ্ছি। হয়ত... হয়ত আরও খুনের ঘটনা ঘটবে।’’
‘‘কার জন্য ভয় পাচ্ছেন?’’
‘‘আমার ছেলেকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি। আমার স্বামীর মৃত্যুর খবর যখন পাই, তখন আমি অসুস্থ। আমার ছেলে তখন কেবলমাত্র অক্সফোর্ড থেকে এসেছিল। খবর শুনে সে মিশরে যায়-মরদেহ নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু এখন আবার ওখানে গিয়েছে। আমার হাজারো অনুরোধ-উপরোধ কানেই তোলে নি। ওর বাবার কাজ দেখে সে এতটাই মুগ্ধ হয়েছে যে, নিজেই এখন খননকার্য চালিয়ে নিতে চাইছে। হয়ত, আপনার কাছে আমাকে মনে হবে বোকা আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মেয়ে মানুষ, কিন্তু মশিয়ে পোয়ারো আমি আমার ছেলের জন্য চিন্তিত। মনে হচ্ছে, হয়ত এখনও ঐ ফারাও এর আত্মা তৃপ্ত হয় নি। কি সব আবোল তাবোল বকছি, কিন্তু তাও-’’
‘‘না, লেডী উইলার্ড।’’ পোয়ারো দ্রুত বলে উঠল, ‘‘আমি মনে করি কুসংস্কারের শক্তি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শক্তিদের মধ্যে একটি।’’
অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। পোয়ারো আর কুসংস্কার! কোনভাবেই মেলানো যায় না। কিন্তু ছোটো খাটো মানুষটাকে দেখে মনে হল একে বারে হৃদয় থেকে কথাটা বলেছে।
‘‘মনে হয় আপনি চাচ্ছেন, আমি আপনার ছেলেকে রক্ষা করি। আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই করব।’’
‘‘বিপদটা যদি জাগতিক হত, তাহলে কোন চিন্তাই হত না। কিন্তু অতিপ্রাকৃতের হাত থেকেও কি পারবেন?’’
‘‘লেডী উইলার্ড, মধ্য যুগের বিভিন্ন বই ঘাঁটলে দেখতে পাবেন, কালো জাদুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার অনেক পন্থা আছে। হয়ত আমরা আমাদের আধুনিক বিজ্ঞান দিয়ে যে সব জিনিস ব্যাখ্যা করতে পারি না, সেসব জিনিস ওদের কাছে ছিল একেবারেই সহজ সরল। যাই হোক আগে কিছু কাজের কথা সেরে নেই, যেন ব্যাপারটা নিয়ে আমার একটা সম্যক ধারণ হয়ে। আপনার স্বামী তো একজন নিবেদিত মিশরীয়বিদ, তাই না?’
‘‘হ্যাঁ, যৌবনকাল থেকেই। এমনকি এ ব্যাপারে সে ছিল একজন প্রথম শ্রেণীর বিশেষজ্ঞ।’’
‘‘কিন্তু, আমার জানামতে, মি. ব্লেইবনার এ ব্যাপারে একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন তাই না?’’
‘‘হ্যাঁ। তাঁর পয়সা কড়ির অভাব ছিল না। যখন যেটা মনে ধরত, তখন তাতে উদার হাতে পয়সা ঢালতেন। আমার স্বামী তাঁকে মিশরের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছিলেন। মি. ব্লেইবনারের টাকা দিয়েই আসলে খনন কার্যের ব্যয় নির্বাহ হচ্ছিল।’’
‘‘আর তাঁর ভাগ্নে? ভাগ্নের রুচির ব্যাপারে কি আপনার কিছু জানা আছে? সেও কি মিশরের ব্যাপারে আগ্রহী ছিল?’’
‘‘আমার মনে হয় না। সত্যি বলতে কি, খবরের কাগজে সংবাদটা পড়ার আগে, আমি এই ভাগ্নের অস্তিত্বের ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। আমার মনে হয় না, মি. ব্লেইবনার আর তাঁর ভাগ্নের মাঝে সুস¤পর্ক ছিল। মি. ব্লেইবনারের মুখে কোন দিন তাঁর কোন আত্মীয়ের কথা শুনেছি বলে মনে পড়ছে না।’’
‘‘খনন কার্যের দলে আর কে কে আছে?’
‘‘উম... ব্রিটিশ মিউজিয়ামের একজন পেটি কর্মকর্তা ড. টসউইল, নিউ ইয়র্কের মেট্রোপলিটান মিউজিয়ামের মি. øাইডার, এক কমবয়সী আমেরিকান সেক্রেটারি আর ডা. অ্যামেস। এছাড়াও ছিল হাসান- আমার স্বামীর খুব অনুগত স্থানীয় ভৃত্য।’’
‘‘আমেরিকান ছেলেটার নাম মনে আছে কি?’’
‘‘যতদূর মনে পরে, ছেলেটার নাম হল হার্পার। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই। তবে এতটুকু জানি যে, সে খুব বেশী দিন হল মি. ব্লেইবনারের সাথে যোগ দেয় নি। বেশ অমায়িক আর আমুদে যুবক।’’
‘‘অনেক ধন্যবাদ লেডী উইলার্ড।’’
‘‘যদি আর কোন তথ্যের প্রয়োজন হয়-’’
‘‘এই মুহূর্তে আর কোন কিছুর দরকার নেই। ব্যাপারটা এবার আমার হাতে ছেড়ে দিন। নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমি আমার ক্ষমতার সর্বোচ্চটা খাটিয়ে আপনার ছেলেকে নিরাপদে রাখব।’’
পোয়ারোর কথাটা শুনে লেডী উইলার্ড যে খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারেন নি, তা তাঁর মুখ কোঁচকানো দেখেই বোঝা গেল। তবে পোয়ারো যে তাঁর ভয়টাকে অমূলক বলে হেসে উড়িয়ে দেয় নি, তাতেই তিনি খুশী।
তবে আমার কথা আলাদা। আমি কখনো ভাবিই নি যে, পোয়ারো কুসংষ্কারের মত একটা ব্যাপারে বিশ্বাস রাখতে পারে। ওর স্বভাবের সাথে ব্যাপারটা একেবারেই খাপ খায় না। বাড়ির দিকে যাবার সময় তাই চেপে ধরলাম ওকে। খুব আন্তরিকতা আর গাম্ভীর্যের সাথে আমার প্রশ্নের জবাব দিল সে, ‘ওহ, হেস্টিংস। আমি আসলেই এসব জিনিস বিশ্বাস করি। কেননা, কুসংষ্কারের শক্তিকে খাটো করে দেখাটা হবে অনেক বড় বোকামি?’’
‘‘তা, এখন আমরা কি করতে যাচ্ছি জানতে পারি?’’
‘‘আহ, আমাদের সদা সর্তক হেস্টিংস! ভাল ভাল। তোমার প্রশ্নের উত্তরে বলি, সবার আগে আমরা তরুণ মি. ব্লেইবনারের মৃত্যুর ব্যাপারে আরও তথ্য চেয়ে নিউ ইয়র্কে তার পাঠাব।’’
যেই কথা সেই কাজ। তার পাঠিয়ে দিল পোয়ারো, উত্তর পেতেও বেশী সময় লাগল না। একেবারে বিস্তারিত আর যথাযথ উত্তর এলো। তরুণ রূপার্ট ব্লেইবনার বেশ কিছু বছর হল অনটনে দিন কাটাচ্ছিল। দক্ষিণ সাগরের বেশ কিছু দ্বীপে সে বেশ কিছু বছর কাটিয়ে এসেছে। ওখানে সে সৈকতে দামী কিছু পাওয়া যায় কিনা, সেই অনুসন্ধানে নিয়োজিত ছিল। হুন্ডি ব্যবসাও করত। বছর দুই আগে ফিরে এসেছিল নিউ ইয়র্কে। এখানে এসে দেনায় আরও ডুবে গিয়েছিল। তবে আমার মতে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যটা আমরা পেয়েছি তা হল, অল্প কিছু দিন আগে সে মিশরে যাবার মত টাকা কারও কাছ থেকে ধার করতে সক্ষম হয়ে ছিল। ‘‘ওখানে আমার একজন খুব ভাল বন্ধু আছে, যার কাছ থেকে আমি টাকা ধার করতে পারি।’’- ঘোষণা করেছিল সে সময়। তবে আফসোসের কথা হল, ওর পরিকল্পনা কাজে লাগে নি। নিজের হাড়কঞ্জুস চাচাকে গাল বকতে বকতে নিউ ইয়র্কে ফিরতে হয়েছিল ওকে। সে সবাইকে জানায়, ওর চাচা নিজের রক্ত মাংসের আত্মীয়ের চেয়ে মৃত রাজার হাড় গোড়কেই বেশী ভালবাসে। মিশরে কাটানো ওর স্বল্প সময়ের মাঝেই স্যার জন উইলার্ড মারা যান। নিউ ইয়র্কে ফিরে আবার সেই উড়নচণ্ডী জীবনে ফিরে যায় রূপার্ট। অবশেষে, কাউকে কোন কিছু আঁচ করতে না দিয়ে, আত্মহত্যা করে বসে সে। সুইসাইড নোটও লিখে যায়। তবে ওতে লেখা বাক্য গুলো কেমন যেন অদ্ভুত, কিছু কিছু শব্দ অত্যন্ত কৌতূহল উদ্দীপক। নোটটা পড়লে মনে হয়, লেখক যেন খুব অনুশোচনায় ভুগছিল। নিজেকে কুষ্ঠ রোগীর মত নির্বাসিত একজন বলে অভিহিত করে সে। একেবারে শেষে ঘোষণা দেয়ার মত করে বলে, তার মত লোকের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভাল।
চিঠিটা পড়েই মাথায় যেন একটা থিওরি খেলে গেল। আমি আসলে কখনোই বহু আগে মারা যাওয়া মিশরীয় ফারাও এর অভিশাপ বিশ্বাস করতে পারি নি। তাই, আমার মনে হল- তিনটা মৃত্যুর জন্য দায়ী আধুনিক কোন অপরাধ। ধরা যাক, এই যুবক সিদ্ধান্ত নেয় যে ওর চাচাকে খুন করবে- বিষ প্রয়োগে খুন করার সিদ্ধান্ত নেয়ার সম্ভাবনাই বেশী। কিন্তু ভুলক্রমে বিষটা পান করেন স্যার জন উইলার্ড। কৃত অপরাধের অনুশোচনা করতে করতে নিউ ইয়র্কে ফিরে আসে রুপার্ট। এখানে এসে শুনতে পায় চাচার মৃত্যু সংবাদ। বুঝতে পারে, ওর করা অপরাধের কোন প্রয়োজনই ছিল না। তাই, অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করে বসে।
পোয়ারোকে শোনালাম আমার থিওরি। দেখে মনে হল, ওর মনে ধরেছে।
‘‘খুব বুদ্ধিমানের মত চিন্তা করেছ- অবশ্যই কৌশলী। সত্য হলেও হতে পারে। কিন্তু সমাধির ভয়ংকর প্রভাবের কথা তুমি বাদ দিয়ে গিয়েছ, বন্ধু।’’
শ্রাগ করলাম, ‘‘তোমার কি আসলেই মনে হয় যে, ঐ সমাধির এতে কোন ভূমিকা আছে?’’
‘‘অবশ্যই, বন্ধু আমার, আমরা কালকেই মিশরে যাচ্ছি।’’
‘‘কি?’’ অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠলাম।
‘‘ঠিকই শুনেছ।’’ পোয়ারোর মুখে একধরণের ঔজ্জ্বল্য খেলা করে গেল। কিন্তু পরক্ষণেই গুঙিয়ে উঠল সে, ‘‘কিন্তু,’’ আফসোসের সাথে বলল সে, ‘‘সমুদ্র! আর সমুদ্র যাত্রা!’’
দুই
এক সপ্তাহ পরের কথা। এই মুহূর্তে আমাদের পায়ের নিচে আছে মরুভূমির সোনালী বালি। মাথার উপরে সূর্য যেন অনল বর্ষণ করছে। বিধ্বস্ত পোয়ারো টলতে টলতে চলছে আমার পাশে। ছোটো খাটো মানুষটা ভ্রমণ একেবারেই সহ্য করতে পারে না। মার্সেই থেকে শুরু হওয়া আমাদের চার দিনের ভ্রমণটা ওকে একেবারে ক্লান্ত করে ফেলেছে। আলেক্সান্ড্রিয়ায় নামার পর ওকে দেখে চেনাই যাচ্ছিল না। এমনকি ওর স্বভাব সুলভ পরিছন্নতাও যেন উধাও হয়ে গিয়েছে। কায়রো পৌঁছে আর এক মুহূর্তও দেরী না করে আমরা চলে এসেছিলাম মিনা হাউজ হোটেলে। হোটেলটা পিরামিডের একেবারে কোল ঘেঁষে অবস্থিত।
মিশরের সৌন্দর্য আমাকে অভিভূত করে ফেলেছে। কিন্তু পোয়ারকে পারে নি। লন্ডনে যে পোশাক পড়ে থাকে, এখানেও তাই পড়ে আছে। পকেটে শোভা পাচ্ছে কাপড় ঝাড়ার একটা ছোট ব্রাশ। মরুভূমির দেশ, তাই ধুলো বালির বিরুদ্ধে ওর এই যুদ্ধ যে অসম, তা মানতেই হবে।
‘‘আর আমার বুট,’’ বিলাপ করল সে, ‘‘একবার খালি আমার বুটের অবস্থাটা দেখ। কি সুন্দর আর বিশেষ ধরণের চামড়ায় বানানো ওগুলো, তা তো জানোই। এমন চকচক করে যে মনে হয় চেহারা দেখা যাবে! আর এখন! ভেতরে বালি জমেছে, ব্যথা পাচ্ছি। আর বাইরের কথা কি বলল, চোখের বিরুদ্ধে যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গরমের কথা আর কি বলব! আমার গোঁফের দিকে তাকাও। কেমন জানি নিস্প্রভ আর নেতিয়ে পড়েছে!’’
‘‘ওসব না দেখে স্ফিংসটা দেখ।’’ আমি অনুরোধ করলাম, ‘আমার মত বেরসিক মানুষও ওই জিনিসের প্রেমে পরে গিয়েছে।’’
পোয়ারো অসন্তুষ্ট চেহারায় আমার ইঙ্গিত করা স্ফিংসের দিকে তাকাল।
‘‘কিন্তু বাতাস ঐ জিনিসের প্রেমে পড়ে নি।’’ ঘোষণা করল যেন, ‘‘কিভাবে পড়বে? জিনিসটার অর্ধেক বালিতে পোঁতা, তাও আবার কেমন অগোছালো ভাবে। আহ, এই অভিশপ্ত বালি যদি না থাকত!’’
‘‘ওভাবে বলছ কেন? বেলজিয়ামে কি বালি নেই?’’ আমি ওকে মনে করিয়ে দিলাম। একবার ছুটি কাটিয়েছিলাম নকে-সার-মার এ। গাইড বইয়ে জায়গাটাকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘‘অনবদ্য বালিয়াড়ি’’ বলে।
‘‘কিন্তু ব্রাসেলসে বালি নেই।’’ পোয়ারো পাল্টা জবাব দিল। চিন্তিত ভাবে তাকাল পিরামিডের দিকে। ‘‘মানতেই হবে যে ঐ পিরামিড গুলোর আকারে জ্যামিতিকভাবে কোন ভুল নেই, কিন্তু তল গুলো অমসৃণ আর দৃষ্টিকটু। তাল গাছ গুলোও আমার পছন্দ হয় নি। এমনকি সারি বদ্ধভাবেও সাজায় নি।’’
ওর বিলাপ থামাবার জন্যই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেললাম। বললাম, আমাদের ক্যাম্পের দিকে এগোনো উচিৎ। উটের পিঠে চড়ে ক্যাম্পে আমাদের যেতে হবে। প্রাণীগুলোকে দেখতে পেলাম হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকা অবস্থায়, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেই সাথে আছে বেশ কয়েকজন বালক, এদের দলপতি আবার দোভাষী।
পোয়ারোর উঠের পিঠে চড়ার বর্ণনা না হয় বাদই দিলাম। শুধু এত টুকু বলি, পুরো রাস্তা জুড়ে ওর বিলাপ আর চিৎকার শুনতে শুনতে আসতে হয়েছে। সেই সাথে কুমারী মাতা মেরী আর ক্যালেন্ডারে উল্লিখিত সব গুলো সাধু সন্তের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা তো আছেই। অবশেষে সইতে না পেরে কোন ক্রমে হাচড়ে পাঁচরে নামল উঠের পিঠ থেকে, যাত্রাটা শেষ করল একটা খুব ছোট গাধার পিঠে চড়ে। তবে স্বীকার করতেই হবে, অনভিজ্ঞদের জন্য উঠের পিঠে চলাটা বেশ কঠিন। আমিও পরের কয়েকদিন ব্যথার চোটে আড়ষ্ট ছিলাম।
বেশ অনেকক্ষণ পর, খনন কার্যের কাছে এসে পৌছালাম আমরা। রোদে পোড়া, ধূসর দাঁড়ির সাদা পোশাক পরিহিত এক লোক এগিয়ে এসে আমাদের সাথে দেখা করল।
‘‘মশিয়ে পোয়ারো আর ক্যাপ্টেন হেস্টিংস? আপনাদের আসার সংবাদ আগেই পেয়েছি। আমি দুঃখিত যে কায়রোতে আপনাদের সাথে দেখা করার জন্য কাউকে পাঠাতে পারি নি। এক দুর্ঘটনা ঘটায়, আমাদের সব পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।’’
পোয়ারো ভয়ে সাদা হয়ে গেল। ওর হাতটা সেই মুহূর্তে কাপড় পরিষ্কার করার ব্রাশের দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু কথাটা শুনে থেমে গেল, ‘‘আরেকটা মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি তো?’’ জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে জিজ্ঞাসা করল সে।
‘‘ঘটেছে।’’
‘‘কার? স্যার গাই উইলার্ডের?’’ আমি চিৎকার করে বললাম
‘‘না, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস। আমার আমেরিকান সহকর্মী মি. স্নাইডার।’’
‘‘কারণ জানা গিয়েছে?’’ পোয়ারো জানতে চাইল।
‘‘টিটেনাস।’’
এবার আমার সাদা হবার পালা। মনে হচ্ছিল আমাকে যেন অশুভ কিছু একটা তার নাগপাশে জড়িয়ে ধরেছে। ধীর কিন্তু নিশ্চিন্ত পায়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। ভয়াবহ একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়- আমি যদি পরবর্তী শিকার হই?
‘‘হায় খোদা,’’ নিচু, প্রায় অনুচ্চ স্বরে বলল পোয়ারো। ‘কিছুই বুঝতে পারছি না। ভয়াবহ ব্যাপার। আমাকে একটু বলুন তো মশিয়ে, মৃত্যুর কারণ যে টিটেনাস সে ব্যাপারে কি আপনারা নিশ্চিত?’’
‘‘আমার সন্দেহ আছে। কিন্তু ডা অ্যামেস আমার চেয়ে ভাল বলতে পারবেন।’’
‘‘তা তো বটেই। আপনি তো আর চিকিৎসক নন।’’
‘‘জি, আমি টসউইল।’’
বুঝতে পারলাম, আমার সামনে দাঁড়ানো লোকটি লেডী উইলার্ড কর্তৃক বর্ণিত ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সেই পেটি কর্মকর্তা। লোকটার মধ্যকার ভারিক্কী ভাব আর দৃঢ়তা আমাকে কেন যেন আকর্ষণ করল।
‘‘দয়া করে আমার সাথে আসুন। আমি আপনাদেরকে স্যার গাই উইলার্ডের কাছে নিয়ে যেতে চাই। তিনি আগেই বলে রেখেছেন, আপনারা উপস্থিত হবার সাথে সাথে যেন তাঁকে জানানো হয়।’’
ক্যা¤েপর অপর মাথায় অবস্থিত এক বড় তাঁবুতে নিয়ে যাওয়া হল আমাদের। ড. টসউইল তাঁবুর ঢাকনি তুলে ধরলে, আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে তিন জন পুরুষ বসা ছিল।
‘‘স্যার গাই, মশিয়ে পোয়ারো ও ক্যাপ্টেন হেস্টিংস এসে উপস্থিত হয়েছেন।’’ টসউইল বললেন।
উপস্থিত তিন জনের সবচেয়ে কম বয়সী পুরুষ লাফ দিয়ে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে আমাদেরকে সম্ভাষণ জানালেন। তাঁর আবেগ প্রবণতা আমাকে লেডী উইলার্ডের কথা মনে করিয়ে দিল। অন্যদের তুলনায় চামড়াটা এখনও ফ্যাকাসে, রোদে পুড়ে বাদামী হয় নি। এই ব্যাপারটা আর চোখের চারপাশে জমে যাওয়া কালি দেখে ওকে বাইশ বছরের যুবক বলে মনে হয় না। দেখেই বোঝা যায় তীব্র মানসিক চাপ ছেলেটাকে বুড়িয়ে দিচ্ছে।
উপস্থিত অন্য দুজনের সাথে আমাদেরকে পরিচিত করিয়ে দিল সে। ডা. অ্যামেসের বয়স ত্রিশের একটু বেশী হবে, বেশ শক্ত পোক্ত আর নিজের কাজে দক্ষ বলে মনে হল তাঁকে। চুলে পাক ধরেছে। অন্য জন হলেন সেক্রেটারি মি. হার্পার। চেহারায় বেশ সুন্দর, চোখে পরে আছে পশুর শিং দিয়ে বানানো ফ্রেম ওয়ালা চশমা।
অল্প কিছুক্ষণ এদিক ওদিককার কথা বলার পর, হার্পার বের হয়ে গেল, ড. টসউইলও তার পিছু নিলেন। আমাদের সাথে রইলেন শুধু স্যার গাই আর ডা. অ্যামেস।
‘‘আপনার ইচ্ছা মত প্রশ্ন করতে পারেন, মশিয়ে পোয়ারো।’’ উইলার্ড বললেন, ‘‘এই অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনাগুলি আমাদেরকে হতভম্ব করে দিয়েছে। কিন্তু অভিশাপ সত্য হতে পারে না- তাই না? এগুলো আসলে কাকতালীয় ঘটনা ছাড়া আর কিছুই না, কি বলেন?’’
নার্ভাস ভঙ্গিতে বলা কথাগুলো যে সে নিজেই বিশ্বাস করে না, সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। পোয়ারোকে দেখে মনে হল, উইলার্ডের প্রতিক্রিয়া খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে সে।
‘‘স্যার গাই, বলুন তো-আপনি আসলেই অন্তর থেকে এই কাজটা করছেন?’’
‘‘নিঃসন্দেহে। যাই ঘটুক না কেন, বা ফলাফল যাই হোক না কেন, কাজ চলবেই। এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ রাখবেন না যেন।’’
পোয়ারো এবার অন্য জনের দিকে ফিরলেন, ‘‘আর আপনার কি মত, মশিয়ে ডাক্তার?’’
‘হুম...’’ আলস্য ভরা কণ্ঠে জবাব দিলেন ডাক্তার, ‘‘আমি হাল ছাড়ছি না।’
পোয়ারো তাঁর সেই চির চেনা ভঙ্গিতে নাক কোঁচকাল।
‘‘তাহলে তো সব পরিষ্কার হয়ে গেল। এখন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখার সময়। আচ্ছা, মি. স্নাইডার কবে মারা গিয়েছেন?’’
‘‘তিন দিন হল।’’
‘‘আর, আপনারা নিশ্চিত যে কারণটা টিটেনাস?’’
‘‘একেবারে নিঃসন্দেহ।’’
‘‘স্ট্রিকনিন পয়জনিং বা এই জাতীয় কিছু হতে পারে না?’’
‘‘না, মশিয়ে পোয়ারো। বুঝতে পারছি, আপনি কি বলতে চাইছেন। কিন্তু এটা যে টিটেনাস, তা নিয়ে আমার কোন সন্দেহই নেই।’’
‘‘অ্যান্টি সেরাম (টিটেনাসের ওষুধ) দিয়েছিলেন?’’
‘‘অবশ্যই,’’ ডাক্তার বিরক্ত গলায় বলায়,‘‘আমাদের দ্বারা যতটুকু সম্ভব করেছি।’’
‘‘আপনার সাথে কি অ্যান্টি সেরাম আগে থেকেই ছিল?’’
‘‘নাহ, কায়রো থেকে আনাতে হয়েছে।’’
‘‘ক্যা¤েপ টিটেনাসের আক্রমণ কি আগেও হয়েছে বা আক্রান্ত কেউ এখন আছে?’’
‘‘নাহ, একটাও হয় নি বা নেই।’’
‘‘আচ্ছা, আপনারা কি নিশ্চিত যে মি. ব্লেইবনারের মৃত্যু টিটেনাসের জন্য হয় নি?’’’
‘‘এরচেয়ে বেশী নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না। ভদ্রলোকের হাতের আঙুলে আঁচড় লেগেছিল, সেখানে ক্ষত হয়। পরে জায়গাটায় বিষ ক্রিয়া শুরু হয়ে ছড়িয়ে পরে। সাধারণ মানুষের চোখে হয়ত দুটো ঘটনার মাঝে কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হবে না, কিন্তু আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিয়ে বলছি মি. ব্লেইবনার টিটেনাসে মারা যান নি।’’
‘‘তাহলে আমাদের হাতে মোট চারটি খুনের ঘটনা আছে, যার একটার সাথে আরেকটার বিন্দুমাত্র মিল নেই-একটা হার্ট ফেইলরের জন্য, একটা রক্তে বিষক্রিয়া, একটা আত্মহত্যা আর একটা টিটেনাস।’’
‘‘ঠিক বলেছেন, মশিয়ে পোয়ারো।’’
‘‘আচ্ছা এই চারটা ঘটনার মাঝে কি কোনই যোগসূত্র নেই?’’
‘‘আপনার প্রশ্নটা বুঝতে পারি নি?’’
‘‘সরাসরিই বলি। এই চার জন কি এমন কোন কাজে জড়িত ছিলেন, যা মেন-হার-রা এর প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে বলে ধরা যায়?’’
ডাক্তার অবাক হয়ে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
‘‘আপনি অবুঝের মত কথা বলছেন কেন, মশিয়ে পোয়ারো? নাকি আপনিও ওসব ছেলে ভুলানো গাল গপ্পো বিশ্বাস করে বসে আছেন?’’
‘‘একেবারেই বাজে রটনা।’’ রাগে বিড়বিড় করে বলল উইলার্ড।
পোয়ারো একেবারে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, বিড়ালের চোখের মত চোখ দুটোর নড়াচড়া ছাড়া ওর দেহের আর একটা অংশও নড়ছে না।
‘‘তার মানে, আপনি এসব ‘‘গাল গপ্পো’’ একেবারেই বিশ্বাস করেন না।’’
‘‘জি না জনাব, করি না।’’ ডাক্তার সাহেব জোর দিয়ে বললেন, ‘‘আমি বিজ্ঞানের লোক। আমি শুধু তাই বিশ্বাস করি যা বিজ্ঞান সমর্থন করে।’’
‘‘প্রাচীন মিশরে কি বিজ্ঞানের কোন ছোঁয়াই ছিল না?’’ পোয়ারো নরম গলায় জিজ্ঞাসা করল। উত্তরের অপেক্ষা করল না সে। করলেও সাথে সাথে পেত বলে মনে হয় না, কারণ ডাক্তারকে দেখে মনে হল, কি বলবেন তা বুঝে পাচ্ছেন না। ‘‘থাক, থাক। আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। তারচেয়ে বলুন, স্থানীয় শ্রমিকেরা কি মনে করে?’’
‘‘আমার মনে হয়,’’ ডা. অ্যামেস বললেন, ‘‘আমরা সাদা মানুষেরা যেখানে মাথা ঠিক রাখতে পারছি না, সেখানে স্থানীয়দের কাছ থেকে খুব বেশী কিছু আশা করা যায় না। আমি স্বীকার করি যে, অবস্থা দেখে ওরা ভীত বলে মনে হয়- কিন্তু কেন, তা বলা মুশকিল।’’
‘‘চিন্তার বিষয়।’’ কোন ব্যাখ্যা না দিয়েই বলল পোয়ারো।
স্যার গাই সামনে ঝুঁকে এলেন।
‘‘আপনি নিশ্চয়,’’ অবিশ্বাসের সাথে বললেন তিনি, ‘‘বিশ্বাস করেন না যে-ওহ, কিন্তু এসব তো বাজে গল্প ছাড়া আর কিছুই না! যদি এসব গল্প বিশ্বাস করে থাকেন, তাহলে প্রাচীন মিশর স¤পর্কে আপনি কিচ্ছু জানেন না।’’
উত্তরে পোয়ারো কিছু না বলে, পকেট থেকে ছোট আর প্রাচীন একটা বই বের করল। আমাদের সামনে বইটা ধরলে আমি নাম দেখতে পেলাম- দ্য ম্যাজিক অফ ঈজিপশিয়ান্স অ্যান্ড ক্যালডীয়ানস। এরপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বের হয়ে গেল তাঁবু থেকে। ডাক্তার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।
‘‘কি ভাবছেন এই ভদ্র লোক?’’
পোয়ারোর মুখে এই বাক্যটা প্রায়ই শোনা যায়। তাই এবার যখন অন্য একজনের মুখ থেকে শুনতে পেলাম, তখন হাসি চাপতে পারলাম না।
‘‘ওই মাথায় যে কখন কোন বুদ্ধি আসে, তা বলা আমার সাধ্যের বাইরে।’’ বললাম আমি, ‘‘হয়ত শয়তানী আত্মা তাড়াবার কোন পরিকল্পনা করছে!’’
পোয়ারোর খোঁজে বেড়িয়ে পরলাম আমি। দেখতে পেলাম সে প্রয়াত মি. ব্লেইবনারের সেক্রেটারি, ঐ সুদর্শন, হালকা-পাতলা ছেলেটার সাথে কথা বলছে।
‘‘না,’’ হার্পারকে বলতে শুনলাম। ‘‘এবার এখানে আসার ছয় মাসও হয় নি। তবে, আমি মি. ব্লেইবনারের ব্যবসা আর লেনদেনের ব্যাপারে প্রায় সব কিছুই জানি।’’
‘‘তাঁর ভাগ্নের ব্যাপারে কিছু আমাকে বলুন তো।’’
‘‘একদিন হঠাৎ করে এখানে এসে উপস্থিত! দেখতে শুনতে মন্দ না। আমি আগে কখনো লোকটাকে দেখি নি, কিন্তু এখানকার দুই একজন দেখেছেন-সম্ভবত ডা. অ্যামেস আর স্নাইডারের সাথে আগে থেকেই তার চেনা জানা ছিল। যাই হোক, মি. ব্লেইবনার কিন্তু ভাগ্নেকে দেখে একদম খুশী হন নি। কিছুক্ষণের মাঝেই ঝগড়া লেগে গেল। ‘‘এক সেন্টও পাবি না।’’ মি. ব্লেইবনার বলছিলেন। ‘‘এখনও না, আমার মরার পরেও না। আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি আমার কাজের জন্য উৎসর্গ করে দিয়ে যেতে চাই। মি. স্নাইডারের সাথে আজকেই এ ব্যাপারে কথা হচ্ছিল।’’ এসব কথাই চলল আরও কিছুক্ষণ । কথা শেষ হবার সাথে সাথে ভাগ্নে কায়রোর পথ ধরেছিল।’’
‘‘সে সময় ওর স্বাস্থ্য কেমন ছিল, কোন অসুবিধা?’’
‘‘কার স্বাস্থ্যের কথা বলছেন, মি. ব্লেইবনারের?’’
‘‘নাহ, ভাগ্নের।’’
‘‘আমার যতদূর মনে পরে, স্বাস্থ্যগত কোন একটা সমস্যার কথা সে বলেছিল। কিন্তু তেমন সিরিয়াস কিছু না মনে হয়, নইলে আমার মনে থাকত।’’
‘‘আরেকটা প্রশ্ন, মি. ব্লেইবনার কি কোন উইল রেখে গিয়েছেন?’’
‘‘আমার জানামতে, যান নি।’’
‘‘আপনি কি এখানে থাকবেন, মি. হার্পার?’’
‘‘না, জনাব। এখানে আর থাকার কোন ইচ্ছাই আমার নেই। ঝামেলা মিটতেই প্রথম সুযোগে নিউ ইয়র্কের দিকে রওনা দিব। আপনি চাইলে আমাকে বোকা মনে করতে পারেন, কিন্তু এই মরার মেন-হার-রা এর পরবর্তী শিকার হবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছাও আমার নেই। আমি এখানে থাকলে, সে অবশ্যই আমার ক্ষতি করবে।’’
ভ্রূ এর উপর জমে থাকা ঘাম মুছে ফেলল যুবক।
পোয়ারো ঘুরে দাঁড়াল। মুখে এক অদ্ভুত হাসি নিয়ে বলল, ‘‘ভুলে গিয়েছেন নাকি, ওর এক শিকার কিন্তু নিউ ইয়র্কে বসে মারা গিয়েছে!’’
‘‘ওহ, হেল!’’ আর্ত চিৎকার করল মি. হার্পার।
‘‘যুবকটা নার্ভাস।’’ চিন্তিত স্বরে বলল পোয়ারো, ‘‘সহ্যের শেষ সীমায় এসে দাঁড়িয়েছে সে, একেবারে শেষ সীমায়।’’
আমি কৌতূহলী চোখে পোয়ারোর দিকে তাকালাম। কিন্তু ওর অদ্ভুত হাসি দেখে কিছুই বুঝতে পারলাম না। স্যার উইলার্ড আর ড. টসউইল আমাদেরকে পুরো খনন এলাকাটা ঘুরে ফিরে দেখালেন। প্রধান সব আবিষ্কারগুলো এরই মাঝে কায়রোতে স্থানান্তর করা শেষ। কিন্তু তাও অনেকগুলো আকর্ষণীয় সমাধি সাজাবার ফার্নিচার দেখতে পেলাম। যুবক ব্যারনের আগ্রহ যেন আমাদেরকেও স্পর্শ করছিল। কিন্তু আমার মনে হল, যেন বাতাসে ভেসে থাকা অশুভ ভাব এড়াবার জন্য একটু বেশীই চেষ্টা করছে সে। আমাদের জন্য নির্ধারিত তাঁবুর দিকে রওনা দিলাম আমরা। সান্ধ্য খাবারের আগে একটু নিজেদেরকে পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। প্রবেশ পথে একজন লম্বা, কালো আর সাদা পোশাক পরিহিত লোক দাঁড়িয়ে ছিল। আমাদেরকে দেখে হেসে পথ ছেড়ে দিল আর আরবিতে বিড়বিড় করে কি যেন বলল। পোয়ারোর কানে আওয়াজ যেতেই থমকে দাঁড়াল সে।
‘‘তুমি নিশ্চয় হাসান, প্রয়াত স্যার জন উইলার্ডের ভৃত্য?’’
‘‘আমি আগে লর্ড স্যার জনের সেবা করতাম, এখন তাঁর পুত্রের সেবা করি।’’ আমাদের দিকে এক পা এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, ‘‘শুনেছি আপনি অনেক জ্ঞানী, শয়তান আত্মাকে বশ করতে জানেন। আমার যুবক প্রভুকে এখান থেকে নিয়ে যান। বাতাসে অশুভের গন্ধ পাচ্ছি, আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে চারিদিক থেকে।’’
আমাদের উত্তরের অপেক্ষা না করে, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল সে।
‘‘বাতাসে অশুভের গন্ধ,’’ বিড়বিড় করে বলল পোয়ারো, ‘‘আমিও টের পাচ্ছি।’’
সান্ধ্য খাবারের পরিবেশটাকে কোন ভাবেই উৎফুল্ল বলা যাবে না। ড. টসউইল একাই সব কথা বললেন, ঈজিপশিয়ান পুরাতত্ত্বের ব্যাপারে বেশ লম্বা চওড়া একটা বক্তৃতা দিলেন তিনি। খাবার শেষ করে তাঁবুতে ফেরার জন্য যেই না উঠেছি, স্যার গাই পোয়ারোর হাত ধরে ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। তাঁবুগুলোর মাঝে একটা ছায়া শরীর হেঁটে বেড়াচ্ছে। তবে শরীরটা যে মানুষের না সেটা নিশ্চিত। কারণ, দেহের উপরে যেখানে মানুষের মাথা থাকার কথা, সেখানে দেখা যাচ্ছে একটা কুকুরের মাথা! সমাধির দেয়ালে এরকম ছবি দেখেছি আমি।
দৃশ্যটা দেখে যেন আমার রক্ত হিম হয়ে এলো।
‘‘হে, খোদা।’’ পোয়ারো অস্ফুট স্বরে বলল, হাত দিয়ে বাতাসে ক্রুশ আঁকছে। ‘‘আনুবিস, শেয়াল মাথার মৃতদের দেবতা।’’
‘‘কেউ আমাদের সাথে ফাজলামি করছে।’’ ড. টসউইল ধিক্কারের সাথে বললেন, দাঁড়িয়ে পড়েছেন।
‘‘তোমার তাঁবুতে গিয়ে ঢুকেছে, হারপার।’’ শোনা যায় না, এমন আওয়াজে বললেন স্যার গাই। চেহারা ভয়ে রঙ হারিয়েছে।
‘‘না।’’ পোয়ারো মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ‘‘ডা. অ্যামেসের তাঁবুতে ঢুকেছে।’’
ডাক্তার পোয়ারোর দিকে অবিশ্বাসের সাথে তাকালেন। এরপর ড. টসউইলের কথাটাই যেন আবার বললেন, ‘‘কেউ আমাদের সাথে ফাজলামি করছে। আসুন, ব্যাটাকে ধরতে হবে।’’
খুব আগ্রহের সাথে ছায়া শরীরটার দিকে ছুটলেন তিনি। আমিও তাঁর পিছু নিলাম, কিন্তু অনেক খুঁজেও ওদিক দিয়ে জীবিত কেউ হেঁটে গিয়েছে, এমন কোন প্রমাণ খুঁজে পেলাম না। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে ফিরে এলাম দুজনে। এসে দেখি, পোয়ারো নিজেকে রক্ষা করার জন্য নিজের মত করে পদক্ষেপ নিয়েছে। আমাদের তাঁবুটাকে ঘিরে, বালির উপরে কি সব আঁকি বুকি করছে। অনেকগুলো পাঁচ কোণা তারা, যেটাকে পেন্টাগন বলা হয়, দেখতে পেলাম। সেই সাথে সাথে, স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে পোয়ারো ডাইনী আর যাদু বিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞান ঝাড়ছে। সাদা জাদু, কালো জাদু, এমনকি বুক অফ ডেডের কথাও কয়েকবার বলল।
ড. টসউইল এসব দেখে যেন রাগে ফেটে পড়ছেন। আমাকে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে ক্রোধোন্মত্ত গলায় বললেন, ‘‘এসব ভুয়া। একেবারে ভুয়া। এই লোকটা আসলে কিছুই না। প্রাচীন মিশরের বিশ্বাস আর মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের পার্থক্য স¤পর্কে এর কোন ধারণাই নেই। এর আগে এমন খিচুড়ি মার্কা অজ্ঞতা আমি অন্তত দেখি নি।’’
রাগ¦ান্তিত বিশেষজ্ঞকে ঠাণ্ডা করতে বেশ বেগ পেত হল আমাকে। এরপর আমাদের তাঁবুতে ঢুকে পোয়ারোর সাথে মিলিত হলাম। আমার ছোটো খাটো বন্ধুটাকে দেখে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছিল।
‘‘এখন শান্তিমত ঘুমাতে পারব।’’ আনন্দের সাথে ঘোষণা করল সে, ‘‘আর আমার এই মুহূর্তে শান্তির ঘুম খুব দরকার। আমার মাথা ব্যথায় যেন ছিঁড়ে পড়তে চাইছে। আহ, যদি এখন কোন পুষ্টিকর পানীয় পাওয়া যেত!’’
যেন পোয়ারোর প্রার্থনা শুনেই, হাসান হাতে ধূমায়িত কোন পানীয় নিয়ে তাঁবুতে প্রবেশ করল। পোয়ারোর দিকে কাপটা বাড়িয়ে ধরলে দেখা গেল, পানীয়টা আসলে ক্যামোমিল চা। পোয়ারো এই চা টাকে খুব পছন্দ করে। আমাকেও আমন্ত্রণ জানালো হাসান, কিন্তু মানা করলাম। পোয়ারো ওকে ধন্যবাদ জানালে, তাঁবু ছেড়ে চলে গেল হাসান। আবার আমরা একা হয়ে গেলাম। জামা পরিবর্তন করে তাঁবুর প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, মরুভূমি দেখছি।
‘‘অসাধারণ একটা জায়গা।’’ আমি উচ্চ স্বরে বললাম, ‘‘আর কাজটাও হচ্ছে অসাধারণ ভাবে। কেন মানুষ মিশরের প্রেমে পড়ে যায়, তা পরিষ্কার বুঝতে পারছি। মরুভূমির জীবন, বিলুপ্তপ্রায় এক সভ্যতার অন্তরের খোঁজ লাগানো! পোয়ারো, তুমিও নিশ্চয় প্রেমে পড়ে যাচ্ছ?’’
কোন উত্তর এলো না দেখে ঘুরে দাঁড়ালাম, কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু বিরক্তিটুকু চিন্তায় পরিণত হতে বেশী সময় লাগল না। পোয়ারোকে একটা কাউচের উপর শুয়ে থাকতে দেখলাম, চেহারা বিকৃত। পাশেই পরে আছে কাপটা, খালি। দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর পাশে। এর পর ক্যাম্পের অন্য পাশে, ডা. অ্যামেসের তাঁবুর দিকে দৌড় লাগালাম।
‘‘ডা. অ্যামেস!’’ চিৎকার করে ডাকলাম আমি, ‘‘জলদি আসুন।’
‘‘কি হয়েছে?’ পায়জামা পড়া ডাক্তার বের হতে হতে জিজ্ঞাসা করলেন।
‘‘আমার বন্ধু। ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে, মারা যাচ্ছে। ক্যামোমিল চা খেয়ে এই অবস্থা। হাসান নামের ভৃত্যটাকে যেন ক্যাম্প ছাড়তে দেয়া না হয়।’’
বিদ্যুৎ চমকের মত ডাক্তার অ্যামেস আমাদের তাঁবুতে এসে উপস্থিত হলেন। যেভাবে রেখে গিয়েছিলাম, পোয়ারো সেভাবেই পরে আছে।
‘‘অসাধারণ।’’ চিৎকার করলেন অ্যামেস, ‘‘দেখে খিচুনির মত মনে হচ্ছে-অথবা-কি যেন বলছিলেন? কি যেন পান করেছেন?’’ খালি কাপটা হাতে তুলে নিলেন।
‘‘সমস্যা একটাই-আমি পান করি নি!’’ শান্ত একটা স্বর বলে উঠল।
অবাক বিস্ময়ে ঘুরে দাঁড়ালাম আমরা। পোয়ারো বসে আছে, হাসছে।
‘‘না।’’ ভদ্র স্বরে বলল সে, ‘‘আমি পান করি নি। আমার বন্ধু হেস্টিংস যখন রাতের আর মিশরের মাধুর্যের বর্ণনা দিচ্ছিল, আমি তখন সুযোগ বুঝে পুরো চা টা ঢেলে ফেলি। না না, আমার গলায় ঢালি নি। ছোট্ট একটা বোতলে ঢেলেছি। বোতলটা পাঠানো হবে এক কেমিস্টের কাছে। না-’’ ডাক্তারকে হটাৎ নড়তে দেখে বলল সে, ‘‘আপনি বুদ্ধিমান লোক। এখানে নাশকতা যে নিষ্ফল, সেটা আপনার এতক্ষণে বুঝে যাবার কথা। হেস্টিংস আপনাকে ডেকে আনতে আনতে, বোতলটাকে আমি গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি। আহ, হেস্টিংস, ধর ওকে!’’
পোয়ারোর কথা বুঝতে ভুল করলাম। বন্ধুকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম ওর সামনে। কিন্তু ডাক্তার দ্রুত নড়াচড়ার উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন। তাঁর হাত চলে গেল মুখে, এরপরই নাকে এলো কাজু বাদামের মত একটা গন্ধ। সামনে ঝুঁকে মাটিতে পরে গেল ডাক্তার অ্যামেস।
‘‘মমির অভিশাপের আরেক শিকার।’’ ভারিক্কী স্বরে বলল পোয়ারো, ‘‘তবে, শেষ শিকার। হয়ত এভাবে সব কিছু শেষ হওয়াটাই ভাল হল। ওর মাথার উপরে তিন খুনের অপরাধ ঝুলছে।’’
‘‘ডা. অ্যামেস?’’ হতভম্ব আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। ‘‘কিন্তু আমি তো ভেবেছিলাম তুমি অতিপ্রাকৃত কিছু একটা কারণ সন্দেহ করছ।’’
‘‘আমাকে বুঝতে ভুল করেছ, হেস্টিংস। আমি বলেছি যে, আমি কুসংস্কারের প্রচণ্ড ক্ষমতায় বিশ্বাসী। একবার যদি কোন ভাবে সবাইকে বোঝানো যায় যে অভিশাপ বলে আসলেই কিছু আছে, তাহলে দিনে দুপুরে সবার চোখের সামনে কেউ ছুরিকাঘাতে মারা গেলেও, সেটাকে অভিশাপ হিসেবেই দেখা হবে। মানুষের মনের উপর কুসংষ্কারের ক্ষমতা এতটাই বেশী। আমি প্রথমেই সন্দেহ করেছিলাম যে, কেউ একজন এই ব্যাপারটাকেই নিজের সুবিধার্থে কাজে লাগাচ্ছে। আমার ধারণা যে, বুদ্ধিটা স্যার জন উইলার্ড মারা যাবার পর সেই লোকের মাথায় এসেছিল। কেননা, স্যার উইলার্ড মারা যাবার সাথে সাথে অভিশাপের ব্যাপারটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। কিন্তু, স্যার জনের মৃত্যুতে কারো কোন লাভ দেখতে পাচ্ছিলাম না। মি. ব্লেইবনারের কথা অবশ্য ভিন্ন। তাঁর পয়সা-কড়ি অনেক। নিউ ইয়র্ক থেকে পাওয়া তারটায় অনেক তথ্য ছিল। প্রথমত, যুবক বে¬ইবনার মানে ভাগ্নের কথা ধর। সে প্রায়ই বলত যে, মিশরে তার এমন এক বন্ধু আছে, যার কাছ থেকে ধার নিতে পারে। সবাই ধরে নিয়েছিল যে, সে তার মামার কথা বলছে। কিন্তু আমার মনে হল, ব্যাপারটা যদি তাই হত, তাহলে তো সে এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথাটা বলত না। যে শব্দগুলো সে বলেছে, তাতে মনে হয় ওর বন্ধুটা অন্য কেউ। আরেকটা ব্যাপার, কোন ভাবে টাকা পয়সা জমিয়ে সে মিশরে এলো। কিন্তু এখানে আসার পর দেখল, তার মামা তাকে এক পয়সাও দিতে রাজী না। তাহলে সে নিউ ইয়র্কে ফিরল কিভাবে? কেউ না কেউ নিশ্চয় তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে।’’
‘‘একেবারে দুর্বল শোনাচ্ছে।’’ আমি বাঁধা দিলাম।
‘‘কথা শেষ হয় নি তো। আরও আছে। অনেক সময় অনেক শব্দ উচ্চারণ করা হয়, যেগুলোকে মানুষ আক্ষরিক অর্থে নেয়। কিন্তু আসলে সেগুলোর অর্থ রূপক। উল্টোটাও ঘটে। এই কেসে, যে সব শব্দগুলো আক্ষরিক অর্থে ধরার করা ছিল, সেগুলো ধরা হয়েছে রূপকার্থে।’’ ভাগ্নে ব্লেইবনার পরিষ্কারভাবে বলে গিয়েছে, ‘‘আমি কুষ্ঠ রোগী।’ কিন্তু কেউ একথা কল্পনাও করে নি যে, ওর আত্মহত্যা করার কারণ হল, নিজেকে সে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত বলে ভেবেছে!’’
‘কি?’’ আমি অবাক হয় জিজ্ঞাসা করলাম।
‘‘একটা নারকীয় মনের চতুর আবিষ্কার এটা। মি. ব্লেইবনারের ভাগ্নে আসলে সাধারণ কোন চর্ম রোগে ভুগছিল। মনে আছে? সে দীর্ঘদিন দক্ষিণের সাগরে কাটিয়েছে। ওসব দ্বীপে এই ধরণের রোগের প্রকোপ অনেক বেশী। অ্যামেস ওর পুরাতন বন্ধু, বেশ দক্ষ ডাক্তার। অ্যামেসের কথা ওর অবিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না। এখানে এসে উপস্থিত হবার পর, আমার সন্দেহ পরে হার্পার আর ডা. অ্যামেসের উপর। কিন্তু আমি খুব দ্রুতই বুঝতে পারি যে, একমাত্র ডাক্তারের পক্ষেই এই অপরাধগুলোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল। হার্পারের কাছে এও জানতে পেরেছিলাম যে, তারা আগে থেকেই একে অন্যের পরিচিত। নিঃসন্দেহে ভাগ্নে কোন উইলে ডা. অ্যামেসকে সব দিয়ে গিয়েছে বা লাইফ ইনস্যুরেন্স করেছে ডাক্তারকে উত্তরাধিকার করে। ডাক্তার ব্যাপারটাকে টাকা কামাবার সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। মি. ব্লেইবনারের ক্ষতটা বিষাক্ত করে ফেলাটা ডাক্তারের জন্য একেবারে জলবৎ তরলং। এরপর ভাগ্নের একটা ব্যবস্থা করা। বন্ধুর মুখে নিজের দুর্ভাগ্য আর রোগের কথা শুনে, হতাশ যুবক আত্মহত্যা করে বসল। যে কারণেই হোক, মি. ব্লেইবনার কোন উইল করে যান নি। তাই স্বভাবতই সব সম্পদ পাবে তাঁর ভাগ্নে, আর সেই সূত্রে ডাক্তার।’’
‘‘আর মি. স্নাইডারের ব্যাপারটা?’’
‘‘একেবারে নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় না। সেও কিন্তু যুবক ব্লেইবনারকে চিনত। হয়ত, কোন কিছু সন্দেহ করে বসেছিল। অথবা হয়ত ডাক্তার অ্যামেস ভেবেছিল যে, আরেকটা অর্থহীন আর মোটিভহীন খুন কুসংস্কারটাকে আরও শক্ত পোক্ত করে তুলবে। তোমাকে আরেকটা মজার সাইকোলজিক্যাল তত্ত্ব বলি হেস্টিংস। একজন খুনি সবসময় তার সফল অপরাধের পুনরাবৃত্তি করতে চায়। তাই স্যার গাই উইলার্ডকে নিয়ে ভয় পাচ্ছিলাম। আজ রাতে যে আনুবিসের ছায়া মূর্তিটা দেখেছ, আমার আদেশে হাসান সেই কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, ডাক্তারকে ভয় দেখাতে পারি কি না। কিন্তু তাকে ভয় দেখাবার জন্য অতিপ্রাকৃত জিনিসই যথেষ্ট না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, অতিপ্রাকৃত জিনিসের উপস্থিতি তিনি পুরোপুরি মেনে নিতে পারেন নি। আমার ছোট্ট নাটকটা তাকে একচুলও বিভ্রান্ত করতে পারে নি। তাই সন্দেহ করেছিলাম যে, আমিই হতে চলেছি তার পরবর্তী শিকার। কিন্তু তার জন্য দুঃখের ব্যাপার, অভিশপ্ত সাগর, অসহনীয় গরম আর বিরক্তিকর বালিও এই মাথার ছোট্ট ধুসর কোষগুলোতে মরিচা ফেলতে পারে নি।’’
পরে দেখা গেল, পোয়ারোর সবগুলো কথাই সঠিক। বেশ কয়েক
বছর আগে, যুবক ব্লেইবনার, মাতাল অবস্থায় মজা করতে গিয়ে একটা উইল করে বসে- ‘‘আমার এই সিগারেটের কেস, যেটাকে তুমি খুব পছন্দ কর, আর মৃত্যুর সময় আমার সব সম্পত্তি আমি আমার কাছের বন্ধু রবার্ট অ্যামেসকে দিয়ে যাচ্ছি, যে আমাকে একবার ডুবে মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল।’’
যতটা সম্ভব ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল কেসটাকে। এখনও মানুষ ফারাও মেন-হার-রা এর সমাধিকে ঘিরে ঘটা মৃত্যুগুলোর কথা স্মরণ করে। বলে, মৃত্যুর ওপার থেকে মৃত ফারাও এর প্রতিশোধ নেবার আর কোন প্রমাণের দরকার কি? সমাধির মর্যাদা নষ্ট করা লোকগুলোর পরিণতি দেখলেই হয়। অথচ, পোয়ারো আমাকে বুঝিয়েছিল, এই বিশ্বাসটা আদি ঈজিপশিয়ান বিশ্বাস আর আদর্শের কতটা পরিপন্থী!
১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১:৫৩
ফুদাল ফিদাল বলেছেন: শিয়োর?
২| ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:২৯
মারুফ হোসেন বলেছেন: এনি ডাউট?
৩| ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ভোর ৫:২৪
ফুদাল ফিদাল বলেছেন: হালকা পাতলা
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৩
মারুফ হোসেন বলেছেন: অতি উত্তম অনুবাদ।