![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হয়ে যাক একটা গল্প। কি বলেন? শীত কিন্তু ভালোই পড়ছে। কাথামুড়ি দিয়ে তাহলে একটা গল্প হয়েই যাক আজকে।
সব কাজের অকাজের চিন্তা-ভাবনা একপাশে রেখে একটু বসেন। চা খাবেন ?
এক কাপ চা হলে ভালোই হয়। কি বলেন?
চলেন, চা-টা বানিয়ে নিই। বানাতে বানাতেই বলি গল্পটা। চিন্তাগুলো যেখানে ছিলো সেখানেই রাখুন।গল্পশেষে ডুব দিতে পারবেন আবার। ওহ্যা, চা টা একটু ভিন্ন হবে।
এক কাপ চায়ের জন্যে আনুমানিক এক কাপের তিন চতুর্থাংশ পানি আর একি পরিমান তরল দুধ একসাথে চায়ের পাতিলে নিয়ে চুলোয় চড়িয়ে দিন। তাতে চিনি দিন। মিক্স করে নাড়তে থাকুন আস্তে আস্তে। এবার দুটো এলাচ, দেড় ইঞ্চি সমান একটা হ্যাংলা-পাতলা দাড়চিনি, দুটো গোলমরিচ,দুটো লং আর একটা তেজপাতা দিয়ে আবার নাড়ুন। নাড়তে থাকুন। ভালো একটা ঘ্রাণ পাবেন। মিশ্রনটা ফুটে উঠলে আগুন কমিয়ে দিন। এবারে চা পাতা দিন । নাড়ুন। রঙ হাল্কা হলে আরেকটু চা পাতা দিন। আবার নাড়ুন। রঙ হয়ে এলেকাপে বা মগে ছাকনি দিয়ে ছেকে ঢেলে নিন। তার আগে চিনি টেষ্ট করে দেখুন। কম হলে আরেকটু দিয়ে নাড়ুন। বেশি হলে কিছু করার নাই।
গল্প ? ও হ্যা, গল্প। বলছি।
গল্পটা দশ-এগারো বছর বয়েসি এক বালকের। নাম রাহিন। খুব সম্ভবত ২০০২ সালের কথা। মানে বোঝাই যাচ্ছে এখনকার দশ-এগারো বছরের ছোকরাদের সাথে ওর তফাৎ কত। না ছিলো ফেসবুক, না ছিলো স্মার্টফোন। মানে পুরাই কনভেনশনাল। নো অটোমেশন।
তখন তার সারাদিনের রুটিন ছিলো অনেকটা এমন, ঠিক সকাল সাতটায় ঘুম থেকে ওঠা, প্রানভরে দাতব্রাশ করা, স্কুলে যাওয়া, ছুটির পর দুপুর ঠিক ১ টাবেজে ৪৫ এ বাসায় আসা, গোসল-খাওয়া-দাওয়া করে বিকেলের আগেই হোমওয়ার্ক করে আছরের আজান পড়া মাত্র বিকেলে খেলতে যাওয়া। সন্ধায় ফিরে পড়তে বসা। পড়া শেষে খাওয়া–দাওয়া করে ঘুম। পরেরদিন আবার একি রুটিন। সারাদিন মাথায় থাকতো কখন বিকেল হবে, কখন খেলতে যাবে।
এভাবেই চলছিলো দিনকাল। একটা সরকারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র তখন সে। ক্লাসের মোট ছাত্রছাত্রী ছিলো প্রায় ৮১ জন যাতে ছিলো ৬৩ জন ছাত্র আর মাত্র ১৮ জন ছাত্রী। ক্লাস ফোর অব্দি ছেলে মেয়ে সেকশন আলাদা থাকলেও ক্লাস ফাইভে ছেলে মেয়ে একি সেকশনে ভাগ করে দেয়া হয়। নতুন বছরের ক্লাস শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। প্রায় তো দেড়মাস ভালো ভাবে পার হয়েছে। একদিন ক্লাসটিচার নাম-ডাকছিলেন । ছেলেদের নামডাক শেষে এবার মেয়েদের পালা। মেয়েদের নাম ডাকতে গিয়ে ঠিক রোল ১৬ তে এই প্রথম কেউ সাড়া দিলো। ক্লাস টিচার হাজিরা খাতা চেক করে দেখেন ওই ছাত্রী সেদিনই প্রথম ক্লাস করতে এসেছে।
"কি? এতোদিন অনুপস্থিত কেন একসাথে? এমন হলে গার্ডিয়ান ডাকিয়ে নিচের ক্লাসে নামিয়ে দেয়া হবে। কি সমস্যা? "ক্লাস টিচার জানতে চাইলেন।
উত্তর এলো "মেডাম, অসুস্থ ছিলাম। ক্লিনিকে ছিলাম। দরখাস্ত আর ডাক্তারের প্রেসকিপশন-সার্টিফিকেট এনেছি সাথে"।
বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে টিচারের টেবিলের দিকে গেলো সে। দরখাস্ত টিচারের হাতে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো টেবিলের ঠিক ডান পাশে। আকাশী রঙ এর ফ্রকগায়ে, মাথায় সাদা স্কার্ফ। রাহিন আজ প্রথম দেখলো রিথিকে। হুম, ওর নাম রিথি। রাহিন এক নজরে তাকিয়ে রইলো। কি বুঝে তাকালো, তাকিয়ে কি খুজছে সে নিজেও জানে না। কিন্তু ওকে দেখতে তার ভালো লাগছিলো। চোখাচোখিও হলো একবার। নাহ, কোন পরিবর্তন নেই। হাই বেঞ্চের ওপর রাখা নিজের ব্যাগের ওপর দু'হাত একের ওপর এক রেখে তাতে থুতনি রেখে দেখেই রইলো রাহিন। রিথি টিচারের হাজারো প্রশ্নের জবাবে ব্যাস্ত।
প্রেম -ভালোবাসা? ১০/১১ বছর বয়সে? ওটা হয়তো আপনি -আমি বুঝতে পারছি কিন্তু রাহিন এসবের কিছুই বোঝে না তখন। ও শুধু এটাই বোঝে যে, রিথিকে ওর দেখতে ভালো লাগে। কেন জানি দেখতে ইচ্ছে করে ওর।
ক্লাসে তিনটি সারিতে বেঞ্চ সাজানো যার প্রথমও দ্বিতীয় সারি ছেলেদের আর শেষ সারি মেয়েদের। ছেলেদের প্রথম সারির সামনে ছিলো ক্লাসরুমের দরজা। রাহিন ছিলো ছেলেদের সারির দ্বিতীয় বেঞ্চের প্রথমজন। রিথি বসতো মেয়েদের সারির দ্বিতীয় বেঞ্চের একদম শেষে। সারাটাদিন রিথিকেই দেখতো রাহিন।
রিথি স্কুলে নিয়মিত ছিলো না। কিন্তু রিথিকে দেখার জন্যে রাহিন নিয়মিত ছিলো। প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে প্রথমেই খুজে বেড়াতে থাকে রিথিকে। যেদিন আসতো সেদিন সারাবেলাই রিথিকে দেখতে থাকে রাহিন লুকিয়ে লুকিয়ে । ক্লাসে, বারান্দায়, মাঠে, টিফিন ব্রেকে, ছুটির পরের ভীড়ে।
প্রায়ই চোখাচোখি হতে লাগলো। রিথিও বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। ক্লাস চলাকালীন কখনো কখনো রিথিও দেখতে লাগলো রাহিনের দিকে। ফের চোখাচোখি। ফের চোখ ফিরিয়ে নেয়া। বুক ডিব ডিব করতে থাকে রাহিনের। কি করবে? আরেকবার দেখবে? যদি আবার চোখাচোখি হয়? যদি টিচারকে নালিশ করে দেয়। কিন্তু না দেখেও পারে না। আবারো তাকিয়ে থাকে। আবারো চোখাচোখি। কখনো কখনো বেঞ্চের ওপর মাথা রেখে হাতের ফাক দিয়ে চুপি চুপি দেখে থাকে রিথিকে। ক্লাসে টিচার না থাকলে মাথার স্কার্ফ নামানো থাকতো রিথির ফলে তার চুল দেখা যেত। বব-কাট চুলে বেন্ড দিয়ে কপালের দিকে কিছু চুল ছড়িয়ে থাকতো ওর যা ছিলো রাহিনের কাছে সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য।
এভাবেই চলতে লাগলো দিন। কথা নেই, বার্তা নেই, শুধু দুজন দুজনকে খেয়াল করা। রিথি স্কুলে এলে রাহিনের দিন যায় ওকে দেখে দেখেই। আর না এলে অকারণে না আসার কারণ খুজে বেরানো, মনে মনে। “কি হতে পারে ওর ? জ্বর ? এতো ঘন ঘন জ্বর কেন হয় ? ভালো ডাক্তার দেখাতে পার না। আমাকে বললে আমি রফিক আংকেলের কাছে নিয়ে যেতাম। একদম ভালো হয়ে যেত। নাকি ইচ্ছে করেই আসে নি? আমি দেখে থাকি বলে? কাল কি তবে গার্ডিয়ান নিয়ে আসবে? মেডামকে বলবে, মেডাম ওই ছেলেটা আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকায় সারাক্ষণ । ওর বাসা কোথায় ? স্কুল বাস কতদূর যায় ? একদিন কাউকে না বলে উঠে পরবো? যদি বাসায় দেরি হয়ে যায় আবার ? বিকেলে ক্রিকেট খেলতে পারবো না। ও কি কাল আসবে? কোন জামাটা পড়বে? গাড় আকাশী নাকি হাল্কা আকাশী? গাড় আকাশীটা সুন্দর ।” এমন হাজারো জল্পনা কল্পনায় ডুবে থাকে রাহিন।
চা কেমন লাগছে ? হুম, স্মেলটা ভালো লাগবে জানতাম। কেউ কেউ মসলাগুলো টেলে গুড়ো করে বয়ামে রেখে দেয়। বাসায় ট্রাই করতে পারেন। তবে আজকে এক কাপই। কোথায় যেন ছিলাম ?
একদিন রিথি স্কুলে আসে নি। সেবার প্রায় একটানা ৪ দিন আসে নি সে স্কুলে। সেদিন ছিলো ৩য় দিন। সেদিন ছেলেদের এক বেঞ্চে সে “লাভ” চিহ্ন দিয়ে ইংরেজিতে “রিথি” লিখা দেখতে পায় রাহিন। হঠাৎ কেমন যেন লাগলো তার। মাথার ভেতরটা কেমন যেন ভন ভন করে উঠলো, কারণ ছাড়াই ঘামতে লাগলো শরীর। রাগ হচ্ছিলো খুব। কিন্তু কে লিখতে পারে ? খুজে বের করা দরকার ।
না, সে এসব ব্যপার কখনো তার কোন বন্ধুর সাথে শেয়ার করে নি কখনো। ছিলোই খুব চুপচাপ। একা থাকতেই পছন্দ করতো। আর তখনকার ছেলেপুলেরা তো এসবের কিছু বুঝতই না। শেয়ার কি করবে?
যাক, শুরু হয়ে গেলো গোয়ান্দাগিরী। হু ইজ দা ছুপা রুস্তম ? যখন জানতে পারলো সে রীতিমতো অবাক। এ আর কেউ নয়। ক্লাসের অনলি ওয়ান এস এম জি রিগ্যান । সুজা মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিন রিগ্যান । ফর্সা লাল্টু টাইপের ছেলে। সে তুলনায় রাহিন শ্যামলা , দেখতে রিগ্যান ওর চেয়ে ভালো। এসবের তফাৎ ঘুরপাক খেতে লাগলো মাথায়। পরে দেখা গেলো রিগ্যান আরো এক ধাপ এগিয়ে। ক্যান্টনমেন্ট স্কুল যেখানে ছেলে মেয়েরা সাধারনত কথা বলত না। যারা বলতো তারাও হাই স্কুলের আপু ভাইয়ারা। আর রিগ্যান করতো কি, রিথি যখন টিফিনে বান্ধবীদের সাথে স্কুলের আনাচে কানাচে ঘুড়ে বেড়াতো রিগ্যান কারণ ছাড়াই ওইদিক গিয়ে হুদাই হাক ডাক দিয়ে আসতো আর এমন ভাব করতো যেন সে কাওকে খুঁজছে বা কিছু খুঁজছে। দেখে যেন গায়ে আগুন লাগে রিহানের।
প্রায় বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ বার্ষিক পরীক্ষার কদিন আগের কথা। যথারীতি রিথির অনুপস্থিতি আর মাঝে মাঝে উপস্থিতি চলেই আসছে। এমনি একদিন টিফিন নিয়ে রাহিন ক্লাসের দিকে আসছে। দরজার কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় রিথি রাহিনের ব্যাগে কি যেন খুঁজছে আর দূরে দাঁড়িয়ে রিথির বান্ধবী নুসরাত। রাহিন আর ক্লাসে ঢোকেনি তখন। পরে ক্লাস চলাকালীন ব্যাগ চেক করে দেখে ওর রাফ খাতায় একটা ভাজ করা পাতা। লিখা ছিলো
“ রাহিন,
আমি খুব অসুস্থ। আমার বিজ্ঞান। প্র্যাক্টিক্যাল খাতা এঁকে দিতে পারবা?
প্লিজ?
রিথি । ”
রাহিন ওর বেঞ্চের দিকে তাকালো। ও নেই। পরে রোল ডাকার সময় ওর আরেক বান্ধবী ম্যাডামকে বললো “ ম্যাডাম, ও অসুস্থ। তাই ছুটি নিয়ে চলে গেছে। ”
এতো মেয়ে থাকতে রাহিনের কাছে আসলো কেন রিথি? কারন রিথি জানতো রাহিন অনেকের প্র্যাক্টিক্যাল খাতা এঁকে দেয়। এটা সে জেনেছিলো বান্ধবী নুসরাতের কাছ থেকে। নুসরাত ছিলো ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলে জিহাদের জমজ বোন। একি ক্লাসে পড়তো ভাই-বোন দুজনে আর জিহাদের প্র্যাক্টিক্যাল খাতাও এঁকে দিয়েছিলো রাহিন। সে সূত্রেই আসা। আর পরীক্ষা কাছে থাকায় মেয়েদের কেউ ওকে হেল্প করতে চায় নি। স্কুলে অনিয়মিত থাকায় কারো সাথে খুব একটা বন্ডিং ও ছিলো না রিথির। ব্যাপারটা সত্যি, যেখানে ফেসবুক, মোবাইল এসব ছিলো না সেখানে কেউ কারো সাথে স্কুলে ছাড়া যোগাযোগ ও করতো না। ফলে বন্ডিংটাও হয় না তখন যা আজকাল খুব সহজে হয় এবং খুবই দরকারী।
রাহিনো উপরের ক্লাসের অনেকের ড্রয়িং করে দিতো। তাছাড়া স্কুলের শুরু থেকে ড্রয়িং এ কখনো ৫০ এ ৪৫ এর নিচে পায় নি। হয় ৫০ এ ৫০ না হয় ৫০ এ ৪৫ । ৪৫ পেতো কারন সে চিত্র আর দৃশ্যের মাঝে তফাৎ বুঝতো না। বেশ কবার দৃশ্যের বদলে চিত্র বা চিত্রের বদলে দৃশ্য এঁকে দিয়ে দিয়েছে সে। তাই শেষ দশে কখনো কখনো ৫ পেত।
যাক, পরে ওই পৃষ্ঠায়ই রাহিন লিখে রাখলো –
“ খাতা, পেন্সিল আর রাবার দিও। এঁকে দেবো। ’’
পরদিন টিফিনে ওরা ঠিকই ব্যাগ চেক করে। একি খাতায় একি পৃষ্ঠায় উত্তর পায়। রাহিন ক্লাসে আসে। ক্লাস শুরু হয়। ক্লাস চলাকালীন চেক করে দেখে কিছুই নেই। না আছে কোন খাতা, পেন্সিল না আছে ভাজ করা পাতায় নতুন কোন লিখা। কিছুই নেই। হতাশ লাগলো খুব। রিথির বেঞ্চের দিকে তাকালো। রিথি তখন ব্ল্যাক বোর্ডে টিচারের লিখা খাতায় তুলছিলো। হলো না চোখাচোখি।
ছুটির পর নুসরাত রাহিনকে ডেকে বললো, “ নাও, খাতা ,পেন্সিল।’’ আর দুই টাকা দিয়ে বললো, “রিথি বলেছে রাবার কিনে নিতে। ওর কাছে ছিলো না।”
রাহিন জানতে চাইলো “ও কই ?”
নুসরাত বলে “ ও তো চলে গেলো।”
রাহিন বলে “ একটু আগেই তো দেখলাম ওকে ।”
নুসরাত বলে “ ওর বাবা এসে নিয়ে গেছে ওকে। তাই ও এসব আমাকে দিয়ে গেছে।”
সেদিন দুপুরে বাসায় গিয়ে খাওয়া দাওয়া করেই বসে পরে রাহিন রিথির কাজ নিয়ে। বিকেলের খেলা, হোমওয়ার্ক সব বাদ। আঁকা হয়ে গেলে সযত্নে ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে আবার আগামীদিনের অপেক্ষায় ।
চা শেষ ? ওকে, আর বেশি বাকি নেই গল্পের। একটা সিগারেট ধরাতেই পারেন। না না, আপনাকে একাই খেতে হবে। আমার অভ্যেস নেই।
এরপর প্রতিদিন রাহিন স্কুলে যায়। কিন্তু রিথির নাম গন্ধ নেই। একদিন, দুদিন, তিনদিন। নাহ, আসে নি। ভেবেছিলো নুসরাতকে জিজ্ঞাসা করবে কিন্তু লজ্জা হচ্ছিলো ওর খুব। জিহাদকে দিয়েও জিজ্ঞাসা করান যাবে না কারোন ও জানা মানে পুরো স্কুল খবর হয়ে যাওয়া। একদম হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গার মতো।
আট দিন। আট দিন পর আসলো রিথি। রাহিনের যেন অনেকদিনের বুকের ভেতরের ধুকধুকানি বন্ধ হলো। রিথি দেখতেই ভালো হয়ে গিয়েছিলো অর মন। আজ সে খাতা দেবে। হয়তো কথা বলবে। খুব কাছ থেকে দেখবে তাকে। টিফিনে যথারীতি ব্যাগ থেকে খাতা নিতে গিয়েছিলো রিথি। পায় নি। কারণ খাতা ছিলো রাহিনের হাতেই। সে অতা নিয়েই বেরিয়েছিলো। ইচ্ছে করেই।
রিথি কোন লিখা ছাড়েনি রাহিনের খাতায়। হয়তো ছুটির পর কথা হবে আজ। সেই খুশিতে রাহিনের যেন সময় ফুঁড়ায় না। সেদিন পুরো ৭টা ক্লাস মন ভরে প্রাণ ভরে রাহিন রিথিকে দেখলো। প্রতি ক্লাসে বেশ কবার করে চোখাচোখিও হলো ওদের। অল্প বয়স। দুজনের কেউই জানে না কি হচ্ছে এসব।
ছুটির পর রিথি দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দার এক পাশে নুসরাতের সাথে। যেই রাহিন বের হয়ে সামনে আসবে অমনি রিথির বাবা এসে হাজির। যথারীতি রিথি হাটা দিলো। আর নুসরাতকে ডেকে কিসব যেন বললো।
স্থির হয়ে গেলো সারা পৃথিবী রাহিনের। চেয়ে চেয়ে দেখছিলো রিথির যাওয়া। রিথি বেশ কবার পেছন ফিরে তাকালো। অনেকক্ষণ চেয়ে রইলো দুজন দুজনকে। এদিকে নুসরাত এলো দৌড়ে দৌড়ে রাহিনের কাছে।
বলে “ ওর বাবা এসছে। কথা বলতে দেখলে রাগ করবেন হয়তো।তাই ও চলে গেছে। তুমি ওর খাতা আমায় দিয়ে দাও।”
মন খুব খারাপ হয় রাহিনের। এমন মন খারাপ সে আগে কখনো অনুভব করে নি। প্রায় ২ টাকা বাস ভাড়ার সমান রাস্তা সে একাই পায়ে হেটেই চলে আসে।
না, হাসির ব্যাপার না। তখন ৫ টাকায় শহরের এপার থেকে ওপারে যাওয়া যেত। একা রাস্তায় কেঁদেছেও সে। মনে মনে অনেক বকাঝকাও করলো রিথিকে “ পচা মেয়ে,আমার সাথে কথা বলো নাই।আমি কি খারাপ ছেলে? আমি তো প্রতিদিন হোমওয়ার্ক করি। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠি। হোয়াইট প্লাস দিয়ে দাঁত ব্রাশ করি। তুমিই তো প্রতিদিন স্কুলে আসো না।”
রিথি আবারো গায়েব। এক্সামের আগের শেষ ক্লাসেও আসলো না।
পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। মেয়েদের হল পড়তো দ্বিতীয় তলায় আর ছেলেদের নিচ তলায়। ক্লাস থ্রি থেকে টেন অব্দি একসাথে এক্সাম হতো। প্রতি পরীক্ষায় রিথিকে এক নজর দেখার জন্য মেইন গেটে দাঁড়িয়ে থাকত রাহিন। আর রিথির বাবা রিথিকে ক্লাসরুম থেকেই হাত ধরে আনতো। ও হয়তো খুব অসুস্থ ছিলো। প্রতি পরীক্ষায় দু একবার চোখাচোখী হতো। রিথিও জানতো রাহিন দাঁড়িয়ে থাকবে মেইন গেটে। খুব অল্প সময়ের জন্য দূর থেকে দেখা দুজন দুজনকে। ব্যাপারটা জিহাদের বোন নুসরাত বুঝতে পারে। এদিকে রাহিন দাড়াতো আর ওদিকে নুসরাত সব কার্যকলাপ খেয়াল করতো। কিন্তু কখনো জিজ্ঞাসা করে নি বা কাউকে বলেও নি। একটা ছেলে আট বছর বয়সে যা বোঝে একটা মেয়ে ছ’বছর বয়সে তা বোঝে।
ক্লাস সিক্সে উঠে গেলো রাহিন। ক্লাস টিচার বললেন “ তোমার ছেলেরা মেয়েরা এখন থেকে একটু একটু কথা বলবা। এখন তোমরা বড় হইছো। ছেলে মেয়ে হাজিরা খাতা এখন থেকে আলাদা নয়। একসাথে।”
রাহিন কিছুটা লাজুক ছিলো। রিথিকে খুজে বেড়াতো সে। নাহ, আসে নি। নতুন ক্লাসে রিথি আসেই নি। নুসরাত ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। একদিন টিফিনে নুসরাত রাহিনকে এক প্যাকেট আচার দিয়ে বলে “ আচার খাবি ?”
রাহিন বলে “না, পেট ভরা। তুই খা ।” নুসরাত তুই করে বললো তাই রাহিনো তুই করে উত্তর দিলো।
নুসরাত বলে “ রিথি মনে হয় আর আসবে না। ও হয়তো স্কুল বদলেছে।ওর বাবা বদলি হইছে অন্য জায়গায়। শেষ পরীক্ষার দিন বলেছিলো আমাকে।” রাহিন বলে “ ওহ, ভালো।” আর কি বলবে খুজে পাচ্ছিলো না রাহিন। চুপ করে বসে রইলো।
ভাবছিলো আর দেখা হবে না রিথিকে। আর অপেক্ষা করতে হবে রাহিনের। ও বুঝতে পারছিলো না কি হয়েছে ওর। শুধু কান্না পাচ্ছিলো। বাসায় এসে সেদিনো হোমওয়ার্ক করে নি সে। বিকেলে মাঠে গিয়েছিলো। কিন্তু খেলেনি। মাঠের পাশে উচু দেয়ালে বসেছিলো চুপচাপ। সারাটা রাত কেদেছে সে। লুকিয়ে লুকিয়ে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে । সে নিজেও বুঝতে পারছিলো না কেন কান্না পাচ্ছে । শুধু এইটুক বুঝেছিলো রিথিকে আর কখনো দেখতে পাবে না সে। কিন্তু সেটা তো ছিলো হারানোর কষ্ট, দূরে চলে যাওার কষ্ট। স্কুলে গেলেও টিফিনে মাঠের পাশের পেয়ারা বাগানে একা একা বসে থাকত রাহিন। কতই না কেঁদেছে একা একা। কখনো বলে নি কাওকে।
এরপর থেকে রাহিন রিথিকে অনেক জায়গায় খুজে ফেরে । কোথাও বেড়াতে গেলে, কোথাও যাওয়ার সময় রাস্তার আশেপাশে। গাড়িতে, বাসে পাশ কেটে যাওয়া রিক্সায়। যদি একটাবার দেখা পাওয়া তার। কিন্তু আর দেখা মিল্ল না রিথির।
২০১৭ এখন। রাহিন বড় হয়েছে। তরুন রাহিন এখন সব বোঝে। প্রেম-ভালোবাসা। হারানোর বেদনা- কষ্ট। সবকিছু। হ্যা, সে বুঝেছে রিথিকে সে ভালোবেসেছিলো। বব-কাট চুলে মাথায় ব্যান্ড দিয়ে সামনের দিকে কপালে ছড়িয়ে থাকা কিছু চুল। এখনো স্পষ্ট মনে আছে রাহিনের। মাঝে মাঝে পুরানো ঘটনা মনে করতেই হাসি পায় তার। কি পিচ্চিই না ছিলো। ভালোবাসা কতোটা অবুঝ হতে পারে। ২ টাকা বাস ভাড়া সমান রাস্তা হেটে হেটে বাসায় গিয়েছিলো সে। ভাবতেই আপনা আপনি হাসি পায় তার। রিথি যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক।
ও হ্যা, হারামজাদা রিগ্যান এখন অস্ট্রেলিয়ায় ।
© পাতার বাঁশি
( Mohammad Nasrul Islam )
২ জানুয়ারী ২০১৭
সাদাছক ৩ নিয়ে বড় ঝামেলায় পড়েছি। আসছি কিছুদিনের মধ্যে
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৫৬
শামচুল হক বলেছেন: গল্প ভালো লাগল।