নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

humanchorcha

writer

সাইফুল ইসলাম গাজী

writer and translator of Bangladesh

সাইফুল ইসলাম গাজী › বিস্তারিত পোস্টঃ

The hell Of Earth Guantanmo bay by gazi saiful islam

২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:১২

পৃথিবীর নরক গুয়ান্তানামো বে

গাজী সাইফুল ইসলাম



‘গুয়ান্তানামো বে’ নৌ-ঘাঁটিটি (Naval Base) কিউবার দক্ষিণপূর্ব প্রান্ত গুয়ান্তানামো উপসাগরের তীরে অবস্থিত। একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি আমেরিকার নৌবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিদেশে আমেরিকান নৌবাহিনীর এটিই সবচেয়ে পুরনো ঘাঁটি এবং এটি এমন একটি দেশে অবস্থিত যে দেশের সঙ্গে আমেরিকার কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। ২০০১ থেকে নৌঘাঁটিটি সামরিক কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে ৯/১১-এর পরে আফগানিস্তানে আল-কায়েদার সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে যেসব লোককে আমেরিকা গ্রেফতার করেছে এবং পরে ইরাক থেকে, তাদের সবাইকে রাখা হয়েছে এই কারাগারে। আমেরিকা বলছে, আমেরিকার বিরুদ্ধে বেআইনি যুদ্ধে লিপ্ত বলে তারা জেনেভা কনভেনসনের বন্দি নিরাপত্তা সুযোগ-সুবিধা পায়নি।



গুয়ান্তানামো বে’র ইতিহাস

গুয়ান্তানামো শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন খ্রিস্টোফার কলোম্বাস| ফিসারম্যানস পয়েন্ট হিসেবে চিহ্নিত এ জায়গাটিতে তিনি প্রথম পদার্পন করেছিলেন ১৪৯৪ খ্রিস্টাবে। পরে ১৮ শতাব্দির প্রথমার্ধে জেনকিনস এয়ারের যুদ্ধের সময় ব্রিটিশরা যখন এলাকাটি দখল করে নেয় এলাকাটির নতুন নামকরণ হয় কাম্বারল্যান্ড বে। ১৮৯৮-এ স্পেনিশ-আমেরিকান যুদ্ধের সময় গ্রীষ্মকালীন সমূদ্র ঝড়ের ভাসতে ভাসতেও আমেরিকান নৌবাহিনী শান্তিয়াগো আক্রমণ করে। এবং গুয়ান্তানামো নামক অনন্য বন্দরটি নিজেদের কব্জা করে নেয়। নৌবাহিনীর সমর্থন নিয়েই মেরিন সেনারা মূল ভূ-খণ্ডে পা রাখে। তারা কিউবান স্কাউটদের রিক্রুট করে স্পেনিশদের বিরুদ্ধে কাজে লাগায়। আর এভাবেই কিউবানদের সহযোগিতায় তারা দেশটির আরও অভ্যন্তরে মূল ভূ-খণ্ডে প্রবেশ করে। এই পুরো এলাকাটিই পরে হয়ে দাঁড়ায় আমেরিকান নৌবাহিনীর ন্যাভাল স্টেশন গোয়ান্তানামো বে, যার আয়তন ৪৫ বর্গ মাইল (বা ১১৬ বর্গ কিলোমিটার)। সংক্ষিপ্ত শব্দে এটি কিছুদিনের জন্য জিটমো নামেও পরিচিত ছিল।

যুদ্ধের শেষে আমেরিকা স্পেনের কাছ থেকে পুরো কিউবার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৩, কিউবার প্রথম প্রেসিডন্টে তমাস এস্ট্রাডা পালমা, যিনি কিনা ছিলেন একজন আমেরিকান, ‘গুয়ান্তানামো বে’ এলাকাটি চিরকালের জন্য আমেরিকার কাছে লিজ দিয়ে দেয়। কিউবা-আমেরিকার মধ্যে সম্পাদিত সেই চুক্তি আরও কিছু বিষয়ে আমেরিকাকে ক্ষমতা দান করে। ওগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো, কিউবা গুয়ান্তানামো এলাকার ওপর তখনই কেবল তার সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে যখন আমেরিকা তাকে স্বেচ্ছায় তা ফিরিয়ে দেবে। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে উভয় দেশ সর্বসম্মতিতে চুক্তিটি নবায়ন করে এবং কিউবা তার ব্যবসায়িক পার্টনারকে বে দিয়ে বিনাশূল্কে প্রবেশাধিকার দান করে। সে সময় লিজ মূল্য পুননির্ধারিত হয়, প্রতি বছরের জন্য ২,০০০ স্বর্ণ মূদ্রা, তখন ওই পরিমাণ স্বর্ণ মূদ্রার দাম ছিল ৪,০৮৫ আমেরিকান ডলার। তবে শর্ত ছিল উভয় দেশের সম্মতিতে লিজটি বাতিল করা যাবে অথবা আমেরিকা যদি ঘাঁটিটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে তাহলেও লিজটি বাতিল হবে।

কিউবা বিপ্লবের সময়, ফিদেল কাস্ট্রোর সরকার গুয়ান্তানামো বে’র ভাড়া বাবত আমেরিকার কাছ থেকে মাত্র একবার চেকের বিপরীতে নগদ মূল্য আদায় করেছিল। অবশ্য কিউবান সরকার তা করেছিল বিপ্লবকালের অস্থিরতার মধ্যে কিছু সন্দেহ থেকে। অপরদিকে আমেরিকা নগদ মূল্য তা পরিশোধ করেছিল অতীতের চুক্তিটির একটি বৈধতা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।

বিপ্লবকালের ১৯৫৩-৫৯ পর্যন্ত হাজার হাজার কিউবান ঘাঁটির বাইরে থেকে ভেতরে গিয়ে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করত। ১৯৫৮-এর মধ্য সময়ে যানবাহন ভেতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রিক্রুটকৃত শ্রমিকদের ভেতরে প্রবেশের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক গেইট খোলা রাখা হয়। আবার গেইট থেকে শ্রমিকদের স্রোত বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য সরকারি কর্ম কেন্দ্রের বাসগুলো সারারাত ধরে চলাচল করত। ২০০৬-এ এসে নতুন লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে কিউবান সরকারের নিষেধাজ্ঞার কারণে এই শ্রমিকের সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ২ জন। তারা দু’জনেই বয়স্ক কিউবান। দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করার জন্য উত্ত-পূর্ব গেইট দিয়ে ক্যাম্পে প্রবেশ করে।

১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত ঘাঁটিতে মিলিটারিদের ব্যবহৃত পানির সংকুলন হতো পাইপ লাইনের মাধ্যমে। আর ওই পানি আনা হতো ৪.৫ মাইল দূরের ইয়াটেরাস নদী থেকে। প্রতিদিন ১০ মিলিয়ন লিটার। এর জন্য আমেরিকান সরকারকে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাস হিসাবে ১৪,০০০ মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে কিউবান সরকার পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। ঘাঁটিতে তখন ১৪ মিলিয়ন গ্যালন পানি সংরক্ষিত ছিল। শিগগির সংরক্ষিত পানিতে টান পড়ে। এই বাস্তবতায় আমেরিকান সরকার ভারগেজের মধ্য দিয়ে জ্যামাইকা থেকে পানি সংগ্রহ করে। এবং পরে সান দিয়াগো, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে। কিন্তু এরপরও কিউবান সরকার আমেরিকার বিরুদ্ধে পানি চুরির অভিযোগ উত্থাপন করে।

১৯৬২ সালে কিউবান মিসাইল ক্রইসিসের সময় অতি অল্প সময়ের নোটিসে মিলিটারিদের ব্যক্তিগত পরিবারগুলো ঘাঁটি থেকে প্রত্যাহার করে নেয় আমেরিকা। ২২ অক্টোবর নোটিস ঘোষিত হয়, আর তাতে বলা হয়, একটি মাত্র স্যুটকেস নিয়ে ঘাঁটি ত্যাগ করতে হবে। ...যাহোক, মিসাইল ক্রাইসিস কেটে গেলে ১৯৬৪ সালে মিলিটারি পরিবারগুলো আবার ঘাঁটিতে ফেরার অনুমতি পায়। মিলি



ক্যাকটাস দেয়াল



ক্যাকটাস দেয়াল হলো মূল কিউবা থেকে গুয়ান্তানামো বে’র পৃথককরণ লাইনের নাম। বিপ্লবের পর কিছু কিউবান গুয়ান্তানামো নেভাল বেসটিকে মেনে নিতে অস্বীকার করে। পরিকল্পনা করেছিল, বের উত্তর-পূর্ব সেকসন ধরে ৮/১৭ মাইলের একটি বেড়া নির্মাণ করার, যাতে কিউবানরা রিফিউজি হিসেবে আমেরিকায় প্রবেশ করতে না পারে। এই বেড়ারই আরেক নাম ক্যাকটাস কারটেন ইউরোপে এইরকম দেয়ালের নাম লৌহ নেকাব আর এশিয়ায় বাঁশের দেয়াল।

তখন কিউবা আর আমেরিকান সৈনিকরা নো ম্যান্স ল্যান্ড অতিক্রম করে কিউবা-আমেরিকান সীমান্ত বরাবর ৫৫,০০০-এর কাছাকাছি ল্যান্ড মাইন স্থাপন করে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ মাইনফিল্ড তৈরি করেছিল। আর সর্ববৃহৎ মাইনফিল্ডটি ছিল ওয়াস্টার্ন হেমিসফিয়ার। ১৬ মে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে, প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এসব মাইন অপসারণ করার নির্দেশ দেন। আমেরিকান সৈনিকরা গতি ও শব্দ সেন্সর ব্যবহারের মাধ্যমে ধীর গতিতে হলেও সেসব মাইন অপসারণ করছে কিন্তু কিউবা তার সীমান্ত থেকে কোনো মাইন অপসারণ করেনি।



বন্দি শিবির



বিশ শতাব্দির শেষ সিকিভাগ থেকে গুয়ান্তানামো বে কিউবা ও হাইতির উদ্বাস্তু, গভীর সমূদ্র থেকে যাদের গ্রেফতার করা হতো, আবাসিক স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। বিশেষ করে, ১৯৯০-এর দশকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জেন বারট্রান্ড অ্যারিসটাইডের সময়ে হাইতি থেকে যারা পালিয়ে এসেছিল। ওসব লোকেরা ক্যাম্প বাকলি অংশে ১৯৯৩-এর মধ্য সময় পর্যন্ত আবদ্ধ ছিল। ৮জুন ইউনাইটেড স্ট্যাটস ডিস্ট্রক্ট কোর্ট জাজ স্টারলিং জনসন জেআর. ঘোষণা দিলেন এ ধরনের ক্যাম্প সংবিধান সম্মত নয়। কিন্তু কোর্টের এ আদেশটি পরবর্তীসময়ে বাতিল করা হয় এবং ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ওখানে বন্দিদের আটক রাখা হয়। সর্বশেষ হাইতিয়ান বন্দিটি গুয়ন্তানামো বে ত্যাগ করে ১ নভেম্বর, ১৯৯৫।

২০০২-এর শুরুতে কয়েকশ মানুষকে ধরে এনে ঘাঁটিটির একটি অংশে বন্দি করা হয়। বন্দিদের বেশিরভাগ আফগানিস্তানের বাসিন্দা। পরে ক্যাম্প ডেল্টা, ক্যাম্প ইকো, ক্যাম্প ইগোয়ানা, আবু গারাইব থেকে আনা হয় আরও বন্দিকে। উল্লেখ্য যে, ক্যাম্প এক্স-রে নামে আমেরিকার আরেকটি কুখ্যাত ঘাঁটি ছিল যা দেশটি বন্ধ হয়ে দিয়েছে। আমেরিকান সৈনিকদের সূত্রে বলা হতে লাগল যে, আফগান ও ইরাকি বন্দিদের বেশিরভাগ আল-কায়েদা জঙ্গি, কেউ কেউ তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত অথবা তালেবান। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণের জন্য তাদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচারের মুখেমুখি করা হলো না বা তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষ্য নেয়া হলো না। এভাবেই কেটে গেল ৭/৮ বছর। কিন্তু বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠনগুলো প্রথম থেকেই উচ্চকিত ছিল। তারা অভিযোগ করে আসছিল যে, বিনা বিচারে বছরের পর বছর আটক রেখে আমেরিকা বন্দিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এমন নিপীড়নের কারণে ইতোমধ্যে সেখানে কমপক্ষে ৩ জন আত্মহত্যা করেছে (২জন সৌদি ১জন ইয়েমেনি)। তারা পরনের কাপড় কিংবা বিছানার শিটের সাহায্যে ফাঁসিতে ঝুঁলে জীবন শেষ করেছে। তাদের আত্মহত্যার পর আরও কজন আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছে।

গুয়ান্তানামো বে’র বন্দি নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা শুধু জোর প্রতিবাদ জানিয়েই থেমে থেকেনি, আটক বন্দিদের শিগগির প্রভাবহীন বিচারের মুখোমুখি করার জন্য দাবী জানাতে থাকে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মে, ২০০৫ থেকে, জাতিসংঘ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ থেকে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন মে, ২০০৬ থেকে গুয়ান্তানামো বে বন্দিশালাটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য দাবী জানিয়ে আসছে। ২২ জানুয়ারি, ২০০৯, প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১০-এর জানুয়ারি মধ্যে গুয়ান্তানামো বে বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন।







সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সেল



বিবিসি জানিয়েছে, গুয়ান্তানামো বে’র সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সেল হলো, ডিটেনশন ক্যাম্পে ৫ ও ৬ নং সেল। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সন্দেহভাজনকে ওই সেল দু’টিতে রাখা হয়েছে। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনে সংরক্ষিত ওই সেল দু’টিতে কোনো জানালা পর্যন্ত নেই। নেই সূর্যালোক প্রবেশের ও বিশুদ্ধ বায়ু প্রবাহের কোনো ব্যবস্থা। উচ্চ শক্তির বৈদ্যুতিক বাল্ব সব সময় জ্বালানো থাকে মাথার ওপর। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় নজরদারী তো রয়েছেই। এ দু’টি সেলের দরজাগুলো সবসময় নিয়ন্ত্রিত হয় কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত অত্যাধুনিক কম্পিউটার সিস্ট্যামের মাধ্যমে।



বন্দি নির্যাতনের কৌশল



সিআইএর বন্দি নির্যাতনের কঠোর কৌশল নিয়ে বিশ্বব্যাপী এখন অনেক আলোচানা-সমালোচনা। যদিও বুশ শাসনামলে সিআইএর পরিচালক বলেছিল, জিজ্ঞাসাবাদের কঠোর কৌশলগুলো নিরাপদ ও দরকারী। আর তার পক্ষ নিয়ে আমেরিকান প্রশাসনের একটি অংশ তখন বলছিল, সিআইএ নির্যাতনের এসব কৌশল ধার করেছে সমাজতান্ত্রিক চীন, উত্তর কোরিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে। গবেষণায দেখ গেছে, ওয়াটারবোর্ডিং-এর মতো কঠোর জিজ্ঞাসাবাদের কৌশলে প্রেসিডেন্ট বুশ ও তার প্রশসানের নৈতিক সমর্থন ছিল। ওয়াটারবোর্ডিং হলো বন্দির নাক-মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে ওপর থেকে ঠাণ্ডা (বা গরম) পানি ঢালা। এতে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় এবং প্রতিমুহূর্তে বন্দি মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে। কোনো কোনো বন্দির ওপর প্রতি আধঘণ্টা অন্তর ওয়াটারবোর্ডিং করা হয়।



নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা সত্যি সম্ভব কিনা



একটা প্রশ্ন উঠছে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় করা সত্যি সম্ভব কিনা? এ প্রশ্নের উত্তরে দুপক্ষের দুধরনের বক্তব্য পাওয়া গেছে। এ পক্ষ বলছে, নির্যাতনের সময় নিজেকে বাঁচনোর জন্য যে কেউ যে কোনো বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিতে পারে। পরে কোর্টে প্রদত্ত স্বীকারোক্তি অস্বীকার করে। বলে, নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য এসব বলেছিলাম। অপর পক্ষ বলেছে, এ ধরনের স্বীকারোক্তি কেবল তাদের সম্মুখেই করা সম্ভব যারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। প্রশিক্ষিত জিজ্ঞাসাবাদকারীরা তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী সঠিক বিষয়েই প্রশ্ন করে এবং প্রাপ্ত উত্তর কতটুকু সঠিক যাচাই করতে পারে। যুক্তিযুক্তভাকে নির্ভরযোগ্য তথ্যের ভিত্তিতেই তারা অগ্রসর হয়। দ্বিতীয়পক্ষের দাবী, জিজ্ঞাসাবাদের সময় কঠোর না হলে কোনো তথ্যই আদায় করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জাত ক্রিমিনাল বা উগ্রপন্থি বা নিবেদিতপ্রাণ উগ্রপন্থিদের কাছ থেকে। এ পদ্ধতিতে আদায়কৃত স্বীকারোক্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আমেরিকান সাংবাদিকরা টিভি শোতে প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে ওয়াটারবোর্ডিং-এর পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেছে। তারা দেখিয়েছে এর মাধ্যমে অনেক সহজে কথা আদায় করা যায়। যেমন এবিসি নিউজ চ্যানেলের একটি শোতে সাংবাদিক Kiriakou বলেন, এক সপ্তাহ ধরে জোবায়েদ নামক এক বন্দিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কোনো প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছিল না। সে সম্পূর্ণ অসহযোগিতামূলক আচরণ করছিল। জিজ্ঞাসাবাদকারীরা সিআইএ-এর উচ্চ পর্যায় থেকে ওয়াটারবোর্ডিং করার অনুমতি গ্রহণ করল। এরপর তারা তাকে চিত করে শুইয়ে নাক-মুখ কাঁথা দিয়ে ঢেকে ওপর থেকে সরাসরি এমন কৌশলে পানি ঢালতে শুরু করল যাতে তার মনে হতে লাগল যে সে ডুবে মরে যাচ্ছে। এভাবে ৩০ থেকে ৩৫ সেকেন্ড পার হতেই জোবায়েদের মনোভাব পাল্টে গেল।

পরদিন দ্বিতীয় দফায় ওয়াটারবোর্ডিং-এর উদ্যোগ নিতেই সে তার জিজ্ঞাসাবাদকারীদের বলল, গত রাত আল্লাহ তাকে স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন এবং বলেছেন, তুমি তাদের সহযোগিতা করো এতে তোমার অন্য ভাইয়েরা যারা আটক আছে তাদের ওপর নির্যাতন কমবে। কাজেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সব প্রশ্নের উত্তর দেব। এরপর সে খুব স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদকারীদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এবিসি নিউজ চ্যানেলে সাংবাদিক Kiriakou-এর দাবী পাকিস্তান থেকে গ্রেফতার হওয়া খালিদ শেখ মহাম্মেদ, ৯/১১ হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী, নিজের স্বীকৃতি অনুযায়ী, সে আল-কায়েদা মিলিটারি কমিটির প্রধান, ৯০ সেকেন্ড ওয়াটারবোর্ডিং করার পরেই সে গান গাইতে শুরু করল। পরে তার স্বীকারোক্তির সূত্র ধরেই সিআইএ ৯/১১-এর আরেক পরিকল্পনাকারী ইয়াজিদ সাফাতকে গ্রেফতার করে। ইয়াজিদ সাফাত কান্দাহার বিমান বন্দরের কাছে একটি ল্যাব্রেটরিতে কয়েক মাস ধরে আল কায়েদার জন্য আনথ্রাক্স গ্যাস উৎপাদনের চেষ্টা চালায় এবং আরও পরে গ্রেফতার করে ইমাম ফারিজকে। Kiriakou-এর দাবী অনুযায়ী ইমাম ফারিজের নেতৃত্বেই বালির নাইটক্লাবে বোমা হামলা হয়েছিল এবং ২০২ জন নিরপরাধ পর্যটক প্রাণ হারিয়েছিল।



প্রদর্শনের কথা ছিল গুয়ান্তানামো বে বন্দিশিবিরে নির্যাতনের ছবি



মার্কিন সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রটির সর্বোচ্চ আদালত গুয়ান্তানামো বে বন্দিশিবিরে নির্যাতনের ছবিগুলো জনসম্মুখে প্রকাশের আদেশ দিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর বারাক ওবামাও ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ২৮ মে ২০০৯ এর মধ্যে গুয়ান্তানামো বেতে নির্যাতনের ছবিগুলো জনসম্মুখে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের চাপ ও বিরোধীদের সমালোচনার মুখে মি. ওবামা পিছু হটেন। আর নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল কোর্ট আগের রায়টি প্রত্যাহার করে নেয়।



গুয়ান্তানামো বে’র বন্দিদের কিছু অংশের মিলিটারি ট্রায়েল পুনরায় শুরু করার ঘোষণা দেয়ায় বারাক ওবামার সমালোচনা করেছে সিভিল লিবার্টি গ্রুপ



ওবামা ক্ষমতায় অভিসিক্ত হয়েই সমালোচনা করেছিলেন, বুশ শাসনামলের বিচার ব্যবস্থার। তিনি বলেছিলেন, সন্দেহভাজনদের বিচারে স্বচ্ছ শুনানির ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলছেন, বিতর্কিত মিলিটারি কমিশন বন্ধ করাই হবে তাঁর অফিসের প্রথম কাজ। এর মাধ্যমে আমেরিকা শ্রদ্ধাপূর্ণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে যাচ্ছে নতুন যুগে। তিনি বলেছেন, গুয়ান্তানামো বে’তে এমন কোনো বন্দি নেই রেগুলার ফেডারেল কোর্ট সিস্টেমে যার বিচার করা সম্ভব না কিংবা করা উচিত না। কিন্তু সিভিল লিবার্টি ইউনিয়নে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাটর্নি জোনাথন হেটেজ এর বিরোধিতা ও সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, ওবামা একটি ব্যর্থ পরীক্ষার (গবেষণার) শেষ না করে নতুন করে তা জাগিয়ে তুলতে চাচ্ছেন সত্যিই হতাশাজনক এটা। জোনাথন হেটেজের মতো আরও অনেকেই তাঁর সংস্কারমূলক পদক্ষেপের জোরালো সমালোচনা করেছেন এবং কেউ কেউ তার বক্তব্যে সন্দেহ পোষণ করেছেন। আবার অনেকেই, অতীতে যারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অধিষ্ঠিত ছিলেন, গুয়ান্তানামো বিষয়ে তাঁর পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। এমনই একজন ব্যক্তিত্ব রিপাবলিকান সেনেটর জন ম্যাককেইন, যিনি ওবামার সঙ্গে নির্বাচনে হেরেছেন। তিনি বলেছেন, আমি খুশি যে ওবামা এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন...। যাহোক, ওবামা চাচ্ছেন, ২০১০-এর জানুয়ারির মধ্যে গুয়ান্তানামো বে বন্ধ করেন দেবেন। তাঁর এ ঘোষণার পরই আলজেরিয়ান বন্দি লাখদার বাউমেদিনি (Lakhdar Boumediene) মুক্তি পান এবং ফ্রান্সের উদ্দেশ্যে গুয়ান্তানামো ত্যাগ করেন। ২০০১ সালে তাকে বসনিয়া হারজেগোবিনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। সাত বছর পর তিনি ছাড়া পান আর ২০০৮- এর নভেম্বরে প্রমাণ হয় তিনি নির্দোষ।

বারাক ওবামার এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন করে মিলিটারি কমিশন গঠন করা হয়। কিন্তু জটিল কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে, এই ট্রাইব্যুনাল কার্যকরি করার ক্ষেত্রে। প্রশ্ন জাগছে সব বন্দিকেই এই আইনের আওতায় আনা হবে কিনা। বলা হচ্ছে, যারা কম সন্দেহভাজন, যাদের ক্ষেত্রে অভিযোগ স্পষ্ট নয়, শুধু তাদেরই আনা হবে এই আইনের আওতায়। এদের সংখ্যা ১৩। যাদের ধরা হয়েছিল ১১/ সেপ্টেম্বরের পর আফগানিস্তান থেকে। যেমন খালিদ শেখ মুহাম্মদ। অভিযুক্ত বিমান হামলাকারীদের মধ্যে একজন। কিন্তু প্রশ্ন জাগছে এদের বাইরে যারা আছে তাদের বিচার কীভাবে হবে? এ জন্যই হোয়াইট হাউজের সূত্রগুলো বলছে, এই কমিশন আবার পরিবর্তিত হতে পারে। কারণ জটিল মামলার পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। এ জন্যই গুয়ান্তানামো ডিটেনশন ক্যাম্পটি অল্প সময়ের মধ্যে শেষ হবে না।

২০০৬ সালে জাতিসংঘ গুয়ান্তানামো বে ডিটেনশন ক্যাম্পটিতে জিজ্ঞাসাবাদের কৌশলে নিপীড়নে নিষ্ঠুরতার আধিক্য দেখে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ক্যাম্পটি বন্ধের জন্য আবেদন জানায়। রিপোর্টটিতে বলা হয়, বন্দিদের নির্জন সেলে দীর্ঘসময় ধরে ফেলে রাখা, অতিরিক্ত তাপ প্রয়োগ, নিবর্তনমূলক আচরণ যেমন জোর করে সেভ করানো। (অনুবাদকের নোট: আমরা সিলস্টার স্ট্যালুনের একটি ছবিতে দেখেছি, বৈদ্যুতিক সাটির্ক সংযুক্ত রেজারের সাহায্যে জোর পূর্বক সেভ করানোর দৃশ্য, গুয়ান্তানামোতেও এমন রেজারের প্রয়োগ থাকতে পারে। কারণ তারা ওখানে মানুষের ওপর অমানবিক নির্যাতনের সর্ববিধ পরীক্ষা চালিয়েছে। একই সঙ্গে পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই ফ্রান্‌জ কাফকার দি ট্রায়েল গল্পটির কথা)। ২০০৮ সালে হিউম্যান রাইট ওয়াচ বন্দিদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, এসব বন্দিদের অপরাপর কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয় না। কারণ তারা দিনরাতের ২৪ ঘণ্টার ২২ ঘণ্টা নির্জন ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থাকে। তারা ওখানে পায় না প্রাকৃতিক আলো কিংবা মুক্ত বিশুদ্ধ বাতাস। তাদের ওখানে নেই শিক্ষার সুযোগ, কুরান ছাড়া সুযোগ নেই অন্য কোনো বই পড়ার। ইতোপূর্বে ২০০৫ সালেই অ্যামিনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পটি বন্ধ করার আবেদন জানিয়েছিল। অ্যামিনেস্টির ২০০৭ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মানুষকে চরম একাকিত্বের মধ্যে ঠেলে দেয়া, আইনের শাসন ভঙ্গ করার ধ্বংসাত্মক প্রবণতার বড় নজির হলো গুয়ন্তানামো। মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ নজিরটি স্থাপন করছে শক্তিশালী একটি দেশে, যা আমাদের সবার জন্যই ভয়ঙ্কর উদ্বেগের কারণ।



নিপীড়ন বেড়েছে ওবামার ক্ষমতা গ্রহণের পর



ডিসেম্বর/০৮-এ বারাক ওবামার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ওগুয়ান্তানামো বে সামরিক ঘাঁটিতে বিনা বিচারে আটক বন্দিদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে বলে রয়টার সংবাদ সংস্থার কাছে অভিযোগ করেছেন ব্রিটিশ-আমেরিকান মানবাধিকার বিষয়ক আইনবিদ আহমেদ গাফফার। তিনি ওখানকার ৩১ জন বন্দির মুক্তির জন্য বিধিসম্মত স্বেচ্ছা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষ করে, ডিসেম্বরে নির্বাচিত হওয়ার পর ২২ জানুয়ারি ওবামা যখন ঘোষণা দিলেন যে, এক বছরের মধ্যে ক্যাম্পটি বন্ধ করা হবে। তিনি জানিয়েছেন, কঠোরভাবে প্রহার করা, ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে আবদ্ধাবস্থায় মরিচের গুঁড়া সেপ্র করা, টললেট পেপারের সঙ্গে মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে রাখা, অনসনকারীদের জোরপূর্বক অতিরিক্ত ভোজন করানো ওখানকার গার্ডদের নিষ্ঠুর খেলায় পরিণত হয়েছে। ওবামার ক্ষমতায় অভিসিক্ত না হওয়া পর্যন্ত এরূপ নিপীড়নের অসংখ্য ঘটনা সেখানে ঘটেছে-আমার অভিজ্ঞতা তাই বলছে। এই নিপীড়নমূলক আচরণকে বর্বরোচিত আচরণ ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়।

মোট ছবার তিনি গুয়ান্তানামোর বন্দিশালা প্রত্যক্ষ করেছেন। বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ ছাড়াও তিনি কথা বলেছেন ওখানকার বন্দি ও গার্ডদের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, ওপর থেকে ঠিক এ ধরনের নিপীড়নের নির্দেশ না থাকলেও ওখানকার আমেরিকান সেনা ও নৌ বাহিনীর কিছু হতাশ সদস্য, যারা ইচ্ছের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালন করছে তারাই এমন নিষ্ঠুর আচরণগুলো বেশি করে। তাদের মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বষ, বর্ণ বিদ্বেষও রয়েছে। একজন কৃষ্ণাঙ্গ ডেমোক্র্যেট নির্বাচনে জয়ী হয়েছে এটা যেমন তারা মানতে পারছে না তেমনই মানতে পারছে না এক বছরের মধ্যে বাদবাকি ২৪১ জন সন্দেহভাজন মুসলমানের মুক্ত হয়ে যাওয়ার ঘোষণাটা।

আহমেদ গাফফার সমপ্রতি বিনয়াম মুহাম্মদ নামের একজন ব্রিটিশ নাগরিককে মুক্ত করেছেন গুয়ান্তানামো থেকে। চার বছর আটক থাকার পর সে মুক্তি পেলো। এই সময়ের মধ্যে না তার বিচার হলো, না তার নামে কোনো অভিযোগনামা তৈরি হলো।

আমি কল্পনাই করতে পারি না কেন তুমি বন্দিদের নির্যাতন করা থেকে মুক্তি পেতে চাও? এমন বিশেষ একজন গার্ডের সঙ্গে আমার কথা হলো-যে কিনা ইরাকে আহত হয়েছিল। সে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমার মক্কেলদেরকেই দায়ী করল তার আহতাবস্থার জন্য, তার ক্ষতের জন্য, তার ভোগান্তির জন্য।

অ্যাডমিরাল প্যাট্টিক ওয়ালেশ আরেকজন তদন্তকারী। তিনি বলেছেন, নিপীড়নমূলক আচরণের বেশকিছু অভিযোগের তদন্ত করতে গিয়ে দেখা গেল, ওখানকার গার্ডরাই প্রধান নিপীড়নকারী। তাদের দুর্ব্যবহারের প্রমাণই আমরা বেশি পেয়েছি। তিনি ২০ অভিযোগের মধ্যে ১৪টির প্রমাণ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার রিপোর্টে। সন্দেহ, অশ্রদ্ধা এসবই নিপীড়নের অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন। আর নিপীড়নের অন্যতম কৌশল মরিচের গুঁড়ো সেপ্র করা। এর বেশি বিস্তারিত কিছু লিখেননি তিনি। গাফফার বলেছেন, বন্দিদের নির্যাতন করা ওখানকার গার্ডদের এক ধরনের খেলা। এ থেকে তারা বিনোদন পায়। আরও যেসব দুর্ব্যবহার তারা করে ওগুলো হলো প্রার্থনায় ব্যাঘাত ঘটানো, যখন তখন শরীরে আঘাত করা, চর-ঘুষি মারা।



কিউবার বিরোধিতা



লিজের নামে দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক গুয়ান্তনামো বে বন্দরটি ধরে রাখার প্রক্রিয়াটি কিউবায় ফিদেল কাস্ট্রো সরকারের কাছে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে থেকে ভীষণ অপ্রিয়। গুয়ান্তনামো বে বন্দরটিও কমিউনিস্ট পার্টি পরিচালিত দি রিপাবলিক অব কিউবার সার্বভৌমত্বের অন্তর্ভুক্ত। দেশটির দাবী, ভয় দেখিয়ে বা শক্তি প্রয়োগ করে সার্বভৌম কোনো অঞ্চলের কিছু অংশ দখলে রাখা ১৯৬৯-এর ভিয়েনা কনভেনসনের ৫২ আর্টিক্যাল অনুযায়ী চুক্তি আইনের পরিপন্থি। এই বিবেচনায় ১৯০১-এর কিউবান সংবিধানের পরে যে সংশোধনী আনা হয় তা ওই চুক্তি বাতিল করে দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই সংশোধনী মানতে নারাজ। বিশ্বের এক নাম্বার শক্তিশালী এ দেশটি কিউবাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, কোনো সংশোধনীই তাদেরকে কিউবা থেকে সরাতে পারবে না। কারণ, কিউবা তার স্বাধীনতার শর্ত হিসেবে আমেরিকাকে অঞ্চলটি লিজ দিয়েছে। তারা ১৯০৩ থেকে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত কিউবার সঙ্গে তাদের সম্পাদিত বিভিন্ন চুক্তির কথা উল্লেখ করে জানিয়ে দিয়েছে যে, ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্ট ডি রুজভেল্টের সময়ে এ অঞ্চলে আমেরিকার স্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই এ চুক্তিটির নবায়ন করা হয়েছিল, যা সকল প্রকার সংশোধনীকে নসাৎ করে দেয়। এরপরও কাস্ট্রোর সরকার আমেরিকার বিরোধীতা করে যাচ্ছে, অপর একটি দেশের সার্বভৌম সীমার মধ্যে অবৈধ সামরিক আগ্রাসন, বন্দি নিপীড়ন ইত্যাকার কর্মকাণ্ডের বিরোধীতা করে যাচ্ছে।

২২ এপ্রিল ২০০৭, দি সান ফ্রান্সিসকো ক্রনিকল এই ঘাঁটি সম্পর্কে একটি আর্টিক্যাল প্রকাশ করেছে। আর্টিক্যালটিতে চুক্তির বিভিন্ন দিকের পর্যালোচনা করে বলা হয়েছে, আমেরিকা গুয়ান্তানামো বে বন্দরটি শুধু কয়লা ওঠা-নামা আর নৌ বিষয়ক কাজেই ব্যবহার করতে পারে বন্দি আটক কিংবা তাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাজা প্রদানের কয়েদখানা কিংবা শত্রু প্রতিহত করার কাজে নয়। এছাড়াও আর্টিক্যালটিতে বলা হয় যে, নির্দিষ্টকৃত এলাকার মধ্যে বানিজ্যিক, শিল্প বিষয়ক অথবা অন্য কোনো প্রকার লাভজনক কর্মোদ্যোগ গ্রহণ এ চুক্তির স্পষ্ট লঙ্ঘন।



গুয়ান্তানামো বে’র বন্দিদের গ্রহণ করবে সৌদি আরব



গুয়ান্তানামো বে বন্ধ হয়ে গেলে আমেরিকা এসব সন্দেহভাজন বন্দিদের নিয়ে কী করবে? কোথায় রাখবে এদের? কারণ সাধারণ আমেরিকানরা সন্দেহভাজনদের সেদেশে ঢুকতে দিতে রাজি নয়। তবে কি কোনো প্রকার বিচার ছাড়াই তাদের ছেড়ে দিতে পারবে যুক্তরাষ্ট্র? বিনা বিচারে ছেড়ে দিলে আমেরিকার আচরণ কি বিশ্বব্যাপী আরও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবে না? এমনিতেই তো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো নির্বিচারে লোকদের আটকে রাখার অধিকার আমেরিকার নেই বলে সোচ্চার। সন্ত্রাসবাদী বা উগ্রপন্থীদের দমনের নামে আমেরিকা নিজেই কি সন্ত্রাসবাদী হয়ে উঠছে না? আবার এটাও সত্য যে, এতদিনে আমেরিকা এটা বুঝতে পেরেছে যে, মুক্ত-নিরপেক্ষ বিচারে এদের কাউকেই দোষী সাভ্যস্ত করা যাবে না। কারণ নিরঙ্কুশ তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে নেই। বাস্তবে এরা শুধুই সন্দেহভাজন। ওবামার সরকারের সামনে এটি এখন একটি বড় প্রশ্ন। একই সঙ্গে কিউবার ফিদেল কাস্ট্রোর সরকারও যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিচ্ছে তার ভূখণ্ডে এ ধরনের নিপীড়নমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করার জন্য। কিউবার পক্ষ নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্র থেকেই প্রকাশিত পত্রিকাগুলো কিউবার দাবীর প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। সমপ্রতি আমেরিকান একটি চ্যানেলের, নিপীড়ন : একটি নোংরা ব্যবসা, শিরোনামের একটি টকশোতে বলা হয়েছে, নিপীড়ন হলো একটি বহুজাকিত শিল্প, আর এর সদর দপ্তর আমেরিকায় (Torture: The Dirty Business, Torture is a multinational industry–but its headquarters is in the USA)| এখন দেখা যাচ্ছে, ইচ্ছে করলেও বন্দি শিবিরটি আমেরিকার পক্ষে বন্ধ করা সহজ নয়। ৭৭৪ জন বন্দি নিয়ে ২০০২-এ শুরু হয়েছিল ক্যাম্প জাস্টিজ গুয়ান্তামোর বে। তাদের মধ্যে ৩ জন আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কতজন ছাড়া পেয়ে নিজ দেশে ফিরে গেছে তার সঠিক কোনো পরিসখ্যান কোনো সূত্র থেকেই পাওয়া যায় নি। পাওয়া যায়নি স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে নিপীড়ন করে কতজনকে হত্যা করা হয়েছে সে পরিসখ্যান। তবে মধ্য জুন/০৯ পর্যন্ত সেখানে ছিল ২৪১ জন বন্দি, যাদের নিয়ে জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি আমেরিকা। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি এই যখন আমেরিকার অবস্থা তখন তার দীর্ঘদিনের মিত্র সৌদি আরব ১০০ জন বন্দি গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে। ইতালিও রাজি হয়েছে কিছু বন্দি গ্রহণ করবে বলে। বর্তমান বন্দিদের বেশিরভাগ ইয়েমেনের বাসিন্দা। কিন্তু ইয়েমেনের জিম্মায় এসব বন্দিদের দিয়ে আমেরিকা নিরাপত্তা বোধ করছে না। তাই সৌদির আরব যখন ১০০ বন্দি গ্রহণ করতে রাজি হয়েছে-আমেরিকা তার পালে কিছু পানি পেয়েছে। তারপরও ওবামার সরকার যখন বন্দিদের বিকল্প ব্যবস্থার জন্য ১০ কোটি ডলারের বরাদ্দের কথা ঘোষণা করেছে ডেমোক্রাটরা তার সমালোচনা করছে। আশার কথা হলো গুয়ান্তানামো বন্দিদের বিচারের খসড়া আদেশ তৈরি করেছে হোয়াইট হাউজ। ২৯ জুন/০৯-এর ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক সংবাদ থেকে এ কথা জানা গেছে, কিউবার গুয়ান্তানামো বে বন্দি শিবিরে আটক সন্দেহভাজন আল কায়েদা ২২৯ বন্দিদের অনির্দিষ্টকালের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আটক রেখে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য খসড়া একটি আদেশ তৈরি করেছে হোয়াইট হাউজ। কংগ্রেসের অনুমোদন পেলে আদেশটি আইনে পরিণত হবে। কিন্তু কংগ্রেস এই খসড়ায় অনুমোদন দেবে কিনা এখনও পরিস্কার নয়। হোয়াইট হাউজ প্রণিত এই খসড়াটিতে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস যদি অনুমোদন না দেয়-তাহলে আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে কারাগারটি বন্ধ করা আমেরিকার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়বে। অবশ্য ওবামা ইচ্ছে করলে তার নির্বাহী ক্ষমতা বলে আদেশটিকে আইনে পরিণত করতে পারবেন। পত্রিকাটি অপর একটি সূত্রের বরাদ দিয়ে জানিয়েছে, আমেরিকা বেসামরিক আদালতে বন্দিদের বিচারের চিন্তাভাবনাও করছে।



সবশেষে গুয়ান্তানামো বে ফাইলস বইটি নিয়ে কিছু কথা



গুয়ান্তানামো বে’তে নির্বিচারে আটক বন্দিদের ওপর আমেরিকার জুলুমের ওপর ভিত্তি করে ইতোমধ্যে রচিত হয়েছে কয়েকটি বই। এবং নির্মিত হয়েছে একটি ছবি। যেমন আফগানিস্তানে তালেবানদের নিপীড়নের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে কান্দাহার ছবিটি। গুয়ান্তানামো বে’র ওপর ভিত্তি করে নির্মিত ছবিটির নাম টেক্সি টু দি ডার্ক সাইড। পরিচালক অ্যালেক্স জিবনি (Alex Gibney)| এই ছবিতে আফগানিস্তান, আবু গারাইব ও গুয়ান্তানামোতে আমেরিকার নিপীড়নের চিত্র দেখানো হয়েছে।



আল-কায়েদার মতো যুক্তরাষ্ট্রও একটি আতঙ্কের নাম-মুয়াম্মের গাদ্দাফি



মুসলিম বিশ্বের জীবীত রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মুহাম্মদ ও ইরানের প্রেসডেন্ট আহমাদিনেজাদ ছাড়া আর কোনো নেতা প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করতে সাহস করেন না। কিন্তু এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মের গাদ্দাফি। বহু বছর চুপচাপ থাকার পর ১২ জুন/০৯ ইতালি সফর করতে গিয়ে বলেছেন, আল-কায়েদা ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ কথা তিনি আগেও একবার বলেছিলেন। তিনি বলেন, তারা উভয়েই সন্ত্রাসী। আল-কায়েদা কোনো পূর্ব-ঘোষণা ছাড়াই জান-মালের ওপর হামলা চালায় আর যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ সমুন্নত করতে বাণিজ্যিক কারণে অপর দেশের নিরিহ মানুষের ওপর হামলা চালিয়ে হত্যা করে। গুয়ান্তানামো বে ঘাঁটিতে বিনা বিচারে অবৈধভাবে আটক রেখে বন্দিদের ওপর নির্যাতন করছে তারা। আল-কায়েদার মতো সারা বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রও একটি ভয়াবহ আতঙ্কের নাম।



উপসংহার ও লেখকের কথা



বন্দি যে অর্থেই বন্দি হোক তার সঙ্গে ব্যবহারের কিছু নীতিমালা রয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার ক্ষেত্রেও বিশ্বসংস্থা কিংবা বিশ্বমানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে কিছু নিয়মনীতি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করা হয়। কিন্তু বিশ্বে এমন সভ্য দেশ খুব কমই আছে যেখানে বন্দিদের সঙ্গে নিয়মনীতি মেনে আচরণ করা হয়। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকেরা কথা আদায়ের নামে নারকীয় নির্যাতন চালায় বন্দিদের ওপর। সবচেয়ে ভয়াবহ সত্য হলো, তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশে এমনকি আমাদের বাংলাদেশেও এমন অনেক বন্দির খবর আমরা জানি, যারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার স্বীকার| মিথ্যে একটি মামলা দিয়ে কিংবা মামলা ছাড়াই গ্রেফতার করে পরে অসংখ্য মামলায় জড়িয়ে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এরপর শারীরিকভাবে পঙ্গু বানিয়ে ছাড়া হয়। এমন প্রতিহিংসামূলক নির্যাতন থেকে অনেক সময় দেশের বুদ্ধিজীবীরাও রেহাই পান না। আরও দুঃসংবাদ হলো, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কিছু লোক ভিকটিমের পরিবারের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের জন্য নিপীড়ন চালায়। কোনো কোনো পরিবার তার স্বজনকে নির্যাতন থেকে বাঁচানোর জন্য অগ্রিম টাকা দিয়ে দেয়। অপরদিকে, ভিকটিমের ওপর নির্যাতন চালানোর জন্যও প্রতিপক্ষের লোকেরা আইন প্রয়োকারী সংস্থার সংশ্লিষ্টদের টাকা দিয়ে থাকে। কিন্তু সমস্যা হয়, গরীব মানুষদের বেলায়। টাকা দিতে না পেরে নির্যাতন সয়ে যায়। আমরা দেখেছি, সন্ত্রাসীরা মানুষ অপহরণ করে টাকা দাবী করে। সময়মতো টাকা দিতে না পারলে ভিকটিমকে হত্যা করার হুমকি দেয়। কখনও সময়মতো টাকা না পেলে সত্যি সত্যি হত্যা করে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনেক সদস্যও এমনটি করে থাকে। তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য আর আর সন্ত্রাসীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। ‌

যাহোক, গায়ের জোরে অন্যের ভূ-খণ্ড ব্যবহার করে আমেরিকার যে সামরিক ঘাঁটিটি/কারাগারটি পরিচালনা করে আসছে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষেরা আশা করছে অদূর ভবিষ্যতে একদিন এর অবসান ঘটবে। হয়তো এই বারাক ওবামার হাত দিয়ে আমরা এর শেষ দেখতে পাব। কিন্তু বিশ্বের বুকে এর ইতিহাস রয়ে যাবে নিপীড়ন আর জুলুমের ঘাঁটি হিসেবে। এখানে যেমন অসংখ্য মানুষের জীবনের প্রদীপ চিরতরে নিভে গেছে, তেমনি আবার জন্ম গ্রহণও অসংখ্য মানুষ। তাদের মধ্যে দু’জন বিখ্যাত ব্যক্তির নাম এই মুহূর্তে আমার মনে আসছে। তারা হলেন অভিনেতা পিটার আর্গম্যান এবং ব্রিটিশ-আমেরিকান গিটারিস্ট আইজাক গুলোরি। নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারাও কমবেশি সোচ্চার এটাই মানবতার শেষ আশারস্থল।





**Article Copyright: Gazi saiful Islam.

No one can use it without writer’s permission.

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৯:৪৩

উইশ বলেছেন: ভালো লাগলো..

২| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:১৮

অগ্নি সারথি বলেছেন: কত অজানারে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.