![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হেলেন রুপা
আজ রাতের ঘড়ির কাঁটা টা মনে হচ্ছে খুব ধীরে ধীরে চলছে । আসলে ঘড়ি তার নিজের গতিধারাতেই চলছে , আমার-ই আজ সকালের খুব বেশি অপেক্ষা ! তাই আমার কাছেই মনে হচ্ছে আজ যেন রাত টা একটু বেশি-ই বড় হয়ে গেছে ! সারা রাত বিছানায় এদিক ওদিক করলাম , রাত এখন ৪.১২ মিনিট খুব পানি তৃষ্ণা পেয়েছে । বিছানা থেকে উঠে পানি খেয়ে নিলাম , বারান্দায় পায়চারি করছি আর মনে মনে কত কি ভাবছি । কাল আমার জন্য অনেক বড় দিন , কাল আমাকে অনেক বড় একটা কাজ করতে হবে ।
সকালে উঠেই হন্ত দন্ত হয়ে বের হয়ে গেলাম , কলেজের রাজনৈতিক মিটিং আছে আজ । দেশের এই অবস্থা এখন আমাদের অনেক দায়িত্ব ! আজ আমাদের মিটিং এ বলে দেওয়া হবে কার কোথায় কোথায় ডিউটি , আমি এর আগে এমন কাজ কখনো করিনি । কেন জানি মনে হচ্ছে দলের স্বার্থে দেশের জন্য এটাই ঠিক ! তাতে কিছুটা না হয় ক্ষতি হবে । এক যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রেট্রোল বোমা নিক্ষেপ করা হবে , ঢাকা তে মোট ২৩ টি জোনে প্রেট্রোল বোমা মারা হবে ! আমার দ্বায়িত্ব পড়েছে সংসদ ভবনের এড়িয়াতে । ঠিক যখন বিকাল ৫.৪০ মিনিট হবে তখন যে বাসটি সংসদ ভবনের সামনে দিয়ে যাবে সেটিতেই প্রেট্রোল বোমাটি নিক্ষেপ করতে হবে !
সকাল ১১ টা বাসায় ফিরে এলাম , আজ অনেক খুশি আমার মন টা । যে কাজটা আমি পেয়েছি তা যদি ঠিক মতো করে দিতে পারি তাহলে বেশ মোটা অংকের টাকা পাবো । ভেবেছি টাকা টা পেয়ে সবার আগে নিউমার্কেট যাবো মা , বাবা , ছোট ভাই টা আর ছোট ২ বোনদের জন্য কিছু কেনাকাটা করবো । আর আমার ওকে একটা লাল শাড়ি কিনে দেব । যদিও এড়া কেউ-ই আমার রাজনীতি করা পছন্দ করে না কিন্তু আমি অনেক সময় না জানিয়েই রাজনীতির সাথে কাজ করে যাই । তাতে নিজের কিছু পকেট খরচা চলে যায় , সিগারেটের টাকা টা নিজেই যোগাতে পারি । আমাদের পরিবারে আমার বাবাই একমাত্র কর্মক্ষম ব্যাক্তি , যার উপরে এতো গুলো মানুষের দায়িত্ব । মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আমিও কিছু করি কিন্তু এস.এস.সি আর এইচ.এস.সি তে ভালো রেজাল্ট করেও কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাইনি এখন পড়ছি অর্নাস ২য় বর্ষে ন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটিতে , আর অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্র হওয়াতে কোন কিছুই এখনো আমার কপালে জুটলো না । তাই যখন যা পাই তাই করি , আমার কিছু বন্ধু-বান্ধবী আছে ওরাই আগে এই রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলো ওদের কথামতই আমিও যোগ দেই । তাতে আমার জন্য ভালোই হয়েছে ।
আজ মা আমার প্রিয় “ তেল কই “ রান্না করেছে । অনেক দিন পর আমাদের বাসায় কই মাছ রান্না হচ্ছে , বাবা কাল বেতন পেয়েছে হয়তো তাই এই আয়োজন ! তা না হলে মাছ মাংস খুব কম-ই খাই আমরা । দুপুরের খাওয়া টা খুব তাড়াতাড়ি সেরে বের হতে হবে আমার । আমাকে তো সংসদ ভবন এড়িয়াতে বিকাল ৪.৩০ টার মধ্যে পৌছাতে হবে ।
বিকাল ৪ টা আমি বের হবো বলে মাকে ডাকলাম , মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম মা আজ অনেক বড় একটা কাজ করতে যাচ্ছি দোয়া করো । মা বললো জয়ী হও । বাসা থেকে বের হলাম হঠাৎ কেমন যেন একটা খারাপ অনুভূতি কাজ করছে কেমন যেন লাগছে । খুব বেশি অস্থির লাগছে ! আমি আমার দায়িত্বের জায়গাতে পৌছে গিয়েছি ততক্ষনে । তবুও যেন স্থির হতে পারছি না । নিজের মধ্যে কেমন যেন অজানা এক ভয় কাজ করছে । বিকাল ঠিক ৫.৪০ আমার হাতে থাকা প্রেট্রোল বোমাটি ততক্ষনে সামনে আসতে থাকা “ বাসন্তী পরিবহণ “ গাড়িটিকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়েছে ! আমি আর ওখানে দারাতে পারনি দূরে সরে গিয়েছি ! কেমন যেন হাপাচ্ছি । ওখান থেকে চলে গেলাম আমাদের অফিসে টাকা পেলাম ৩০ হাজার তা নিয়ে বাড়ি চলে এলাম । টাকা টা হাতে পাবার পরও আমার কোন শান্তি নেই ! বাড়ি আসার পর আমার রুমে চলে গেলাম , চুপ করে বিছানায় শুয়ে আছি । খুব খারাপ লাগছে আগুনে জ্বলতে থাকা সেই বাসটির দৃশ্য শুধু আমার চোখের সামনে আসতে থাকলো আর আমাকে যেন অসাড় করে ফেলতে থাকলো । এর মধ্যে কয়েকবার বমিও করেছি , খুব অসস্থি বোধ হচ্ছে ।
বিকাল গড়িয়ে রাত হচ্ছে । মা এলো আমার ঘরে , বললো আমার কি হয়েছে অসুস্থ্য নাকি , বললাম না । মা বললো
ঃ তোর বাবার আজ তো বিকালেই বাসায় আসার কথা ছিলো আর এখন রাত ৯ টা বাজে এখনো এলো না । একটু কল দে তো ।
ঃ আমি কল দিলাম ।
ঃ মা বললো কিরে কল ধরে না ?
ঃ আমি বললাম হয়তো বাবা ব্যস্ত আছেন । তাই মোবাইল বন্ধ আছে , পরে কল দেবো আবার , তুমি এখন অন্য কাজে যাও মা ।
রাত ১১ টার খবর হচ্ছে টিভিতে , হঠাৎ একটি খবর দেখাতে লাগলো এবার সংসদ ভবনের সামনে “ বাসন্তী পরিবহণ “ এ হামলাকারীরা মারলো প্রেট্রোল বোমা । যাতে আহত হয়েছে কম করে ২৫ জন এবং নিহত হয়েছে গাড়ি চালক সহ আরো ১৫ জন যাদের মধ্যে ১০ জনের দেহ গুরুতর ভাবে পুড়ে গেছে তাদের সনাক্ত করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে । খবরটি দেখেই আমি চ্যানেল ঘুড়িয়ে দিলাম ! খুব খারাপ লাগছে নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে । এতো গুলো মানুষ কে আমি মারলাম । তা যেন অচিন্তনীয় আমার জন্য ।
রাত ১২ টা বাবা এখনো বাসায় ফেরেননি । এবার বাবার অফিসের এক আংকেল কে কল করলাম । আংকেল জানালো বাবা অফিস থেকে বের হয়েছে বিকাল ৪.৫০ মিনিট এ তারপর ঐ আংকেল এর সাথে বেশ কিছু সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথাও বলেছেন কিছুক্ষন পর বিকাল ৫.১০ এর “ বাসন্তী পরিবণে “ বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে । কথাটা শোনার পর আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো । আমি বাসা থেকে দৌড়ে বের হলাম প্রথমেই গেলাম ঢাকা মেডিকেলে ওখানে কি মনে করে গেলাম জানিনা ! তারপর ওখান থেকে বাস কাউন্টারে গেলাম বাসন্তী পরিবহণ এর ! যেয়েই জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের কোন গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে তাতে কোন কোন যাত্রী ছিলো তাদের লিস্ট দেখি । লিস্ট দেখতে দেখতে হঠাৎ আমার চোখ ২২ নং পাসেঞ্জারে যেয়ে আটকে গেল “ সবুর হোসেন “ এ তো আমার বাবার নাম ! হে আল্লাহ এ আমার হাত দিয়ে কি হয়ে গেল ! আবার দৌড়ে ছুটে গেলাম ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে । সেখানে বাবাকে কোথায় খুজে পেলাম না । কোথায় তার নাম ও নেই । বাসন্তী পরিবহণের সব আহত রোগীদের সাথে কথা বলতে শুরু করলাম । এক পর্যায়ে “ সাদী “ নামের এক ছেলের সাথে কথা বলতে গেলাম সে বললো বাবা তার পাশেই জানালার সীটে বসা ছিলেন পড়নে একটা সাদা শার্ট ছিলো চোখে মোটা ফ্রেমের কালো চশমা । প্রেট্রোল বোমা ছোড়ার সাথে সাথেই সে নীচে পরে গেলেও বাবা জানালার পাশে থাকার তার উপর-ই প্রভাব টা বেশি পরে । বাবা হয়তো বেঁচে নেই এ বলেই সে অজ্ঞান হয়ে যায় । আমি হাসপাতালের মর্গে চলে যাই ! যেখানে পোড়া কয়লা রুপী লাশ গুলো সাজিয়ে রাখা হয়েছে বেশ যত্নে ! লাশ দেখতে শুরু করলাম কি ভয়ানক দৃশ্য যা কিনা আমার-ই সৃষ্টি করা ! ৩ নাম্বার ট্রলিতে যেয়ে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো আর কিছু চললো না ঐ মুহুর্তে ! এই তো সেই মোটা ফ্রেমের চশমার ঝলসে যাওয়া টুকরো দেখতে পাচ্ছি । আর কিছু বলার অবস্থায় আমি রইলাম না সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে গেলাম , চোখ খুলে দেখলাম আমার মা বসা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে সে আর আমার পুরো পরিবার যে কান্না কিনা আমার-ই সৃষ্টি করা । বিকালে সেই প্রেট্রোল বোমা টা যা কিনা আমার এই হাত দিয়েই মেরেছি তা আর কারো না আমার বাবা বসে থাকা বাসেই মেরেছি ! বাবার লাশ নিয়ে বাসায় এলাম সবাই , সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছে আমার কান্না আর জোড়ে প্রকাশ করতে পারছি না । আমার মাকে ততক্ষনে নাকফুল বিহীন করে দেওয়া হয়েছে , পরণে পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সাদা বসন ! আমার বাবার লাশ দাফন হলো ।
আমি বাসায় এলাম । কাঁদতে কাঁদতে আমার মায়ের পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে থাকলাম আর চিৎকার করে বলতে থাকলাম মাগো তোমার এই সাদা বসন আমার-ই উপহার দেওয়া , কারণ এই আমি–ই যে আমার বাবাকে খুন করেছি । খুন করেছি বেশ কিছু প্রানের । এ প্রেট্রোল বোমা আমার-ই মারা ছিলো মা , অন্যের ক্ষতি করতে করতে আজ নিজের জীবনের সব থেকে মূল্যবান মানুষ টিকেই নিজের হাতে শেষ করে দিলাম মা ! মাগো আমি যে তোমার সন্তান নামের ও অযোগ্য মা
বিঃ দ্রঃ বর্তমান পরিস্থিতির উপরেই ভিত্তি করেই আমার এই লেখাটা , এখানে কোন দলকে আমি উল্লেখ করিনি শুধু মাত্র যারা প্রেট্রোল বোমা মেরে মানুষ মারছে তাদের কে নিয়ে কথা বলেছি ! তাদের একটা কথা মনে রাখা উচিৎ যে “ আজ আমি অন্যের পরিবারের ক্ষতি করছি কে জানে কাল হয়তো কেউ আমার পরিবারের ক্ষতি করবে বা আমি-ই আমার পরিরের ক্ষতির কারণ হবো ঠিক এমন করেই ! “
***অনেক দিন পর একদমই ভিন্নধর্মী একটা বাস্তবধর্মী গল্প লেখার চেষ্টা করেছি , জানিনা কেমন হয়েছে যদি একটু ভালো লাগে তাহলে লেখাটা স্বার্থক হবে । তাই বন্ধুরা পড়ে জানালে খুশি হবো , কেমন লাগলো তোমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটের লেখা এই ভিন্নধর্মী গল্পটি ? গল্পটিকে কোন রাজনৈতিক আলোচনায় না জড়ালেই খুশি হবো ।
©somewhere in net ltd.