নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ছন্নছাড়ার আবোল-তাবোল

ইমরান নিলয়

পকেটে কিছু খুচরো স্বপ্ন নিয়ে নিজেকে জানার চেষ্টায় আছি। মাঝে মাঝে শব্দ দিয়ে দাগাদাগি করি। অসামাজিক।

ইমরান নিলয় › বিস্তারিত পোস্টঃ

ছোটগল্পঃ দ্য সার্কেল

২২ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:১২

আশফাক মতিন সাহেব একবার আকাশের দিকে চেয়ে নিয়ে চোখ পিট পিট করলেন। মেঘলা আকাশ। সাতসকালে মন খারাপ করে দিতে যথেষ্ঠ। বিষন্ন দিনগুলোর শুরুটা বোধহয় এভাবেই হয়। রাতে ভালো ঘুম হয়নি তার। অনেকদিন ধরেই হয় না। রাতভর এপাশ-ওপাশের পর শেষরাতে তন্দ্রামত লেগে আসে। ঘুমিয়েও পড়েছিলেন বোধহয়। কুৎসিত একটা স্বপ্নে সেই ঘুমের মৃত্যু হয়। স্বপ্নটা কালো ছিল।



তিনি কবর খুঁড়ছিলেন। হাতে কোদালজাতীয় কিছু। স্পষ্ট না ঠিক। পাশে খাটিয়ায় লাশ রাখা। শুভ্র কাফন উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে। নিকষ অন্ধকারে ইতস্তত উজ্জ্বলতা। খুঁড়তে খুঁড়তে একসময় কবরের বেশ গভীরে চলে গেলেন আশফাক সাহেব। থপ থপ শব্দে কোদাল চলতে থাকে।

তখন তিনি বুককবরে। অন্ধকারের মাঝেও অন্ধকার। গায়ের ওপর আচমকা একদলা মাটি এসে পড়ায় আশফাক সাহেব কবর খোঁড়া থামিয়ে অবাক হয়ে উপরের দিকে তাকালেন। খাটিয়ায় থাকা লাশটা উঠে এসেছে। দাঁড়িয়ে আছে কবরের পাশে। সাদাকাফনে জড়ানো লাশটা পাশের স্তুপ করে রাখা মাটি দিয়ে কবরটা ঢেকে দিতে চাইছে। বৃষ্টির মত ঝুরঝুর মাটি এসে পড়ছে আশফাক সাহেবের মাথায়, শরীরে। তিনি কোদাল হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন। যেন সামান্য নড়ার শক্তিও শরীরে অবশিষ্ট নেই। সাদা কাফনের ফাঁক দিয়ে মৃতদেহের অর্ধমৃত মুখের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে শুধু। আশফাক সাহেব মন্ত্রমুগ্ধের মত অতিপরিচিত চেহারাটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার গা শিরশির করে উঠল। সারাজীবনভর এই চেহারাটা তিনি বহুবার দেখেছেন। কারনে-অকারনে দেখেছেন। তার নিজের চেহারা।



ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পরও আশফাক সাহেব হাঁপাতে লাগলেন। নিঃশ্বাসের তালে তালে তার বুক দ্রুত ওঠানামা করে। মাটি কাটা বেশ পরিশ্রমের কাজ। স্বপ্নে হোক বা বাস্তবে। ভয়ঙ্কর দৃষ্টিটা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। শীতল দৃষ্টিটা চোখে লেপ্টে আছে। চোখ বন্ধ করলেই গা শিরশির করে উঠছে। এই বুঝি আবার ফিরে গেলেন কবরটাতে।



তিনি জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালেন। তুলার মত মেঘ ভাসছে। এইবার বৃষ্টি এলে হয়। গরমে জীবন এখন যায়- তখন যায় অবস্থা। গত কয়েকদিনের ভ্যাপসা গরম আর সহ্য হচ্ছে না। এইবার খুব বৃষ্টি চাই। আকাশ কালো করা ঝুম-ঘুম বৃষ্টি।



আশফাক সাহেব কি মনে করে খানিক ঝুঁকে খাটের নিচ থেকে একটা কালো ট্রাঙ্ক বের করে আনলেন। পুরনো আর মলিন একটা লোহার অবয়ব। যেন সুপ্রাচীন কোন দানব কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার উপরে ধূলার পুরু স্তর জমে শক্ত হয়ে আছে। লোহার ডালার উপর সাদা হরফে আশফাক মতিন সাহেবের নাম লেখা। সেটাও ধূলার আড়ালে চলে গেছে। খেয়াল করে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।

আশফাক সাহেব সাবধানী হাতে লোহার ডালা উঁচু করে ধরেন। দেখে মনে হতে পারে বাক্সটা লোহার না হয়ত; কাচের তৈরী। তবে সত্যি হল যে সেটা লোহা দিয়েই মোড়ানো; অন্যকিছু না। কারন ডালা উঁচু করে ধরার সময় অপুষ্ট লোহা প্রানপনে ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে প্রতিবাদ জানায়। যদিও তা যথাযথ কতৃপক্ষের কানে খুব একটা সুবিধা করতে পারে না।

ট্রাঙ্কের ভেতর সারি সারি জিনিসপত্র সাজানো। নানারকম, নানারঙের। একটা ছাতা, কিছু কাপড়, দু'টো রুলটানা সবুজ খাতা, একটা কালচে ডায়রি, কয়েকটা শীষভাঙ্গা পেন্সিল, একটা আধভাঙ্গা আয়না এবং আরো নানাকিছু। সবকিছুই অতীতের স্বাদ জড়ানো। রুগ্ন আর জরাক্রান্ত।



আশফাক সাহেব বসে আছেন জানালার পাশে। তার হাতে খাতা আর কালচে ডায়রিটা। ধূলোমাখা আর মলিন। যেন মহাকালের স্বাক্ষ্য দিচ্ছে। তিনি ধীরে ধীরে ডায়রির পাতা উল্টিয়ে চলেন। কোনকিছু খোঁজেন হয়ত। বা হয়ত খোঁজেন না। এম্নিই দৃষ্টি মাখেন মুমূর্ষু পৃষ্ঠাগুলোতে।

খানিকপর আশফাক সাহেব যখন ডায়রিটা খাটের উপর নামিয়ে রাখলেন তখন তার হাতে পুরনো একটা খাম ধরা। প্রাচীন খামের উপর ময়লা ডাকটিকিট সাঁটানো। পুরনো কোন চিঠি হয়ত। অন্যান্য নমুনার মতো চিঠিটাও বেশ দুর্বল। কালচে বাদামী রঙের খামটা হয়তবা একসময় উজ্জ্বল হলুদ ছিল। অপুষ্টিতে ভুগে ভুগে স্বাস্থ্য হারিয়েছে।



দু'আঙ্গুলের মাথায় চেপে খামের ভেতর লুকিয়ে থাকা চিঠিটা বের করে আনলেন আশফাক সাহেব। শান্ত, আলতো আর যত্নষ্পর্শে। বয়সের যথেষ্ঠ ছাপ স্বত্ত্বেও কাগজটাকে প্রায় তরুনই বলা যায়। যদিও দেখে বোঝা যায় যে অনেকবার পড়া হয়েছে। কাগজের কোনগুলো হলদে হয়ে ক্ষয়ে গেছে।

চিঠিটা বিশেষত্বহীন। কোন দামী প্যাড বা সুগন্ধী কালির অস্তিত্ব নেই তাতে। লম্বা রুলটানা সাদা খাতার এক পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে চিঠিটা। হাতের লেখাও মুক্তোর মত না। বরং শামুক বা ঝিনুকের সাথে তার অনেকটা মিল পাওয়া যায়।



সম্বোধন থেকে বোঝা যায় চিঠিটা তাকেই লেখা।

"বাবা আশফাক,

দোয়া লইও। আশা করি সুস্থ আছ। পরসমাচার এই যে আমরা সবাই আল্লার দয়ায় ভালো আছি। অনেকদিন যাবত বাড়ি আসিতেছ না। পত্রও দাও না বহুদিন। তোমার মা সর্বদা তোমার চিন্তায় অস্থির থাকে। অল্পতেই অস্থির হইয়া যাবার তাহার এই স্বভাবের কথা নিশ্চয়ই তোমার অজানা নয়।"



অল্পতেই চিন্তায় অস্থির হয়ে যাওয়াটা মায়ের পুরনো স্বভাব। বাবার হয়ত ফিরতে দেরি হচ্ছে। মা অস্থির হয়ে পায়চারী করতেন। 'দেখতো বাবু। কে যেন দরজা ধাক্কালো মনে হয়।' বলে নিজেই একটু পরপর ছুটে যেতেন দরজার কাছে। দরজায় কেউ থাকত না। মা ফিরে আসতেন আরো বিবর্ন হয়ে। যেন বড় কোন সর্বনাশ হয়ে গেছে।

একদিন স্কুল ছুটির পর আশফাক সাহেব বাড়ি গেলেন না। ওপাড়ায় ধুন্ধুমার ফুটবল খেলে ঘরে ফিরলেন বিকেলের পর। এসে দেখেন চারিদিক থমথমে। মা আধবোজা চোখে বিছানায় শুয়ে আছেন। আর বাবা মাথার কাছে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করছেন। তার চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মা। ভাগ্য ভালো যে বাবা ঘরে ছিলেন। আশফাক সাহেব সেদিন মনে মনে আকাশের তারা গুনছিলেন- আজ পিঠে বস্তা বাঁধতে হবে। পরে অবশ্য বাবার মারের হাত থেকে মা-ই বাঁচিয়েছিলেন। বেচারী মা।



বাড়ি যাওয়া হচ্ছিল না অনেকদিন। আশফাক সাহেব তখন নতুন একটা ব্যবসা দাঁড় করাতে ব্যস্ত। চাইলেই কি আর যাওয়া যায়। একটা চিঠিও দেওয়া হয়ে ওঠে নি। এর জন্য অবশ্য ব্যস্ততার চেয়ে অবহেলার দায় বেশি। ভেবেছিলেন একটু গুছিয়ে নিয়েই যোগাযোগ করবেন। কিন্তু দিন দিন সময় ছোট হয়ে আসে। সত্যি বলতে, মায়ের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন প্রায়। আশফাক সাহেব মনে মনে লজ্জিত হন। খুব অনুশোচনা হয়। সুযোগ থাকলে এখন মায়ের কাছে গিয়ে বসে থাকতেন; নড়তেন না। কিন্তু সেই সুযোগ নেই। মা চলে গেছেন অনেকদিন হল। এখন আর কেউই শুধু শুধু তার জন্য অস্থির হয় না। মানুষ খুব অদ্ভুত প্রানী। প্রচন্ড ভালোবাসাটাকে অবহেলা করে অবলীলায়। আর সময়ের পর 'দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বোঝা যায় না' নামক প্রবাদখানা আউড়ে আউড়ে মুখে ফেনা তোলে।

আশফাক সাহেব শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে থাকেন। অনেকদিনপর মায়ের চেহারাটা মনে পড়ে তার। ঝাপসা হতে হতে মুখখানা প্রায় মুছেই গিয়েছিল। শ্যামলাবরন রোগা দুটি হাত। মাথায় একহাত ঘোমটা টেনে রাখা মায়া মায়া মুখে অকৃত্রিম আর গোছানো সরল হাসি। মমতায় ডোবানো চোখদুটোতে অদ্ভুত রকমের উজ্জ্বলতা।



বাইরে অন্ধকার জমাট বাঁধছে। বাতাসে জলের গন্ধ। প্রকৃতির মনে চাপা খুশির আভা। যেন সদ্য প্রেমে পড়া কোন তরুণী আপ্রান চেষ্টা করছে ভেতরের খুশিটাকে বশে রাখতে। কিন্তু আনন্দ বশ মানছে না।

'নামুক বৃষ্টি। সবকিছু লন্ডভন্ড করে বৃষ্টি নামুক'।

আশফাক সাহেব আবার হাতের চিঠিটার দিকে নজর দিলেন।



"আমি আল্লাহর দয়ায় ভালো আছি। তবে ইদানীং হাঁপানির টান বাড়িয়াছে। মকবুল ডাক্তার একবেলা করে চা পান করিতে বলিয়াছে। চা নাকি কফের জন্য ভালো। আর আরো কিছু ঔষধের নামও লিখিয়া দিয়াছে। কিনিব কিনিব করিয়া কেনা হইতেছে না। সময় করিয়া কিনিয়া নিব। আমার জন্য চিন্তিত হইও না। সবই বয়সের ফাঁকি।"



বাবা। জীর্ন শরীর। হাঁপানির টান উঠলে দেহটা আরো চুপসে যেত। বুকটা হাঁপড়ের মতো উঠা-নামা করত ঘনঘন। বাবাকে তখন একটা খেজুর গাছের মত লাগত। অল্পকয়টা ডাল মাত্র। বাতাসে কেঁপে যায় তির তির করে।

মা যতটা বাড়াবাড়ি রকমের আবেগ দেখাতেন বাবা ছিলেন ঠিক ততটাই নিষ্পৃহ। ভদ্রলোক একটা দূরত্বে বাস করে গেছেন আজীবন। অসীম ভালোবাসা নিয়ে নির্লিপ্ত থাকতে পারাটা সহজ ব্যাপার না; বেশ কঠিন কাজ। আশফাক সাহেব কখনোই এই শূন্য অনুভূতির কারন বুঝতে পারেন নি। কিছু কিছু মানুষ থাকে, তারা সমুদ্রভালবাসা নিয়েও মরুভূমির জীবন কাটায়।



বাবা ঔষধ না কেনার জন্য নিজের অলসতার কথা বলেছেন। যদিও আশফাক সাহেব জানেন সেটাই একমাত্র কারন ছিল না।

বাড়িতে অনেকদিন টাকা-পয়সা পাঠানো হচ্ছিল না। পাঠাবেন কি। তখন তার নিজেরও বেশ খারাপ অবস্থা। হাতে টাকা নেই। নাজনীন আর একমাত্র ছেলেটাকে নিয়ে কোনমতে টিকে থাকা। বেঁচে থাকা। মাঝে মাঝে সময়রা খুব নির্দয় হয়। মানুষকে হাতে-কলমে স্বার্থপরতা শেখায়, কখনো কখনো আপন ছায়ার সাথেও। দুভার্গা মানুষ; নিয়তির নিয়ত অস্থিরতা।

ভেতরকার লজ্জায় আশফাক সাহেবের মাথা হেঁট হয়ে আসে। লজ্জার চেয়ে কষ্টটা বেশি। মানুষের মাঝে মাঝে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার ক্ষমতা থাকলে ভালো হত।



"রানুর জন্য একটা সমন্ধ আসিয়াছে। আগামী সপ্তাহে তারা রানুকে দেখিতে আসিবে। ছেলে সরকারী চাকুরী করে। দেখিতে-শুনিতেও খারাপ না। ছেলের এক মামা হাইকোর্টের উকিল। সবমিলিয়ে ভালই। তুমি উপস্থিত থাকিলে খুব ভালো হইত। মেয়েটাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়।"



ছেলেটা ভালো ছিল না। অমানুষ ছিল। আর ছিল নানাপদের বদ অভ্যাস। বিয়ের পর থেকেই রানুটার সাথে ভয়ানক খারাপ আচরন করতে শুরু করল। গায়েও হাত তুলতো হয়ত। রানু মুখ ফুটে কখনো কাউকে কিছু বলে নি। কিছু কথা থাকে, কাউকে বলা যায় না। একাএকাই পুড়ে যাওয়া। মেয়েটার ভাগ্য অবশ্য ভালো ছিল। বেশিদিন এ অত্যাচার সহ্য করতে হয় নি। আড়াই বছরের মাথায় পৃথিবীর উপর ভীষন অভিমানেই হয়তবা অন্য কোন পৃথিবীতে আশ্রয় নিল বোনটা।

সেদিনের ছোট্ট রানু। গোলগাল শুকনো মুখ। গালদু'টো ফোলা ফোলা । হাসলে ফোকলা ফোকলা দাঁত দেখা যায়। বোনটার জন্য আশফাক সাহেবের বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। অস্পষ্ট ভেজা চোখে জানালার বাইরে তাকান। সবকিছু ঝাপসা লাগে।



"রাসেল কতটুকু বড় হইয়াছে? সে কি এখন কথা বলিতে পারে? দাদুকে অনেকদিন দেখি না। তার জন্য অনেক আদর ও স্নেহ রইল।"



ছোট্ট রাসেল ততদিনে অনেকটুকুই বড় হয়ে গেছে। নতুন নতুন দাঁত উঠছে। রাজ্যের জিনিসপত্র মুখে ঢুকিয়ে ফেলত। আর হাতের কাছে যা কিছু পাওয়া যায় ছুঁড়ে ফেলত জানালা দিয়ে। নরম মুখে আধো আধো কথা ফুটছে তখন। আশফাক সাহেবকে 'বা বা' ডাকে। আদর দিতে বললে লোল দিয়ে গাল ভিজিয়ে দেয়। আর পাখি দেখলেই 'ফা ফা' করে করে অস্থির হয়ে যায়।

ঝাপসা চোখেই আশফাক সাহেবের ঠোঁটে একটা অপুষ্ট হাসি খেলে যায়।



এইত সেদিন ছোট্ট রাসেলটা বড় হয়ে গেল, পড়াশুনা শেষ করে একটা বিয়েও করে ফেলল। বাবা বেঁচে থাকলে সেদিন খুব খুশি হতেন। রাসেল একটা পরীর মত মেয়ের পাশে বসে আছে- দৃশ্যটা তার জন্য বেশ উপভোগ্য হওয়ার কথা। কুঁড়িফুলো কত তাড়াতাড়ি ফুল হয়ে যায়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো হাতের চিঠিটাতে ডুবে যান আশফাক সাহেব। দীর্ঘশ্বাসগুলো আজকাল বড় বেশি দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। বিস্তৃত হাইওয়ের মত। পিচঢালা বুক বেয়ে নেমে আসে।



"বৌমা কেমন আছে? তাহার শরীর কি সারিয়াছে? না সারিলে অতিশীঘ্রই ডাক্তার দেখাইও। কোন রোগকেই হেলা করিতে নাই। ছোট ছোট ব্যাধিই অবহেলায় ভয়ংকর হইয়া উঠিতে পারে। ঢাকায়তো অনেক বড় বড় ডাক্তার আছে। খোদার রহমতে সব ঠিক হইয়া যাবে। তাহাকে আমার দোয়া ও স্নেহ দিও।

আর কি লিখিব? ভালো থাকিও। সুখী হও।

ইতি--

তোমার পিতা"



বুকের ভেতরতায় প্রচন্ড শূন্যতা অনুভব করেন আশফাক সাহেব। শুকনো কাগজের ভেলায় চেপে অতীত তার চকচকে দাঁতের চিহ্ন রেখে যায় বুকের ভেতর।

নাজনীনের শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। মাঝেমাঝেই মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা করত। দুই-তিনদিন পর্যন্ত স্থায়ী হত। সেটা যে ব্রেইন ক্যান্সারের লক্ষন কেউ বুঝতে পারে নি। যখন বুঝেছিল তখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। শক্ত করে হাতদু'টো ধরে রাখা ছাড়া আশফাক সাহেবের আর কিছুই করার ছিল না। ডাক্তার বলেছিলেন সময় হয়ে এসেছে। আর মাত্র অল্প ক'টা দিন।

আশফাক সাহেব রাত-দিন নাজনীনের বিছানার পাশে পরে থাকতেন। কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। মৃত্যুর ক্ষমতা কি মানুষের চেয়ে বেশি। তাতে অবশ্য লাভ হয় নি। বৌটা চোখের নিচে কালি আর মুখে এক চিলতে অভিমানী হাসি নিয়ে দিন দিন বিছানার সাথে মিশে গেল। আশফাক সাহেব একবুক অনন্ত শুন্যতাকে পোষ মানিয়ে বেঁচে রইলেন।



একজোড়া চোখ বেয়ে টাপুর-টুপুর অশ্রু নামে। চিঠিটাকে তিনি শক্ত করে বুকের কাছটায় ধরে রাখেন। যেন চিঠিটা শুধু একটা কাগজের টুকরা না- এটারও প্রান আছে। যেন এটা একটা পাখী। হাতের মুঠো শিথিল হলেই উড়ে চলে যাবে। অনেক হারানোর জীবনে চিঠিটাই যে তার একমাত্র সাথী। এই দুঃখচিহ্নটা হারাতে চান না তিনি। কখনোই না। নিঃশব্দ কান্নার দমকে আশফাক সাহেবের দেহটা কেঁপে কেঁপে ওঠে। আর অস্পষ্ট গোঙ্গানির ভীরু শব্দ ভেসে চলে কোন এক অজানার পথে।



বাইরে তখন ঝুমঝুম বৃষ্টি নেমেছে। জলসৈনিকেরা মার্চ করার ভঙ্গীতে ছপ ছপ শব্দে আছড়ে পড়ছে কালো মেঘেদের দেশ হতে। তার কয়েকফোটা আশফাক সাহেবের কাছে ছিটকে আসে পরম মমতায়। আর পাশের খোলা জায়গাটা বিক্ষত হতে থাকে। আঙ্গিনার একপাশে ভিজতে থাকা নামফলকটা অপার্থিব অন্ধকারে ডুবেও জ্বলজ্বল করে কুকুরের চোখের মত।

'ভরসা বৃদ্ধাশ্রম'।

মন্তব্য ২৬ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১২:৩৩

খেয়া ঘাট বলেছেন: আঙ্গিনার একপাশে ভিজতে থাকা নামফলকটা অপার্থিব অন্ধকারে ডুবেও জ্বলজ্বল করে কুকুরের চোখের মত।
'ভরসা বৃদ্ধাশ্রম'।
ডিটেইলস গল্প। অনেক ভালো লেগেছে।
+++++++++

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৫২

ইমরান নিলয় বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ জানবেন। পছন্দের গল্পকারের এমন মন্তব্য সাহস দেয়।

২| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ২:২১

শিব্বির আহমেদ বলেছেন: কেন যেন চোখ ভিজে যায় ।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৫০

ইমরান নিলয় বলেছেন: লেখাটা যদি এতটাই ছুঁয়ে দিতে পারে তাহলেই লেখার স্বার্থকতা বেশি। ধন্যবাদ

৩| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ৯:০৮

মাসুম আহমদ ১৪ বলেছেন: হুমমম, লাইফটা সার্কেল!

এক দিন হয়ত রাসেল মিয়াও সেই সার্কেলের মধ্যে পড়ে যাবেন !

গপ ভালা লাগছে

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৪৭

ইমরান নিলয় বলেছেন: এইটাই নামকরনের পয়েন্ট ছিল। অনেক ধন্যবাদ মাসুম ভাই। :)

৪| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:০৪

কান্ডারি অথর্ব বলেছেন:


লেখায় প্রাঞ্জলতা আছে। গল্প ভাল লাগল।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৪৫

ইমরান নিলয় বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ, প্রাঞ্জল লেগেছে জেনে ভালো লাগল

৫| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:১১

অপর্ণা মম্ময় বলেছেন: তুমি নিয়মিত লেখো না কেন বলো তো ?

কালকে অর্ধেক পড়েছিলাম গল্পটা ! আজ বাকিটুকো।

আশফাক সাহেবের বাবার জন্য ভেতরটা ভার ভার লাগছে। এরকম অনেক বাবাই আছেন আমাদের আশেপাশে।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৪৪

ইমরান নিলয় বলেছেন: আসলে আপু লেখার স্পীড খুবই কমে গেছে। একবসায় আর আগের মত লেখা হয় না। আর একবসায় না হলে আরো অনেক বসা লাগে।

অবহেলা আর অনাদরে পড়ে থাকে তারা।

৬| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:৩৮

শরৎ চৌধুরী বলেছেন: বেশ বেশ।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৩৯

ইমরান নিলয় বলেছেন: ধন্য ধন্য

৭| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:১১

মামুন রশিদ বলেছেন: মাসুম আহমদ ১৪ বলেছেন: হুমমম, লাইফটা সার্কেল!

এক দিন হয়ত রাসেল মিয়াও সেই সার্কেলের মধ্যে পড়ে যাবেন !


চমৎকার লিখেছেন ।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৫৩

ইমরান নিলয় বলেছেন: ধন্যবাদ মামুন ভাই। আপনার সংকলনে জায়গা পাওয়ার লোভটাও লিখতে প্রেরনা যোগায়।

৮| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:২৯

অরুদ্ধ সকাল বলেছেন:
যতটুকু পড়লাম
বেশ!

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৩৬

ইমরান নিলয় বলেছেন: শুভকামনা

৯| ২৩ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১১:৪৮

প্রোফেসর শঙ্কু বলেছেন: সাবলীল লেখা। অনুসরণে নিলাম।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৩৩

ইমরান নিলয় বলেছেন: এধরনের কমেন্টের রিপ্লাই কি হয় কে জানে। ধন্যবাদ ধন্যবাদ।

১০| ২৪ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১২:১৬

মোঃ ইসহাক খান বলেছেন: ছোটগল্প হিসেবে দারুণ।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:২৯

ইমরান নিলয় বলেছেন: ধন্যবাদ লেখক

১১| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:৫০

হাসান মাহবুব বলেছেন: মন খারাপ করা গল্প। ফিনিশিংটা চমৎকার।

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:১৪

ইমরান নিলয় বলেছেন: দ্য গ্রেট হামা ভাইয়ের এমন মন্তব্য সত্যিই বেশি অনুপ্রেরনাদায়ক

১২| ২৬ শে জানুয়ারি, ২০১৪ রাত ১০:৩৪

না পারভীন বলেছেন: খুব প্রাণবন্ত দুঃখের গাঁথা । :(

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ২:১১

ইমরান নিলয় বলেছেন: ধন্যবাদ আপু

১৩| ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৪৮

অরিত্র অন্বয় বলেছেন: চমৎকার লাগলো গল্পটা। বেশ..

০৪ ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ দুপুর ১:৪৫

ইমরান নিলয় বলেছেন: ধন্যবাদ জানবেন..

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.