নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রাজনীতি বিশ্লেষণ

আমি কার পক্ষে নই, আমি সেই পক্ষে, যে পক্ষে ঘুমিয়ে আছে ৩০ লক্ষ শহীদ

রাজনীতি বিশ্লেষণ

এই সমাজ পচা গলা এই সমাজ ভাঙতে হবে। ভাঙতে গেলে লড়াই হবে। সেই লড়াই এ জিততে হবে।সমাজের প্রত্যেকটি অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য আমার উপর ও সে দায় পরে।

রাজনীতি বিশ্লেষণ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মাদ্রাসা শিক্ষা সমাচার। পর্ব-৪

২৪ শে জুন, ২০১৩ দুপুর ২:৩৮

আহমদ ছফা ১৯৮০ সালের গণকন্ঠে বলেন, “মূল সন্ধান করলে দেখা যাবে যে, মাদ্রাসার ছাত্ররা আসে অধিকাংশই বিত্তহীন এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণী থেকে। স্কুল-কলেজের যে সকল ছেলেমেয়েরা টাকাপয়সার অভাবে ভর্তি হতে পারে না, অথচ মনে জ্ঞানের প্রতি তীব্র, তীক্ষ্ণ আগ্রহ রয়েছে তারা মাদ্রাসায় ভর্তি হয়। আর যে সকল মা-বাবা ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে পড়াবার খরচ যোগাতে পারে না, তারা বাধ্য হয়েই ছেলেকে মাদ্রাসায় ভর্তি করায়। কেননা ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা মাদ্রাসাগুলোতে জাকাত, দান, ছদকা ইত্যাদি দিয়ে থাকেন। সেই অর্থেই ছাত্রদের লেখাপড়া চলে।... মাদ্রাসার ছাত্রদের কোন প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, কোন ছাত্রসংগঠন নিজেদের সঙ্গে একাত্ম করে গ্রহণ করেনি। তার ফল এই হয়েছে যে, মাদ্রাসার ছাত্ররা প্রগতিশীল রাজনৈতিক এবং ছাত্র-আন্দোলনের পথে ভারসর্বস্ব একটি প্রবল বাধা হয়ে সার্বক্ষণিকভাবে বিরাজ করছে। ধরে নিলাম, এখানে একটা সামাজিক বিপ্লব হয়ে গেল। মনে করলাম, মাদ্রাসা ছাত্ররা তার বিরোধিতা করল না। তারপরেও সেই বিপ্লব কোন মঙ্গলজনক সামাজিক পরিবর্তন আনতে পারবে না।”



কেন পারবে না সে কারণটা আমরা সবাই জানি। ১৯৮০ সালে ছফাও তাই বলছেন, “কেননা, আমাদের সমাজে সাধারণ শিক্ষার চল খুব একটা হয়নি। ধর্মীয় সংস্কার এখনো অনেকগুলো ক্ষেত্রেই সমাজের সাংস্কৃতিক জীবনপ্রবাহকে মুখ্যত নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। ...ধর্মকে মূলধন করে যারা রাজনীতি করে তারা সমাজের অন্তর্বর্তী কাঠামোতে অনগ্রসর চিন্তা-চেতনার দিক থেকে পশ্চাদপদ জনগণের কুসংস্কারকে ব্যবহার করে সব সময়ে প্রগতির পথে অন্তরায় হয়ে টিকে রয়েছে।...এ দেশের তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরাও মাদ্রাসা শিক্ষিত মানুষদের প্রতি এমন একটা নাকসিটকানো দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে যে তাকে কিছুতেই সঙ্গত এবং মানবিক বলা যেতে পারে না। এই মনোভাব মারাত্মক। এটা দেশের জন্য খুব খারাপ পরিণতি বহনকরে নিয়ে আসবে।...প্রগতিশীল বলে কথিত কোন রাজনৈতিক দল তাদের জীবন-জীবিকা এবং দেশের সমস্যা নিয়েআলাপ, আলোচনা করেনি। মাদ্রাসার ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সংগঠন তৈরী করে আধুনিক রাষ্ট্র এবং সমাজদর্শনের চেতনা তাদের মধ্যে সঞ্চারিত করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি।... যেহেতু মাদ্রাসাসমূহের পরিবেশটাই এমন যে, সেখানে কেউ কোন পেশাগত বুৎপত্তি অর্জন করতে পারে না। হাওয়াটা এমন, মধ্যযুগীয় যে ছাত্ররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে অন্যকোন পেশা বা বৃত্তিতে যোগ্যতা অর্জন করবেন সেকথা চিন্তাও করতে পারেন না।” ধর্মীয় শিক্ষার নামে এই বিশাল জনসংখ্যার এমন বিপুল অপচয় কেন? এত বৈষম্য কেন? এইসব কি আমাদের চরিত্রগত? সংখ্যাগুরুর এই দেশে মরুদেশের বহিরাগত ধর্ম, ধর্মীয় ভাষা, সংস্কৃতির সাথে মাতৃভাষা বাংলা এবং মাতৃভূমি বঙ্গদেশের আবহমান কালের সংস্কৃতির দোটানা, সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের সংকট আজও কাটে নাই। মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়া এই পটভূমি তৈরীতে চিকনবুদ্ধির ইংরেজ সাম্রাজ্য যতটা দায়ী, এই প্রেক্ষাপট টিকিয়ে রাখার দায়ে আমরা নিজেরা আরও বেশী দায়ী। যার জন্য ঠিকই জন্ম নিয়েছে নবতর শ্রেণীসংঘাত, অর্থনৈতিক সমস্যা, দারিদ্রপীড়িত লোকের কাছে শিক্ষা হয়েছে ব্যয় বহুলতার কলংকে কলংকিত। মাদ্রাসা শিক্ষার এই হালের ঐতিহাসিক কারণ খুঁজতে একটু পিছে তাকানো জরুরী। পিছে তাকানো আসলে সবসময়ই জরুরী।



ড.আবুল বারকাতের পরিচালিত জরিপের একটি কৌতূহলোদ্দীপক তথ্য উদ্ধৃত করা হল। সারাদেশ থেকে দৈবচয়নের ভিত্তিতে নির্ধারিত ৬০টি আলিয়া মাদ্রাসা এবং ৬০টি কওমি মাদ্রাসা অর্থাৎ মোট ১২০টি মাদ্রাসার গভর্নিং বোর্ডের সদস্যদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা জরিপ করে তিনি নিম্নোক্ত ক্রমিক গুরুত্বটি পেয়েছিলেন :



প্রথম জামায়াতে ইসলাম সংশ্লিষ্টতা ২৯.১ এবং বিএনপি প্রায় ২৬.৬ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে আওয়ামী লীগ প্রায় ২১.৯ শতাংশ। চতুর্থ_ ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন এবং খেলাফত মজলিস, প্রায় ১০.৭ শতাংশ। পঞ্চম_ জাতীয় পার্টি প্রায় ২.৭ শতাংশ। অন্যান্য প্রায় ৮.৭ শতাংশ।



উদ্ধৃত পরিসংখ্যান থেকে সুস্পষ্ট বোঝা যায়, আধুনিক রাজনৈতিক ইসলামপন্থিরাই তাদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে বর্তমানে অধিকাংশ মাদ্রাসার পরিচালনা পরিষদে নেতৃত্ব প্রদান করছেন। তবে একটি সুখবর হচ্ছে এই যে, এই মৌলবাদী ও আধুনিক ইসলামপন্থিদের সন্তানরা কেউই সাধারণ কওমি বা আলিয়া মাদ্রাসায় পাঠগ্রহণ করেন না। আমরা আবুল বারকাতের তথ্যভাণ্ডারের শরণাপন্ন হলে আরও দেখতে পাব :



১. আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসার যথাক্রমে ৭৬ শতাংশ এবং ৮৪ শতাংশ শিক্ষকেরই প্রধান অভিযোগ বেতনের নিম্ন হার। ড. বারকাতের মতে, এখানে সর্বনিম্ন বেতন হচ্ছে মাসিক ৪৬০০ এবং সর্বোচ্চ মাসিক ১১০০০ টাকা। অন্যদিকে কওমি মাদ্রাসার যেহেতু কোনো বিধিবিধান নেই, সেখানে বেতনের বিষয়টি খুবই নমনীয়। যখন যেমন সংগ্রহ, তখন তেমন বেতন এই ভিত্তিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলো চলে থাকে। ড. বারকাতের তথ্য অনুযায়ী তাদের সর্বনিম্ন আয় মাসিক ১৪৫০ এবং সর্বোচ্চ ৪৫০০ টাকা। লক্ষণীয় যে, ড. বারকাত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকদের আয়ের যে হিসাব দিয়েছেন সে অনুযায়ী নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, তারা প্রায় সবাই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন।



২. এটাও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, এই মাদ্রাসা শিক্ষকরা শিক্ষকতা ছাড়াও অন্যান্য পেশায় জড়িত এবং সেখান থেকেও তাদের পরিপূরক আয় হয়। তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষকদের মোট আয়ের ৫৭ শতাংশ শিক্ষকতা থেকে এলেও ২৩ শতাংশ আয় আসে কৃষি থেকে। পক্ষান্তরে কওমি শিক্ষকদের মোট আয়ের মাত্র ৪৫ শতাংশ আসে শিক্ষকতা থেকে। ৯ শতাংশ আয় আসে ইমামতি করে। কৃষি থেকে আসে ২০ শতাংশ। রেমিট্যান্স থেকে আসে ৪ শতাংশ। অর্থাৎ মাদ্রাসা শিক্ষকদের বহুমুখী জীবনযাত্রা ও আয়ের উৎস রয়েছে।



৩. যদিও মাদ্রাসার এই শিক্ষক গোষ্ঠী আয় বিবেচনায় দরিদ্র বা নিম্ন মধ্যবিত্তের পঙ্ক্তিভুক্ত; কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের মনে করেন সামাজিকভাবে মধ্যবিত্ত স্তরের অন্তর্ভুক্ত। নিজেদের মধ্যবিত্ত বলে বিবেচনা করেন এ রকম শিক্ষকের সংখ্যা আলিয়া মাদ্রাসায় ৬০ শতাংশ ও কওমি মাদ্রাসায় ৪৮ শতাংশ। পক্ষান্তরে নিজেরাই নিজেদের নিম্ন মধ্যবিত্ত মনে করেন এ রকম শিক্ষকের সংখ্যা আলিয়া মাদ্রাসায় ৩৫ শতাংশ এবং কওমি মাদ্রাসায় প্রায় ৩৬ শতাংশ। এ থেকে বোঝা যায় যে, আয় কম হলেও সামাজিক মর্যাদার সিঁড়িতে তাদের অবস্থান অতটা নিচুতে নয়। অন্তত সেরূপই তাদের আত্মবিশ্বাস। এই তথ্যটি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে প্রগতিশীলদের বিবেচনায় নিতে হবে। তারা যেহেতু শিক্ষক এবং দরিদ্র সেহেতু তারাই হবেন গ্রামশির ভাষায় 'গ্রামীণ অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত বুদ্ধিজীবী' Rural Organic Intellectual সুতরাং, গ্রামীণ রাজনীতিতে তাদের বিশেষ প্রভাব থাকবে। বর্তমানে এই সামাজিক শক্তিকে প্রতিক্রিয়াশীলরা ব্যবহার করছে।



এবার আমরা একটু মাদ্রাসার ছাত্রদের দিকে তাকাব। দেখা যাক ড. বারকাতের তথ্য কী বলে :

১. প্রথমত, এই মাদ্রাসা ছাত্রদের মোট সংখ্যা ২০০৮ সালে ছিল ৯৮ লাখ ২৭ হাজার ৭৪২ জন। তাদের মধ্যে গ্রামের মাদ্রাসায় পড়েন ৮৫ শতাংশ। শহরে মাত্র ১৫ শতাংশ।

২. তাদের মধ্যে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়েন প্রায় ৪৬ লাখ, আর কওমি মাদ্রাসায় প্রায় ৫৩ লাখ। অর্থাৎ অধিকাংশ মাদ্রাসার ছাত্রই এসে জমা হয়েছেন 'খারিজি মাদ্রাসা'য়।

৩. আলিয়া মাদ্রাসার ৭১ শতাংশ ছাত্রই ছেলে। ছাত্রী ২৯ শতাংশ। কওমি মাদ্রাসায় ৯১ শতাংশ ছাত্র, ৯ শতাংশ ছাত্রী।

৪. কওমি মাদ্রাসায় ৮৫ শতাংশ ছাত্রই মাদ্রাসার বোর্ডিংয়ে থেকে লেখাপড়া করেন। মাত্র ১৫ শতাংশ ছাত্র বাইরে থেকে এসে পড়েন। পক্ষান্তরে আলিয়া মাদ্রাসায় ৮৯ শতাংশ ছাত্র বাইরে থেকে এসে পড়েন। ১১ শতাংশ হোস্টেলে থেকে পড়েন।

৫. মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের বিচারে তাদের প্রায় ৫১ শতাংশ দরিদ্র শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। ৪৪ শতাংশ নিজেদের মনে করেন মধ্যবিত্ত। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে শিক্ষকদের মতো ছাত্রদের আপেক্ষিক আয় ও সামাজিক পরিচয় হচ্ছে_ দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত।



শাসকশ্রেণী কোণ নৈতিক বোধ থেকে নয় বরং একটা প্রতিক্রিয়াশীল কায়েমি স্বার্থেই মাদ্রাসার প্রসার ঘটিয়ে চলছে। সামরিক স্বৈরশাসনের আমলে মাদ্রাসা বৃদ্ধির হারও তাই ছিল সার্বাধিক। জেনারাল এরশাদের আমলে স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষার সমঞ্জস্য বিধানের নামে ১৯৮৩ সালে মাদ্রাসার এবতেদিয়া স্তরকে প্রাইমারী, ১৯৮৫ সালে অষ্টম শ্রেণীর মানের দাখিলকে এইসএসসি এবং ফাজিল ও কামিল কে যথাক্রমে স্নাতক ডিগ্রির সমমানের করেন।



ব্র্যাকের শিক্ষা গবেষক সমীর কুমার নাথকে মাদ্রাসা বিষয়ে আমি ফিল্ডের অভিজ্ঞতা নিয়েছিল। তিনি কিছুটা আশার আলো দেখতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি দেখলেন,দেশে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী ছেলেমেয়ের সংখ্যা মোটামুটি জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ প্রায় ৩ কোটি ৭৫ লাখ। তাদের প্রায় সবার বর্তমানে মূলধারার প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার বাস্তব সুযোগ থাকায় ৯৫ শতাংশই সেখানে ভর্তি হচ্ছে। মাত্র ৫ থেকে ৬ শতাংশ নানা কারণে মাদ্রাসার ইবতেদায়ি শাখায় ভর্তি হয়।



আসছে শেষ পর্ব............

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.