![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাধারণ মানুষ
যদ্দুর মনে পড়ে, ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে বিদ্যালয়ে একবার বিজয় দিবসের কুইজ প্রতিযোগীতার আয়োজন করা হয়েছিলো। সরকার দলীয় (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) কিছু রাজনৈতিক নেতা কর্মী এসে দুই পাতার কাগজ দিয়ে গেলো। সেখানে প্রশ্ন লিখা। নিচে দাগ টানা খালি জায়গা, সেখানে উত্তর লিখতে হবে। বিষয় তৎকালীন বাংলাদেশ ও স্বাধীনতার ইতিহাস। এক সপ্তাহের মধ্যে উত্তর লিখে জমা দিতে হবে। তখন কম্পিউটারের নাম শুনিনি। ইন্টারনেট তো বহু দূর। তাই গৃহ শিক্ষকের আই কিউ আর মায়ের স্বল্প স্বল্প জ্ঞানই ভরসা। সেখানে একটা প্রশ্ন ছিলো, “স্বাধীনতার ঘোষণা সর্ব প্রথম কে দেন?”
গৃহ শিক্ষকের কাছ থেকে প্রাপ্ত উত্তরে সাথে মায়ের সত্যায়নে লিখলাম “জিয়াউর রহমান”।
বাবা ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মেজাজের দিক দিয়ে বদ রাগি। তাই না পারতে আগে পিছে মাড়াতাম না। কাগজ নিয়ে মায়ের কাছেই সন্তর্পনে আনা গোনা করতাম। সন্তর্পনে আনা গোনা করতে যেয়েই একবার বাবার সামনে পড়ে গেলাম। পড়াশোনা না করে দুই পাতা কাগজ নিয়ে আমি কেন লাফাচ্ছি সাথে ছোট খাটো একটা হুঙ্কার দিয়ে হাতের কাগজটা নিয়ে চোখ বুলাতে লাগলেন। প্রশ্নটাতে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, “ভুল হয়েছে। উত্তর হবে চট্টগ্রামের আওয়ামীলীগের নেতা হান্নান স্বাধীনতার ঘোষণা সর্বপ্রথম দেন। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে। কেটে ঠিক কর।”
আমি ভয়ে ভয়ে সাথে কিছুটা দুশ্চিন্তা নিয়েই কেটে ঠিক করলাম। কারন উত্তর ভুল হলে আর কেটে লিখার মত জায়গা নেই।
গৃহ শিক্ষকও দেখে কিছু বললেন না। আমি পড়লাম আরও দুশ্চিন্তায়। বাবা যদি সঠিক হন তাহলে গৃহ শিক্ষক ভুল এবং উনি আরও কত এমন ভুল করেছেন সেটা ভেবেই দুশ্চিন্তা। বাসার পাসেই এক বাল্য বন্ধুর বাসা। সেও দেখলাম উত্তরে লিখেছে “জিয়াউর রহমান”। এই উত্তর তার মার কাছ থেকে প্রাপ্ত। গেলাম খালাম্মার কাছে। খালাম্মা জানালেন, “তোমার উত্তরও ঠিক আছে কিন্তু সরকারী দলের আয়োজিত প্রতিযোগিতাতো তাই “জিয়াউর রহমান” ই সঠিক হবে।
মোটের ওপর টাশকি খেলাম। রাগটা হচ্ছিল বাবার ওপর। হুদাই আমার উত্তরটা ভুল করালেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উনি কেন জানবেন না সরকারী দলের আয়োজিত প্রতিযোগিতায় সঠিক উত্তর “জিয়াউর রহমান” ই হবে!!!!!
উত্তর জমা দেয়ার দিন, যত জন কে জিজ্ঞেস করলাম সবাই বলল জিয়াউর রহমান। তাদের আত্ববিশ্বাস দেখেও কুই কুই করে কয়েক জনকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম “আওয়ামীলীগের নেতা হান্নান” উত্তর হিসাবে গ্রহণ যোগ্য হবে কিনা।
“হান্নান?!!!!! কোন হান্নান??!!!!। আমাগো ক্লাসের ফোকলা হান্নান??!!”----- সাথে খিক খিকানি হাসি। তারা কেউ হান্নানের নামই শোনে নাই। উল্টা আমাকে নিয়ে এক ঝলক হয়ে গেলো।
যাই হোক স্বাধীনতা, জিয়াউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এই শব্দগুলোর সাথে আমার তখনই প্রথম পরিচয়। ইতিহাস জ্ঞান এতটুকুই। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম। পাঠ্য বইয়ের বাইরে তখন সাধারন জ্ঞান আহরণের আমার নির্ভরযোগ্য মাধ্যমগুলো ছিলো বিটিভি এবং বন্ধুদের যার যার বাসার বড়দের মুখ থেকে শোনা কথা, সব শেষে মা বা গৃহ শিক্ষকের কাছ থেকে চূড়ান্ত যাচাই। কিন্তু তখন আমাদের মায়েরা বিদ্যালয়ের পড়ার বই এর বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়ে বেশি প্রশ্ন সহ্য করতে পারতেন না। তাই আশে পাশে যা যা দেখা বা শোনা যেত আমার ইতিহাস জ্ঞানের ওপর তার প্রভাব পড়তে লাগলো।
আর বিটিভি?
জ্ঞান বুদ্ধি বাড়ন্ত হওয়ার সময় অর্থাৎ ১৯৮৮-৮৯ সালের এ সময়টাতে বিস্ববেহায়া হু মু এরশাদ ক্ষমতায়। টেলিভিশনে ‘পাকিস্থানি হানাদার’ বলা নিষিদ্ধ, শুধু “হানাদার” বলতে হয়। বেশ কয়েকজন কথিত রাজাকার এরশাদের মস্ত্রিসভার সদস্য। তার মাঝেও হুমাউন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকের মাধ্যমে রাজাকার শব্দের সাথে প্রথম পরিচয় ঘটে। তবে তথ্য স্বল্পতার কারনে এর ম্ররমার্থ বুঝিনি। বিটিভির আরেক নাটক “উঠান” এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ মুহুর্তে, স্বাধীনতার ঘোষণা আসার আগেই, হু মু সরকার নাটকটি বন্ধই করে দেয়।
সমাজ বিজ্ঞান বইতে ইতিহাস পড়তাম।ব্রিটিশ বিরোধি আন্দোলন, দুদু মিয়া, ফরায়েজী আন্দোলন, তিতুমীরের বাশের কেল্লা ইত্যাদির সাথে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আধা পাতা। কালো চশমা পরিহিত জিয়াউর রহমান ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক হিসাবে, মওলানা ভাসানী ছিলেন রাজনীতি বিদ হিসাবে আর বীর শ্রেষ্ঠ মতিউর কোণ রকমে ছিনতাই করা পাকিস্থানি বিমান নিয়ে ঝুলে ছিলেন। এতটুকুই।
তাই কালো চশমার জিয়াউর রহমান হন আমার হিরো।
সেনাবাহিনীর বীর যোদ্ধা।সেনাবাহিনীই তো যুদ্ধ করেছে। দেশ স্বাধীন করেছে।সেনাবাহিনীর বাইরে, বাবাদের মত ঠুনকো মুনকো মুক্তি যোদ্ধারা আর কতটুকুই বা করেছে??!!!
শেখ মুজিবের নাম শুনেছিলাম। সাথে এও শুনতাম,
রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার, শেখ মুজিবের মৃত্যুতে মিষ্টি বিতরণ, শেখ কামালের ব্যংক লুট এবং পর স্ত্রী অপহরণ, ভারতের সাথে গোলামীর চুক্তি এবং দেশ বিক্রির অপচেষ্টা, যুদ্ধরত দেশ ছেড়ে পাকিস্থানিদের কাছে স্বেচ্ছা গ্রেফতারী বরন ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরও কিছু মতবাদ তখন শোনা যেত। আমরা মুসলমান। মুসলমান হিসাবে কোন ধরনের দিবস পালন করা আমাদের জন্য গুনহা। অতীতের সব রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে সবাইকে একসাথে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। অতীত ঘেঁটে লাভ কি? রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে যেতে হবে কিন্তু ধর্মিয় বিভেদ পদে পদে মাথায় রাখতে হবে। কারন আমরা মুসলমান।
ডান গালে থাপ্পড়টা পড়ে ২৩ জুন ১৯৯৬ সালে। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামীলীগ সরকার। ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত হলে গায়ের জোরে চাপিয়ে রাখা, বিটিভি তার নির্লজ্জতার চাদর ঝেড়ে ফেলে বের করে আনে বঙ্গ বন্ধুর ৭ ই মার্চের ভাষণ।
“আজ দুখ্য ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি……...।।”
দরাজ কণ্ঠ শুনে বসার ঘরে উকি দিয়ে দেখি বাবা মন্ত্র মুগ্ধের মত টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন। ব্যক ব্রাশ করা চুল সাথে মোটা ফ্রেমের চশমা, পরনে সাদা পাঞ্জাবীর উপরে কালো কটির মত কিছু একটা। বিশাল জন সমুদ্রের সামনে বীরোচিত তর্জনি ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে যেন বজ্র ছুড়ে দিচ্ছেন। সেই বজ্রের আঘাতে জনসমুদ্রের দিকে দিকে উঠছে ঢেউয়ের ফনিত মস্তক। জনতা যেন ফুসে ফুসে উঠছে। “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। জয় বাংলা।”
শেষের জয় বাংলাটা যেন বাড়ি খেয়ে খেয়ে ঘরের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার চম্বুকিয় টানে আমার গায়ের লোম দাড়িয়ে গেছে। গলার কাছে কি যেন একটা দলা পাকিয়ে বসে গেছে। বদরাগী বাবার চোখও যেন ছল ছল করছে। বাবাকে কোন প্রশ্ন করতে আমার কমপক্ষে দুই দিনের প্রস্তুতি লাগতো। কিন্তু এই ভাষণের এমনই গুন মড়ার শরীরও নাড়িয়ে তুলবে। আন্দাজ করতে পারছিলাম তার পরেও মনের অলক্ষনেই কখন প্রশ্ন বেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারি নি। “আব্বা। উনি কে?”
অদ্ভুত গলার স্বরে বাবা জবাব দিলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।”
বাবা সেদিন আরেকটা অদ্ভুত কাজ করেছিলেন। যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা উনার শোকেজ থেকে নিউজ প্রিন্টের কাগজে ছাপা একটি বই বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এর লিখা, “লক্ষ প্রানের বিনিময়ে”। মন্ত্র মুগ্ধের মত পড়ে ফেললাম। ঘোর লাগা চোখে সেই শোকেজ থেকে একে একে বের করে আনলাম, “সত্তর থেকে নব্বই”, “আমি খালেদ মুশাররফ বলছি”, “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে”, “আমি বিজয় দেখেছি”, “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র”, “আমি বীরাঙ্গনা বলছি”, “একাত্তরের দিনগুলি”, “একাত্তরে গণহত্যা ও নারী নির্যাতন”, “রেইপ অফ বাংলাদেশ-অ্যান্থনি মাসকারেনহাস”……………...
পড়ছি আর মরমে মরে যাচ্ছি। কোথায় “কালা চশমা”??!!!! আছেন তিনি আছেন। বিশাল দীঘির বুকে এক বালতি পানির মত তিনি আছেন। আর এতদিন সেই এক বালতি পানিকেই কিনা আমি ভাবতে বাধ্য হয়েছিলাম দিঘী!!!!!!!!
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল, ২১ বছর। এই ২১ বছর কোথায় ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান???!!!! কেন আমি তাকে আমার পাঠ্য বইতে পাই নি? কেন তার মৃত্যু দিবসে ঘটা করে পালন করা খালেদা জিয়ার ২য় জন্ম দিনের কেক কাটা দেখতে হয়েছে? কেন প্রজন্মের চোখে কালো চশমা পরানোর চেষ্টা চলেছে?
আজকে অনেকে বলছেন, ভুয়া মুক্তি যোদ্ধায় তালিকা ভরে গেছে। তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন সেই ২১ বছরে কারা মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নথি ভুক্ত হয়েছিলেন!! এবং তাদের নাম এখনো পর্যন্ত বহাল আছে। যে সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামই পাঠ্য বইতে রাখে নি সেই সরকার সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করবে!! বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন এটা বিশ্বাস যোগ্য?!
মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোন ইস্যুতে ভোট চাওয়ার অধিকার কি তাদের আছে? অন্য যে কোন ইস্যুতে তারা ভোট চাইতে পারেন।অবশ্যই চাইতে পারেন। কিন্তু তারা যখন বলেন, মুক্তি যুদ্ধের চেতনার সঠিক বাস্তবায়ন, ভুয়া মুক্তি যদ্ধার তালিকা বাতিল সর্বোপরি নতুন প্রজন্মের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নথি ভুক্ত “তারা” করবেন, তখন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে ইচ্ছা করে ওই ২১ সাথে আর ও ৬ বছর মোট ২৭ বছর তারা কোথায় ছিলেন, কি করেছিলেন এবং কেন করেছিলেন??!!
এখন বলতে পারেন, ইতিহাস বিকৃতির আরেক নায়ক হু মু এরশাদ সাথে অনেক রাজাকার আওয়ামী জোট সরকারেই তো আছে। এর জবাব টা একটু নোংরা করেই দিতে ইচ্ছা করছে।
আমার জন্ম হয়েছিল রেলওয়ে কলোনিতে। রেলের কর্মচারিদের জন্য ব্রিটিশ আমলের তৈরি সেই সব এক তলা বাড়ি গুলোতে শোচনাগার ছিলো দুই তলা। এক তলায় মুত্র ত্যগের স্থান এর পাশে চার ধাপ সিড়ি ডিঙিয়ে মল ত্যগের স্থান। দুটো ইট মাঝখানে বিশাল ছিদ্রের নিচেই থাকতো একটা আধ কাটা ড্রাম। আমাদের যাবতীয় কর্মকান্ড সেই ছিদ্র দিয়ে ড্রামে জমা হোত। সপ্তাহে একবার মেথর এসে সেই ড্রাম পালটে দিত। মেথর এসে কিন্তু শুধু ড্রামই পালটাতো তার আশে পাসের দেয়ালে লেগে থাকা ছিটা মিটা বা পড়ে থাকা মলের দলাগুলো পরিষ্কার করতো না। তো আপনারা মানে বি এন পি বসে আছেন মলের ড্রাম( জামাত/শিবির) নিয়ে আর চিৎকার করছেন ছিটা মিটা দলা পরিষ্কার করতে!!!! আপনারা “আগে” ড্রাম সরান তার পর না হয় “ছিটা মিটা দলা” নিয়ে চিৎকার দেন। সাথে আমিও চিৎকার দিব।
©somewhere in net ltd.