![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলার
ইতিহাসের সবচেয়ে আলোচিত অধ্যায়
হলো পলাশী যুদ্ধ। পলাশী যুদ্ধে নবাব
সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় মানে
বাংলার স্বাধীনতা হারানো। শুধু কী
বাংলার স্বাধীনতা বিনষ্ট হওয়া? এর
ফলে বাংলা, বিহার ও উরিষ্যার
স্বাধীনতা বিনষ্ট হয়। এরপর ক্রমান্বয়ে
সমগ্র ভারতবর্ষই স্বাধীনতা হারায়। ১৭৫৭
সালের ২৩ জুন বাংলা, বিহার ও
উরিষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উ-
দৌলা ইংরেজদের সাথে দেশ রক্ষার
যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু ক্ষমতার লোভে
এদেশীয় মীর জাফর, রাজবল্লভ, রায় দুর্লভ,
উর্মি চাঁদ, জগৎশেঠেরা প্রতারণা করে
সিরাজকে পরাজিত করে। আর নিষ্ঠুর
ইংরেজদের নির্দেশে এবং মিরনের
আদেশে মোহম্মদী বেগ, বাংলার
মহানায়ক সিরাজকে শহীদ করে ২ জুলাই
১৭৫৭। শুধু সিরাজকে শহীদ করেই ক্ষান্ত
হয়নি এ নিষ্ঠুর চক্রটি। তারা সিরাজ
পরিবারটিকেই তছনছ করে ফেলে।
ইতিহাস গ্রন্থে, প্রবন্ধে নবাব সিরাজ-
উদ-দৌলাকে নিয়ে বহু লেখালেখি
হয়েছে। কিন্তু তার পরিবার নিয়ে তেমন
কোন লেখালেখি হয়নি। যাও কিছু
লেখা হয়েছে তাও যৎ কিঞ্চিত।
আমাদের এবার একটু ভেবে দেখা দরকার
ইংরেজ ও তার দোসর মীরজাফর কী
অবস্থায় রাখে বাংলার স্বাধীন নবাব
সিরাজের পরিবারকে। নবাব সিরাজের
ছোট ভাই মির্জা মেহেদী। তখন বয়স
মাত্র ১৫ বছর। সিরাজ হত্যার পর মির্জা
মেহেদীকেও হত্যা করা হয় নিষ্ঠুরভাবে।
কথিত আছে, মির্জা মেহেদীকে তক্তা
বা কাঠ চাপা দিয়ে নির্মমভাবে শহীদ
করে মিরনের দোসররা। ইংরেজ দোসর
মীরজাফর, জগৎশেঠরা কারাগারে
প্রেরণ করেন সিরাজ মাতা আমিনা
বেগমকে, নানী সরফুন নেসা, নবাব স্ত্রী
লুৎফুননেসা ও সিরাজের চার বছরের শিশু
কন্যাকে। সিরাজের খালা ঘসেটি
বেগম যিনি সিরাজ উৎখাত ও হত্যায়
জড়িত ছিলেন তাকেও কারাগারে
প্রেরণ করে মীর জাফর। লর্ড ক্লাইভ ও মীর
জাফর গংরা আমিনা বেগম, সরফুন নেসা,
লুৎফুন নেসা, ঘসেটি বেগম ও সিরাজের
চার বছরের শিশু কন্যাকে মুর্শিদাবাদ
কারাগারে না রেখে ঢাকার
জিঞ্জিরায় নির্বাসনে পাঠায়।
ইংরেজদের ভয় ছিল নবাব পরিবার
মুর্শিদাবাদ থাকলে হয়তো দেশীয়
সৈন্যরা বিপ্লব ঘটাতে পারে। এ
ভায়েই নবাব পরিবারকে ঢাকার
জিঞ্জিরায় প্রেরণ করা হয়েছিল। নবাব
স্ত্রী লুৎফুন নেসাকে ক্লাইভের
নির্দেশে ঢাকা হতে মুর্শিদাবাদ আনা
হয়। কিন্তু মুর্শিদাবাদ আনা হয়নি
আমিনা বেগম ও ঘসেটি বেগমকে।
তাদের ঢাকায়ই রাখা হয়। ১৭৮০ সালের
কথা। পুত্র মিরনের সাথে আলাপ
আলোচনা ও পরামর্শ করে মীরজাফর
কয়েকজন অনুচরকে পাঠালেন ঢাকার
জিঞ্জিরায়। মুর্শিদাবাদ নেয়ার নামে
দু’বোনকে নৌকায় তোলা হয়। সিরাজ
মাতা আমিনা বেগম ও খালা ঘসেটি
বেগমকে ধলেশ্বরী নদীতে নৌকা
ডুবিয়ে সলীল সমাধী ঘটানো হয়। কতটা
পাষ- ও নির্মম অত্যাচার করা হয়
সিরাজের পরিবারের উপর। লর্ড ক্লাইভ ও
মীর জাফররা একের পর এক হত্যা, লুণ্ঠন
চালায় নবাব সিরাজ-উ-দৌলার
পরিবারের উপর। ২ জুলাই ১৭৫৭ সালে
সিরাজ হত্যার পর স্ত্রী লুৎফুন নেসার
জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। ১৭৫৮
সালে একটি সাধারণ নৌকায় তুলে
ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয় সিরাজ
পরিবারকে। জিঞ্জিরা প্রাসাদে
খাওয়া-দাওয়ার জন্য ইংরেজ সরকার
সামান্য অর্থ বরাদ্দ দেয়। আর এ টাকা
আসতো অনিয়মিতভাবে। ১৭৬৩ সালে
রেজা খান ঢাকার সুবেদার নিযুক্ত
হলেন। তিনি নবাব পরিবারের
নারীদের জন্য সামান্য সম্মনী বরাদ্দ
করেন। তবে ক্লাইভের নির্দেশে ১৭৬৫
সালের ডিসেম্বর মাসে জিঞ্জিরা
বন্দিদশা থেকে নবাব সিরাজের স্ত্রী
লুৎফুন নেসা, সিরাজের শিশু কন্যা ও
আলী বর্দীখার স্ত্রী সিরাজ নানী সরফুন
নেসাকে মুক্তি দেয়া হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া
কোম্পানি লুৎফুন নেসা ও তার কন্যার
ভরণ-পোষণের জন্য ৬শ’ টাকা ভাতা বরাদ্দ
করলো। নবাব সিরাজের কন্যার বিয়ে হয়
মীর আসাদ আলী খাঁর সাথে। সিরাজের
কন্যার ৪টি মেয়ে হলো। তাদের নাম
ছিল সরফুন নিসা, আমাতুন নিসা,
সাকিনা ও আমাতুল। এরই মাঝে
সিরাজের মেয়ের জামাই মীর আসাদ
আলী হঠাৎ মারা যান। ১৭৭৪ সালে
সিরাজের কন্যাও মারা যান। চার
চারটি এতিম শিশু নিয়ে ৬শ’ টাকায়
চলে না সিরাজ স্ত্রীর। বাধ্য হয়ে ১৭৮৭
সালে কর্নওয়েলিশের নিকট ভাতা
বৃদ্ধির আবেদন করেন লুৎফা। লুৎফার আবেদন
নাকচ করে দেয় কর্নওয়েলিশ। ওই ভাতা
ছাড়াও মাসে আরো ৩০৫ টাকা ভাতা
দেয়া হতো আলীবর্দী খাঁ ও নবাব
সিরাজের মাজার দেখাশোনার জন্য।
ভাগ্য বিড়ম্বিত, ঝঞ্চাতাড়িত ও চির
দুঃখী লুৎফুন নেসা ১৭৯০ সালের নভেম্বর
মাসে নামাজরত অবস্থায় স্বামীর কবরের
পাশে মারা যান। নবাব সিরাজ-উদ-
দৌলার কবরের পাশেই লুৎফাকে
সমাহিত করা হয়। সিরাজ পরিবারের
ইতিহাস এখানে এসেই থেমে যায়। নবাব
সিরাজ-উদ-দৌলার কন্যার কোন খোঁজ
দিতে পারেনি বাংলার ইতিহাস
এমনকি ভারতীয় ইতিহাস। তবে ইদানীং
গবেষণা চালিয়ে সিরাজ কন্যার নাম
উদ্ধার সম্ভব হয়েছে। সিরাজ কন্যার নাম
উম্মে জোহরা। এমনকি উম্মে জোহরার
চার কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের নাম
পাওয়া যায়, তার পুত্র লুৎফে আলী খান।
লুৎফে আলী খানের কন্যা ফাতিমা
(সিরাজ-উদ-দৌলা মুর্শিদাবাদ-আব্দুল
হাই শিকদার)। সিরাজের পরবর্তী বংশ
ধারা পাকিস্তান ও বাংলাদেশে চলে
আসে বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
বাংলাদেশের খুলনা ও ঢাকায় নবাব
সিরাজ-উদ-দৌলার বংশধরগণ বসবাস করেন
বলে আব্দুল হাই শিকদার নবাব সলিমুল্লার
একটি চিঠি প্রমাণ হিসেবে দাঁড়
করিয়েছেন তাঁর গ্রন্থে। স্যার
সলিমুল্লাহ নবাব পরিবারের নিম্নতর
বংশধরদের চাকরি ও ভাতার ব্যবস্থা
করার জন্য ইংরেজদের অনুরোধ জানিয়ে
পত্র দেন। তবে ১৭৯০ সালের পর সিরাজ
পরিবারের ধারাবাহিক ইতিহাস
সংরক্ষণ করা যায়নি। অর্থাৎ নবাব
সিরাজ-উদ-দৌলার স্ত্রী ইন্তেকালের
পর সিরাজ পরিবারের ধারাবাহিক
ইতিহাস সংরক্ষণ হয়নি। হয়ে থাকলেও
ইংরেজ, মীজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ,
সিরাজ-উদ-দৌলাসহ সমকালীন ইতহাস
বিনষ্ট করে দেয়। মুর্শিদাবাদের
পলাশীতে (বর্তমান নদীয়া জেলার
কালিগঞ্জ থানা) সিরাজ-উদ-দৌলার
সাথে যুদ্ধ হয়নি ইংরেজদের। হয়েছিল
প্রহসন ও বিশ্বাস ঘাতকতা। যেখানে লর্ড
ক্লাইভ মাত্র ৩ হাজার সিপাহী (২
হাজার ২শ’ সিপাহী ৮শ’ পদাতিক সৈন্য)
নিয়ে নবাবকে আক্রমণ করে। এর
বিপরীতে নবাবের ৫০ হাজার সৈন্য (৩৫
হাজার পদাতিক, ১৫ হাজার অশ্বারোহী,
৫৩টি কামান) পরাজিত হয়। যে যুদ্ধ
কল্পনাকেও হার মানায়। বাংলা,
বিহার, উরিষ্যার, শেষ স্বাধীন নবাব
সিরাজ-উদ-দৌলা ১৭৩৩ খ্রিস্টাব্দে
জন্মগ্রহণ করেন। নানা আলীবর্দী খানের
মৃত্যু হলে ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল মসনদ
লাভ করেন। তখন তার বয়স সবে মাত্র ২৩
বছর। পলাশী যুদ্ধের সময় সুদর্শন এ নবাবের
বয়স হয়েছিল মাত্র ২৪ বছর। নবাব সিরাজ-
উদ-দৌলাকে জাফরগঞ্জ প্রাসাদে
নির্দয় ও নিষ্ঠুরভাবে শহীদ করার পর তার
ছিন্ন ভিন্ন লাশ হাতির উপর নিয়ে শহর
প্রদক্ষিণ করায়। পরে সিরাজের মৃতদেহ
কাপুরুষ ও অমানুষ মীর জাফর রাস্তার
পাশে ফেলে রাখে। তাকে কবর দেয়নি
পাষ-রা। একজন সিরাজ প্রেমিক অনুমতি
সাপেক্ষে নবাবের লাশ অতিযতœ
সহকারে কোলে তুলে নেন। ধুয়ে মুছে
অর্থাৎ মুসলমান রীতিতে গোসল করিয়ে
খোশবাগে রাতের আঁধারে কবর দেন
সিরাজ-উদ-দৌলার লাশ। যিনি সিরাজ-
উদ-দৌলাকে কবর দেন তার নাম মির্জা
জয়নুল আবেদীন। খোশবাগ কবরস্থান ৯ একর
জমির উপর সেই কবরস্থান। প্রাচীর
বেষ্টিত এ কবর এলাকাটা খোশবাগ
হিসেবে নবাব আলীবার্দী খান স্থাপন
করেন। এখানে রয়েছে নবাব আলীবর্দী
খানের সমাধী, এটির পূর্ব পাশে নবাব
সিরাজ-উদ-দৌলার সমাধী, একটির পূর্ব
পাশে সিরাজের ছোট ভাই মেহেদীর
সমাধী। সিরাজ সমাধীর ঠিক পায়ের
নিচে স্ত্রী লুৎফার সমাধী। খোশবাগে
জেনানা কবরস্থানে সরফুন নেসা,
সিরাজ মাতা আমিনা বেগম ও খালা
ঘসেটি বেগমের সমাধীও রয়েছে।
প্রাচীরের বাইরে একাধারে ১৭টি কবর
রয়েছে। তারা আশরাফু দৌলার
নেতৃত্বে সিরাজের কবর জিয়ারতে
বিহার থেকে এসেছিল। মিরন তাদের
হত্যা করে। এখানেই তাদের কবরস্থ করা
হয়। বাংলার স্বাধীনতার মহাবীর,
বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক নবাব
সিরাজ-উদ-দৌলা চির নিদ্রায় শায়িত
আছেন মুর্শিদাবাদের খোশবাগে। নবাব
সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মধ্যে দিয়ে
ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্য যুগের অবসান
ঘটে। আর শুরু হয় দু’শ’ বছরের গোলামীর
জীবন।
সংগৃহীত
©somewhere in net ltd.