![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রথম ভাগ
গাইবান্ধা জেলাকে ম্যাপে দেখলে খুরশিদের মনে হয়, গলা ছিলা মুরগির কণ্ঠা। দুই পাশেই ভারত। শুধু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নামক একজন লেখক আর যমুনা নদীর কারণে সে এই জেলাকে ভালোবাসে। নয়ত তার ধ্যানজ্ঞান জীবনের এই গরিবি চাল চলন ছুড়ে ফেলে ঢাকা শহরে আসন গেড়ে বসা। তবে কারো সাথে কথা হলে সে যমুনা নদীর কথাই বলে। তার মোহনীয়তা, জলের শব্দ আর মন হু হু করা বাতাসে পাড়ে বসে আড্ডা দেয়া, সে ভুলতে পারে না। সাহিত্য সে বোঝে না, যদি বুঝত তবে সে কথায় কথায় ইলিয়াস'কে আওড়াত আর কিভাবে চেনে, ঘর কোথায় - এই সব বৃত্তান্ত চারিয়ে চারিয়ে বলত বৈকি।
শহর থেকে বড় চাচা, ফায়েজ হক আসলে তিনি এই লেখকের কথা বলেন, কিভাবে তিনি এই লেখককে বড় হতে সাহায্য করেছেন সেটাও বলেন। বিকেলে বাজারের পাশে ইউনিয়ন পরিষদে বসে আড্ডায় তার এসব কথার অনেক যে বুজরুকি, তা খুরশিদ ধরতে পারলেও মাথা ব্যথা করে না। চাচার কারণে তারও একটু পরিচিতি আছে, আর এইসব ব্যাপার মাঝে মাঝে বেশ কাজে লাগে। ঢাকায় কলেজে ভর্তি হতে গিয়েছিল, খুরশিদ। ভাইভা'তে তাকে, তার প্রিয় লেখক কে জিজ্ঞেস করেছিল জনৈক শিক্ষক। উত্তরে খুরশিদ বলেছিলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পরে মনে একটু খচখচ করেছিল, হিন্দু লেখক প্রিয় হতে পারে কি না। এর পর থেকে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে একই প্রশ্ন আবার করলে সে, 'আখতারুজ্জামান ইলিয়াস' এর নাম বলে দেবে। সেই কলেজে আর ভর্তি হতে পারে নি, খুরশিদ। এখন অবশ্য সেসব দিন গত, বেশ ভালোই আছে। পড়ালেখা শেষ করে সে আর কোনদিন বই হাতে নেয় নি, তাই সাহিত্য নিয়ে আলাপচারিতা থেকে মুক্ত হয়েছে অনেককাল আগেই।
ফায়েজ হক, ঢাকায় এসে থীতু হয়েছেন তা আজ বছর তিরিশেক তো হবেই। পরীবাগের বাসায় এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে থাকেন আর একটা রিক্সা গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে তার মোটামুটি চলে যায়। আগে সরকারি চাকুরি করতেন, এখন ঝাড়া হাত পা। ছেলেটা গ্যারেজ নিয়ে থাকুক আর মেয়েটার বিয়ে দিয়ে দিলে একটা হিল্লে হবে তার। খুরশিদ এর এই বড় চাচা কিছুটা প্রগলভ ও কর্তৃত্বপরায়ণ। তার ছেলেটা মন মতো হলেও, মেয়েটাকে নিয়ে উনি বিশেষ ভাবনায় আছেন। কোনমতে কাউকে গছিয়ে দিতে পারলে, তারপর তিনি হজ্বে যাবেন। মেয়েটা দেখতে মাশাল্লা খুবই ভালো, কিন্তু একটা চোখ লক্ষী ট্যারা। আর হাসলে সামনের নিচের পাটির দুটি দাঁত এখনকার দিনের ছেলেদের মতো দুই পা আড়াআড়ি করে থাকে। উনার স্ত্রীকে নিয়ে যেতে হবে না বলে উনি বেজায় খুশি, শুধু শুধু কতগুলো টাকা খরচ হবে। উনার স্ত্রী, জমিলা খাতুন কোমরের ব্যাথায় সারাদিন কাতর থাকেন। হাঁটতে পারেন না ঠিকমতো, খেতে গেলে কাপড় নষ্ট করেন। এইরকম মানুষ নিয়ে হজ্বে গেলে, না তিনি হজ্ব করতে পারবেন, না তার স্ত্রী কিছু করবেন।
ফায়েজ হকের জীবনে তেমন কিছু পাবার নেই। কামিয়েছেন প্রচুর, এখনও মাঝে মাঝে লাগলে টাকা পয়সা পান। নিন্দুকেরা অবশ্য একমত হতে পারে নি কখনই যে তার এই স্বচ্ছলতার উৎস কী! তবে, কেউ কেউ বলেন চাকুরি করার সময় সরকারি অনেক জিনিসপাতি নাড়াচাড়া করেছেন আবার কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তার কার্যক্রম নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন। ভাতিজা ঢাকা আসবে শুনে তিনি কিছু বাজারপাতি নিয়ে আসেন। খুরশিদকে তিনি খুব একটা পছন্দ করেন তা না, কিন্তু ছেলেটা আদব কায়দা জানে, বড়দের মুখের উপর কথা বলে না।
খুরশিদ আসে যখন তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। খুরশিদের চাচাতো বোন সোনিয়া তখন সবে গোসল সেরে বেরিয়েছে। দরজায় ধাক্কাধাক্কি দেখে সে ভেজা চুল নিয়েই দরজা খুলতে যায় আর গজগজ করতে থাকে। ফায়েজ সাহেব আবার এই সময় ঘুম দেন, অনেকদিনের অভ্যেস। চাকুরি জীবনেও তিনি ঘুমাতেন দুপুর বেলা নিয়ম করে। খুরশিদ বাম হাতে একটা চটের ব্যাগ, ডান হাতে একটা ক্যানভাসের তোড়া ছিড়ে যাওয়া ট্রাভেল ব্যাগ আর দরজার সামনে কতগুলো দেশি মুরগি রেখে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সোনিয়ার গায়ে দেয়া নতুন সাবানের গন্ধ, খুরশিদের নাকে এসে লাগে। সোনিয়া খুরশিদকে খুব একটা চেনে তা নয়, কারণ বাবা ঢাকা আসার পরে নিজে বাড়ি গেলেও সোনিয়াদের কোন এক অজানা কারণে যাওয়া হয়ে উঠে নি। আর অতদূর থেকে কেউ কখনও আসেও নি। যদিও বাড়িতে দু'চারঘর আত্মীয় তাদের আছে। খুরশিদ সোনিয়াকে দেখেই চিনতে পারে। কুশল বিনিময় করে ভেতরে ঢুকে খুরশিদ। বাড়িতে একজন গৃহকর্মি আছে, সেই জিনিসপাতিগুলো নিয়ে ভেতরে চলে যায়। জমিলা খাতুন পা টেনেটেনে বসার ঘরে আসেন। খুরশিদ সবে বসেছিল সোফায়, উঠে কদমবুসি করে। জমিলা খাতুন বসতে বলে বাড়ির নানান কথা জিজ্ঞেস করেন।
ফায়েজ হকের বসার ঘরে সেগুন কাঠের এক সেট সোফা, দুটো টি টেবিল, একটা শোকেস আর কোনায় একটা খাট আছে। কাসাসুল আম্বিয়া, বেহেশতি জেওর আর বিষাদ সিন্ধু বইটা শোকেসের সৌন্দর্য বর্ধনে এবং জ্ঞান চর্চার একমাত্র স্বাক্ষী। ছয়জনের বসার মতো করে তৈরি করা হয়েছে খাবারের টেবিল। বাসাটা একতলা, চারিদিকে জায়গা আছে ভালোই। পিছনের জায়গাটায় রিক্সার গ্যারেজ। খুরশিদ এর আগে চাচার বাসায় আসে নি। খেতে খেতে সে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। জমিলা খাতুন, খুরশিদের পাশে বসে, নদীর জল কতটুকু বাড়ল এবার, ফসল কেমন হয়েছে, মজুল হকের বউ এখনও "কাবিখা"র মাটি কাটে কি না ইত্যাকার নানান প্রশ্নে খুরশিদকে ক্রমান্বয়ে প্রগলভ আর স্বাভাবিক করে তুললেন। কুচোচিংড়ী দিয়ে শুটকি, কাঁঠালের বিচি আর কচুর তরকারি দিয়ে খুরশিদ প্রায় পৌনে এক প্লেট সাবাড় করে দিলেও, কথা বলার মানুষ পেয়ে জমিলা খাতুন সেসব এড়িয়ে এবার বাড়ির গাছ গাছালির কথা, পুকুরে মাছের কথা আর তাদের ভিটার পেছনের গোলাপজাম গাছের খোঁজ খবর নিয়েই তবে ক্ষান্ত দিলেন।
দ্বিতীয় ভাগ
পেট ভরে খাবার পর ধূমপান না করলেই নয়, কিন্তু কি বলে বেরুনো যায় ভেবে খুরশিদ, চাচা ঘুম থেকে না উঠা পর্যন্ত বাড়ির পেছনের রিক্সার গ্যারেজ দেখতে যাবে বলে ফিকির খোঁজে। চাচাতো ভাই আমান হক থাকলেও না হয় কথা ছিল। সাদা একটা পায়জামা আর টেরিলিনের একটা শার্ট পরে খুরশিদ গ্যারেজের পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে থাকে। আশেপাশে কেমন শুনশান, লোকজন তেমন নেই। ১৯৯৭ সালের ঢাকাকে দেখে বোঝার উপায় নেই খুরশিদের যে এখানেই সে নিজেকে মেলে ধরতে পারবে একদিন। ঠুং ঠাং আওয়াজে মেরামতের কাজ চলছে তখন গ্যারেজে। খুরশিদ আগ্রহবশত এগুতে থাকে গ্যারেজের দিকে। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে ছয়জন লোক 'তাস' খেলছে, লরিস। খুরশিদকে দেখে খুব একটা গাঁ করে না কেউ, শুধু ফতুয়া পরা নির্মম চেহারার একজন তাকিয়ে থেকে বলে, 'খুরশিদ ভাই না'? হাতের তাস ফেলে আমান উঠে দাঁড়ায়, চাচাতো ভাইয়ের সাথে কোলাকুলি করে। আমানের মুখ থেকে ধূমপানজনিত এবং তামাকের আধিক্যজনিত একটা উৎকট ঘ্রাণ নাকে লাগে, যেমন লাগত যমুনা নদীর পাড়ে বসলে, বন্ধুদের সাথে। একে একে সবার সাথে পরিচিত হয় খুরশিদ। বেশভূষায় আরেকবার সবাইকে মেপে দেখে সে এবং কথা কম বলা শ্রেয়, এটা খুরশিদের বুঝতে বেগ পেতে হয় না। সেদিনের মতো তাসের খেলা শেষ করে বাকিরা চলে গেলে, প্রায় কাছাকাছি রকমের প্রগলভতা দেখায় আমান তার মায়ের মতো। এলাকার চেয়ারম্যান কে, রাস্তাঘাটের এখন কি অবস্থা, সরকারের অনেক প্রোজেক্ট যাচ্ছে সেগুলো নিয়ে কারা কাজ করে এসবই আমানের জিজ্ঞাসায় উঠে আসে। খুরশিদ অল্পতেই বুঝে যায় আর যাই হোক, আমানের সাথে তাল মেলালে তার দুনিয়াবি লাভের একটা ব্যাবস্থা হতে পারে। দুই ভাই আরো কিছুক্ষণ আলাপ করে বাসায় আসে।
ফায়েজ হক একটু দেরি করেই উঠেছিলেন আজ। বসার ঘরে বসে কি যেন দেখছিলেন আনমনে। দরজায় সাড়া পেয়ে নিজেই গিয়ে খুলে দিলেন। খুরশিদ আজ দিনে দ্বিতীয় বারের মতো কদমবুসির কাজ সারল। ফায়েজ হক মোটামুটি যা জিজ্ঞেস করলেন, তা আগেই চর্চিত থাকায়, খুরশিদ আরো ঠান্ডা মাথায়, থেমে থেমে প্রতিটা শব্দ কাজে লাগাল। ফায়েজ হক এই স্থিতধী ভাতিজার উপর প্রসন্ন হয়ে, বিকেলের চা নাস্তার আয়োজনে সবাইকে হাঁক ডাক দিয়ে ব্যাতিব্যস্ত করে তোলেন। চা নাস্তা শেষ করে ফায়েজ হক, খুরশিদের আসার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে খোঁজ নেন এবং সব কিছু শুনার পর কিছুদিনের জন্যে বাসায় থাকার অনুমতি দেন। খুরশিদ জানে, এতটুকুই তার জন্যে অনেক, সে শিক্ষিত চতুর ছেলে, কিছু না কিছু একটা ব্যাবস্থা করে ফেলতে পারবে। তাছাড়া গ্রামের আরো দশজন লোক এখানে থাকে, প্রয়োজনে এদের কাছে সে যাবে। ইকোনোমিক্সে খুরশিদ পোস্ট গ্রাজুয়েশান করেছে, ছাত্র হিসেবে সে বরাবরই ভালো ছিল। যদিও মানুষ যেসব রুচির কথা বলে, সে বিষয়ে তার অজ্ঞতা তাকে আরো বাস্তবমুখী করেছে। মুক্তবানিজ্যের হাওয়া সে ভালোই টের পায়। স্বাধীনতা পরবর্তী নেয়া অনেক সিদ্ধান্তের সে কোন কারন খুঁজে পায় না। খুরশিদ, তার সামনে খুব সুন্দর একটা সূত্র মেনে নিয়েছে, এর বাইরে সে আর কিছু জানতে চায় না। একাত্তর কিংবা বাহান্ন, অথবা আরো আগে গেলে উপমহাদেশের ভাগাভাগি - এ সবই সে মূল্যায়ন করে অর্থের মানদণ্ডে।
সন্ধ্যার পরে সোনিয়া, খুরশিদকে নিয়ে ছাদে গিয়ে বসে। আমান এ সময়টা তার বন্ধুদের সাথে মোহাম্মদপুর গিয়ে আড্ডা দেয়। সোনিয়া সবে কলেজ পাশ করেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চায় সে। মঞ্চ নাটক তার খুব পছন্দ। মিনু রহমান, গোলাম মোস্তফা আর সুবর্না মোস্তফার অভিনয় তার দুর্দান্ত লাগে, কিন্তু বাবা নাটক দেখতে নিলে মনঃক্ষুণ্ণ হয়। কেন হয় সোনিয়া এখনও বোঝে না। এ কথা ও কথার পর, খুরশিদ কিছুটা অস্বস্তিবোধ করে। নদীর পাড়ের খোলা হাওয়ায় তার আলোচনা বেহুলা লক্ষ্মীন্দর কিংবা লাইলি মজনু অথবা শাহজাহান আকবরে সীমাবদ্ধ, সেখানে এইসব আধুনিক নাটকের ব্যাবচ্ছেদ এর ব্যাপারে তার অজ্ঞতা সোনিয়াকে মর্মপিড়া দেয়। খুরশিদ চতুর মানুষ। সোনিয়াকে সে এবার বলতে থাকে, কিভাবে তারা চাঁদনি রাতে নৌকো নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কিভাবে সবাই সাঁতার কেটে পুকুরের এ মাথা ওমাথায় যেতে পারে, আবার যাত্রাপালায় বিবেকের চরিত্রে সে কত ভালো করতে পারে, কিন্তু যদিও কোন এক অজানা কারনে খুরশিদের তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় প্রতিভা থাকার পরেও এ চরিত্রে বরাবরই একজন দুর্বল মানুষকে দিয়ে চালানো হয়। আর এই যন্ত্রণাটা নিয়ে সে অনেকদিন ভেবেছে কিন্তু সুরাহা করতে পারে নি। মুক্তিযুদ্ধের পরপরই খুরশিদের জন্ম, অভাব অনটন, ঝড়ঝঞ্জা, সিদ্ধান্তহীনতা আর সঠিক মানুষদের আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্তে যখন দিশেহারা দেশ, তখন খুরশিদের বাবা ক্ষেতি করে দিনের পর দিন দুবেলা খেয়ে বেঁচে ছিলেন। খুরশিদ তখন ছোট, মায়ের কোল ছাড়ে নি ঠিকমতো। একদিন কারা এসে যেন বাড়িতে বাবাকে ধমকে গিয়েছিল। বাবা কৃষক মানুষ, এমন কি আর করতে পারত যে তাকে এভাবে ধমকাতে হবে। সেদিন খুরশিদ বোঝে নি কিছুই। তবে বুঝেছিল কিছুটা বড় হয়ে। তারপর থেকে ফায়েজ হক আড়াল করে রেখেছিল, খুরশিদদের। সোনিয়া ঠিক বুঝে উঠতে পারে না, খুরশিদের কথা। একবার ভাবে এসব কথার মানে নেই, আবার ভাবে নাটকে, বইয়ে এগুলোই তো লেখা থাকে।
খুরশিদ তখন সবে মাত্র গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো। অবশ্য আর যাই হোক এখনকার মতো দুষ্ট শিক্ষা ব্যাবস্থা ছিল না, তখন। একদিন ক্লাশে হেডমাস্টার মশাই এসে ওকে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর দুটো বাতাসা হাতে ধরিয়ে নিয়ে ওদের বাড়ির দিকে এগুতে লাগলেন। খুরশিদ সেদিন অবাক হয়ে দেখেছিলো, তাদের সেই ভাঙ্গা ঘরের দাওয়ায়, ঘরের ভেতরে, আশে পাশে মানুষ আর মানুষ। বাতাসাগুলো আর খাওয়া হয় নি খুরশিদের, বাবার ক্ষতবিক্ষত লাশের সাথে বাতাসার আকর্ষণ হার মেনেছিলো। বাবাকে কারা, কেন, কিকরে এমন করে জখম করেছিলো, কুপিয়েছিলো সে সুরাহা কখনই হয় নি। খুরশিদ বড় হবার পরেও জানার চেষ্টা করেছিলো অনেকদিন, কিন্তু মায়ের বেদনা বিধুর মুখ আর ভবিষ্যতের কথা ভেবে সে মেনে নিয়েছিল সবই। খুরশিদের বাবা বেশ ভালো মানুষ ছিলেন, অনেকটা আরুজ আলী'র মতো। মুক্তিযুদ্ধে তিনি অনেক গেরিলা অপারেশনে সহযোগিতাও করেছিলেন। কেউ কেউ বলে ওইসব রাগেই কি না, তাকে মেরে প্রতিশোধ নিয়েছে ওরা। খুরশিদও ভেবে রেখেছে, সুযোগ পেলে সেও প্রতিশোধ নেবে, ছারখার করে দেবে প্রয়োজনে দেশকেও। দেশের জন্যে অবদানের পরেও যদি পথে ঘাটে তার বাবাকে মরে পড়ে থাকতে হয় তবে, সেখানে শুধু শুধু মায়া করে লাভ কী? আর, স্বপ্নদ্রষ্টা হওয়া এক ব্যাপার, দেশ চালানো ভিন্ন। অর্থনীতিতে পড়াশুনো করে আর যাই হোক, ডিমান্ড ও সাপ্লাই পলিসির মর্মোদ্ধার সে বেশ ভালোই করতে জানে।
তৃতীয় ও শেষ ভাগ
ক্রমে ক্রমে ঢাকার জলবাতাস খুরশিদের ভালো লাগতে শুরু করে। বাগাড়ম্বরে ভরা সামাজিক জীবন আর সত্যিকে অস্বীকার করা জাতির অসহায় অবস্থা খুরশিদের মনে একটুও দাগ কাটে না, কি করে ফায়দা নিতে হবে, সে চিন্তায় মশগুল থাকে কিছুদিন খুরশিদ। খুব দ্রুতই সে রপ্ত করে নেয় পথ চলার পন্থা। দেশের অনেক পরিবর্তন ঘটে, 'গণতন্ত্র' নামক এক প্রপঞ্চে ঘুরপাক খায় পুরো বাংলাদেশ। তার বাবার হত্যায় যারা জড়িত ছিলেন, এদের মর্যাদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। এক সময় আসে এরা আসন গেড়ে বসে এ দেশের রাজনীতিতেও। পালাবদলের এ যাত্রায় খুরশিদ অবশ্য বিবেকের চরিত্রে অভিনয় করার খায়েশ করে না, বরংচ খুব নিরিবিলি সে পর্যবেক্ষণ করে যায় সবকিছু। তার বিচারবোধে অর্থনৈতিক পরিকাঠামো দাঁড়িয়ে থাকে জগাখিচুড়ি হয়ে। সমন্বয়হীনতা, দূরদৃষ্টি, বাস্তবকে অস্বীকার করে এক ইউটোপিয়ায় দৈনন্দিন জীবন আবর্তিত হতে থাকে দেশে। প্রথম শ্রেনিয় সমস্যা সমাধানে তৃতীয় শ্রেনিয় জনপ্রতিনিধিরা লুণ্ঠন, হত্যা, অগ্নিসংযোগ আর অবিবেকপ্রসূত কাজে লিপ্ত হতে থাকে। আর এ সুযোগে সেইসব কথিত, 'অমানুষেরা' আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে তাদেরই হাত ধরে, একদিন যাদের পরিচিতদের ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হতে হয়েচিলো বেয়োনটে। সব ভুলে নতুন এক দেশ গড়ার অভিপ্রায়ে সবাই হাতে হাত মিলিয়ে কাজ শুরু করে। যা কিছু উচ্ছিষ্ট ছিল, সেসবও কেড়ে নিতে থাকে নতুন অর্থনৈতিক দিক নির্দেশনায়। আর এসবই ঘটে খুব দ্রুত, একটা ছক মেনে।
খুরশিদ নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় ফায়েজ হকের বাসা থেকে, মাঝে মাঝে আসে - সোনিয়ার সাথে গল্প কবিতা নিয়ে কথা হয়, আমানের সাথে ঢাকার রাজনীতি, ড্রাগ ট্রাফিকিং, হিউম্যান ট্রাফিকিং নিয়ে আলোচনা হয় আর ইদানিং ফায়েজ কাকা তার প্রতি উচাটন বোধ করেন। জমিলা খাতুন আরো অসুস্থ হতে থাকেন, যেমন হতে থাকে বাংলাদেশ। আর এসবই খুরশিদ দেখে, কিন্তু বলে না কিছুই। শুধু এটুকু বুঝতে পারে, যিনি দায়িত্ব নেন, তার মানসিকতাও বড় প্রভাব ফেলে পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে আর গোটা বিশ্বে। খুরশিদ দিনে দিনে নিজেকে নোংরা করতে থাকে - চলাফেরায়, কথাবার্তায়, আচরনে, ভাবনায়, জীবনবোধে। এসবের মাঝে সে এক হিংস্র আনন্দ খুঁজে পায় আর প্রতিশোধ নিতে থাকে সমাজের উপর, তার বাবার খুনিদের যারা কিছু বলেনি তাদের উপর আর নিজের উপরও হয়ত। হায় মানুষ, অসহায় জীব - নিজের হাতে নিজের সহমরণ দাবী করে এরা। নপংসুক সমাজের বাস্তবতায় খুরশিদ তার আখের গোছাতে থাকে। তার চাচার অতীতের গোপন কর্মকান্ড, আমানের রাত বিরেতের ঝটিকা অভিযান, সোনিয়ার লুকানো আবেগী জীবন আর জমিলা খাতুনের পঙ্গুত্বে সে দেশের ছায়া খুঁজে পায়। এসবই সে দেখে এক নির্মোহ দৃষ্টিতে, সমাজের অধিপতিদের মতো করে। তার এই নৈর্ব্যাক্তিক দৃষ্টিকোণ এক সময় তার জীবনাচারনের অনুষঙ্গ হয়ে উঠে, যেমন হয়ে উঠেছিল সমাজের শাসক শ্রেনিরও। আর সাধারন জনগন, মাই ফুট। এরা কারনে অকারনে ঝামেলা করে, নোংরা করে পরিবেশ, আর সমাজের ফাজিল অংশ একবার এদিক আরেকবার ওদিক করে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে হাজির করে আপন মাতৃভূমিকে।
©somewhere in net ltd.