নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

উৎসের খোঁজে।

Jaliskhan

মানুষ হইবার চাই

Jaliskhan › বিস্তারিত পোস্টঃ

জুলেখা

২৭ শে আগস্ট, ২০১৬ সকাল ১১:৩৫

আদিনামূড়া সাধারণ আর দশটা গ্রামের মতোই। একই রকমের একঘেয়ে ধানক্ষেত আর একটা আধপাকা রাস্তা চলে গেছে সোজা তীরের ফলার মতো উত্তর থেকে দক্ষিণে। গতানুগতিক সবুজ চারিদিকে আর মাথা উঁচু করে আছে তাল সুপারির সারি সারি বাগান। অন্য গ্রামের সাথে অমিল বলতে, যেখানে বাদবাকি গ্রামগুলো ইচ্ছেয় অনিচ্ছেয় রাস্তার পাশ ঘেঁষে বেড়ে উঠে সেখানে আদিনামূড়া একটি একটি বাড়ি করে রাস্তার ধার ধরে সোজা উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বালম্বিভাবে বিস্তৃত হয়েছে।

এ বৈশিষ্ট্য তাদের অস্থিমজ্জায় এমন ভাবে মিশে আছে যে এরা সবাই সরল, এরা সবাই একমত হতে পারে ঠিক যে কোন বিষয়ে, যেমন রাস্তাটা একমত হয়েছে সোজা সরল থাকবে বলে। আর একই কারণে এখানকার মানুষেরা আর সবার চাইতে আলাদা।

জুলেখা এ গ্রামেরই মেয়ে। ওকে ইস্কান্দর যখন প্রথম দেখে তখন বুড়ো রোদ লোমশ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীতে। ইশকুলের গেটের সামনে ছোট ভাইকে নিতে দাঁড়িয়েছিলো। ইস্কান্দর সে পথ দিয়ে বাজারে আসছিলো। লালচে আভা জুলেখাকে কোন এক আনন্দ উদ্ভাসিত জগতের করে দিয়েছিলো আর সে আভা গায়ে মেখে ঠায় দাঁড়িয়েছিলো ইস্কান্দর।

বাজার চুলোয় উঠেছিলো সেদিন। পিছু পিছু গিয়ে দেখে এসেছিলো বাড়ি কোথায়। তারপর প্রতিদিন একই সময়ে আসা রুটিন করে দিয়েছিলেন বিধাতা ইস্কান্দরের ভবিতব্যে।

এসবই ভাবে আর বড়শি তে কেঁচো গেঁথে পুকুরে ছুঁড়ে মারে ইস্কান্দর। মাছের চাইতে মনোযোগ বেশি তার জুলেখায়। নিজেকে তার টোপের পাশে ঘোরা মাঝারি আকারের মাছ মনে হয়। ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে নেবে নাকি গিলে ফেলবে পুরোটা এ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে ইস্কান্দর। তবে যে কোনটাই সই, সে মন দিয়ে ফেলেছে জুলেখাকে।

ইস্কান্দররা এখানে বসবাস করছে খুব বেশিদিন আগের কথা না। বছর দুয়েক হবে। পুরনো বাড়ি বেঁচে দিয়ে আদিনামূড়ায় ঘর বানিয়ে থাকে ওরা। এমনিতে এ গ্রামের মানুষ ভালো, কিন্তু অপরিচতদের বেলায় প্রথম প্রথম একটা আক্রণাত্মক ভঙ্গী করে।

ইস্কান্দর স্কুলে আলাদা বেঞ্চিতে বসতো, ওকে কোনদিন কোন শিক্ষক জিজ্ঞাসা করেন নি পড়া শিখে এসেছে কি না? সারা দুনিয়ায় ইস্কান্দর সম্ভবত একমাত্র নিয়তি তাড়িত মানুষ, যে সমাজের বৈষম্যের মাঝেও একটা মানুষের যেসব স্বপ্ন থাকে তার প্রায় সবকিছুই চেখে দেখছে।

সে বাজারে খেতে বসলে আলাদা টেবিল চেয়ার পায়, সিনেমা দেখতে গেলে পাশের সিটে আরাম করে পা মেলে দিতে পারে, দোকানিরা দরদাম করে না তেমন - কারণ সে এ গ্রামের নয়। সে হিন্দু বা বৌদ্ধদের মতোও নয়, তবে অনেকটা পাহাড়ি বা সমতলের জাতি গুলোর মতো। পাশাপাশি থাকে আবার অনেকটা অচ্ছুৎও বলা যায়।

এসবই সে ভাবে সেই সময়ের মাঝে, যতটুকু সময়ের মাঝে মাছটা বড়শি নিয়ে টানাটানি করে। আলতো টানে সে মাছটাকে বড়শিতে বিঁধে ডাঙায় তোলে। সূর্যরশ্মির ছিটেফোঁটায় মাছটির গোলাপি আভা আর লেজের মাঝে কালো গোল দাগে লাল ফুটি দেখে ইস্কান্দর কিছুটা বিবশ অনুভব করে আর সে জুলেখার কথা মনে করে মাছটাকে ছেড়ে দেয় আবার পানিতে।

প্রেমে পড়লে মানুষ সরল সোজা হয়ে যায়, যেমন এই আদিনামূড়া গ্রামও সরল সোজাভাবে বেড়ে উঠেছে। আর এই জগতে নানান ঘটনা ঘটে, যাতে করে মনে হতেই পারে কেউ একজন কোথাও না কোথাও বসে বসে এসব করেন। আর সেই কারণেই ইস্কান্দর মাছটাকে ছেড়ে দিলেও মাছটা তাকে ছাড়ে না। ছিঁড়ে যাওয়া থুঁতনি নিয়েও ইস্কান্দরের মাছ ধরার জায়গায় সে প্রগলভ ঘুরে বেড়ায়।

বেশ সময় লাগে ইস্কান্দরের এই হিসাব বুঝতে এবং অভিভূততা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে যেমন গ্রাস করে এ গ্রামের সবাইকে এক রকম থাকতে। ইস্কান্দর যেহেতু ব্রাত্য, তাই সে কারো সাথেই একথা বলে না। শুধু বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞেস করে, "মা, মাছেরা কি ব্যাথা পায়"?

ইস্কান্দরের মা এমন আলাপে চিন্তিত মনে হয় না, শুধু ছেলেকে মনে করিয়ে দেন ইউনুস নবীর মাছের পেটে বেঁচে যাওয়ার ঘটনাটুকু। ইস্কান্দর সবই বিশ্বাস করে, যেমন সে করে আজকের হয়ে যাওয়া তার সাথে রহসস্যময় আচরণ।

পরেরদিন সে পুকুর পাড়ে এসে একবার রাস্তায় আরেকবার পুকুরের দিকে তাকায়। তাল বা সুপারির সারি কিংবা খড়ের গাঁদা অথবা গ্রামের সার্বজনীন রুপ মনোহরতা তাকে একটুও দমায় না আজ। ঘরে ফিরে আবার বড়শি নিয়ে আসে। ভেজা মাটি খুঁড়ে কয়টা কেঁচো বের করে এনে সে মাছ ধরতে বসে। সূর্যটা যখন পূব থেকে দক্ষিণে জায়গা বদলায়, থুঁতনি ছেঁড়া সেদিনের মাছটা, যাকে ইস্কান্দর জুলেখার প্রতিনিধি মনে করে, অথবা যে নিজেই মাত্র একদিনেই ইস্কান্দরের মন জয় করে নিয়েছে - ঘাটলার পাশে ডুবতে ভাসতে দেখা যায়।

ব্যাপারটা এমন হয় যে, ইস্কান্দর জুলেখা না থুঁতনি ছেঁড়া মাছ - এই দুইয়ের মাঝে কাকে বেছে নেবে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে। এই দ্বিধাদ্বন্দ্বের ফাঁকে একটা মৃগেল মাছ বড়শি ধরে টান দেয়। ইস্কান্দরের অসতর্ক মুহুর্তে ছিপসহ বড়শি নিয়ে পুকুরে মৃগেল মাছের টানাহ্যাঁচড়া চলে। হতভম্ব ইস্কান্দর, জুলেখা অথবা থুঁতনি ছেঁড়া মাছের কথা ভুলে গিয়ে, সে অবস্থায় পুকুরে লাফিয়ে পড়ে।

বড়শিসহ মাছ কিংবা মাছসহ বড়শি নিয়ে ইস্কান্দর আবার ঘাটলার পাশ দিয়ে পাড়ে উঠে। আর এররকম উত্তেজনার পর যখন সে স্বাভাবিক ভাবে চিন্তা করতে শুরু করে প্রথমেই তার থুঁতনি ছেঁড়া মাছটার কথা মনে পড়ে।

মৃগেল মাছটা বাড়িতে রেখে এসে ছিপ ফেলে যখন ইস্কান্দর কিছুটা প্রশান্তি বোধ করে, তখনই একটা কালো গোল দাগের লেজে লাল ফুটি করা থুঁতনি ছেঁড়া মাছ চিত হয়ে ভেসে উঠে। ইস্কান্দর প্রথম একটু অবাক হয়, পরক্ষণেই বুঝতে পারে কি ঘটেছিলো এই মাছ-জুলেখার জীবনে। ছিপ ফেলে হাঁচড়েপাঁচড়ে পুকুরে নেমে মাছটাকে আলতো করে দু'হাতে তুলে নেয়, হয়তো এমন করে সে তুলে নিতো জুলেখাকেও।

যদিও মাছের শোক দীর্ঘ হয় না, তথাপি ইস্কান্দর সেই দিন পূর্নশোক পালন করে। দুপুরে সে ভাতও খায় না, বিকেলে সে বাজারেও যায় না, আর রাতে খড়ের গাঁদায় শুয়ে শুয়ে সে একটা তারা বাছাই করে, যাতে করে মাছটার কথা জুলেখা হয়ে ফিরে ফিরে আসে আর যেন কোনদিন জুলেখার সাথে দেখা হলে এই তারা সে প্রেমের চিহ্ন মনে করে নিবেদন করতে পারে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.