![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাদামাটা একটা বাড়ি, ভিটে রাস্তা থেকে অনেক উঁচুতে। আশেপাশের চৌচির হয়ে যাওয়া জমি দেখলে মনে হয় এতো সুন্দর কারুকাজ ঈশ্বর বা দেব দেবীদের। বৃষ্টি হয় না অনেক দিন। নদীর পানিও আর এখানে তার শীতল আঁচল বিছিয়ে দেয় না। কোন একসময় প্রিয় ভারতের দেবদেবীরা তুষ্ট ছিলেন, এখন উনারা রুষ্ট।
বাড়ির ভেতর বাইরে নিমগাছ আর পেঁপে গাছের আধিক্য। হয়ত কেউ কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা জ্বর জারিতে একাত্মতা বোধ করেন। আমাদের বসার জায়গা হলো কামরুল ভাই'র বন্ধুর ঘরে। কামরুল ভাই'র বন্ধুর নাম টুটুল।
টুটুল ভাই'র চোখের নিচে কালশিটে পড়ে গেছে, ডান হাতে, কাঁধে পুরোটাই ব্যান্ডেজ। শুয়ে থেকেই বাম হাতে কোনমতে উঁচিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। আমরা কিছুটা অস্বস্তির সাথে দমবন্ধ করা গরমে এসে খাট আর লোহার চেয়ারে নিজেদের এলিয়ে দিয়েছিলাম।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে কামরুল ভাই আমাদের এখানে নিয়ে এসেছেন। টুকিটাকি আলাপ আর পরিচয়পর্ব শেষ করে, অতিথিসেবার আয়োজন উদরস্থ করে, কামরুল ভাই আর টুটুল ভাইর খুনসুটিতে নজর দিলাম আর জানা গলো উনার হাত ভাঙ্গার রহস্য।
গ্রামে গঞ্জে মানুষেরা, পশুদের প্রজননের উদ্দেশ্য এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ছুটে যায়। কোন না কোন গ্রামে এক একজন বিশেষ লোক থাকে যারা এসবের জন্যে খ্যাত থাকে।
গেলো সপ্তাহে এই টুটুল ভাই, যিনি ছাগী পালন করেন আর তার থেকে জাত বাচ্চাগুলো বাজারে বিক্রি করে ঘর সংসার চালান - যথারীতি তার পাঁচটা ছাগি নিয়ে পাশের গ্রামে শামসু মিঞার ওখানে গিয়েছিলেন সেগুলোকে পোয়াতি করবেন বলে।
শামসু মিঞার এখানে দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসে মাদী গরু আর ছাগল নিয়ে। তার এখানে আড়াআড়ি করে পোঁতা আছে বিশটি বাঁশ। আলাদা টিনের চালা দেয়া। প্রতিটি প্রাণীর জন্যে দুইটা করে, গুণ চিহ্নের মতো। একসাথে দশটি গরু বা ছাগলকে প্রজনন করানো যায়।
পশু পাখির প্রজননের ক্ষেত্রে শামসু মিঞার এই ক্ষনিক ভালোবাসার ব্যবসা তাকে দিয়েছে খ্যাতি, অর্থ আর অভিজ্ঞতা। তার ছেলেমেয়ের সংখ্যা সাত - মেয়ে তিনটি, ছেলে চারটি। আমেনা বেগম তার স্ত্রী, শরীর সুস্থ থাকলে আগামীতে আরেকটা সন্তান নেয়ার ইচ্ছে আছে শামসু মিঞার। এ তল্লাটে তার মতো করে প্রজননের কাজ আর কেউ করে বলে শ্রুতি নেই। নিষ্ঠা কাকে বলে তিনি তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
শামসু মিঞা কাজ শুরু করতেই টুটুল ভাই, যিনি কামরুল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আশেপাশের প্রকৃতি ও ফুল, আকাশ ও ফসল আর মানুষ ও ছাগ-ছাগীদের যুগপৎ আনন্দ, বেদনা আর ভবিষ্যৎ মাথায় না নিয়ে, দু'ঢোক তাড়ি গিলে ভ্যানের উপরে কাঁঠালপাতা ছড়িয়ে দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে পড়লেন।
মাটিফাটা রোদ্দুরে উনার যখন ঘুম ভাঙ্গল তখন বেলা হয়ে গেছে, আধবোজা চোখে এদিকে সেদিকে তাকিয়ে উঠে ভেতরে গিয়ে দেখেছিলেন ছাগীগুলো খড় চিবুচ্ছিলো। গুনে গুনে পাঁচটা ছাগী নিয়ে ভ্যানে উঠিয়ে রওনা দিয়ে ছিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।
শামসু মিঞার বাড়ি থেকে বাজার শ'গজের মতো হবে। টুটুল ভাই'র ভ্যান যখন বাজারের কাছ থেকে দশ গজের মতোন দূরে আছে, তখন একেবারেই শূন্য থেকে শামসু মিঞা হাজির হলেন। ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে গতিরোধ করে জানতে চাইলেন, কি করে টুটুল ভাই তাকে না জানিয়ে ছাগীগুলো নিয়ে চলে আসলেন।
কথায় কথায় কথা বাড়ে আর এর সাথে যদি দেনা পাওনা জড়িত থাকে তবে তো সোনায় সোহাগা। আর যেহেতু মানুষের জীবনে তেমন বিনোদনমূলক কিছুই ঘটে না, তাই শামসু মিঞা আর টুটুল ভাইকে নিয়ে একটা ছোটখাটো ভীড় জমা হতে খুব বেশি সময় নেয় না।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, শামসু মিঞার এই ব্যবসা পদ্ধতি প্রতি পশু দুইশত পঞ্চাশ টাকা করে, কিন্তু বাচ্চা হবে কি হবে না এই নিশ্চয়তা উনি দিতে পারবেন না। সেজন্যে তার বাড়ির বাইরে একটা স্টিলের বক্স আছে, যেখানে দান খয়রাত করা যায় আর বিনিময়ে সন্তান লাভের সম্ভাবনা থাকে। আর টুটুল ভাই যেহেতু পাঁচটি ছাগী নিয়ে এসেছেন, সেহেতু শামসু মিঞস বারোশ পঞাশ টাকার দাবীদার।
শামসু মিঞা চিৎকার চেঁচামেচি করে তার পাওনা দাবী করলেও টুটুল ভাই মুখের কোনে বাঁকা একটা হাসি ধরে রাখলেন তাচ্ছিল্য করে। শেষমেষ এক মুরুব্বি মিমাংসা করে দিতে উদ্যত হলেন, আর জনতা সমস্বরে হুল্লোড় করে সমর্থন জানিয়ে দিলো।
শামসু মিঞার অভিযোগ টুটুল ভাই আরো কয়েকবার টাকা দেয় নি বা দিয়ে থাকলেও বাকি ছিলো। যেহেতু নিয়মিত খরিদ্দার তাই সে মেনে নিয়েছিলো। মুরুব্বি সব শুনলেন, বুঝলেন তারপর বলে দিলেন আগামী বাজারের দিন টুটুল ভাই, শামসু মিঞা ও তার ছাগলদের পাওনা পরিশোধ করে দিবে। আর যদি ব্যর্থ হয়, তবে তার ছাগীদের আর কোনভাবেই আশেপাশের গ্রামের কেউ পোয়াতি করে দেবে না।
জনতা উৎফুল্ল চিত্তে এ বিচার মেনে নিলো, মানলো না আমাদের টুটুল ভাই। ভ্যান থেকে নেমে টুটুল ভাই মুরুব্বিকে বললেন, "চাচা এ কেমন কথা! আনন্দ করবেন আপনি, ফুর্তি করবেন আপনি আর বিল চুকাবে আরেকজন"? মুরুব্বি কথার গূঢ়ার্থ বুঝলেন কি বুঝলেন না - টুটুল ভাইকে বেয়াদব বলে ফেললেন।
টুটুল ভাই গরিব হলেও আত্মসম্মানবোধ বলে কথা, বাজারের দিন তাই হাটে হাড়ি ভাঙ্গলেন।
টুটুল ভাই, রাগের মাথায় বলে ফেললেন, "চাচা, গেলো মাসে শহরে গিয়ে যখন আপনি হোটেলে উঠলেন আর তারপর আনন্দ করে বিল চুকিয়ে ফিরলেন, কই তখন তো আপনি হোটেলওয়ালাদের কাছে আপনার পারিশ্রমিক দাবি করলেন না, তবে এখন কেন আপনি আমার এই বাপ মা ছাড়া ছাগীগুলোর জন্যে শামসুর ছাগলদের পারিশ্রমিক দিতে বলেন"।
টুটুল ভাই এখানেই থামলেন না। আরো বললেন, "শামসু মিঞা তো হিসেব মতে আমাকে টাকা দেবার কথা, আমি তো সেই দাবী করি নাই, তবে আমার দোষ কী? তার ছাগলগুলো তো ঠিকই আনন্দ করেছে, টাকাতো আমার ছাগীরা পাওনা"।
মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেলো, "তারপর"!
খানিকক্ষণ সবাই চুপ, গরম আরো বেড়েছে মনে হচ্ছে। টুটুল ভাই বললেন, "ভাগ্য ভালো ছাগীগুলোর কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিলো, নাইলে আমাকে সহ আবার ওরা পোয়াতি বানয়ে দিতো, খালি হাত ভাঙ্গার উপর দিয়ে গেছে"!
©somewhere in net ltd.