নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

উৎসের খোঁজে।

Jaliskhan

মানুষ হইবার চাই

Jaliskhan › বিস্তারিত পোস্টঃ

ত্রাণ

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ১২:২২

​এক.

গ্রামের নাম আন্ধা। আন্ধা এখানে সৃষ্টিকর্তাও। আন্ধা এখানে মানুষের বিবেকও। পল্লিবিদ্যুত বলে কিছু একটা থাকলেও তার বদৌলতে চব্বিশ ঘন্টায় অন্তত চব্বিশ মিনিট বিদ্যুতের আলো বাকি সময়ের অন্ধকারকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না। ফি বছর ‘বন্যায় ভেসে যাওয়া’ ঘটনার কততম পূর্তি হলো, এ খোঁজও কেউ রাখে না।

দুশো পরিবারের আন্ধাবাসীরা প্রায় সবাই অভয়নগর ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্রে আছে মাসাধিক কাল ধরে। বাণে ভাসা মানুষ। সপ্তাখানেক আগেও দু’বেলা জাউ আর শুকনো চিড়ে ছিলো খাবারের তালিকায়। এখন থেকে একবেলা জাউ আর একবেলা শুকনো চিড়ে।

পরবর্তী ত্রাণ পৌঁছানোর কোন নিশানা দেখা যায় নি। দিন তিনেক হবে একদল একটা নৌকা নিয়ে বেরিয়েছিলো, এখন পর্যন্ত ফেরে নি। এর মাঝে দুজন বৃদ্ধ আমাশয় হয়ে, অল্পবয়েসি একটা মেয়ে, যাকে সাপে কেটেছিলো আর একটা দু’বছরের বাচ্চা না খেতে পেয়ে মরে গিয়েছিলো। এদের একটা কলার ভেলায় জড়ো করে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে।

এখন ছোট দু’মাসের একটা বাচ্চা আছে এক মেয়ের কোলে, নাম মনি। ছোটখাটো মেয়েটা, সরলতা আছে কিন্তু সেই সাথে আছে অসাধারণ প্রাণশক্তি। একমাত্র সেই হাসি দিয়ে এখনও কথা বলতে পারে আর বলে তার সন্তান বড় হলে আবার সব ঠিক করে দেবে, তাদের নিজের ঘর হবে, অনেক উঁচু করে বানাবে তারা যেন আর ভেসে না যায়।

বাদবাকিদের মাঝে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি। আর ছেলেপিলে সারাদিন মরা মাছ, পশু দেখে দেখে আর চেঁচামেচি করে কাটিয়ে দেয়। পুরুষেরা আশ্রয়কেন্দ্রের সিঁড়ির পাশ ঘিরে বসে থাকে আর অভিশাপ দেয় তাদের পূর্বপুরুষদের প্রতি। সৃষ্টিকর্তার কাছে আহাজারিও করে কেউ কেউ।

দুই.

সাবিহা’রা এসেছে তাও একমাস হয়ে গেলো। ধরতে গেলে ওদের এই স্বেচ্ছাসেবী দলটা উদ্যোগ না নিলে হয়তো আন্ধাবাসীরা এই আশ্রয়কেন্দ্রে আসতই না। কেন ওরা আন্ধা গ্রাম বেছে নিয়েছে জানে না, কিন্তু সাবিহা বুঝতে পারে তার জন্যে হয়তো এটাই ছিলো ভবিতব্য।

সাবিহা ভাবে মধ্যযুগে যেমন দাসদাসীরা মরে গেলে ওদের ফেলে দেয়া হতো রাস্তার আশেপাশে, মুক্তিযুদ্ধে যেমন হানাদার বাহিনীরা মেরে ফেলে রেখেছিলো আমাদের, এখনও তেমন উচ্ছিষ্টের মতো এই দেশের আমাদের সময়ের নাগরিকদের মরতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সবই তো খাওয়ারই জন্যে!

সাবিহা হয়তো চলেই যেতো যদি না এই মনি ওকে সেদিন বিপদ থেকে না বাঁচাতো। সাবিহার থেকে যাওয়া কোন কৃতজ্ঞতা থেকে নয় হয়তো, কিন্তু একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সাবিহা যখন নিজেকে মনি’র জায়গায় কল্পনা করে, তখন আর সে ছেড়ে যেতে পারে নি। কোন কারণ ছাড়াই সাবিহার মনে হয়েছে, দেখি না আর কিছুদিন। টিপিক্যাল বাঙ্গালি মানসিকতা, কিন্তু তাও সই। শেষ ও দেখতে চায়।

সাবিহারা এখানে এক সপ্তাহের জন্য এসেছিলো। এখন চার সপ্তাহ চলছে, তার জিদের কাছে হার মেনে বাকিরা চলে গেলেও সে রয়ে গেছে আন্ধাবাসীদের সাথে। সাবিহার সাথে মনির একটা সখ্যতা হয়ে গেছে। মনি’র বুক থেকে বাচ্চাটা দুধ পায় না ঠিকমতো। তখন চিপে চিপে বাচ্চাটাকে খাওয়াতে হয়, সেসময় সাবিহা সাহায্য করে। তবে বলা যায় দেনা পরিশোধের মতো।

একমাত্র বাথরুমে যেদিন সাবিহার তলপেটে চিরে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়েছিলো, খানিকটা বিরক্তিতে, খানিকটা অসহায়ত্বে কাঁদছিলো – তখনই মনি এসে দরজায় খটখট করে তাকে বাঁচিয়েছিলো।

সেই দুঃসহ স্মৃতি যখনি মনে পড়ে সাবিহা দাঁতে দাঁত চাপে। বাসায় আজ যোগাযোগ নেই তিন সপ্তাহ হয়ে গেলো। এখন আর একদম ভাবনা হয় না সাবিহার। গায়ের উটকো গন্ধ আর এতোটা পীড়া দেয় না। এখন জাউ আর শুকনো চিড়ে মুড়ি খেতে খেতে “ফাস্ট ফুড” দোকানের কথা মনে পড়ে। কেন যেন মনে হয়ে ওখানে জীবন ছিলো না, জীবন এখানে। এই মানুষগুলোর মাঝে।

এই মানুষগুলো যারা জানে না আবার কবে ফিরবে নিজের ভিটেয়। আবার কবে উঠোনে বসে রাতের বেলায় দাদুর গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাবে ছেলেপিলের দল, জানে না যারা ভেসে গেছে বানের জলে, ওদের কি আরেকবার শ্রদ্ধা জানানো যাবে কি না। ওরা জানে না আবারও তিল তিল করে গড়া সংসার নতুন করে ভেসে যাবে বানের জলে বছর কে বছর।

তবুও মনিরা স্বপ্ন দেখে, মৃতপ্রায় স্তনের দু একফোঁটা দুধে তার সন্তান বড়ো হবে, চারপাশের জল নেমে গেলেই আবার বাঁধবে ঘর, বাঁধবে স্বপ্ন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.