নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

উৎসের খোঁজে।

Jaliskhan

মানুষ হইবার চাই

Jaliskhan › বিস্তারিত পোস্টঃ

মায়া

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৪২

আমি মায়াকে খুঁজে বেড়াই বছর তিনেক হয়ে গেলো। উঁহু তোমরা যেমন ভাবছো তেমন কিছু নয়। আমাদের ফোনে কথা হতো, সেও আবার টেলিফোনে মানে যাকে ল্যান্ডফোন বলে সবাই। কেমন করে যোগাযোগ হয়েছিলো, পরিচিত কেউ ছিলো কি না সে প্রশ্ন অবান্তর। কারণ মায়া ঠিক কি চিন্তা করতো সেটা জানা হয় নি কখনও। ওরকম সুযোগ আসেও নি তেমন।

একদিন দুপুরবেলা ঠিক তিনটে বাজে ঘড়িতে, ল্যান্ডফোনের ক্রিংক্রিং মেজাজি শব্দে বিরক্ত হয়ে রিসিভার উঠিয়ে বলেছি, "জ্বি, বলুন"!

ঠিক শেষ অক্ষরটা বাতাসে মিলিয়ে যায় কি যায় নি, আমি বুঝে গিয়েছিলাম খানিক স্তব্ধতার ফাঁকে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যে বোবা ভাষা এখনও বুক থেকে মুখে শব্দে রুপ নেয় নি, তা মায়া।

- আপনার বাবাকে দিন, উনাকে বলবো।

জীবনে সেইবারই প্রথম একটা বাক্য গিলতে ঘাম ঝরেছিলো আমার। কোনমতে ঢোক গিলে বলেছিলাম, "কে বলছেন"?

- তোমাকে বলবো কেন? তোমার নাম কি বলো তো?

- জ্বি, আমি শরিফ। শরিফুদ্দিন ভূঁইয়া।

কেন এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম, জানি না। গলা শুকিয়ে কাঠ। জলের খোঁজে ইতিউতি তাকাতে গিয়ে জানালায় চোখ পড়েছিলো। নিচের রাস্তায় একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হাঁটছিলো। গ্লাসে জল ঢেলে এক ঢোক খেতে গিয়ে মনে পড়ছিলো, ওহ বাবাতো বেঁচে নেই, তবে এই টেলিফোনে উনি কাকে চাচ্ছেন।

এইবার আমি চেতনায় ফিরলাম যেন। চোখ রগড়ে আরেকটা ছোট দম নিয়ে বললাম, "খুকি, বলে ফেলো কোথা থেকে ফোন করেছো? বাসায় জানিয়ে দেবো কিন্তু"!

একটা টুং টাং আওয়াজ, আঁচলের খসখস আর ক্ষীণ কাজল কালো চুলের মতো ক্ষীণ কিন্তু মর্মভেদী এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, "আমি, মায়া। আপনাকে বিরক্ত করেছি, দুঃখিত"।

কিছুক্ষণ আমিও চুপ, অপরপ্রান্তেও চুপ। কোন বিজয়ের অনুভূতি হলো না, কেমন যেন একটা মমতা, নিচের হেঁটে যাওয়া জোড়া প্রাণী থেকে জানালার ফাঁক গলে হয়তো ভর করলো আমায় আর আমি বেশ স্নেহপ্রবণ হয়ে গেলাম।

এসবই অধিকারবোধ, জানো। কেউ একটু দুর্বলতা দেখালে আমি অধিকার ফলাই।

বললাম, "আরে দুঃখিত হবার কি আছে! ভুলচুক তো হয়ই"!

এসবই ছিলো শুরু করার পায়তারা মাত্র। কেন যেন হয়ত দূরালাপনি বলেই, মায়ার ভারী কণ্ঠস্বর আমার অবচেতন মনে তো রয়েই গেলো, কিন্তু কানে এসে ভর করলো চুড়ির আওয়াজ, শাড়ির খসখস আর চোখে ভেসে আসা একটা মুখাবয়ব, শুধু জ্যামিতিক জটিল রেখার গোলকধাঁধা।

মায়া প্রগলভ ছিলো, কর্তৃত্বপরায়ণ ছিলো, দেখো গিয়ে সুন্দরীও ছিলো। এই যেমন পাতলা শরীর, এলো চুল, তাকালে বুকটা এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যায় - এ জাতীয়। কিন্তু আমার কাছে মায়া ছিলো শুধুই একটা রেখা, খুব সূক্ষ্ম কিছু রেখা, জ্যামিতিক।

আমাদের ওই দুপুরবেলাই কথা হতো, আর এর মাত্রা দিনে দিনে ছাড়িয়ে যাওয়া শুরুও করলো। মাত্রা ছাড়ানো জ্ঞানে আমরা কখনও হাসি, কখনও কাঁদি, কখনও সহানুভূতি জানাই। কিছু একটা মায়ার হয়েছিলো সে আমি বুঝতাম ঠিকই। কারণ কথা বলতে দু'একটা শব্দে ওর কম জোর দিয়ে বলা, কোন কোন জায়গার নাম বললে ওর বিরক্তি আমি টের পেতাম, ফোনেই।

আমাদের মাঝে ভালোবাসা ছিলো না, সেটা আমি বা মায়া দু'জনেই বুঝতাম। সহানুভূতি তো ছিলই, কিন্তু ছিলো নির্ভরতা। মন খুলে কথা বলতাম। আর একদিন যখন ও বললো, নতুন শাড়ি পরে কথা বলছে, আমি একটুও অবাক হই নি।

আর ওমন দুপুরে কথা বলতে বলতে, দুপুর নিয়ে আমি অনেক কিছু জেনে গেলাম। দুপুরে হয়তো শরীরস্থ গ্ল্যান্ডের কারসাজি থাকে, হয়তো সেই বৃষ্টির ছাঁটে ঘরে ঢোকা চড়ুই পাখি আমার মতই মায়াকে খোঁজে, হয়তো কোন কোন দুপুরে সব চুপচাপ হয়ে এলে মায়ার শ্বাস আমার শরীরে এসে লাগে।

একদিন ফোন এলো, মায়া একাকিত্ব কাটাতে চাকুরি বেছে নিয়েছে। ও তোমাদের বলা হয় নি, আমরা দু'জনেই শিক্ষিত। কি একটা কল সেন্টারে চাকুরি পেয়েছে ও। কদিন বাদেই জয়েন।

বেশি কিছু জানা হলো না। বাসায় কেউ এসেছিলো মনে হয়। ফোন রেখে দিলো। এরপর আর আট দশদিন কথা হয় নি। তারপর একদিন দুপুরে কেউ ফোন করেছিলো, কিন্তু ধরা হয় নি। এভাবেই চলছিলো, বিস্মৃতির তলায় চাপা পড়ে পড়ে কিংবা অভিমানে আর খোঁজা হয় নি মায়াকে।

আমি তখন নিজেই চাকুরির খোঁজে ঘুরে বেড়াই সারাবেলা। আর রাস্তায় বেরুলেই চমকে উঠি, এই বোধহয় মায়া।

একসময় চাকুরি খুঁজে পেতে পেতে হয়রান হই, অন্যদিকে মায়া যেন ধীরে ধীরে আমার সত্তায় বাসা বাঁধে। আমি নিজেই তার অবয়ব দেই, আমি নিজেই কথা বলি। ভাইভাতে জিজ্ঞেস করে ভবিষ্যতে কি হবার ইচ্ছে। আমি বলি, "শুধু দুপুরবেলা আমাকে দশমিনিট ল্যান্ডফোনে কথা বলতে দেবেন। বাদবাকি আমি সব করে দেবো"।

আমার আর চাকুরি হয় না। মায়ার সাথে আর কথা হয় না। জ্যামিতিক রেখাগুলো স্থূলতায় ভোগে। আমি উদাসিন হাঁটি, দুপুরে জানালা দিয়ে দুটো মানুষকে দেখি, বৃষ্টি দেখি, ভিজে চাওয়া চড়ুই পাখির চোখে মায়া দেখি, কিন্তু মায়াকে খুঁজে পাই না। সেই মায়া যার পরিচিতি মানে কিছু শব্দ, একটা লয় আর কিছু ভাবনা।

একদিন কল সেন্টার থেকে একটা ফোন এলো। আগে ধরতাম না, এখন ধরি। নিরাশ হবার আগে, আমাকে যখন জিজ্ঞেস করেছিলো, "স্যার, আর কোন তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারি"?

আমি বলেছিলাম, "মায়াকে চিনেন, খুঁজে দেবেন"?

- "সরি স্যার। আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে"!

আর কি বলবো বলো! ওরা সাত পুরুষের সব তথ্য জানে আর মায়ার কথা বললেই বলে, আমি ভুল করেছি।

তাও মুষড়ে পড়লাম না। মনে হলো, সবগুলো কল সেন্টারে খোঁজ নেবো, একবার না একবার তো মায়াকে খুঁজে পাবই। তোমরা জানো কি না, আমাদের দেশে হাজারো রকমের কল সেন্টার আছে!

প্রতিদিন ফোন দেই কল সেন্টারে, একটা করে গলার আওয়াজ শুনি আর রেখে দেই। কখনও কখনও মনে হয় এইবার বুঝি পেলাম, নাহ, সেই চুড়ির গা ঘেঁষাঘেঁষির শব্দ আর শুনতে পাই না, শুনতে পাই না সেই হালকা করে ছড়িয়ে দেয়া দীর্ঘস্বাস। শুনতে পাই না রিসিভারে আসা সেই মায়াভরা মায়াবি কথা।

সেদিন দুপুরবেলা কে যেন ফোন দিয়েছিলো, না না না - ল্যান্ডফোনে না সেলুলারে। আমি আর বাসায় থাকি না দুপুর বেলায়, ক্লান্ত কোন রাস্তার বাঁকে, উদাস কোন পার্কের ভেতরে আমি এলোমেলো হতে থাকি। সেদিন প্রায় গোল হয়ে ছিলাম, সেই সময় ফোন। অনেক বড় নাম্বার, পুরো পড়তে গেলে ফোন কেটে যাবে, তাই কাঁপা কাঁপা হাতে ধরেই ফেললাম।

- গুড ইভেনিং, মি. শরীফ বলছেন।

কন্ঠের স্বরে প্রায় ভেবেই নিয়েছিলাম, প্রতীক্ষার প্রহর গোনা শেষ। কিন্তু জানো, সে কন্ঠে মায়া ছিলো না, দরদ ছিলো না, ছিলো যাপিত জীবনের লাস্যময়তা।

- জ্বি, বলছি। আমার নির্বিকার উত্তর।

- আমাদের কোম্পানি পৃথিবীর বিখ্যাত......।

আস্তে করে ফোনটা কেটে দিয়ে মায়াহীন চোখে তাকালাম আধুনিক জীবনে। আবার ফোন এলো।

- স্যার, একটু আগেই ফোন করেছিলাম। আপনি কি কেটে দিয়েছিলেন! আমি ভেবেছি এখান থেকে কিছু হলো কি না! খুবই দুঃখিত।

- দুঃখ আমি দেখেছি। আপনি কি মায়াকে দেখেছেন, মায়াকে জানেন।

- দুঃখিত স্যার, আমরা তো প্রডাক্ট বিক্রি করি। আপনি বোধহয় ভুল করছেন।

আমার খুব রাগ হয়েছিলো, কিন্তু রেগেমেগে মায়াকে আর হারাতে চাই নি। আমাকে বলে ভুল করেছি। তিনবছর ধরে কেউ ভুল করতে পারে!

- জ্বি, ভুল আমারই হয়েছে। আচ্ছা শুনুন, কাল একবার শাড়ি পরে আসবেন। চুড়ি পরবেন আর ভালো না লাগলে টিপ দিতে হবে না কপালে। তবুও কাল হাসিমুখে আসবেন। আমাকে ফোন দেবেন আর এসব বলছি বলে বকে দেবেন।

তারপর লাইন কেটে দিলাম। ফোন বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম গাছগুলোর দিকে। অব্যক্ত গাছেরা কি মায়াকে চেনে, নিশ্চয় চেনে। কি এক অসীম মায়া নিয়ে ওরা দাঁড়িয়ে থাকে। আমি আর প্রকৃতি একা দাঁড়িয়ে থাকি, মায়ার খোঁজে, ধূসর বিস্তৃত জ্যামিতিক এক অরণ্যে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.