![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক.
লালক্রস বম এর ঘরে আজ আনন্দ আর আনন্দ। ঢাকা থেকে পঁচিশ জন বাঙ্গালি আসবে পাহাড়ে ঘুরতে, তার ঘরেই উঠবে। লালক্রসের এটাই প্রথম গাইড হিসেবে কাজ, অনেক বলে কয়ে কিছু খরচাপাতি করে অনুমতি আদায় করে নিয়েছে সে।
এই পাহাড়ে সে কম বয়সিদের মধ্যে শিক্ষিত, দেখতে সুন্দর আর সবচেয়ে বড় পাড়ায় একেবারে শেষের দিকে থাকে। একটা তিন বছরের ছেলে আছে আর সমবয়সি এক বউ। লালক্রসের মুখে হাসি ফিরে আসে।
একবার মনে হয় এই বাঙ্গালিগুলা চলে গেলে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে। হাজার পাঁচেক টাকা পাবে সে গাইড হিসেবে, আর যদি কিছু এদিক সেদিক করতে পারে, তবে তো হয়েই গেলো। এদিক সেদিক মানে চুরি বা লুকিয়ে কিছু করা না। এদিক থেকে বমেরা অন্য মাত্রার। চুরি করা এদের ধাতে নেই। যত যাই হোক পাড়ায় বাঙ্গালি থাকবে এটা অন্য অধিবাসিরা খুব যে ভালো চোখে নেবে তা কিন্তু না। একে তো লালক্রসের ট্যাকে কিছু টাকা পয়সা আসবে, অন্যদিকে এই বাঙ্গালিগুলো অদ্ভূত রকমের মানুষ। নিতান্তই নোংরা আর এতো হৈ হল্লা করে যে বনদেবী আবার না রাগ করে।
এসবই লালক্রস ভাবছে আর প্রস্তুতি নিচ্ছে রোয়াংছড়ি যাবার। বাঙ্গালিগুলো ওখানেই এসে পৌঁছাবে দুপুরের দিকে। তারপর এদের নিয়ে পাঁচটা পাহাড় ডিঙ্গিয়ে আসতে সময় লাগবে দশ বারো ঘন্টা। বাঙ্গালিগুলো ঠিকমতো হাঁটতে পারে না। এ ভেবে লালক্রসের মুখখানা কেমন আনন্দে ভরে যায়।
দুই.
লালক্রস সকালের নাস্তা সেরে রওনা দেয় রোয়াংছড়ির উদ্দেশ্যে। যাবার আগে বউকে বলে যায় শতরঞ্জি, তোষক, পাটি আর রান্না বান্নার সরঞ্জাম গুছিয়ে রেখে দিতে। অভিযাত্রীরা এসে চুলো ধরাবে, খাবে তারপর ঘুমাবে।
বনবিবির নাম নিয়ে, যিশু কে স্মরণ করে লালক্রস ব্যাগ ঝুলিয়ে শুরু করে পথচলা। বাঙ্গালিদের মধ্য থেকে নেতা গোছের একজন ফোন দিয়ে তাকে জানায় ওরা পঁচিশ জন না সতেরো জন আসছে। লালক্রস মনে মনে যুগপৎ খুশি ও বেজার হয়। বেশি মানুষ মানে, বেশি যন্ত্রণা আবার বেশি মানুষ থাকলে বেশি আয়েরও ব্যাপার আছে।
এই তো সেদিন পাড়ার মাঝে একটা ঘরে আটাশজন বাঙ্গালি এসেছিলো। যাবার সময় ওরা প্রায় সব রেখেও গিয়েছিলো। সেই ঘরের লালচিয়ন বম, রেখে যাওয়া জিনিসপাতি বেঁচে সাতশো টাকা ঘরে নিয়েছে। এবার সে পাশের জমিটা জুম করবে।
লালক্রস এসবই ভাবতে ভাবতে পাহাড়ে উঠা শুরু করে। একটা শর্টকাট আছে, গোপন রাস্তা। ওটা ধরে এগোলে দুই ঘন্টার আগেই সে পৌঁছে যাবে।
আজকে রোদের তাপ আগের মতোই। এ অবস্থা চললে বাঙ্গালিদের আসতে সময় লেগে যাবে বেশি। পাহাড়ে রোদে হাঁটা অনেক বেশি কষ্টকর। তাছাড়া রনি পাড়া আসতে মাত্র দুইটা ছড়া পড়ে। পর্যাপ্ত জলের ব্যবস্থা না থাকলে কষ্টের মাত্রা অসহনশীল হয়ে যাবে।
লালক্রস আশে পাশের পাহাড়ে তাকায়। লোকজন আজ চলাফেরা কম করছে। তবে সন্ধ্যার পরে অনেক গুলা দল আসবে। লালক্রস মনে মনে ভাবে, এ দলটা গেলে সে আরো ভালো করে প্রচার করবে আর যদি নিয়মিত অভিযাত্রীর দল পায়, তবে পাশের পাহাড় থেকে আরো পাঁচ একর জায়গা নিতে হবে। সেখানে ভুট্টা করবে যখন অবসর থাকবে।
তিন.
লালক্রস যখন রনি পাড়া থেকে বেরিয়েছে, আশেপাশে তখনই রোদের তাপ প্রখর হতে শুরু করেছে। বাতাস আজ কম। জুমের ধানের গন্ধে বুক ভরে শ্বাস নেয় সে। বামের পাহাড়টার দিকে তাকায় কিছুক্ষণ। একটা বড় মেঘ, দলা পাকিয়ে পাহাড়টাকে ঘিরে ফেলেছে। ওদিকে কুকিরা থাকে।
লালক্রসের মনে পড়ে তার দাদুর কথা। বুড়ো মানুষটা সেই সময়ের গল্প করতো যখন "রনি কারবারি" এ জায়গায় এসে পাড়া বানিয়েছিলো। কুকিদের সাথে মিলে খৃষ্টান হয়ে গিয়েছিলো পুরো বম ও কুকি সমাজ।
এ ঘটনা বেশিদিন আগের নয়, উনিশো আঠারো সালের দিকে কুকিরা প্রথম ধর্মান্তরিত হয়। সারা পৃথিবীতেই তখন অভাব আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষের রেশ।
কুকিদের দেখাদেখি সেই অভাবের সময়েও বমেদের মাঝে "রনি কারবারি" এগিয়ে এসে না খেয়ে থাকা থেকে বাঁচায় ওদের। "রনি পাড়া" নাম তখন থেকেই। উনিশো তেতাল্লিশের শেষের দিকের ঘটনা।
মুরং, চাকমারা সেই সময় তাদের চাইতে ভালো অবস্থায় ছিলো। এদিকে ক্যাপ্টেন সেবাস্টিয়ান "সিপ্পি" পাহাড়ে আসার তোড়জোড়ে ব্যস্ত তখন। ব্রিটিশ মাউন্টেড বাহিনীর এই ক্যাপ্টেন এর হাত ধরেই মিশনারিরা এই দুর্গম এলাকায় এসে পড়েছিলো। এখানে পরে একটা ক্লাবঘরও করেছিলো ক্যাপ্টেন।
সিপ্পি পাহাড়ের নাম নিতেই, লালক্রস মনে মনে ক্রস আঁকে। এই পাহাড়ে বিদেশিরা এসেছিলো বলে বমের সর্দাররা অনেক মারামারি করেছিলো। কুকিদের কারণে পেরে উঠে নি। পাহাড়িদের মাঝে কুকিরাই সবচেয়ে হিংস্র। তবে বমেরাও কম নয়। এরা দু'পুরুষ আগেও মানুষ খেকো ছিলো।
সিপ্পিতে এই বিদেশিগুলো না আসলে, হয়তো ওরা আগের মতোই থেকে যেতো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে লালক্রস আবার পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে থাকে। আজকের গরমটা বেশ। ফাঁকে ফাঁকে একটুখানি বাতাস আসে আর সারা শরীরে শীতল পরশ বুলিয়ে যায়। পাহাড়গুলো যেন মুখ নিচু করে আছে। যতই মানুষের ভীড় বাড়ছে ততই পাহাড়গুলো বিরক্ত হচ্ছে যেন। হাজার বছরের নিরবতা ভেঙ্গে যাচ্ছে দেখে লালক্রসেরও বিরক্ত লাগে।
প্রথম পাহাড়টা অর্ধেক পেরিয়ে একটা কাঠের গুড়িতে ঠেস দিয়ে বসে লালক্রস বম। সিগারেট ধরিয়ে তাকায় আকাশের দিকে। কুকিদের পাড়ায় বৃষ্টি হচ্ছে। একবার লালক্রস ছোট থাকতে মেঘ ধরতে গিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিলো। মনে আছে প্রথমে লতাপাতায় আটকে ঝুলে ছিলো, তারপর একেবারে নিচে, পপাত ধরণি তল।
চার.
আজ এতো বছর পর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে লালক্রসের মুখে হাসির ক্ষীণ রেখা ভেসে ওঠে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে আবার পথ চলা শুরু করে সে। প্রথম পাহাড়টা সে খুব দ্রুত পের হয়ে ডেথ জোনে এসে দাঁড়ায়।
'ডেথ জোন' কেন বলে এই নিয়ে লালক্রস খুব বেশি চিন্তা করার সময় পায় না। পাহাড়ি ছাগলের মতো তরতর করে উঠে যায় লালক্রস। জায়গাটা কিছুটা বিপদজনক। একদিকে খাড়া পাথুরে পাহাড়, সাথে সরু সিঁড়ির মতো করে উঠে গেছে উপরে একশ ফিটের মতো। অন্যদিকে অতলান্ত খাদ। নেমে গেছে হাজার ফিটেরও বেশি।
শুধু পায়ের সামনের অংশে ভর দিয়ে লালক্রস উঠে পড়ে পাহাড়ের উপরে। এবার ডানে বাঁক নিয়ে আবার প্রায় একই সমান রাস্তা উঠতে হয় তাকে। পাহাড়ি শরীরেও হাঁপিয়ে যায় লালক্রস। তৃতীয় বারের চেষ্টায় সে বৃষ্টি ঘরে পৌঁছে দু'ঢোক জল পান করে নেয়।
এ পাহাড়টায় বেশ মেঘ করেছে। বৃষ্টি নামবে এখুনি। বাঙ্গালি দলটাকে নিয়ে সন্ধ্যের আগেই এই জায়গা না পেরুলে কি হবে ভাবতে ভাবতে লালক্রস দ্রুত পায়ে হাঁটতে থাকে। খানিকটা বৃষ্টির ছাট লাগে লালক্রসের গায়ে।
দ্বিতীয় পাহাড়ের খাড়া মেঠো পিচ্ছিল রাস্তা পেরিয়ে লালক্রস আবার এসে থামে পাইখং পাড়া। পনেরো টাকার ওটমিল এর প্যাকেট গরম পানিতে গুলে খেয়ে আরেকটা সিগারেট ধরায় লালক্রস। আজ সিগারেট টানা হবে বেশি। 'তা হোক' ভাবে লালক্রস।
পরের ঘন্টায় দেড়টা পাহাড় ডিঙ্গোয় লালক্রস। এখানকার হাটার পথ অনেক বেশি সমতল। খুব দ্রুত এগিয়ে যায় সে। ডানে আট দশটা পাহাড়ের সভা সমাবেশ সে দেখেও দেখে না। সূর্যর আলোয় ঝলসে উঠে ফসলের মাঠ, হরিৎ বর্ণের ফসলে বাতাসের দোলায়, কেঁপে কেঁপে উঠে। আর পাহাড়গুলোর চূড়া মনে হয় যেন তীব্র আলোয় নিজের সৌন্দর্যকে প্রস্ফুটিত করেছে, গাঢ় সবুজ আর হলুদ ধানের ক্ষেত থরে থরে নেমে গেছে পাহাড় থেকে পাহাড়ে, উঁচু থেকে নিচুতে।
পাঁচ.
লালক্রস আর কোনদিকে তাকায় না, ছুটে চলে একরকম যতক্ষণ না রোয়াংছড়ি যাবার খালে এসে পড়ে। আহ! আর মাত্র বিশ মিনিট। হাতে কাজ আছে অনেক। বাঙ্গালি গুলো আসলেই ওদের কাগজপত্র জমা দিতে হবে, অনুমতি নেয়া আছে আগেই। কিছু বাজার সদাই করবে। ছেলেটার জন্যে একটা দুটো জিনিস নিয়ে যেতে হবে ভাবে লালক্রস।
থানায় লালক্রস কথা বলে এসে বসে এক বাঙ্গালি দোকানে। সাড়ে এগারোটা বেজে গেলো। একটা বাস আসার কথা এখন। ওই তো দেখা যাচ্ছে ব্রীজের উপর কতগুলা লোক। মাথায় ক্যাপ, হাতে ব্যাগ, বেশিরভাগই হাফ প্যান্ট পরা। একটা লোককে দেখে হেসে ফেলে লালক্রস। লোকটার থুতনি থেকে লম্বা লম্বা ছাটা চুল বুক পর্যন্ত এসেছে, মাথায় ছোট একটা ক্যাপ।
সামনে খাটো মতো একটা লোক চশমা পরা, পাশে আরেকটা লোক চুল কম, তারও চোখে চশমা। তারপাশে লম্বা মতোন পুরুষ্টু শরীরের দু'তিনজিন, পেশিবহুল শরীর, মোটা থামের মতো হাত। লালক্রস একটা ঢোক গিলে এসব দেখে। আগে যারা এসেছিলো সব রোগা পটকা, এবারের লোকজন বেশ স্বাস্থ্যবান। ধনী মানুষ মনে হয় সবাই।
ঝুটি বাঁধা একটা কম বয়েসি ছেলে লালক্রসকে দেখে এগিয়ে আসে। লালও সামনে এগোয়। একই দেশের দুই ভাষাভাষীর মানুষ দুটো আলাদা সভ্যতার প্রতিনিধি হয়ে হাতে হাত মিলায়। লালক্রস সম্বোধন করে মামুন'দা বলে। একে একে পরিচয় হতে শুরু করে সবার সাথে।
লালক্রস হাত মিলায় নিপু সরকারের সাথে, এ অভিযাত্রী দলের সংগঠক, এ নিয়ে টানা এগারোটি অভিযাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ এই লোকটি। পরপর আসে শাকিল, ব্যক্তিগত জীবনে যে ইঞ্জিনিয়ার, এরপর রনি চাকুরি জীবনের শুরু যার মাত্রই, আসে নূর হোসেন যিনি চাকুরি করছেন বিদেশি ল্যাবরেটরিতে। রনি চৌধুরি যিনি ব্যবসা করে, পেশিবহুল শরীর নিয়ে একটু চাপ দেয় লালক্রসের হাতে, এরপর পরিচিতি হয় সৈকত, বিলেত ফেরত ব্যবসায়ী - চোখে তার অনেক স্বপ্ন।
একে একে আরাফাত- ব্যবসায়ী, নজরুল - চাকুরে, মাহফুজ- কাপড় বিক্রেতা, মোস্তফা - চাকুরে, মামুন - ইঞ্জিনিয়ার, ইমেল - চাকুরে, নাঈম - চাকুরে এবং একমাত্র ডি এস এল আর ক্যামেরা বহনকারী, হাসান - চাকুরে, দ্বিতীয় মামুন - চাকুরে, সুলতান- চাকুরে আর জেলিস - চাকুরে, হাত মেলায় লালক্রসের সাথে।
একটা দোকানে বসে সবাই নাস্তা করে আর নানান জিজ্ঞাসার ফাঁকে ছোট মামুন, সবার কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র জমা নিতে থাকে। লালক্রস লক্ষ্য করে ক্লান্ত প্রাণ সতেরো জন বাঙ্গালি কি যেন খুঁজে ফিরে ব্যাগের মাঝে। শেষ পর্যন্ত তিনজনের কাগজপাতি পাওয়া যায় না। লালক্রস একটা ঢোক গেলে। এমনিতেই সে নতুন, তায় আবার কাগজ ছাড়া পুলিশ বা আর্মি কেউ অনুমতি দিবে না।
ছয়.
লালক্রস কাগজ নিয়ে ছুটোছুটি করার ফাঁকে দেখে নেয় বাঙ্গালিগুলোর অবস্থান। নাস্তা করছে সবাই, তিনজন ভাত আর সবজি দিয়ে খাচ্ছে, বাকিরা রুটির সাথে আলু ভাজি আর ডিম ভাজা খাচ্ছে। কয়েকজন খাওয়া শেষে ইতস্ততবিক্ষিপ্ত ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
মামুন দা'কে নিয়ে লালক্রস কাগজপত্র গুছিয়ে থানায় জমা দিতে আসে। রোয়াংছড়ি থানা বেশ গুছানো দেখতে। পাহাড়ের মাঝে এ থানা, চারিদিকে খোলা জায়গা, দূরে সবুজ মাঠ বিস্তৃত হয়ে পাহাড়ে ঠেকেছে। সূর্যরশ্মি চামড়া পুড়িয়ে দিচ্ছে যেন। বাঙ্গালিগুলো এ রোদেও সমানে চিকন চিকন ক্যামেরায় ছবি তুলছে। একটু পর পর ক্যামেরায় কি জানি দেখে আর হেসে উঠে একজন আরেকজনকে দেখিয়ে।
লালক্রস লক্ষ্য করে গোঁফ পাকানো একটা ছেলে কিসব বলছে আর সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। বাদবাকিরাও এসে পড়েছে ততক্ষণে। বিশাল দেহী একজন সেই চিকন ক্যামেরা দিয়ে কথা বলছে দেখে লালক্রস অবাক হয়।
সবাই এসে গেলে, লালক্রস আরাফাতকে নিয়ে অফিসারের সাথে দেখা করে আসে। একটা রেজিস্টারে সবার নাম, বাবা মায়ের নাম, বাসার ঠিকানা, ফোন নাম্বার নিয়ে থানা থেকে বেরুতে বেরুতে বারোটা বেজে যায়।
নিপু দা'কে নিয়ে লালক্রস বাজারে যায় মুরগি কিনতে। দরদাম করে খুমিতে করে বারবিকিউ করার জন্যে ছয়টা মুরগি নিয়ে লালক্রস যখন বাজারে আসে ততক্ষণে সবাই ব্যাগ গুছিয়ে তৈরি হয়ে গেছে। প্রায় সবাই রোয়াংছড়ি বাজার থেকে গামছা আর স্যান্ডেল কিনে নেয়। পাহাড়ি পথে হাটতে এই দেড়শো টাকার স্যান্ডেলের মাহাত্ম্য মনে থাকবে এই বাঙ্গালিদের ভাবতে ভাবতে লালক্রস ঘরে ফেরার তাড়া অনুভব করে।
চশমা পরা ছোটখাটো দেখতে একটা লোক এসে লালক্রসকে জিজ্ঞাসা করে, "আমাদের কতক্ষণ লাগবে পৌঁছাতে"। লালক্রস হেসে বলে, "ছাত আট ঘন্টায় যাওয়া যাবে দাদা"।
তারপর আর কথা হয় না, সবাই ধীরে ধীরে রোয়াংছড়ি বাজার থেকে আর্মি ক্যাম্পের দিকে এগোয়। শেষ অনুমতি ওরাই দেবে।
এখানে আরো কতক্ষণ অপেক্ষা করে সবাই। সবার গ্রুপ ছবি তুলে রাখে আর্মিরা। বেশ মিশুক রকমের, কিন্তু লালক্রসকে দেখে ওদের বিরক্তি এড়ায় না কারো চোখে। লালক্রস আশ্চর্য শান্ত হয়ে থাকে এ সময়। অবশেষে মুক্তি মেলে, অনুমোদনের আনন্দে সুলতান লাফিয়ে উঠে আর লালক্রস অভিযাত্রীদের নিয়ে চলে পাঁচ পাহাড় দূরের গন্তব্য "রনিপাড়া"য়।
সাত.
অভিযাত্রী দল লালক্রসের সাথে নানা বিষয়ে কথা বলতে থাকে। একই বিষয় নিয়ে প্রায় সবাই বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে, আর হাসিমুখে সে জবাবও দিয়ে যায়। একসময় পুরো দল সভ্যতার শেষ চিহ্নটুকু পেরিয়ে নেমে পড়ে একটা খালে। সেই খাল যার উৎপত্তি তিনাপ সাইতার থেকে, সেই খাল যা সাংগু নদীতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।
এই জলের ধারার উৎসমূলে লালক্রস আর অভিযাত্রী দলের যাত্রা। নুড়ি বিছানো পথ, জলের তীব্র স্রোত, দুপাশে সবুজ পাহাড়, কুহক অরন্য আর কীট পতঙ্গের বিবিধ শব্দে আস্তে আস্তে অভিযাত্রী দল নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে।
দু'তিনটে মোড় ঘুরে ঝিরিপথের শেষে এসে পড়ে পুরো দল। খুমিতে রাখা মুরগিগুলো গরমের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কিছু মৃতপ্রায়, আর কিছু মৃত্যু আলিঙ্গন করে। যেন সামনের ভয়ঙ্কর পরিবেশের আভাস দেয়। আধমরাগুলোকে জবাই করে লালক্রস আবার সবাইকে নিয়ে এগোয়।
ছোট খাড়া একটা ঢালে উঠে মাটির রাস্তায় এসে পড়ে পুরো দল। প্রথম পাহাড়ের শুরু এখান থেকেই। পরবর্তী দুই পাহাড়ে থাকবে না কোন লোকালয়, থাকবে না কোন ছোট দোকান, পড়বে না কোন ঝিরি। অগত্যা গ্লুকোজ, স্যালাইন আর ভরপুর জল নিয়ে দারুণ আত্মবিশ্বাসে দৃঢ় পদক্ষেপে সবাই এগুতে থাকে। নিপু'দা, মোস্তফা দাদার সাথে লালক্রস জরুরি কিছু পরামর্শ সেরে নেয় হাঁটতে হাঁটতে।
আধা ঘন্টা পর যখন তিনটে খাড়া ঢাল বেয়ে, উপরে উঠতেই হাঁপিয়ে যায় শহুরে হাওয়ায় বেড়ে ওঠা বাঙ্গালি অভিযাত্রী দল। দুমিনিট জিরিয়ে নেয় সবাই। পরের আধাঘন্টায় লালক্রস আর অভিযাত্রী দল যখন পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছায়, অনেকের অনভ্যস্ত শরীর পথে বসে পড়ে। এর মাঝে একজন বিনীত অনুরোধ জানায় তাকে ছেড়ে যেতে।
লালক্রস প্রথম দিকে কিছু বুঝতে না পারলেও, ক্লান্তিকর পথচলা নিয়ে কথা ছোড়াছুঁড়ি উপভোগ করে সে। দশ মিনিট পর যখন সবাই আবার উঠে দাঁড়ায়, তখন সে কিছুটা হলেও অবাক হয়। কারণ আগের অনেক দলই, সে শুনেছে - এখান থেকে ফেরত গিয়েছে।
ঘন্টা দুয়েক লাগে প্রথম পাহাড় পেরুতে। লালক্রস তাড়া দিতে থাকে সবাইকে, থেমে থাকা যাবে না। সূর্য ঠিক মাথার উপর থেকে উপহাস করে অভিযাত্রী দলকে।
মানুষ হার মানে নি কোনদিনও, সে যতই কষ্টকর হোক পথচলা। সবাই দাঁতে দাঁত চেপে পরের পাহাড় ডিঙ্গোতে শুরু করে। যেখানে এক ঘন্টায় একটা পাহাড় পেরিয়ে যাবার কথা, সেখানে দুপুর দুইটার কিছু পরে অভিযাত্রী দল দ্বিতীয় পাহাড়ে অভিযান শুরু করে।
দ্বিতীয় পাহাড়, প্রথমটার থেকে কিছুটা রুক্ষ, পাথুরে আর অমসৃণ। রাস্তাগুলো ক্রমশ সরু হয়ে আসে। সবাই ঘন ঘন শ্বাস নেয় আর ক্লান্ত ভঙ্গিতে এলোমেলো পা ফেলতে থাকে। কচিত কদাচিৎ দু'চারজন আশেপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে ছবি তোলে।
আশেপাশে মৌনব্রতে থাকা পাহাড়গুলো আরো বেশি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। রোদের ঝলকে অপার্থিব এক সবুজ চোখে ধরা দেয়। দূরে সারি সারি পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে অভিযাত্রী দল বিস্ময়ে থাকিয়ে থাকে এক অপার নিরব সৌন্দর্যর দিকে। এ যেন অন্য কোন গ্রহ, এ যেন ভিন্ন কোন জগত।
আট.
দ্বিতীয় পাহাড় পেরুতে পেরুতে চারটা বেজে যায়। লালক্রসের কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে। কারণ সামনের তিনটা পাহাড়ই ভয়াবহ রকমের খাড়া, একেবারে উঠে গেছে উপরে, দম নেবার জায়গাটুকু পর্যন্ত নেই। লালক্রস আবার সবাইকে তাড়া দেয়, যাদের দম আছে তারা পথচলা শুরু করে। দুচারজন তখনও বসে থাকে।
লালক্রস বুঝতে পারে, সমতলের আলো ছায়ায় বেড়ে ওঠা মানুষেরা পাহাড়ে আসলে রবাহূত। এখানে বাতাস নেই, খাবার পানি নেই, ধান আর ভূট্টা ছাড়া আর কিছু চাষ হয় না, বন্য জন্তু বলতে গয়াল আর মাঝে মাঝে কিছু হরিন এখনও পাওয়া যায়। এদের বেশিরভাগই থাকে "সিপ্পি" পাহাড়ের দিকে। লালক্রস আরো একবার শূন্যে ক্রস আঁকে।
বাঙ্গালি অভিযাত্রী দলটি যখন তৃতীয় পাহাড়ের উপরে, একজন অজ্ঞান হয়ে শুয়ে পড়ে পথে। লালক্রস তখন সামনে এগিয়ে কারণ আরেকজন শ্বাস নিতে না পেরে আকুলি বিকুলি করছে। কোথা থেকে বেঁটেমতো চশমা পরা লোকটা এসে কি জানি খাইয়ে দেয়। সবাই আরেকবার পাঁচ মিনিটের বিশ্রাম নেয়। এ পাহাড় থেকে নেমে, পরের পাহাড়ের মাঝামাঝিতে একটা পাড়া আছে, লালক্রস মনে মনে যিশুকে অনুরোধ করে এ যাত্রায় সহযোগিতা করতে।
হয়তো যিশুর কথা শুনেই নয়তো দয়াপরবেশ হয়ে প্রকৃতি শীতল বাতাসের পরশে আবার তাগড়া করে তোলে। মিনিট দশেক হাঁটার পর আবার সবাই বসে পড়ে। সামনে সরু ঢালু সিঁড়ির মতো রাস্তা, যেন পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাওয়া যাবে।
মাহফুজ আর জেলিস দাদা উঠে দাঁড়িয়ে ঢালে দাঁড়ায়। বাদবাকিরাও পাশে এসে থমকে দাঁড়ায়। সম্ভবত সবাই একই ব্যাপার ভাবে। সামনে যতদূর চোখ যায় শুধু গাদাগাদি করে রাখা পাহাড়ের সারি, জুমের হরিৎ ফসল আর ঝড়ো হাওয়া। একবার দাঁড়ালে মনে হয় সারা পৃথিবী বুঝি পদানত।
কেউ ছবি তোলে না, কেউ কথা বলে না। দুচোখ ভরে শুধু পাহাড়ের, ফসলের, অভাবের, কিছু না থাকার, শহর থেকে দূরে থাকার আর এতগুলো অপরিচিত মানুষের একরকম ভাবার, একটা বন্ধন তৈরি হতে থাকে অজান্তে। এই বন্ধন বাকি দিনগুলো একসাথে রাখবে সবাইকে। লালক্রস মৌনতা ভেঙ্গে সবাইকে নিয়ে এগুতে শুরু করে।
চতুর্থ পাহাড়ের আধাআধি এসে পাইখং পাড়ায় আরেকবার যাত্রা বিরতি করে সবাই। সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে তখন। চাপান করে সবাই জিরিয়ে নিতে নিতে ইতিউতি তাকায়। গত আট নয় ঘন্টায় একটা পাখিও চোখে পড়ে নি, একটা ফল গাছের দেখা মেলে নি, কোন বন্য প্রাণীও কেউ দেখে নি।
কেমন অভিশপ্ত মনে হয় সবকিছু। লালক্রস বোঝে কি বোঝে না, তবুও সবাইকে নিয়ে আবার বের হয়। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাস্তা এখনও পেরোনো বাকি। সেই বিখ্যাত "ডেথ জোন"।
নয়.
আনুমানিক সাড়ে আটটায় লালক্রস অভিযাত্রী দল নিয়ে ডেথ জোনের পাশে এসে বৃষ্টি ঘরে পৌঁছে। গত এক ঘন্টা ভয়াবহ বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে। শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে সবাই বসে পড়ে মাটিতে। ডেথ জোন পেরুলেই শেষ পাহাড়, বড়জোর দশ কিলোমিটার রাস্তা তখন বাকি। প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে লেগে গেছে দশ ঘন্টার মতো।
শরীরের শক্তি নিঃশেষ প্রায়। হাপরের মতো হাপাচ্ছে সবাই। তুমুল বৃষ্টিও শরীরের ঘাম ঝরানো বন্ধ করতে পারছে না। প্রায় এক ঘন্টা পর বৃষ্টির তোড় কমে এলে আবার সবাই প্রস্তুতি নেয় নামার।
গত দশ ঘন্টায় অভিযাত্রী দল আসলে খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠেছে। এবার বাকি পথ টুকু নেমে যাবার পালা। মনে মনে সাহস সঞ্চয় করে পথে নামে। বৃষ্টি ঘরে আরেকটা দল পেয়ে গেলে, গভীর নিকষ কালো অন্ধকারের মাঝে দিয়ে টর্চ হাতে একে একে তেত্রিশ জন নামতে থাকে হঠাৎ করে নিচে নেমে যাওয়া রাস্তায়।
পিচ ঢালা রাস্তা নয়, মেঠো পথ নয়, ইট বিছানো মনোরম কোন রাস্তা নয়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে পায়ের আগায় ভর দিয়ে নেমে যেতে হবে সব মিলিয়ে শ'দুয়েক ফিট। একপাশে গভীর খাদ, অন্যপাশে শ্যাওলা পড়া পিচ্ছিল পাহাড়। হাত রাখার জায়গাটুকু নেই। আর ব্যাগগুলো সবার পিঠে যেন সারা পৃথিবীর ভার বহন করে।
এক পা এক পা করে দুইশ ফিট রাস্তা লালক্রস আর অভিযাত্রী দল পেরোয় পুরো দেড় ঘন্টা ধরে। কেউ কারো দিকে তাকায় না, শুধু শোনা যায়, "টর্চের আলো এদিকে হবে, ভাই আমাকে একটু ধরেন, ইত্যাকার নানান শব্দ"। আতঙ্ক গ্রাস করে সবাইকে। লালক্রস বৃষ্টির মাঝেও বন বিবির পূজো করতে থাকে।
কেউ জানে না কখন, মনে হয় অনন্তকাল ধরে সবাই নামতে থাকে আর তারপর একসময় শেষ হয় অভিযাত্রী দলের দুঃস্বপ্ন। এরকম কূল ভাসানো বৃষ্টিতেও দরদর করে ঘামে সবাই। জীবনের সমস্ত সুখের তুলনায় এই পথ বেয়ে নেমে আসার সুখ তুলনা করে না কেউ। বেঁচে থাকার আনন্দই সবার মাঝে অনুপ্রেরণা জোগায় বাকি পথটুকু চলার।
রাত যখন সাড়ে এগারো তখন লালক্রস আর্মি ক্যাম্পে এসে হাফ ছাড়ে। রনি পাড়া আর্মি ক্যাম্পে গাদাগাদি করে বসে সবাই হাত পা এলিয়ে দেয়। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়ে, কাজ সেরে আরো চার কিলোমিটার হেঁটে রাত পৌনে বারোটায় লালক্রসের ঘরে এসে পৌঁছে।
ফেলে আসা দুঃসহ স্মৃতির রেশ তখনও সবার মগজে, মননে, শরীরে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বেঁচে থাকার অনুভূতি প্রকাশ করে সবাই।
কোনমতে গোসল সেরে ঘরে গিয়ে বসে অভিযাত্রী দল। মোস্তফা, বড় মামুন, ছোট রনি, মাহফুজ আর অন্যেরাও হাত মিলিয়ে রান্না শুরু করে। রাত দুটো নাগাদ কোনমতে শতরঞ্চ বিছিয়ে শরীর ছেড়ে দেয় সবাই। লালক্রস বাঙ্গালি অভিযাত্রী দলকে একা রেখে তার বাবার ঘরে চলে যায়।
আগামিকাল সকালে বেঁচে থাকলে সবাই দেখতে যাবে "লাং লাই দা, তি দং খত" সাইতার।
দশ.
ষোল তারিখ সেপ্টেম্বর, দুহাজার ষোল খৃষ্টাব্দ। ভোর ছয়টায় অভিযাত্রী দল আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে পড়ে। প্রাতরাশ সেরে, গতকালের ক্লান্তিকর ভ্রমণের কথা উড়িয়ে দিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ে কাছাকাছি দুই পাহড় দূরের একটা ঝর্ণা দেখতে।
তি দং খত, অসাধারণ এক ঝর্ণা দেখার প্রত্যয়ে, ফোস্কা পড়া পায়ে, মচকে যাওয়া আঙ্গুলের অভিযাত্রীদের নিয়ে লালক্রস বেরিয়ে পড়ে। রনি পাড়া থেকে পাহাড়ি প্রাণীদের পায়ের ছাপ ধরে ধরে এক সময় সবাই পৌঁছায় ঝর্ণার কাছে।
আশেপাশে সাতটা ঝর্ণা যেন গাল ফুলিয়ে থাকে। অসাধারণ সব ঝর্ণাগুলো ছাড়িয়ে অভিযাত্রীরা অবলোকন করে অপ্রতিরোধ্য এক জলের ধারার। এ সৌন্দর্য ছবিতে তোলা যায় না, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।
তীব্র স্রোত, স্বচ্ছ জল আর ফেনা তোলা জলের ধারায় অভিযাত্রী দল জীবনের হিসেব নিকেশ শেষ করে। প্রকৃতির এতো রুক্ষতার মাঝেও এ জলের ধারা যেন শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয় যেন।
ঘন্টাদুয়েক থেকে অভিযাত্রী দল বিকেল নাগাদ ফিরে আসে রনি পাড়ায়, লালক্রসের ঘরে। কাল সবচেয়ে বড় ঝর্ণা দেখতে যাবে সবাই। আবার ভয়াবহ পাঁচটা পাহাড়, বুনো গয়াল আর নড়বড়ে পাথরের উপর দিয়ে হাঁটতে হবে আনুমানিক চারঘন্টা।
কিছুটা শক্তি ফিরে পায় যেন সবাই। মাহফুজ কফি বানিয়ে পরিবেশন করে সবাইকে। নজরুল, আরাফাত, ইমেল আর হাসান - সবাইকে অবাক করে দিয়ে হাসিমুখে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়।
রাতে চাঁদ ওঠে মেঘের ফাঁক দিয়ে। নিপুদা আর রনিদা গান ধরে, সবাই সুর মেলায়। গানে গানে কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। সবাই সুরের মোহনায় বিমোহিত হয়ে মগ্ন হয় কোন সুদূর পরাহত স্বপ্নের। স্বপ্ন মাখা চোখে ভেসে ওঠে পিয়ার ছবি আর সবাই চাঁদের দিকে তাকিয়ে শোনে,
"ও চাঁদ, সুন্দর রুপ তোমার
তারচেয়ে রুপে রাঙ্গা পিয়া আমার"।
এগারো.
সতেরো সেপ্টেম্বর দুহাজার ষোল'র ভোরবেলা। আজ সবচেয়ে বড় পরীক্ষা। শরীর টেনে ধরে আছে, মস্তিষ্ক সাড়া দিচ্ছে না কারুর। ব্যথাতুর সবার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। হাতমুখ ধুয়ে পা টেনে টেনে সবাই ছুটার অভিনয় করছে। লালক্রস আজ যাবে না অভিযাত্রী দলের সাথে। জুমের ফসল কাটতে হবে। সিয়ান বম আর লালটান বম নামে দুজন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে দলকে।
পুরো যাত্রায় অস্বাভাবিক রকমের শ্লথ থাকা হাসান'দা আজো সবার আগে নেমে বসে আছে পথে। চোখে তার স্বপ্ন, দেশের সবচেয়ে বড় ঝর্ণায় যাবে আজ। সারাজীবন হয়তো বলার মতো এ কথাগুলোই থাকবে। আর মনে থাকবে হয়তো অল্প সময়ের জন্যে হলেও এতোগুলো মানুষের ভালোবাসা, বন্ধন আর সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করার সময়টুকু।
একে একে অভিযাত্রী দল নেমে পড়ে পথে। একজন গাইড সিয়ান বম সামনে আর আরেকজন লালটান বম পেছনে থেকে যাত্রা শুরু করে। যে পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে অভিযাত্রী দল, আজ তারচেয়েও বড় পরীক্ষা। নুড়ি বিছানো পিচ্ছিল রাস্তা। আড়াইহাজার ফিট উপরে উঠতে হবে, সিপ্পির পাশে গিয়ে আজ দাঁড়াবে অভিযাত্রীরা।
পথে পড়বে দেবছড়া গ্রাম, তারপর বুনো গরু গয়ালদের চারণভূমি আর টাইগার জোঁকেদের রাজত্ব। পথে অবশ্য ঝিরি পড়বে অনেক।
দু'দিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে সবাই বিধ্বস্ত, তবুও দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা সুন্দরের জন্যে। গল্পে গল্পে এগুতে থাকে সবাই। দেবছড়া পেরিয়ে ঘন্টাখানেক হেঁটে প্রথম পাহাড়ের শেষে ঝিরিতে বসে সবাই খানিক জিরিয়ে নেয়।
তারপর আবার ঘন্টাখানেক এক নাগাড়ে হাঁটে সবাই। রনি পাড়া থেকে বেরুতেই পাখির ডাক শুনতে পায় সবাই, দেখা মেলে বুনো গয়াল আর সাপের। এদিকের পাহাড় আরো খাড়া কিন্তু বেশ বাতাস আছে। আজকের পাহাড়েরা যেন অভিযাত্রী দল আসবে জানে। সেজেছে সবাই দারুণ করে। মেঘেরা বাসা বেঁধেছে মাথার ওপর।
ধীরে ধীরে পাহাড় টপকে, উঁচুতে উঠে যেতে থাকে সবাই। আরো উঁচুতে, আকাশ ছুতে চায় যেন পাহাড়েরা। আর অভিযাত্রী দল মনের কোন গহীনে জমা করে রাখে এই পথচলার দৃশ্য। একটা দুটো তারপর অনেকগুলো বিশালদেহী বুনো গয়াল দৃষ্টির সামনে এসে ধরা দেয়। এক বছরের একটা গয়াল অভিযাত্রীদের পিছু পিছু আসে অনেক দূর।
বীরেরাই জয়মাল্য পায় আর তা পেতে গেলে একনিষ্ঠ পরিশ্রমের বিকল্প থাকে না। এক সময় তৃতীয় পাহাড়ের পাদে এসে আবার জিরিয়ে নেয় সবাই। আর একটা পাহাড়, তারপর স্বপ্নের, "তিনাপ সাইতার"।
বারো ও শেষ পর্ব.
পরবর্তী পাহাড় খুব সহজেই ডিঙ্গিয়ে যায় সবাই। আর ঝিরিপথে ধরে বাকি পথ হাঁটতে থাকে সবাই। ফাঁকেফাঁকে উঁচু নিচু জায়গা, বড় বড় বোল্ডার, তীব্র স্রোত আর ঠান্ডা হাওয়ায় সবাই উল্লসিত হয়, এসে গেছে স্বপ্নের সেই, "তিনাপ সাইতার"।
আরো আধা ঘন্টা লেগে যায় ঝিরিপথে। ধীরে ধীরে ঝিরিপথ চওড়া হতে থাকে। বাতাসের ঝাপটায় চনমন হয়ে ওঠে সবার শরীর মন। জড়তা ঠেলে দ্রুত পায়ে এগুতে থাকে অভিযাত্রী দল। সহস্র গ্যালন জলের একসাথে আছড়ে পড়ার শব্দের তীব্রতায় অভিযাত্রী দলের কথা বোঝা যায় না।
তারপর এক সময় সূর্য মাথার উপর এসে দাঁড়ায়। অভিযাত্রী দল হাঁটু গেড়ে বসে দেখে নেয় বিশাল জলধারার সফেদ ফেনায়িত নিম্নগামিতা। বিস্ময়কর দৃশ্যের সম্মুখিন হতে হতে বুক কাঁপে সবার। সমস্ত দুঃখ, জরাজীর্ণতা, হা হুতাশ নিমিষে মিলিয়ে যায়।
আশেপাশে প্রায় দু'তিনশ মিটার জায়গা নিয়ে তলদেশ আর ভেতরে পঁচিশ তিরিশ ফিট গভীর এক খোড়লে গিয়ে অপার চোখে তাকিয়ে দেখে সবাই প্রকৃতির অসামান্য অবর্ননীয় সেই সুন্দরকে, হয়তো কারো কারো জীবনবোধ পালটে দেয় এই সাইতার। হয়তো অবলাকে দিয়ে কথা বলায় এই তিনাপ সাইতার।
সবাই একটা বড় বোল্ডারে ওঠে বসে থাকে। চোখ বন্ধ করে শোনে যেন পাহাড়ের ভাষা। শীতল হাওয়া, জলের ফোটার ঘর্ষণে সৃষ্টি হওয়া জলকনারা গায়ে মেখে আপন করে নেয় সবাইকে।
থাকুক তিনাপ সাইতার যেখানে আছে সেখানেই, নাই বা হোক জনবহুল, তবুও যারা একবার হলেও আসবে কখনও ওরা পেয়ে যাবে বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র, সাম্যের ধারণা, পিছিয়ে পড়া বন্ধুকে টেনে তোলা, ভাঙ্গা হাত নিয়ে ছুটে চলা, হাতে হাত ধরে পথ চলা। এসবই তিনাপ সাইতারের শিক্ষা। ভালো থাকুক পাহাড়, ভালো থাকুক প্রকৃতি, ভালো থাকুক মানুষ।
১৮ ই জুলাই, ২০১৭ দুপুর ১২:০০
Jaliskhan বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ।
ঘুরতে পারাটা আমার কাছে প্রয়োজনীয় বিষয় মনে হয়, তাই সুযোগ পেলেই এদিকে সেদিকে যাওয়া হয়। আপনি গিয়েছেন শুনে ভাল লাগল। তবে তিনাপ সাইতার যাবার আরেকটা বিকল্প রাস্তা আছে, তাতে এত কষ্ট নেই।
আমি অন্যের লেখা পড়তেই পছন্দ করি। তবে যতটুকু লিখি, নিজের মত করেই। আপনার ভাল লেগেছে জেনে আমারও আনন্দ লাগছে।
ভাল থাকবেন।
©somewhere in net ltd.
১|
১৭ ই জুলাই, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৩৬
রাখালছেলে বলেছেন: আহা ! আপনার লেখার ধরন এত্ত এত্ত সুন্দর । এই প্রথম একটা লেখার মধ্যে পাহাড়ের মানুষের দু:খ কষ্টের ঝাপ পেলাম । কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না । আমিও এইমাসের ১১ তারিখে তিনাপ সাইতার আর ১২ তারিখে সিপ্পি গিয়েছিলাম । আপনার লেখা পড়ে অনেক কিছুই জানতে পারলাম।
আপনি লেখা চালিয়ে যান। লেখার ধরন আর গঠন সুন্দর । প্লিজ আরও লিখুন ।