![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পার্কের বেঞ্চিতে তখনও কোন রোদের আলো পড়ে নি, বসে নি কোন উদ্ভিন্ন যৌবনা, দেহকলা সেরে হাঁপিয়ে ওঠে নি কোন প্রৌঢ় মানুষ। পাখিদের মল এখনও নোংরা করে নি বেঞ্চিখানা। শুধু গতরাতের সঙ্গমের চিহ্নগুলো ভাগে ভাগে নিমজ্জিত, কুয়াশার আস্তরে ঢেকে থাকা শিরিশ গাছের পাতায় পাতায় ঝরে পড়া শিশির বিন্দু দিয়ে।
জট লেগে থাকা শিশির বিন্দু, নিমজ্জিত গতরাতের মূল্যবান পঙ্কিল ফোঁটা, কন্ট্রাসেপ্টিভের তেলেমাখানো প্যাকেট, অগুনতি বাদামের খোসা আর ফেলে যাওয়া লবণের মিশ্রিত ক্বাথ ছোট দুটো হাত দিয়ে ঝেড়ে ফেলে মবিন। ঘেন্নার বোধের চেয়েও জরুরী এখন কোথাও গা হেলান দিয়ে বসে পড়া। এরপর হয়তো সে ভাববে আবার, হয়তো ক্লান্ত চোখে ঘুমে ঢলেও পড়তে পারে সে।
ভাবনাদের এই আসা যাওয়ার মাঝেই এক ফোঁটা বাসি শিশির বিন্দু আরো ক'ফোঁটার রেখে যাওয়া উত্তরসূরিদের সাথে করে টুপ করে ঝরে পড়ে মবিনের মাথায়। নিতান্তই সূক্ষ্ম একটা শিরশিরে অনুভূতির দোলায় মবিনের না খেয়ে থাকা পেটে শীতল দোলন লাগে। ক্ষুধা পেটে জরুরী ভাবনাগুলো মনে পড়ে তার, মোচড় দেয়া পেটে ন্যায় অন্যায়ের বোধ নিয়ে অল্প সময়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছায় মবিন, আজ বাড়ি ফিরবে না।
পৃথিবীকে আলো করে দেয়া সূর্যর রশ্মি, মোদিত মবিনের চোখে বাস্তবের উন্মেষ ঘটিয়ে জানিয়ে দেয় সারাদিন আজ নতুন অভিজ্ঞতায় কাটবে। মনে মনে প্রস্তুতি নিতে নিতে মবিনের পাশে এক অভিজ্ঞ এসে বসেন। অভিজ্ঞতার সারা শরীরে ফোঁটা ফোঁটা শিশিরবিন্দু জমে থাকে, কয়েকটা টুপ করে গড়িয়েও পড়ে। চোখের দৃষ্টিতে তার তিরষ্কার মবিনকে কুণ্ঠিত করে। অভিজ্ঞ মানুষটি ডান পকেট থেকে গোলাপি টিস্যু বের করে বেঞ্চিতে ছুঁইয়ে জলের ধারা তৈরি করে, কিন্তু ততক্ষণে মবিন কাগজের মন্ডের ব্যুৎপত্তির দিব্যজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করে নিয়েছে।
অভিজ্ঞ মানুষটি সেই নোংরামিতেই ট্রাউজার নিয়ে বসে পড়ে, পরিহিত চশমা খুলে রাখে এবং পা দুটো টানটান করে ছড়িয়ে দেয় সম্মুখে। মবিন এবং অভিজ্ঞ মানুষটি সহজ কিছু বোঝাপড়া করে নেয় মনে মনে। দুজনেই কেউ কাউকে না ঘাঁটিয়ে চোখ বোঝে। খানিকবাদে অভিজ্ঞতার দায় থেকে মানুষটি মবিনকে জিজ্ঞেস করে, কেন এখানে সে বসে আছে। মবিন ভাবে ঠিকই কিন্তু জানতো বলেই শিরিশ গাছে বাবুই পাখির বাসার গল্প করে, তার গৃহপালিত কবুতরের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার কথা বলে আর তাদের খুঁজে পেতে হয়রাণ হতে হতে অবশেষে বেঞ্চিতে আশ্রিত হবার সিদ্ধান্ত করে।
অভিজ্ঞ মানুষটি স্থিরচিত্তে গল্পটুকু শুনে, শারীরিক ক্লান্তিতে গল্পের অসংলগ্নতা ভুলে আবার চোখ বোঝে। মবিন রোদের তেজ, পেটের ক্ষুধা আর সিদ্ধান্তের অনিবার্যতা আবারো বিচার করে বেঞ্চিতে হেলান দিয়ে বসে।
সকাল যখন আর সকাল থাকে না, কোমলতা হারিয়ে যখন সে যুবতী হয়ে ওঠে, পরিবেশ কেমন যেন মুখরা হয়ে আসে। অনতিদূরে রাস্তায় তখন মানবেতর যাপিত জীবনের ছুটে চলা মানুষের আহাজারি চিৎকারে পরিণত হয়। হর্ণের ঝগড়াটে শব্দ, উৎকট ময়লার গন্ধ আর প্রাণীজগৎ এর চলাফেরায় মবিন দিশেহারা বোধ করে। স্কুলের বাচ্চাদের আসা যাওয়ায় মবিনের তাড়না বোধ হলেও, সে বেশি কিছু ভাবে না, কারণ ভাবনা তখনই আসে যখন পেটপূজা সাঙ্গ হয় মানুষের, যখন মানুষ একের অধিক ভালোবাসা লালন করে বুকে।
অভিজ্ঞ মানুষটি অভ্যাসের বদৌলতে চোখ মেলে, খুকখুক করে কাঁশে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজে। ট্রাউজারের পকেট থেকে খুচরো কিছু টাকা বের করে মবিনের দিকে তাকিয়ে নিরীক্ষণ করে আবার ভাঁজ করে রেখে দেয়। মবিন বোঝে অভিজ্ঞতার হয়তো দাম আছে, নাহলে এই মানুষটি আর মবিন নিজে একই রকম হতো। মবিন স্বতপ্রণোদিত হয়ে জিজ্ঞেস করে অভিজ্ঞতার কিছু প্রয়োজন আছে কি না। অভিজ্ঞতার মূলত কিছুর প্রয়োজন হবার কথা না, কিন্তু তারপরেও অভিজ্ঞতা অবিশ্বাস করে, মবিন টের পায়।
আরো কিছু সময় বাদে শিরিশ গাছের গোড়ায় বাঁধিয়ে রাখা চত্তরে এসে বসে অল্প অভিজ্ঞ দু'জন মানুষ। একজন নারী একজন নর, মবিনের বইয়ে পড়া কথা মনে পড়ে। আরো ভাবে নারীটি একদিন মা হবে, নর হবে বাবা। মবিন চোখের পাতা 'না খোলা না বন্ধ' রেখে নরনারীর রুপ রহস্যে অনুসন্ধিৎসু মন রাখে।
শিরিশ গাছ ঘিরে থাকা বাঁধাই করা চক্রাকার ইট সিমেন্টের গোলকধাঁধায় এবার এসে আসন গাড়ে বাদামওয়ালা, আইস্ক্রিম বিক্রেতা আর বিস্মৃতির তলায় তলিয়ে যাওয়া রং বেরংয়ের কাপড়ের টুকরো পরা চানাচুরওয়ালা। এরা সবাই কাছাকাছি সময়ে আসে, স্কুলের ডিউটি শেষ করে। নর ও নারী আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে চেপে বসে। রোদের প্রখরতায় আহা উহু করতে করতে মবিন আর অভিজ্ঞ লোকটিও গাছতলায় এসে বসে।
স্পষ্টতই মবিন বা সেই অভিজ্ঞ লোক, কেউ এভাবে বসতে হবে জানতো না, কারণ বেঞ্চের সিমেন্টের প্রলেপ পশ্চাৎভাগ তাতিয়ে দিয়েছে আর পিপাসার্ত মানুষের কাছে অধিকারবোধ বলে কিছু থাকে না। নর একশ গ্রাম বাদাম কিনে, নারীকে খোসা ছাড়িয়ে দেয়। খোসা ছাড়িয়ে দেয়ার মাঝে দৈনন্দিন জীবনের কি একটা সত্যও তারা অনুভব করে। বাদামের সাদা অংশটা পাতলা চামড়ার আস্তরণ পেরিয়ে উঁকি দিতেই নর অদ্ভূত হাসি হাসে।
মবিনের মুখে লালা জমে, একে তো ক্ষুধা তার উপর দুই নরনারীর খুনসুটি তাকে অন্য ক্ষুধার অস্তিত্বের কথা জানান দেয়। চানাচুরওয়ালা একটা লেমন কাঠি আইসক্রিম কিনে চুষতে থাকে। আইস্ক্রিমওয়ালা ঝাল ঝাল করে লেবু দেয়া চানাচুর ভাজা চিবোতে থাকে। এদের মাঝে অভিজ্ঞ লোকটি তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে সীমারেখা বের করে দেখে নিয়ে আবার পকেট হাতড়ে খুচরো টাকা বের করে একশ গ্রাম বাদাম কেনে।
মবিন খোসা ছাড়ানো বাদাম আর সেদিন বাথরুমে নিলুর কাপড় ছাড়া পায়ের কথা তুলনা করতে করতে অজান্তে জিহ্বায় ঘন লালার অস্তিত্ব অনুভব করে। চানাচুরওয়ালার আইসক্রিম চোষার সাথে বাস্তবিক সে কিছুর মিল পায় না, কিন্তু এই তপ্ত সময়ে কিছু চুষতে না পারাটা বেদনাদায়ক মনে হয় মবিনের কাছে। অভিজ্ঞ লোকটি কিছুক্ষণ খোসা ছাড়ানো বাদাম খায়, সন্তুষ্ট কিংবা প্রয়োজন ফুরালে কিংবা অতিরিক্ত অভিজ্ঞতায় বাকি বাদামগুলো মবিনের দিকে ঠেলে দিয়ে লোভাতুর চোখে আইস্ক্রিম চোষা দেখে।
চোষাচুষির এমন পর্যায়ে সুঠামদেহী, সাজগোজ করা কজন মানুষ এসে শিরিশ গাছের পাশের বেঞ্চিতে এসে বসে। চানাচুরওয়ালা ঢক করে আইস্ক্রিমের বাকি অংশটুকু মুখে পুরে দিয়ে চানাচুর, পেয়াজ আর মরিচ নিয়ে নাড়াচাড়া করে। মবিনদের পরিত্যাক্ত বেঞ্চে বসা সেইসব মানুষেরা হঠাৎ অট্টহাস্যে ভেঙ্গে পড়ে, জগতের সব নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে, ভাষার ব্যাকরণ ভেঙ্গে নরনারীর দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, "রাইতে বাইত যাও নাই, কনডমের প্যাকেট একটা ক্যান" বলে একজন আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়ে।
মবিন ও তার কান দুপুরের তপ্ততার চেয়েও উত্তপ্ত হয়। নতুন অভিজ্ঞতার রসে সে সিক্ত হয়, নরনারী আরো গভীরে সেঁধিয়ে যেতে থাকে, আশপাশ আরো আলোকিত হতে হতে মধ্যগগনে সূর্যর উপস্থিতি আরেকবার সবাইকে পিপাসার্ত করে।
বেঞ্চিতে বসা মানুষগুলো এবার উঠে এসে শিরিশ গাছের নিচে বসে, অভিজ্ঞ মানুষটির চারপাশে ঘিরে থাকে আর মবিনকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে, "পোলা লইয়া পার্কে মজা লইতে আইছো নাগর"। অভিজ্ঞ লোকটি অস্বস্তি বোধ করে, গলা খাঁকারি দিয়ে এমন এক ব্যাখ্যা দেয় যা তার নিজেরই অবিশ্বাস্য মনে হয়, কিন্তু পরিস্থিতির মোড় ঘুরে।
আশেপাশের সবাই নিশ্চিত হয় মবিন আর অভিজ্ঞ লোকটি পূর্ব পরিচিত নয়, বাসায় ছেলে ছেলের বউ বেড়াতে গেছে, বিকেলে আসবে। সকাল বেলা হাঁটতে বেরিয়ে চাবি হারিয়ে ফেলেছে, পার্কে বসে সময় কাটাচ্ছে। মবিন বুঝতে পারে এবার তাকেও নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে হবে আর সে নরনারীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উঠানামা, ডানে বামে মোচড় এসব ব্যাপারগুলোর পর্যবেক্ষণ হারাতে হবে বলে আফসোস করে।
নিলু আজ সকালবেলা গোসল করছিলো যখন মবিন আড়ালে লুকিয়ে দেখছিলো। বিদ্যুৎ না থাকায় খানিকটা ফাঁক করা দরজায় নিজেকে গলিয়ে কখন খোসা ছাড়ানো বাদামের মতো পা দুখানায় হাত চলে গেছে টেরও পায় নি, মবিন। মা না দেখলে কি হতো সে জানে না, তবে বাসা থেকে বের করে দেয়ার পর - কি অন্যায় সে করেছিলো এই মুহুর্তে সেটাই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে তার কাছে।
বেঞ্চির সেই মানুষগুলোর মাঝে একজন আসে, অদ্ভূত করে পরা শাড়ি, লোমশ বুকে হাত দিয়ে মবিনের চোখে তাকায়। মবিনের বুকের ধঢ়াস ধঢ়াস শব্দ বোধকরি সবাই টের পায়। আদতে কেউ টের পায় না, মানুষের ন্যায় অন্যায়ের বোধ কিভাবে জন্ম নেয় তা জানা হয় না কারুর। কিন্তু সেই লোমশ বুক, সুরমা দেয়া চোখ, আর গাঢ় লাল লিপস্টিকের সেই 'না নর না নারী'র ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে মবিন কেঁদে ফেলে।
নরনারী শারীরিক সঙ্গমের তীব্র কিন্তু ছোট অংশটা রাতের জন্যে তুলে রেখে মবিনের পাশে এসে দাঁড়ায়। একে একে বাদামওয়ালা, চানাচুর বিক্রেতা, আইস্ক্রিমওয়ালা আর সেই অভিজ্ঞ মানুষটি যাদের কারুরই জীবনের উপর হাত নেই, যারা ভেবেছিলো এক হয়েছে আরেক - সবাই একত্রিত হয় মবিনকে ঘিরে।
মবিন ভসভস করা ঘামের সাথে সিগারেটের গন্ধে মাখা লোমশ বুকে আশ্রয় নিয়ে কেঁদে ফেলে। আকস্মিকভাবে সবাই সবার দিকে তাকায়, ফেলে আসা স্মৃতিরা ভেসে আসে, রোদের তাপ আরো প্রখর হয়, তবুও সেই শিরিশ গাছের নিচে পঙ্কিলতার পাঠ নেয়া মানুষগুলি কিশোর মবিনের অসহায় কান্নায় সমবেত হয়ে অপেক্ষা করে দুপুর গড়িয়ে যাবার। আর মবিন, এই এক টুকরো সমাজকে জড়িয়ে ধরে পথচলার পাথেয় খুঁজে নেয় শিরিশ গাছের ছায়ার নিচে।
©somewhere in net ltd.