নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

উৎসের খোঁজে।

Jaliskhan

মানুষ হইবার চাই

Jaliskhan › বিস্তারিত পোস্টঃ

অন্ধকার ইতিহাস

০৩ রা অক্টোবর, ২০১৬ দুপুর ২:৫২

ওমানের সোহার নগর থেকে বিশ মাইল দূরে আল আকর মোড়ে গাড়ি না ঘুরিয়ে আরো মিনিট বিশেক সোজা দক্ষিণে গেলে খাটমাত মালাহার যাওয়ার পথ। সুলতান কাবুস হাইওয়ে দিয়ে চার ঘন্টায় পাহাড়ি পথের দু'ধারে আসন গেড়ে বসা হাজার হাজার বছরের ইতিহাসকে, পাড়ি দিতে লেগে যাবে পঁয়ষট্টি মাইল রাস্তা। তারপর ধূ ধূ মরুভূমি। আরো মাইল তিনেক এগোলে মালাহা বর্ডার। যতদূর চোখ যায় কাঁটাতারের বেড়া।

ষাট চাকার একটা দানবীয় বালুভরা লরিতে করে এই পথ ধরে বিশজন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী এসে সংযুক্ত আরব আমিরাতের নিকটে, ওমানের খাটমাত মালাহা সীমান্তে থামে। সাধারনত ওমানিরাই এই সীমান্ত ব্যবহার করে দুবাইয়ে যেতে।

তারপর আবার একটানা পথ দুপাশে চিকচিক করে মরুভূমির শীতল বালু। দিগন্তরেখায় মরুভূমির চড়াই উৎরাই পেন্সিলে আঁকা রেখা মনে হয়। রেখার শেষ টানে ঝিকমিক করে উঠে পেশিবহুল কাঁটাতারের পুরো করে দেয়া বেড়া। রাতের মধ্যগগণে পূর্ন চন্দ্রালোকিত এই পাহাড় আর মরুভূমি এসে থেমে আছে এখানে। কাঁটাতারের বেড়ায় এসে আটকে গেছে জোৎস্নামাখা রাত।

স্থাপনার কাজে ব্যবহৃত ষাট চাকার লরির মাঝে আট ফিট ব্যাসের একটা লোহার পাইপে সাড়ে চার ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে এই বিশজন অবৈধ "মানুষ"। বেঁচে থাকার সুখকর স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময় নির্জীব হয়ে সেঁটে গেছে একে অন্যের শরীরে।

দড়ি দিয়ে বেঁধে একে একে নামানো হয় সবাইকে। সিদ্ধ হওয়া বিশটি শরীর এলিয়ে পড়ে পাথুরে জমিতে। সামনের তিন কিলোমিটার রাস্তা ভরাটের কাজ চলছে আর এই পথ ধরেই সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়িয়ে পাড়ি দিতে পারলেই দুবাই।

মিনিট পাঁচেক পর লরির সাথে থাকা এক ভারতীয়, ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে পাহাড়ের মাথায়। সবাইকে বুক মুখ গুঁজে পাহাড়ের সাথে মিশে যেতে বলে সে নিজেও শুয়ে পড়ে। একটা তীব্র আলোর বৃত্ত তাদেরকে না ছুঁয়েই চলে যায়। এই ফাঁকে সবাই নির্দেশ পায়, আলো সরে যাবার সাথে সাথেই লাফিয়ে পড়তে হবে নিচে। তারপর আবার অপেক্ষা করতে হবে পরের আলোর জন্যে। এমনি করে মোট তিনবারে পাড়ি দিতে হবে, কাঁটাতারের বেড়া আর তারপর আরাধ্য দুবাই প্রবেশের রাস্তা।

অন্ধকারে লাফিয়ে পড়ে সবাই, শক্ত পাথরে পড়ে পিছলে যায় কেউ কেউ। প্রায় তিরিশ ফিট উপর থেকে লাফিয়ে পড়েছিলো, ফিরে দেখে না কেউ। উজ্জ্বল আলো ঘনিয়ে আসতেই পাথরের সাথে ঘন কালো হয়ে মিশে যায় সবাই। তারপর আবার ছুট, সামনে কি যেন দেখা যায় - বাড়ির মতো।

একেকজনের বুক হাপরের মতো ওঠানামা করে। আর একটা বাঁধা পেরুতে পারলেই একটা স্বপ্নপূরণ হবে হয়তো, সেই সাথে আরেকটা দুঃস্বপ্ন তাড়া করবে আরো কত দিন কে জানে। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ওরা সবাই। তিনদিনের না খাওয়া শরীর আর মাথায় বিপদের খাড়া নিয়ে, এক পা এগুতেই যেন মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত দায়িত্ব ওদের কাঁধে।

মরে যাওয়া মুখ, প্রিয় বন্ধু, স্বজন আর পরিবার এবং অনাগত সন্তানের কথা ভেবে, আবার প্রস্তুতি নেয় ওরা শেষ বাঁধা পেরোবার। নানাভাষী মানুষ, নানাদেহী মানুষ একে অপরের দিকে তাকায় শেষবারের মতো। একশ গজ রাস্তা, একেবারেই সমতল পাথুরে জমিন, মাঝে একটা খাড়ি - লাফ দিয়ে পেরুতে হবে যা। এর মাঝে এক মুহুর্ত বিরতি মানে সাম্যবাদী বুলেটের ধাক্কায় কেঁপে কেঁপে উঠবে স্রষ্টার দেয়া জীবন।

আলোর বৃত্তটা আরেকবার ছেড়ে যেতেই লাফিয়ে দৌড় দেয় সবাই। অদূরে ল্যাম্পপোস্টের আলোর দিকে তাকিয়ে একেকজন উইসন বোল্ট হয়ে যায়। তিনদিনের না খাওয়া পেটে, ছেড়া জামা জুতো নিয়ে হাঁচড়ে পাঁচড়ে প্রায় সবাই পেরিয়ে যায় খাড়ি। আবার আলোর বৃত্ত ফিরে আসে, আবার সব ধূলোমাখা জমিনে বুক চেপে শুয়ে থাকে, হয়তো খুব সূক্ষ্ম ভাবে মনে পড়ে দেশের কথা, দেশের ধূলোবালিময় জীবনের কথা।

তিরিশ গজের মতো বাকি আছে তখনও। দুইশো দেরহামের বিনিময়ের এই সাময়িক মুক্তির অল্প বাকি থাকতেই তিনজন অপারগতা প্রকাশ করে বাকিটুকু পথ পাড়ি দেবার। সতেরোজন দ্বিধা নিয়ে ভাবে এক দন্ড, তারপর দে ছুট। খাড়ির পাশ থেকে তিনজন শুয়ে শুয়ে দেখে, ছোট ছোট আলোর টুকরো ধেয়ে আসছে মূল রাস্তায়। তারপর অপসৃয়মান আলোয় বাকি তিনজনের শেষ পরিচিত মানুষগুলোও বিদায় নেয়।

থেকে যাওয়া তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একে অপরের। জোরে নিশ্বাস নেয় সবাই। ফুসফুসে দম ভরে সটান ছোটে আরাধ্য মুক্তির উদ্দেশ্যে। প্রথম গুলিটা একেবারে কানে ঢুকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় পুরো ধড় এক বিশাল দেহী বেলুচির, দ্বিতীয় গুলির আগেই সাইরেন বেজে ওঠে। বাকি দুজন ততক্ষণে আর মাত্র পাঁচ গজ দূরের রাস্তার দিকে ছোটে। দূর থেকে একটা গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে ওরা।

একটা ট্যাক্সি ক্যাব থামে আর জিজ্ঞেস করে, "তুমলোগ জাল আদমি হ্যায়, কেয়া। গাড্ডি মে ব্যায়ঠো"। দরজা না লাগানো অবস্থাতেই চলতে শুরু করে গাড়ি। একজন বাঙ্গালি আর একজন ভারতীয় গাড়ির পেছনে কোনমতে বসে মাথা ছোয়ায় ক্লান্তিতে, শ্রান্তিতে আর বিপদ মুক্তির আশায়। একটা শব্দ হয়, ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙ্গে। ভারতীয় "মানুষ"টি এলিয়ে পড়ে পাশে বসা বাংলাদেশীর গায়ে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.