![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দিন দিন সম্পর্কটা কেমন খাপছাড়া ঠেকছিলো। সূর্য আগের মতোই উঠছিলো, দিনের শুরুটা আনন্দঘনই হচ্ছিলো, কিন্তু কোথাও যেন একটা ক্লান্তিও ভর করেছিলো। দিনের শুরুর, মাঝের আর বিকেলবেলায় ফোন দেয়ার পাশাপাশি সন্ধ্যায় এখানে ওখানে সময় কাটানো চলছিলো পাশাপশি। শীতের হিমেল হাওয়া আর জবরদস্ত পোষাকের উত্তাপ টের পাচ্ছিলাম কিন্তু মনের আর শরীরের উষ্ণতা যেন হারিয়ে গিয়েছিলো কোথাও। কবিতা কিংবা লিটল ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ আনন্দ দিচ্ছিলো না। টক শো কিংবা রাজনীতি অথবা সিরিয়া বা ইহুদী জঙ্গী আইএস এর কথাও বেমালুম ভুলে যাচ্ছিলাম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিলো, আমি খুব দ্রুতই একটা সংখ্যায় পরিণত হয়ে যাচ্ছিলাম। নামে আর কিছুই আসতে যেতো না। এমনকি যেসব স্বপ্ন, চাইলেও পূরণ করা যেতো মনে হচ্ছিলো থাক না সেসব। সব স্বপ্নই কি পূরণ করতে হবে না কি!
কফি শপে আমাদের সময় কাটছিলো আগের চাইতেও বেশি, কিন্তু নিশ্চুপ চিন্তামগ্নতায়। আমরা আসলে দেখছিলাম অনেক বেশি, শুনছিলাম কম, বলছিলাম একেবারেই কিছু না। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে বড় কফির মগের এদিক সেদিক খুঁটছিলাম, কিউব চিনির দলাগুলো নিয়ে হাতের মুঠোয় খেলছিলাম, যেমন জীবন খেলে আমাদের সাথে। জমাট বাঁধা চিনির টুকরোগুলো মনে করিয়ে দিলো ভালোলাগাগুলো জমাট বেঁধে পড়ে আছে ঘরের কোণে, দেয়ালে ফ্রেমে, আলমারির পরতের পর পরত কাপড়ে, সাজানো ড্রয়িং রুমে, আর গেলো বার কেনা পেইন্টিংগুলোতে।
আশেপাশে যারা বসে ছিলো তাদের দেখেই আমরা বুঝতে পারছিলাম কে কি ভাবছে। মনে মনে হাসিও পাচ্ছিলো, দুঃখও হচ্ছিলো আর কদিন পরে এই কলতান থেমে আসবে, নিশ্ছিদ্র একাকীত্ব নেমে আসবে দুটো জীবন জুড়ে, নাকি একজনরেই জীবনে। যদি এমন হয়, আরেকজনের বোঝার ক্ষমতাই না থাকে তবে কি হবে! তা হয় হোক! কার কি যায় আসে!
এভাবেই চলছিলো এবং চলতো যদি না আমাদের দু'জনের জীবনে আরো দুজন আসতো। গরীব মানুষের বেড়ার ফাঁক দিয়ে যেমন দিনের আলো আসে, মধ্যবিত্তের জীবনে যখন সন্তান আসে, ধনীর জীবনে যেমন সাফল্য আসে, তেমনি আমাদের জীবনে দুটি মানুষ আসায় আমাদের চিত্ত চঞ্চল হলো আর আমরা আমাদের এতোদিনকার যাপিত জীবনের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলতে থাকলাম, "কি জঘন্য জীবন কাটাচ্ছিলাম আমরা"। আর এ কথাগুলো প্রথম দিকে সদ্য জীবনে আসা মানুষটির সাথে আমরা বলতেও শুরু করলাম। খুব মনোযোগ দিয়ে তারা শুনছিলোও। আর এসবই ছিলো আসলে আবেগ দিয়ে কাউকে কাছে টানার কৌশল।
কৌশল রাজনৈতিক শব্দ হলেও প্রেম, ভালোবাসায়, সংসারে অহরহ ব্যবহার করা চলে। সুতরাং আমরা দু'জনেই এবার কৌশলী হলাম। আমাদের জীবনে দেখা নাটক বা সিনেমাগুলো আমরা আমাদের বাস্তবিক জীবনে মঞ্চস্থ করার চেষ্টা করলাম। মাঝে মাঝে আমাদের অভিনয় এতো দারুণ হতো যে আমরা দুজনেই অভিভূত হতাম। মনে মনে আমরা প্রশংসাও করতাম একে অপরের। গল্পের বইয়ে পড়া চরিত্রগুলো আমাদের কাছে ধরা দিলো এক সত্যিকার জীবন নিয়ে। আমরা দু'জনেই প্রতিদিন আশায় থাকতাম এক মানসিক বিষ্ফোরণের, এক দৈহিক সংঘর্ষের, এক একাডেমিক ডিবেটের।
এমন করেই হয়তো অনেকে শেষ দিনতক চালিয়ে যায়, কেউ বা পারে না ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়, কেউ বা আত্মহত্যা করে। আমাদের বেলায়ও অন্যথা হলো না। একদিন এই অভিনয়ের জীবন থেকে মুক্তি পেতে আমাদের মধ্যে একজন মরে গেলো। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। অফিসে থেকে ফেরার পথে লোকাল বাসের সাথে সংঘর্ষে পিষে গেলো একজন। সেসময় আমি বাসায়। শোনার পর আমার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। আমি সম্ভবত কেঁদে ফেলেছিলাম এবং সেটা সশব্দ কান্নাই ছিলো, তাতে আবেগ ছিলো, উদ্বেগ ছিলো, অসহায়তা ছিলো আরো ছিল অভ্যাস।
মনে হলো আর ছোঁয়া হবে না সে শরীর, নেয়া হবে না সিঁথির গন্ধ, আধো রাতে শারীরিক ভালোবাসার অবিরত অভ্যাসের যবনিকাপাত ঘটে গেলো। সপ্তাহান্তে খুব করে মনে পড়বে কোন সুপার মল থেকে বাজার করে ফেরার দৃশ্য কিংবা পার্কিং লটে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানা। স্মৃতিরা ঘুরঘুর করবে আইসক্রিমের শেষ অংশ গলে পড়ে যাবার মতো করে, এবং পড়েও যাবে আর ভুলেও যাবো হয়তো। কিন্তু এসবই খুব অল্প সময়ের জন্য। কারণ মানুষের সম্পর্ক মাকড়শার জালের মতো। নিজেকে আলাদা করা যায় না, আর জালের এক অংশ ছিঁড়লেও অন্য অংশ থেকে সহসা আলাদা হয় না। সুতরাং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ এ খবর শুনে দেখতে এলো আর আহাজারিতে মাতিয়ে দিলো - আহা! এমন দারুণ 'কাপল' খুবই কম দেখা যেতো। আমাদের সম্পর্কে মানুষের চুল চেরা বিশ্লেষণগুলো আমাকে দারুণ করে উজ্জীবিত করছিলো এবং আমার বেশ কয়েকবার মনেও হয়েছিলো, আমাদের দু'জনের সম্পর্কটা খুব একটা খারাপ ছিলো না।
কিন্তু এইসব ভাবনার ফাঁকেফাঁকে একটা ব্যাপার মাথায় উঁকি দিচ্ছিলো, এইবার বোধহয় অভিনয়ের জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া গেলো। আর বোধহয় হিসেব করে হাসিমুখে কথা বলতে হবে না। পছন্দ না হলেও বলতে হবে না, "অওসাম চয়েস"। রাত বিরেতে লং ড্রাইভে যাওয়া কিংবা কারো সারপ্রাইজ পার্টিতে যাওয়া লাগবে না।
সে ভাবনার ফাঁকে আমার বিষাদক্লান্ত অভিনীত চেহারা দেখে বারান্দায় কেউ আমাকে ধরাধরি করে বসালো। একা থাকতে চাই বলায় সবাই সেখানেই আমাকে রেখে ড্রয়িং রুমে বসে রইলো। সবাই চলে যাওয়ায় খুব আয়েশ করে সিগারেট ধরালাম। মনে কি যেন একটা প্রশান্তি ফিরে এলো। বারান্দার বসে বাইরের আকাশ দেখতে দেখতে মনে হলো আর আমাকে কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না কোন বিষয়ে, কাউকে শুধু খুশি করার জন্য হাসিমুখে কথা বলতে হবে না। বিরক্ত লাগলেও হাতে হাত ধরে হাঁটতে হবে না। এই অবারিত আকাশ বাতাস আর আলো আঁধারকে সঙ্গে নিয়ে আমি একাই পথ চলতে পারবো।
ঠিক কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না, ড্রয়িং রুমের শোরগোল আমার মনোযোগ ফিরিয়ে আনলো। কেউ একজন এসে আমাকে কিছু বলতে চাইলো। উত্তেজনার আধিক্যে তার মুখ দিয়ে কিছুই বেরুচ্ছিলো না। তাকে সাথে করে আমি ড্রয়িং রুমে আসলাম। তারপর আমার কাছে মনে হলো আমার বাঁ দিকের বুকে চিনচিন করে ব্যথা করছে। আমার দৃষ্টি বিষ্ফোরিত হচ্ছিলো আর আমার বিস্ময়াহত চেহারা দেখে সবাই ভাবছিলো আমি খুশি হয়েছি, অনেক অনেক খুশি হয়েছি। আসলে ঘটনা যা ঘটেছে তা হলো, যে দুর্ঘটনায় মরে গেছে সে আমার কেউ ছিলো না। ভুল তথ্য দেয়া হয়েছিলো। বাসায় সবাই যখন নানা বিষয়ে আমাদের নিয়ে স্মৃতিচারণ করছে, দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সমৃদ্ধ করছে, ঠিক সে সময়ে অফিস ফেরত আমার স্ত্রী হতবাক হয়ে সবাইকে দেখছে আর ভাবছে আমারই কিছু হয়েছিলো কি না।
ওকে দেখে আমার সমস্ত কল্পনার ফানুস উড়ে গেলো, আমি খুব ধীরে ধীরে হাটু গেড়ে বসে পড়লাম। কিছু কিছু শব্দ আমার কানে আসলো, ডাক্তার, এম্বুলেন্স আর গাড়ির হর্ণ। এও শুনলাম কেউ বলছে, "ভাবী, আপনার মৃত্যুর কথা শুনে উনি অনেক ভেঙ্গে পড়েছিলেন। আর এখন আপনাকে দেখে খুশিতে মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছেন। হাসপাতালে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। চলুন।"
কিন্তু আমি ভাবছিলাম, আমি যদি এই অস্পষ্ট আবছায়া থেকে ফিরে না আসি, তবে কি আমার স্ত্রীও বারান্দায় বসে আমাকে নিয়ে একই ভাবনা ভাববে যা আমি ভেবেছিলাম তার মৃত্যুর খবর শুনে। সেও কি অপেক্ষা করে মুক্তির।
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৫০
Jaliskhan বলেছেন: এ গল্পটা আসলে ১৮৯৪ সালে "Vague" ম্যাগাজিনে কেট চপিনের একটা ছোট গল্পের সমালোচনা হিসেবেই লেখা।
২| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:২৪
আমিই মিসির আলী বলেছেন: মানুষ বাঁচে কম, ভাবে বেশী।
এত ভাবনার জাল বুনে হয়টা কী! সাহিত্য? তাতে জীবনের ছোঁয়া কোথায়?
অনরগল দূরআশা ছাড়া কিছুই দেখলাম না।
তবে বর্ণন পদ্ধতি বেশ লেগেছে। চালিয়ে যান।
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:৫০
Jaliskhan বলেছেন: এ গল্পটা আসলে ১৮৯৪ সালে "Vague" ম্যাগাজিনে কেট চপিনের একটা ছোট গল্পের সমালোচনা হিসেবেই লেখা।
৩| ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:০২
শাহাদাৎ হোসাইন (সত্যের ছায়া) বলেছেন: ভাবনার জগত আর বাস্তব মাঝে মাঝে কিছুটা মিলে গেলেও ফারাক থাকে বিস্তর।
©somewhere in net ltd.
১|
২৭ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৫:০৮
চাঁদগাজী বলেছেন:
হতাশার জাল বুনছেন অকারণ