নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ঝর্ণা মনি

ঝর্ণা মনি › বিস্তারিত পোস্টঃ

রেণু থেকে বঙ্গমাতা

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:১২

‘কোনো কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারী/ প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে, বিজয়-লক্ষ্মী নারী।’
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অমর এই কবিতাখানি যার সঙ্গে হুবহু মিলে যায় তিনি আমাদের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের রেণু। বাঙালি জাতির যুগসন্ধিক্ষণের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবন মরণের সঙ্গী ছিলেন মহিয়সী এই নারী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক প্রেরণাদায়িনী মহীয়সী নারী। ১৯৩০ সালের ৮ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন রেণু। মাত্র তিন বছর বয়সে পিতা ও পাঁচ বছর বয়সে মাতা হারান। পিতার নাম শেখ জহুরুল হক এবং মাতার নাম হোসনে আরা বেগম। বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। দাদার চাচাতো ভাই শেখ লুৎফর রহমানের পুত্র শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ১৯৩৮ সালে রেণুর বিবাহ হয়। তখন থেকে রেণুর শাশুড়ি বঙ্গবন্ধুর মাতা সায়েরা খাতুন তাকে নিজের সন্তানদের মতো মাতৃস্নেহে লালন-পালন করেন।
ছাত্ররাজনীতি করতে গিয়ে যখনই বঙ্গবন্ধুর অতিরিক্ত অর্থের দরকার হতো তখনও পিতৃ সম্পত্তি থেকে অর্জিত অর্থ বিনা দ্বিধায় প্রেরণ করতেন বঙ্গমাতা। বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তেও সংসার ও রাজনীতির কর্মময় জীবনের বর্ণনায় বার বার স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নাম ওঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু বার বার কারারুদ্ধ হলে বেগম মুজিবকে গৃহ-সামগ্রী বিক্রয় করতে হয়েছে। তিনি অনেক অলংকার বিক্রয় করেছেন, কিন্তু বাদ্যযন্ত্র আর গানের রের্কডগুলো কখনও হাতছাড়া করেননি। বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পারিবারিকÑরাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা আড়াল থেকে সর্বান্তকরণে সহযোগিতা করেছেন।১৯৫৯ সালে ঢাকা জেল থেকে প্রিয়তমা স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসার কাছে লেখা শেখ মুজিবের একটি চিঠি যা সাক্ষ্য দেয় সংসারে টানাটানির ইতিবৃত্তকেই। বাবার কাছে পাঠানো (এবং না পৌছানো) চিঠির মাস কয়েক পর এটি লিখেছিলেন তিনি। চিঠিটি হুবহু তুলে দেয়া হলো_

ঢাকা জেল
১৬-৪-৫৯
রেনু,
আমার ভালোবাসা নিও। ঈদের পরে আমার সাথে দেখা করতে এসেছো ছেলেমেয়েদের নিয়ে আস নাই। কারণ তুমি ঈদ করো নাই। ছেলেমেয়েরাও করে নাই। খুবই অন্যায় করেছো। ছেলেমেয়েরা ঈদে একটু আনন্দ করতে চায়। কারণ সকলেই করে। তুমি বুঝতে পারো ওরা কতো দুঃখ পেয়েছে। আব্বা ও মা শুনলে খুবই রাগ করবেন। আগামী দেখার সময় ওদের সকলকে নিয়ে আসিও। কেন যে চিন্তা করো বুঝি না। আমার যে কবে মুক্তি হবে তার কোনো ঠিক নাই। তোমার একমাত্র কাজ হবে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখানো। টাকার দরকার হলে আব্বাকে লেখিও, কিছু কিছু মাসে মাসে দিতে পারবেন। হাছিনাকে মন দিয়ে পড়তে বলিও। কামালের স্বাস্থ্য মোটেই ভাল হচ্ছে না। ওকে নিয়ম মতো খেতে বলিও। জামাল যেন মন দিয়ে পড়ে আর ছবি আঁকে। এবার একটা ছবি একে যেন নিয়ে আসে আমি দেখব। রেহানা খুব দুষ্ট ওকে কিছুদিন পর স্কুলে দিয়ে দিও জামালের সাথে। যদি সময় পাও নিজেও একটু লেখাপড়া করিও। একাকী থাকাতে একটু কষ্ট প্রথম হতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে কোন চিন্তা নাই। বসে বসে বই পড়ি। তোমার শরীরের প্রতি যতœ নিও।
ইতি-
তোমার মুজিব (সূত্র : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ট্রাস্ট কর্তৃক প্রকাশিত জাতির জনক প্রকাশনা, পৃ: ২১০)
অবশ্য এর আগে ১৯৫৪ সালে বেগম মুজিব প্রথমবারের মত ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায় বসবাস করতে চলে আসেন এবং ওই এলাকার রজনী চৌধুরী লেনে বাসা নেন। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিব মন্ত্রী হলে বেগম মুজিব গেন্ডারিয়ার বাসা ছেড়ে ৩নং মিন্টো রোডের বাড়িতে উঠেন। পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিলে ১৪দিনের নোটিশে ৩নং মিন্টো রোডের বাসা ছাড়তে বাধ্য হন বেগম মুজিব। এ রকম অনেক বার তাঁর বাসা ছাড়তে হয় আবার বড় কষ্ট করে বাসা খুঁজে পেতে হয়েছে। অবশেষে ১৯৬১সালে ধানমন্ডির ৩২নং সড়কে বাড়ির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হল এবং ওই বছরের ০১ অক্টোবর বেগম মুজিব ৩২নং সড়কের বাড়িতে প্রবেশ করেন। বঙ্গবন্ধু জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময় কারান্তরালে কাটিয়েছেন বছরের পর বছর। তাঁর অবর্তমানে একজন সাধারণ গৃহবধূ হয়েও মামলা পরিচালনা, দলকে সংগঠিত করতে সহায়তা করা, আন্দোলন পরিচালনায় পরামর্শ দেয়াসহ প্রতিটি কাজে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগ্রামে নিজেকে জড়িত রেখেছেন বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। পাশাপাশি তিনি তার স্বামীর রাজনীতিতে সবরকম সহায়তা দিতেন। অন্যদিকে তার রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মীও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে তখন বাঙালি মুক্তির সনদ ছয় দফা কর্মসূচী ভিত্তিক লিফলেট বোরখা পরিহিত অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে বিতরণ করতে দেখা গেছে এই নিরব বিপ্লবী কর্মীকে। তিনি যেখানে লিফলেটগুলো রেখে আসতেন সেখান থেকে ছাত্রলীগ কর্মীরা সংগ্রহ করে বিলি করতো। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা। আগরতলা মামলা দায়ের করার পর তৎকালীন পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ বিষয়ে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জোরালো আপত্তি জানান এবং এক রকম প্রতিহত করেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে তিনি নেতাকর্মীদের সকল বিষয় অবহিত করেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু যেন শক্ত থাকেন সে বিষয়ে তিনি পরামর্শ দেন। বেগম ফজিলাতুন্নেছার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের ভিত্তিতে ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান বেগবান হয়। প্রবল গণ-অভ্যুত্থানের মুখে বাঙালির মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হলেন ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯। পরের দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা তাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দিয়ে বরণ করে নেয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো নয়টি মাস অসীম সাহস, দৃঢ় মনোবল ও ধৈর্য্য নিয়ে বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছেন। এমনকি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ও ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রধান উদ্দীপক ও পরামর্শক হিসেবে বিবেচনা করা যায় বেগম শেখ ফজিলাতুন্নেছকে। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের পর দিন ১৭ ডিসেম্বর তার ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বন্দিদশার অবসান ঘটে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু লন্ডনে যান। সেখান থেকে বেগম মুজিবের সঙ্গে তাঁর প্রথম কথা হয়। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। অবসান ঘটে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার দীর্ঘ প্রতীক্ষার। এরপর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজেও বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়ান তিনি। অনেক বীরাঙ্গনাকে বিয়ে দিয়ে সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন জীবনদান করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে জাতির পিতার হত্যাকারীদের হাতে বেগম মুজিব নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার মামলার বিভিন্ন নথিপত্র থেকে দেখা যায়, আনুমানিক সাড়ে ৫টার দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আক্রমণ শুরু হয়ে যায়। প্রথমে গেটে ঢুকতে গিয়েই গোলাগুলির সূত্রপাত হয়। তারপর তা প্রবল আকার ধারণ করে। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পুলিশ গার্ডরা অবিরাম গুলি চালিয়ে সেনাদের আক্রমণে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। আর্টিলারির শামছুল আলমের মাথায় গুলি লেগে সঙ্গে সঙ্গেই সে মারা যায়। আরো একজন আহত হয়। সঙ্গীদের ঢলে পড়তে দেখে আর বঙ্গবন্ধু ভবনের ভেতর থেকে প্রচন্ড প্রতিরোধের কারণে সৈন্যরা তাদের সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সৈন্যরা চারদিক থেকে মুজিবের বাড়ির ওপর গুলি বর্ষণ করতে থাকে। একটি বুলেট মুজিবের ছোটভাই নাসেরের হাতে লাগে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতের মত এবারো বাড়ির সকলে শেখ মুজিবের শোবার ঘরে আশ্রয় নেন। শেখ মুজিব কয়েকজন অফিসারকে ফোন করেন এবং বারান্দায় এসে পুলিশদের ফায়ার বন্ধ করতে বলেন। বেগম মুজিব শাড়ির এক অংশ ছিড়ে দেবর নাসেরের রক্তাক্ত হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। অন্যদিরেক, বঙ্গমাতা যিনি আজীবন পেছনে থেকে স্বামীকে উৎসাহ দিয়েছেন, বিজয়ী লক্ষ্মী নারী হিসেবে প্রেরণা দিয়েছেন প্রতিটি সংগ্রামে, যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আশ্রয়, মরণেও সহযাত্রী হয়েছেন স্বামী অন্ত:প্রাণ মহিয়সী বেগম মুজিব। থমকে যাওয়া সময়ে সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর গুলিবিদ্ধ প্রাণহীন দেহ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে ঘাতকদের মিনতি করে বলেন, ‘তোমরা আমাকে আর বাঁচিয়ে রেখো না, ওকে যখন শেষ করে দিয়েছ, আমাকেও এইখানেই শেষ করে দাও, আমি আর এক মুহুর্তও বাঁচতে চাই না। আমাকে মেরে ফেল।’ সীমাররা তাকে আবার মূল বেডরুমে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সেখানে ছিলেন আটকে রাখা হয়েছিল শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজি এবং শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা কামালকে। পিতৃহন্তারকরা সেই কালরাতে গুলি করে দরজার বোল্ট উড়িয়ে দিয়ে খুলে ফেলে প্রতিটা কক্ষের দরজা। এরপর এমনভাবে ব্রাশফায়ার করে ঝাঁঝরা করে দেয় যেন একজনও এর ভেতরে বেঁচে থাকতে না পারে।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পর পাল্টে যায় দেশের ইতিহাস। ২১ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বিকৃত ইতিহাসের আস্তাকুড় থেকে সঠিক ইতিহাস ফিরিয়ে আনার কাজে ব্রতী হন। ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর নামে পাশে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিচিত লাভ করেন বঙ্গমাতা নামে। ইতিহাসে গান্ধীপত্মী কস্তরী বাই, নেহরুপত্মী কমলা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের পত্মী বাসন্তী দেবী, ম্যান্ডেলাপত্মী উইনি যেমন বিখ্যাত হয়ে আছেন স্বামীর সহযোদ্ধা হিসেবে তেমনই বঙ্গমাতা বেগম শেখ ফজিলাতুননেছা মুজিব তার স্বামীর সহযোদ্ধা হিসেবে আজীবন বেঁচে থাকবেন বঙ্গমাতা নামে। বেঁচে থাকবেন বাংলার মানুষের মণি কোঠায়। অবনত মস্তকে শ্রদ্ধা জানাই বাংলা মায়ের দামাল সন্তান অসামান্য এই মানবীকে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.