![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিগত শতাব্দী বাদ দিলে সমগ্র মানব জাতির ইতিহাসে একটি গ্রহণযোগ্য সামাজিক আচার। বাল্য বিবাহের সুচনাকালের কোন সুনির্দিষ্ট ইতিহাস না থাকলেও ধরে নেয়া যেতে পারে ঘর বাঁধার বা সমাজবদ্ধ হওয়ার কালই হল এর সূচনাকাল। ইউরোপীয় পরিব্রাজকদের রচনা থেকে জানা যায় ষোড়শ শতকের অষ্টম দশকেও এর প্রচলন ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাল্যবিবাহ সম্বন্ধে স্ক্রাফটন বলেছিলেন, “এই উপমহাদেশের ছেলেমেয়েদের শিশুকালে বিয়ে দেয়া হতো। ১২ বছর বয়সে একজন রমনীর কোলে একটি সন্তান- এটা ছিলো সাধারণ দৃশ্য”। এই দৃশ্যের পুনরাবৃতি ঘটার মূল কারণ ছিল সামাজিক বিধি। সে সময় ৬-৭ বছরের পরে মেয়ে অবিবাহিত থাকা ছিল পরিবারের পক্ষে অসম্মানজনক ও নিন্দনীয়। সেই পরিবারের সাথে সামাজিক ও ধর্মীয় সম্পর্ক ছেদ করে একঘরে করে দেওয়া হত তাঁদের। এই নিন্দার হাত থেকে নিষ্কৃতির উপায় ছিল এই বিবাহ। এ তো গেল অষ্টাদশ শতাব্দীর কথা।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তীব্র সামাজিক আন্দোলন শুরু হয় রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নেতৃত্বে। আজ প্রায় এক শতাব্দীকাল অতিক্রান্ত। আজ মানুষ শিক্ষিত, রুচিশীল, উন্নত। শিক্ষার হার ক্রমবর্ধমান। তবু আজও শোনা যায় – ‘বাংলাদেশের একটি জেলা কুষ্টিয়ায় বাল্য বিবাহ দেওয়ার অভিযোগে একজন সাবেক স্কুল শিক্ষককে কারাদন্ড দিয়েছে একটি আদালত’, অথবা, ‘সৌদি আরবে ৮ বছর বয়সের এক শিশুকন্যার সঙ্গে ৪৭ বছর বয়সী এক লোকের বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। অসম এ বাল্য বিয়ের রায় দেন সৌদি আরবের এক বিচারক। রায়ে বিচারক শেখ হাবিব আবদুলস্নাহ আল হাবিব বরকে পরামর্শ দেন, শিশুকন্যার প্রতি মায়া-মহব্বত ও দয়া দেখাতে এবং কনের বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানোর আগে মেলামেশা থেকে বিরত থাকতে’। বাল্য বিবাহ শুধুমাত্র অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনই নয়, এই ফলে দেশ হয় অপুষ্টি ও দুর্বল ভবিষ্যত প্রজন্মের শিকার যা দেশের উন্নয়নের পক্ষে বিপরীতধর্মী। বাল্যবিবাহ বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন রকম আইন প্রনয়ণ হয়েছে বিভিন্ন সময়।
১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ আইন অনুসারে বাল্যবিবাহ মানে হল, নাবালক বয়সের ছেলে মেয়েদের বিবাহ। কিন্তু আইন বলবৎ হলেও নেই কোন যথাযথ প্রয়োগ। আইন অনুসারে তিন ধরনের বিবাহ আইনত দন্ডনীয় – ‘এক, প্রাপ্ত বয়স্কের সঙ্গে অপ্রাপ্ত বয়স্কের বিবাহ; দুই, অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ের বিয়ে; তিন, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পাত্র-পাত্রীর অভিবাবক কর্তৃক বিবাহ নির্ধারণ বা বিয়েতে সম্মতি দান’। আইন থাকলেও তার বিশেষ কোন প্রয়োগ দেখা যায় না, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এখনো এই প্রথা একইভাবে চলছে। তাছাড়া, আইন অমান্যের ক্ষেত্রে শাস্তি মাত্র একমাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং/অথবা এক হাজার টাকা জরিমানা। তাই, এই আইনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করা সম্ভব হয় না এবং তার ফলে এই প্রথা আইনত বন্ধ করাও সম্ভব হয় নি। তাই, উচিত উপযুক্ত আইন প্রনয়ণ ও তার সফল প্রয়োগ। গ্রামাঞ্চলে বাল্য বিবাহের হার বেশি হওয়ার কারন হিসাবে বর্তমানে দারিদ্রতা ও অশিক্ষার কথাই বলা হয়।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, মৌলিক চাহিদাগুলি যেখানে পরিপূর্ণ হয় না, সেক্ষেত্রে আইনের দ্বারা এই প্রথা বন্ধ করা অসম্ভব। দারিদ্রের কারণেই মুলত দরিদ্র পিতা মাতা শিশুকন্যাটির নিশ্চিত ভরণ পোষনের দায়িত্ব অন্যস্থানে দিয়ে দায়মুক্ত হতে চান। এছাড়া আছে অশিক্ষার অন্ধকার। যে সকল গ্রাম অশিক্ষার অন্ধকারে জর্জরিত, সেখানে এই প্রথা ভয়াবহ রূপ নেয়। বাল্যবিবাহের ফলশ্রুতি হল অল্প বয়সে সন্তান ধারণ যা সবথেকে বেশি ঘটে থাকে এশিয়ার দেশগুলিতে। বাল্যবিবাহের শিকার হয় নারীসমাজ, ভবিষ্যত প্রজন্ম এবং পরিশেষে সমাজ ও সমগ্র জাতি। সবথেকে আগে প্রয়োজন সমাজ সচেতনতা ও শিক্ষার প্রসার। অশিক্ষা দূরীকরন করতে হবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন থেকে। অশিক্ষা ও কুসংস্কার দূর করতে পারলেই এই প্রথা রদ করা সম্ভব। সাথে প্রয়োজন দারিদ্রতা দূরীকরণ। সামাজিক এই প্রথা রদ করতে হলে মানসিকতার উন্নতি ঘটাতে হবে মানুষের মধ্যে। তা না হলে কেবলমাত্র আইন দ্বারা এই প্রথা দূর করা বিশেষ ফলপ্রসূ হবে না।
©somewhere in net ltd.