![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
একিদন- একরাত করেছি প্রেমের সাথে খেলা একরাত-একিদন করেছি মৃত্যুরে অবহেলা একিদন- একরাত;তারপর প্রেম গেছে চলে সবাই চলে যায়-সকলের যেতে হয় বলে
ন্যাশনাল ট্রাভেল্স। ঢাকাগামী দূরপাল্লার চেয়ার কোচ। বাসটা ছেড়ে যেতে এখনো দশ মিনিট বাকি। অতএব এক কাপ চা খেয়ে নেয়া যাক। নির্দিষ্ট সিটে কাঁধের ছোট্ট ব্যাগটা রেখে আমি বাস থেকে নেমে পড়লাম। চারদিকে হাড় কাঁপানো শীত। আমি মাফলারটা দিয়ে ভালো করে মাথা ঢাকলাম। নোংরা মতো একটা টি স্টলে উঁকি দিলাম। আমারই মতো দু-একটা লোক চায়ে চুমুক দিচ্ছে। বেশ দ্রুত চা শেষ করলাম। বাসের ইঞ্জিনটা স্টার্ট দেয়া হয়েছে। দিনের মতো যাত্রীদের হুড়োহুড়ি দেখলাম না। চারদিক মোটামুটি নিশ্চুপ। শহরে রাত বারোটা খুব বেশি রাত নাÑ কিন্তু শীতকাল বলে কিংবা এটা ঢাকা শহর নয় বলেই বাসটা মোটামুটি ফাঁকা। আমি বাসে উঠে পড়লাম।
আমি হতভম্ব ! আমার ব্যাগটা যেখানে রেখেছিলাম, সিটের সে জায়গায় ব্যাগটা নেই। জিঞ্জেস করে জানা গেল- পাশের ভদ্রলোক ব্যাগটা উপরে বাম্পারে রেখেছেন। আমি সিটে বসে মাফলার দিয়ে ভালো করে মাথা মুড়লাম। এখন শুধু আমার চোখ দুটো বের হয়ে আছে।বাতাস আমার একদম সহ্য হচ্ছে না। বাসটা বিনোদপুর বাজারে চলে এসেছে। শেষ বারের মতো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালাম। আর এখানে আসা হবে কিনা জানি না। একটা প্রয়োজনীয় কাগজ উঠাতে প্রায় চার বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছি। সব কিছু কেমন আগের মতই আছে। ঐতো সৈয়দ আমীর আলী হলটা আগের মতই আছে। আমি কি করব বুঝতে পারছি না। আমি একটুখানি চোখ বুজে থাকলাম। ঘুম আসবে বলে মনে হচ্ছে না। আমি চোখ খুললাম। চারপাশে চোখ বুলালাম একবার। পাশের ভদ্রলোক গুটুর গুটুর করে গল্প করছে তার স্ত্রীর (সম্ভবত) সাথে। আমি কান পাতলাম। মহিলাটি (মহিলা বলা কী ঠিক হচ্ছে !) রিনিঝিনি শব্দে কথা বলছে। “তুমি যাই বলো শারমিনের ছেলের জন্মদিনে আমাদের কিন্তু যাওয়া উচিত।” “আচ্ছা জান্নাতটার জন্য একটা ছেলে দেখলে কেমন হয় ?” “ পিটবো, আমি তোমাকে পিটবো।”
আমার বুকটা ধ্বক করে উঠলো। কণ্ঠটা কেমন যেন পরিচিত, শব্দটাও। আমার খুব ইচ্ছে করতে লাগলো তাঁদের জিঞ্জেস করি - আপনাদের বাড়ি কোথায় ? আমি কি করবো ভেবে উঠতে পারছি না। আমি তাকালাম তাঁদের দিকে। আমার গা ছুঁয়ে যে লোকটা বসে আছে, তিনি পরিপূর্ণ ভদ্রলোক। তাঁর পাশে ঠিক জানালার ধার ঘেঁষে বসে আছে নিষ্ঠুর বোরখাঢাকা একটা রমণী। তাঁর বয়স কেমন, বেশবাস-ই বা কেমন, কিচ্ছু বোঝার উপায় নেই।
আমার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে গেল। কোন কিছু না ভেবেই জিঞ্জেস করলাম, আপনার বাড়ি কোথায়? ভদ্্রলোক জিঞ্জাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। মৃদু হেসে বললেন, কিছু বললেন? ভদ্্রলোকের মুখটা কেমন পরিপূর্ণ পবিত্র - দেখলেই কেমন “ভালোমানুষ” “ভালোমানুষ” টাইপ মনে হয়। আমি পুনরায় জিঞ্জেস করলাম, আপনাদের - না মানে আপনার বাড়ি কোথায়? ভদ্্রলোকের ব্যবহার অমায়িক। তিনি হ্যান্ডশেক করে আমার সাথে পরিচিত হলেন। নামটা কি রহমান যেন বললেন, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম না। বাড়ি নওগাঁয়, দুজনেরই। ভদ্রলোক একটা কলেজে পদার্থ বিঞ্জান পড়ান, সঙ্গিনীটি পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক সংস্থায় কি একটা পদে যেন। আমি ধরে নিলাম দুরন্ত সুখী পরিবার। তাঁদের ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্য অবশ্যি জানতে পারলাম না। এখন আমার পরিচয় দেবার পালা। আমার অসম্ভব ইচেছ করতে লাগল পরিচয়টা গোপন করি। আমি হড়বড় করে মিথ্যা বলে গেলাম, আমি শ্রভ্র। ঢাকার সাভারে বাড়ি। ঢাকায় ব্রাক হেড অফিসে একটা পদে আছি। রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে একটা প্রয়োজনীয় কাজে এসেছিলাম। পরপর অনেক গুলো মিথ্যা কথা বলে ফেললাম। গত তিন বছরে মিথ্যা কথাকে আমি একটা আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছি। মুখে একটুও বাধে না। অনুশোচনাও হয় না। অথচ তিন বছর আগেও মিথ্যাকে কেমন ভয় পেতাম। নদীর নরম মুখটা চোখের উপর ভেসে উঠত। কী যে মায়াবি মুখ ! প্রিয় নদী, তুই কি নদী ?
আমার নাম শূভ্র না, শাহীন। বাড়ি রাজবাড়ি জেলার কোনো এক স্বপ্নঝরা গ্রামে। তবে চাকরির কথাটা আমি মিথ্যা বলিনি। ভদ্রলোক বেশ আগ্রহভরে শুধালেন, আপনি নিশ্চয়ই রাজশাহী
ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন? আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম এবং বললাম, সাবজেক্ট ম্যাথ - বছর ছয়েক হল। আমি এই মিথ্যা কথাটি কেন বললাম, জানিনা। তবে আমার বিষয়টা গণিত-ই ছিল, তবে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়েছি বছর চারেক হল। ভদ্রলোক গালভরে হেসে বললেন, আমিও ওখান থেকেই - তবে আমার সাবজেক্টটা ছিলো ফিজিক্স। সেটাও বছর দশেক হল । ও আচ্ছা, আমার স্ত্রী বছর চারেক হল বেরিয়েছে- ওর সাবজেক্টও ছিল ম্যাথ।
আমার সম¯ত বুকটায় শীতকালের ঝরাপাতারা ঝরে পড়ল। আমার নদী আমারি দেড় হাত দুরে বসে আছে, অথচ আমাকে চিনতে পারছেনা ! আমার বুকের শব্দ কী বেড়ে গেল ? হয়তো-হয়তো না। আমার এমন লাগছে কেন ? ইচ্ছে করছে চাঁদগলা রূপালি রাতে ছুটে যাই সমুদ্র তীরে। পেছনে সারি সারি ঝাউবন - বাতাসে ঢেউয়ের গন্ধ। আমি বুঝতে পারছি না সমুদ্্েরর ঢেউগুলো আমার বুকে আছড়ে পড়ছে কিনা।আমি ভদ্্রলোককে আনমনে জিঞ্জেস করলাম, আচ্ছা ভাই - কখনো নদী দেখেছেন ? ভদ্রলোকটি কী রকম আশ্চর্য শাšত দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছেন। নদীও কি চেয়ে দেখলো একবার আমার দিকে !আমার দেয়া নাম - কী মায়ায় জড়ানো নাম ---- ঠিক যেন বসšেতর ঝরাপাতা ---- নদী !
রহমান সাহেব আমাকে গুঁতো দিয়ে বললেন , আরে নদী দেখবো না কেন ! রাজশাহী কলেজে পড়ার সময়ে পদ্মাতে কত ঝাঁপ দিয়েছি। আমি হাসলাম। বললাম , শুনে আশ্চর্র্য হবেন আমি জীবনে নদীর পানি ছঁয়ে দেখিনি। আচ্ছা নদীর পানি খুব কী নরম ? রহমান সাহেব আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি অনর্গল মিথ্যা কথা কথা বলে চলেছি - কলেজে থাকতে একবার আমরা শিা সফরে গিয়েছিলাম কক্সবাজার - সবাই সমুদ্্ের নেমে গোসল করলো , শুধু আমি নামলাম না। পানিকে আমি খুব ভয় পাই। তাছাড়া সাঁতারও জানি না আমি। ট্রলারে সেন্টমার্টিন গেলাম সম¯ত পথ চোখ বুজে - জ্যাকেট মুড়ি দিয়ে। সবাই আমার অবস্থা দেখে সেদিন খুব হাসাহাসি করেছিলো। রহমান সাহেব মহানন্দে গা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে লাগলেন। বার তিনেক বললেন , ভেরি ইন্টারেস্টিং। আমি গাঢ় স্বরে কবিতা আবৃত্তি করে চলেছি -
রাইসর্ষের তে সকালে উজ্জ্বল হল - দুপুরে বিবর্ণ হয়ে গেল
তারই পাশে নদী ;
নদী , তুমি কোন্ কথা কও ?
অশথের ডালপালা তোমার বুকের ’পরে পড়েছে যে ,
জামের ছায়ায় তুমি নীল হলে ,
আরো দূরে চলে যাই
সেই শব্দ পিছে পিছে আসে ;
নদী নাকি ?
নদী , তুমি কোন্ কথা কও ?
তুমি যেন ছোট মেয়ে - আমার সে ছোট মেয়ে ;
যতদূর যাই আমি - হামাগুড়ি দিয়ে তুমি পিছে পিছে আস ,
তোমার ঢেউয়ের শব্দ শুনি আমি : আমারই নিজের শিশু সারা দিন
নিজ মনে কথা কয়।
কথা কয় - কথা কয় - কান্ত হয় নাকো এই নদী
এক পাল মাছরাঙা নদীর বুকের রামধনু
বকের ডানার সারি শাদা পদ্ম - নিস্তব্ধ পদ্মের দ্বীপ নদীর ভিতরে
মানুষেরা সেই সব দেখে নাই।
তখন আমের বনে ব’লে গেছি
এইখানে কোকিলের ভালবাসা কোকিলের সাথে ,
এখানে হাওয়ায় যেন ভালোবাসা বীজ এক আছে ,
নদীর নতুন শব্দ এইখানে : কার যেন ভালোবাসা পুষে রাখে
সোনালি প্রেমের গল্প সারা দিন পাড়ে
সারা দিন পাখি তাহা শোনে ; তবু শোনে সারা দিন ?
পাখিরা তাদের গানে এই শব্দ তবু
পৃথিবীর েেত মাঠে ছড়াতে পারে না ,
নদীর নিজের সুর এ যে !
নদী , তুমি কোন্ কথা কও ?
গাছ থেকে গাছে - মাঠ থেকে মাঠে রোদ শুধু মরে যায়
সব আলো কোন্ দিকে যায় !
নিজের মুখের থেকে রোদের সোনালি রেণু মুছে ফেলে নদী
শেষ রেণু মুছে ফেলে
সে যেন অনেক বড় মেয়ে এক - চুল তার ম্লান - চুল শাদা -
শুধু তার ফুল নিয়ে খেলিবার সাধ -
ফুলের মতন কোন্ ভালোবাসা নিয়ে ,
ধানের কঠিন খোসা - খড় - হিম - শুষ্ক সব পাপড়ির মাঝে
সেই মেয়ে
ইত¯তত বসে আছে ;
গান গায় ;
নদীর - নদীর শব্দ শুনি আমি।
(নদী , জীবনানন্দ দাশ)
কবিতা আবৃত্তি শেষ। রহমান সাহেব অবাক হয়ে চেয়ে আছেন আমার দিকে।মাথা বাকিয়ে বললেন ,শুভ্র সাহেব ,এই যে আপনার হাত ছুঁয়ে বলছি, জীবনে এতো ভালো কবিতা আর এতো ভালো আবৃত্তি শুনেছি বলে মনে পড়ে না।কী কথা -- নদী তুমি কোন্ কথা কও।আমি অভদ্রের মত নদীর দিকে তাকালাম। বাসের ভিতরের অস্পষ্ট আলোয় ওর চোখে কী অশ্র“ দেখলাম ! এ আমার উদ্ভট কল্পনা কিংবা দৃষ্টি ভ্রমও হতে পারে। আচ্ছা- নদী কি আমাকে চিনে ফেলেছে ? কেন জানি মনে হচ্ছে- ও আমাকে চিনে ফেলেছে। চিনলে চিনুক, এ বুকটা মরে গেলে মরে যাক – আমি কিচ্ছু বলবো না। সুনীলের “কেউ কথা রাখেনি” আমি ওকে মনে করিয়ে দিব না। জিঞ্জেস করবো না, কেন বরুণারা কথা রাখে না।
রহমান সাহেব কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই ব্যাগ থেকে ফাস্ক বের করলেন। কিন্তু সমস্যা হয়ে গেলো কাপ দুটির বেশি হয় না। আমি বললাম, ঠিক আছে সমস্যা নেই- বরং আপনারাই খান। রহমান সাহেব এবং মিসেস রহমান দুজনেই ঘোর আপত্তি তুললেন। অবশেষে রহমান সাহেব নিজে ফাস্কের ঢাকনি ব্যবহার করলেন, আর আমরা দুজন কাপ। বাসের ঝাঁকুনির তালে তালে চা খেতে খেতে গল্প করা মন্দ না। আমি আর রহমান সাহেব বর্তমান রাজনীতি নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি, হঠাৎ নদী আমাকে বললো, আচ্ছা শুভ্র সাহেব আপনি কি মিথ্যা কথা বলেন ? আমি চমকে উঠলাম। রহমান সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন। চোখ পিট পিট করে বললেন , ও খুব সেনসেটিভ মেয়ে- কেউ মিথ্যা কথা বললে ঠিকই ধরে ফেলতে পারে।আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। নদীকে কী সত্যি কথা বলা যায় – এখন মিথ্যাই সর্বস্য।আমি নড়েচড়ে বসলাম এবং মুখে অনেকখানি হাসি এনে বললাম , আমার এক প্রিয় বন্ধু বলেছিলো , মিথ্যা স্বাস্থ্যেও জন্য ভালো। আমার যেহেতু স্বাস্থ্য একটু খারাপ , যখন তখন মিথ্যা বলার চেষ্টা করি। রহমান সাহেব আমার ঊরু চাপড়ে বললেন , আপনি ঠিকই বলেছেন।দূর্ভাগ্য আমার মিথ্যা বলা কপালে সইলো না। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ভদ্রলোক একটু বেশি কথা বলেন কিনা। নদী হঠাৎ বললো , আপনি কোন হলে ছিলেন ? আমার মাথায় চার-পাঁচটা হলের নাম ঘুরপাক খাচ্ছে , কোনটা রেখে কোনটা বলি। একটা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে কমপে দশটা মিথ্যা কথা বলতে হয়। আমি যেহেতু সোহ্রাওয়ার্দী হলে ছিলাম , তাই নির্দ্বিধায় বলে দিলাম মাদার বখ্শ হল। আপনি কি হাসানকে চেনেন-মাদার বখ্শে থাকতো ? নদী জিঞ্জাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি বললাম , হাসান নামের কাউকে আমি চিনি না।
তারপর অনেকখানি নিরবতা। বোধ হয় সবারই ঝিমুনি ভাব এসে গিয়েছিলো- রাত তো কম হয়নি। হঠাৎ বাসটা প্রচন্ড ঝাঁকুনি খেলো , স্পিড ব্রেকার মাড়িয়ে গেলো হয়তো।এখন এই রাত দুইটা একান্ন মিনিটে আমরা কোথায় আছি বুঝতে পারছি না।হঠাৎ মনে হলো , এই বাসটা যদি আর কোথাও না থামতো ! আজকের এই জোনাকজ্বলা রাতটা যদি আর ভোর না হোত !!
আমি কী ভুল শুনলাম- শাহীন, কেমন আছিস তুই ! আড় চোখে নদীর দিকে তাকালাম। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা।এটা আমার অবচেতন মনের কল্পনা বলেই ধরে নিলাম। আমি এখন কি করবো - কি করা যায়। সময় যেন হিমালয় চাপা পড়ে গেছে।জানি না কখন সকাল হবে।তারচে মনে মনে একটা চিঠি লিখি। কিন্তু কার কাছে লিখবো ? বাবা-মা , সে অনেক দূরের কেউ। বন্ধু-বান্ধব নেই বললেই চলে। একদিন নদী ছিলো , আজ নেই। না না ভুল বললাম- নদী আজও আছে , ঠিক দেড়হাত দূরে......... মাঝখানে বিরান গ্রীষ্মের মাঠ, দীর্ঘশ্বাসের নীরব পথচলা।
আমি সিগ্রেট ধরালাম। শীতে সিগ্রেটে টান দেয়ার মজাই আলাদা।তাছাড়া সবাই যেহেতু ঘুমিয়ে পড়েছে , তাই কারও অসুবিধা হবে বলে মনে হলো না। আমি মনে মনে নদীকে চিঠি লিখতে বসলাম।
প্রিয় নদী........আমার ভাবনার সুতা ছিঁড়ে গেলো।আমার হাতে কিসের স্পর্শ যেন ! স্পর্শটা কি খুব বেশি নরম ! কেন এই শেষ বার আবার আমার হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছে করছে। আমি পুনরায় সিগ্রেটে টান দিতে গেলাম , আবার সেই স্পর্শ ! আমার হাত থেকে সিগ্রেট পড়ে গেলো। নদী তো নদীই - মোমের প্রতিমা , স্বপ্ন-আকাঙার বেলাভূমি। আমি হাত ছাড়িয়ে নিলাম। অনুশোচনার সুরে বললাম , সরি- বুঝতে পারিনি। বেশ কিছুণ কেটে গেলো , শুধু বাসটার গুমগুম শব্দ।
প্রিয় নদী ,
কথা ছিলো........
আমি পাথর হয়ে গেলাম। নদী ফিসফিস করে বললো , শাহীন- কেমন আছিসরে তুই ? এখন আর না শোনার ভান করতে পারলাম না। আমি বললাম , এক্সকিউজ মি- আমি শাহীন না। আপনি ভুল করছেন.......। আবার নিরবতা। আঁধার মাড়িয়ে বাসটা ছুটে চলেছে যেন আমার বুকের উপর দিয়ে।
প্রিয় নদী ,
কথা ছিলো পাশ করার পর দুই বছর অপো করবি। আসলে আমি জানতাম না, কেউ কথা রাখে না। আজ কেবলি-----
আচ্ছা আপনি নদী চেনেন ! শেষ বার আবার ভুল করে ফেললাম। চোখে আলো আঁধারি মেখে নদী চেয়ে আছে আমার দিকে। যে এক কোটি আশি ল শপথের বেড়াজালে আজো আটকে রেখেছে আমাকে।
প্রিয় নদী ,
কেমন আছিস তুই ? স্বামী-সংসার নিয়ে বেশ থাকবার কথা। এই যে তুই দেড় হাত দুরে বসে আছিস , নির্মম হলেও সত্য যে তোর মুখটা খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। বোরখা ঢাকা মুখটা যদি আজো আমাকে বাচতে শেখায় ! আচ্ছা নদী, তোর কি মনে পরে পদ্মার চর, শবেবরাতের রাত, জোৎস্নার নদী.....
এরি মাঝে গাবতলী চলে এলাম নাকি ! নাহ্ এখনো সামান্য পথ বাকি। আমাকে এখানে নেমে যেতে হবে। গাবতলী থেকে বাসায় যেতে খুব সমস্যা হয়। আমি কাঁধে ব্যাগ ঝুলালাম। রহমান সাহেব অঘোরে ঘুমাচ্ছেন। আমি কি ডাক দিব তাকে ? আমি রহমান সাহেবের কাঁধে হাত রাখলাম। একটুখানি নড়েচড়ে উঠলেন তিনি। আমি ডাকলাম, রহমান সাহেব-রহমান সাহেব। তিনি ধড়মড় করে জেগে উঠলেন। বললেন, এসে গেছে নাকি ! আমি মৃদু হেসে বললাম, না এখনি এসে পড়বে। আমি এখানেই নেমে পড়ব। সুবিধা হবে। রহমান সাহেব হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি হাত ধরলাম আর মনে মনে বললাম, রহমান সাহেব, আমার নদীটাকে আপনি কোনোদিন কষ্ট দেবেন না।
শেষবার নদীর দিকে কি তাকাব ? হ্যাঁ, না তাকিয়ে পারলাম না। ওর চোখে কি পানি ? না- এ হতেই পারে না। পোড়া মন উদ্ভট কল্পনা করতে ভালোবাসে। কি বলা উচিত ? এদিকে বাস থেমে গেছে। আমার প্রিয়নদীটার সাথে এক টুকরো কথা বলারও সময় নেই। নদী, ভা----লো----;আমাকে নেমে যেতেই হলো। বাসটা পুনরায় ছেড়ে দিয়েছে। আমার নাম ধরে কেউ কি ডাকলো ? পোড়া মন !
এখনি ভোর হবে হবে। আচ্ছা আর যদি ভোর না হয় কখনো ! রিকশা নেই , হেঁটেই রওনা হতে হলো। এখন তেমন কুয়াশা নেই। ল্যাম্পোস্টের নিয়ন আলোয় আকাশটা কালো। আমি পা চালালাম বেশ জোরে। রাত্রির রাজপথ পুরোপুরি ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। অনেকখানি আমার হৃদয়ের মতো।
২৭.০১.২০০৪ ইং
দুপুর ০১.৪৯
বাজিতপুর, রাজবাড়ি
©somewhere in net ltd.