| নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অদৃশ্য যোদ্ধা
সত্য কথা বলা এবং সুন্দর করে লেখা অভ্যাসের উপর নির্ভর করে
সেদিন সন্ধ্যা সমাগত।
পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে এক স্বাধীন রাষ্ট্রের আবির্ভাব তখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা যখন দিগন্তে প্রায় বিলীন, ঠিক সেই মুহূর্তে যুদ্ধবিধ্বস্ত ঢাকা নগরী এক চরম থমথমে পরিবেশের সাক্ষী। শহরের উপকণ্ঠে তখনও চলছিল বিক্ষিপ্ত যুদ্ধ, এমনকি শহরের কেন্দ্রস্থলেও শোনা যাচ্ছিল বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষের শব্দ।
এমনই এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ঠিক সন্ধ্যা ৫টা ২৫ মিনিটে, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান, জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ডের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করলেন।
আত্মসমর্পণের পরপরই মুক্তিকামী জনতা আর মুক্তিযোদ্ধারা বাঁধভাঙা উল্লাসে ফেটে পড়লেন। শহরের পথে-পথে আকাশের দিকে তাক করে রাইফেলের ফাঁকা গুলিতে প্রকম্পিত হতে থাকল স্লোগান—"জয় বাংলা!" যে ঢাকা নগরী সন্ধ্যা পর্যন্ত ছিল থমথমে, রাতের পর রাত সেটিই পরিণত হলো এক অনিন্দ্য বিজয়-উৎসবে।
নারী, পুরুষ, শিশু—সবাই নির্ভয়ে ঘরের দেওয়াল ছেড়ে নেমে এলো রাজপথে। বিজয়ের আলোয় উদ্ভাসিত হলো নগরীর প্রতিটি অলিগলি। সেই রাতে নির্ঘুম ঢাকা শহরের ঘরে-ঘরে জ্বলেছিল বিজয়ের মশাল।
কেমন ছিল ১৯৭১ সালের সেই ঐতিহাসিক ১৬ ডিসেম্বর, ঢাকার চিত্র? প্রত্যক্ষদর্শী তিন জন বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতিচারণ এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বহু প্রামাণ্য গ্রন্থে এর বহুবিধ বিবরণ পাওয়া যায়।
তাঁদের ভাষ্যমতে, সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। সকাল থেকেই ঢাকা শহরের রাজপথ তরুণ-যুবা আর উৎসুক জনতার ভিড়ে ছিল মুখরিত। সবার চোখে-মুখে ছিল এক অবিস্মরণীয় প্রত্যাশা। সকাল সাড়ে ১০টার পর সাভার-মিরপুর সড়ক ধরে যখন মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর বিজয়ী কন্টিনজেন্ট ঢাকায় প্রবেশ করে, তখন জনতা বিপুল করতালি ও 'জয় বাংলা' ধ্বনির জয়োচ্ছ্বাসে তাদের স্বাগত জানায়।
পথে-পথে মুক্তিকামী মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর বিজয় উদযাপনের প্রধান সঙ্গী হয়ে ওঠে। একদিকে ছিল পারস্পরিক উল্লাস আর বাঁধনহারা আনন্দ, আর অপরদিকে তখন চলছিল পরাজিত হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি। বিজয়ের সেই দিনটিতে ঢাকা নগরীর বাতাস ছিল প্রত্যাশা ও উল্লাসের মিশেলে এক অভূতপূর্ব আবেগঘন।
মুক্তিযুদ্ধের যৌথ বাহিনীর সিদ্ধান্ত অনুসারে, সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মতো ঐতিহাসিক দায়িত্বটি অর্পণ করা হয়েছিল ভারতের ইস্টার্ন আর্মির চিফ অব স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জেকবের ওপর।
তিনি ভারত থেকে যাত্রা শুরু করে যশোরে হেলিকপ্টার বদল করে ঢাকায় পৌঁছান। ঢাকা এয়ারফিল্ডে অবতরণের পর, ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী এবং কর্নেল এম এস খারা-কে সঙ্গে নিয়ে জেকব জেনারেল নিয়াজির হেডকোয়ার্টার্সের দিকে রওনা হন।
ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর একটা। জেকব তাঁর দলবল নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে পৌঁছান। এর পরপরই তিনি আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত দলিলপত্র তৈরি এবং আনুষঙ্গিক কার্যক্রম গোছানোর কাজে হাত দেন। বিজয়ের সেই ক্ষণটিকে আইনি ও সামরিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার জন্য দ্রুততার সাথে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।
‘আমি নিয়াজির অফিসে ফিরে এলে কর্নেল খারা আত্মসমপর্ণের শর্তাবলি পাঠ করে শোনান। নিয়াজির চোখ থেকে দরদর করে পানি পড়তে থাকে, সেই সঙ্গে ঘরে নেমে আসে পিনপতন নিস্তব্ধতা।’ জে এফ আর জেকব তার ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ গ্রন্থে লিখেছেন এভাবেই।
হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান নিয়াজির হেডকোয়ার্টার্সের অভ্যন্তরে যখন পিনপতন নীরবতা, ঠিক তখনই বাইরের পরিবেশ ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত, উচ্ছ্বাসমুখর!
শহর তখন ভরে উঠছে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর বিজয়ী পদচারণায়। ঢাকার পথে-পথে ছিল মানুষের উপচে পড়া ভিড়, বাঁধনহারা আনন্দ আর উল্লাস। একইসঙ্গে, সবার চোখে-মুখে ছিল প্রতীক্ষা—কখন হবে হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুকুল বোস যুদ্ধ শেষে সেই ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরই ঢাকায় ফিরে আসেন। সুদীর্ঘ ৫০ বছর পরেও ঢাকার সেই বিজয়-দৃশ্য তাঁর স্মৃতিতে আজও অম্লান ও সজীব।
তিনি সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে বলছিলেন:
“আমি যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বরই ঢাকায় ফিরে আসি। শহরে ঢোকার মুহূর্তেই দেখলাম সবার মধ্যে আনন্দ, মিছিল আর উৎসবের ঢেউ। পুরো ঢাকা জুড়ে তখন মিছিল হচ্ছে, সমাবেশ হচ্ছে, আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে বিজয়ের স্লোগানে। যার-যার সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ তখন তাদের মুক্তির আনন্দ উদযাপন করছে।”
ডিসেম্বরের প্রথম দিনগুলো থেকেই ঢাকার ইস্কাটনে আত্মগোপনে ছিলেন প্রবীণ রাজনীতিক ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। তবে ১৬ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক সকালে তিনি আর লুকিয়ে থাকলেন না—মুক্তির বার্তা পেয়েই বেরিয়ে এলেন আত্মগোপনের আস্তানা থেকে।
এক সাক্ষাৎকারে সেই দিনের স্মৃতি তুলে ধরে টুকু বলেন-
“পাকিস্তানি বাহিনী তখন ধীরে ধীরে গুটিয়ে যাচ্ছে, রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে আসছে। আর আমাদের বাঙালি সাধারণ মানুষও তখন উঁকিঝুঁকি দিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছে। চারদিকে তখন এক চরম থমথমে ভাব, আমার মনে আছে ওরা কারফিউ জারি করেছিল। এরপর যখন ঘোষণা হলো—ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ হবে, তখন যেন মানুষ একবারে বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো।”
রণাঙ্গণের সংবাদ নিয়ে 'পূর্ববাংলা' নামে একটি পত্রিকা বের করতেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ। তখনকার যুদ্ধোত্তর পরিবেশের কথা উল্লেখ করে ইকবাল হাসান আরও যোগ করেন:
“আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে দেখি—যাঁরা এতদিন মাঠে থেকে যুদ্ধ করেছেন, সেই মুক্তিযোদ্ধারা দলে দলে শহরে ঢুকছেন। যাঁদের দেখলাম—তাঁরা মূলত কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষের সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে এই কৃষক-শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি ছিল।”
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালের সেই ঐতিহাসিক দিনে মিত্রবাহিনীর ঢাকা প্রবেশের সময় নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থে তথ্য রয়েছে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের লেখা 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি' গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে।
অন্যদিকে, মোহাম্মদ হান্নান রচিত 'ঢাকার রাজনৈতিক ইতিহাস' গ্রন্থ থেকে আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়:
"১৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় মেজর জেনারেল নাগরার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী সাভার-মিরপুর সড়ক ধরে বিপুল করতালি এবং মুহুর্মুহু 'জয় বাংলা' ধ্বনির মধ্য দিয়ে বিজয়ের বেশে ঢাকায় প্রবেশ করে। জেনারেল নাগরার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ ও দল।"
গুরুত্বপূর্ণ হলো, এরও আগে, ঠিক সকাল ৮টা ৩০ মিনিটেই, জেনারেল নাগরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় অধিনায়ক জেনারেল আমীর আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির কাছে একটি জরুরি বার্তা পাঠান। সেই বার্তায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করার কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই বার্তাই চূড়ান্ত আত্মসমর্পণের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত দিনে রেসকোর্স ময়দানের দিকে দুপুরবেলার পরিবেশটি ছিল মিশ্র অনুভূতির। পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকার বাসিন্দা, বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমেদ, যিনি তখন কিশোর বয়সে গেরিলা যুদ্ধ করেছেন, স্মৃতি হাতড়ে পত্রিকাকে বলছিলেন=
“আমরা দুপুর ১২টা-১টার দিকে রেসকোর্সের দিকে যাচ্ছিলাম। পরিবেশ তখনো কিছুটা থমথমে ছিল, খারাপই বলা চলে। কিন্তু এর মধ্যেও সবার চোখে-মুখে ছিল এক ধরনের চাপা আনন্দ, এক বিজয়ী খুশি-খুশি ভাব।”
অন্যদিকে, গেরিলা যোদ্ধা ইকবাল হাসান মাহমুদ সেই মুহূর্তের তীব্র আবেগ ও অনুভূতি প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা প্রায় অসম্ভব ছিল:-
“তখনকার অনুভূতিটা আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আমরা ছিলাম চরম উত্তেজিত (We were so excited)। ষাটের দশক থেকে শুরু করে দিনের পর দিন আন্দোলন করতে করতে এই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। সেই আন্দোলনের ফল দেখতে পাওয়ার উত্তেজনা ছিল অবর্ণনীয়।”
১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্টের দিকে ফিরে যাওয়ার পথে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য ঢাকার শাহবাগস্থ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের (তৎকালীন নাম) সামনে উপস্থিত জনতার ওপর আকস্মিকভাবে গুলি চালায়।
গেরিলা যোদ্ধা ইকবাল হাসান মাহমুদের বর্ণনায় সেই অপ্রত্যাশিত মুহূর্তটি উঠে আসে:
“পাকিস্তানি বাহিনীর একজন সৈনিক আচমকা গুলি ছুঁড়তে শুরু করে দিলো—হয়তো সে লুকিয়ে রেখেছিল অস্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সৈনিকরা দ্রুত সাড়া দিয়ে তাদের মধ্যে তিন-চারজনকে গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু ততক্ষণে দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দু’জন বেসামরিক মানুষও প্রাণ হারালেন।”
ইকবাল হাসান মাহমুদ আরও উল্লেখ করেন, সেদিন কেন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের দিকে এত ভিড় ছিল:
“আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশ্ব মিডিয়ার প্রচুর সাংবাদিক তখন হোটেলে অবস্থান করছিলেন। এই কারণে মুক্তিবাহিনীর অনেক সদস্যের আগ্রহ ছিল শাহবাগের এই হোটেলটির দিকে। ছবি তুললে তা বিশ্ব মিডিয়ায় প্রকাশিত হবে—এই আগ্রহে অনেকেই তখন হোটেলটির আশেপাশে ভিড় জমিয়েছিলেন।”
আত্মসমর্পণের সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের বর্ণনা পাওয়া যায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জেকবের লেখা ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন:
“গার্ড অব অনার পরিদর্শনের পর অরোরা (লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা) এবং নিয়াজি টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। অরোরার নিয়ে আসা আত্মসমর্পণের আনুষ্ঠানিক দলিলটি টেবিলের ওপর রাখা হলো। নিয়াজি কৌতূহলী দৃষ্টিতে সেটির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে স্বাক্ষর করলেন। এরপর অরোরাও দলিলে সই করলেন। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম—সময় তখন ভারতীয় সময় অনুযায়ী বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিট।”
দলিল স্বাক্ষরের পর নিয়াজি তাঁর কাঁধ থেকে অধিনায়কদের সম্মানসূচক ব্যাজ (অ্যাপলেট) খুলে ফেলেন এবং একটি ছোট দড়ি সমেত পয়েন্ট ৩৮ রিভলভারটি অরোরার হাতে তুলে দেন। এই সময় তাঁর চোখে অশ্রু দেখা যাচ্ছিল।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত জনতার গর্জন শুরু হয়। নিয়াজিবিরোধী এবং পাকিস্তানবিরোধী স্লোগান ও গালিগালাজে ময়দান প্রকম্পিত হতে থাকে।
তৎকালীন পরিবেশ প্রসঙ্গে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমেদ বলেন:
“সারেন্ডার হওয়ার পর তো রীতিমতো চিল্লাচিল্লি হইছে, হৈ-হৈ হইছে, কত কিছু! স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে তো আমরা আগেই জানতে পেরেছি যে দেশ স্বাধীন হচ্ছে। কিন্তু তখনও আশপাশের কিছু এলাকায় ঝামেলা চলছিল। ইংলিশ রোডে মারামারি হচ্ছিল, নয়াবাজারে তখন আগুন জ্বলছিল। সন্ধ্যার পর পাড়া থেকে ছোট-ছোট বিজয় মিছিল বেরিয়েছিল, আর ওপরের দিকে গোলাগুলিও চলছিল।”
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর ঢাকা শহরের পরিবেশ কেমন ছিল, তার বর্ণনা দিয়েছেন তৎকালীন ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুকুল বোস:
“ঢাকার সারা শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তখন অনবরত মুক্তিযুদ্ধের গানগুলো বাজছে। পুরো শহর তখন যেন কেবল আনন্দ আর উল্লাসের এক মহাসমুদ্র। অনেকেই নিজেদের খুশি ধরে রাখতে না পেরে ঘরে-ঘরে মিষ্টিও বিতরণ করছিলেন।”
তবে এই বাঁধনহারা উল্লাসের মধ্যেও ছিল অন্য চিত্র। গেরিলা যোদ্ধা ইকবাল হাসান মাহমুদ বিজয়ের পর পরই উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রসঙ্গে বলেন:
“একদিকে যেমন ছিল বিজয়ের তীব্র উল্লাস, অপরদিকে তেমনই সুযোগসন্ধানীদের কারণে ছিল একধরনের অরাজকতা।”
তিনি উল্লেখ করেন, আগের কয়েকদিন কারফিউ থাকলেও বিজয়ের পরপরই শহরে আইনশৃঙ্খলা (Law and Order) প্রায় ছিল না বললেই চলে। এই সুযোগে:
“সুযোগসন্ধানীরা যে যার মতো লুটপাট করেছে, এমনকি বেশ কিছু বাড়িঘরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে।”
এই বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, চরম আনন্দের মধ্যেও সদ্য স্বাধীন হওয়া ঢাকা নগরী তখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি এবং তাকে সামাল দিতে হচ্ছিল নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ।
তথ্যসূত্র ও ছবিঃ
‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ ‘পূর্ববাংল ’ ‘ঢাকার রাজনৈতিক ইতিহাস’ 'ঢাকার রাজনৈতিক ইতিহাস' বিবিসি, বাংলা ট্রিবিউন, ইত্তেফাক ও ইন্টারন্টে ।
©somewhere in net ltd.