নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

প্রভাবপ্রতিপত্তি আজীবন থাকে না। প্রতারকরাও প্রতিরিত হয়। ক্ষমতাচ্যুত হলে ক্ষমতাসীনের কী হবে? কবর অথবা শ্মশানে প্রতিদিন মৃতসৎকার হয়। ©_Mohammed Abdulhaque [www.mohammedabdulhaque.com]

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক

অন্তত একবার সত্যকে তার সম্বন্ধে কিছু বলতে দাও। আমরা কে কী, অন্যরা তা জানতে এবং দেখতে পারবে।

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক › বিস্তারিত পোস্টঃ

"ফুলসাধনা"

১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪১




"ফুলসাধনা"

অসমাপ্ত প্রেমোপন্যাস
মোহাম্মাদ আব্দুলহাক

ব্যস্ত শহরের এক প্রান্তে দৃষ্টিনন্দন প্রাসাদ। প্রাসাদে উপর মনোময় বাগান। হঠাৎ দেখলে বতাসে ভাসা বাগিচা মনে হয়। কলাকুশলির সাধনচাতুর্য প্রাসাদকে অলীক সৌন্দর্যে নান্দনিক করেছে। ক্রোশ কয়েক দূর বনাঞ্চল। সবুজ ফটকে রজতাক্ষরে নন্দনাকানন লেখা। প্রাসাদ যে বানিয়েছেন উনি শৌখিন লোক। সফল পুরুষের জন্য যা যা প্রয়োজন আল্লাহ সব উনাকে দিয়েছেন। দান দয়ায় উনিও অকৃপণ। উনার একমাত্র মেয়ে নন্দনা, ফুলসাধনায় সাধিকা হওয়ার ব্রত করেছে।
ফুলের মত কমলিনী নন্দনা রূপজেল্লায় উজ্জ্বলা। নীলকান্তমণির মত চোখ। মধুরকণ্ঠী। শান্ত স্বভাববিশিষ্টা। কিছু করলে আনন্দ এবং আন্তরিকতার সাথে করে। বিশেষ করে ফুল দিয়ে কিছু করলে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে করে। ওর কামরার দেয়ালে ফুল কলি এবং অলির কারুকার্য। শিথানে পদ্মপলাশ। পৈঠ্যনে উড়ন্ত হীরামনপাখি। পাখির লাল ঠোঁটে হলদে ফুলের পাপড়ি। বামে মধুপায়ী প্রজাপতি, ডানে বোলতা এবং বভ্রু ভ্রমরী। ছাদের ছবিতে নীলাকাশে ভাসা খণ্ড মেঘের প্রতিবিম্ব। মেঝেতে সবুজ গালিচা। ছিটেফোঁটা বৃষ্টির মত বৈচিত্র্য ফুলের পাপড়ি বিছনায় ছিটানো। পরিপার্শ্বের সাথে মানিয়ে পারিপাট্য ভাবে ঘরের ভিতর আসবাবপত্র সাজানো। ভবনের কাজ শেষ হলেও যোগালিয়ারা টুকিটাকি কাজ করছিল।
বাসা দেখার জন্য প্রথমবারের মত বাবার সাথে নন্দনা আসে। দারোয়ান ফটক খুলে দেয়। চালক সর্তকতার সাথে গাড়ি চালিয়ে ভিতরে যায়। গাড়ি থামিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পিছনের দরজা খুললে নন্দনা বেরিয়ে ডানে বাঁয়ে তাকায়।
বাবা বেরিয়ে ওর পাশে গেলে আনন্দে উদ্বেলিত হয়। বাবার গালে গাল লাগিয়ে উম্মা বলে প্রায় দৌড়ে ছাদে ওঠে। ছাদের প্রান্তে যেয়ে চিৎকার করে বলে, ‘আব্বু, আপনিই আমার পৃথিবী।’
‘মা রে, আমার আনন্দের একমাত্র আত্মা তুমি। তুমি আমার জীবনের সম্বল। পিছনে যা রে মা। আমার হাত পা অবশ হয়েছে। আল্লার দোহাই দিচ্ছি, পিছনে যা।’ বাবা কম্পিতকণ্ঠে বলে কাঁধ ঝুলিয়ে মাথা নেড়ে রাজমিস্ত্রিদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে বললেন, ‘ছাদের চারপাশে এখুনি রেলিং লাগাও।’
রেলিং নিয়ে মিস্ত্রিরা ব্যতিব্যস্ত হয়। নন্দনা কপটহেসে পিছিয়ে হাতের ইশারায় ডেকে বলল, ‘আব্বু, ছাদে এসে দেখুন। পাখিদের জন্য পানির বন্দোবস্ত করা হয়নি।’
‘যেখানে আছ ওখানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকো। আমি আসছি।’ বলে বাবা দৌড়ে ছাদে উঠে দু হাতে হাঁটু ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘ছাদে যে রেলিং নেই তা কি তুমি খেয়াল করনি?’
‘আনন্দে প্রায় আত্মহারা হয়েছিলাম তাই না আব্বু?’ বলে নন্দনা ডানে বাঁয়ে থাকিয়ে শিউরে ওঠে।
‘তুমি খামোখা চিন্তার করো না। সব কিছুর সুবন্দোবস্ত হবে। বাগানের কাজ এখনও শেষ হয়নি। ওদেরকে বলেছি, আজ রাতেই সব কাজ শেষ করবে। আর কিছুর প্রয়োজন হলে চলো যেয়ে নিয়ে আসি।’
‘আর কিছু লাগবে না আব্বু। এখন আম্মুকে আসার জন্য বললে সবাই খুশি হবো।’ বলে নন্দনা ফুলের টব-ডাব্বা টানাটানি শুরু করে। বাবা হেঁটে হেঁটে দেখেন। ঠাঠাপড়া রোদে রক্তাভ হচ্ছে তবুও শীততাপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে যেতে নারাজ। এক মিস্ত্রির মাথায় ছাতা দেখে নন্দনা বায়না ধরে বলল, ‘আব্বু, ঔ ছাতা আমি চাই।’
বাবা ওকে ডেকে বললে ভালো করে ধুয়েমুছে ছাতা নিয়ে যায়। নন্দনা তাকে ধন্যবাদ বলে ছাতা মাথায় দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাগান দেখে। দেশ বিদেশ থেকে বিবিধ ফুলের চারা আনা হয়েছে। তা দেখে আনন্দ আহ্লাদে আটখানা। মিস্ত্রিরা রেলিং নিয়ে ব্যস্ত। নন্দনা বারবার এক কোণা থেকে অন্য কোণায় যাচ্ছে দেখে বাবা শঙ্কিত হন এবং নিরাপত্তার জন্য ওকে নিয়ে নিচে চলে যান। এমন সময় মা এবং পরিচারিকাকে নিয়ে ড্রাইভার আসে। নন্দনা বার বার ঘরবার করে। ফুল নিয়ে খেলা না করলে ওর সময় কাটে না। কোথাও গেলে ফুলের চারা চায়। ফুল ছাড়া আর কিছুই যেন চাওয়ার বা পাওয়ার নেই। নন্দনার চিন্তা চেতনায় ফুল ই ফুল।
ফুল আমরা সবাই ভালোবাসি এবং আমাদের মাঝে শখ সখ্যতা আছে। শখ এবং সখ্যে আমরা স্বর্গ অথবা নরকে যাব। অকল্মষ মনে ভালোবাসা থাকে এবং যাদের মনে মায়া টান আছে ওরা কখনও অন্যকে কষ্ট দিতে পারে না। বিশেষ করে গোলপ যারা পছন্দ করে তাদের মনে মোহ, মদ এবং মাৎসর্য থাকে না। ফুল কখনও অলীক অহংকারে ভ্রান্তি ছড়ায় না। ফুলের সুবাসে নিস্তেজ আত্মা সতেজ হয়। ফুল সবসময় অন্যকে আনন্দ দেয়। নর্দমায় ফুটলেও ফুল পবিত্র থাকে এবং ফুলের মধু অমৃত। নিয়মিত মধুসেবনে স্বাস্থ্য স্বস্তি বহাল থাকে। নিষ্পাপকে আমরা ফুলের সাথে তুলনা করি। ফুলের মত চরিত্র। ফুলের মত মন। ফুলের মত ফুটফুটে শিশু। ফুল নিয়ে শত শত কাব্য উপন্যাস রচিত হয়েছে। ফুলেল গাছে ফল ধরে। ফুল ছাড়া সুফল মিলে না। ফুলকে অবহেলা করলে সাধকের সাধনা সাধিত হয় না। তপোবনেও ফুল ফুটে। ফুলের দিকে তাকালে মন ফক-ফকে হয়। ফুলের সুবাসে বিচঞ্চল বাতাস হয় সুবাসি, ফুলের প্রেমে মজে মন হয় বাগানবিলাসী। ফুলের মালা গলায় দিয়ে জপতপ করলে পাপী মন হয় তপস্বী। ফুল আমি ভালোবাসি।
বাগানের এক পাশে দোলনা। দোলনায় বসে নন্দনা গুনগুন করছিল। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে। বিজলির ঝিলিক এবং ঠাঠার শব্দে চমকে ওঠে। আকাশে তাকিয়ে দোরঙামেঘ দেখে অনিমিখে বাগানের দিকে তাকায়। এমন সময় ঝেপে বৃষ্টি নামে। নন্দনা চিন্তিত হয়। ওর বাগানে দোরঙাগোলাপ নেই। বাবাকে বললেই এনে দেবেন। কিন্তু, আরেকটা মানেই অতিরক্ত। অতিরিক্ত কিছুই ভালো নয় এবং বাগানের জন্য একটা গাছ বেশি হবে। নন্দনা জানে, শুচিতারক্ষায় অতিরিক্ত ঝাড়াইবাছাইয়ে বাতিকা রোগ হয় এবং অতিরিক্ত আড়ম্বরে বিড়ম্বনা ঘটায়।
কী করবে কী না নিয়ে নন্দনা যখন ধেয়ান চিন্তা করে বাবা ওকে ডেকে বললেন, ‘নন্দনা, এসে দেখো। তোমার জন্য দোরঙাগোলাপের চারা এনেছি।’
নন্দনা স্বস্তির সাথে দাঁড়ায় এবং সতর্কতার সাথে হেঁটে সিড়ির পাশে যেয়ে প্রায় দৌড়ে নিচে নেমে ব্যস্তকণ্ঠে বলল, ‘কই দেখি। আব্বু, আমার চিন্তার খবর আপনি জানলেন কেমনে?’
‘তোমার বাগানে দোরঙাগোলাপ নেই। তাই নিয়ে এসেছি। নার্চারির কর্মচারি আমাকে দেখে বলেছিল, একটু খেয়াল পরখ করলে আরেকটা গাছের জায়গা বার করা যাবে। তাকে বলেছি জায়গা না হলে চারা ফিরিয়ে দেব। তবে সে বলেছে ফিরিয়ে দিতে হবে না। সে নাকি কয়েক মাস ধরে তোমার বাগান নিয়ে চিন্তা গবেষণা করেছে। তুমি তো জানো, উদ্যানপালনবিতে সে স্বর্ণপদক পেয়েছিল।’
‘তাইলে নিশ্চয় সব খুলাসা করে বলেছে?’
‘হ্যাঁ সে আমাকে বলেছে এবং দেখিয়েছেও। তবে বারণ করেছে। সে তোমার সাধনা এবং দক্ষতা দেখতে চায়। যাক, এখন আমাকে এক কাপ চা দাও। তার বক বক শুনে আমার মাথার মগজ ফেনা। প্রায় দুইটা ঘণ্টা আমার সাথে বকবক করেছিল।’ বলে বাবা মাথা নেড়ে ঘরে প্রবেশ করেন। বাবাকে চা দিয়ে নন্দনা বাগানে ফিরে যায়। কোথায় নতুন চারা রাখবে তা নিয়ে ধেয়ান চিন্তা করে। মাগরিবের আযান হয়। বাগানের এক কোণে জায়নমাজ বিছিয়ে নমাজ পড়ে এবং বাদ এশা তসবি হাতে ধ্যানমগ্ন হয়। বাগানের দিকে তাকায়। অনেক ফুল ঝরে পড়ছে। তা দেখে ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে ফুলের কাছে যায়। বাম হাতে তুলতে চেয়ে মাথা নাড়ে। তসবি বাম হাতে নিয়ে ডান হাতে গোলাপের পাপড়ি উঠায়। মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে। তসবি গলায় পড়ে এক এক করে সব ফুল কুড়িয়ে কুঁচে লয়। স্বস্তির সাথে বসে ঝরা ফুলে সাধনাসন বানায়। হাঁটু ভাজ করে পাপড়ির উপর বসে। চোখ বুজে বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস টেনে অন্তরাত্মাকে সতেজ এবং সুবাসিত করে। চোখ খুলতে চেয়ে প্রায় চমকে উঠে নড়ছড়ে স্বস্তির সাথে বসে। বুক ভরে শ্বাস টেনে অন্তর্দৃষ্টে পরখ করে কিছু দেখার চেষ্টা করে। দৃষ্টিকোণে অস্পষ্ট পুরুষ অবয়ব। মাথার উপর উড়ন্ত হীরামন। পরিপার্শ্বে পাতাবাহারের সমাহার। পাখি এবং পুরুষের হাবভাবে অকৃত্রিম প্রাণবন্ততা। পুরুষ মাথা নত করে ঠায় বসেছে। যেন নিশ্চল। নন্দনা কিড়িমিড়ি খেয়ে আত্মিকশক্তি প্রয়োগ করতে চায়। মনের কানে শান্ত এবং গম্ভীর পুরুষকণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়, ‘আধ্যাত্মিক বলে সাধিকা হতে হলে আত্মশুদ্ধি করতে হবে। আমি আত্মিক সম্পর্ক পছন্দ করি না। অন্তরে একমাত্র অন্তর্যামী থাকেন। মন মোহাবিষ্ট হলে মর্মপীড়া বাড়ে। মনকে আয়ত্তে রাখতে চাই। মনানন্দে আমি নিরানন্দ হতে চাই না।’
নন্দনা অত্যাশ্চার্য হয়ে চোখ মেলে। ঘনঘন শ্বাস টেনে ডানে বাঁয়ে তাকায়। দু হাত বাজুতে ঘেষে দাঁড়ায় এবং দ্রুত হেঁটে নিচে যায়। রাতের খাবার খেয়ে আইঢাই শুরু করলে মা চিন্তিতকণ্ঠে বললেন, ‘তোর কী হয়েছে, হাবভাবে অস্থিরতা কেন?’
‘আকুলি-বিকুলি করে বললেও আপনার বিশ্বাস হবে না। পরে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লষণ করে বুঝিয়ে বলব। এখন যা বলতে চাই তা হলো, আমি জানি আপনার কাছে ঘুমের ঔষধ আছে। আমাকে কয়েকটা ট্যাবলেট দিতে হবে। ঘুমের ঔষধ না খেলে আজ রাতে আমি ঘুমাতে পারব না। কে যেন আমার সাথে কথা বলেছিল গো আম্মু। এই দেখুন আমার রোমোদ্গম হচ্ছে।’ বলে নন্দনা শিউরে ওঠে। নন্দনার হাবভাবে মা ভয়ত্রস্ত হয়ে বললেন, ‘তুই তোর বাপের কাছে যা। আমারও ভয় হচ্ছে। দুনিয়ার যত বিতিকিচ্ছিরি কিস্সা তোদের মুখ থেকে শুনতে হয়।’
‘কিমাশ্চর্য কাণ্ড হলেও লোকটা কিম্ভূত ছিল না। তবে ভাবগম্ভীর পরিবেশে রোরুদ্যমান শব্দের অনুরণন ছিল। রোমহর্ষক ঘটনা। ও আম্মু গো।’
‘দূরে থাকে, কাছে আসলে দেব গণ্ডা দুয়েক। ওই, কেউ ওকে ওর বাপের কাছে নিয়ে যা। ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হতে শুরু করেছে।’ বলে মা পরিচারিকার দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করেন। হাঁই হুই শুনে বাবা গেলে মা কম্পিতকণ্ঠে বললেন, ‘আপনার মেয়ের মাথায় উপরি ভার ভর করেছে। মুগুর দিয়ে বাড়ি মারলে ভর নামবে।’
‘তোমার মাথা নষ্ট হয়েছে নাকি? নন্দনা, কী হয়েছে রে মা?’ বলে বাবা নন্দনার দিকে তাকালে মা মুখ ভেংচিয়ে বললেন, ‘শান্তি স্বস্তির আশায় জংলার পাশে বাসা বানিয়েছিলেন। হায় রে দূরাশা।’
‘স্বস্তিপাঠে মনে শান্তি আসে এবং সাধনায় সান্ত্বনা মিলে। সমস্যা হলো তোমার হাবভাবে টুনটিনির স্বভাব আছে।’ বলে বাবা বিদ্রুপ হাসলে মা দাঁত কটমট করে নন্দনার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘গড়গড় করে সব তোর বাপকে বল। নইলে মুগুর দিয়ে মাথায় বাড়ি মারব।’
নন্দনা কপট হাসলে বাবা মৃদু হেসে বললেন, ‘আব্বুকে বললে সমস্যার সমাধান হবে নইলে তোমার মা খামোখা বকবক করবে।’
নন্দনা গম্ভীর হয়ে সব বিশ্লষণ করলে বাবা মৃদুহেসে বললেন, ‘চিন্তা বা ভয়ের কারণ নেই। তোমার সাথে যে কথা বলেছিলেন উনি ফুলসাধক। কেউ বলে হাজার বছর, কেউ বলে একশো বছর ধরে উনি ফুল সাধনা করছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো কেউ উনাকে এখনও দেখেনি।’
বাবার কথায় নন্দনা স্বস্তি সান্ত্বনা পায়। ধীরে ধীরে হেঁটে নিজের কামরায় যায়। বিছানায় লম্বা হয়ে হীরামনের দিকে অনিমিখে তাকালে দৃষ্টিভ্রম হয়। হীরামনের উড়াউড়ি দেখে স্বপ্নপুরে চলে যায়। হুবহু ওর বাগান। তবে এই বাগানে মৃন্ময়াল আছে। দোরঙাগোলাপের গাছ দেখে স্তম্ভিত হয়। ফজরের সময় ঘুম ভাঙে। নমাজ পড়ে কোরআন সামনে নিয়ে বসে। মা বাবা উঠলে নাস্তা খেয়ে বাবাকে সব খুলে বলে।
সন্ধ্যার আগে বাঁশ শণ দিয়ে মৃন্ময়ালয় বানানো হয়। মাত্র একটা কোঠা। একখান জায়নমাজ। ছোট্ট টেবিলে ভাজ করা সাদা রেশমের ওড়নার উপর কোরআন রাখা। তসবিমালা নেই। ফজর এবং এশার নমাজ মৃন্ময়ালয়ে পড়ে। ফজরের নমাজ পড়ে কোরআন পাঠ করে। এশার নমাজ পড়ে হাঁটু ভাজ করে বসে এবং এক আঁজলা গোলাপ পাপড়ি বাম পাশে রাখে। ওড়না দিয়ে হাত পা ঢেকে স্বস্তির সাথে শ্বাস টেনে চোখ বুজে অনুচ্চস্বরে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু জিকির করে। লা শব্দ উচ্চরণের সাথে সাথে একটা পাপড়ি বাম থেকে ডানে যায়। শেষ পাপড়ি ডানে যখন যায় তখন চোখ মেলে বুক ভরে শ্বাস টেন স্বস্তির সাথে ছেড়ে সামানে তাকায়। ওড়না না সরিয়ে দু হাত তুলে দোয়া করে। আঠারো বছর বয়সে ফুলসাধনা শুরু করেছিল। দুই বছরে নন্দনার বাগান এবং দেহমনে পরিবর্তন আসে। মনোমতো বাগানের মতো নন্দনাও মনোময় হয়েছে। কোথাও কিছুর কমি নেই। আনায় আনায় ষোলানা। নৈসর্গিক তুলাদণ্ডে বরাবর ওজন। দাঁড়িপাল্লায় কিছু ওজন করার পর বিনিময়ে তা গ্রাহককে দিতে হয়। বিক্রির জন্য নন্দনার কাছে কিছুই নেই তবে এয়জের জন্য যথেষ্ট আছে। ফুলের জন্য তপস্বীরা নন্দনাকাননে আসে। বিশেষ করে ভালোবাসা দিবসে ফুলের জন্য বালক বালিকা আসলে মুগুর হাতে তাড়া করে। বাগানে কত পাখি আসে। পানি খায়। গাছের ডালে বসে গান গায়। কখনোসখনো মুধুচোরও আসে। ভ্রমরীর সাথে আড়ি দিয়ে টুনটুনিকে সই বানিয়েছে। গণ্ডা দুয়েক জড়ো হলে নীরব দুপুরের তূষ্ণীম্ভাব দূর হয়।
এক বিকালে একটা টিয়া বাগানের আশেপাশে উড়া উড়ি করে। তখন ফুলবালক আসে এবং এক তোড়া ফুলের জন্য বায়না ধরে। ‘না! দেব না।’ নন্দনার সাফ জবাব। ফুলবালকাও নাছোড়বান্দা। সিড়িতে বসে হাঁইহুই শুরু করে। নন্দনা ওকে হাজার টাকার নোট দিয়েছে তাতেও সে বেজার। তা দেখে মা কপাল কুঁচ করলেও কিছু না বলে ভিতরে চলে যান। ফুলবালক ছিনেজোঁকের মত নিশপিশ শুরু করলে নন্দনা দাঁত কটমট করে হেঁকে বলল, ‘দারোয়ান, নাই-আঁকড়াকে আকাশ দেখাও।’
দারোয়ান প্রায় দৌড়ে যেয়ে গায়ের ঝাল ঝাড়ার জন্য দাঁত কটমট করে নাদনবাড়ি দিয়ে বাড়ি দিতে চায়। নন্দনা হাত উঠিয়ে ফুলবালকের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দুই হাজার দেই?’
ফুলবালক মাথা নাড়লে নন্দনা মাথা দিয়ে ইশারা করে বাগানে চলে যায়। সময় নষ্ট না করে দারোয়ান ফুলবালকের কান ধরে মোচড় দিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, ‘আজ তোর কানের গোড়ায় দেব কয়েকটা। বেটা বদের হাড্ডি, তোর যন্ত্রণায় রাতেও ঘামাতে পারি। কার পাল্লায় পড়েছিস খুলে না বললে আজ তোকে জেলে চালান করব।’
ফুলবালক হাউমাউ করে বলল, ‘আপনি আমার ধর্মের বাপ, আমারে মাফ করে দাও। জীবনেও আমি আর এই টোলায় আসব না। কালাপানি আমি ডরাই।’
‘চোপ, বেআক্কেলের ভায়রা। আমি এখনও বিয়েই করিনি, আর তুই আমাকে ধর্মের বাপ ডাকছিস। তোকে আমি কালাপানি চালান করব। আজ তোর একদিন কী আমার একদিন।’ বলে দারোয়ান তাকে ফটকের বাইরে নিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল, ‘আরেকদিন আশেপাশে দেখলে তোকে আমি কুমির দিও খাওয়াব। যা ভাগ।’
ফুলবালক মুখ ভেংচিয়ে চলে যায়। এমন সময় এক অদ্ভুতদর্শন যুবকের আবির্ভাব হয়। তার উপস্থিতি নন্দনাকে চিন্তিত করে। যুবক ঠায় দাঁড়িয়ে বাগান দেখে। নন্দনা মাথা নুয়ে আলত করে হেঁটে মুগুর হাতে নিয়ে চিলেকোঠায় যায়। উঁকি দিয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে বারান্দায় গেলে বাবা বেরিয়ে কপাল কুঁচকে বললেন, ‘নন্দনা, মুগুর হাতে এসেছ কেন?’
‘ফুলচোর এসেছে। আজ তার একদিন কী আমার একদিন।’ বলে নন্দনা দাঁত কটমট করে। বাবা মাথা নেড়ে দারোয়ানকে ডেকে বললেন, ‘আজ কড়া নজরদারি কর। বাগান থেকে ফুল চুরি হলে তোর চাকরি শেষ।’
দারোয়ান চিন্তিত হয়। নাদনবাড়ি বগলদাবা করে বুক ফুলিয়ে দাঁড়ায়। নন্দনা স্বস্তির শ্বাস টেনে মুগুর টেনে ছাদে ওঠে। উঁকি দিয়ে চার পাশে দেখে। কেউ বা কিছু দেখতে না পেয়ে বাগানচর্যায় ব্যস্ত হতে চেয়ে চিৎকার করে, ‘আব্বু গো, সর্বনাশ হয়েছে।’
চিঁক শুনে সবাই চিলেকোঠায় এককাট্টা হন। দারোয়ান থরহরি করে কম্পিতকণ্ঠে বলল, ‘ফুলকুমারি, কী হয়েছে?’
বাবা উদ্বেজিতকণ্ঠে বললে, ‘নন্দনা, কী হয়েছে রে মা?’
মা ওকে বাজুতে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করেন। ভয়ে উনি প্রায় পাণ্ডুবর্ণ। নন্দনা ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে বলল, ‘আব্বু, ওই দেখুন নির্দয়ের মত কেউ ফুল ছিঁড়িছে। ধরতে পারলে চোরকে আমি ইচ্ছামতো ঠ্যাঙাব। ইস। আব্বু আমার কলিজায় কষ্ট হচ্ছে। উঁফ। চোর এত নির্দয় নিষ্ঠুর হয় কেন? আমি তার কী ক্ষতি করেছি। আমার ফুল ছিঁড়লো কেন? আব্বু।’
অদ্ভুতদর্শন যুবক তখন ফটকে ঠোকছিল। দারোয়ান দৌড়ে যেয়ে ফটক খুলে নাদনবাড়ি নাচিয়ে বলল, ‘তুমি কী ফুল চুরি করেছ?’
যুবক অবাককণ্ঠে বলল, ‘না তো। আমি ফুল চুরি করি না। নন্দনাকানন দেখার জন্য অন্য শহর থেকে এসেছি। সেই কখন থেকে ঘোরঘুরি করছি, প্রবেশপথ খুঁজে পাচ্ছি না। হাঁইহুই শুনে দৌড়ে এসেছিলাম। কী হয়েছে?’
‘আপনি আমার সাথে আসুন। পাপপুণ্যের বিচার রায় না হওয়া পর্যন্ত আপনাকে যেতে দেব না। আমার সাথে আসুন।’ বলে দারোয়ার যুবকের হাত ধরে টেনে নন্দনার সামনে নিয়ে যায়। যুবককে দেখে বাবা রাগান্বিতকণ্ঠে বললে, ‘ফুল চুরি করেছ কেন?’
যুবক শঙ্কিত হলেও শান্তকণ্ঠে বলল, ‘মহোদয়, আমি ফুল চুরি করিনি। নন্দনাকানন দেখার জন্য অন্য শহর থেকে এসেছি। আমি ফুলচোর নয়।’
নন্দনা দাঁতকটমট করে বলল, ‘তাইলে কে ফুল ছিঁড়েছে? ইস। ঔ দেখো ফুলটাকে ছিঁড়ে ছেঁচড়ে নিয়ে গেছে।’
যুবক চিন্তিত হয়ে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে মাথাসই রেলিং দেখে কপাল কুঁচকে বলল, ‘ফুলচোর ফটক টপকিয়ে আসেনি। বাগানে মাত্র একটা প্রবেশ পথ। এই পথে প্রবেশ করলে কারো না কারো চোখে পড়বে। কেমন আগে ফুল চুরি হয়েছে? আপনি তখন কোথায় ছিলেন?’
‘তোমাকে দেখে আমি মুগুর হাতে নিচে গিয়েছিলাম। বড়জোর দশ মিনিট হবে। এসেই দেখি আমার প্রিয় ফুলটা চুরি হয়েছে। আহ। আমাকে বললে আমি তাকে কয়েকটা দিয়ে দিতাম। আমি তার কী ক্ষতি করেছি? আমার ফুল চুরি করল কেন?’ বলে নন্দনা কাঁদতে শুরু করে। যুবক চিন্তিত হয়ে বিজ্ঞ গোয়েন্দার মত পায়চারি করে। বাবা তাকে নকল করলে দারোয়ানও যোগ দেয়। সবাই চিন্তিত এবং শঙ্কিত। নন্দনাকাননে চোর হানা দিয়েছে। এ কোনো মামুলি বিষয় নয়। দারোয়ান থানায় ফোন করে জিডি করে। দারোগা এসে অপকর্মের ছবি তুলে নিয়ে যায়। খবরের কাগজে তা প্রকাশ হয়। শত শত দর্শনার্থীর ভিড় জমে। ইথারে কানাঘুষা শুরু হয়। এক এক জন এক এক রকম মন্তব্য করে। কিন্তু চোরের হদিশ কেউ দিতে পারে না। ফুলচোরকে দেখার জন্য সবাই হাঁইহুই শুরু করলে শান্ত হওয়ার জন্য নন্দনা সবাইকে অনুরোধ করে।
মাগরিবের নমাজ পড়ে টেবিলে বসে। ল্যাপটপ অন করে দেখে ওর ব্লগে একজন মন্তব্য করেছে, ‘আপনি তো উত্তম বিপদে পড়েছেন।’
‘কষ্টের দহনতাপে আমার মন তাতাচ্ছে আর আপনি উপহাস করছেন। আমি মর্মাহত হলাম।’
‘আপনার জন্য উত্তম খবর হলো, আপনার ফুলসাধনা সার্থক হয়েছে। আমার কষ্টের কথা শুনবেন?’
‘উত্তম খবরের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। মনে শান্তিস্বস্তি পেয়েছি। এখন আপনার কষ্টের কথা বলুন। শুনেছি অন্যের কষ্ট শুনলে নিজের কষ্ট লাঘব হয়।’
‘জি সত্য শুনেছেন। অন্যের কষ্টকথা শুনলে নিজের কষ্ট লাঘব হয়। ছোট কালে আমিও বাগানবিলাসী ছিলাম। এক বসন্তে কান্নাকাটি করে একজনের কাছে থেকে সাদা গোলাপের একটা ডাল এনেছিলাম। পরের বসন্তে দুইটা পাতা দিয়ে মাত্র একটা ফুল ফুটেছিল। সেই ফুল কে যেন চুরি করেছিল। কয়েক দিন পর গাছটাই মরেছিল। সেই থেকে আমি আর ফুলের ধারে পাশে যাই না। আপনার ফুলসাধনার সুবাদে টিয়া আহার পাচ্ছে। এমন সুভাগ্য কয়জনের হয়? আপনার কষ্ট হলে ক্ষতিপুরণ আমি দেব। তবুও দয়া করে টিয়াটা খেদাবেন না। টিয়া চলে গেলে আপনার ফুলসাধনা সাধিত হবে না। মনে রাখবেন, রিযেকের মালিক একমাত্র আল্লাহ। আপনার ফুলের পাপড়ি টিয়ার রিযেক।’
‘আমি এখন কী করব? দয়া করে সদুপদেশ দিলে কৃতার্থ হব।’
‘ফুল ফুটে ঝরে পড়ে। আপনার ফুল ঝরে পড়বে না। আপনার প্রিয় শত্রুর পেট ভরবে। তাকে মনানন্দে খেতে দিন। টিয়া আসা বন্ধ করলে আপনিই কাঁদবেন আর বলবেন, ইস টিয়া কেন আসছে না? ফুলরা তো ঝরে পড়বে।’
‘সত্যি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’
‘কষ্ট হওয়ারই কথা। তবে আগুনে পুড়ে সোনা যেমন খাঁটি হয়, তদ্রুপ দুঃখেরাগুনে পুড়ে মন মন্তা হয়। দুঃখ, আহা দুঃখ, তুমি কেন এতো আপন হও?’
‘দুঃখ এতো আপন হয় কেন আপনি জানেন?’
‘সঠিক উত্তর আমি জানি না। দুঃখকে কেউ আপন করতে চায় না। সবাই সুখ চায়। দুঃখের সাথে যাদের সখিত্ব হয় ওরাই প্রকৃত সুখি। আপনি কি সুখ বরণ করেছেন?’
‘দুঃখ শব্দ আমি খুব পছন্দ করি। তবে দুঃখ কী আমি কখনো অনুভব করিনি। দুখিরা আমার সামনে বসে তাদের দুঃখ বলে কাঁদে। তাদের দুঃখ কষ্টের গল্প শুনে আমার চোখে জল আসে। তখন বুকের বাম পাশে কেমন যেন করে। বিশ্লেষণ করার ভাব-ভাষা আমি জানি না। দুখিরা চলে গেলে যখন আমি একেলা হই তখন নিরালায় বসে কাঁদি। আমার কান্নাবিন্দু ফুলের পাড়িতে পড়ে নীরবতার প্রতিধ্বানি হয়। আমি তখন দুখিদের জন্য দোয়া করি। কে যেন আমাকে কানে কানে বল, সবাই সুখি হলে কে আমাকে আপন করবে? আমি তখন তাকে বলি, অন্তত দুখিকে সুখি হতে দাও। তোমাকে খুশি করার জন্য আমি দুঃখকে বরণ করব। তোমার সব দুঃখ আমাকে দাও। আমি দুঃখ প্রকাশ করব না। দুঃখের নবরঙে আমি আমার বাগান সাজাব। আমার কষ্টে সাদা গোলাপ কালো হবে। সেই গোলাপ দিয়ে আমি মনানন্দে বরণ মালা গাঁথব।’
‘কবিতা। আহ কবিতা। কবিতা তুমি কেন কষ্টকে আকৃষ্ট করো? তুমি কি জানো, তোমার কারণ কবিরা কষ্ট বরণ করে আর বলে, আমার কোনো কষ্ট নেই?’
‘জানেন, চিন্তার খোরাক এবং অনুপ্রেরণার জন্য আমি আপনার ব্লগে আসি। আপনার সাথে মন্তব্যবিনিময় করলে কল্পনায় শক্তিসঞ্চারণ হয়।’
‘তা তো আমি জানি না।’
‘আপনার সাথে মন্তব্য বিনিময় হলে বিমনা মন চনচনে হয়। ফুলের সাবাসে সুবাসিত হতে চায়। নন্দনাকাননের দিশাপাশা আমি জানি না। তবে কোনোএক দিন আমি আসব।’
‘অদ্য নয় কেন?’
‘অদ্য আমি কষ্টে ক্লিষ্ট।’
‘কেন, কী হয়েছে আপনার?’
‘মর্মাহত আমি ধীরে ধীরে বাতাসে ভাসা পালক হতে চাই। হারাতে চাই স্মৃতির ভিড়ে, খুঁজতে হবে গন্তব্য। মনকে স্বাধিনতা দিতে চাই। অনেক দিন হয়েছে তাকে আমি কড়া শাসনে রেখেছি। এখন সে আনন্দসাগরে ভাসতে চায়।’
‘আপনি কি জানেন আপনার মনের কাঠগড়ায় মানবী দণ্ডায়মান? আপনি কি কখনও আমার মনের খবর জানতে চেয়েছেন? আপনি তো ছদ্মনামে আমার সাথে মন্তব্য বিনিময় করেন। আমি কি কখনও আপনার পরিচয় জানেত চেয়েছি? আমার মনের অনুভূতি কখনও জানতেও চাননি। আমি কতদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করেছি। আপনি নীরব থেকেছেন। কিন্তু কেন? আমি জানি আমি রূপের ধুচুনি। তবে অপয়া নয়। দুখিরা যখন আমার সাথে কথা বলে তখন ওরা নাকি মনে সান্ত্বনা পায়। কষ্ট যখন সক্রিয় হয় তখন মোমের আলো নীল হয়। আমি অনেক দিন দেখেছি।’
‘হে মানসী, আমি তোমার মনে বসে থাকি। তোমার ভাবনায়। তোমার কল্পনায়। দিনমান তোমার সাথে মনে মনে কথা বলি। এই তো, আমি তোমার সাথেই কথা বলছি। তোমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমি ভোরে উঠে তোমার কবিতা পড়ি। ফুলের ছবি দেখি। মনে রেখো, মনের ভিতর সাত আশমান এবং সাত জমনি লুক্কায়িত। মনের কারণেই আমরা স্বর্গ অথবা নরকে যাব। আমার জন্য দোয়া করবে।’
‘জানি পাপপুণ্যের বিচার হবে। তবুও আমি তোমাকে স্পর্শ করব। তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি কষ্টের নীল রং দেখতে চাই। তুমি কবে আসবে? তোমার অপেক্ষায় আমি অপেক্ষমাণ।’
‘আমি জানি নন্দনতত্ত্বে তুমি পারদর্শি হয়েছ। তোমার জন্য আমি অমঙ্গলজনক। আমার উপস্থিতি তোমার সর্বনাশ করবে, তোমার সাধনা পণ্ড হবে। আমি যদিও ফুল ভালোবাসি কিন্তু ফুলের রেনু আমার নিশ্বাসে মিশলে আমি অসুস্থ হই। আমার খুব কষ্ট হয়। আমি তোমাকে ফুলপরি ডাকি। কেন ডাকি জানো?’
‘না বললে জানবো কেমনে?’
‘আমি জানি তুমি এখন কাঁদছ। কেঁদে নদী বানালেও বাতাস থেকে ফুলের রেনু আলাদা করতে পারবে না। ফুলপরিরা ফুলের রেনু গায়ে মাখে। এই জন্য আমি তোমাকে ফুলপরি ডাকি। আমি কখনো ফুলপরি দেখিনি। তোমাকে একনজর দেখতে চেয়েছিলাম।’
‘হ্যাঁ, ফুলপরিরা ফুলের রেনু গায়ে মাখে। আমিও ফুরের রেনু গায়ে মাখি। তুমি আসার আগে ফুলকলিকে কানে কানে বলব, অনিমিখে তোমাকে দেখার জন্য। তুমি যখন আমাকে দেখবে, আমি চোখ বুজে আরশিকোঠায় ঠায় দাঁড়াব। তুমি চলে গেলে কলিকে কানড়ে গুঁজে আমি তোমার গুণগান শুনব। তুমি কবে আসবে?’
‘মনে আজ অসুস্থ হওয়ার সাধ জেগেছে। তোমাকে দেখার জন্য আমি নীরব নিশায় আসব।’
‘আজ আমি আরশিকোঠায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকব।’
‘অপেক্ষার প্রহর অনন্ত হয়। তা আমি জানি। অপেক্ষা মৃত্যু কামনা করায় তাও আমি জানি। আমার জন্য দোয়া করবে। দোয়া খুবই শক্তিশালী যাচনা। আল্লাহে বিশ্বাসীর দোয়া দোজখের আগুন নিবাতে পারে। দয়া করে আমাকে অভিশাপ দিয় না। আমি এক অসহায়।’
‘আমি তোমার নাম জানতে চাই। আত্মা তৃপ্ত হবে। যমের জাঙ্গালে আমি বন্দিনী হতে চাই না।’
‘অনিল আমার প্রিয় নাম ধরে ডাকলে আমি খুশি হব।’
‘নন্দিত এবং প্রাণবন্ত হলাম আমি নীরব নিশায় পরিতৃপ্ত হব। দোয়া করি ইহ এবং পরকালের সকল প্রকার অভীষ্টপূরণ হোক।’ বলে নন্দনা ল্যাপটপ অফ করে বাগানে যেয়ে হাঁটা হাঁটি করে। এশার আযান হয়। নামজান্তে নিত্যকৃত্যে বসলেও শমদমে সমস্যা হয়। যিকিরের সাথে ফুল উঠে বাম থেকে ডানে যায় না। মাঝপথে পড়ে। বারবার মাথা নাড়ে এবং ঘনঘন নিশ্বাস টানে। আত্মার উপর যে অত্যধিক ছাপ প্রয়োগ করছে তা ওর চেহারায় স্পষ্ট।
‘ফুলপরি, প্রশান্ত হওয়ার চেষ্টা করো। আমার সম্বন্ধে ভাবলে আধ্যাত্মিক সাধনায় সমস্যা হবে। অনন্যা তুমি কাম্য। তোমাকে পাওয়ার জন্য আমার মত শতাধিক পুরুষ জানবাজি ধরবে। আমি উভে যাব না। নীরব নিশায় আসবই আসব। মৃত্যু আমাকে নিথর করলেও আমার অতৃপ্ত আত্মা তোমার সামনে দণ্ডয়মান হবে। আমি তোমাকে কথা দিয়েছি। অসময়ে অধ্যবসায় অনর্থক। অপূর্ণ সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয় না। প্রশান্ত হয়ে ফুলসাধনা করো। সাধ্যসাধনায় তুমি সর্বার্থসাধিকা হবে।’
‘অনিল, আমি তোমাকে স্পর্শ করতে চাই।’
‘সাধনা শেষ করো। বাতাস বদ্ধ হলে শ্বাস রুদ্ধ হয়। তুমি আমার মাঝে আছ। আমি বাতাস। তোমার নিশ্বাসে মিশে আমি তোমার বিশ্বাস অনুভব করেছি। বাতাসে অনেক শক্তি আছে। বাতাসে মিশে আমি পরিবেশে ভাসতে পারি। সর্বশক্তিমান আল্লাহ আমাকে এই সাধ্য দিয়েছেন। দুশ্চিন্তা না করে স্বস্তির সাথে ফুলসাধনা করো।’
কথা না বলে নন্দনা সাধনায় তন্ময় হয়। রাত দ্বিপ্রহর। বাগানের ঠিক মাঝখানে অদৃষ্ট কিছু অবতরণ করে। সতর্কতা এবং সন্তর্পণে আরশিকোঠার দিকে অগ্রসর হলে অপ্রতীয়মানের উপস্থিতি উপলব্ধ করে নন্দনা রোমাঞ্চিতা হয়ে বলল, ‘দৃষ্টাদৃষ্ট কেন? দৃষ্টিগোচরে আসো। দৃষ্ট আমি তোমাকে স্পষ্ট ভাবে দেখতে চাই।’
শান্ত পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘অপেক্ষার সীমানায় সুখের গন্তব্য হয়ে আমি একাকি আছি দাঁড়িয়ে, বধূ তুমি আস, বধূ তুমি আস আশাবাদী হয়ে, আমি তোমাকে নিরাশ করব না, তোমাকে বরণ করার জন্য আমি ছিলাম, আমি আছি; সদা থাকব দণ্ডায়মান। দীপ্তিমান তোমার মুখাবয় কভু না ভুলতে পারব, তোমার স্মৃতি সদা মনের আকাশে থাকবে দীয়মান, মনের চোখে দেখি তোমাকে, চোখের কোণে কান্নাবিন্দু দোলায়মান। সাঁজের আকাশে দিনমণি লুকিয়েছিল, কণ্ঠলগ্ন হয়ে আমি তোমার উপমা করেছিলাম, চাঁদিনির আলোর সাথে করেছিলাম তোমার রূপের উপমান। নির্জনে একা বসলে শূন্যতায় হয় তোমার নামের উদীরণ, তোমার মুখের সুমধুর বুলি সদা কর্ণকুহরে হয় শব্দায়মান, নিশি রাতে তনুমিলনের আশা জাগে মনে উদ্দীপন, বধূ তুমি আস, নিসর্গে আজ আমাদের মিলন মন্ত্র উদীর্যমাণ। বধূ একাকি আছি দাঁড়িয়ে, তোমার অপেক্ষায় অপেক্ষামাণ।’
নন্দনা অগ্রসর হয়ে স্বপ্নপুরুষকে দেখে স্তম্ভিত হয়।


অসমাপ্ত

একসাথে পোস্ট করার কারণ আমি আর ব্লগে সময় দিতে পারব না কাজে ব্যস্ত থাকব।

এই গল্পটা শুরু করেছিলাম প্রথম আলো ব্লগে
ব্লগার কামরুন নাহার বীথি আপার ফুলের বাগানে টিয়া পাখি দেখে

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৩

মোস্তফা সোহেল বলেছেন: ভাইয়া পরে পড়ব এখন একটু কাজে যাচ্ছি।

১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৫

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক বলেছেন: ঠিকাছে ভাই, ধন্যবাদ।

২| ১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৪

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: বভ্রু ভ্রমরী অর্থ কি ?
ভালই লাগিলো।

১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৫

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক বলেছেন: বভ্রু [ babhru ] বি. 1 পিঙ্গলবর্ণ, হলদেটে নীল; কটা রং ('তরুণীর বভ্রু কেশে সঞ্চারিল শিহরণ': সু.দ.); 2 অগ্নি। [সং. ভৃ + উ (নি.)]।

ভ্রমর [ bhramara ] বি. (কাব্যে.) ভ্রমরা বি. 1 ভোমরা; 2 মৌমাছি। [সং ভ্রম্ + অর]। স্ত্রী. ভ্রমরী। ভ্রমর-কৃষ্ণ বিণ ভ্রমণের মতো গাঢ় ও উজ্জ্বল কালো রঙ্গের (ভ্রমরকৃষ্ণ শাড়ি)।


পড়ে মন্তব্য করার জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

৩| ১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫৯

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক বলেছেন:

৪| ১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:০৮

মোঃ মাইদুল সরকার বলেছেন: বুঝিয়ে বলার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।

১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:১০

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক বলেছেন: আপনি জানতে চেয়েছেন, আপনাকে যথেষ্ট তথ্য দেওয়া আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য।

আপনার মঙ্গল কামনা করি।

৫| ১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:১৯

শাহাদাৎ হোসাইন (সত্যের ছায়া) বলেছেন: অফিসে আছি। অর্ধেক পড়লাম। বাকীটা বাসায় গিয়ে পড়ব। আপনি গৎবাঁধা নিয়মে যে গল্প আছে তার বাহিরে যেতে চেয়েছেন।

১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১১:১২

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক বলেছেন: ধন্যবাদ। আপনার মন্তব্যে সত্যি আনন্দিত হয়েছি।

৬| ১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৯:২০

গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: সুন্দর লিখেছেন। কিছু কঠিন শব্দের যুতসই প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।

১১ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১১:১৩

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক বলেছেন: ধন্যবাদ লিটন ভাই।

৭| ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১০:০৮

কামরুন নাহার বীথি বলেছেন:
আমার বাগানের ফুলচোর টিয়াপাখি দেখে যে গল্প আপনি শুরু করেছিলেন, আজও তা অসমাপ্তইই রেখে গেলেন।
এই গল্পের বিশ্লেষণ আমার মত পাঠকের দ্বারা কখনওই সম্ভব নয়!
তবু অনুভূতিতে নাড়া দিয়ে গেছে!!

লিখতে থাকুন, আবারও দেখা হবে!!
(এই ফুলচোরককে নিয়ে একটা ছোট গল্পও লিখবেন! :) )

৮| ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১০:১১

কামরুন নাহার বীথি বলেছেন:
এই ব্লগেও ফুলচোর এসেছিল!! পড়ে দেখতে পারেন!

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪০

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক বলেছেন: এই চোরকে নিয়েই গল্প শুরু করেছিলাম।

৯| ২২ শে অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৯

সত্যপথিক শাইয়্যান বলেছেন: আবার কবে ব্লগে আসবেন, সিলেটি ভাই?

২৫ শে অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪০

মোহাম্মাদ আব্দুলহাক বলেছেন: এইতো এসেছি, দেশিভাই!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.