নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস পাওয়া যায় তাঁর কবিতা থেকে। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। উচ্চতর মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯৪৭ সালের ১৫ মে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর মুত্যুদিনে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
মানবতার জয়ের জন্য লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী কবি সুকান্ত ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতার ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের মাতামহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এই ক্ষণজন্মা কবি। তাঁর পিতা-নিবারন ভট্টাচার্য এবং মা-সুনীতি দেবী। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। কবির জন্মের পূবেই তার পূর্ব পূরুষেরা এ দেশ থেকে ভারতে চলে যায়। সুকান্তের বাড়িতে সাহিত্যের খুব ভাল পরিবেশ ছিল। মনীন্দ্রলাল বসুর ‘রমলা’উপন্যাসের নায়ক সুকান্তের নামেই আদরের ভাইটির নাম রেখেছিলেন জ্যাঠতুতু দিদি রানি। রানিদিদির উৎসাহেই লেখালেখিতে সুকান্তের হাতে খড়ি। মনীন্দ্র বসুর উপন্যাসের সুকান্তকেও অকালেই যক্ষা রোগে চলে যেতে হয়েছিল। কবি সুকান্তেরও সেই একই গতি হবে রানিদি নিশ্চয়ই স্বপ্নেও ভাবেন নি। এই সংযোগ দেখতে পাবার বহু আগেই সেই রানিদির হঠাৎ মৃত্যু হয়েছিল। সুকান্তের বয়স তখন মাত্র সাত বা আট। তার পরেই সুকান্তের বাবা জ্যাঠাদের পরিবার আলাদা হয়ে যায়। সুকান্তের বাল্যবন্ধু ছিলেন কবি অরুনাচল বসু। সুকান্ত সমগ্রতে লেখা সুকান্তের চিঠিগুলির বেশিরভাগই অরুনাচল বসুকে লেখা। অরুনাচল বসুর মাতা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রস্নেহে দেখতেন। সুকান্তের ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাকে সেই অভাব কিছুটা পুরন করে দিতেন। কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়ীতে। সেই বাড়িটি এখনো অক্ষত আছে। পাশের বাড়ীটিতে এখনো বসবাস করেন সুকান্তের একমাত্র জীবিত ভাই বিভাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুকান্তের নিজের ভাতুষ্পুত্র।
স্কুলের ছাত্র হিসেবে ভালো মার্ক্স পাওয়া মেধাবী ছাত্র হবার নজির ছিলোনা সুকান্তের। অর্থাৎ সাধারণ মানের ছাত্র ছিলেন তিনি। তাই লেখাপড়ায় খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না। তদূপরী ভারত জুড়ে ভারতীয়দে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণে লেখাপড়া বাধা গ্রস্থ হচ্ছিলো তার। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। তবে ভারত ছাড়ো আন্দোলন ঝিমিয়ে গেলে আবার স্কুলে যেতে হচ্ছে বলে তিনি বেশ হতাশই হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর প্রতিভা যে ছিল প্রশ্নাতীত তা এই সব সম্মান আর স্বীকৃতিতেই প্রমাণ মেলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই বছর আকাল নামক একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।
১৯৪১ সালে সুকান্ত কলকাতা রেডিওর গল্পদাদুর আসরের যোগদান করেন। সেখানে প্রথমে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। গল্পদাদুর আসরের জন্য সেই বয়সেই তাঁর লেখা গান মনোনীত হয়েছিল আর তাঁর সেই গান সুর দিয়ে গেয়েছিলেন সেকালের অন্যতম সেরা গায়ক পঙ্কজ মল্লিক।
ক্ষনজন্মা এই কবির রচনার সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু যদি তাঁর বয়সটির কথা মনে রাখি, তবে সেই সংখ্যা অবিশ্বাস্য। সুকান্তকে আমরা কবি হিসেবেই জানি। কিশোর কবি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন কেবল মাত্র কবি ছিলেন না, সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তাঁর ছিলো অবাধ বিচরণ। তেমনি সুকান্তও ঐ বয়সেই লিখেছিলেন কবিতা ছাড়াও, গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ। তাঁর ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধটি পাঠেই বেশ বোঝা যায় ঐ বয়সেই তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিকটিই শুধু আয়ত্বে আনেন নি, সে নিয়ে ভালো তাত্বিক দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন। অথচ ১৯৪৫এ প্রবেশিকা পরীক্ষাতে তিনি অকৃতকার্য হয়েছেন। সেই আট ন’ বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তাঁর লেখা বিবেকান্দের জীবনী। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন। এটি পরে তাঁর ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন যখন তখন বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তাঁর আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন।
সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার (১৯৪৫) ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো: ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
সুকান্ত তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন। বালক বয়সে তিনি ভাবনার বৈতরণীতে অনেক বেশি অগ্রসর হয়েছিলেন। সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অসুস্থতা অর্থাভাব তাকে কখনো দমিয়ে দেয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য সুকান্ত নিরন্তর নিবেদিত থেকেছেন। তিনি মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন।
সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার কবিতায়। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। সুকান্ত তার বয়সিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তার পরিণত ভাবনায়। ভাবনাগত দিকে সুকান্ত তার বয়স থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন।
একাধারে বিপ্লবী ও স্বাধীনতার আপোসহীন সংগ্রামী কবি সুকান্ত ছিলেন কমুনিষ্ট পার্টির সারাক্ষণের কর্মী। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করলেন তাতে তাঁর শরীরে প্রথম ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলিকাতার ১১৯ লাউডট ট্রিষ্ট্রের রেড এড কিওর হোমে মৃত্যুবরণ করেন।
আজ ক্ষনজন্মা তরুন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য়ের ৬৫তম মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের সাথে তাঁর বিখ্যাত কবিতা ছাড়পত্র সংযুক্ত করলাম আপনাদের জন্য।
ছাড়পত্র
---সুকান্ত ভট্টাচার্য
যে শিশু ভূমিষ্ঠ হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুমঃ
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বোঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা।
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ঠ শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অবশেষে সব কাজ সেরে
আমার দেহের রক্তে নতুন শিশুকে
করে যাব আশীর্বাদ,
তারপর হব ইতিহাস।
২| ১৩ ই মে, ২০১৩ সকাল ১১:২২
সোহানী বলেছেন: অসাধারন লেখক তিনি, যেভাবে আত্বাকে কাপিয়ে দেয় তার লিখা তা যে না পডবে সে অনুভব করতে পারবে না। ধন্যবাদ স্বরণ করিয়ে দেবার জন্য।+++
৩| ১৩ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৪:৫৭
অমৃত সুধা বলেছেন: গার্ডিয়ানকে ইউনূস:
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর আহ্বান
http://dhakajournal.com/?p=7388
৪| ১৩ ই মে, ২০১৩ বিকাল ৫:০৬
সোহাগ সকাল বলেছেন: কবির প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
৫| ১৩ ই মে, ২০১৩ রাত ১০:৩৯
তৌিহদ মাহমুদ বলেছেন: এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
অসাধারণ। ভালো লাগল ।
©somewhere in net ltd.
১| ১৩ ই মে, ২০১৩ সকাল ১০:২১
মৃন্ময় বলেছেন: তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
এই ভাবনার কেউ কি আর অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয়?
স্যালুট..........