নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলা গদ্যসাহিত্যের চর্চা শুরু হয়েছে প্রায় দুশো বছর আগে, যদিও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, বাংলা গদ্যসাহিত্যের যিনি পথপ্রদর্শক বা পথিকৃৎ, তিনি বাঙালি ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন ইংরেজ মিশনারি। তাঁর নাম উইলিয়াম কেরি। তিনিই হয়ে গেলেন বাংলা ভাষায় গদ্য চর্চার পথিকৃৎ। মিশনারি স্যার উইলিয়াম কেরি ছিলেন বহু ভাষাবিদ, তাত্ত্বিক ও বাংলা গদ্যপাঠ্য পুস্তক প্রণেতা। খ্রিস্টধর্ম প্রচারক এবং বাংলা মুদ্রণশিল্প ও বাংলা গদ্য বিকাশের ইতিহাসে স্মরণীয় পুরুষ উইলিয়াম কেরি। ১৮৩৪ সালের ৯ জুন ৭৩ বছর বয়সে কলকাতার শ্রীরামপুরে উইলিয়াম কেরি পরলোকগমন করেন। আজ এই বাংলা প্রেমিক মানুষটির মৃত্যুদিন। তাঁর মৃত্যুদিনে আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
(শিল্পীর তুলিতে আকাঁ উইলিয়াম কেরির বসত বাড়ি)
উইলিয়াম কেরি ১৭৬১ সালের ১৭ আগস্ট ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটনশায়ারের এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি জুতা তৈরি ও মেরামতের কাজ করতেন। তবে শৈশব থেকেই ধর্ম ও জ্ঞানচর্চার প্রতি তার আগ্রহ ছিল প্রবল। টমাস জোন্সের কাছে তিনি গ্রিক ও লাতিন ভাষা শিক্ষা এবং বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানলাভ করেন। ১৭৮৬ সালে উইলিয়াম কেরি মোল্টন গ্রামে শিক্ষকতা শুরু করেন। ১৭৯২ সালে তার নেতৃত্বে খ্রিস্টানদের মধ্যে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করার উদ্দেশ্যে কেটারিং শহরে একটি সমিতি গঠিত হয়। এ সময় খ্রিস্টধর্ম প্রচারের পন্থা সম্পর্কে ইংরেজি ভাষায় তিনি একটি বই লেখেন। ১৭৯৩ সালে ব্যাপ্টিস্ট মিশন থেকে তাকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য ভারতে পাঠানো হয়। কেরি, তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র ফিলিক্স, স্ত্রী ও কন্যাসহ একটি ইংরেজ জাহাজে চেপে ১৭৯৩ সালের ১১ নভেম্বর সপরিবারে কলকাতায় এসে নামেন। কলকাতায় পৌঁছে তাঁবু প্রস্তুত ও মেরামতির কাজ করে তাঁদের জীবনধারণ ও মিশন স্থাপনের জায়গা প্রস্তুত করতে হয়। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে সংযোগস্থাপনের জন্য তাঁরা বাংলা ভাষা শিখতেও শুরু করেন। তারপর বাংলা ভাষা শেখা এবং এদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে জানার জন্য বিখ্যাত বাঙালি পন্ডিত রাম বসুকে প্রাইভেট সেক্রেটারী নিয়োগ করেন এবং তার সহায়তায় বাংলায় ‘বাইবেল’ অনুবাদ করেন। তখন থেকেই তিনি বাংলা ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৭৯৪ সালে তিনি বাংলা ভাষায় একটি শব্দকোষ ও একটি ব্যাকরণ রচনা করেন। এবছর অর্থাৎ ১৭৯৪ সালে কেরি মালদহের মদনবাটি নীলকুঠির তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। স্থানীয় কৃষক-প্রজাদের শিক্ষার সুবিধার্থে এখানে তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৭৯৭ সালে বই ছাপানোর উদ্দেশ্যে দেশি হরফ তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে তার সঙ্গে চার্লস উইলকিন্সের শিষ্য পঞ্চানন কর্মকারের পরিচয় হয়। এ সময় পঞ্চানন কর্মকারও এ মিশনের ছাপাখানায় যোগ দেন। কেরি ও পঞ্চাননের যৌথ প্রচেষ্টায় ‘মিশন সমাচার’ নামে বই ছাপার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষায় প্রথম মুদ্রণকাজের সূচনা হয়। পরে শ্রীরামপুর থেকে কেরির নেতৃত্বে প্রায় ৪০টি ভাষা ও উপভাষায় খ্রিস্টধর্মীয় গ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
এরপর নীলকুঠি বন্ধ হয়ে গেলে কেরি কিছুকাল খিদিরপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস করে ১৭৯৯ সালের শেষদিকে জোশুয়া মার্শম্যান, উইলিয়াম ওয়ার্ড, গ্রান্ট প্রমুখ মিশনারির সঙ্গে শ্রীরামপুরে যোগ দেন এবং ১৮০০ সালের জানুয়ারিতে শ্রীরামপুর মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮০০ সালের আগস্ট মাসে তিনি মথি লিখিত ‘মিশন সমাচার’ শ্রীরামপুর প্রেস থেকে মুদ্রিত করেন ও প্রকাশ করেন। এটাই প্রথম গদ্যপুস্তক। ১৮০১ সালের ৪ মে কলকাতায় সদ্য প্রতিষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা ভাষার অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। এখানে ভাষা শিক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি ভারতীয় ভাষাগুলো, বিশেষ করে বাংলা ভাষার সর্বাঙ্গীণ উন্নতিসাধনে আত্মনিয়োগ করেন। সুশৃঙ্খলভাবে ভাষা শিক্ষাদানের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব পূরণের উদ্দেশ্যে তিনি পাঠ্যপুস্তক, ব্যাকরণ এবং অভিধান রচনা করেন। তার অধীন পণ্ডিতদেরও তিনি এই কাজে উৎসাহিত করতে থাকেন। ১৮০৬ সালে কেরি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য হন। ১৮০৭ সালে আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ‘ডক্টর অফ ডিভিনিটি’ উপাধিতে ভূষিত করে।
কেরির রচিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো গ্রামার অফ দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ (১৮০১ সালে ইংরেজি ভাষায় রচিত), ডায়ালোগস (বাংলা-ইংরেজি দ্বিভাষিক গ্রন্থ, ১৮০১), ইতিহাসমালা (গল্পসংগ্রহ, ১৮১২), বাংলা-ইংরেজি অভিধান (১৮১৫-২৫), চার খণ্ডে ওল্ড টেস্টামেন্ট বা ধর্মপুস্তক (১৮০২-০৯, হিব্রু থেকে অনূদিত)। এছাড়া তিনি মারাঠি ব্যাকরণ ও অভিধান এবং পাঞ্জাবি ব্যাকরণ, তেলিঙ্গা ব্যাকরণ, কানাড়ি ব্যাকরণ প্রকাশ করেন। তিনি ওড়িয়া, পাঞ্জাবি, সংস্কৃত ও অসমিয়া ভাষায়ও বাইবেল অনুবাদ করেন। জোশুয়া মার্শম্যানের সঙ্গে মিলে তিনি মূল বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যাকা- পর্যন্ত ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে তিন খণ্ডে প্রকাশ করেন। ‘এ ইউনিভার্সাল ডিকশনারি অফ দি ওরিয়েন্টাল ল্যাঙ্গুয়েজেস’ নামের সংস্কৃতসহ ১৩টি ভারতীয় ভাষায় এক সমন্বিত শব্দকোষ কেরির অসামান্য পাণ্ডিত্যের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু এই শব্দকোষের পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ অগ্নিকাণ্ডে বিনষ্ট হওয়ায় এর মুদ্রণ সম্পন্ন হতে পারেনি। উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষায় 'কথোপকথন' (১৮০১) ও 'ইতিহাসমালা' (১৮১২) গ্রন্থ রচনা করেন। ওই সময় তার উদ্যোগে ৪০টি ভাষায় খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থ প্রকাশ হয়। তিনি বাংলা হরফের সংস্কার, অন্যান্য ভারতীয় ভাষার হরফ তৈরি করেন। রচনা করেন বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা-ইংরেজি অভিধান। তার উদ্যোগে ১৮১৮ সালে ‘ফ্রেন্ড অফ ইন্ডিয়া’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। পুস্তক রচনা, অনুবাদ ও প্রকাশের পাশাপাশি বাংলা হরফের সংস্কার এবং অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় হরফ তৈরির কাজেও তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন।
উইলিয়াম কেরি ১৮২২ সালে বিখ্যাত লিনিয়ান সোসাইটির এবং ১৮২৩ সালে লন্ডন জিওলজিক্যাল সোসাইটি ও রয়াল এগ্রিকালচারাল সোসাইটির সদস্য হন। ১৮২৩ সালে ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম এগ্রি-হর্টিকালচারাল সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮২৪ সালে কেরি তৎকালীন বৃটিশ সরকারের বাংলা অনুবাদক নিযুক্ত হন। ১৮৩১ সাল পর্যন্ত ৩০ বছর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা জীবনে তিনি বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, অভিধান, পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও ভারতীয় আরো অনেক ভাষায় বাইবেল অনুবাদ এবং ব্যাকরণ ও অভিধান সংকলন করে প্রকাশ করেছিলেন। ১৮৩১ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে তিনি পরবর্তী এক বছর শ্রীরামপুর কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।
উইলিয়াম কেরি ভারতবর্ষের জ্ঞান বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৮৩৪ সালের ৯ জুন শ্রীরামপুরে তার জীবনাবসান ঘটে। একদা পাদুকা নির্মাতা উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিকাশে যে অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আধুনিক মিশনসমূহের জনক ("father of modern missions") বাংলা গদ্যসাহিত্যের পথপ্রদর্শক, বাংলা প্রেমিক উইলিয়াম কেরির মৃত্যুদিনে গভীর শ্রদ্ধা
২| ০৯ ই জুন, ২০১৩ সকাল ১১:০৪
সানাউল্লাহ তুষার বলেছেন: বই পুস্তকে অনেক পড়েছি, কখনও তার নাম পরিচয় কাজের সন্ধান করি নাই...
বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যে তার প্রতি শ্রদ্ধা।
লেখা ভাল লাগল
৩| ০৯ ই জুন, ২০১৩ সকাল ১১:৩৬
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: ভালো লাগলো ভাইয়া। বাংলা চর্চার পথিকৃত হিসাবে তিনি বরাবরই আমাদের শ্রদ্ধাভাজন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অবশ্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ড. আনিসুজ্জামান অবশ্য তাঁর গবেষণালব্ধ ''প্রাচীন বাংলা গদ্য'' নামক বইতে দেখিয়েছেন বাংলা গদ্য চর্চা কেরির আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তবে কেরির ভূমিকা বাংলা গদ্যের ইতিহাসে চিরকাল সম্মানের সাথেই উচ্চারিত হবে।
৪| ০৯ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৩:৫৩
আলাপচারী বলেছেন: আপনার বিষয় ভিত্তিক লেখাকে স্বাগতম।
৫| ০৯ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:৪২
ডি মুন বলেছেন: প্রিয়তে নিলাম +++++++
৬| ০৯ ই জুন, ২০১৩ রাত ৮:৪২
ডি মুন বলেছেন: প্রিয়তে নিলাম +++++++
৭| ১০ ই জুন, ২০১৩ রাত ১২:৩৫
কাউসার রুশো বলেছেন: বিনম্র শ্রদ্ধা
প্রিয়তে নিলাম +++++++
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই জুন, ২০১৩ সকাল ১০:৫৫
ঢাকাবাসী বলেছেন: তাঁর প্রতি আমাদেরও শ্রদ্ধা রইলো। লেখাটি ভাল লেগেছে।