নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গাজীউল হক একজন ভাষাসৈনিক। তবে গাজীউল হক শুধু ভাষাসৈনিকই ছিলেন না। তিনি ছিলেন দেশের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সামনের কাতারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বড় তিনটি ঘটনা ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এ তিনটিতেই গাজীউল হকের অবদান রয়েছে। তিনি ভাষা আন্দোলনসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী মোতাহার হোসেনসহ বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে এসে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনে অংশ নেন। তিনি সব সময খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলেছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পাশেও দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে মিছিল করেন। এজন্য তাঁকে সরকারের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করতে হয়েছে কয়েকবার। আজন্ম দ্রোহী গাজীউল হক ফেনীর ছাগলনাইয়া হাইস্কুলের শিক্ষক সুরেন্দ্রনাথের কাছে বিপস্নবী দীক্ষা পয়েছিলেন। এর স্ফূরণ ঘটে ১৯৪২ সালের ২৩ মার্চ ১৫ বছর বয়সে। ইউনিয়ন জ্যাক পতাকার প্রতি ‘অসম্মান’ প্রদর্শনের অভিযোগে এদিন তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। এরপর ১৯৫৩, ১৯৫৪ (দুই বার করে), ১৯৫৬, ১৯৫৮, ১৯৬৪, ১৯৬৯ ও ১৯৭৫ সালে গ্রেফতার হয়ে কারাবাস করেছেন। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের কারণে ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে হুলিয়া মাথায় নিয়ে গোপনে আন্দোলন করেছেন তিনি। ভাষা সৈনিক গাজীউল হক ২০০৯ সালের ১৭ জুন মৃত্যুবরন করেন। তাঁর চতুর্থতম মৃত্যুদিনে আজ তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
গাজীউল হক ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মওলানা সিরাজুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি পীর সাহেব হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। মা নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিনী। তাঁর দাদা মওলানা আবদুল বারী এবং নানা মওলানা সাকরুদ্দীন পীরসাহেব ছিলেন। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে গাজীউল হক ছিলেন তৃতীয়।
গাজীউল হকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যখন শুরু হয় তখন তিনি থাকতেন নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে। বাড়ির সামনে একটি মক্তবে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয়। এই মক্তব পরীক্ষায় তিনি দু'টাকার বৃত্তি পান। এই স্কুল থেকে তিনি উচ্চ প্রাইমারি বৃত্তি লাভ করেন। এখান থেকে ১৯৪১ সালে গাজীউল হক বগুড়া জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরই ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উদযাপন করার জন্য ছাগলনাইয়ায় মিছিল বের হয়। গাজীউল হক এই মিছিলে অংশ নেয়। মিছিল ছাগলনাইয়া থানা কার্যালয়ের সামনে থেকে বৃটিশ পতাকা ইউনিয়ন জেক নামিয়ে সেখানে পাকিস্তানি তিনকোণা পতাকা উড়িয়ে দেন। এই অপরাধে পুলিশ তাঁদের ধরে নিয়ে হাজতে চালান দেয়। মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁদের কয়েক ঘন্টার মধ্যে হাজত থেকে মুক্ত করে আনেন। এই স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি ইতিহাস শিক্ষক সুরেন স্যারের সান্নিধ্যে আসেন এবং বৃটিশ বিরোধী মনোভাব তার ভেতরে দানা বাঁধে। এতেই থেমে রইলেন না তিনি। সে সময়ে কয়েকজন ছাত্র মিলে 'বিদ্রোহী' নামে একটি হাতে লেখা ম্যাগাজিন বের করতেন। গাজীউল হক ওই পত্রিকায় একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি জেলা প্রশাসনের নজরে পড়ে। জেলা প্রশাসন দ্রুত বিদ্যালয় কতৃর্পক্ষকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। সহকারী প্রধান শিক্ষক আবেদ আলী জেলা প্রশাসনের এই নির্দেশকে মানতে পারলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করেন। প্রতি বছরই বিদ্যালয়ে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত। একবার তিনি এই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বির্তক, আবৃত্তি এবং গানে অংশ নিয়ে পুরস্কার পান। আর চার লাইনের একটি ছড়া লিখে তিনি বেশি আলোচিত হন। ছড়াটি ছিল - আমি গাইব গান মুক্ত কন্ঠে, জীবন দীপের আলো জ্বেলে, সুর ছড়াবো, রং ছড়াবো, পুড়বো আমি, আলো ছড়াবো।
১৯৪৬ সালে বগুড়া জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন গাজীউল হক। এরপরই তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজে আইএ ভর্তি হন। কলেজে ভর্তি হয়েই তিনি অধ্যক্ষ ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অসাম্প্রদায়িক যুব প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক যুবলীগের দুদিনব্যাপী কমী সম্মেলনের আয়োজন করে। গাজীউল হক বগুড়ার পাঠচক্র 'শিল্পায়নে'র সদস্যদের সঙ্গে অংশ নেন। সম্মেলনে প্রস্তাব পাঠ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। যার অন্যতম প্রস্তাব ছিল 'মাতৃভাষাই হবে শিক্ষার বাহন, অফিস আদালতের ভাষা হবে বাংলা।' এভাবেই তিনি ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কমী হিসেবে কাজ করেন। তিনি আই.এ. পরীক্ষার স্টার মার্কস নিয়ে পাশ করেন।
১৯৪৮ সালে তিনি বগুড়া কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অর্নাসে ভর্তি হন। এরপরই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে কারাবরণ করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন-বেতন কর্মচারিগণ ধর্মঘট আহবান করলে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তিনিও এর সমর্থন করেন। এই ধর্মঘট আন্দোলনে কেন্দ্রীয়ভাবে কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১৬ নং কক্ষ থেকে। এই কক্ষটি গাজীউল হকের নামে বরাদ্দ ছিল। এখানে আসতেন ছাত্রনেতা অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর রহমান চৌধুরী, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। '৪৯ এর এই ধর্মঘট আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে গাজীউল হকের। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। আবদুল মতিনকে এই কমিটির আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির উদ্যোগে ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়।
গাজীউল হক ১৯৫১ সালে অর্নাস পাশ করে এম.এ.-তে ভর্তি হন। এবার তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের উপস্থিত বক্তৃতা, আবৃত্তি, বির্তক প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। গান গেয়েও গানের আসরকে মাতিয়ে তুলতেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ঢাকায় এসে পল্টনের জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন 'উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র হলে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা ছিল উত্তাল। ২০ ফেব্রুয়ারী পাকিস্থান সরকার ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিকে তছনছ করে দেয়ার জন্য ঢাকাতে সমাবেশ, মিছিল-মিটিংযের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। একুশে ফেব্রুয়ারী সকাল ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটের পাশে ছাত্র-ছাত্রীদের জমায়েত শুরু হতে থাকে। সকাল ১১ টায় কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক প্রমুখের উপস্থিতিতে ছাত্র-ছাত্রীদের সমাবেশ শুরু হয়। উপস্থিত সাধারণ ছাত্ররা স্বত:স্ফূর্তভাবে ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের দাবিতে শত শত বিদ্রোহী কন্ঠে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই দাবীতে আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। শ্লোগানে শ্লোগানে কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ এবং গুলি বর্ষণ শুরু করে। গুলিতে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত (ঢাবি এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর মাষ্টার্সের ছাত্র), রফিকউদ্দিন আহমদ, এবং আব্দুল জব্বার নামের তিন তরুণ মারা যায়। রফিক, জাব্বার, বরকত, শফিক সহ নাম না জানা আরও অনেকের সাথে সালামও সেদিন গুলিবিদ্ধ হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে গাজীউল হক পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। বগুড়ায় এই খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানকার আলতাফুন্নেছা মাঠে তাঁর গায়েবানা জানাজাও পড়ানো হয়েছিল। ‘ভুলব না, ভুলব না‘ বলে যে গানটি একুশে ফেব্রুয়ারীর স্মারক হিসেবে প্রথম দিকে গাওয়া হত সেটি গাজিউল হকেরই রচনা।
(স্ত্রীর সাথে গাজিউল হক)
১৯৫২ সালে এম.এ. পাশ করেন গাজীউল হক । কিন্তু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তাঁর এম.এ. ডিগ্রি কেড়ে নেয়। পরবতীতে ছাত্রনেতা ইশতিয়াক (ব্যারিস্টার), মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগের নেতা) প্রমুখের প্রচণ্ড আন্দোলনের চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর এম.এ. ডিগ্রি ফেরত দিতে বাধ্য হয়। এর পর ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন। এ বছরের ১৪ এপ্রিল তাঁকে চার বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে ছাত্র আন্দোলনের চাপে কারাগারে থাকতেই তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বহিষ্কারাদেশের কারণে তিনি কারাগারে বসে আইন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাননি। পরবতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জেংকিন্স ও রেজিষ্টার হাদী তালুকদারের আন্তরিক সহযোগিতায় ১৯৫৬ সালে তিনি একসঙ্গে ১১ পেপার আইন পরীক্ষা দেন। এরপরও তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কৃতকার্য হন। এরপরই তাঁর ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৫৭ সালে আইনজ্ঞ সৈয়দ নওয়াব আলীর অধীনে বগুড়া বারে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পূর্ব-পাকিস্তান ঢাকা হাই কোর্টে আইন ব্যবসায়ের সনদ লাভ করেন।
গাজীউল হক ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলনে অংশ নেন। '৬৯ এর ৪ মার্চ বগুড়ার সাতমাথায় পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়লে ক্রুদ্ধ জনতা তখন বগুড়ার জামিল বিল্ডিং এ আগুন ধরিয়ে দেয়। বগুড়ার প্রশাসন কারফিউ জারি করে। এ সময় গাজীউল হক জামিল পরিবারের সদস্যগণকে ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বগুড়া শহরে গুজব রটে আড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা বগুড়া দখল করার জন্য রওয়ানা দিয়েছে। ঐদিন রাতেই গাজীউল হক মাত্র ২৭ জন যুবকসহ পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে গাজীউল হকের উপর। ১৬ এপ্রিল গাজীউল হক অস্ত্র সংগ্রহ এবং অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে উত্তরাঞ্চল যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে ভারত গমন করেন। এর পর হিলিতে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে একটি খণ্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র 'জয়বাংলা' পত্রিকার বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বসহ আকাশ বাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন।
(পরিবারের সাথে গাজীউল হক)
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে গাজীউল হক বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে যোগদান করেন এবং সর্বোচ্চ আদালতে একজন আইনজীবী হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে আইন ব্যবসা পরিচালনা করেন। আইন পেশার পাশাপাশি সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন লেখক, কবি, গীতিকার। রাষ্ট্রভাষা বাংলা মর্যাদা পাবার পরও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু না হওয়ায় তিনি ভীষণ কষ্ট অনুভব করতেন। বিভিন্ন সময় তাঁর কথা, লেখায় এই আক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিলনা। তার উল্লেখ যোগ্য প্রকাশনাঃ
১। জেলের কবিতা (১৯৫৯), ২। এখানে ও সেখানে, ৩। একটি কাহিনী, ৪। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম (১৯৭১), ৫। এগিয়ে চলো (১৯৭১), ৬। Bangladesh Unchained (১৯৭১), ৭। Media Laws & Regulation in Bangladesh (১৯৯২), ৮। মোহাম্মদ সুলতান (১৯৯৪), ৯। বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন (১৯৯৬) ইত্যাদি।
কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের গাজীউল হক অনেক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। যথাঃ
১। ১৯৭৭ সালে পান পাবনা থিয়েটার পুরস্কার।
২। ১৯৭৯ সালে বগুড়া জিলা স্কুল 'বন্ধন'-এর পক্ষ থেকে ক্রেষ্ট উপহার দেওয়া হয়।
৩। ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি 'সড়ক'-এর পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হয়।
৪। ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জাতীয় ব্যক্তিত্ব গবেষণা কেন্দ্র তাঁকে রাষ্ট্রভাষা পুরস্কার পদক ও সম্মান স্মারক প্রদান করে।
৫। ১৯৯৭ সালে অন্নদা শংকর রায় কলকাতার পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে।
৬। ১৯৯৭ সালে বছর বগুড়া প্রেস ক্লাব কর্তৃক ভাষাসৈনিকদের সংবর্ধনা দেয়।
৭। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম ইয়ুথ কয়ার-এর পক্ষ থেকে ৭ মার্চ তিনি ভাষাসৈনিক পদক পান।
৮। ১৯৯৭ সালে বগুড়ার ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু পরিষদ সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাঁকে অর্পণ নামে একটি ক্রেষ্ট উপহার দেয়।
৯। ১৯৯৯ সালের ২৬ নভেম্বর বাংলা একাডেমী থেকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ অর্জন করেন।
১০। ২০০০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আমরা সূর্যমুখী-এর পক্ষ থেকে নাগরিক সম্মাননা দেয়।
১১। ২০০০ সাল বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত করেন।
১২। ২০০০ সালের ১০ জুলাই পান বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন পুরস্কার।
১৩। ২০০১ সালে ফেনী সমিতির পক্ষ থেকে গুণীজন সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
১৪। ২০০১ সালেই একাত্তরের ঘাদানিক এর পক্ষ থেকে 'জাহানারা ইমাম পদক' পান।
১৫। ২০০২ সালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট তাঁকে একটি ক্রেষ্ট উপহার দেয়।
১৬। ২০০৩ সালে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু পদক পান।
১৭। ২০০৪ সালে পান শের-ই-বাংলা জাতীয় পুরস্কার।
১৮। ২০০৫ সালে শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার পান।
১৯। ২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন-তাঁকে ক্রেষ্ট উপহার দেয়। এ ছাড়াও তিনি আরো বহু সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
দেশের জন্য আজীবন সংগ্রামী এই গুণীজন ২০০৯ সালের ১৭ জুন বিকালে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর | ওইদিন সকালে ঘুমের মধ্যে তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অবস্থায় স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালানো হয়| কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরলোকগত হন তিনি| আজ ৪র্থতম মৃত্যুদিনে ভাষা সৈনিককে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই জুন, ২০১৩ বিকাল ৪:২৫
অন্তরন্তর বলেছেন:
একজন অসম্ভব ভাল মানুষের কথা লিখেছেন। আপনার
পোস্টে উনার কথা সব লিখা আছে, আর কিছু যুক্ত করতে
চাই না। ছোট বেলায় এই অপূর্ব, অমায়িক এবং ভদ্র মানুষটির
বাসায় গিয়েছি, উনার কথা মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। তখন আমরা
পূর্ব হাজীপাড়াতে থাকতাম(২০/২৫ বছর ছিলাম)। উনার বাসার
সামনে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। অনেক দিন দেশের বাইরে থাকায়
কোন খবর জানি না কিন্তু আপনার লিখা দেখে সেইসব স্মৃতি চোখে
ভেসে আসল। আল্লাহ্ উনাকে জান্নাত দান করুন।