নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্যই সুন্দর

আমি সত্য জানতে চাই

কোবিদ

আমি লেখালেখি করি

কোবিদ › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাংলা তথা ভারতীয় নাট্যজগতের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব, স্বনামধন্য আবৃত্তিশিল্পী ও চলচ্চিত্র অভিনেতা শম্ভু মিত্রের ৯৮তম জন্মদিনে শুভেচ্ছা

২২ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:০১



শম্ভু মিত্র, আধুনিক বাঙলানাট্যের প্রবাদপ্রতীম পুরুষ। বাঙলা নাটককে বিশ্ব আঙিনায় পৌছে দিতে যে কজন গুণীব্যক্তি বিশেষ অবদান রেখেছেন শম্ভু মিত্র তাদেরই একজন। নবনাট্য আন্দোলনের পিতা, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাট্যব্যক্তিত্ব শ্রী শম্ভু মিত্র । প্রবাদপ্রতিম এই মানুষটি আত্ম মর্যাদার প্রতীক। নিজের বিশ্বাস আর কাজে তিনি ছিলেন স্থির প্রত্যয়ী। 'নবান্ন' থেকে 'পুতুলখেলা' , 'ডাকঘর' থেকে 'রাজা অয়দিপাউস' সবই আজ ইতিহাস | বিজন ভট্টাচার্য্য রচিত নবান্ন নাটকের মাধ্যমে তিনি মঞ্চ নাটকের চিরায়িত ধারণা ভেঙ্গে নবধারার সূচনা করেন এবং ১৯৪৮ সালে তিনি ‘বহুরূপী’ থিয়েটার গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শুধু সফল মঞ্চ অভিনেতা, নির্দেশক, নাট্যকারই ছিলেন না, চলচ্চিত্রেও র্দোদান্ড প্রতাপে অভিনয় করেছেন। মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী, রাজা ও চার অধ্যায়, রাজা ইডিপাস, পুতুল খেলা তাঁর অভিনীত বিখ্যাত মঞ্চ নাটক। মঞ্চ অভিনয়ের জন্য তিনি পদ্মভূষণ, ম্যাগসেসে পুরস্কার সহ অসংখ্য সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। আজ এই বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের ৯৮তম জন্মদিন। ১৯১৫ সালের ২২ আগষ্ট তিনি জন্মগ্রহন করেন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা ও গভীর শ্রদ্ধা।



শম্ভু মিত্র ১৯১৫ সালের ২২ আগস্ট কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে মাতামহ ডাঃ আদিনাথ বসুর গৃহে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম শরৎকুমার বসু ও মাতার নাম শতদলবাসিনী দেবী। শম্ভু মিত্রের পৈত্রিক নিবাস ছিল হুগলি জেলার কলাছাড়া গ্রামে। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে বিদ্যালয় শিক্ষা সমাপ্ত করে ভরতি হন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। তবে কলেজের পাঠ সমাপ্ত করেননি। ১৯৩৯ সালে রংমহলে যোগদানের মাধ্যমে বাণিজ্যিক নাট্যমঞ্চে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু । পরে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য হন। নাট্যনিকেতনে কালিন্দী নাটকে অভিনয়ের সূত্রে সেযুগের কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সঙ্গে আলাপ হয়। পরবর্তীকালে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর প্রযোজনায় আলমগীর নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন। কিন্তু এই সময় থেকেই শিশিরকুমারের থেকে আলাদা সম্পূর্ণ নিজস্ব এক নাট্যঘরানা তৈরিতে উদ্যোগী হন শম্ভু মিত্র। ১৯৪২ সালে ফ্যাসিবিরোধী সংঘের সঙ্গে পরিচিত হন শম্ভু মিত্র। ১৯৪৩ সালে বাম রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ঠ হয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক পি. সি. যোশির অনুপ্রেরণায় যোগ দেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে।



১৯৪৫ সালের ১০ ডিসেম্বর গণনাট্য সংঘে কাজ করার সময়ই প্রখ্যাত মঞ্চাভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন শম্ভু মিত্র। শম্ভু মিত্রের স্ত্রী তৃপ্তি মিত্র ও কন্যা শাঁওলী মিত্রও স্বনামধন্য মঞ্চাভিনেত্রী। ১৯৮৩ সালে নিজের প্রযোজনায় কন্যা শাঁওলী মিত্র পরিচালিত নাথবতী অনাথবৎ নাটকে কন্যার সঙ্গে অভিনয় করেন শম্ভু মিত্র। কন্যা শাঁওলি মিত্রের নাট্যসংস্থা পঞ্চম বৈদিকের তিনি প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ও আমৃত্যু কর্মসমিতি সদস্য ছিলেন। ১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রবীন্দ্রসদনে পঞ্চম বৈদিকের প্রযোজনায় ও তাঁর পরিচালনায় দশচক্র নাটকটির পরপর ছয়টি অভিনয় পাঁচ দিনে মঞ্চস্থ হয়। অভিনেতা রূপে এর পর আর কোনোদিন মঞ্চে অবতীর্ণ হননি তিনি। তাঁর পরিচালনায় উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল নবান্ন, দশচক্র, রক্তকরবী, রাজা অয়দিপাউস ইত্যাদি। তাঁর রচিত নাটকের মধ্যে চাঁদ বণিকের পালা সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য।



১৯৪৮ সালে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠন করেন বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠী। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বহুরূপীর প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সফোক্লিস, হেনরিক ইবসেন, তুলসী লাহিড়ী এবং অন্যান্য বিশিষ্ট নাট্যকারের রচনা তাঁর পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়। তাঁর এই পরিচালনাগুলি ভারতীয় নাটকের ইতিহাসে এক একটি মাইলফলক হিসেবে পরিগণিত হয়। ১৯৭৮ সালের ১৬ জুন অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে দশচক্র নাটকে অভিনয় করেন। বহুরূপীর প্রযোজনায় এটিই তাঁর শেষ নাটক। এই বছরই ১৫ অগস্ট অ্যাকাডেমিতে স্বরচিত চাঁদ বনিকের পালা নাটকটি পাঠ করেন তিনি। এরপর বহুরূপীর আর কোনো প্রযোজনায় তাঁকে দেখা যায়নি। ১৯৭৯ সালে প্রায় দৃষ্টিহীন অবস্থায় নান্দীকার প্রযোজিত মুদ্রারাক্ষস নাটকে চাণক্যের ভূমিকায় তাঁর অভিনয় বিশেষ সাড়া ফেলেছিল। ১৯৮০-৮১ সালে ফ্রিৎজ বেনেভিৎজের পরিচালনায় ক্যালকাটা রিপোর্টারির প্রযোজনায় গ্যালিলিওর জীবন নাটকে অভিনয় করেন।



বহুরূপীর প্রযোজনায় শম্ভু মিত্র পরিচালিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল: নবান্ন, ছেঁড়া তার, পথিক, দশচক্র, চার অধ্যায়, রক্তকরবী, পুতুল খেলা, মুক্তধারা, কাঞ্চনরঙ্গ, বিসর্জন, রাজা অয়দিপাউস, রাজা, বাকি ইতিহাস, পাগলা ঘোড়া, চোপ আদালত চলছে ইত্যাদি। চাঁদ বণিকের পালা তাঁর রচিত একটি কালজয়ী নাটক। এই নাটকের প্রযোজনা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে একাধিক অনুষ্ঠানে তিনি এই নাটক পাঠ করেছেন এবং রেকর্ডও করেছেন। তাঁর রচিত অন্যান্য নাটকগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: উলুখাগড়া, বিভব, ঘূর্ণি, কাঞ্চনরঙ্গ ইত্যাদি। এছাড়া গর্ভবতী বর্তমান ও অতুলনীয় সংবাদ নামে দুটি একাঙ্ক নাটকও রচনা করেন। সব গুণী শিল্পীই কিছুটা খুঁতখুঁতে হন। শম্ভু মিত্র কিছুতেই খুশি হতে পারতেন না। একটি স্ক্রিপ্টে লেখার ভাষাকে সাদামাটা কথোপকথনের স্টাইলে বদলে নেওয়াটা তাঁর কাছে ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’-এ একটি সংলাপ ছিল, নায়ক নায়িকাকে বলছে, ‘এনে দিলুম আমার কাপড়ের তোরঙ্গ তোমার চরণতলে।’ শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে এটি মঞ্চে হয়ে যেত, ‘পায়ের তলায়’।



নাট্যরচনা ছাড়াও শম্ভু মিত্র পাঁচটি ছোটোগল্প ও একাধিক নাট্যবিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। তাঁর রচিত কাকে বলে নাট্যকলা ও প্রসঙ্গ: নাট্য দুটি বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ। নাট্যাভিনয়ের সূত্রে চলচ্চিত্র জগতেও পা রেখেছিলেন শম্ভু মিত্র। খাজা আহমেদ আব্বাসের পরিচালনায় নির্মিত হিন্দি ছবি ধরতি কে লাল-এর সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি। অভিনয় করেছেন মানিক, শুভবিবাহ, ৪২, কাঞ্চনরঙ্গ, পথিক, বউ-ঠাকুরাণীর হাট প্রভৃতি চলচ্চিত্রে। অমিত মিত্রের সঙ্গে একদিন রাত্রে ও তার হিন্দি জাগতে রহো-র কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনার কাজ করেন। রাজ কাপুর প্রয়োজিত ও অভিনীত জাগতে রহো ছবিটি গ্রাঁ পিঁ সম্মানে ভূষিত হয়েছিল।



অভিনয়, নাট্য পরিচালনা ছাড়াও শম্ভু মিত্র ছিলেন বাংলার এক স্বনামধন্য আবৃত্তিশিল্পী। জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের মধুবংশীর গলি কবিতাটি আবৃত্তি করে তিনি জনসমাজে বিশেষ সাড়া ফেলেছিলেন। রক্তকরবী, চার অধ্যায়, রাজা অয়দিপাউস, তাহার নামটি রঞ্জনা, ডাকঘর, চাঁদ বণিকের পালা ও অয়দিপাউসের গল্প তাঁর স্বকণ্ঠে রেকর্ড করা নাট্যপাঠ। এছাড়া শম্ভু মিত্র (কবিতা আবৃত্তি), রবীন্দ্রনাথের কবিতাপাঠ, দিনান্তের প্রণাম তাঁর প্রসিদ্ধ বাংলা কবিতা আবৃত্তির রেকর্ড। ১৯৭৬ সালে সম্ভুমিত্র নাটক ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ম্যাগসেসে পুরস্কার এবং ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মান লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে এক বছরের জন্য তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফেলো হয়েছিলেন। এছাড়াও ১৯৮৩ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে দেশিকোত্তম উপাধিতে সম্মানিত করে। যাদবপুর ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট. উপাধিতেও ভূষিত করেছিল।



কাল যতই নিরবধি হোক আর বিচিত্র পৃথিবী যতই বিপুলা হোক না কেন মঞ্চের আলো-আঁধারির পাদপ্রদীপে মঞ্চায়নের উদ্দেশ্যে নামা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়টা তো শেষ পর্যন্ত কিছু জীবন্ত মানুষের উপস্থিতিতে জীবন্ত পরিবেশনা। চূড়ান্তভাবেই সেটা তাৎক্ষণিক। প্রদীপের প্রাণশক্তি তেলের যতক্ষণ উপস্থিতি ততক্ষণই তার জ্বলে ওঠা এবং দহনে পুড়তে পুড়তে অবশেষে নিভে যাওয়া। তা সত্ত্বেও কেউ না কেউ তো জীবনের অগ্নি পরীক্ষা দিতে দিতে হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত করে। মঞ্চে যা বলবে, বিশ্বাস করেই বলবে'। সেই বলা কথার মানুষটি নবনাট্যের রূপকার অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক এবং প্রযোজক শম্ভু মিত্র ১৯৯৭ সালের ১৯ মে কলকাতার বাসভবনে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইচ্ছাপত্র-এ তিনি লিখেছিলেন, “মোট কথা আমি সামান্য মানুষ, জীবনের অনেক জিনিস এড়িয়ে চলেছি, তাই মরবার পরেও আমার দেহটা যেন তেমনই নীরবে, একটু ভদ্রতার সঙ্গে, সামান্য বেশে, বেশ একটু নির্লিপ্তির সঙ্গে গিয়ে পুড়ে যেতে পারে।” এই কারণে সৎকার সমাধা হওয়ার পূর্বে সংবাদমাধ্যমে শম্ভু মিত্রের মৃত্যুসংবাদ প্রচার করা হয়নি। সময়ের প্রবাহমান ধারায় তার নশ্বর দেহ আজ আর নেই। তবু মঞ্চের মধ্যমণি, কিংবদন্তি এ নাট্য ব্যক্তিত্বকে চিরদিন স্মরণ রাখবে নাট্যবোধ্যারা।



সম্মানকে জীবনের ধ্রুবতারা জ্ঞান করা, বিশ্বাসকে আমৃত্যু আগলে রাখা, অকূল দরিয়ায় নাও ভাসানো নবনাট্যের রূপকার শম্ভু মিত্রের আজ ৯৮তম জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা ও গভীর শ্রদ্ধা।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১২:০৭

শরৎ চৌধুরী বলেছেন: বাহ! চমৎকার পোষ্ট। +।

২২ শে আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ২:১৭

কোবিদ বলেছেন:

ধন্যবাদ আপনাকে অন্যমনস্ক শরৎ

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.