নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অতুলপ্রসাদ সেন বিশিষ্ট বাঙালি গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তিনি একজন বিশিষ্ট সংগীতবিদও ছিলেন। অতুলপ্রসাদ বাংলা গানে ঠুংরি ধারার প্রবর্তক। তিনিই প্রথম বাংলায় গজল রচনা করেন। দাদামশায়ের নিকটই সংগীত ও ভক্তিমূলক গানে তাঁর হাতেখড়ি। তাঁর রচিত গানগুলির মূল উপজীব্য বিষয় ছিল দেশপ্রেম, ভক্তি ও প্রেম। তাঁর জীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণাগুলি তাঁর গানের ভাষায় বাঙ্ময় মূর্তি ধারণ করেছিল; "বেদনা অতুলপ্রসাদের গানের প্রধান অবলম্বন"। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গানের বিশেষ গুণগ্রাহী ছিলেন। অতুলপ্রসাদের "মোদের গরব, মোদের আশা" গানটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। আজ এই সঙ্গীতজ্ঞের ৭৯তম মৃত্যুদিন। ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুদিনে অতুলপ্রসাদকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
অতুলপ্রসাদ সেন ১৮৭১ সালের অক্টোব ঢাকায় তাঁর মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পৈতৃক বাড়ি ছিল দক্ষিণ বিক্রমপুরের মাগর-ফরিদপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম রামপ্রসাদ সেন এবং মায়ের নাম হেমন্তশশী। অতি অল্পবয়সেই অতুলপ্রসাদ পিতৃহারা হন অতুল প্রসাদ সেন। এরপর তাঁর দাদামশায় কালীনারায়ণ গুপ্ত তাঁকে প্রতিপালন করেন। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি যখন কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, সে সময় তাঁর বিধবা মা হেমন্তশশী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর জ্যাঠামশাই দুর্গামোহন দাশকে বিবাহ করেন। এর ফলে তিনি মানসিকভাবে অত্যন্ত আঘাত পান। ইনি মায়ের নির্দেশে তাঁর বোনদের মায়ের কাছে রেখে আসেন, কিন্তু নিজে মামা বাড়িতে ফিরে যান। এরপর তিনি মামাদের অনুরোধে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন।
১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। শৈশব থেকেই আকাঙ্ক্ষা ছিল বিলেত গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ার। এই কারণে তাঁর মামারা তাঁকে বিলেত যাবার ব্যবস্থা করেন। এই যাত্রার পিছনে অলক্ষ্যে সহযোগিতা করেন তাঁর সৎপিতা দুর্গামোহন দাশ। এ কথা জানতে পেরে তিনি দুর্গামোহন দাশের সাথে দেখা করেন এবং এর ভিতর দিয়ে তাঁর মা এবং সৎপিতার সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। জাহাজে বসে তিনি রচনা করেছিলেন 'উঠ গো ভারতলক্ষ্মী' গানটি। লন্ডনে গিয়ে তিনি আইন শিক্ষা করেন এবং আইন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। এই সময় তাঁর বড় মামা কৃষ্ণগোবিন্দ সপরিবারে লন্ডনে যান। অতুলপ্রসাদ নিয়মিতভাবে লণ্ডনের মামাবাড়িতে যাওয়া-আসা শুরু করেন। এই সূত্রে তাঁর মামাতো বোন হেমকুসুমের সাথে ঘনিষ্ঠতা জন্মে। আইন পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে ১৮৯৪ সালে তিনি বাংলায় ফিরে আসেন এবং রংপুর ও কলকাতায় অনুশীলন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি লখনউ চলে যান এবং সেখানে অবধ বার অ্যাসোসিয়েশন ও অবধ বার কাউন্সিলের সভাপতি হন।
আইন ব্যবসায় কলকাতায় ততটা পসার জমাতে পারেননি অতুলপ্রসাদ সেন। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে দুর্গামোহন দাশ পরলোকগমন করেন। ফলে অতুলপ্রসাদকে সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। আর্থিক সুবিধা লাভের আশায় তিনি রংপুরে চলে যান।এই সময় তাঁর সাথে হেমকুসমের সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে যায়। হিন্দু রীতিতে এই বিবাহ অসিদ্ধ, তাই যথারীতি পারিবারিকভাবে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরে তাঁরা সত্যেন্দ্রসিংহের পরামর্শে ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় বিলাত যান এবং স্কটল্যান্ডের গ্রেট্নাগ্রীন গ্রামের রীতি অনুসারে বিবাহ করেন। বিবাহের পর এঁরা দেশে ফিরে না যাওয়ার সংকল্প করেন এবং বিলেতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু এই ক্ষেত্রে অতুলপ্রসাদ এখানেও কোনো সুবিধা করতে পারলেন না। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁদের যমজ পুত্র সন্তান জন্ম হয়। এঁদের নাম রাখা হয় দীলিপকুমার ও নিলীপকুমার। এই সময় তিনি প্রচণ্ড আর্থিক কষ্টের ভিতর পড়েন। সংসারের খরচ মেটানোর এক সময় হেমকুসুম গহনা বিক্রয় শুরু করেন। এর ভিতর নিলীপকুমার সাত মাস বয়সে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। চরম হতাশা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে তিনি দেশ ফেরার কথা ভাবতে থাকেন। এই সময় মমতাজ হোসেন নামক এক বন্ধু তাঁকে উত্তরপ্রদেশের লখ্নৌতে আইন ব্যবসার পরামর্শ দেন। এই ভরসায় ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রথমে কলকাতায় ফিরে আসেন। কলকাতায় তাঁর আত্মীয়-স্বজনেরা তাঁকে বর্জন করলে, তিনি লখ্নৌতে চলে যান। এখানে তিনি মমতাজ হোসেনের সহায়তায় লখনৌতে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং উর্দু ভাষা শেখেন। তখনকার সরকারি উকিল টমাস, নগেন্দ্র ঘোষাল ও ঝাউলালপুলের বিপিনবিহারী বসুর সহযোগিতায় নিজেকে প্রথম শ্রেণীর আইনজীবী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন।
অতুলপ্রসাদের গানের সংখ্যা ২০৮ আর তাঁর রচিত বাংলা গজলের সংখ্যা ৬-৭টি। গীতিগুঞ্জ (১৯৩১) গ্রন্থে তাঁর সমুদয় গান সংকলিত হয়। এই গ্রন্থের সর্বশেষ সংস্করণে (১৯৫৭) অনেকগুলি অপ্রকাশিত গান প্রকাশিত হয়। অতুলপ্রসাদ সেনের কয়েকটি বিখ্যাত গান হল "মিছে তুই ভাবিস মন", "সবারে বাস রে ভালো", "বঁধুয়া, নিঁদ নাহি আঁখিপাতে", "একা মোর গানের তরী", "কে আবার বাজায় বাঁশি", "ক্রন্দসী পথচারিণী" ইত্যাদি। তাঁর রচিত দেশাত্মবোধক গানগুলির মধ্যে প্রসিদ্ধ "উঠ গো ভারত-লক্ষ্মী", "বলো বলো বলো সবে", "হও ধরমেতে ধীর"। অতুলপ্রসাদের গানগুলি "দেবতা", "প্রকৃতি", "স্বদেশ", "মানব" ও "বিবিধ" নামে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত। "অতুলপ্রসাদী গান" নামে পরিচিত এই ধারার একজন বিশিষ্ট সংগীতশিল্পী হলেন কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে লখ্নৌতে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনে সভাপতি হন অতুলপ্রসাদ সেন। এই অধিবেশনে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অতুলপ্রসাদ এর নামকরণ করেন 'উত্তরা'। এই সময় হেমকুসুম দেরাদুনে যান। সেখানে টাঙ্গা থেকে পড়ে গিয়ে তাঁর পেলভিস্ বোন ভেঙ্গে যায়। অতুলপ্রসাদ দেরাদুনে গিয়ে তাঁর চিকিৎসার সকল ব্যবস্থা করে লখ্নৌতে ফিরে আসেন। এরপর কলকাতা থেকে তাঁর অসুস্থ মাকে লখ্নৌতে নিয়ে আসেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ মে-তে তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেন। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের নির্ধারিত সভাপতি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়লে, অতুলপ্রসাদ সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে এলাহাবাদ লিবারেল পার্টির উত্তরপ্রদেশ শাখার অষ্টম অধিবেশনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে, তিনি স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য কার্শিয়াং যান। ডিসেম্বরে গোরক্ষপুরের প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। এরপর তিনি সুস্থবোধ করায় লখ্নৌতে ফিরে আসেন।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ এপ্রিলে পুরী যান অতুলপ্রসাদ সেন। গান্ধী (মহাত্মা) এই সময় পুরীতে আসেন। গান্ধীজীর অনুরোধে অতুলপ্রসাদ তাঁকে গান গেয়ে শোনান। এ বছর ২৫শে আগষ্ট তিনি অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২৬শে আগষ্ট দিবাগত রাতে মৃত্যবরণ করেন। আজ এই সঙ্গীতজ্ঞের ৭৯তম মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে অতুলপ্রসাদকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
অতুল প্রসাদের গান শুনতে ক্লিক করুনঃ অতুলপ্রসাদের গান
©somewhere in net ltd.