নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
উইলিয়াম সিডনি পোর্টার প্রখ্যাত মার্কিন ছোট গল্পকার। তিনিই সম্ভবতঃ মার্কিন ছোট গল্পকারদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত এবং জনপ্রিয়। তবে আসল নামে নয় তিনি খ্যাতি লাভ করেন ও হেনরি ছদ্মনামে লিখে। 'ও হেনরি' বা অলিভার হেনরি (Olivier Henry) হলো 'উইলিয়াম সিডনি পোর্টার'-এর ছদ্মনাম। ও হেনরি প্রায় ছয়শতাধিক গল্প লিখেছেন। তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় সঙ্কলনগুলি হলো- 'বাঁধাকপি এবং রাজা'(Cabbages and Kings), 'নিয়তির রাস্তা' (Roads of Destiny) এবং 'ছয়-সাত'(Sixes and Sevens)। আজ প্রখ্যাত এই গল্পকারের জন্মদিন। ১৮৬২ সালের আজকের দিনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে তাঁর জন্য আমাদের শুভেচ্ছা।
উইলিয়াম সিডনি পোর্টার ১৮৬২ সালের ১১ জুন আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার গ্রীণসবোরো শহরে (Greensboro, North Carolina) জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ডাঃ এলজারনোন সিডনি পোর্টার এবং মাতার নাম মেরী জেন ভারজিনিয়া সোয়াইম পোর্টার। তার পিতা এলজারনো্ন সিডনি পোর্টার পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। ডাঃ এলজারনোন এবং মেরী জেন ভারজিনিয়া ১৮৫৮ সালের ২০ এপ্রিল বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন যখন উইলিয়ামের বয়স তিন বছর। তার মাতার মৃত্যুর পরে ও হেনরি তার পিতামহী ও চাচীর কাছে পালিত হন। ১৮৮৭ সালে ও হেনরি এথোলা ইস্টেসকে বিয়ে করেন। দাম্পত্য জীবনে মার্গারেট ওয়ার্থ পোর্টার নামে এক মেয়ে ছিলো। ১৮৯৭ সালে তার স্ত্রীর মৃত্যু হয়। পরে ১৯০৭ সালে তিনি তার শৈশব প্রণয়ী সারাহ লিন্ডসে কলিমেনকে বিয়ে করেন যদিও ১৯০৮ সালে তারা পৃথক হয়ে যান।
কর্মময় জীবনে ও হেনরি বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন। ও হেনরি প্রথম জীবনে কিছুকাল একটি খামার বাড়িতে কাজ করেন। এ ছাড়াও একটি ওষুধের দোকান ফার্মাসিস্ট হিসেবে এবং কলাম লেখক হিসেবে কাজ করেন। তিনি একটি ব্যাংকে কেরানি হিসেবেও কাজ করেন তবে ব্যাংকের তহবিল তসরুফের কারণে তাকে অভিযুক্ত হন এবং ব্যাংকের চাকুরী থেকে বরখাস্ত হন। ব্যাংকের দায়ের করা অভিযোগে ১৮৯৬ সালে তিনি পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হন। জামিন পাবার পরে তিনি ভবঘুরে জীবন-যাপন শুরু করেন এবং ছোট-গল্প লিখে নিজের ও তাঁর পরিবারের ভরণ-পোষণ চালান।
বিখ্যাত এই ছোট গল্পকার অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থায় ১৯১০ সালের ৫ জুন আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে মৃত্যুবরণ করেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে যকৃতের সিরোসিস তার মৃ্ত্যুর কারণ বলে ধারণা করা হয়। আজ এই জনপ্রিয় গল্পকারের জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁর জন্য আমাদের শুভেচ্ছা।
জন্মদিনে ও হেনরির লেখা আসাধারণ গল্প “দি গিফট অব দি মেজাই” উৎসর্গ করা হলো সামু ব্লগের পাঠকদের জন্য।
“The Gift of the Magi” বা “মেজাইয়ের উপহার” ছোট গল্পটি ১৯০৫ সালে নিউ ইয়র্ক সিটির একটি পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ১৯০৬ সালে “The Four Million” গ্রন্থে সংকলিত হয়।
“The Gift of the Magi”
ও. হেনরীর ছোট গল্প
মাত্র এক ডলার সাতাশি সেন্ট তার হাতে। এর ভেতরে ষাট সেন্ট আবার খুচরো। বাজার করতে গিয়ে জিনিসপত্রের দর-দস্ত্তরর করতে গিয়ে তা থেকে এক পেনি আধ পেনি বাঁচিয়ে অনেক কষ্ট করে এই ক’টা মুদ্রা জমিয়েছে সে। মুদ্রা ক’টা তিনবার গুণল সে। এক ডলার আর সাতামি সেন্ট। অথচ কালকেই বড়দিন।
হতাশ হয়ে সে চেয়ারের ওপর ভেঙে পড়ল । কেঁদে উঠল। তার মনে হল জীবনটা শুধু কান্না আর দুঃখেই ভরা । এর ভেতরে কান্নার ভাগটাই বেশি।
ডেলা যখন কাঁদছে, কাঁদুক। তার আশপাশের কথা এই ফাঁকে একটু বলি। সপ্তাহে আট ডলার ভাড়া দিতে হয় তাদের এই সাজানো ফ্ল্যাটটার জন্যে। খুব খারাপ নয় বাড়িটা। কিন্তু এই ভাড়া গুণতে অনেক কষ্ট করতে হয় তাদের।
নিচের দেয়ালে একটা চিঠির বাক্স ঝোলানো। কোনোদিন কোনো চিঠি হয়তো এখানে ফেলা হয় নি। এর পাশেই বৈদ্যুতিক বোতাম। কোনোদিন কউ এটা টিপে ডেকেছে বলে মনে হয় না। এর পরেই ছোট্ট একটা নামের ফলক। সেখানে লেখা মিঃ জেমস ডিলিংহ্যাম ইয়ং।
নামের ফলকটা ঝোলানো হয়েছিল যখন তাদের অবস্থা ভালো ছিল। যখন ডিলিংহ্যাম সপ্তাহে তিরিশ ডলার করে পেত। িএখন পায় বিশ ডলার। আর তার অবস্থার অবনতির সাথে সাথেই বুঝি নাম-ফলকের ঔজ্জ্বল্য্ও অনেকখানি ম্লন হয়ে এসেছে। তবু এখন্ও যখন সে বাড়ি ফিরে আসে, ডেলা তার আদরের নাম জিম বলে ছুটে আসে, তাকে জড়িয়ে ধরে। অনেক সুখে আছে ওরা।
ডেলা আর কাঁদল না। পাউডারের তুলি দিয়ে গালের অশ্রু মুছে নিল। জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। দূরে উঠোনের পাশে বেড়ার ওপর দিয়ে একটা ছাই রঙ বেড়াল হেঁটে যাচ্ছিল। কালকেই বড়দিন। অথচ ঐ এক ডলার সাতাশি সেন্ট দিয়ে জিমকে তার একটা উপহার কিনে দিতে হবে। এজন্যেই সে মাসের পর মাস কষ্ট করে পয়সা জমিয়েছে। সাপ্তাহিক যা আয় তা থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু জমানো যায় না। অনেক চেষ্টা করেছে, পারে নি। জিমের জন্যে এপর্যন্ত যা জমাতে পেরেছে তা ঐকটা টাকা মাত্র। কী তাকে কিনে দেবে, অনেকদিন সে অনেক অবসরে বসে বসে ভেবেছে। সুন্দর আর অসাধারণ একটা কিছু কিনতে চেয়েছে সে। এমন কিছু দেবে যা জিমকে মানাবে, যা পেয়ে জিম গর্বিত হবে।
দুজানালার মাঝখানে একটা অয়না ঝোলানো । আট ডলার ভাড়ার ফ্ল্যাটে আয়না আর কেমনই বা হবে? লম্বা, বড় একটা অয়না। যে কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে পুরো দেখতে পাবে। ডেলাও ধদখতে পায়।
অচমকা জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল সে। মুখ তার বিবর্ণ কিন্তু চোখ জোড়া উজ্জ্বল। ঘনকালো আর দীর্ঘ চুলের গোছাটা খুলে দিল সে পিঠের ওপর।
দুটো জিনিস ছিল তাদের স্বামী-স্ত্রীর। দুজনেই যে যার জিনিসের জন্য ছিল গর্বিত। একটা হচ্ছে ডেলার সুন্দর আর লম্বা চুলের গোছা। আর একটা হচ্ছে জিমের সোনার ঘড়ি। এ ঘড়িটা তার ঠাকুরদা’র কাছ থেকে পাওয়া। যদি উল্টোদিকের ফ্ল্যাটে শেবা’র রানি থাকতেন আর ডেলা জানালায় তার ভিজে চুল ছড়িয়ে রাখত তবে রাণিও হয়তো ঈর্ষায় মরে যেতেন। এমন অসাধারণ সৌন্দর্য ছিল সে চুলের। আর যদি সোলেমান বাদশাহ নিচের তলায় সমস্ত ধর-রত্নের মাঝ বসেও থাকতেন আর জিম যেত-আসতে তার সোনার ঘড়িটা বের করে সময় দেখত, তবে বাদশাও তাকে হিংসে না করে পারতেন না। এই দুটো জিনিস নিয়ে এতো গর্বিত ছিল ওরা।
সোনালি জলের মুক্তা-ধারার মতো ডেলার উজ্জ্বল চুল ছড়িয়ে পড়ল তার হাঁটুর অবধি। কম্পিত হাতে তাড়াতাড়ি সে আবার খোঁপা বেধে রাখল। মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে রইল নীরবে। দু-এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। ঝড়ে পড়ল লাল মেঝের ওপর।
তাড়াতাড়ি সে বাদামি রংঙের জ্যাকেট আর টুপিটা তুলে নিল। তারপর দ্রুত স্কর্ট দুলিয়ে উজ্জ্ল চোখে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল রাস্তায়।
যেতে যেতে একটা সাইবোর্ডের সামনে এসে দাঁড়াল সে। সেখানে লেখ-‘ম্যাড়াম সোফ্রানি, যাবতীয় চুলজান দ্রব্যের দোকান’। ডেলা হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে উঠে ম্যাডামের সামনে দাঁড়িয়ে নিঃস্বান নিয়ে বলল, ‘আপনি চুল কিনবেন’?
‘কিনব। টুপি খুলে চুল ছড়িয়ে নি, আগে দেখি।’
সোনালি চুলের বোঝা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। ব্যবসায়ী চালে ম্যাডাম চুল তুলে ধরে বললেন,‘বিশ ডলার দিতে পারি।’
‘তাহলে তাড়াতাড়ি করুন আপনি।’
পরের দুঘন্টা যেন হাওয়ায় ভেসে গেল। যেলা হন্যে হয়ে খুঁজছিল সব দোকান- কী সে কিনবে জিমের জন্যে?
অবেশেষে তার পছন্দ হল। ঠিক জিমের সাথে খাপ খাবে।
যেন শুধু জিমের জন্যেই ওটা তৈরি হয়েছিল। এ রকমটি সে আর কখনো দোকানে দেখেনি।। একটা প্লাটিনামের চেন, সুন্দর নকশা করা, দেখেই দামি মনে হয়। শুধু নকশা নয়, জিনিসটা অদতেই সুন্দর। জিমের ঘড়িতে আশ্চর্য মানাবে। দামও জিনিসে অনুপাতে বেশি না। একুশ ডলার মোট নিল দোকানদার। বাকি সাতাশি সেন্ট নিয়ে সে ফিরে এল ফ্ল্যাটে। জিম ওই চেন লাগিয়ে বন্ধ-বান্ধবের কাছে খুব বাহবা নেবে। দেখাবার জন্যে বারবার সময় দেখবে। ডেলা ভাবল ঘড়িটার সাথে সাধারণ চামড়ার ব্যন্ড মোটেই মানায় না। এবার এই চেনে অদ্ভুত মানাবে। আরো সুন্দর লাগবে ঘড়িটাকে। বাসায় ফিরে এসে চুলের কথা মনে পড়ল। জিমের কথা ভাবতে ভাবতে সে ভুলেই গিয়েছিল চুলগুলো ঠিক করা দরকার। চল্লিশ মিনিচের ভেতরে সমসম্ত চুল কোঁকড়ানো হয়ে গেল। আশপাশে. কানের লাতির নিচে ছড়িয়ে পড়ল চূর্ণ চূর্ণ হয়ে। একরাশ, ঝাঁকড় ঝাঁকড়া। বাচ্চা ছেলের মতো যেন দেখাতে লাগল তাকে। অনেকক্ষণ ধরে আয়নার সামনে সে দাঁড়িয়ে রইল সাবধানী চোখে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর আপন মনেই বলল, ‘যদি জিম রাগ না করে তাহলে বলবে সে আমাকে ঠিক কনি আইল্যান্ডের গাইয়ে মেয়ের মতো দেখাচ্ছে। কিন্তু আমার তো কোন উপায় ছিল না। এক ডলার সাতাশি সেন্ট দিয়ে কী কিনতে পারতাম আমি?
ঠিক সাতটার সময় কফি বানানো হয়ে গেল। চুলোর ওপরে কড়াই বসিয়ে রাখল। জিম এলেই গরম গরম ক’টা চপ ভেজে দেবে। কিন্তু এতো দেরি তো ও কোনোদিন করে নি। ডেলা সেই চেন হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে ঘরে ঢোকাবার দরোজার পাশে চুপ করে বসে রাইল। বাইরে সিঁড়ি থেকে ভেসে এল জিমের পায়ের আওয়াজ। ফেকাশে হয় গেল সে এক মহূর্তের জন্যে। ডেলার অভ্যেস ছিল প্রত্যেক কাজের আগে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা। সে ফিস ফিস করে উচ্চারণ করল, ‘হে ঈশ্বর, আমাকে কুৎসিত দেখাচ্ছে বলে জিম যেন রাগ না করে’।
ঘরে ঢুকে জিম দরোজা বন্ধ করে দিল। কেমন শুকনো আর গম্ভীর দেখাচ্ছে ওকে। বেচারা ! মাত্র বাইশ বছর বয়সে সংসারের ঝামেলায় পড়ে গেছে। একটা ওভারকোটও নেই। বেচারা!
জিম বিহ্ববল হয়ে, বোকা হয়ে দরোজার সামনে নিশ্চল হয়ে গেল। একদৃষ্টে চেয়ে রইল ডেলার দিকে। আর তার চোখের সেই শূন্য দৃষ্টির সামনে ডেলা কুঁকড়ে এল, এতাটুকু হয়ে গেল। তার চোখে রাগ ছিল, বিষ্ময় ছিল না, কিছুই ছিল না। ডেলা যা ভেবেছে তার কোন ছায়াই সেখানে নেই। সে শুধু একদৃষ্টি তাকিয়ে রইল ডেলার দিকে অদ্ভুত ভাবে।
ডেলা সরে এল কাছে। কান্না-ভাঙা গলায় বলল, ‘জিম, জিম অমন করে তাকিও না। আমি চুল বিক্রি করে ফেলেছি-বড়দিনে তোমাকে কিছু না দিয়ে থাকতে পারব না, সে জন্যে। আবার তো চুল বড়ো হয়ে যাবে, তুমি আমায় একটুও বোকো না। এছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আমার চুল খুব তাড়াতাড়ি বাড়ে। এসো বড়োদিনের আনন্দ করি। দেখো, তোমার জনে্য কী কিনে এনেছি, তুমি ভাবতেও পারবে না-দেখো’।
জিম যেন এখনও কিছুই বুঝতে পরে নি। কিছুই দেখে নি। সে শুধু উচ্চারণ করল, তুমি চুল কেটে ফেলেছ’?
‘হ্যা, বিক্রি করেছি। চুল ছাড়া কি আমাকে দেখতে খুব খারপ লাগছে,?
জিম অদ্ভুত ভাবে ঘরের চারিদিকে তাকাল। বোকার মতো বলল:
‘সব চুল কেটে ফেলেছ’?
‘হ্যাঁ, বিক্রি করে ফেলেছি। সব দোকানে চলে গেছে। আজ বড়দিনের সন্ধে। তোমার জন্যেই এ কাজ করেছি। আমার চুল হয়তো গোনা যাবে, কিন্তু তোমাকে যে আমি কতো ভালোবাসি কী করে তার হিসেব দেব। চপগুলো কী গরম করব ? ডেলা মিষ্টি সুরে বলল।
জিম যেন এতক্ষণে চৈতন্য ফিরে পেল। জড়িয়ে ধরল ডেলাকে।
আপনি এখানে একটা কথার জবাব দিন- সপ্তাহে আট পাউন্ড আর বছরে একলাখ,দুয়ের ভেতরে কী তফাৎ? একজন অঙ্ক শাস্ত্রবিশারদ যা উত্তর দেবেন তা এখানে মিথ্যে। আজ দুজন পরস্পরের জন্য যে উপহার এনেছে সে সব জিনিসে তাদের আর প্রয়োজন নেই। এই রহস্যময় উক্তি একটু পরেই পরিষ্কার বোঝা যাবে।
জিম তার কোটের পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে টেবিলের ওপর রাখল। বলল, ‘আমাকে ভুল বুঝো না ডেলা। চুল থাকলেও বা না থাকলেও আমার ভালোবাসার কোন তারতম্য কোনোদিন ঘটবে না। একই ভাবে তোমাকে ভালোবাসবো আমি। কিন্তু যদি ওই প্যাকেট ছিঁড়ে ফেলল। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সে। তারপরই বিষাদে ম্লান হয়ে এল। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
দ্রুমহাতে ডেলা নারোম আঙুলে প্যাকেট ছিড়ে ফেলল। উল্লাসে চিৎকার করে উঠল সে। তারপরই বিষাদে ম্লান হয়ে এল। কান্নায় ভেঙে পড়ল সে।
হাতে তার নোতুন চিরুনি- আর মাথা আঁচড়াবার সাজসরঞ্জাম। কতো দিন। ব্রডওয়ের দোকানে এই সেট দেখে কিনতে চেয়েছেও । সুন্দর হাড়ের তৈরি, পাথর বসানো কিনারা। আর বঙটা এতো মানানসই যে চুলে দিলে বোঝা যায় না যে, চিরুনি আছে। ডেলা জানে অনেক অনেক দাম এগুলোর। তবুও সে ব্যথিত হৃদয়ে কতদিন ভেবেছে- আহা, সে যদি কিনতে পারত। আজ সে তা পেয়েছে, কিন্তু কি হবে তা দিয়ে? তার চুল আজ আর নেই ।
সে বুকের ওপর জড়িয়ে ধরল চিরুনিটা তারপর আলতো চোখ তুলে খুশি ভরা গলায় বলল, ‘তাতে কি? আমার চুল শিগগিরই বড়ো হয়ে যাবে’। তারপর ডেলা খুশিতে নেচে উঠল।
জিম এখনো তার নিজের জন্যে কেনা উপহার দেখে নি। ডেলা মেলে ধরল সেটা এবার তার সামনে। উজ্জ্বল চেনটা তার হাতে আলোয় ঝকমক করছে।
‘বেশ সুন্দর না জিম? সব দোকান খুঁজে কিনেছি। দাও, তোমার ঘড়িটা দাওতো, আমি নিজের হাতে লাগিয়ে দেব’।
কিন্তু তা না দিয়ে জিম চেয়ারে এলিয়ে পড়ল। দুহাত মাথার পেছনে রেখে সে যেন কেমন হয়েগেল। হাসল, একটু হাসল, তারপর বলল, ‘ডলা , কিছুক্ষণের জন্যে উপহার পাশে রেখে দাও। এতো ভালো আর দামি ওগুলো যে সব সময় ব্যবহার করা যাবে না। আসল কথা কী জানো, তোমার চিরুনি কেনবার জন্যে আমি আমার ঘড়িটা বিক্রয় করে দিয়েছি। দাও এবার চপটা ভেজে দাও।
সেই রাজন্য বর্গ অত্যান্ত জ্ঞানী- যারা একদিন সেই নবজাত শিশুর জন্যে উপহার বয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তারাই বড়দিনে উপহার দেবার নিয়ম চালু করেছিলন। তারা জ্ঞানী ছিলেন। তাই এমন উপহার হয়তো এনেছিলেন তারা যাতে করে দুটো উপহার এক হয়ে না যায়, বদলে নেওয়া যায়। আর এখানে আমি দুটি সরল হৃদয়ের গল্প বলেছি। তারা পরস্পরের জন্যে নিজের শ্রেষ্ঠ ধন বিসর্জন দিয়েছিল। কিন্তু একথা সত্যি যে, আজকের এই বড়োদিনে তাদের উপহারই শ্রেষ্ঠতম। যারা উপহার দেন তারা আছেন। তারা হচ্ছেন সেই রাজন্যবর্গ। আর আমাদের এই দুটি নায়ক-নায়িকা, এরা আজ ঐ সব রাজাদের চেয়েও জ্ঞানী, তাদের চেয়েও বোধ করি সুখী।
১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:২৫
কোবিদ বলেছেন:
ধন্যবাদ মহামহোপাধ্যায় আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য্।
ভালো থাকবেন আর ভালো লেখা পড়বেন
২| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:১৪
আপেক্ষিক বলেছেন: ধন্যবাদ। আমার প্রিয় একজন লেখক। ভালো লাগল
১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:২৬
কোবিদ বলেছেন:
অসংখ্য ধন্যবাদ আপেক্ষিক
জনপ্রিয় ছোট গল্পকার ও হেনরির
জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর জন্য
৩| ১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ১:১৩
নাজিম-উদ-দৌলা বলেছেন:
আমার মতে দা গ্রিন ডোর আর র্যান্সম রেড চিফ - এই দুইটা ওনার বেস্ট গল্প।
স্যারকে সদা স্যালুট জানাই তার রেখে যাওয়া অমর কীর্তি গুলর জন্য
১২ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:২৪
কোবিদ বলেছেন: ধন্যবাদ জনাব নাজিম উদ দৌলা আপনাদের মন্তব্যের জন্য
ও. হেনরীর ছোট গল্প : দি লাস্ট লিফ
ওয়াশিংটন স্কয়ারের পশ্চিমে এক ছোট জেলা, যেখানে রাস্তাগুলো অনিরাপদভাবে ছুটে চলেছে এবং ভেঙে ভেঙে নিজেদের ভিতরে ছোট ছোট ‘গলি’ তৈরী করেছে। এই গলিগুলোতে গড়ে উঠেছে অদ্ভুত সব কোণা কানছি আর বাঁক। একটি রাস্তা নিজের উপর দিয়ে এক দুইবার করে অতিক্রম করে গেছে। একবার এক চিত্রশিল্পী এই রাস্তাটির মাঝে এক মূল্যবান সম্ভাবনা আবিষ্কার করে বসলেন। মনে করুন, একজন সংগ্রাহক রঙ, কাগজ এবং ক্যানভাসের জন্য বিল সাথে নিয়ে এই পথের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎকরে দেখল সে আগের জায়গায়ই ফিরে এসছে, এর জন্য তাকে এক পয়সাও খরচ করতে হয় নি!
তাই, চিত্রশিল্পীরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এই অদ্ভুত পুরনো গ্রিনিচ গ্রামে চলে এল, খুঁজে বের করল উত্তর দিকের জানালাসহ আঠার শতকের পুরনো গ্যাবল (ডাচ গ্যাবল জ্যাকোবিয়ান সময়ের ইংল্যান্ডের বিশেষ স্থাপত্যের বাড়ী), কম ভাড়ায় এক ডাচ চিলেকোঠা। এরপর তাঁরা ছয় নম্বর এভিনিউ থেকে রান্না করা ও খাবার গরম রাখার জন্য চুল্লিযুক্ত দুই একটি পাত্র এবং কিছু পিউটর মগ নিয়ে এসে এখানে কলোনি গড়ল।
তিন তালা পাকা বাড়িটির নীচ তলায় ছিল সিউ ও জনসির স্টুডিও। ‘জনসি’ জোয়ান্না নামে পরিচিত ছিলেন। একজন এসেছিল মেইন থেকে, অন্যজন ক্যালিফোর্নিয়া। আট নম্বর স্ট্রীটের “ডেলমনিকো’স” হোটেলের খাবার টেবিলে তাঁদের পরিচয় হল এবং তাঁরা দেখলেন শিল্প, চিকরি সালাদ ও বিশপ স্লিভ (ফুল হাতার জামা বিশেষ) এ তাঁদের রূচির অনেক মিল, যার ফলশ্রুতিতে এই যৌথ স্টুডিওটি দাঁড়িয়ে গেল।
সময়টা ছিল মে মাস। নভেম্বরে এক শীতল, অদেখা আগন্তুক, যাকে ডাক্তাররা ডাকত নিউমোনিয়া, কলোনিতে জেকে বসল, তাঁর হিমশীতল আঙুলগুলো এখানে সেখানে স্পর্শ করল। এই ধ্বংসকারী দুঃসাহসিকভাবে লম্বা লম্বা পা ফেলে পূর্ব দিকে এগোলেন, তার শিকারকে আঁচড় বসিয়ে সজোরে আঘাত করলেন, কিন্তু এই সরু ও শেওলা পড়া গোলক ধাঁধার ‘গলি’ দিয়ে তার পা আস্তে আস্তে পথ মাড়াল।
একজন আদর্শ নাইট, বয়স্ক সজ্জন ব্যক্তিকে আপনি যা ডাকতে পারেন, নিউমোনিয়া সাহেব তেমনটি নন। ক্যালিফোর্নিয়ার মৃদুমন্দ পশ্চিমা বায়ুর সহানুভূতির পাত্র রক্তশূন্য ছোট মেয়েটি ছিল লাল মুঠো, স্বল্পস্থায়ী শ্বাস-প্রশ্বাসের নির্বোধ বুড়োটার জন্য নামেমাত্র বৈধ আক্রমণস্থল। তাই জনসিকে সে সজোরে আঘাত করে বসল; জনসি বিছানায় পড়ে গেল, হাঁটা চলা করত না বললেই চলে, নিজের আলপনা আঁকা লোহার খাটে শুয়ে শুয়ে ছোট ডাচ জানালার শার্সির কাচের ভিতর দিয়ে সামনের পাকা বাড়িটার শূন্য দিকটায় চেয়ে থাকত।
একদিন সকালে সিউয়ের আমন্ত্রণে উস্কখুস্ক, ধূসর ভ্রু’র এক ব্যস্ত ডাক্তার বিল্ডিংয়ে এলেন।
“তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশে এক ”, ডাক্তার তাঁর ক্লিনিক্যাল থার্মোমিটারের পারদ ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, “এবং তাঁর জন্য এই সম্ভাবনাটি হল তাঁর নিজের বেঁচে থাকার ইচ্ছা। শেষ সীমানায় পৌছে যাওয়া মানুষ জন এই উপায়েই আবার ফিরে আসে – যে সীমানায় মৃত্যুদূত সমগ্র ফার্মাকোপিডিয়াকে নিরর্থক বানিয়ে ফেলে। আপনার এই ছোট মেয়েটি নিজের মনকে বুঝিয়েছে সে আর সুস্থ হতে যাচ্ছে না। তাঁর মনে এছাড়া আর অন্যকিছু আছে কি?”
“সে – সে কিছুদিন নেপলস উপসাগরকে আঁকতে চেয়েছিল।”, সিউ বলল।
“চিত্রাঙ্কণ? – নাহ! তাঁর মনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো চিন্তা দুইবার এসেছিল কি – যেমন ধরুন কোনো মানুষকে নিয়ে?”
“কোনো মানুষ?”, জিউ’স হার্পের (এক ধরণের বাদ্য বিশেষ) টুং টাং শব্দের মত কর্কশ নাকি সুরে সিউ বলল, “কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ – কিন্তু, না, ডাক্তার; এমন কিছু হয় নি।”
“আচ্ছা, এটাই তাহলে তাঁর দুর্বলতা”, ডাক্তার বলল। “আমার সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব, বিজ্ঞান অনুসারে আমি তার সবটুকুই করব। কিন্তু যখনই আমার রোগী তাঁর শব যাত্রার দিন গুনতে শুরু করবে, আমি ঔষধের উপশম-সহায়ক ক্ষমতা অর্ধেকে নামিয়ে নিয়ে আসবো। নতুন শীতের ধরনে তাঁর ক্লোক স্লিভে (ফুল হাতার আলখাল্লা বিশেষ) কেমন লাগছে যদি আপনি তাঁকে প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করতে পারতেন, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়ে দশে একের পরিবর্তে পাঁচে এক হবে।”
ডাক্তার চলে গেলে, সিউ তাঁর ওয়ার্করুমে গিয়ে নরম জাপানী ন্যাপকিনে মুখ ঢেকে কাঁদলেন। এরপর সে তাঁর ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে তর্জন গর্জন করতে করতে জনসির রুমে গিয়ে সিটি বাঁজিয়ে র্যাগটাইম (১৯২০ এর দশকের নিগ্রোদের জনপ্রিয় গান) গাইতে লাগলেন।
জনসি কাঁথার নিচে বড়ো জোর একটু নড়াচড়া করে, জানালার দিকে মুখ করে শুয়ে রইল। সিউ সিটি বাঁজানো থামিয়ে ভাবলেন, জনসি ঘুমিয়ে আছে।
সে তাঁর বোর্ড সাজিয়ে ম্যাগাজিনের গল্প ফুটিয়ে তোলার জন্য কলম-কালি দিয়ে চিত্র আঁকতে শুরু করলেন। একজন নবীন চিত্রশিল্পীকে শিল্পকলায় প্রতিষ্ঠা পেতে হলে অবশ্যই ম্যাগাজিনের গল্পের জন্য চিত্র আঁকতে হয়, যেমন একজন নবীন লেখককে প্রতিষ্ঠা পেতে গল্প লিখতে হয় ম্যাগাজিনের জন্য।
সিউ ঘোড়-দৌড়ে পড়ার জন্য এক জোড়া রুচিশীল পায়জামা এবং গল্পের নায়ক, এক ইডাহো (যুক্তরাষ্ট্রের একটি অঙ্গরাজ্য) রাখালের একপার্শ্বিক চিত্রের স্কেচ আঁকছিলেন, তখন সে বেশ কয়েকবার পুনরাবৃত্তিসহ নিচু স্বরের একটি শব্দ শুনতে পেলেন। সে দ্রুত বিছানার পাশে ছুটে গেলেন।
জনসির চোখ পুরোপুরি খোলা ছিল। সে জানালার বাইরে তাঁকিয়ে গুনছিল – উল্টো দিক থেকে গননা।
“বারো”, সে বলল, এবং অল্প সময় পরে, “এগারো”; এরপর “দশ”, “নয়”; “আট”, সাত”, প্রায় এক সাথেই।
সিউ উৎকণ্ঠিতভাবে জানালার বাইরে তাঁকালো। কি আছে সেখানে গোনার মতো? সেখানে দেখা যাচ্ছিল এক শূন্য, বিষণ্ণ উঠোন, এবং কুড়ি ফুট দূরে এক পাকা বাড়ির শূন্য অংশ। একটি পুরনো, গাঁটযুক্ত ও ক্ষয়ে যাওয়া শিকড়যুক্ত বয়স্ক আইভি লতা ইটের দেয়ালের অর্ধেকটায় বেয়ে উঠেছিল। পরিত্যক্ত ইটের দেয়ালে প্রায় শূন্য লতাটির কাঠামো প্রশাখা দৃঢ়ভাবে লেগেছিল, যতক্ষন পর্যন্ত না হেমন্তের শীতল হাওয়া লতাটি থেকে পাতাগুলোকে দুর্বল করে ফেলেছিল।
“কি করছো, সোনা?” সিউ জিজ্ঞাসা করল।
“ছয়”, প্রায় ফিসফিস করে বলল জনসি। “ওরা এখন খুব দ্রুত পড়ে যাচ্ছে। তিন দিন আগেও প্রায় একশটা ছিল। ওগুলো গুনতে গুনতে আমার মাথাটা ধরে এসেছিল। কিন্তু এখন সহজ হয়ে এসেছে। আরেকটা পড়ে গেল। এখন আর মাত্র পাঁচটি বাকি আছে।”
“পাঁচটি কি, সোনা? তোমার সিউডিকে বলো?”
“পাতা। আইভি লতার। যখন শেষ পাতাটি পড়ে যাবে, আমিও অবশ্যই চলে যাবো। তিন দিন হল এটি আমি জেনেছি। ডাক্তার কি তোমাকে বলে নি?”
“ওহ! এই ধরনের অর্থহীন কথা আমি আর কখনো শুনি নি,” আশ্চর্যরকম অবজ্ঞার সুরে অভিযোগ করে বলল সিউ। “তোমার সুস্থ হয়ে যাওয়ার সাথে বুড়ো আইভি পাতার কি সম্পর্ক? তুমি ঐ লতাকে খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছো, দুষ্ট মেয়ে। বোকার মত আচরন করো না। কেন, ডাক্তার তো আজ সকালেই আমাকে বলল তোমার দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবার ভালো সম্ভাবনা আছে – মনে আছে তোমার, ডাক্তার ঠিক কি বলেছিল – সে বলল, সম্ভাবনা দশে এক! কেন, এটা তো প্রায়ই একটি ভালো সম্ভাবনা হতে পাড়ত যদি আমরা নিউ ইয়র্কে স্ট্রিট কারে চড়ে ঘুরে বেড়াতাম অথবা একটি নতুন বিল্ডিংয়ের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতাম। এখন কিছুটা স্যুপ খাওয়ার চেষ্টা করো এবং তোমার সিউডিকে তাঁর ড্রয়িংয়ের কাছে আবার ফিরে যেতে দাও, যাতে সে ওগুলো সম্পাদক সাহেবের কাছে বিক্রি করে তাঁর অসুস্থ বাচ্চাটার জন্য পোর্ট ওয়াইন (পর্তুগালের গাঢ় লাল বা সাদা, উগ্র, মিষ্ট মদ বিশেষ) এবং নিজের জন্য লোভনীয় শুকরের চপ কিনতে পারে।”
“তোমাকে আর ওয়াইন কিনতে হবে না,” জানালার বাইরের তাঁর দৃষ্টি স্থির রেখে, জনসি বলল। “আরেকটা পড়ে গেল। না, আমি কোনো স্যুপ চাই না। আর মাত্র চারটা পাতা আছে। অন্ধকার নেমে আসার আগেই আমি শেষ পাতাটির পড়ে যাওয়া দেখতে চাই। এর পরে আমিও চলে যাবো।”
“জনসি, সোনা,” তাঁর উপর নুয়ে পড়ে সিউ বলল, “তুমি কি আমাকে কথা দিবে, তোমার চোখদুটো বন্ধ রাখবে, এবং যতক্ষন পর্যন্ত আমার কাজ শেষ না হয় তুমি জানালার বাইরে তাঁকাবে না? আমাকে ছবিগুলো কালকেই জমা দিতে হবে। আমার আলো দরকার, না হলে আমি পর্দা টেনেই আঁকতাম।”
“তুমি অন্য রুমে গিয়ে আঁকতে পারো না?” নিষ্প্রাণভাবে বলল জনসি।
“আমাকে এখানে তোমার পাশেও থাকতে হবে,” সিউ বলল। “এছাড়া, আমি চাই না তুমি ঐসব তুচ্ছ আইভি পাতার দিকে তাঁকিয়ে থাকো।”
“তোমার কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই আমাকে বোলো,” ফ্যাকাশে ও ভূপতিত স্ট্যাচুর মত শুয়ে থেকে, চোখদুটো বন্ধ রেখে জনসি বলল, “কারন আমি শেষ পাতাটির পড়ে যাওয়া দেখতে চাই। আমি অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। আমি ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত। আমি সকল বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে চাই, ক্রমশ ডুবে যেতে চাই, ঠিক ঐসব নিঃস্ব, ক্লান্ত পাতাগুলোর মত।”
“ঘুমোতে চেষ্টা করো,” সিউ বলল। “বৃদ্ধ নির্জনবাসী খনি-শ্রমিকের মডেল হবার জন্য আমাকে বেহরম্যানকে ডাকতে যেতেই হবে। আমার যেতে এক মিনিটও লাগবে না। আমি না ফেরা পর্যন্ত নড়াচড়ার চেষ্টা করো না।”
বৃদ্ধ বেহরম্যান ছিলেন একজন পেইন্টার, যিনি তাঁদের নিচে গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকতেন। ষাট পেরোনো এই বুড়োর মাইকেল এঞ্জেলোর ‘মোজেসে’র মত দাড়ি ছিল, যেন স্যাটারের মাথা থেকে কোঁকড়িয়ে নিচে নেমে এসেছে এবং দেহখানা খুদে শয়তানের মতো। (ইতালীর বিখ্যাত চিত্রকর ও ভাস্কর মাইকেল এঞ্জেলোর ভাস্কর্য ‘মোজেস’; দুই সুশোভিত মার্বেল স্তম্ভের মাঝখানে মার্বেল চেয়ারে বসা মোজেস, যার দীর্ঘ দাড়ি কোলের উপরে এসে পড়েছে। মোজেস ইসলাম ধর্মে মুসা নবী নামে পরিচিত ও ইহুদী ধর্মের প্রবর্তক। স্যাটার গ্রীক ও রোমান পুরানে উল্লেখিত অর্ধমানব ও অর্ধপশুরূপী বনদেবতা।) বেহরম্যান চিত্রশিল্পে ছিলেন ব্যর্থ। চল্লিশ বছর ধরে ব্রাশ ঘষেও তাঁর গিন্নীর গাউনের আঁচলের কাছাকাছি কিছু একটা আঁকতে পারেন নি। সে সবসময় তাঁর শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি আঁকার কথা ভাবত, কিন্তু কখনোই সেটা শুরু করতে পারে নি। বেশ কয়েক বছর ধরে, কিছু ইতঃস্তত বাণিজ্যিক ও বিজ্ঞাপনী আনাড়ি চিত্র আঁকা ছাড়া তেমন কিছুই করতে পারে নি সে। কলোনির নবীন আঁকিয়ে যাদের পেশাদার চিত্রশিল্পীর মতো অর্থ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাঁদের মডেল হিসেবে কাজ করে সে অল্প কিছু উপার্জন করত। সে মাত্রাতিরিক্ত জিন (মদ বিশেষ) পান করত এবং সবসময় তাঁর আসন্ন শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মটি সম্পর্কে কথা বলত। বাকিটা সময় সে ছিল একজন রাগী ছোটখাটো বুড়ো মানুষ, অন্যের স্নেহ-মমতা পাওয়ার জন্য যে ছিল ক্ষুধার্ত, এবং নিজেকে গণ্য করেছিল অপেক্ষমান বিশেষ মাস্টিফ (প্রহরাকাজে দক্ষ, বড় আকারের শক্তিশালী কুকুর বিশেষ) হিসেবে যে উপরের স্টুডিওটির দুই নবীন চিত্রশিল্পীকে বাঁচাতে যাচ্ছিলেন।
সিউ বেহরম্যানকে তাঁর অনুজ্জ্বলভাবে আলোকিত আস্তানায় প্রবলভাবে জুনিপার (চিরসবুজ গুল্ম বিশেষ) ফলের ঘ্রাণ নিতে দেখতে পেলেন। এক কোণায় কাঠের ফ্রেমে একটি শূন্য ক্যানভাস সাজানো ছিল, শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটির রূপ পেতে প্রথম রেখাটির জন্য যা পচিশ বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে। সিউ বেহরম্যানকে জনসির অবাস্তব কল্পনার কথা বলল, বলল কতটা শঙ্কিত দেখাচ্ছে তাঁকে, নিজেকে তুচ্ছ ও ঠুনকো পাতার মত ভাবছে, ভেসে চলে যাচ্ছে দূরে, পৃথিবীর প্রতি তাঁর ক্ষুদ্র বন্ধন ক্রমশ দুর্বলতর হচ্ছে।
বুড়ো বেহরম্যানের রক্তিম চোখদুটোতে অশ্রুর বন্যা বেয়ে গেল, সে চেঁচিয়ে এই নির্বোধ ধরনের কল্পনাকে অবজ্ঞা ও উপহাস করল।
“ধুর!” সে কেঁদে ফেলল। “পৃথিবীতে এমন লোকও আছে, যারা তাঁদের নির্বুদ্ধিতার জন্য মারা যাবে, এক দুর্দশাগ্রস্ত লতা থেকে পাতাগুলো ঝরে পড়ে যাচ্ছে এই কারনে? আমি এই ধরনের কথা আগে কখনো শুনি নি। না, আমি আপনার বোকা নির্জনবাসী – নির্বোধ ব্যক্তির মডেলের পোজ দিতে পারব না। এই ধরনের বোকাটে কারবার কেন আপনি তাঁর মাথায় আসতে দিলেন? আহ, বেচারা ছোট্ট মিস জনসি।”
“সে এখন খুবই অসুস্থ ও দুর্বল,” সিউ বলল, “ এবং জ্বর তাঁর মনটাকে অসুস্থ করে দিয়েছে, আজব সব অবাস্তব কল্পনায় তাঁর মন ভরে উঠেছে। খুব ভালো, বেহরম্যান সাহেব, যদি আপনি আমার জন্য পোজ দিতে না চান, আপনাকে প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি একজন কুৎসিত বুড়ো – গল্পগুজবপ্রিয় বুড়ো ফচকে।”
“আপনিও আর দশটা মেয়ে মানুষের মতো!” চেঁচিয়ে উঠল বেহরম্যান। “কে বলল আমি পোজ দিব না? চলুন। আমি আপনার সাথে যাচ্ছি। আধা ঘন্টা ধরে আপনাকে আমি বলার চেষ্টা করছি, পোজ দিতে আমি প্রস্তুত। হায় ইশ্বর! এমন কোনো জায়গা থাকতে পারে না যেখানে মিস জনসির মতো একজন ভালো মানুষকে অসুস্থ হয়ে পড়তে হবে। একদিন আমি আমার শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্মটি আঁকব, এবং একদিন আমাদের সবাইকে চলে যেতে হবে। হায় ইশ্বর! হ্যাঁ।”
তাঁরা উপরের তলায় যখন গেল, জনসি তখন ঘুমোচ্ছিল। সিউ জানালার চৌকাঠ পর্যন্ত পর্দা টেনে দিয়ে বেহরম্যানকে ইশারা করে অন্য রুমে যেতে বলল। সেখানে তাঁরা ভয়ের সাথে জানালার বাইরে উকি দিয়ে আইভি লতাটিকে দেখল। এরপর তাঁরা নিশ্চুপ থেকে কিছু সময়ের জন্য একে অপরের দিকে তাঁকালো। তুষারপাতসহ অবিরামভাবে শৈত্য বৃষ্টি পড়ছিল। বেহরম্যান তাঁর পুরনো নীল শার্টটি গায়ে চড়িয়ে, উল্টে রাখা কেটলির উপর অবিচলিতভাবে নির্জনবাসী খনি – শ্রমিকের মত বসে পড়ল।
পর দিন সকালে সিউ যখন তাঁর এক ঘন্টার ঘুম থেকে জেগে উঠল, জনসিকে দেখতে পেল মলিন, পুরোপুরি খোলা চোখ নিয়ে এক দৃষ্টিতে টেনে দেয়া সবুজ পর্দাটার দিকে তাঁকিয়ে আছে।
“এটাকে উপরে টেনে দাও; আমি দেখতে চাই,” জনসি ফিসফিসিয়ে নির্দেশ দিল।
সিউ ক্লান্তভাবে নির্দেশ পালন করলেন।
কিন্তু, দেখুন! সারা রাত ধরে তীব্র বৃষ্টিপাত ও আকষ্মিক প্রবল ঝড়ো হাওয়া সহ্য করার পরেও, ইটের দেয়ালে একটা আইভি পাতা তখনো টিকে আছে। এটা ছিল লতাটির শেষ পাতা। কান্ডের কাছে এটি এখনো গাঢ় সবুজ; মলিন ও ক্ষয়ে যাওয়া খাঁজ কাটা হলুদ প্রান্ত নিয়েও মাটি থেকে কুড়ি ফুট উপরে এক প্রশাখার সাথে চমৎকারভাবে ঝুলে আছে।
“এটাই শেষ পাতা,” জনসি বলল, “আমি ভেবে ছিলাম, এটা নিশ্চিতভাবেই কাল রাতে পড়ে গেছে। আমি বাতাসের শব্দ শুনেছিলাম। এটা আজকে পড়ে যাবে, এবং তখন আমিও মরে যাবো।”
“সোনা, সোনা!” সিউ তাঁর মলিন মুখখানা বালিশে চেপে বলল, “যদি তুমি তোমার কথা ভাবতে না চাও, তবে আমার কথা ভাবো। তাহলে আমি কি করব?”
কিন্তু জনসি কোনো উত্তর দিল না। একটি আত্না যখন তাঁর রহস্যময়, দূরের যাত্রার জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখন এটি হয়ে দাঁড়ায় পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি একাকী আর দুঃখকাতর কোনো অস্তিত্ব। অবাস্তব কল্পনা তাঁর মাঝে এত প্রবলভাবে ভর করে যেন সব ধরনের বন্ধন যা তাঁকে বেঁধে ছিল বন্ধুত্বের মাঝে, পৃথিবীর সাথে, এক এক করে মুক্ত হয়ে যায়।
দিন পেরিয়ে গেল, এমনকি গোধূলির সময়ও তাঁরা নিঃসঙ্গ আইভি পাতাটিকে দেয়ালের উপর তার কান্ডের সাথে দৃঢ়ভাবে এঁটে থাকলে দেখল। এবং এরপর, রাত নেমে এলে উত্তরীয় হাওয়া আবার বইতে শুরু করল, জানালার উপর বৃষ্টি আছড়ে পড়ল সেদিনও এবং ছাদের সামনের দিকের নিচু অংশ দিয়ে টিপটিপ করে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ল।
যখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল, হৃদয়হীনা জনসি পর্দাটিকে উপরে টেনে দিতে আদেশ দিল।
আইভি পাতাটি তখনো সেখানে ছিল।
জনসি বিছানায় শুয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এটার দিকে তাঁকিয়ে থাকল। এরপর সে সিউকে ডাকল, সিউ তখন গ্যাসের চুল্লীর উপর রাখা চিকেন স্যুপকে চামচ দিয়ে নেড়ে দিচ্ছিল।
“আমি খারাপ মেয়ে হয়ে গেছি, সিউডি,” জনসি বলল, “কোনো একটা কারনে শেষ পাতাটি সেখানে থেকে গিয়ে আমাকে দেখাচ্ছে কতটা মন্দ আমি। মরতে চাওয়াটা পাপ। তুমি আমাকে অল্প একটু স্যুপ এনে দাও, আর কিছু পরিমান দুধের সাথে অল্প একটু পোর্ট ওয়াইন, আর – না; প্রথমে তুমি আমার জন্য একটা হাত-আয়না নিয়ে আসো, এর পর আমার কিছু বালিশ জড়ো করো, আমি এর উপর বসে তোমার রান্না করা দেখব।”
এবং ঘন্টাখানেক পর সে বললঃ “সিউডি, আশা করি এক দিন আমি নেপলস উপসাগরকে আঁকতে পাড়ব।”
ডাক্তার বিকেলের দিকে এল, এবং সিউ ওজর দেখিয়ে ডাক্তারের সাথে বারান্দার দিকে গেল।
“এমনকি সুযোগ পেলে,” ডাক্তার সিউয়ের সরু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ঝাকাতে ঝাকাতে বলল, “ভালো সেবা দিয়ে আপনি জয়ী হবেন।” “এখন আমাকে নীচতলার আরেকজন রোগীকে অবশ্যই দেখতে যেতে হবে। বেহরম্যান,তাঁর নাম – এক প্রকার চিত্রশিল্পী বলতে পারেন, আমি বিশ্বাস করি, তাঁরও নিউমোনিয়া হয়েছে। সে একজন বুড়ো, দুর্বল মানুষ, এবং আক্রমণটাও খুব মারাত্নক। তাঁর বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই; তবুও সে আজ হাসপাতালে গিয়েছে আরো অধিক আরামবোধ করার জন্য।”
পরের দিন ডাক্তার সিউকে বলল, “সে এখন বিপদমুক্ত। আপনি জিতে গেছেন। পুষ্টিকর খাবার আর যত্ন – এখন শুধু এইটুকুই যথেষ্ট।”
জনসি যে বিছানায় শুয়েছিল সিউ সেই বিকেলে সেখানে এল, একটি গাঢ় নীল এবং ব্যবহারের একেবারেই অযোগ্য উলের তৈরী কাঁধের স্কার্ফ মনের আশ মিটিয়ে সেলাই করতে লাগল এবং অন্যহাত দিয়ে জনসি, তাঁর বালিশ এবং চারপাশে বুলাতে লাগল।
“আমার সাদা ইঁদুর, তোমাকে কিছু বলার আছে আমার,” সিউ বলল, “বেহরম্যান সাহেব আজ হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় মারা গেছে। সে মাত্র দুই দিন অসুস্থ ছিল। প্রথম দিন সকালে দাঁড়োয়ানেরা তাঁকে নীচতলায় তাঁর রুমে অসহায়ভাবে ব্যাথায় কাঁতারানো অবস্থায় পেয়েছিল। তাঁর জুতো ও কাপর–চোপড় ছিল ভেজা এবং বরফ শীতল। তারা কল্পনাও করতে পারে নি ঐ ভয়ঙ্কর রাতে সে কোথায় ছিল। এরপর তারা একটি লণ্ঠন দেখতে পেল, সেটা তখনো জ্বলছিল, এবং আর একটি মই যেটি এখান থেকে টেনে নেওয়া হয়েছিল, আর কিছু ইতস্তত ছড়ানো ব্রাশ এবং একটি প্যালেট (চিত্রশিল্পীদের রঙ গোলা ও মেশানোর জন্য ব্যবহৃত বোর্ডবিশেষ) যার উপর সবুজ এবং হলুদ রঙ মেশানো হয়েছিল – জানালার বাইরের দিকে দেয়ালের উপর শেষ আইভি পাতাটার দিকে একটু তাঁকাও, সোনা। তুমি কি একটুও বিস্ময়াভিভূত হও না কেন বাতাস বয়ে গেলে এটি দোলে না বা নড়াচড়া করে না? ওহ সোনা! এটাই বেহরম্যানের শ্রেষ্ঠচিত্রকর্ম – শেষ পাতাটি পড়ে যাবার পর সেদিন রাতে সেখানে সে এটি এঁকেছে।”
©somewhere in net ltd.
১| ১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৭:১২
মহামহোপাধ্যায় বলেছেন: ভালো লাগলো প্রিয় গল্পকারকে নিয়ে দেয়া পোস্টটি। ধন্যবাদ জানবেন।
এই গল্পটা মনে হয় কোন একসময় মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর পাঠ্য ছিল। আপু ভাইয়ার কাছে ছোটবেলায় শুনেছিলাম। আজ পড়তেও অনেক ভালো লাগলো। "দি গ্রিন ডোর" এবং "দি লাস্ট লিফ" এই গল্পদুটির জন্য ও হেনরির লেখা খুব ভালো লাগে।