নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাঙালি মহিয়সী নারী, তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার আদায়ে সংগ্রামী কৃষক নেত্রী ইলা মিত্র। বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যিনি স্বেচ্ছায় জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছিলেন, ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। কিন্তু থেমে যায়নি যাঁর আদর্শের লড়াই। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য লড়ে গেছেন যে সংগ্রামী, মহিয়সী নারী তিনি বাংলার কৃষকের রাণী'মা ইলা মিত্র। ১৯৪৬-৪৭ সালে ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি মাসে তখনকার পূর্ববঙ্গ (বাংলাদেশ) ও পশ্চিমবঙ্গে যে তেভাগা সংগ্রাম হয়েছিল তা ছিল যেমন বিরাট, তেমনি জঙ্গী। ৬০ লাখ দুঃস্থ ভাগচাষী হিন্দু, মুসলমান, উপজাতি মেয়ে-পুরুষ জীবনকে তুচ্ছ করে ঐ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। বাংলার মাটি হিন্দু, মুসলমান উপজাতি মেয়ে-পুরুষ কৃষকের রক্তে লালে লাল হয়ে পৃথিবী বিখ্যাত এক কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। সারা পৃথিবীতে যতগুলি বিরাট বিরাট কৃষক আন্দোলন আজ পর্যন্ত হয়েছে বাংলার তেভাগা আন্দোলন সেগুলির মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির পাশে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন ইলা মিত্র। ১৯৭১ সালে ইলা মিত্র ও তার স্বামী রমেন মিত্র বিভিন্নভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের সদর দপ্তর ছিল ইলা মিত্রের বাড়ি। এই কিংবদন্তি নেত্রী ৭৭ বছর বয়সে ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ১১তম মৃত্যুবাষির্কী। বাংলার লড়াই-সংগ্রামের কিংবদন্তি: কমরেড ইলা মিত্রের মৃত্যুৃদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
(কিশোরী ইলা মিত্র ও তার প্রাপ্ত পুরস্কার)
তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় ইলা মিত্র ছিলেন ইলা সেন। তাঁর বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বৃটিশ সরকারের অধীন বাংলার একাউন্টেন্ট জেনারেল। তাঁদের আদি নিবাস ছিল তৎকালীন যশোরের ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকুরির সুবাদে তাঁরা সবাই কলকাতায় থাকতেন। এ শহরেই তিনি বেড়ে ওঠেন, লেখাপড়া করেন কলকাতার বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯৪৪সালে স্নাতক শ্রেণীতে বি.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। পরে ১৯৫৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে এম এ ডিগ্রি লাভ করেন।ইলা সেন যখন বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বি.এ. সম্মানের ছাত্রী তখন থেকেই রাজনীতির সাথে তাঁর পরিচয় হয়। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। সময়টা ছিল ১৯৪৩ সাল, ইলা সেন কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হলেন৷ রাওবিল বা হিন্দু কোড বিল এর বিরুদ্ধে সে বছরই মহিলা সমিতি আন্দোলন শুরু করে। সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি সনাতনপন্থীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনেক প্রচার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। নারী আন্দোলনের এই কাজ করতে করতে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।
(স্বামী রমেন মিত্রের সাথে ইলা মিত্র)
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জমিদার মহিমচন্দ্রের পুত্র রমেন মিত্রের সাথে ১৯৪৫ সালে ইলা মিত্রের বিয়ে হয়। জমিদারি রক্ষণশীল পরিবারে বিয়ে হয়েও উদারপন্থী ইলা মিত্রের স্বস্তি ছিল না। তিনি সবসময় এই পরিবেশ থেকে মুক্তি চাইতেন মনে মনে। পরবর্তীতে স্বামী রমেন মিত্রের সহযোগিতায় গ্রামের নিরক্ষর মেয়েদের কাছে শিক্ষার আলো পৌঁছিয়ে দেয়ার কাজ শুরু করেন। ইলা মিত্রের স্বামীও কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ সদস্য হয়েছিলেন। এজন্য তাদের দুজনকে অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পোহাতে হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার চালানো হয়েছিল। এ অপপ্রচার নির্যাতিত কৃষকের আরো কাছে এনে দিয়েছে ইলা মিত্রকে। গরিব কৃষকরা যাতে তাদের ন্যায় অধিকার আদায় করতে পারে, আন্দোলন গড়ে তুলতে এবং সেই আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে পারেন সেজন্য তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ইলা মিত্র এক সংগ্রামের নাম। এক বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধির নাম। এক মানবতাবাদী নারীর নাম। যিনি সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বেচ্ছায় জীবনের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন। ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। তবুও থেমে যায়নি তার আদর্শের লড়াই। জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জন্য লড়ে গেছেন এই সংগ্রামী মহিয়সী নারী। শত অত্যাচার নীরবে সহ্য করে গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। কৃষক আন্দোলনে যোগ দিয়ে শোষিতের পাশে দাঁড়িয়েছেন আবার শিক্ষকতা করে অগণিত শিক্ষার্থীকে আলোর পথ দেখিয়েছেন।
(কলকাতায় আন্দোলনের সময় বন্দী ইলা মিত্র)
১৯৪৭-এ দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়। কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কমিউনিস্ট নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচারে অত্যাচার-নিপীড়ন চালানো হয়। এজন্য ইলা মিত্র ও তার স্বামীকে আত্মগোপনে থাকতে হয়। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ইলা মিত্র ও রমেন মিত্র। ছত্র ভঙ্গ কৃষকদের সংগঠিত করতে ইলা মিত্র ছুটে যান গ্রাম থেকে গ্রামে। ১৫০ জন কৃষককে পুলিশ হত্যা করে। নাচোল কৃষক আন্দোলন চিরতরে বন্ধ করে দিতে শাসকগোষ্ঠী গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। ইলা মিত্রের একনিষ্ঠ আত্মত্যাগের ফলে সাঁওতালদের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে উঠে। তিনি তাদের প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ দেন। শাসক গোষ্ঠী যখন সাঁওতাল অধ্যুষিত চন্ডিগড় গ্রামকে লক্ষ্য করে ১৯৫০ সালে অভিযান শুরু করে, তখন ইলা মিত্র সেখানেই ছিলেন। ইলা মিত্র সঙ্গীদের নিয়ে ওখান থেকে পালানোর সময় ৭ জানুয়ারি রেল স্টেশনে ধরা পড়েন। ধরা পড়ার পর ইলা মিত্রসহ অন্যদের নাচোল থানায় এনে নির্যাতন করা হয় নির্মমভাবে। ১৬ জানুয়ারি পুনরায় পুলিশ তার ওপর নির্যাতন চালায় এবং অর্ধচেতন অবস্থায় জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করেন। ১৯৫০ সালের ২১ জানুয়ারি নির্যাতনের কারণে সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় ইলা মিত্রকে রাজশাহী জেলে নিয়ে আসা হয়। একটি নির্জন অন্ধকার জেলে একাকী রাখা হয় তাকে। মুসলীম লীগ সরকার ইলা মিত্র, স্বামী রমেন মিত্রসহ ১০৭ জন সাঁওতাল কৃষকের বিরুদ্ধে মামলা করে। এদের মধ্যে ইলা মিত্র, রমেন মিত্র ও মাতাল সরকারকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হয়। ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দি অবস্থায় ৮ মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। কিন্তু তার শরীরের কোনো উন্নতি না হওয়ায় তাকে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা ফজলুল হকের উদ্যোগে ডাক্তারের পরামর্শে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। স্বামী রমেন মিত্র স্ত্রীর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে ভারতে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কংগ্রেস সরকার তাকে নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পরবর্তীতে রমেন মিত্রের স্ত্রী হিসেবে নাগরিকত্ব দেয়া হয়।
(১৯৯৮ সালে কামাল লোহানী ও তার স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর সাথে বিপ্লবী ইলা মিত্র)
নারী অধিকার বাস্তবায়নে ইলা মিত্র ছিলেন আশাবাদী। তার মতে শুধু মহিলাদের সংগঠিত হলেই হবে না। নারী মুক্তির জন্য সমাজ পরিবর্তন করতে হবে। ১৯৫৭ সালে ইলা মিত্র এমএ পাস করে কলকাতায় একটি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। তিনি ভারতের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনি রাজনীতির ওপর একাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। অনুবাদকও ছিলেন তিনি। কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে বিভিন্ন নারী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় ১৯৬২, ১৯৭০, ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে তাকে আবারো কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্ভীক আন্দোলনের অগ্রপথিক। তাকে থামানো যাবে না। এজন্য তিনি চারবার বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
কার্ল মার্ক্স দ্বারা প্রভাবিত ইলা মিত্র বেশ কয়েকটি রুশ গ্রন্থ অনুবাদ করেন। যথাঃ ১। জেলখানার চিঠি, ২। হিরোশিমার মেয়ে, ৩। মনে প্রাণে-২ খণ্ড, ৪। লেনিনের জীবনী, ৫। রাশিয়ার ছোট গল্প ইত্যাদি। হিরোশিমার মেয়ে বইটির জন্য তিনি 'সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু' পুরস্কার লাভ করেন এবং এ্যাথলেটিক অবদানের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ভারত সরকার তাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মানে "তাম্রপত্র পদক" এ ভূষিত করে সম্মানিত করে।
(ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নার্সদের সাথে অসুস্থ ইলা মিত্র)
২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর এই মহীয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ১১তম মৃত্যুবাষির্কী। কিংবদন্তি এই মহিয়সী নারীর শারীরিক মৃত্যু হলেও হাজারো বঞ্চিত মানুষের হৃদয়ে ইলা মিত্র আছেন, থাকবেন প্রতিক্ষণ।
বাংলার লড়াই-সংগ্রামের কিংবদন্তি: কমরেড ইলা মিত্রের মৃত্যুৃদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি
২| ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ২:৪৬
আরজু পনি বলেছেন:
ধন্যবাদ ।
প্রিয়তে রাখলাম ।
৩| ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৩ বিকাল ৫:০৬
সেলিম আনোয়ার বলেছেন: শ্রদ্ধাঞ্জলী ইলামিত্র ।
৪| ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৭:৫৫
তুহিন সরকার বলেছেন: বাংলার শোষিত ও বঞ্চিত কৃষকের অধিকার আদায়ে সংগ্রামী কৃষক নেত্রী কমরেড ইলা মিত্রের মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ধন্যবাদ কোবিদ সাহেব, শুভেচ্ছাসহ শুভকামনা রইল।
৫| ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:২৫
অস্পিসাস প্রেইস বলেছেন: শ্রদ্ধাঞ্জলী ইলামিত্র ।
৬| ১৪ ই অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৯:৩৪
বশর সিদ্দিকী বলেছেন: তার আদর্শে সাথে যদিও এক মত নই
তবুও কৃষকদের জন্য আন্দোলনে তার অবদানের জন্য শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
©somewhere in net ltd.
১| ১৩ ই অক্টোবর, ২০১৩ দুপুর ১:২৩
সৌভিক ঘোষাল বলেছেন: মনে হল আপনার এই চমৎকার লেখাটিকে শুধুই ধন্যবাদ জানাবো না, আজকের রাজনীতিতে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কেও কিছু বলব। নিচের লেখাটি সেকারণেই এখানে দিলাম। আপনার মতামত জানাবেন
-------
সম্প্রতি একটা খবর অর্থনীতির দুনিয়ায় খানিকটা বিষ্ময় মাখা কোতূহল তৈরি করেছে। ভালো বৃষ্টির ফলে এই বছরে কৃষিক্ষেত্রে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। যা অতীতের বছরগুলিতে দেড় দুই শতাংশের গড়ের প্রায় তিনগুণ। বলাই বাহুল্য কৃষি ক্ষেত্রে এই বিকাশ গ্রামের মানুষের হাতে যে অতিরিক্ত অর্থের যোগান দেবে তা অন্যান্য শিল্পদ্রব্যের চাহিদা বিকাশের মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনীতিকেও অনেকখানি চাঙ্গা করবে। এই খবরের সূত্র ধরে কৃষিক্ষেত্র নিয়ে সরকারী নীতির আমূল বদলের দাবিটি আরেকবার তোলার জন্যই এই লেখা।
বুর্জোয়া অর্থনীতি রাজনীতির জগতে একটা চালু ধারণা হল অর্থনীতির ব্যাপক উন্নয়নের প্রেক্ষিতে বেশিরভাগ মানুষের কৃষিতে যুক্ত হয়ে থাকা একটা দায়, একটা অতীতের অনভিপ্রেত রেশ, যা উন্নতির জন্য দ্রুত ঝেড়ে ফেলতে হবে। অধুনা অর্থনীতির যা কিছু সম্ভাবনা তা নাকি কিছুটা শিল্পে (যা মূলত রপ্তানীমুখী চরিত্রের হওয়া বাঞ্ছনীয়) আর পরিষেবায়। সারা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে জিডিপির ক্ষেত্রে কৃষির স্বল্প অবদানের বিষয়টাকে উদাহরণ হিসেবে দেখিয়ে ভারতকেও সেই অভিমুখে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখান বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদ রাজনীতিবিদেরা।
আমাদের দেশের একটা বড় সংখ্যক মানুষ এই শিল্প বা পরিষেবার গ্রহীতা হওয়ার যায়গাতেই নেই তাদের চরম দারিদ্রের কারণে। অর্জুন সেনগুপ্ত কমিটির রিপোর্ট ব অন্যান্য অনেক রিপোর্ট দেখিয়েছে দেশের ৭৭ শতাংশ মানুষ দিনে কুড়ি টাকার বেশি ব্যয় করতে পারেন না। আমাদের শিল্প আর পরিষেবার বন্টনের চরিত্রটা তাই বাধ্যতামূলকভাবে দেশের একটা ছোট অংশের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ অথবা রপ্তানীমুখী। শিল্প/পরিষেবার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণের পুঁজির জন্য মূলত নির্ভর করা হয় বিদেশী বিনিয়োগের ওপর। কোনও কারণে ডলার বিনিয়োগে ঘাটতি হলে বা বিনিয়োগকৃত ডলার ফেরতের প্রক্রিয়া শুরু হলে গোটা অর্থনীতি জুড়ে ত্রাহি ত্রাহি রব পড়ে।
আমাদের জাতীয় অর্থনীতিকে মজবুত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে গেলে এদেশের ষাট শতাংশ মানুশ যে কৃষির সাথে জড়িত, সেই কৃষিতে পুঁজি বিনিয়োগ কয়েক গুণ বাড়ানো দরকার। আমাদের দেশে কৃষিতে যে পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে তা মূলত ব্যক্তিপুঁজি। সেটা ধনী চাষী বা কুলাকদের বড় পরিমাণ বিনিয়োগ হোক বা মাঝারী ক্ষুদ্র চাষীর ছোট পরিমাণ বিনিয়োগ। বিপরীতে কৃষিতে সরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ নেহাৎই কম। অন্যদিকে শিল্প বা পরিষেবা ক্ষেত্রকে উৎসাহ প্রদানের নামে সরকার বিপুল পরিমাণ ভরতুকি দেয়। পরিকাঠামো নির্মাণের দায় গ্রহণ করে।
অথচ কৃষি উপকরণের জোগান যথাযথ হলে কৃষি উৎপাদনের বৃদ্ধি কতটা হতে পারে সেটা সাম্প্রতিক সময়ে ভালো বৃষ্টির সাহায্যে পাঁচ শতাংশ বৃদ্ধির নিদর্শন থেকেই বোঝা যায়। টাইমস অব ইণ্ডিয়া এবং ইকনমিক টাইমস এর এক রিপোর্ট জানাচ্ছে ভালো বৃষ্টির ফলে এই বছরে কৃষি অর্থনীতির বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। শুধু বৃষ্টির সহায়তাতেই কৃষি ক্ষেত্রে জিডিপি বেড়ে গেল প্রায় তিনগুণ। এই তথ্য থেকে বোঝাই যায় শুধু প্রকৃতির দানের মুখাপেক্ষী করে ভারতীয় কৃষিকে ফেলে না রাখলে কৃষির ক্ষেত্রে যথেষ্ট সম্ভাবনা বিদ্যমান।
কৃষির বিষয়টি কীভাবে অর্থনীতির কেন্দ্রে স্থাপন করা আমাদের অন্যতম দায়িত্ব। কৃষি আর লাভজনক নয়, এই যুক্তিতে কৃষিতে সরকারী বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়ে আলোচনাটাই বুর্জোয়া অর্থনীতি রাজনীতির বাইরে চলে যাচ্ছে, যাকে প্রশ্ন করা দরকার। শুধু বুর্জোয়া দলগুলিই নয়, সি পি এম এর মতো তথাকথিত বাম দলও একই কাজ করেছে। আমাদের সবারই মনে আছে ২০০৬ এর পশ্চিম বঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর বুদ্ধবাবু ও সি পি এমের প্রধান অ্যাজেন্ডাই হয়ে উঠেছিল কৃষিকে নস্যাৎ করা। কৃষকের (শিল্প/রিয়েল এস্টেটের জন্য) জমি বেচে দেওয়াটাই উচিৎ কারণ কৃষি করে লাভ আর হবে না, এটাই ভবিতব্য হিসেবে স্থাপন করা হয়েছিল। যে টুকু বিতর্ক ছিল সেটা শুধু অধিগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে। রাজারহাট মডেলের সাফল্য আর সিঙ্গুর মডেলের ব্যর্থতা - এরকম ভাবেই আলোচনা এগোচ্ছিল সি পি এমের মধ্যে এবং সমর্থক মহলে।
গোটা ভারতেও এই সময়ে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া গতি পেতে চাইছিল সংসদে নতুন পাশ হওয়া এস ই জেড নীতিকে কেন্দ্র করে। এস ই জেড আইন পাশ হওয়ার সময় তার বিরুদ্ধে সংসদে একটি ভোটও পড়েনি, কিন্তু এই আইন রূপায়ণে সর্বত্র প্রবল বাধার মুখোমুখি হয়েছিল। ১৮৯৪ সালের ঔপনিবেশিক জমি অধিগ্রহণ আইন কে হাতিয়ার করে তরতর করে এগোতে চাইছিল জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া। ডান, সংসদীয় বাম সবার মধ্যে জমি অধিগ্রহণ করে শিল্প/পরিকাঠামো/রিয়েল এস্টেট তৈরির উন্নয়ন মডেল নিয়ে একটা সামীপ্য দেখা গিয়েছিল। বিপরীতে বাম আন্দোলনের ভালোরকম ঐতিহ্য থাকুক আর নাই থাকুক, সব রাজ্যেই কৃষকদের ব্যাপক বাধার সামনে পড়তে হয় এই অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াকে,শেষ পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণের পুরনো আইনটা বাতিলই করে দিতে হয়।
এই গোটা পরিঘটনাটি একটি বিষয়কে প্রমাণ করে, কৃষির প্রতি জমির প্রতি কৃষকের মমতা কমে নি, ভূমিহীন কৃষকের জমির আকাঙ্ক্ষাও শেষ হয়ে যায় নি। আমূল ভূমিসংস্কার এর ইস্যুটা তাই কোনও মৃত ইস্যু আদৌ নয়। খাস জমির আন্দোলন থেকে অনেক ব্যাপক জনভিত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা কোনও অতীত স্বপ্নমাত্র নয়।
সি পি এম/ সি পি আই এর মতো দলের ও দল পরিচালিত সরকারের সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম নিয়ে অবস্থান ও ভূমিকা স্পষ্ট করে দিয়েছিল কৃষি ও কৃষকের প্রশ্নটিকে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে স্তাপন করার সমস্ত রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা তারা হারিয়েছেন, বুর্জোয়া উন্নয়ন তত্ত্বের কাছে তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বন্ধক দিয়েছেন। সংসদীয় ক্ষমতার মোহে জনগণের রাজনৈতিক দাবি থেকে সরে আসার মূল্য তাদের দিতে হয়েছে রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা, সাংগঠনিক ক্ষয় এবং পরিশেষে এমনকী সংসদীয় রাজনীতির অঙ্কের হিসেবেও অপাংক্তেয় হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে।
ভারতীয় রাজনীতিতে বামপন্থার পুনঃজাগরণের জন্য কৃষিকে যথাযোগ্য জায়গায় স্থাপন করাটা প্রাথমিক কাজ। কৃষির ক্ষেত্রে মূল দাবিগুলো হল সার বীজ বিদ্যুৎ সেচ হিমঘর ফসল সংগ্রহর মত ফসলের উৎপাদন সংরক্ষণ ও বন্টনে সরকারী হস্তক্ষেপের দাবি। কৃষিতে সরকারী পরিকাঠামো তৈরি ও বিনিয়োগের দাবি। ভালো সেচ কৃষিকে এখনো কতটা লাভজনক করতে পারে সাম্প্রতিক বছরে ভালো বৃষ্টির ফলে কৃষির নিদারুণ বৃদ্ধি তার একটা প্রমাণ।
ভালো বৃষ্টির ফলে এই বছরে কৃষিক্ষেত্রে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশ। যা অতীতের বছরগুলির গড়ের প্রায় তিনগুণ। বলাই বাহুল্য কৃষি ক্ষেত্রে এই বিকাশ গ্রামের মানুষের হাতে যে অতিরিক্ত অর্থের যোগান দেবে তা অন্যান্য শিল্পদ্রব্যের চাহিদা বিকাশের মাধ্যমে সামগ্রিক অর্থনীতিকেও অনেকখানি চাঙ্গা করবে। ভারতীয় অর্থনীতির বিকাশের ক্ষেত্রে রপ্তানি নির্ভর মডেলটিকে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বিশ্ব বাজারের মর্জির ওপর অতি নির্ভরশীল হয়ে উঠতে দেখেছি। আমেরিকা ইউরোপের মন্দা ভারতের এত দিনের তাক লাগানো বিকাশের গতিকে গত দু বছরে ভালোই নামিয়ে এনেছে। এ বছরে ভারতীয় অর্থনীতি ডলারের আমেরিকা প্রত্যাবর্তন ও সেই সূত্রে টাকার অবমূল্যায়ন ও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ ঘাটতির নানান আশঙ্কায় যখন জর্জরিত তখন প্রকৃতির হাত ধরে কৃষির বিকাশ সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্বস্তির কিছু হাওয়া এনে দিচ্ছে।
কৃষক আন্দোলনকে জমি বাঁচানোর আন্দোলন ছাড়াও আগ্রাসী দাবিদাওয়ার আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে। এই সময়ে তাই জোরের সাথে আবার কৃষি পরিকাঠামোর দাবিগুলো তোলা দরকার। সেচের ক্ষেত্রে সরকারী বিনিয়োগ কেন বহুগুণ বাড়বে না? সোনালী চতুর্ভুজ থেকে জে এন এন ইউ আর এম এর মতো বড় মাপের প্রকল্প সেচের ক্ষেত্রেও নেওয়া দরকার। সেচের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতে ভরতুকি বাড়াতে হবে অনেক পরিমাণে। অতীতের ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের মতো সার বীজ কারখানার জাতীয়করণের দাবি বা সরকারী সমবায়/রেশন প্রকল্পের মাধ্যমে এর বিলিবন্টন এর দাবি তোলা দরকার।