নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
উপমহাদেশের খ্যাতিমান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, লেখক ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বাগ্মীনেতা বিপিনচন্দ্র পাল। ব্রিটিশ বিরোধী এই বিপ্লবী বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও সমাজ সংস্কারক। উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাঁর বাগ্মীতা ছিল অসাধারণ। ১৮৮০ সালে তিনি প্রকাশ করেন সিলেটের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র পরিদর্শন। এছাড়া ১৮৮৩ সালে তিনি 'বেঙ্গল পাবলিক অপিনিয়ন' এবং ১৯৯১ সালে 'নিউ ইন্ডিয়া' পত্রিকার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিপিনচন্দ্র ছিলেন চরমপন্থী রাজনীতির অন্যতম প্রধান প্রবক্তা। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অনলবর্ষী বক্তৃতা দিতেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতা ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে দেশবাসীকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্দীপ্ত করে জাগিয়ে তোলেন। তাঁর আহবানে হাজার হাজার যুবক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কলকাতায় ছাত্রজীবনে তিনি কেশব চন্দ্র সেন, সিবনাথ শাস্ত্রী, বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামীর মত বেশকয়েকজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বের সান্নিদ্ধে আসেন এবং তাঁদের আদর্শে প্রভাবিত হয়ে তিনি ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করে ব্রাহ্ম আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পরেন। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর প্রভাবে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে বল গঙ্গাধর তিলক, লাজপত রায় এবং অরবিন্দ ঘোষের বুদ্ধিতে ক্রমান্বয়ে চরমপন্থি রাজনীতিতে জড়িয়ে পরেন বিপিনচন্দ্র। যদিও তিনি বল গঙ্গাধর তিলকের হিন্দু জাতীয়তাবাদ এর পক্ষপাতি ছিলেন না। প্রবাদতুল্য এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ৮২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৩২ সালের আজকের দিনে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারক বিপিনচন্দ্র পালের মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিরল প্রতিভার অধিকারী বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পাল ১৮৫৮ সালের ৭ নভেম্বর বর্তমান সিলেটের হবিগঞ্জ জেলার সদর থানার পইল গ্রামে এক ধনী কায়স্থ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা রামচন্দ্র পাল ছিলেন একজন গ্রাম্য জমিদার এবং সিলেট বারের প্রভাবশালী সদস্য। জমিদার হওয়া সত্বেও তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। বিপিনচন্দ্র পালের মা'ও ছিলেন উদার ও মানবিক গুণের অধিকারী। পারিবারিকভাবেই বিপিনচন্দ্র পালের মধ্যে সাম্য ও মানবতা বোধের দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে। বিপিনচন্দ্রের পড়াশুনার হাতেখড়ি বাবার কাছে। পাঁচ বছর বয়সে বাংলা বর্ণমালা শিক্ষা শুরু হয়। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের শ্লোক শুনে তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। ১৮৬৬ সালে তিনি নয়া সড়ক স্কুলে ভর্তি হন। তারপর ১৮৬৯ সালে সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুলে। এই স্কুল থেকে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে পাশ করেন। ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতায় যান এবং ১৮৭৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে এফ.এ. কোর্স ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার কিছুদিন আগে তিনি জল বসন্তে আক্রান্ত হন। ফলে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এরপর তিনি ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজে ভর্তি হন। ১৮৭৭ সালে এখান থেকে তিনি পুনরায় এফ.এ. পরীক্ষা দেন।
১৮৭৭ সালে কালকাতায় ছাত্রাবস্থায় সেকালের উদারপন্থি সমাজ সংস্কারক দার্শনিক আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর আদর্শে ও প্রেরণায় প্রভাবিত হয়ে স্বাধীনতার সাধকদলের সদস্য হিসেবে বিপিনচন্দ্র পাল দীক্ষা গ্রহণ করেন। এসময় থেকে তিনি স্বদেশ-স্বজাতির মুক্তির লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ব্রতে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করেন। প্রথমদিন শরৎচন্দ্র রায়, আনন্দচন্দ্র মিত্র, কালীশঙ্কর-সুকুল, তারাকিশোর চৌধুরী, সুন্দরীমোহন দাস এবং বিপিনচন্দ্র পাল দীক্ষা গ্রহণ করেন। কর্মজীবনে ১৮৭৯ সালে বিপিনচন্দ্র পাল উড়িষ্যার কটক একাডেমীতে প্রথমে সাধারণ শিক্ষক হিসেবে এবং পরে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। তবে খুব বেশিদিন তিনি সেখানে থাকেননি। ১৮৮০ সালের ৫ জানুয়ারি সিলেটের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট 'শ্রীহট্ট জাতীয় বিদ্যালয়' হিসাবে রূপান্তর হলে বিপিনচন্দ্র পাল এই জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। তবে ১৮৮০ সালের জুলাই মাসের শেষে তিনি কলকাতায় ফিরে যান। ১৮৮১ সালের আগস্ট মাসে রায়বাহাদুর নারায়ণ স্বামী মুদালিয়ারের প্রতিষ্ঠিত উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি বাঙ্গালোরে কিছুদিন একটি হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। কর্মজীবনে তিনি কোথাও বেশিদিন স্থির হতে পারেননি। যখনই তাঁর আত্মমর্যাদা বোধ ও স্বাধীন চিন্তার একটু ব্যঘাত হয়েছে তখনই তিনি সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।
১৮৮৫ সালে বোম্বে সম্মেলনের ভিতর দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হলে বিপিনচন্দ্র পাল সর্বভারতীয় পর্যায়ের একজন নেতা হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেন। ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত হন। বিপিনচন্দ্র পাল অসাধারণ বক্তা হওয়ার কারণে বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের জনগণকে জাগ্রত করতে সক্ষম হন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৯০-৯২ সাল পর্যন্ত বিপিনচন্দ্র পাল কলকাতায় পাবলিক লাইব্রেরি ও পৌরকর্পোরেশনে কিছুদিন কাজ করেন। ১৮৯২-৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের লাইসেন্স ইন্সপেকটার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯৯ সালে তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের বৃত্তি নিয়ে গবেষণার জন্য অক্সফোর্ডের ম্যানচেষ্টার কলেজে যান। সেখানকার পাঠক্রম শেষ করার পর সারা ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকা ভ্রমণ করে তিনি হিন্দুধর্ম, ভারতীয় রাজনীতি ও মাদকদ্রব্য নিবারণ সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন এবং ১৯০০ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
(বাম থেকে লালা রাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বিপিন চন্দ্র পাল)
কলকাতায় এসে তিনি বসে থাকেননি, সারা ভারতবর্ষের প্রতিটি অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে পরাধীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁকে 'গুরুদেব' বলে সম্বোধন করতেন। তখনকার ভারতে রাজনৈতিক অঙ্গনে তিন দিকপাল যথা লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বিপিনচন্দ্র পাল যাঁদেরকে সংক্ষেপে লাল-বাল-পাল বলা হত। বিপিনচন্দ্র পাল অল্পদিনেই তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন এবং ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের চিন্তা ও মতবাদকে জনসাধারণের মধ্যে পৌছে দেওয়ার কারণে তিনি 'চরমপন্থী' নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯০৪ সালে বিপিনচন্দ্র পাল বোম্বাইয়ে কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন। ১৯০৬ সালে শ্রীহট্ট সুরমা উপত্যকার প্রথম রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে বক্তৃতা দেন। এছাড়া ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। এভাবে ১৯০৫ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ব্রিটিশের ভিত নড়ে যায়। ১৯০৭ সালে মাদ্রাজে তিনি যে বক্তৃতা প্রদান করেন তাতে সারাদেশে এক জাগরণ সৃষ্টি হয়। ১৯০৮ সালে করিমগঞ্জে সুরমা উপত্যকার দ্বিতীয় সম্মেলনে বক্তৃতা করেন তিনি। এ কারণে সেক্রেটারী অব স্টেট ও বড়লাট বিপিনচন্দ্রকে শৃঙ্খলিত করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন।
১৯০৬ সালে বিপিনচন্দ্র পাল বন্দেমাতরম পত্রিকা প্রকাশ করেন। 'বন্দেমাতরম' পত্রিকার সম্পাদক থাকা অবস্খায় আদালত অবমাননার দায়ে বিপিনচন্দ্র পালকে ৬ (ছয়) মাস সাধারণ কারাদণ্ড দেয়া হয়। জেল থেতে ছাড়া পেয়ে ১৯০৮ সালে তিনি ইংল্যাণ্ডে যান এবং সেখানে 'স্বরাজ' নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করেন। এ সময়ে তিনি ভারতীয় রাজনীতি, ধর্ম ও দর্শন সম্বন্ধে বহু বক্তৃতা প্রদান করেন। কিন্তু ১৯১১ সালে বোম্বাই পদার্পণ করা মাত্র তাঁকে রাজদ্রোহের অপরাধে আবার জেলে প্রেরণ করা হয়। ১৯১২ সালে বিপিনচন্দ্র পাল জেল থেকে মুক্তি পান। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ১৯১২ সালে তিনি হিন্দু রিভিউ, ১৯১৩ সালে আলোচনা, ১৩৩১ (বঙ্গাব্দ) বাংলা ট্রিবিউন, সোনার বাংলা , ১৯১৯ সালে ইনডিপেনডেন্ট, ডেমোক্রেট, ফ্রিডম ফেলোশিপ, ট্রিবুনি, জনশক্তিসহ অনেক পত্রিকায় সাংবাদিক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচীতে মহাত্মা গান্ধীর সাথে মতের মিল না হওয়ায় কংগ্রেসের নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহরু, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ নেতৃবর্গ এক নতুন কর্মসূচি নিয়ে 'স্বরাজ দল' নামে এক নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নে মোতিলাল নেহেরু, চিন্তরঞ্জন দাস, মহাত্মা গান্ধীর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে বিপিনচন্দ্র পাল শেষ জীবনে রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসেন। জীবনের শেষাংশে তিনি সাহিত্য সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করেন।
যৌবনের প্রথমদিকে কথাসাহিত্যের ভেতর দিয়ে তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা হয়েছিল। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে প্রবন্ধের সংখ্যা বেশি। তাছাড়া তিনি উপন্যাস, জীবনী, আত্মজীবনী, ইতিহাস রচনা করেছেন। বিপিনচন্দ্র পাল বাংলায় ১৫টি এবং ইংরেজিতে ১৭টির বেশী বই লিখেছেন। বিপিনচন্দ্র পালের প্রথম উপন্যাস 'শোভনা' প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে। 'শোভনা' উপন্যাসে তিনি ছদ্মনাম 'হরিদাস ভারতী' ব্যবহার করেন। 'শোভনা' নারীসমাজের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য লিখিত একটি উপন্যাস। তাঁর 'সত্তর বছর' বইটি সেকালের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের দলিল হিসেবে স্বীকৃত। বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত তাঁর ২৫টিরও বেশী বই বিশ্বের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়।
রাজা রামমোহন প্রবর্তিত বিধবা বিবাহের সমর্থনে বিপিনচন্দ্র একজন বিধবাকে বিয়ে করেছিলেন। ফলে সমাজচ্যুত হয়ে নিজ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন। তবে শেষ জীবনে ব্রাহ্ম ধর্ম ত্যাগ করে বৈষ্ণব ধর্ম ধারণ করেন। সাংবাদিকতা, সমাজ সংস্কারসহ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী প্রবাদতুল্য এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ১৯৩২ সালের ২০ মে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার ৮২তম মৃত্যুবার্ষিকী। লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও সমাজ সংস্কারক বিপিনচন্দ্র পালের মৃত্যুবার্ষিকীতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
©somewhere in net ltd.