নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বাংলা লোক সঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী আব্দুল আলীম। বাংলাদেশের লোকসঙ্গীতের ইতিহাসে আবদুল আলীম এক অবিস্মরণীয় নাম। কণ্ঠস্বরের অসাধারণ ঐশ্বর্য্য নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন এবং সেক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দী। দরাজ কণ্ঠের অধিকারী আব্দুল আলীম যখন গান গাইতেন, তখন মনে হতো পদ্মা মেঘনার ঢেউ যেন আছড়ে পড়ছে শ্রোতার বুকের তটভূমিতে। মানুষের মনের কথা, প্রাণের সাথে প্রাণ মিলিয়ে যে গানের সুর আবদুল আলীমের কণ্ঠ থেকে নিঃসৃত হতো, তা শুধু এই বাংলা ভাষাভাষীদের মনেই নয়; বিশ্বের সকল সুর রশিক যারা, বাংলা ভাষা জানেননা- তাদেরও আপ্লুত করতো। পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সঙ্গীত কলেজের লোকগীতি বিভাগের অধ্যাপক। বাংলা লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী লোক সঙ্গীতকে অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যেখানে জীবন জগৎ এবং ভাববাদী চিন্তা একাকার হয়ে গিয়েছিল। খুবঅল্প বয়স হতেই বাংলার লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী গান গেয়ে নাম করেছিলেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড হয়। ১৯৩১ সালের আজকের দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আজ তার ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। লোক সঙ্গীতের অমর শিল্পী আবদুল আলীমের জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা।
আবদুল আলীম ১৯৩১ সালের ২৭ জুলাই ভরতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামের এক আর্থিকভাবে অসচ্ছল এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল মোহাম্মদ ইউসুফ আলী। বাল্যকাল থেকেই আলীম সঙ্গীতের প্রবল অনুরাগী ছিলেন। তবে অর্থনৈতিক অনটনের কারণে কোন শিক্ষকের কাছে গান শেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। তিনি অন্যের গাওয়া গান শুনে গান শিখতেন। আর বিভিন্ন পালা পার্বণে সেগুলো গাইতেন। ১৯৪২ সাল। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু হয়েছে। শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক এলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায়। সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বড় ভাই শেখ হাবিব আলী আব্দুল আলীমকে নিয়ে গেলেন সেই অনুষ্ঠানে। আব্দুল আলীমের অজ্ঞাতে বড় ভাই অনুষ্ঠানের আয়োজকদের কাছে তাঁর নাম দিয়ে ছিলেন গান গাইবার জন্য। এক সময় মঞ্চ থেকে আবদুল আলীমের নাম ঘোষণা করা হলো। শিল্পী ধীর পায়ে মঞ্চে এসে গান ধরলেন, ‘‘সদা মন চাহে মদিনা যাবো।’’ মঞ্চে বসে আবদুল আলীমের গান শুনে শেরে-বাংলা শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন। কিশোর আলীমকে জড়িয়ে নিলেন তাঁর বুকে। উৎসাহ দিলেন, দোয়া করলেন এবং তখনই বাজারে গিয়ে পাজামা, পাঞ্জাবী, জুতা, পুটি, মোজা সব কিনে দিলেন। এভাবে পালা পার্বণে গান গেয়ে তিনি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। প্রাইমারি স্কুলে পড়বার সময় গ্রামোফোন রেকর্ডে গান শুনে গান গাইবার জন্য আগ্রহ জন্মে। শিল্পীর বয়স যখন ১০/১১ বছর তখন তাঁর এক সম্পর্কিত চাচা গ্রামের বাড়ীতে কলের গান (গ্রামোফোন) নিয়ে আসেন। তিনি তখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদ বরকত তাঁর সহপাঠী। প্রায় প্রতিদিনই তিনি চাচার বাড়ীতে গিয়ে গান শুনতেন। পড়াশোনার জন্য গ্রামের স্কুল তাঁকে বেশী দিন ধরে রাখতে পারেনি। তাই কিশোর বয়সেই শুরু করলেন সঙ্গীতচর্চা। আবদুল আলীমের নিজ গ্রামেরই সঙ্গীত শিক্ষক সৈয়দ গোলাম ওলীর কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। ওস্তাদ তাঁর ধারণ ক্ষমতা নিরীক্ষা করে খুবই আশান্বিত হলেন। গ্রামের লোক আবদুল আলীমের গান শুনে মুগ্ধ হতো। পালা-পার্বনে তাঁর ডাক পড়তো। আবদুল আলীম গান গেয়ে আসর মাতিয়ে তুলতেন। সৈয়দ গোলাম ওলী আবদুল আলীমকে কোলকাতায় নিয়ে গেলেন। কিছুদিন কোলকাতা থাকার পর তাঁর মন ছুটলো ছায়াঘন পল্লীগ্রাম তালিবপুরে। কিন্তু ওখানে গান শেখার সুযোগ না থাকায় বড় ভাই শেখ হাবিব আলী একরকম ধরে বেঁধেই আবার কলকাতা নিয়ে গেলেন।
মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে তাঁর গানের প্রথম রেকর্ড হয়। রেকর্ডকৃত গান দুটি হলো " ১। ‘‘আফতাব ঐ বসলো পাটে আঁধার এলো ছেয়ে ও চল ফিরে চল মা হালিমা আছেরে পথ চেয়ে।’’" এবং ২। "তোর মোস্তফাকে দেনা মাগো’’ সঙ্গেলয়ে যাই, মোদের সাথে মেষ চারণে ময়দানে ভয় নাই"। এতো অল্প বয়েসে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। তবে পরে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকেনি, তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাংলার লোক সঙ্গীতের এক অবিসংবাদিত কিংবদন্তি পুরুষ। তাঁর কিছু অবিস্মরণীয় গান "নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা; সর্বনাশা পদ্মা নদী; হলুদিয়া পাখী; মেঘনার কূলে ঘর বাঁধিলাম; এই যে দুনিয়া; দোল দোল দুলনি; দুয়ারে আইসাছে পালকি; কেন বা তারে সঁপে দিলাম দেহ মন প্রাণ; মনে বড় আশা ছিল যাবো মদীনায়" ইত্যাদি। এদেশের পল্লীগান হলো মাটির গান। পল্লীর কাঁদা মাটির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা শিল্পী আবদুল আলীম মাটির গানকেই শেষ পর্যন্ত বেছে নিলেন। এর আগে তিনি ইসলামী গানসহ প্রায় সব ধরনের গান গাইতেন। গান শেখার ক্ষেত্রে আর যাঁরা তাঁকে সব সময় সহযোগিতা ও উৎসাহ দিয়েছেন- তাঁদের মধ্যে বেদার উদ্দিন আহমেদ, আবদুল লতিফ, শমশের আলী, হাসান আলী খান, মোঃ ওসমান খান, আবদুল হালিম চৌধুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। লোকসঙ্গীতের অমর কণ্ঠশিল্পী মরহুম আববাস উদ্দিনের পরামর্শক্রমে তিনি ওস্তাদ মোঃ হোসেন খসরুর কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের একমাস পূর্বে আবদুল আলীম কলকাতা ছেড়ে গ্রামের বাড়ীতে চলে এলেন। ঐ বছরেই ডিসেম্বর মাসে ঢাকা এলেন। পরের বছর ঢাকা বেতারে অডিশন দিলেন। অডিশনে পাশ করলেন। ১৯৪৮ সালের আগষ্ট মাসের ৯ তারিখে তিনি বেতারে প্রথম গাইলেন,’’ ও মুর্শিদ পথ দেখাইয়া দাও।’’ গানটির গীতিকার ও সুরকারঃ মমতাজ আলী খান। এরপর পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের সাথে আবদুল আলীমের পরিচয় হয়। কবি জসীম উদ্দিন তাঁকে পাঠালেন জিন্দাবাহার ২য় লেনের ৪১ নম্বর বাড়ীতে। একসময় দেশের বরেণ্য সঙ্গীত গুণী শিল্পীরা এখানে থাকতেন। এখানে তিনি প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ মমতাজ আলী খানের কাছে তালিম গ্রহণ করেন। মমতাজ আলী খান আবদুল আলীমকে পল্লী গানের জগতে নিয়ে এলেন। পরবর্তীতে তিনি কানাই শীলের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন।
দেশ বিভাগের পরে আব্দুল আলীম ঢাকায় চলে আসেন এবং রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে গান গাইতে শুরু করেন। তিনি পরে টেলিভিশন সেন্টার চালু হলে সেখানেও সঙ্গীত পরিবেশন শুরু করেন। এছাড়াও তৎকালীন বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রটি হলো ‘লালন ফকির’। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির মতো গান রেকর্ড হয়েছিল তাঁর। আব্দুল আলীম তাঁর আধ্যাত্মিক ও মরমী মুর্শিদী গানের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। আবদুল আলীম শুধু পল্লীগানের শিল্পী ছিলেন না, লোক সংস্কৃতির মুখপাত্রও ছিলেন। পল্লীগানের যে ধারা তিনি প্রবর্তন করে গেছেন সেই ধারাই এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। তাঁর উদাত্ত কণ্ঠের গান গ্রাম বাংলাকে সুরের আবেশে মাতোয়ারা করে তুলেছিল। তাঁর কণ্ঠে ভাটিয়ালীর সুর যেন মাঝির মনের বেদনার কথা বলতো। বাউল গান শুনে বৈরাগীরা থমকে দাঁড়াতো। মারফতী আর মুর্শিদীর সুরে তাঁর বিনয় নম্র ভক্তি নিবেদন ঝরে পড়তো। পাল্লীগানের জগতে তিনি এক আদর্শ গায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যাদুকরী কণ্ঠের অধিকারী আব্দুল আলীম জীবদ্দশায় ও মরণোত্তর বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একুশে পদক, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার ইত্যাদি। পাকিস্তান মিউজিক কনফারেন্স, লাহোরে সঙ্গীত পরিবেশন করে আব্দুল আলীম পাঁচটি স্বর্ণ পদক পেয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৭ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে সম্মানিত করে। কালজয়ী এই লোকসঙ্গীত শিল্পী মাত্র ৪৩ বৎসর বয়সে ১৯৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ভক্তকুলকে কাঁদিয়ে পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আবদুল আলীম আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আছে তাঁর গান। তাঁর গানের মাঝে তিনি সঙ্গীত পিপাসু জনগণ, তথা পল্লীগ্রামের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগ যুগ ধরে। তার গান এ প্রজন্মের শিল্পীরাও বিভিন্ন চ্যানেলে গেয়ে বাহবা পাচ্ছেন। অসংখ্য ভাটিয়ালি, দেহতত্ত্ব, মুর্শিদী, ইসলামী আর লোকসঙ্গীতের মাধ্যমে আবদুল আলীম অমর হয়ে থাকবেন।
আজ মরমী কণ্ঠশিল্পিী আব্দুল আলীমের ৮৩তম জন্মবার্ষিকী। শিল্পী আব্দুল আলীমের জন্ম দিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
©somewhere in net ltd.
১| ২৭ শে জুলাই, ২০১৪ সকাল ১১:৪২
এ.টি.এম.মোস্তফা কামাল বলেছেন: আমার প্রিয় শিল্পীদের একজন। তাঁর সহজাত দরাজ গলা হৃদয়ের অতল স্পর্শ করতো। ১৯৭৪ সালে যেদিন তিনি মারা যান সেদিন বাসায় বাসায়, রাস্তার মোড়ে মোড়ে লোকজন ভীড় করে রেডিওতে তাঁর গান শুনেছে আর কেঁদেছে। বাংলাদেশ বেতার সারাদিন তাঁর গান প্রচার করেছিলো।