নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি পেশায় একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সংবাদকর্মী, সমাজসেবক এবং প্রযুক্তিবিদ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে থাকি।

ছোট কাগজ কথিকা

আমি পেশায় একজন শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সংবাদকর্মী, সমাজসেবক এবং প্রযুক্তিবিদ। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি, এবং সমাজের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম নিয়ে আমি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে থাকি।

ছোট কাগজ কথিকা › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফেক আইডি

০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১১

লেখক: সাব্বির জাদিদ


নিহার বমি করার নেপথ্য কারণ জানতে অামাদেরকে রাজনের ফেসবুক একাউন্ট লগইন করতে হবে। এবং লগইন করে অামরা অবাক হয়ে যাব। কারণ, তার প্রোফাইল নেম নাবিলা ইয়াসমিন এবং প্রোফাইল পিকচারে নিহার লেটেস্ট একটা ফটো জুড়ে দেয়া। তখন আমরা ধন্দে পড়ে যাব। এই আইডি কীভাবে রাজনের হয়! হলে নিহার হতে পারে। যেহেতু প্রোফাইলে তার ছবি ঝুলানো এবং নাবিলা ইয়াসমিন হয়ত নিহার অাকিকা দেয়া নাম। কিন্তু এসব অামাদের সম্ভাবনার কথা। প্রকৃতপ্রস্তাবে নাবিলা ইয়াসমিন— এ রাজনেরই আইডি।
রাজন নিহা ভাইবোন। রাজন বড়। মিরপুর বাংলা কলেজে অনার্স ভর্তি হয়েছে মাত্র। নিহা টেনে। মিরপুর দশ নাম্বারে কম পরিচিত এক বেসরকারি স্কুলে সে পড়ছে। নিহা সুশ্রী মেয়ে। আপনারা হয়ত মনে মনে হাসছেন। দুর্বল লেখকরা গল্পের মুখ্য নারী-চরিত্রকে সবসময় সুশ্রী হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু অামাদের নিহা, অাসলেই সে সুদর্শনা। সুদর্শনা না হলেও এই গল্পের খাতিরে তাকে সুদর্শনা ধরে নিতে হবে আমাদের। কারণ, এই গল্পে নিহা যে চরিত্রে অভিনয় করছে, সে চরিত্রে তাকে সুদর্শনা হওয়া বড়ই জরুরি। সে-কথা যথা সময়ে জানা যাবে।
এবার রাজনের কথায় অাসা যাক। না, রাজনের চেহারাসুরত নিয়ে অামরা কিছু বলব না। এই গল্পে তার চেহারার কোন ভূমিকা নেই। সুতরাং সে অালোচনা নিষ্প্রয়োজন। যেটুকু প্রয়োজন, অামরা সেটুকুই বলবার চেষ্টা করব। খুব ছোটবেলা থেকেই রাজনের টাকার নেশা। অথচ তার বাবা সরফরাজ খান বড় হিসেবি মানুষ। প্রয়োজনের বাইরে একটা পয়সাও তিনি সন্তানদের হাতে দেন না। কিন্তু উঠতি বয়সের ছেলেদের সামনে হঠাৎ হঠাৎ জীবনমরণ সমস্যার মতো এমন সব প্রয়োজন দাঁড়িয়ে যায়, যেগুলো বড়দের কাছে কোন প্রয়োজনই নয়। এইটে থাকতে এমনই এক প্রয়োজনের মুখোমুখি হতে হল রাজনকে। ঢাকায় এসেছে পাকিস্তান ক্রিকেট টিম। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ খেলতে। রাজনের বন্ধুরা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে একটা ম্যাচ উদযাপন করতে চায়। কারণ, ইতোপূর্বে বন্ধুদের কেউ মাঠে বসে সরাসরি খেলা দেখেনি। অথচ তাদের সবার বাসা মিরপুর। ক্রিকেটপ্রেমীরা দেশের নানা জেলা থেকে একগাদা পয়সা খরচ করে মিরপুরে এসে খেলা দেখে যায়, অার তারা ঘরে বসে শুধু গ্যালারির হইচই শুনে যাবে অার অাপসোস করে যাবে তা তো হতে পারে না। এ যেন মক্কাবাসীর বেহাজি হয়ে থাকা। বন্ধুরা বাবাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে টিকেট জোগাড় করে ফেলল। পারল না শুধু রাজন। সে জানে, তার বাবা খেলা দেখার জন্য কখনোই টাকা দেবে না। হোক সে একশ টাকা অথবা দুশো টাকা। কারণ, সরফরাজ সাহেবের কাছে খেলা দেখাটা কোন কাজই নয়। সুতরাং তার মতো হিসেবি মানুষ এই অকাজে কেন পয়সা যোগান দেবে! অতএব রাজনকে অসদুপায় অবলম্বন করতে হল। একদিকে খেলা দেখার তীব্র টান, অন্যদিকে বন্ধুদের কাছ থেকে লজ্জামুক্তি। এক দুপুরে গোপনে সে বাবার পকেট থেকে পাঁচশ টাকা তুলে নিলো অার দোষ চাপাল কাজের বুয়ার ঘাড়ে। বুয়ার চাকরি নট। এভাবেই অামাদের রাজনের পয়সা কামানোর এবং উড়ানোর হাত খুলতে লাগল। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় সে এক ফেক ফোনকলের খপ্পরে পড়ে। তখন তার চোখের দৃষ্টি মাত্রই রঙিন হতে শুরু করেছে। পথেঘাটেবাসে যেখানে যে মেয়েকে সে দেখে, ভালো লেগে যায়। এমন এক পিছলা মুহূর্তে তার মোবাইলে মিসডকল অাসে। সে এক গভীর রাতের কথা। মায়ের অাঁচল ধরে ঘ্যানঘ্যান করে করে সে একটা কমদামি মোবাইলের মালিক হয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত সে মোবাইলের বাটন টেপে। সাপের গেম খেলে। পাতানো নাম্বারে মিসডকল দেয়। সেসব নাম্বার থেকে কখনো কলব্যাক অাসে। কখনো অাসে না। কলব্যাককারীদের ভেতর যেমন পুরুষ থাকে, নারীও থাকে। রাজন শুধু নারীদের সাথেই কথা বলে। এমন এক রাতজাগা রাতে রাজনের নাম্বারে মিসডকল অাসে। বিস্ময়ের ব্যাপার, এই নাম্বারের সাথে রাজনের নাম্বারের যথেষ্ট মিল। নাম্বারটার প্রতি রাজন অচেনা টান অনুভব করে। তখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে। কোম্পানি রাতজাগা পাখিদের জন্য কলরেটও কমিয়ে দিয়েছে। রাজন কলব্যাক করে। ওপাশে মেয়েকণ্ঠ। রাজন তড়াক করে শোয়া ছেড়ে বিছানায় উঠে বসে। নিজের অবস্থান থেকে যতটা সম্ভব সুন্দর করে সে কথা বলে। মেয়েকণ্ঠ জানায়— তার নাম সিনথিয়া। বাসা ধানমন্ডি। নতুন পরিচয়ে নামের পিঠে নাম বলতে হয়। ঠিকানার পিঠে ঠিকানা বলতে হয়। রাজন তার নাম বলতে গিয়েও থেমে যায় হঠাৎ। সিনথিয়া এতো চমৎকার একটা নাম। তার পাশে রাজন নামটা মানায় না যেন। সে হুট করে বলে ফেলে— তার নাম প্রবাল। বাসা বনানী। পরক্ষণে নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে যায় রাজন। এমন সসঙ্কটময় মুহূর্তে এত চমৎকার একটা নাম কীভাবে সাপ্লাই দিলো তার ব্রেন!
রাজনের একাউন্ট ব্যালেন্স ছিল বারো টাকা সাতাশ পয়সা। সেই রাত বারোটার পর, কলরেট যখন পঁচিশ পয়সা প্রতি মিনিট, রাজন পুরো বারো টাকার কথা বলে ফেলে। ব্যাল্যান্স ফুরিয়ে গেলে রাজন অপেক্ষায় থাকে, সিনথিয়া হয়ত কলব্যাক করবে। কিন্তু কলব্যাক করে না সিনথিয়া। রাজন নিজেকে সান্ত্বনা দেয়— মেয়েরা অমনই হয়। এতেই মেয়েদের সৌন্দর্য। বলাই বাহুল্য, দিন কুড়ির ভেতর প্রবাল সিনথিয়ার প্রেম হয়ে যায়। রাজন প্রতিটা মুহূর্ত প্রবল সুখ অার উত্তেজনা নিয়ে রাত বারোটা বাজার অপেক্ষায় থাকে। বারোটা বাজার সাথে সাথে ছুটতে থাকে তাদের কথা-ঘোড়া।
প্রেমের বয়স তিনমাস হলেও তাদের সামনাসামনি দেখা হয় না একবারও। দেখা করবার পরিকল্পনাও কখনো করে না তারা। সিনথিয়া যে দেখা করতে চাইবে না, সে অামাদের জানা কথা। কারণ, ফোনের ওপাশে মূলত সিনথিয়া নামে কোন মেয়ের অস্তিত্ব নেই। সে রাজনের মতোই কোন এক ছেলে। চায়না মোবাইলে ভয়েস চেঞ্জ করে সে সেজেছে সিনথিয়া। তাহলে রাজন কেন দেখা করবার কথা বলে না কখনো? আস্তে, অত ব্যস্ত হবেন না। অামাদের ভুলে গেলে চলবে না, রাজন এখনো কলেজপড়া ছেলে। এখনো তার গোঁফদাড়ি পুরোপুরি গজায়নি। অার এই বয়সী ছেলেরা মেয়েদের কাছে যাবার চেয়ে দূর থেকে ভালোবাসতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। সেকারণেই রাজন কখনো দুজনের দেখা হবার প্রসঙ্গটি উথ্থাপন করে না।
ঈদ এগিয়ে অাসে। একরাতে সিনথিয়া খুব লুতুপুতু ঢঙে জানায়, সামনে তাদের ভালোবাসার প্রথম ঈদ। ঈদটা সে প্রবালের গিফট করা থ্রিপিচ পরে ইনজয় করতে চায়। সাথে এ-ও জানায়— অাজকাল নাকি পাঁচহাজারের নিচে গর্জিয়াস পোশাকও পাওয়া যায় না। রাজন ঘামতে থাকে। এত টাকা সে কোথায় পাবে। প্রতিদিনের ফোনখরচ, এটা যোগাড় করতেই সে দুচোখে অাঁধার দেখে। কলেজের নাস্তাখরচ বাঁচিয়ে সে মোবাইলের ক্ষুধা মেটায়। অার একারণে বন্ধুরাও তাকে ছেড়ে গেছে। কিন্তু তার এই সঙ্কট তো মিষ্টি মেয়ে সিনথিয়ার সামনে উন্মোচন করা যায় না। তাই সে নির্ভার গলায় জানায়— যদিও সে এখনো স্টুডেন্ট, তার কোন অায়-ইনকাম নাই, তবু সিনথিয়ার জন্য সে সব করতে পারে। অতএব রাজনকে মায়ের মোবাইল ফোন গোপনে চোরাই মার্কেটে বিক্রি করতে হয়। এতে নগদ তিনহাজার টাকা তার হাতে অাসে। তিনের উপর এদিক সেদিক থেকে ধারদেনা করে অারো এক বাড়িয়ে সে চার হাজার টাকা সিনথিয়াকে বিকাশ করে। অার সেদিন থেকেই সিনথিয়ার নাম্বার অনির্দিষ্টকালের জন্য ডিএ্যাকটিভ হয়ে যায়।

দুই.
অনার্স ভর্তি হয়ে রাজন খেয়াল করে যুগটা এখন ফেসবুকের। এবং তার প্রত্যেকটা বন্ধুরই পাঁচসাতটা করে ফেক অাইডি। এইসব আইডি দিয়ে বন্ধুরা বিনোদনধর্মী নানা কর্মকাণ্ড চালায়। যুগের দাবি মেটাতে রাজন স্বনামে একটি আইডি খোলে। দুমাসে ফেসবুকের নাড়িনক্ষত্র তার অাঙুলের মাথায় এসে যায়। সে এক ফেসবুক বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে। তখন তার মনে হয় একটা ফেক আইডি খোলা যায় এখন। নাবিলা ইয়াসমিন নামে একটা অাইডি খোলে রাজন। অাইডিটা সে এমনভাবে সাজায়, খালি চোখে কারো বোঝার উপায় থাকে না নাবিলার অাড়ালে নিশ্বাস ফেলছে কোন পুরুষ। ফেক অাইডির মূল সঙ্কটের জায়গা প্রোফাইল পিকচার। ফিমেল অাইডতে কোন মেয়ের ছবি না থাকলে লোকে ভাবে— এ ফেক অাইডি। অাবার মডেলকন্যাদের মতো অতীব সুন্দরী ছবি প্রোফাইল পিকচার হিসেবে ব্যবহার করলেও সমস্যা রয়ে যায়। লোকে ভাবে— এ অাসল মেয়ে নয়। কোন মডেলের ছবি মেরে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। ভেবেচিন্তে রাজন তাই সুদর্শনা ছোটবোন নিহার ছবি ঝুলিয়ে দেয় প্রোফাইল বোর্ডে। এবং দুদিন পরপরই সে প্রোফাইল পিকচার বদল করে। কারণ, নিহা তার ঘরের বোন। এবং নিহার ছবি ওঠারও ব্যাপক বাতিক। ভাইয়ার ফ্ল্যাশ দেয়া এ্যান্ড্রোয়েড ফোন সে ছবি উঠিয়ে টইটুম্বুর করে রাখে। সেখান থেকে পছন্দসই ছবি রাজন ফেসবুকে অাপলোড করে। শুধু ছবি অাপলোড করে ক্ষান্ত দেয় না সে, ফাঁকে ফাঁকে লুতুপুতু টাইপের মেয়েলি স্ট্যাটাসও দেয় ভুল বানানে। এই যেমন সেদিন দুই লাইনের এক স্ট্যাটাস দিলো— 'অামার পুসিক্যাটটার ঠাণ্ডা লাগছে। বন্ধুরা ওর জন্য দোয়া করবেন।' স্ট্যাটাসের সাথে নিহার পোষা বিড়ালের একটা ছবি। অারেকদিনের স্ট্যাটাস— 'অাম্মুর সাথে ঝগড়া করে রাতে খাবার খাইনি। ভালোই হইছে। রাগ দেখানোও হইল, ডায়েট কন্ট্রোলও হইল।' কখনো মায়ের হাতের রাঁধা তরকারির ফটো আপলোড দেয়— 'লাইফের ফার্স্ট রান্না। কতটা জঘন্য হবে অাল্লাহ মাবুদ সেই জানে।'
অল্পদিনে নাবিলা ইয়াসমিন আইডিটা বড় ফেমাস হয়ে ওঠে। তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ নাবিলা ইয়াসমিনের আইডিকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। যেভাবে সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহরা প্রদক্ষিণ করে। দশবারোটা ধনী ছেলের সাথে ইনবক্সে নাবিলার প্রেম হয়ে যায়। শুরুতেই নাবিলা বুঝে ফেলে— ফেসবুক প্রজন্ম বড় ছ্যাঁচড়া প্রজন্ম। এরা পরিচয়ের শুরুতেই নাবিলার ফোন নাম্বার চায়। প্রেম নিবেদন করে। নির্জন রেস্টুরেন্টে মিট করার প্রস্তাব রাখে। উদ্ভূত পরিস্থিতি নাবিলা বড় বুদ্ধিমত্তার সাথে সামাল দেয়। যারা ফোন নাম্বার চায়— নাবিলা তাদের জানায়, সে বাবা-মার একমাত্র মেয়ে। বাবা-মা তাকে খুব গাইডে রাখে। বাসায় ফোনে কথা বলা জাস্ট অসম্ভব। এমনকি রাতে ঘুমোনোর পর অাম্মু মাঝে মাঝে এসে দরজায় কান পেতে রাখে। অার বাসার বাইরে কথা বলাটাও বিড়ম্বনার। ঢাকা শহরের রাস্তায় কোন নরোম মেয়ে কথা বলতে পারে!
যারা দেখা করতে চায়, নাবিলা তাদের জানায়— সে গরিব ঘরের মেয়ে। পড়াশোনার বাইরে তাকে দুটো টিউশানি করতে হয়। এতসব সামলে দেখা করার মতো সময় তার হয়ে ওঠে না। অতএব নাবিলার সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে ফেসবুক-ইনবক্স।
ঘটনাপরম্পরায় অামরা জেনেছি, রাজন এক ভয়েস চেঞ্জারের কাছে বড় রকমের ঠক খেয়েছিল। কিন্তু অামরা জানি না, এই শোক সে ভুলতে পারেনি। তার শিরা-উপশিরার ভেতর রক্ত চনমন করে ওঠে সেই চার চারটে হাজার টাকার কথা মনে পড়লে। এই ক্ষতি সে পুষিয়ে নিতে চায় নাবিলার মাধ্যমে। অতএব নাবিলা টাকা ধরার ফাঁদ পাতে ইনবক্সে। দেখা যায় রাজনের মতো বোকা ছেলের অভাব নেই জগতে। নাবিলার দুএকটা লুতুপুতু কথায় তারা গলে পড়ে মোম হয়ে। নাবিলাকে শুধু অাগুন হয়ে অাঁচ দেয়ার কাজটা করে যেতে হয়।
নাবিলার প্রথম শিকার হয় এক শিল্পপতির ছেলে পিলু। পিলু প্রাইভেট ইউনিভারসিটিতে পড়ে। ঘাড়ের নিচে লম্বা কোকড়ানো চুল নামিয়ে বাইক দাবড়ে বেড়ায়। একমাসের ঘনিষ্ঠতায় নাবিলা অায় করে দশহাজার টাকা। বিকাশ একাউন্টসে টাকাটা যোগ হওয়ার সাথে সাথে পিলুকে ব্লক মারে নাবিলা। দ্বিতীয় শিকার হয় সৌরভ। সেও চালান হয় ব্লাকলিস্টের অন্ধকার কূপে। এভাবে নাবিলার ব্লাকলিস্ট ক্রমেই স্বাস্থ্যবান হতে থাকে। সেই সাথে স্বাস্থ্যবান হয় রাজনের দীনহীন পকেট।


তিন.
নিহার মেট্রিক পরীক্ষা পরশু থেকে শুরু। ছোটবেলা থেকেই সে পড়াশোনায় যথেষ্ট সিরিয়াস। এখন পরীক্ষা সামনে নিয়ে সে খুব খাটছে। ভাইয়ার ফোনে ছবি তোলা অনেক কমে গেছে।
রাজন নিহার জন্য মহল্লার পরিচিত একটা রিকশা ঠিক করে দিয়েছে। পরীক্ষার দিনগুলোয় এই রিকশায় সে যাতায়াত করবে। নিহার বেশ অবাক লাগছে। ভাইয়া এমন ছিল না আগে। তার শরীর চিপলে একটা পয়সা বেরুতো না। উল্টো নিহার জমানো টাকাপয়সা সে নানা ফন্দিফিকির করে হাতিয়ে নিতো। সেই রাজন নিজ খরচে রিকশা ঠিক করে দিয়েছে। মাঝে একদিন নিহার কসমেটিকসসামগ্রী কিনে দিয়েছে। ভাইয়া হঠাৎ টাকার গাছ হয়ে গেল কি না বুঝতে পারে না নিহা।
নিহার সিট পড়েছে শ্যাওড়াপাড়ার এক স্কুলে। প্রথম দিন বলে সাথে রাজন গেল। নিহাকে কেন্দ্রে ঢুকিয়ে সে বাইরে এক চায়ের দোকানে বসে ফেসবুকিং করতে লাগল। ফেসবুক ছিল বলেই তিনটে ঘণ্টা সহজে পার হয়ে গেল রাজনের। নিহা উজ্জ্বল চেহার নিয়ে বেরিয়ে এলো কেন্দ্র থেকে। তার পরীক্ষা প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হয়েছে। রাজন নিহাকে সাথে নিয়ে এক বিরিয়ানি হাউজে ঢুকল। বোনকে পেটভরে বিরিয়ানি খাওয়ালো। ফেরার পথে ঘটল ঘটনা। তাদের রিকশা কাজীপাড়া পার হয়েছে তখন। হঠাৎ কোকড়ানো লম্বা চুলের এক যুবক এপাসি বাইক নিয়ে ঘ্যাচাং করে অাটকে দিলো তাদের পথ। রিকশা জোরে ব্রেক করায় ভাইবোন হুমড়ি খেয়ে পড়ো পড়ো অবস্থায় সামলে নিলো শেষমুহুর্তে। স্থির হয়ে বসার পর ক্রুদ্ধ রাজন ধমক দিতে যাবে পথ অাটকানো যুবককে। তার অাগেই নিহার উদ্দেশে কথা বলে উঠল যুবক। সানগ্লাস কপালের উপর তুলে দিয়ে ভিলেনীয় ঢঙে বলল, হায় নাবিলা, অামারে ঠক দিয়া অন্যের লগে মৌজ মাইরা বেড়াচ্ছ!
যুবকের বাইক, কোকড়ানো চুল, বিরাট সানগ্লাস, খাঁচ কাটা প্যান্ট— এইসব এমন প্রভাব বিস্তার করল, যুবককে কথা বলবার সুযোগ করে দিতে রিকশাওয়ালা রিকশাটাকে রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতে রাখল। রিকশাওয়ালারা জানে ঢাকাশহরের এইসব পোলা ভীষণ ভীতিকর জন্তু। যখন তখন এদের পকেট থেেক পিস্তল বেরিয়ে অাসে।
যুবক নিহাকে নাবিলা সম্বোধনে ডেকেছে। ওই নামটা গলিত সীসা হয়ে যেন ঢুকল রাজনের কানে। সে এবার ভালো করে তাকাল যুবকের দিকে। যুবকটা পিলু তাতে কোন সন্দেহ নেই। নিহা কিছু না বুঝে ভয়ার্ত চেহারায় রাজনের দিকে তাকালো। তখন রাজনের চেহারায়ও নেমে এসেছে ভীতি। সে এক প্রতারক।
পিলু মোটরসাইকেলের স্টার্ট থামিয়ে চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, দ্যাখতে তো তুমারে নিষ্পাপ লাগে, ভালোও বাসছিলাম কলিজা দিয়া, কিন্তু ক্যামনে তুমি দশটা হাজার টাকা হজম করলা নাবিলা!
রাজন কিছু বলছে না দেখে নিহা বলল, অাপনি কাকে কী বলছেন! অামি নাবিলা না। অামার নাম নিহা। অাপনার কোন ভুল হচ্ছে।
এইবার রাজনও যেন সাহস পায় কিছুটা। সে বলে, এইভাবে ব্লাকমেইল করা শিখছেন কোথ্থেকে। ও অামার ছোটবোন। ওর নাম নিহা। নাবিলা নয়। বিশ্বাস না হলে দেখতে পারেন কাগজপাতি। ও মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে বাসায় যাচ্ছে। অাপনি রাস্তা ছাড়ুন।
যুবক তবু একটুও নরম হয় না। সে অাত্মবিশ্বাসের সাথে বলে, অামি ভুল কিছু করছি না। তোমার নাম নিহা হোক অার নাবিলা হোক কিছু যায় অাসে না। কিন্তু তুমি সেই মাইয়া। ফেসবুকে তুমার এক হাজারটা পিক অামি দেখছি। তুমি নিজেই চ্যাটিঙের সময় সেলফি তুলে পাঠাইছ। তুমার চিহারা অামার মনে গাইথ্যা অাছে। কসমেটিকস অার কাপড়ের লাইগ্যা অামার কাছ থেকে দশহাজার টাকা নিছো। তারপর ব্লক মারছ। পোলা হইলে এখুনি তোমারে বকছিন মারতাম। বহুত যন্ত্রণা দিছো অামারে। কতা কম, টাকা ফেলে বাসায় যাও। কিছু কমু না।
নিহা জোর দিয়ে বলে, অসম্ভব! অামার কোন ফেসবুক একাউন্ট নাই।
যুবক এবার পকেট থেকে তার মোবাইল বের করে। ডাউনলোড ফাইল অপেন করে নিহার সামনে ধরে— কও, এইগুলা তুমার পিক না! তুমি অামারে পাঠাইছ ইনবক্সে, অামি সব সেভ দিয়া রাখছি। যেইদিন তুমি অামারে ব্লক মারলা সেই দিন থেইকা কাম করি অার রাস্তায় রাস্তায় তুমারে বিছরাই। আইজ পাইলাম হরিণরে। দ্যাহো, পিকটা দ্যাহো। তুমি কি না।
নিহা এবার কেঁপে ওঠে সর্বাঙ্গে। তার ছবিতে যুবকের মোবাইল ভর্তি হয়ে অাছে। এই ছবিগুলো সে তুলেছিল রাজনের মোবাইলে।
রাজন যখন দেখে সে ধরা পড়ে গেছে, ফণা নামায়। পকেট থেকে পাঁচহাজার টাকা অার মোবাইল বের করে তড়িঘড়ি বলে, অাচ্ছা ভাই, দশহাজার টাকা হলেই হবে তো! এই নেন পাঁচহাজার টাকা অার মোবাইল। দুটো মিলে দশ হয়ে যাবে। এবার পথ ছাড়েন। এই রিকশা আগাও অাগাও। জ্যাম লেগে যাবে তো!
রিকশা যদিও ফুটপাতের গাঘেঁষে দাঁড় করানো হয়েছিল, তবু তো এটা ঢাকাশহর। এখানে রাস্তার পাশে একটা কুকুরও বিশ্রাম নিতে পারে না। অতবড় একটা রিকশা কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে! একটু পরেই রিকশার পিছে অারেক রিকশা এসে গুঁতা মারে। তার পিছে অারেক রিকশা। জ্যাম লেগে যায়। ট্রাফিকপুলিশকে উদ্ধত চেহারায় বাঁশি দিতে দিতে এদিকে ছুটে অাসতে দেখা যায়। এই সুযোগে নিহাদের রিকশা ছুট লাগায়।
সারাপথ একটা কথাও বলে না নিহা। রাজনও চুপচাপ। একটু অাগের ঘটনা সে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে চাইছে। কিন্তু দুঃস্বপ্নের মতো বারবার চোখের সামনে হাতপা মেলে দাঁড়াচ্ছে। নিহা থমথমে মুখে বসে অাছে অার চোখ মুছছে। অপমানে তার চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। ছোট্ট দুটো চোখ এতো জল কোথায় কীভাবে লুকিয়ে রাখে!
ছেলেমেয়ের থমথমে মুখ দেখে জুলেখা বেগম ভড়কে যান। ভাবেন, নিহার পরীক্ষা নির্ঘাত খারাপ হয়েছে। তিনি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন, কিরে নিহা, পরীক্ষা ভালো হয়নি!
'পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে'— এক কথায় জবাবটা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে যায় নিহা। মায়ের মন তবু অাশ্বস্ত হয় না। তিনি এবার ছেলের কাছে যান— পরীক্ষা কি খুব খারাপ হয়েছে?
অনিচ্ছাকৃত হাসি ফুটিয়ে রাজন বলে— পরীক্ষা খুব ভালো হয়েছে। টেনশন কর না তুমি।
—তাহলে অার কী হয়েছে? দুজনই মুখ কালি করে রেখেছিস কেন?
রাজন এবার রেগে যায় প্রচণ্ড। চিৎকার করে বলে, তুমি তোমার কাজে যাও। অামাকে একা থাকতে দাও। সারাক্ষণ খালি প্যানপ্যান!
রাজন পোশাক না বদলেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। এই গ্রহের সর্বনিকৃষ্ট কীট মনে হয় নিজেকে। সরফরাজ সাহেব তখন অফিসে। জুলেখা বেগমের গোসল হয়নি। তিনি গজগজ করতে করতে গোসলে চলে যান।
একটু পর নিহা রাজনের ঘরে অাসে। ভঙ্গিটা মারমুখি। তবে কণ্ঠ ভেজা। রাজন তখনো উপুড়। নিহা কান্না অাটকে রেখে বলে, তুমি অামার ভাই, এটা ভাবতেই অামার লজ্জা হচ্ছে।
এইটুকু বলে সে একটু দম নেয়। তারপর বলে— তাই তো বলি, হঠাৎ এতো টাকা তুমি কই পাচ্ছ! অামার পিকচার ব্যবহার করে তুমি ব্যবসা খুলছ। ছিঃ অাজ একজনের কাছে ধরা খাইলাম। কাল অারেকজনের হাতে অপমান হবো। কত জনের কাছ থেকে যে এইভাবে চিট করে টাকা নিছো! এখন থেকে অামাকে বোরকা পরে বাইরে বেরুতে হবে। নয়তো সবাই চিনে ফেলবে নাবিলাকে। অার রিকশাওয়ালাকে মানা করে দিও। চিট করা টাকার রিকশায় অামি চড়ব না।
রাজন হঠাৎ মাথা তুলতে গিয়েও অাবার নামিয়ে দেয় বালিশে। অামরা বুঝতে পারি, ছোট বোনটার ভেঙেপড়া অবয়ব খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু সে কীভাবে নিহার সামনে মুখ তোলে! সে বালিশে মাথা গুঁজে উপুড় হয়ে পড়েই থাকে নিষ্প্রাণ সরীসৃপের মতো।
নিহা ঢেলেই যায় তার কণ্ঠে লুকানো বিষ— তোমার টাকার দরকার, তুমি বাবাকে বলতা। না হয় অন্যকোন পথ দেখতা। এই পথটাই তোমার পছন্দ হল! ছিঃ! তোমার দেয়া কসমেটিকস বারান্দায় বের করে রেখেছি। কী করবা জানি না। ডাস্টবিনে ফেলবা না গায়ে মাখবা তোমার ব্যাপার। অামার ঘরে ওই জিনিস অার ঢুকবে না। ওহ! কেন যে ওই বিরানি খাইতে গেলাম। গা গুলাচ্ছে অামার। বলতে বলতে নিহা হড়হড় করে বমি করে দেয় রাজনের রুমের ফ্লোরে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.