নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নিজেকে এখনো প্রশ্ন করি, কিকরে হলাম আমি কবি

মাহদী আব্দুল হালিম

এই জন্মে এবং এরপরের জন্মেও (যদি সত্যি নতুনকরে আবার জন্মানোর সুযোগ দেন করুণাময় আমাকে,) আমি কেবল একজন কবি-ই হতে চাইব

মাহদী আব্দুল হালিম › বিস্তারিত পোস্টঃ

উপন্যাস ১

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৩:১৯

ভালোবাসার কাঠপোকা



একটা প্রশ্ন কয়েকদিন যাবতই তারেকের মাথায় কাঠপোকার মত গুণ গুণ করে, থামে না। বেলা মাথার ওপর উঠে এলে রাস্তা ঘাট কেমন সুনসান হয়, তার ভয় করে। কেমন একটা বাতাস ঝিরঝির বইতে থাকে, কান পাতলে মনে হয় কানাকানি করছে, বড় কাকা অবশ্যি বলেন, মরা প্রেতাত্মারা এভাবে বাতাসে কথা বলে। তাদের কথা কেউ বুঝে না। প্রেতাত্মা টেতাত্মার কথা শুনেই বয়ে গেছে তারেকের। খামোকা কান পেতে তার মর্মোদ্ধার করতে গিয়ে মৃত্যুর ভবিষ্যদ্বাণী শোনার খায়েশ নেই তার। কিন্তু এ সময়টায় তাকে মাঠে থাকতে হয়। দূরে তাকালে দুই কূলে কারো টিকিটি চোখে পড়ে না। বাশঁঝাড় ঘেঁষে ঝোপের মতন তার বিশ্রামের জায়গাটায় বাতাস বহে। ঝিরিঝির পাতলা বাতাস। কেউ যেন আদর করে তাকে ঘুম পাড়াতে চায়। সে ঘুমায় না। যতকিছুর মূল্যে হোক এ অভিশপ্ত ঘুম কখনোই ঘুমাবে না। বড় কাকা বলেন, প্রেতাত্মারাই এই ঘুম পাড়ায়। শুরুতে খুব সুখ সুখ অনুভূতি হয়। কিন্তু একবার ঘুমালেই হল, আর জাগতে হবে না। এ সময় সে গাভীটাকে অযথা ছড়ি দিয়ে আঘাত করে। এখানে সেখানে তাড়িয়ে বেড়ায়। না হয় অলস বসে থাকলে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে। প্রেতাত্মারা বুঝি খুব শক্তিশালী হয়। হাজারো উপেক্ষা করেও সেই ঘুম ঠেকানো যায় না। অবশ্যি এ সময় ঘুমিয়ে আর জাগেনি এমন কারো কথাও তো সে শোনেনি। তাহলে বড় কাকু যে বলেন। তাহলে রাস্তাঘাট এত সুনসানই বা হবে কেন? মানুষগুলি তাহলে যায়ই বা কোথায়? প্রথমে পাত্তা না দিলেও প্রশ্নটি এখন জটিল আকার ধারণ করেছে। কিছুতেই রহস্যের জট খুলছে না। সাধারণ কৌতুহল থেকে এখন অসুস্থতায় পরিণত হয়েছে। বড় কাকু তো সবজান্তা। গাঁয়ের মানুষ তার নাম আজাদ বোস্তামি পাল্টিয়ে সবজান্তা রেখেছে। গাঁয়ের মানুষের ভালোবাসার ভোটে নির্বাচিত মেম্বার আজাদ। মানুষের উপকারে বিরাম নাই তার। যার যখন ইচ্ছা হয়, আসতে পারে আজাদের কাছে। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে, অভিযোগ নিয়ে আবার বিনা অনুযোগে আজাদের সালিস বাটি প্রত্যহ তাই সরবই থাকে। গাঁয়ের মানুষের বড় আদরের আজাদ, তারা তাকে মেম্বার নয় সবজান্তাই বলে। কারণ, তার কাছেই নাকি আছে সব রহস্যের সমাধান। তারেকের কোন আপত্তি নেই তাতে। সে বোকাসোকা মানুষ। দুবেলা দুমুঠো পেলেই হল। বড়কাকুর কাছেই মানুষ। তার জন্মের আগে বাপকে হারিয়েছে। তার যখন দুবছর। কী একটা অসুখে মা মারা গেলো। তখন নাকি গাঁয়ের অনেকেই মরেছিল। সারা গাঁয়ে মৃত্যুশোকে হাহাকার পড়ে গেছিল। পীর ফকির এনে পরে সেই মৃত্যুক্ষুধা নেভানো হয়েছিল। এসবই শোনা বড় কাকুর কাছে। তার কেবল শোনে যাওয়াই কাজ বড় কাকুর সামনে। মুখ ফুটে কিছু বলবার সাহস সে এযাবত করেনি। আদৌ পারবে কিনা সে সম্ভাবনাও নেই। অবশ্যি তার দরকারও নেই। সে বড় কাকুর গরুগাভী দেখভাল করে, বিনিময়ে বড়কাকু তাকে দুবেলা দুমুঠো খেতে দেয়, ঈদে নতুন জামাজুতো দেয়, তার আর কিছু চাই না। সে বরং খুশি। পৃথিবীর সবচে সুখি মানুষটি এ মুহূর্তে সে। কিন্তু প্রশ্নটি কয়দিন যাবত একটানা কামড়ে যায়। যেন অসংখ্য কাঠপোকা। হঠাত বিকট আওয়াজে তার ভাবনায় ছেদ পড়ে। ধরমড়িয়ে ওঠে টের পায়, কাঁঠাল গাছের গদির মত কাণ্ডটায় বসে সে ঠিকই ঘুমিয়ে পড়েছিল। বাতাসটা বড্ড পাতলা। একদম ঘুম পাড়িয়ে দেয়। বিকট শব্দ করে পাখিটা তখন তাকে জাগিয়ে না তুললে এতক্ষণে সে প্রেতাত্মাদের পেটে চালান হয়ে যেত। আচ্ছা ওই পাখিটা এত বড় কেন? এত শব্দই বা করে কিভাবে? আরেকটা অদ্ভূত প্রশ্ন মাথা কামড়ে ধরে তারেকের নামে না। উঠে ছড়ি দিয়ে আঘাত করে গাভীর পুরু পাছায়। গাভীটা চরম বিরক্তি প্রকাশ করে একটু সরে দাঁড়ায়। এখান থেকে সরে যাওয়ার ইচ্ছা নাই। নরম ঘাসগুলো এখনো সব সাবার করতে বাকি। বার কয় ডাক ছেড়ে একটা ঢেকুর তুলে আবার ঘাড় নামিয়ে মনোযোগী হয় ঘাস খাওয়ায়। কি জানি কী হয় মাঝে মাঝে ছোড়াটার, খালি পেটায়। কিন্তু ছোড়াটা ভালো। বড় সাদাসিধে। বেলাটা পড়ে এলে, পুকুরে নামতে দেয়। আর কি যত্ন করে গাটা ধুয়ে দেয়। নারকেলের খোসায় গা মাজতে খুব আরাম। ছোড়াটা ভারি অদ্ভূত। কী জানি সারাক্ষণ ভাবতে থাকে। আর এই দুপুর বেলায়-ই যা। কি জানি কী হয়! বলা নেই হঠাত হঠাতই পাছায় সপাং সপাং বাড়ি। মাথায় আবার দোষ আছে কিনা কে জানে। সূর্যটা বড় তেজি। পিঠটা পুরে কয়লা হয় না কেন? রোদের তাপে ঘাসগুলোও তেতে ওঠে। খেলেই পানির তেষ্টা পায়। কিন্তু লবণগোলানো পানি ওই বিকেলের পর। তার আগে পুকুরের বালুপানি গলায় বিঁধে। দাঁতে বালু কিচকিচ করে। আর লবণ তো নেই-ই। তারপরও তেষ্টা কমে, পুকুরের পানসে বালুপানিতে।

দুই

বেলা পড়ে এলো বলে। তারেক গাভী পুকুরের দিকে হাঁকায়। তার মাথায় আবার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ দুপুরে অনেকগুলি বিরাট পাখি দেখেছে আকাশে। ভোঁ ভোঁ, কি তার প্রচন্ড আওয়াজ! এত বড় পাখি নিশ্চয় ভিনদেশ থেকে আসে। কই তাদের দেশে তো এরকম বড় পাখির কথা কারো কাছে শোনেনি। বড় কাকুও তো কোনদিন বলেন না। কোথায় উড়ে যায় কে জানে! ভাবতে ভাবতে কোমরে লুঙ্গির ছোট গিঁটটাতে হাত পড়তে মনে হয়-চারআনা পয়সা আছে। কাকীমার জন্য দুটো গুলের কৌটা নিতে হবে দোকান থেকে। বাকি পয়সায় কিছু মিঠাইও মিলবে। কাকীমাকে খুব ভালোবাসে তারেক। সেটা এজন্যই বোধহয়। মাঝে মধ্যেই মিঠাই, লজেন্স খাওয়ার পয়সা দেন। নি:সন্তান কাকীমার তারেকই ছেলের আসন দখল করে থাকে। কিন্তু বড় কাকুর ভাব-গাম্ভীর্যতা কখনো তারেককে আহ্লাদ করতে দেয়নি। তাই কাকীমা আদর করে কাছে টানলেও, তারককে যেতে হত গুটিয়ে শুটিয়ে। তারেকের প্রতি সৌহাদ্র আচরণে বড় কাকুর বিরাগ তা নয়, স্বভাব গম্ভীরতায় নিজেই নিজের প্রতি অসন্তুষ্ট আজাদ বোস্তামি। গাঁয়ের মোড়ল। অথচ নি:সন্তান। বংশের মান তিনি রাখতে পারেন না, তাই তার ভেতরের দুর্বলতা তাকে প্রতিমুহূর্তে ব্যথিত করে। আর তাই প্রকাশ পায় কারো না কারো প্রতি বিরাগ প্রদর্শনে। তারেক ভাবে না এসব নিয়ে। নিজের বাপ-মার স্নেহ পায়নি তো কী হয়েছে বড়কাকু কাকীমা তাকে স্নেহ দিয়েছে। কাকীমার টান তো একটু বেশীই, সেটা তারেক জানে। কাকীমাও তাকে আজাদের ব্যাপারে বলেছে, 'তোর কাকা তো তোকে যত্ন করতে কঞ্জুস নয় রে তারেক, তার অন্তরের জ্বালা তুই এখন বুঝবি না বাপ। অ নিয়ে বৃথাই মন খারাপ করিসনে যেন।' তারেকের মাথায় সারাদিন চিন্তার ঘুণপোকা গিনগিন করে, ভালোবাসার কাঠপোকারা তাকে সামান্য অযত্ন নিয়ে ভাববারই বা ফুরসত দেয় কই? সে বরং বড়কাকুর কাছে শোনা নানা গপ্পো নিয়ে চিন্তা করে। আজ জিগ্যেস করতে হয়, দুপুরে দেখা বিরাট পাখিগুলোর কথা। সুযোগ মিলবে তো? আশ্বস্ত নয় সে। রাত করে বাড়ি ফেরেন আজাদ। কোনদিন যদি তারেকের সাথে দেখা হয় রাতের আহার শেষে, তবে পানতামুক সাজিয়ে আয়েশ করে গপ্পো করেন। সেটা খুব একটা ঘন নয়। গাভী নির্বিকার হাঁটে। তার মাথায় আপাত কোন চিন্তা নেই বুঝাই যায়। পেট পুরে খেয়ে নিয়েছে, কিছু জমাও করেছে। এখন গাটায় একটু পানি পড়লেই হয়। রোদের তাপে তেতে ওঠেছে বড় গাটা। হেলতে দুলতে পথ চলে। লেজটা একটু একটু এদিক ওদিক নাড়ে। নিশ্চিন্ত ভাবেরই আলামত। অথচ তারেকের মাথায় চিন্তার রশি হিজিবিজি লেগে গেছে। ক'টা চিন্তা? কোনটারই তো কোন মীমাংসা হয় না। কেবল সব চিন্তারই শুরু হয় বড়কাকুর কথার জের থেকে, শেষও হয় বড়কাকুর ওপর ভরসা করে। বড়কাকুকে ভয় করার এটাও একটা বড় কারণ তারেকের কাছে। বড়কাকু বিরাট বিদ্বান। গায়ের মোড়ল। কত বড় বড় ষন্ডারা প্রতিদিন বৈঠক ঘিরে থাকে লাঠি হাতে। পেশীর সাথে মিলিয়ে ভয়ানক তাদের মুখায়বয়বগুলি। বড় পেঁচানো গোঁফে নাকি মন্ডার তৈল মালিশ করা থাকে। মন্ডার তৈলে শরীর চনমন হয়, কারো ওপর যখন তখন ঝাঁপিয়ে পড়ায় এর বড় ফায়দা বর্ণনা করে থাকে ষন্ডারা। এমন বিরাট অবস্থান থেকে তারেকের আজাদকে ভয় পেয়ে কাছেপিঠে না ঘেঁষা নিতান্তই সাধারণ। কিন্তু রহস্যময় ব্যাপারটা দশ মাথা ঘুরে তারেকের মাথায় আসতে কেবল সময়ই নয়, বুদ্ধির পুরু বাকলও ক্ষয় হয়েছে বিস্তর। উদ্ঘাটিত সত্যটা মেঘের আড়ালেই থাকে বহুদিন। আর গুণগুণ করে অযথাই তারেকের চিন্তান্বিত মাথায়। বড় বড় ষণ্ডারা তো এ দেশীয় নয়। বিহারী। মোড়লের সামান্য মাইনে থেকে বিহারী পালোয়ান লাঠিয়াল কেমনে রাখেন আজাদ? কেমনে রাখেন, এ পর্যন্তই আর সবার মত তারেকের মাথায় কাঠপোকা গুণ ধরে। বিরাট পাখির রহস্যটা তাহলে কী? বিহারীরাও বিদেশী। পাখিগুলোও যদি বিদেশী হয় তাহলে তো একটা যোগসূত্র দাঁড়িয়েই যায়। কিন্তু কী সেটা? নাহ্, কাঠপোকাগুলো বড্ড শব্দ করে ভেতরে? আচ্ছা, এর বেশী, কোন চিন্তারই বেশী কথা সে ভাবতে পারে না কেন? আজাদকে ভয় করে কেন? কাকীমাকে এত ভালোবাসে কেন? নাহ্, কেমন সব তালগোল পাকিয়ে যায়। একটা একটা করে চিন্তা করে দেখলে কেমন হয়? তাও নয়, চিন্তাগুলো আকাশের বিরাট থালায় ছড়ানো তারার মত একটার গায়ে আরেকটা। আলাদা করে ভাবা যায় না। এরচে' গাভী হলেই বরং ভালো হোত, অভিমান হয় নিজের ওপর। গাভীটাতো শুধু সকাল বেলা একটু সবুজ ঘাস নিয়ে ভাবে। বিকেলে পেট পুরে খেয়ে স্বস্তির নি:স্বাস ফেলতে পারে। সে তো তাও পারছে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, এইসব নিয়ে সে আর ভাববে না। কোনদিন এইসব মনে হলে কাজে ব্যস্ত হবে। কিংবা ছড়া কাটবে, গলা ছেড়ে অযথা গান ধরবে। চিন্তাগুলোর হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায় তবে

তিন

গাভী গোয়ালের দরজায় বেঁধে তারেক লবণ পানি বানায়। কাকীমা ভেতর থেকে ডাকে। "তারেক বাপ, গুলের কৌটা আনছিস?" তারেক উত্তর দেয়, এই যাইতাছি। গাভীটার একটা হিল্লে করে যেতে হয় যে বড়মা। " হু, তাই যা। আর দেখিস, সাবধানে যাস যেন। বাতাস খারাপ। " তিন মাগরিব পড়ে পড়ে। তরিঘড়ি করে শফিক দোকানের ঝাঁপি ফেলতে ফেলতে তারেককে দেখে। এদিকে আসছে। "কিরে, কিছু লাগব নাকি? আজান দিতে হইব যে, আয়, তরে দিয়াই দোকান বন্ধ করি।" গুলের কৌটা দুটো কোমরে গুঁজে নেয় তারেক। ' খবর রাখছ, দেশের হাওয়া দ্রুত পরিবর্তন হইতাছে। তোর তো এইগুলা হুইনা কাম নাই, বাদ দে। কেমন আছস, তরার মোড়ল কেমন? টিটকারির মতন শোনায় শেষের প্রশ্নটা? গাঁয়ের অর্ধেক মানুষ আজাদ মোড়লকে ঘৃণা করে সেটা তারেকও জানে। কিন্তু আবার ভালোবাসে এমন মানুষও কম নেই। যারা ভালোবাসে তারা দিল উজার ক'রে, যারা ঘৃণা করে তারা সর্বাঙ্গে। দুয়ের এই তফাতের কোন সদুত্তর তারেকের জানা নেই। কিন্তু দেশের হাওয়া বদলের সাথে আজাদ মোড়লের অবস্থার কী সম্পর্ক? তারেক ভাবে। তাকে ভাবতে হয়, আজাদ মোড়ল কি দেশের হাওয়া বদলের সাথে জড়িত তাহলে? আর এই হাওয়া বদলেরই বা কী অর্থ? কাকীমাও বললেন, বাতাস খারাপ, শফিক মুআজ্জিন বলে হাওয়া বদল, কী অর্থ এসবের? মাথায় কাঠপোকাগুলো হঠাত কোথায় উধাও হয়। চিন্তার গুণগুণ শব্দ আসে না। লজেন্সের সুখেই হয়তোবা। গুলের কৌটা নিয়ে কাকীমা বলল, বাইরে তোর কাকাকে নিয়ে বড্ড সংলাপ হয় না কিরে? কী বলে লোকে? কাকীমাকে দু:খিত করতে চায় না তারেক। ঠোঁট উল্টিয়ে জবাব দেয় কই হুনি নাইতো কিছু। হ। তুই কোত্থেকে হুনবি এইসব রাজনীতির কথা। তোর কাজ তো বন-বাঁদারে। কত কইলাম, স্কুলে যা, না তা যাবে না। নবাবপুত্তুর, পড়ালেখা করবে না, আবার মুখে মুখে বড় কথা মোড়ল হবে। খিস্তি ঝরে কাকীমার ভাঙ্গা কণ্ঠে। টের পেয়েছেন, স্বামীর বিরুদ্ধ ক্ষেপে উঠেছে গাঁয়ের মানুষ। তারেক মাথা নীচু করে রাখে। খামোকা লাগতে যায় না কাকীমার সাথে। বলুক না আর কিছু। জানে, এইসব রাগ তার ওপর না, নিজের মানুষের ওপর যাচ্ছে। কিন্তু তার মত কাকীমাও আজাদের সামনে অবলা। তাই কাকীমা প্রতিদিন খিস্তি শোনায় একাকী তারেককে। তারেক নির্বিকার সব শোনে। কোনদিন প্রতিবাদ করে না। নিজের তার দুই কুলে বলতে তো এরাই। দুবেলা দুমুঠো খেতে দেয়, পরতে দেয়, একচিলতে ঘুমোনোর জায়গা দেয়। তার আর কী চাই? এই মুহূর্তে সে পৃথিবীর সুখি মানুষদের একজন। বাইরের কিছু নেই বলেইতো একমাথা চিন্তা আছে তার। কাঠপোকার মত নিরন্তর কাটতে থাকে, থামে না। সন্ধ্যায় কাচারি ঘরে বৈঠক বসেছে। আজাদ বোস্তামি গাঁয়ের কিছু ময়মুরুব্বি নিয়ে মিটিং করে। দেশের চলমান রাজনীতির হাওয়া বদল নিয়ে চিন্তিত মহাজনরা। তারেক বৈঠকে চা পরিবেশন করে। আরো কতদিন বৈঠক বসেছে। সে চা পরিবেশন করেছে। কিন্তু কোনদিন কান পাতার গরজ অনুভব করেনি। আজ কান পাতে। হয়তো রাজনীতির সাথে বেরিয়ে আসবে হাওয়া বদলের কারণ। একজনের নাম খুব শোনে তারেক। সবাই বলে নামটা। শেখ মুজিব সাহেব। পশ্চিম পাকিস্তানের আহ্বানে আলোচনায় যাবেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জেতার পরও আলোচনায় যেতে হবে তাকে। মুরুব্বিদের কেন' এর জবাবে আজাদ ক্ষেপে ওঠে। দালাল হারামি। ইন্ডিয়ার দালাল, বোঝেন না নাকি আপনারা। আমার চোখে এখন দিবালোকের মত পষ্ট, ইন্ডিয়ার গোলামী করতাছে শেখ সাহেব। আমরা আলোচনার ফলাফলা পর্যন্ত দেখব। " মোড়লের সামনে আর কেউ প্রতিবাদ করে না। প্রতিবাদের ক্ষমতা রাখে না তা নয়, এরা মোড়লেরই পারতপক্ষের লোক। এদের আস্কারাতেই আজাদ এতটা প্রতাপী। আবার ভালোবাসাও আছে, সে খাটে গাঁয়ের মানুষের পক্ষে। মানুষ তাকে ভালোবাসে। গফুর মেম্বার তার প্রতিদ্বন্দ্বী। পথে ঘাটে আজাদের কুৎসা রটায়। মানুষের সেবা তো দূরের কথা, এটা ওটা চাঁদার নাম করে সারাবছর গুন্ডাপান্ডা দিয়ে আদায় করে। তারপরও দুপক্ষের দলই ভারি, টের পায় তারেক। শফিক মুআজ্জিনরা এই গফুরেরই লোক। রাজনীতির হাওয়া বদলের সাথে তাহলে গফুর মেম্বারের দল আর আজাদের দলের শত্রুতার সম্পর্ক। মাঝে আছে শেখ মুজিব সাহেব। তারেকের মাথায় এখন এক মন ওজনের চিন্তার বিরাট ডিপু। শেখ সাহেবের আলোচনার পর হিসেব কিতেব হবে, কারা তার সংগ দিবে? আজাদের দল নাকি গফুরের? তারেক বিপাকে পড়ে যায়। শেখ সাহেবকে এখন উদ্ধার করতে হয়, কে এই লোক? যাকে ঘিরে এখন দেশের রাজনীতির ঘুটি চালান হচ্ছে পক্ষে বিপক্ষে।



শেখ সাহেবের সন্ধান পেতে দেরী হয় না। সকালে গোয়াল থেকে গাভী ছাড়ানোর সময় দেখা শফীকের সাথে। এদিক হয়ে যাচ্ছিল। বড় উত্তেজিত। তার সাথে কবির। গফুর মেম্বারের জরুরি তলব নাকি আছে। এরইমধ্যে দুটো প্রশ্ন করে জেনেছে শেখ সাহেবের সম্বন্ধে। তবে আরো জানতে হবে। কে তাকে জানায় আর? মোড়লের পালতু ছেলে, পড়া লেখা বিরাগী রাখাল বলে সবাই তাকে মাথা খারাপই মনে করে। অথচ পাঠশালায় সে গিয়েছে। ভালোই যাচ্ছিল ক'দিন। ক্লাশ টুতে উঠতে না উঠতে বই পত্তরের এত্ত করে পড়া তার স্বাধীনতায় বাগড়া বসায়। বনবাদারের তারেকের মন বইয়ের পাতায় ধরে না বড়। সে মুক্তি চায়। একদিন পড়া না পারার অজুহাতে মাস্টার বেদম পিটায় তারেককে। আজাদ খুশি হয়, বাদরামির শাস্তি সে পেয়েছে বলে। কাকীমা দিনভর কেঁদে সিদ্ধান্ত করে তারেকের আর স্কুলে যেতে হবে না। পড়ালেখা না করে ছেলেরা তো আর হাতগুটিয়ে ঘরে বসে থাকতে পারে না। তারেককে তাই গরুগাভীর দেখভাল করতে হয়। এতে সে বরং খুশিই। হাজার হোক বই খাতা নিয়ে তো আর বসতে হবে না।

কিন্তু আজাদের সংসারে কাকীমার সিদ্ধান্তের থোরাই দাম দেয়া হয়। স্কুল বাদ দিলেও আজাদ গৃহশিক্ষক নিয়োগ দেয়। মাসখানেক গেলে গৃহশিক্ষক বিদায় হয়, ছাত্র থাকলে তো পড়ানোর দায় থাকে। সারা মাসেও একদিন গৃহশিক্ষকের মুখোমুখি হয়নি তারেক। বনবাদারের সংগ ছেড়ে অল্পই ঘরমুখো হয়। তাও কাকীমার সোহাগের এতটুকু টান আছে বলেই। আজাদ ব্যস্ত তার রাজনীতি, প্রতাপ, চেলাচামুন্ডা নিয়ে। নিতান্ত অবসরে মাসে দুচারদিন তারেক তাকে পায়। আর আজগুবি গপ্পো শোনে। তারেকের কাছে আজাদের কোন ত্রুটি নেই। কিন্তু স্বভাবচাপা আর প্রতাপী বলে বড় একটা কাছে ঘেঁষে না সে। তাছাড়া তার বনবাদারেই বেশী ভালো লাগে। আজাদের মোড়লগিরির সস্তা চাকর হতে তার কোন ইচ্ছে নাই। বারোয়ারি বিহারীরা আছে, লাঠিয়াল, মারমুখো। দেখলেই কেমন কাঁপন ওঠে বুকে, কি রকম ষণ্ডা চেহারা ওদের!

গাভীটার কোন মাথাব্যথা নেই কিছুতে। তার এখন পেটের চিন্তা। মাঠে যাচ্ছে, খেয়ে দেয়ে ফিরবে। আর কি! তারেকের উদ্ধার করতে হয় শেখ সাহেবের আলোচনা। আজাদ ও গফুরের রাজনীতির লড়াই। কিন্তু কে তাকে বলবে? সবাই হেলা করে, রাজনীতি জানারও বুঝি কোন বয়স লাগে?

করিম বখশ আসে। হাতে বাজারের ব্যাগ, গুটানো। তারেক সালাম দেয়। করিম বখশ তিরিশ-পয়ঁত্রিশের যুবক। আজাদ না গফুরের দলে, তারেকের জানা নেই। এ ক'দিনে সে ঠিক বুঝে গেছে পাড়ার বেবাক লোক আজাদ আর গফুরে ভাগ হয়েছে। দুটোতে একটা শক্ত মারকাট হবে। করিম বখশ তারেককে দেখে হাসে। আজাদের রাজনীতির সাথে এই নাবালকের থোরাই সম্পর্ক। আদতে নেই বললে চলে। বাপমা মরা ছেলে, আজাদের কোলেপিঠে মানুষ। আজাদের দোষে তাকে দোষী করা অন্যায়।



করিম বখশ বাজারের মুখ থেকে হইচইয়ের আভাস পেতে থাকে। গনেশের টিস্টলের সামনে বড় জটলা বেঁধে গেছে এতক্ষণে। একজন বড় গলায় কিছু বলছে। গফুর মেম্বারই তো। সকালে একটা প্রতিবাদ মিছিল বার করার কথা ছিল। ওইটাই বোধয়। বেশ ছেলেপিলে জুটে গেছে দেখি। নাহ্, এ পক্ষের জনসমর্থনও তো কম নয়। সবচে' বড় কথাটা হচ্ছে, আজ সত্য যখন সবার সামনে, জাতীয় মৃত্যু যখন অত্যাসন্ন, স্বাধীনভাবে বাসের অধিকার যখন বিদেশীদের অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপে ক্ষুন্ন, ভাতের অধিকার নেই, পানির অধিকার নেই, ভাষার অধিকার নেই, বাঁচার অধিকার নেই তখন কেবল জীবনের সুখস্বপ্নগুলি পাশে সরিয়ে মৃত্যুভয় জয় করে গর্জে ওঠাই হয়ে ওঠে প্রকৃত কর্তব্য। বিড়াল মরিয়া হলে বাঘের মুখও খামচে দিতে কুণ্ঠিত হয় না। তাই মজলুম জনতা শেষ অবলম্বন হিশেবে আন্দোলন, লড়াইকেই বেছে নিয়েছে। এতে সবার স্বত:স্ফূর্ত অংশগ্রহণ ভবিষ্যত স্বাধীন দেশের সম্প্রীতির পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

জয় বাংলা ধ্বনিতে বাজার কেঁপে ওঠে। হাতিমতলা বাজার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে গফুর মেম্বারের মিছিল বের হচ্ছে। খবরটা রাষ্ট্র হতে সময় লাগে না। আজাদের কাছে আগেই খবর পৌঁছেছে। কিন্তু আসন্ন বিপদ সম্পর্কে তার কর্তব্য স্থির হতে সময় লাগে। জন সমর্থন এমনিতে গফুরের বেশি। আজকাল যত বাড়ছে কেবল। শেখ মুজিবের বড় বড় কথায় ভোলা জনগণ পটতে বসেছে। যাই করুক, পাকিস্তান গভ:মেন্ট সোজা পাত্র নয়। এ ধরনের ফেরেববাজি নিস্তনাবুদ করতে তাদের ইশারাই যথেষ্ট। কিন্তু আজাদের টনক নড়ে, যখন মিছিলের লেজ বাড়তে থাকে ক্রমাগত। চল্লিশ-পঞ্চাশটা তরুণ ছেলে ছোকরা গাঁ সুদ্ধ টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তান নিপাত যাক, জেনারেল ইয়াহিয়া নিপাত যাও। ভুট্টো তুমি নিপাত যাও। শেষে জয় বাংলা ধ্বনি, আকাশ বাতাশ কাঁপিয়ে গর্জে ওঠে মিছিলের কণ্ঠে। আজাদ দমবার পাত্র নয়। লাঠিয়াল বাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে বলে সে শহরের সাথে টেলিযোগাযোগ করবার চেষ্টা করে। সেইসাথে শেখ সাহেবের আলোচনার ফলাফলও জানতে হবে।

চলছে......

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৩:২২

মাহদী আব্দুল হালিম বলেছেন: এখনো নির্মানাধীন। ভাবনা চলছে। উপযুক্ত মন্তব্য পেলে উৎসাহিত হব, এই আশায় আজ প্রথম কিস্তি পরীক্ষামূলক প্রকাশ করলাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.