![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছবি : এফএএস / রেহমান আসাদ
একটা সময় ছিল যখন বিজয় দিবস অথবা স্বাধীনতা দিবস এলে বেশ উৎফুল্ল ভাব হত। বিজয় দিবস অথবা স্বাধীনতা দিবসে দেশাত্ববুধক গান শুনে ধমনীতে রক্ত অনেকটাই উষ্ণ হয়ে উঠতো, ভেতরে তোলপাড় সৃষ্ঠি হত অথবা মুক্তিযুদ্ধার সন্তান হিসেবে আবেগআপ্লুত হয়ে যেতাম। কিন্তু সত্য বড় নির্মম, বাস্তবতা অনেক কঠিন। নিজেকে জোর করে স্বাধীন ভাবার চেষ্ঠা করলেও বিবেক বার বার প্রশ্ন করে আমি কি আসলেই স্বাধীন ? আর বাস্তবতা উত্তর দেয় “আমরা কখনই পূর্ণ স্বাধীন ছিলাম না, এখনও না” । বিজয় দিবস অথবা স্বাধীনতা দিবসে দেশাত্ববুধক গান শুনাকে স্বাধীনতা বলে না, দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর পশ্চাৎদ্দেশে লাথি মেরে পাক হায়েনাদের পাকিস্থান পাঠিয়ে দেয়াকে স্বাধীনতা বলেনা ।
যে দেশে জনগন মুখ ফুটে সত্য কথা বলতে ভয় পায় শাসক বাহিনীর ডান্ডার ভয়ে, যে দেশে সাইদি, নিজামী, আজম, সাকারা শাষকের আসনে বসে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্জনকে পদদলিত করে, যে দেশে রাজাকারেরা স্বাধীন বাংলার পতাকা নিজের গাড়িতে লাগিয়ে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করে, যে দেশে আমরা প্রতি ৫ বছর পর পর লাইন ধরে দাঁড়াই এটা ঠিক করার জন্যে যে কারা আমাদের আগামী ৫ বছর সর্বস্ব লুটে খাবে, যে দেশে হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কেউ-ই বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেনা যে আজকে আমি নিরাপদ, আজ আমি ডান্ডার বাড়ি কিংবা চাপাতির কোপ না খেয়ে বাসায় ফিরতে পারবো, যে দেশে আমার মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত টাকার ট্যাক্স মেরে দিয়ে আকাশ ছোয়া অট্টালিকা তৈরি করে আমাদেরই শাসক, যে দেশে আমার পিতার হত্যাকারী কোন এক অজ্ঞাত কারণে মাফ পেয়ে যায় রাষ্ট্রপতির দরবারে, যে দেশে আমার নিরপরাদ ভাইকে রাস্তায় বের হলে হায়েনাদের কুপ খেয়ে লাশ হয়ে বাসায় ফিরতে হয়, যে দেশে একজন মুক্তিযোদ্ধা যিনি দেশ স্বাধীন করার জন্য ৭১ সালে হাতে রাইফেল ধরেছিলেন আজ স্বাধীন দেশে ২০১২ সালে তাকে জীবন যুদ্বে টিকে থাকার জন্য সেই হাতে রিকশার হ্যান্ডেল ধরতে হয় । একজন মুক্তিযোদ্ধাকে বৃদ্ধ বয়সে মাসিক ২০০০ টাকা বেতনের জন্য মেডিকেলে লাশ টানার কাজ করে হয়, অথবা কোন অক্ষম মুক্তিযোদ্ধাকে তার পরিবার পরিজন নিয়ে চলার জন্য শাসকের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষুকের মত ঘুরতে হয়।
শহীদগণ কি এজন্য প্রাণ দিয়েছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাগন কি এজন্য যুদ্ধে গিযেছিলেন ? বঙ্গবন্ধু কি এজন্যই যার যা আছে তাই নিয়ে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়তে বলেছিলেন ? দেশে আমরা কি স্বাধীন? এই কি আমাদের বিজয়?
আমরা প্রতিটি বাঙ্গালী আজ বন্দী। আমরা পরাধীন। আজও কান পাতলে দেশে পাকিস্তানীদের দোষর আর বাংলার মা বোন দের সম্ভ্রম হননকারী রাজাকার দের হুংকার শুনা যায় আর মুক্তিযোদ্ধাগন তাদের চিরশত্রু রাজাকারের বিচারের জন্য অসহায়ের মত প্রলাপ করেন। এদেশে শুধু ভীনদেশি থেকে নিজ দেশি শোষক বদলেছে, আমাদের কিছুই বদলায়নি। আত্মিক আর মানসিক এই বন্দিত্বের লৌহবেড়ি পায়ে বেঁধে আমরা শহীদ মিনারে আদিখ্যেতা দেখাতে যাই। বিজয়ের গান গাই। বিজয় দিবসে ফেইসবুকে লাল সবুজের জোয়ার এনে দেই। দেশপ্রেমিক জনগনের কাছে আমি দুংখিত কারন এই পরাধীনতার পাথর মাথায় রেখে বিজয় দিবস নিয়ে আবেগআপ্লুত হওয়ার কোন মানসিকতা আমার নেই। আমাকে অনেকে অনেক বিশেষনে আখ্যায়িত পারেন। সানন্দে মাথা পেতে নেব। তবুও আমি মাথা উঁচু করে চিৎকার দিয়ে বলবো, এটা বিজয় নয়। এটা স্বাধীনতা নয়। আমার পিতৃতুল্য মুক্তিযোদ্ধাগণ ও মাতৃতূল্য বিড়ঙ্গনাগণ এই খোলস পরানো আনুষ্ঠানিকতার এই বিজয় দেখতে চাননি।
বাংলাদেশের বিজয় উৎসবে আমার আনন্দ হয় না, আমি উল্লাসে ভাসতে পারিনা সবার মতো। আমার মনে পড়ে ক্ষত-বিক্ষত নিথর কিছু লাশের কথা। আমার মনে পড়ে সকিনা বিবির ছেঁড়া আঁচলে রক্তের দাগের কথা। আমার মনে পড়ে হাসু আপার বুকফাটা আর্তনাদের কথা। আমার মনে পড়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ও আছিয়া বেওয়ার সন্তান হারানোর বেদনার কথা । আমার মনে পড়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পা হারানো মুক্তিযোদ্ধার আর্তনাদের কথা। আমার মনে পড়ে হায়েনার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য উদ্ভাস্তুুতে পরিণত হওয়া লক্ষাধীক নিরীহ বাঙালীর মানবেতর জীবনযাপনের কথা। মনে পড়ে জানোয়ার কাছে সম্ভ্রম হারানো আমার অসহায় মা-বোন দের কথা ।
আমার মনে পড়ে সেই হিংস্র কুকুরদের কথা, যারা আজো বাংলার বুকে জীবিত। যারা আজো ক্যান্সারের মতো কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে, আপনাকে, এই বাংলাদেশের উজ্জ্বল দীপ্তিময় তরুনদেরকে। আজো যারা বিভ্রান্তি করে যাচ্ছে লাশের সংখ্যা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাঙ্গালী জাতিসত্তাকে । তারাই আজ প্রশ্ন তোলে যুদ্ধাপরাধের বিচার ও ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে।
বাংলাদেশের প্রকৃত বিজয় সাধিত হবে সেদিনই, প্রতিটি বাঙালি পাবে পাবে তার মৌলিক অধিকার অধিকার, থাকবে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কোন মুক্তিযোদ্ধাকে মানবেতর জীবন যাপন করতে হবে না, যেদিন কোন মুক্তিযোদ্ধাকে আক্ষেপ করতে হবে না যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়নি বলে, যেদিন দেশে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকবে না, যেদিন রাজনৈতিক রোষানলে পড়ে লাশ হয়ে ঘরে ফেরা বিশ্বজীতকে নিয়ে তার মাকে কাঁদতে হবে না, যেদিন কেউ বলবে না, "বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের চক্রান্ত", যেদিন কোন রাজাকারের সন্তানেরা মুখ ফুটে বলতে পারবে না, "মুক্তিযোদ্ধারা কুকুরের বাচ্চা", যেদিন কোন চৈনিক বাম টিএসসিতে দাঁড়িয়ে বলতে পারবে না, “তথাকথিত স্বাধীনতা" অথবা বলতে পারবেনা “৯ মাস এর যায়গায় ৯ বছর যুদ্ধ হলে একটাও মাঠে থাকত না ”!
আমি সেইদিনের স্বপ্ন দেখি, যেদিন সব ধর্মের মানুষ পাবে সমঅধিকার , সবকিছুর উপরে স্থান পাবে মানবতা, যেদিন সমির মাস্টার তাঁর ছেলেকে বড় করবেন একজন সৎ ও সফল রাজনিতীবিদ হিসেবে দেখার জন্য, কৃষক জামালের ঘরে নতমুখে দাঁড়িয়ে সাংসদ বলবেন, “আমাকে ক্ষমা করেদিন। আপনি ধানের সঠিক দাম পান নাই, এটা আমার ব্যর্থতা", বিশ্বজিতের খুনিদের ঝুলন্ত ফাঁসিকাঠে ঝুলতে দেখে শান্ত হবে নাগরিক মন। সারা বাংলাদেশ এক হবে একই পতাকা তলে, হুংকারে হুংকারে সারা বিশ্বকে কাঁপিয়ে বলবে, “জয় বাংলা!"
অনন্ত নক্ষত্রবিথীর তলে, ক্ষুদ্র গ্রহের অতিশয় ক্ষুদ্র বাংলাদেশের এক গৃহকোনে বসে আমি আমার সন্তানকে বলবো, “এইতো আমাদের বিজয়, আমাদের স্বাধীনতার নিস্পাপ এই অর্ঘ তুলে দিয়ে গেলাম তোমার হাতে হে ভবিষ্যচারী, গ্রহন করো।"
©somewhere in net ltd.