নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মঞ্জুর চৌধুরী

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!

মঞ্জুর চৌধুরী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফাক ইউ

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৩:৫২

দূর থেকে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঠা ঠা ঠা ঠা!!! যেন বুলেটের বৃষ্টি হচ্ছে সেখানে। সাথে বজ্রপাতের মত ক্ষণিকের বিরতি দিয়ে দিয়ে শোনা যাচ্ছে কামানের গোলার শব্দ।

পুরো শহর অন্ধকার, কিন্তু সবাই জেগে আছে। আতঙ্কে কারও চোখে ঘুম নেই। সবাই ঘরে স্বেচ্ছাবন্দী। বাইরে যে তান্ডব ঘটছে তাতে কোনই সন্দেহ নেই, তবে সেই তান্ডব কতটুকু ভয়াবহ, সেটা ঘরে বসে কল্পনায় ধরা যাচ্ছে না।

গোলাগুলির শব্দ কাছে এগিয়ে আসছে। গৃহকর্তা হযরত আলী বাতি নিভিয়ে ঘরের সবাইকে নিজের শোবার ঘরে নিয়ে এলেন। তিন মেয়েই মায়ের আঁচল ধরে ফোপাচ্ছে। মায়ের কোলে দুই বছরের শিশুপুত্র। ঘুম। বাইরের জগতের ভয়াবহতা সম্পর্কে এখনও সে কিছু বুঝতে শিখেনি। শিশুরা অনেক সুখী হয়ে থাকে।

স্ত্রীর হাত ভয়ে কাঁপছে। হযরত আলী তাঁর স্ত্রীকে সাহস দিতে তাঁর হাতে হাত রাখলেন। তিনি নিজেও আতঙ্কিত। প্রিয় মানুষগুলোর নিরাপত্তার চিন্তা তাকে দিশেহারা করে ফেলছে।

স্বামী স্ত্রী দুজনেই এক মনে আল্লাহকে ডেকে চলেছেন। বিপদের সময়েই মানুষ আল্লাহর কথা বেশি বেশি স্মরণ করে।

"ইয়া নফসি! ইয়া নফসি!! ইয়া নফসি!!!"

কেয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে যাবার সময়ে কবর থেকে উঠে আসা মানুষরা এই নামেই জিকির করবে। বাইরে যা ঘটছে, তাকে কেয়ামত বললে কি খুব একটা ভুল হবে?

গোলাগুলির শব্দ যেন একটু থেমেছে বলে মনে হলো। তাহলে কি ওরা হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করেছে আপাতত? মানুষ খুন করতে করতে হাপিয়ে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছে? কাল আবার পুর্ণদ্যমে প্রলয়কান্ড শুরু করবে? তবে কি তাঁরা আরেকটি রাতের জন্য বেঁচে গেলেন? আহ! বেঁচে থাকা যে কতটা মধুর, সেটা এই পরিবারটি আগে কখনই উপলব্ধি করতে পারেনি!

ঠিক তখনই সদর দরজায় একদল লোক লাথি দিতে শুরু করলো। সেই সাথে অশ্রাব্য গালাগালি!

"এই শুয়োরের বাচ্চা! এই '..'কির পোলা! দরজা খোল!"

ভয়ে হযরত আলীর তিন মেয়েই কেঁদে দিল। স্ত্রী বাচ্চাদের সামলানোর চেষ্টা করছেন। পারছেন না। তিনি নিজেও কাঁদছেন। কোলের শিশুটি তখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মায়ের কোলে রয়েছে সে। এরচেয়ে নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা আর প্রশান্তি কোথায় পাবে সে?

ওরা দরজা ভেঙ্গে ফেলছে। হযরত আলী দরজা খুলতে এগিয়ে গেলেন। স্ত্রী বাঁধা দেয়ার মৃদু চেষ্টা করলেন। কিন্তু কাঠের দরজা কতক্ষন ওদের আটকে রাখতে পারবে?

হুরমুর করে একদল লোক ঘরে ঢুকে পড়ল। এরা কেউ পাঞ্জাবি মিলিটারী নয়। বেশির ভাগই বাঙ্গালী, সাথে আছে কিছু বিহারী। সবাই সাধারন জনতা। কিন্তু আজকে তাদের দেখতে ঠিক 'জনতা'র মত লাগছে না। অন্ধকারেও তাদের চোখ জ্বলছে দাউদাউ করে। শ্বাপদের মত হিংস্র জিহ্বা লকলক করছে। দোযখের সম্রাট ইবলিশ শয়তান কি এদের চেয়েও ভয়ংকর?

এরপর বেশ কিছু ঘটনা অতি দ্রুত ঘটে গেল।

ছেলেমেয়েদের সামনেই খুন হলেন বাবা মা। তার আগে মা নিজের প্রাণের চেয়েও নিজের সম্ভ্রমহানীর ভয়ে অস্থির ছিলেন। ঘাতকেরা তাঁর প্রতি দয়া করলো। তারা তাকে বাদ দিয়ে বেছে নিল তার এগারো বছরের শিশু কন্যাটিকে। মা বাবার সামনেই ছোট্ট মেয়েটির জামাকাপড় টেনে ছেড়ে হলো। নরকের বিভিৎসতার সাথে কোনই পরিচয় ছিল না মেয়েটির। আজকে তাকে পরিচয় করিয়ে দিল তাদেরই প্রতিবেশী একদল 'দেশপ্রেমিক' যুবক।

হযরত আলী, তার স্ত্রী কাকুতি মিনতি করলেন তাদের মৃত্যু দ্রুত ঘটাতে। পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ যুবকেরা তাদের প্রতি এবারে ততটা দয়ালু হলো না।

হইচই হট্টগোলে শিশু পুত্রটির ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তাকে চুপ করাতেও বেশি সময় নিল না ওরা।

দেশদ্রোহী পরিবারটির প্রতিটা সদস্যের মৃত্যু নিশ্চিত করে তারা যখন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল, তখনও তারা জানেনা অন্ধকার তার গর্ভে ছোট একটি মেয়েকে লুকিয়ে রেখেছে। জীবিত। যে নিজের চোখের সামনে নিজের বাবা মামা ভাইবোনদের খুন হতে দেখেছে। আদরের বোনটিকে নিয়ে হিংস্র জানোয়ারদের দাপাদাপি দেখেছে। সবার প্রিয় ছোট ভাইটি, যাকে পালা করে সব বোনেরা কোলে নিয়ে আদর করতো, তাকেও নিরবে মরে যেতে দেখেছে। এত কিছু দেখার পরে মেয়েটির মাথায় প্রথমেই যে চিন্তা এলো তা হচ্ছে, "আমি কিভাবে বেঁচে গেলাম?"



স্বজনদের স্তুপিকৃত শবদেহের পাশে বিহ্বল বসে থাকতে থাকতেই আকাশের দিকে তাকিয়ে অদেখা বিধাতার কাছে প্রশ্ন করলো সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি, "আমাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলে তুমি?"

মহাজগতের নিয়ন্ত্রক উত্তর দিলেন চল্লিশ বছর পরে। এক বিশেষ আদালতে পরিবারের সকল সদস্যের হত্যাকারীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে এসে মেয়েটি সেদিনের সেই প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিল।

তাঁর এবং সাথে অন্যান্য অনেকের সাক্ষীর উপর ভিত্তি করে প্রমাণিত হয়েছিল কাদের মোল্লা একজন হত্যাকারী, কাদের মোল্লা একজন ধর্ষক, কাদের মোল্লা একজন দেশদ্রোহী রাজাকার!

মহামান্য আদালত প্রথমে ভুল সিদ্ধান্ত (গণহত্যার বিচার কী করে যাবজ্জীবন হয় সেটা এখনও মাথায় ঢুকেনা) দিলেও পরে গণআন্দোলনের মুখে তাকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলানোর আদেশ দিয়েছিল।

অনেকদিন পরে মেয়েটি বুঝতে পেরেছিল কেন পরম করুণাময় তাকে সেদিন বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।

ফাঁসি কার্যকর হবে দিবাগত রাত বারোটা এক মিনিটে। আসামির সব নিকটাত্মীয়েরা তার সাথে শেষ দেখা করতে কেন্দ্রীয় কারাগারে এসেছে। সাংবাদিকেরাও গেটে ভিড় করছে। বাংলার ইতিহাসের অন্যতম বড় খলনায়কের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হতে চলেছে। রচিত হতে চলেছে নতুন ইতিহাস। এই সময়টিকে ক্যামেরাবন্দী, কলমবন্দী করে রাখতে হবে না?

স্বামীর সাথে দেখা শেষে কাদের মোল্লার স্ত্রী উত্সুক সাংবাদিকদের দামী দামী ক্যামেরার সামনে দুই আঙ্গুল উঁচিয়ে বিজয় চিহ্ন দেখালেন।

সবাই হতবাক হয়ে ভাবলো, "ফাঁসির আসামী স্বামীর সাথে দেখা করতে এসে এই বিজয় চিহ্ন'র মানে কী?"

উত্তর পেতে এবার কারও দেরী হয়নি। সবসম্ভবের দেশে গণহত্যাকারীর ফাঁসির রায় স্থগিত হয়ে গেল মানবাধিকারের দোহাইয়ে!

সবাই বুঝতে পারলো, কাদের মোল্লার স্ত্রী দুই আঙ্গুল দেখালেও আসলে তিনি একটিই আঙ্গুল দেখিয়েছেন। ডান হাতের মধ্যমা। দ্য ফেমাস ওয়ান ফিঙ্গার সেল্যুট! সাংকেতিক ভাষায় তিনি পুরো জাতিকে বলে দিলেন, "ফাক ইউ!"

যে লোকটি তাকে পরিবারহারা করেছিল, তার বিচারের রাত্রিতে ঘুম আসছিল না মেয়েটির।

চল্লিশ বছর ধরে প্রতি রাতেই বাবা, মা, বোনেরা এসে তার সাথে দেখা করে যান। ছোট ভাইটি এখনও সেই ছোট্টটিই আছে। মৃত্যুর পর মানুষের বয়স বাড়ে না। মায়ের কোলে বসে মিটিমিটি হাসে। সে কোলে নিতে চাইলে আসতে চায় না। মায়ের কোলেই সিঁটিয়ে থেকে তার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি হাসে।

তার মাকে তার চেয়ে ছোট দেখায়। বোনেরা এখনও সেই আগের মতই ফ্রক পড়ে থাকে। বাবার কাঁচা পাকা চুলে বাড়তি পাক ধরে না।

এইপ্রথম, আজকে রাতেই তাঁরা কেউ এলেন না। মেয়েটি অনেকক্ষন প্রিয়জনদের আসার প্রতিক্ষা করলো। কেউ এলো না। তবে কি তারা অভিমান করেছেন? কার উপর?

ঘটনার নাটকীয়তায় বিহ্বল মেয়েটি গভীর রাতে বারান্দায় এসে চুপচাপ বসে থাকে। কাঁদতে ইচ্ছে করে তার, কান্না আসেনা। কিছু একটা ভাঙ্গতে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায়, কিছু ধরতে পায়না। মরে যেতে ইচ্ছে করে। মরে যেতে পারলে কি একটু শান্তি পাওয়া যেত? মৃত্যুর পরের জগৎটিতে যেতে পারলে কি তার এতদিনের তৃষ্ণাও তার পিছু নিত?

সে মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশটি এখনও সেই তেমনই আছে যেমনটা ছিল চল্লিশ বছর আগে। আকাশ কখনও পুরনো হয়না। সে বিড়বিড় করে বিধাতার কাছে সেই চল্লিশ বছর আগে করা প্রশ্নটিই নতুন করে করলো, "আমাকে কেন বাঁচিয়ে রাখলে তুমি?"

তার ধারনা ছিল সেপ্রশ্নের জবাব সে পেয়ে গেছে। এখন বুঝতে পারছে, বিধাতা এখনও উত্তর দেননি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.