নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর - আমি চির উন্নত শির!
খুনী
- মঞ্জুর চৌধুরী
১.
"বললে নাতো আজকে আমাকে দেখতে কেমন লাগছে?"
শম্পা খুব আহ্লাদী কন্ঠে জানতে চাইলেন।
শওকত সাহেব শেষবারের মতন আয়নায় টাইয়ের নটটা দেখতে দেখতে গলায় আলগা রোমান্টিকতা এনে বললেন, "তোমাকে অসুন্দর লাগে কবে?"
শম্পা নববধূর মতন লজ্জায় লাল হলেন। বললেন, "তাহলে বলো না যে?"
শওকত বললেন, "তুমি না সেদিন বলেছিলে আমার চোখ দেখেই তুমি সব বুঝে যাও? আমার নাকি মুখ ফুটে বলার প্রয়োজন হয় না?"
শম্পা বললেন, "কিছু কথা শুধু চোখের ভাষাতেই না, মুখের ভাষাতেও বলতে হয়।"
শওকত সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একটা দুষ্টু হাসি দিলেন। এ দৃষ্টির অর্থ শম্পা জানেন। তিনি বললেন, "একদম অসভ্যতা করবে না, খবরদার!"
শওকত সাহেব সেই দুষ্টুমির স্বরেই বললেন, "আমি কিন্তু কিছু বলিনি, তুমিই যা বুঝার বুঝে নিয়েছো।"
শম্পাও গলার স্বর পাল্টে বললেন, "এখন না, ফিরে এসে তারপর।"
শওকত সাহেব বললেন, "ফেরার পর তোমার কিছু মনে থাকবে? তখন ঘুমাবার জন্য অস্থির হয়ে যাবে।"
শম্পা স্বামীর বুকে মাথা রেখে আলতো গলায় বললেন, "ফেরার পর।"
আজকে তাঁদের বিয়ের চব্বিশতম বার্ষিকী। চব্বিশ বছর আগে এই দিনেই শওকত নামের এক মেধাবী ছেলের হাত ধরে শম্পা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন। এক বস্ত্রে গৃহত্যাগ যাকে বলে।
শওকত তাঁর সাথে এক ক্লাসে পড়তো। বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছিল বলে বাবা বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। ভীতু মেয়ে শম্পা মা বাবাকে শওকতের কথা বলতেও পারেনি।
শেষে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাঁর হাতে আর কোন উপায়ও ছিল না।
ভাগ্য ভাল ছিল যে শওকতের বড় ভাই তাঁদের ঘর থেকে বের করে দেননি। নাহলে যে কী হতো ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই শওকত স্কলারশিপ নিয়ে অ্যামেরিকা চলে যান, ক্যালিফোর্নিয়া। স্ত্রী হিসেবে শম্পাও নতুন দেশে পাড়ি জমান।
নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন জীবন! জীবনের শুরুতে সামান্য কষ্ট হলেও তাঁদের দিন সুখেই কেটেছে বলা যায়।
দশ বছরের প্রবাস জীবন শেষে তাঁরা যখন দেশে ফিরে আসেন, ততদিনে তাঁদের পায়ের নিচে শক্ত মাটি। কোলে ফুটফুটে শিশু শাহান।
আজকে বিবাহ বার্ষিকীর সাথে ডবল আনন্দ হিসেবে যোগ হয়েছে আজকেই শাহানের এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। সে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে!
ছেলে এখন গেছে তার বন্ধুর বাড়ি, বন্ধুর বাবা ছেলের সাফল্যে বাড়িতেই পার্টি দিয়েছেন। সেখানে সব বন্ধুরা মিলে সেলিব্রেট করবে।
তাঁরা যাবেন হোটেল ওয়েস্টিনে। সেখানেই ডিনার সারবেন। শাহানকে বলা আছে ডিনারের সময়ে মা বাবার সাথে যোগ দিতে। চব্বিশ বছরকে একটি বিশেষ মাইল ফলক বলা যায়। এই দিনটিতে পরিবারের সবার উপস্থিত থাকা ভাল। তারপর নাহয় বন্ধু বান্ধবদের সাথে আবার আড্ডায় মাতা যাবে।
বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে শম্পা স্বামীর হাত জড়িয়ে ধরে হাঁটতে লাগলেন।
"কোন কোলনটা গায়ে মেখেছো?"
শওকত সাহেব বললেন, "বারবেরি।"
শম্পা বললেন, "গন্ধটা সুন্দর।"
শওকত সাহেব আবারও স্ত্রীর দিকে দুষ্টু দৃষ্টি দিয়ে বললেন, "তাহলে কী টেবল রিজার্ভেশন আধঘন্টা পিছিয়ে দিব?"
শম্পা শওকতের বাহুতে কিল দিয়ে বললেন, "তুমি কিন্তু আজকে ভীষণ অসভ্যতা করছো বলে দিলাম!"
শওকত সাহেব বললেন, "তোমাকেও কিন্তু আজকে ভিশন সেক্সি লাগছে বলে দিলাম! হাহাহাহা।"
শম্পা কিছু বললেন না। হাসতে হাসতে স্বামীর বাহুতে মাথা রেখে হাঁটতে লাগলেন।
বিশাল প্রাডো গাড়িটা আজকে শওকত সাহেব নিজেই চালাবেন। ড্রাইভারকে ডাকলেন না।
গাড়িতে উঠে শম্পা সিটবেল্ট বাঁধলেন। দীর্ঘদিন অ্যামেরিকায় থাকার অভ্যাস!
স্ত্রীকে মোবাইল ফোন বের করতে দেখে শওকত সাহেব বললেন, "কাকে কল দাও?"
"বাবুকে। বলি যে আমরা রওনা হয়ে গেছি।"
"ওকে বলো যে পারলে আমরাই ওকে পিক করতে পারি।"
"হ্যালো, বাবু? আমরা বেরিয়ে গেছি বাবা! তুমি কতক্ষণে আসবে?"
শাহান বলল, "তোমরা পৌছে কল দাও মা। আমাদের এখান থেকে অনলি ফাইভ মিনিটস। আমি পৌছে যাব।"
"তোমার বাবা বলছিল তোমাকে আমরা পিক করতে পারি। ওখানকার অ্যাড্রেস কী?"
"That won't be needed. আমি পৌছে যাব। Just reach করে আমাকে একটা কল দাও।"
ফোন কেটে গেল।
শম্পা বললেন, "বলল যে আমরা পৌছে ওকে কল দিলে ও পাঁচ মিনিটে চলে আসবে।"
শওকত সাহেব বললেন, "গ্রেট! ততক্ষণ প্রাইভেটে তুমি আর আমি! ক্লাসিক স্টাইলে রোমান্স করা যাক, কী বলো?"
শম্পা জানতে চাইলেন, "কিভাবে?"
শওকত সাহেব উচ্চ ভল্যুমে সিডি প্লেয়ার ছেড়ে দিলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়ে উঠলেন, "এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বল তো!"
হেমন্তের সাথে পাল্লা দিয়ে শওকত সাহেব গলা ছেড়ে গাইতে লাগলেন। তাঁর গলায় কোন সুর নেই। শুনতে হাস্যকর লাগছে। শম্পা বাচ্চা মেয়েদের মতন খিল খিল করে হাসতে লাগলেন। শওকত সাহেব গাড়ির এক্সেলেটরে চাপ বাড়িয়ে দিলেন।
২.
"কী হলো? খেতে ভাল হয়নি?"
শওকত সাহেব স্ত্রীর চিন্তিত মুখ দেখে জানতে চাইলেন।
শম্পা বললেন, "বাবু বলেছিল পাঁচ মিনিট লাগবে আসতে। আধঘন্টা হয়ে গেল, এখনও আসছে না।"
শওকত সাহেব বললেন, "নানা বাড়ির স্বভাব পেয়েছে আর কি! ডোন্ট ওয়ারী, চলে আসবে।"
শম্পা কপট রাগের ভঙ্গি করলেন।
কেউ দেরী করলেই শওকত তাঁর বাড়ির লোকজনের সাথে তুলনা করেন।
শওকত সময়ের ব্যপারে অত্যন্ত পাক্কা। কিন্তু বাংলাদেশের আর কেউতো তাঁর মত নয়। লেটে পৌছানোটাই এখানে সাধারণ ঘটনা। তাঁদের বাড়িতে দাওয়াতে তাঁর বাপের বাড়ির লোকজনেরা স্বাভাবিকভাবেই এক আধঘন্টা দেরিতে পৌছায়। সেটাও রাস্তায় ট্রাফিক জ্যামের কারনে। এটা এমন কোন দোষেরও কিছু না। কিন্তু এটাকেই শওকত খুচিয়ে মজা নেন।
"হয়েছে! তোমার গুষ্ঠির লোকজনতো একেকজন বিরাট পাংচুয়াল! একেকজনতো ঘড়ি হাতে পড়েই মায়ের পেট থেকে বেরিয়েছো!"
শওকত সাহেব হাসতে হাসতে বললেন, "আস্তে! ওয়েটাররা দেখছে। হাহাহা।"
শম্পা তাকিয়ে দেখেন আসলেই দুইটা ওয়েটার ড্যাব ড্যাব করে তাঁদের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে।
"এদের কী তাকিয়ে থাকা ছাড়া কোন কাজ নেই?"
শওকত সাহেব বেশ রোমান্টিক গলায় বললেন, "তুমি এত সুন্দর করে সাজুগুজু করে আসলে না তাকিয়ে যাবে কোথায় বলো?"
শম্পার রাগ অভিমান সব মুহূর্তেই উড়ে গেল।
লাজুক স্বরে বললেন, "আবার শুরু করলে?"
শওকত সাহেব আবার গান ধরলেন। তবে এইবার অনেক নিচু স্বরে।
"চলো না ঘুরে আসি, অজানাতে এ এ, যেখানে নদী এসে থেমে গেছে!"
শম্পা হাসি চাপতে চাপতে বললেন, "গান গেও না, প্লিজ! লোক তোমাকে তাড়িয়ে দিবে। হিহিহি।"
ঠিক তখনই শম্পার মোবাইল ফোনে একটা কল এলো। হাসতে হাসতেই তিনি ধরলেন। এবং মুহূর্তেই তাঁর চেহারা বদলে যেতে লাগলো।
"কী?....কখন?....কিভাবে?...."
"কি হয়েছে?"
শওকত সাহেব জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।
শওকত সাহেব স্ত্রীর ফোন কেড়ে নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন, "হ্যালো কে বলছেন?"
"হ্যালো, আমি তাসিনের মা বলছি। শাহানের ফ্রেন্ড।"
"আমি শাহানের বাবা।"
"জ্বী, ভাই স্লামালিকুম। একটা দুঃসংবাদ দেবার ছিল। আপনারা কী এখুনি গুলশান দুইয়ে আসতে পারবেন? তাসিন বলছিল শাহানদের গাড়িটা নাকি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে।"
শওকত সাহেবের বুক শুকিয়ে গেল। হাত কাঁপতে শুরু করেছে। তবু গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললেন, "আমরাও গুলশান দুই নম্বরেই। আপনি জানেন, এক্সিডেন্ট লোকেশনটা কোথায়?"
"গুলশান বনানী নতুন লিংক ব্রীজ হয়েছে না? সেখানেই। গাড়ি নাকি রাস্তা থেকে উল্টে লেকে পড়ে গেছে। আপনারা তাড়াতাড়ি যান। আমরাও আসছি।"
"জ্বী অবশ্যই। আমরা এখুনি যাচ্ছি।"
"আমার বাবুর কি হয়েছে? আমাকে বাবুর কাছে নিয়ে চলো! এখুনি।"
শম্পা হাউমাউ করে কাঁদছেন। রেস্টুরেন্টের সব অতিথি তাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওয়েটাররা এগিয়ে এলো দ্রুত। ম্যানেজারও ছুটে এসেছেন।
"স্যার এনি প্রবলেম?"
শওকত সাহেব তাঁর নিজের হাত পরীক্ষা করলেন। এখনও কাঁপছে। তিনি নার্ভাস হয়ে পড়ছেন। এখন মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে।
"ইয়ে.....আমাদের ছেলের অ্যাক্সিডেন্টের নিউজ এসেছে। আমাদের এখুনি যেতে হবে। আপনাদের বিল কত হয়েছে?"
ম্যানেজার ভদ্রলোক শওকত সাহেবকে চিনেন। কর্পোরেট অফিস থেকে প্রায়ই এখানে মিটিং, পার্টি রাখা হয়। বহুদিন ধরেই তাঁদের সাথে খুবই ভাল সম্পর্ক।
তিনি বললেন, "It's ok sir, আমরা সেটা পরেও sort করতে পারবো। আপনারা এখুনি যান। এবং একটু শক্ত থাকুন। ইনশাল্লাহ কিছুই হবে না।"
শওকত সাহেব বললেন, "দোয়া করবেন ভাই।"
যদিও ঈশ্বরের ভক্ত তিনি তেমন একটা নন। তবু বিপদে পড়লে বুঝিবা মানুষ কেবল তাঁরই দ্বারস্থ হয়!
স্ত্রীকে নিয়ে তিনি দ্রুত রওনা হলেন। বিড়বিড় করে "আল্লাহু, আল্লাহু" বলতে লাগলেন। এ ছাড়া তিনি আর তেমন কোন দোয়াই জানেন না।
জিকিরে একটা লাভ অবশ্য হয়েছে। তাঁর হাত কাঁপা বন্ধ হয়েছে।
৩.
গাড়ির অবস্থা দুমড়ে মুচড়ে একেবারে শেষ। পুলিশ এসেছে। ভেতরে কেউ জীবিত নেই নিশ্চিত করেছে। এখন লাশ বের করা হচ্ছে।
শম্পা বিরামহীন কেঁদে যাচ্ছেন। তাঁকে মহিলা পুলিশকর্মী এবং অন্যান্য মহিলারা ধরে রেখেছে। তিনি বারবার গাড়ির দিকে ছুটে যেতে চাইছেন।
তাঁরা ছাড়াও অন্যান্য অভিভাবকরাও ছুটে এসেছেন। মায়েরা কাঁদছেন। বাবারা কাঁদছেন। এলাকাবাসী, উৎসুক জনতার ভিড়ে তিলধারন ক্ষমতা নাই।
শওকত সাহেব একমনে প্রার্থনা করে চলেছেন।
"শাহান যেন গাড়িতে না থাকে! শাহান যেন গাড়িতে না থাকে!! শাহান যেন গাড়িতে না থাকে!!!"
গাড়ির দরজা কেটে প্রথম লাশ বের করা হলো।
মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লো দেখার জন্য। ক্লিক ক্লিক শব্দে ছবি উঠছে। ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠছে। মানুষ মোবাইল ফোনেও ছবি তুলছে।
মোবাইল ফোনে লাশের ছবি তুলে মানুষ কী করবে? ফেসবুকে আপলোড? ফাজলামির সীমা থাকা উচিৎ।
ভিড়ের ঠ্যালায় শওকত সাহেব লাশের কাছে যেতে পারছেন না। পুলিশ হুইসেল বাজিয়ে লাঠি পেটার ভাব করলো। এতে ভিড় হালকা হলো। শওকত সাহেব লাশ দেখতে পেলেন।
নাহ। এটা শাহান নয়! যদিও দুর্ঘটনায় লাশের মুখ যথেষ্টই বিকৃত হয়ে গেছে, দেখে চেনার উপায় নেই, তবু তাঁর ছেলের শরীরের গঠন, গায়ের জামা, মাথার চুল ইত্যাদি দেখে তাঁর চিনতে অসুবিধা হবার কথা নয়।
তিনি মনে মনে উপরওয়ালাকে ধন্যবাদ দিলেন।
আরও জোরে দোয়া পড়তে লাগলেন, "ইয়া আল্লাহ, আমার ছেলে যেন এই গাড়িতে না থাকে।"
লাশটি শাহানেরই আরেক বন্ধুর। তাঁর মা-বাবা ঝাপিয়ে পড়লেন মৃত ছেলের বুকে। এ দৃশ্য সহ্য করা মুশকিল। শওকত সাহেব তাঁর দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।
ছেলেটির মৃতদেহ দেখে এইমাত্রই তিনি আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন। কী স্বার্থপরের মত কান্ড! মানুষ আসলেই ভীষণ স্বার্থপর প্রাণী!
শম্পার কান্না একদম থেমে গেছে। তিনি ঘোর লাগা চোখে গাড়ির দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর মনে কী চলছে তিনিই জানেন। কারও পক্ষে অনুমান করা সম্ভব নয়।
আরেকটি লাশ বের করা হলো। শওকত সাহেবের মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। তাঁর পায়ে জোর হলো না তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখার। তিনি হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। অনেক কষ্টে আবারও তাকালেন নিহত যুবকের দেহে।
প্যান্টটা তাঁর চেনা। ছেলেকে বহুবার নিষেধ করেছেন এইরকম ছেড়া জিন্স পড়তে। ছেলে "লেটেস্ট ফ্যাশন" বলে সবসময়েই বাবার আপত্তিকে উড়িয়ে দিত।
শার্টটাও তাঁর চেনা। গতমাসে কনফারেন্সে যখন তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন, তখন সেখানকার এক মল থেকে কেনা। Versace. শার্ট পেয়ে ছেলে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিল।
কিন্তু মুখটি তাঁর চেনা নয়। তাঁর ছেলে সবসময়ে হাসিখুশি। প্রাণ চাঞ্চল্যে ভরপুর তার মুখশ্রী। আছে স্বপ্নময় দুটি চোখ! রয়েছে ছুরির ফলার মত ধারালো নাক। ভাঙ্গা উইন্ডশিল্ডের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া মুখটি তাঁর ছেলের নয়।
শম্পা জম্বির মত তাকিয়ে আছে ছেলের দিকে। সেও চিনতে পেরেছে।
পুলিশের কোন এক কর্মকর্তা এসে জানতে চাইলো, "স্যার, লাশ শনাক্ত করতে পেরেছেন?"
শওকত সাহেব ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন পুলিশের দিকে। ঠিক যেমনভাবে তিনি তাকিয়েছিলেন আজ থেকে ষোল বছর আগে, ক্যালিফোর্নিয়ার সেন্ট জোসেফ হসপিটালে এক মধ্যবয়সী ডাক্তারের দিকে। যখন শম্পার পেট কেঁটে সদ্য জন্মানো শাহানকে তাঁর কোলে তুলে দিয়ে ডাক্তার বলেছিলেন, "কনগ্রাটস!"
আনন্দে বিস্ময়ে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। আজকে আনন্দ ও বিস্ময় অনুপস্থিত থাকলেও তিনি সেই একই পরিমানে বিহ্বল।
ছেলে হলে আযান দেয়ার নিয়ম। তাঁর বড় ভাই স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন, নবজাতকের সামনে দাঁড়িয়ে অবশ্যই যেন তিনি আযান দেন। আযানের বাণীগুলো তাঁর মুখস্ত ছিল না। তাঁর চাচাতো ভাই রুমনকে তিনি হাসপাতালে আটকে রেখেছিলেন আযান শেখার জন্য।
পুলিশ অফিসার একদম আবেগহীন কন্ঠে আবার জিজ্ঞেস করলেন, "এ কী আপনার ছেলে?"
শওকত সাহেব অফিসারের মুখের দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠলেন, "আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার! আশহাদু আল্লাহ ইলাহা ইল্লাল্লাহ!"
উপসংহার:
দরজায় নক হতে শওকত সাহেব চোখ তুলে তাকালেন।
"এসো মঞ্জুর।"
মঞ্জুর ভিতরে এসে নরম গলায় বলল, "স্যার, Is everything alright?"
শওকত সাহেব হাত দিয়ে চোখ মুখ কচলে বললেন, "Yes, yes, everything is good. There's nothing to worry about."
মঞ্জুর কিছু বলল না। চলেও গেল না। সে জানে বসের কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। এই কিছুক্ষণ আগেই কনফারেন্সে তিনি হঠাৎ করেই ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার চ্যাচামেচি ও ভাংচুর করে কান্নাকাটি করেছেন। বিদেশি অনেক ক্লায়েন্ট ছিলেন, পার্টনার্স ছিলেন; পাঁচ দেশের আলাদা আলাদা চীফ অপারেটিং অফিসাররা ছিলেন। তাঁর এই কান্ডে সবাই ভীষণ অবাক! বসকে সে অনেক বছর ধরেই চেনে। এরকম কখনও ঘটেনা।
সাথে সাথে বসকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে মঞ্জুর পরিস্থিতি সামলেছে। এখন এসেছে বসের সাথে কথা বলতে।
শওকত সাহেব মঞ্জুরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, "বসো।"
মঞ্জুর চেয়ার টেনে বসলো।
"তোমার মদ্যপানের অভ্যাস আছে?"
"জ্বী না স্যার।"
"এতটুকুও নেই? সোস্যাল ড্রিংকিং যাকে বলে? আই মিন বন্ধুদের আড্ডায়, অথবা অফিস কনফারেন্সে, কোথাও ড্রিংক করার অভ্যাস নেই?"
"জ্বী না স্যার।"
"কেন? ব্যপারটা ধর্মীয়?"
"জ্বী স্যার। তা বলতে পারেন। তাছাড়া যে জিনিসে আমার কোন উপকার নেই, সেটার পেছনে শুধু শুধু পয়সা নষ্ট করার কোন যুক্তি আমি দেখিনা।"
"হুমম।"
শওকত সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। উঠে দাঁড়ালেন। বসকে উঠতে দেখেও মঞ্জুর উঠলোনা, চেয়ারেই বসা রইলো। বিদেশে চাকরি করার অভ্যাস।
"আমার একমাত্র ছেলেটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। জানো নিশ্চই?"
"জ্বী স্যার, জানি।"
"সে কিভাবে মারা গেল জান?"
মঞ্জুর অনুমান করলো যেহেতু মদের প্রসঙ্গ থেকে কথাটা উঠেছে, হয়তোবা মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। বস মনে আঘাত পেতে পারেন বলে বলল না।
"জ্বী না স্যার, জানিনা।"
শওকত সাহেব এবার জানালা দিয়ে বাইরের শহর দেখতে দেখতে বললেন, "ওরা এসএসসিতে ভাল রেজাল্ট করা সেলিব্রেট করছিল। বন্ধুদের বাসায়। আমরা সেলিব্রেট করছিলাম আমাদের বিবাহ বার্ষিকী। ছেলেকে বললাম আমাদের সাথে এসে ডিনারে জয়েন করতে। ওর বন্ধু বলল ওকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যাবে। রাস্তাতেই অ্যাক্সিডেন্ট হলো। গাড়িতে উপস্থিত সবকটা ছেলে স্পট ডেড! পাঁচটা সম্ভাবনাময় ছেলের জীবন একরাতেই খতম!"
মঞ্জুর গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। কী বলবে বুঝতে পারছে না। কিছুইতো বলার নেই।
"পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট এলো। চারটা ছেলেই ক্লীন ছিল, কেবল একজনের রক্তে অ্যালকোহল পাওয়া গেল। মাত্রাতিরিক্ত অ্যালকোহল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই গাড়ি চালাচ্ছিল। গাড়িটা তার নিজের ছিল বলেই হয়তো।"
মঞ্জুর এবারেও চুপ। সে সান্তনার বাণী বলতে তেমন পারদর্শী নয়।
শওকত সাহেব এবারে মঞ্জুরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, "কিছু ছেলে মনে করে বড় হয়ে গেলেই বুঝি মদ খেতে হবে। 'স্কুল শেষ! We should celebrate!' মদ খাবি খা, কিন্তু তুই মদ খেয়ে দল নিয়ে ড্রাইভ করতে যাবি কেন? মরলে তুই একা মর। আমাদের ছেলেদের কেন খুন করবি?"
শওকত সাহেবের কথা ধরে এলো। চোখ ঠিকরে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। মঞ্জুর চোখ সরিয়ে নিল।
"আমি আসি স্যার।"
শওকত সাহেব নিজেকে সামলে বললেন, "স্যরি, আজকে কনফারেন্স রুমে যে কাজটা আমি করলাম সেটা মোটেও ঠিক হয়নি। আসলে চোখের সামনে মদের বোতল দেখে আমার মাথা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। নিজের ছেলের খুনীকে সামনে দেখলে কার না মাথা নষ্ট হয় বলো?"
মঞ্জুর অত্যন্ত নিচু ও নরম গলায় বলল, "It's completely fine স্যার। আমি আপনার পরিস্তিতি বুঝতে পারছি। আপনি কী এখন বাড়িতে চলে যাবেন? I think you should take some rest. আজকের কাজ আমি সামলে নিতে পারবো।"
শওকত সাহেব কন্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বললেন, "না না, আমি ঠিক আছি। আমি একদম ঠিক আছি। তুমি আসায় খুশি হয়েছি। কাউকে মনের কথা বলতে পেরে ভাল লেগেছে।"
মঞ্জুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
শওকত সাহেব ফাইল খুলতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন তাঁর হাত কাঁপছে।
শাহানের মৃত্যুর পর থেকে প্রায়ই তাঁর হাত কাঁপে। এখন আর আগের মত যেকোন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে তাঁর মাথা ঠান্ডা থাকেনা। ভেতরকার নার্ভাস সিস্টেম পুরোটাই ভেঙ্গে গেছে।
তিনি বিড়বিড় করতে লাগলেন, "আলাহু! আল্লাহু!! আল্লাহু!!!"
আরও লেখা পড়তে ফেসবুকে যোগ দিন:
https://www.facebook.com/groups/canvasbd/
২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ রাত ৮:৩১
মঞ্জুর চৌধুরী বলেছেন: জ্বি, রিপোস্ট করলাম। মনে হলো, ম্যাসেজটা আরও কিছু মানুষের কাছে পৌছানো জরুরী।
©somewhere in net ltd.
১| ২৩ শে অক্টোবর, ২০১৪ সকাল ৯:০৯
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: এই গল্পটাই আগে না আরও একবার দিয়েছিলেন !