নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শিরোনামহীন

তানি তানিশা

তানি তানিশা › বিস্তারিত পোস্টঃ

এই আমি সেই আমি (শৈশব) ২

১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৩৭

কহিনুর আপার বিয়ে এবং কুমকুম



আমার নানী বাড়ি আর আমাদের বাড়ি হচ্ছে লাগোয়া। যেহেতু আমার আব্বা আর আম্মা চাচাতো ভাইবোন ছিল তাই আমার দাদা আর নানা পাশাপাশি বাড়ি করে। পরে আমার দাদু অবশ্য দিনাজপুর শহরে গিয়ে ছোট দাদী আর সেই ঘরের ফুপু, আর চাচাদের নিয়ে থাকতো। আর আমার আব্বা আর দাদী গ্রামে।

আমার দাদীর তিন মেয়ে আর এক ছেলে। তাই আব্বার আদর অবশ্যই বেশি ছিল। সে যাইহোক, আমাদের বাড়ির সামনে একটা রাস্তা আছে সেটার অপর পাশে আমার ফুরু-বিটি (মেঝ ফুপি) এর বাড়ি। ফুরু-বিটির মেয়ে কহিনুর আপা। এবারের গল্প হোল কহিনুর আপার বিয়ে।

আমার ফুফাতো ভাই-বোনরা সুন্দর ছিল। কিন্তু কেন জানি কহিনুর আপা দেখতে কালো আর দাঁত উঁচু ছিল। সে জন্য তার বিয়ে হতো না। দেখতে আসে আর বিয়ে ভেঙ্গে যায়। সে অবশ্য তাঁর চেহারা দেখে নাকি অদ্ভুত সাজার ধরন দেখে সেটা পাত্রপক্ষ ছাড়া কেউ জানে না। এমনিতেই কালো, তার উপর পড়াশুনায় ডাব্বা। কিন্তু কি যে সাজতে পারতো সেটা দেখার মতো। বর পক্ষ দেখতে আসলে তার একটা গোলাপি রঙের লিপস্টিক ছিল সেটা ঠোঁটে ঘোষে আর মুখে পাউডার দিয়ে ফেকফেকা সাদা করে যেত। আমার এখন মনে হয় কহিনুর আপা কে না সাজলেই বেশি সুন্দর লাগতো। কিন্তু ছোট বেলায় আমি এই কহিনুর আপার খুব ভক্ত ছিলাম। কারন সাজুগুজু অবশ্যই। আমিও খুব সাজতে পছন্দ করতাম। তাই যখন কহিনুর আপা আয়নার সামনে দারিয়ে লাল ফিতা দিয়ে টেনে টেনে চুল বাধত তখন আমিও আমার লাল ফিতা নিয়ে তার কাছে দৌরে যেতাম। যদিও সে আমাকে বেশি পাত্তা দিতো না। তার পরেও হঠাৎ কখনো সখনো আমাকে সাজিয়ে দিতো। আর আমি তখন সবাইকে দেখিয়ে বেড়াতাম।

একদিন ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো আব্বা আম্মা আর ফুরু-বিটির কথার গুঞ্জনে। কথা হচ্ছে কহিনুর আপাকে নিয়ে। তার নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। কবে কখন কি ভাবে জানিনা। কিন্তু বিয়ে ঠিকঠাক। আমার জীবনে দেখা প্রথম বিয়ে। আমার ধারনা ছিল বিয়ে হলেই মেয়েদের বাবা মায়ের বাড়ির পাশেই বাড়ি করে থাকে। কেন এমন ধারণা হোল সেটা পাঠকরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমার আম্মা তো নানী বাড়ির পাশেই থাকে, আমার ফুপুও তাই। কিন্তু আর বাকি ফুপু এবং খালারা যে দূরে থাকতো সেটা আমার সেই ছোট মাথায় আসেনি। সে যাই হোক! আমি খুব খুশিই হলাম। যাক বাবা কহিনুর আপার বিয়ে, তাহলে আমিও সাজুগুজু করতে পারবো। বিছানা ছেড়ে উঠেই দৌর জিনিয়ার কাছে। ওকে সব বললাম। ও তো নাচা শুরু করে দিলো।

তার কিছুদিন পরের কথা। আমি আর জিনিয়া স্কুল থেকে ফিরছি, দেখি কতগুলো বাইরের মানুষ রিক্সা করে আসছে। আমাদের দেখে জিজ্ঞেস করলো যে ভুটিয়া পাড়ার বাবুলের (আমার আব্বা) বাড়িটা কথায়। আমরা বলে দিলাম। একটু অবাক ও হলাম। কারন আমার আব্বাকে চিনলে আমাকেও চিনতে হবে এরকম একটা ধারণা ছিল। আমাদের গ্রামের কেউ হলে বলতাম না, কিন্তু বাইরের মানুষ তাই বললাম। কি জন্য তারা এসেছে এটা দেখার জন্য আমি আর জিনিয়া ছুটতে থাকি।

বাড়ি ফিরে দেখলাম বিশাল আয়োজন। সেই মানুষ গুলো আমাদের চালিতে (মাটির বাড়ির বারান্দা) বসে আব্বার সাথে কি নিয়ে গল্প করছে। আমি অবশ্য গুরুত্ব দিলাম না। কতো মানুষই তো আসে আব্বার কাছে। আমি বই খাতা রেখে বাইরে খেলতে গেলাম।

সন্ধায় আব্বা আর আম্মা আলাপ করছে কহিনুর আপার নাকি দুই সপ্তাহ পর বিয়ে। আমি আর আনন্দ ধরে রাখতে পারিনা। অবশেষে সেই দিন চলে এলো। দুলাভাই এর নাম সামাদ। বোঁচাগঞ্জ বাড়ি। জুতার দোকান আছে দুইটা। সে এক আরও আনন্দের খবর। কারন সাজুগুজুর সাথে সাথে আমার নতুন জুতা আর জামার প্রতি খুব আকর্ষণ ছিল। এখনো আছে অবশ্য। আমার সামাদ দুলাভাইয়ের নাম দিয়ে দিলাম জুতা দুলাভাই।

নির্দিষ্ট দিন বিয়ের আয়োজন করা হোল। যেহেতু আমার ফুপা অনেক আগেই মারা গেছেন তাই আব্বা কহিনুর আপার মামা হিসেবে যতটুকু সাধ্য তার থেকে বেশিই করলো। আমি কহিনুর আপার বিয়ে উপলক্ষে পেলাম নতুন জামা, জুতা। কিন্তু কহিনুর আপাকে প্রায় ১০ টা শাড়ি, আলতা, চুড়ি, আরও অনেক জিনিষ এনে দিলো আব্বা। আমার সেই সব জিনিস থেকে একটা জিনিসের উপর খুব লোভ হোল। সেটা একটা কুমকুমের কৌটা। ছোট খুপচিতে নানা রঙ এর কুমকুম। আম্মা কে জিজ্ঞেস করে এর নাম জানলাম। এটা দিয়ে বউ সাজানো হয় শুনে আমিও গান ধরলাম আমাকে সাজিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু আম্মা বলল

- আগে তোমার বিয়ের দিন আসুক তখন সাজাবো। এটা শুধু বউদের জন্য।

আমার খুব খারাপ লাগলো কথা টা শুনে। যেহেতু বড় হইনি তাই বিয়ে করতে পারছিনা। মন খারাপ করে চলে আসলাম।

অবশেষে কহিনুর আপার বিয়ের দিন। সব আয়োজন করা শেষ। বরযাত্রী আসতে বেশি সময় নাই। আমি কহিনুর আপাকে দেখার জন্য তার ঘরে গেলাম। আমি তো দেখে অবাক। এতো সুন্দর আমার কহিনুর আপা! লাল শাড়ি পরে কি যে সুন্দর দেখাচ্ছিল। আমারও সেইরকম সুন্দর দেখাতে হবে। তাই আম্মার কাছে গিয়ে বললাম

- আম্মা আমাকেও সাজিয়ে দেও। আমিও বিয়ে করবো।

ঘরের সবাই আমার কথা শুনে হা হা করে হেসে উঠে। আমি তাদের পাত্তা দিলাম না। আমি বুক ঠুকে ঘোষণা করলাম যে আমিও বিয়ে করবো। ছোটো বেলায় অসম্ভব জেদি ছিলাম। আমি বউ সাজবো মানে সাজবো। মহীমা মামী (সেঝ মামী) বলল

- বিয়ে যে করবে তো তোমার জন্য বর তো দেখাই হয়নি। কহিনুরের বিয়ের পরেই একটা বর দেখে তোমাকে বিয়ে দিব।

আমি চিন্তায় পরে যাই। আসলেই তো আমার বর নাই। মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। একটা বরের অভাবে আমার বউ সাজা হইল না। মনে মনে আব্বার উপর বিরক্ত হই। কহিনুর আপার সাথে আমার একটা বর দেখলে কি এমন ক্ষতি হতো! মন খারাপ করে উঠে যাচ্ছি তখন কহিনুর আপাই আমাকে আটকাল। আম্মা কে বলল

- দেও না মামী তানিয়াকে বউ সাজায়। বেচারি কবে থেকে সাজতে চাচ্ছে।

আম্মা আপত্তি করতে গিয়েও করলো না। তার পর আর কি! আম্মার একটা শাড়ি পরে, আলতা পায়ে দিয়ে, কুমকুম দিয়ে টিপ দিয়ে বউ সাজলাম। বরযাত্রী আসলে আমি জুতা দুলাভাইয়ের পাশে বসে থাকলাম।

বিয়ের সব কাজ শেষে এইবার বিদায়ের পালা। কহিনুর আপা আম্মাকে, ফুপি কে, আব্বাকে, আরও ফুপি আর ফুপাতো ভাইবোনদের থেকে বিদায় নিল। আমিও কহিনুর আপার হাত ছাড়িনা। তার পিছু পিছু ঘুরছি। কিন্তু কিছুতেই বুঝছিনা পাশের বাসায় থাকবে তার জন্য এতো কান্না কেন? চাইলেই তো আবার নিজের ঘরে থাকতে পারবে।

বিদায় মানে যে আমার বাবার বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া যখন বুঝতে পারলাম তখন কহিনুর আপাকে নিয়ে বরযাত্রী রাস্তায় উঠে গেছে। আমিও কান্না শুরু করলাম তখন। এই কান্না কহিনুর আপা চলে জাচ্ছে সে জন্য না, কাদছি এজন্য যে আমিও শ্বশুর বাড়ি যাব। আমি হাত পা ছুড়ে কান্না আমিও যাবো শ্বশুর বাড়ি। হাজার হলেও বউ সেজেছি। কি করে আমাকে রেখে কহিনুর আপা আগে শ্বশুর বাড়ি যায়? আম্মা আমাকে কলে তুলে চুপ করানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আমার পাঁচ বছর বয়সী সেই মন আকুলি বিকুলি করতে থাকে। আমি হয়তো আমাদের পরিবারের প্রথম মেয়ে যে শ্বশুর বাড়ি যাবে বলে কান্না করেছিলো। সে যাই হোক, কহিনুর আপা আর জুতা দুলাভাই আমার কাছে এলো। সবাই কান্না ভুলে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার আরও রাগ হতে থাকে। আমি শ্বশুর বাড়ি যাবই যাবো। পরে আমাকে জুতা দুলাভাই প্রমিস করে যে সে বোঁচাগঞ্জ পৌঁছেই আমার বরকে পাঠিয়ে দিবে। এর পরে আমার কান্না থামে এবং কহিনুর আপা তার শ্বশুর বাড়ি আমার আগে চলে যায়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.