নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেলাশেষে ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় আসলাম সামুর তীরে, রেখে যেতে চাই কিছু অবিস্মরণীয় কীর্তি । পারি না আর না পারি, চেষ্ঠার ত্রুটি রাখবো না, এই ওয়াদা করছি ।

মোশারফ হোসেন ০০৭

একজন শৌখিন লেখক আমি, আবার কবিও বলা যেতে পারে । যখন যা ভালো লাগে তাই লিখি ।

মোশারফ হোসেন ০০৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

(পর্বভিত্তিক বড় গল্প) জীবনে কারাবন্দী হওয়ার ভয়ংকর অভিজ্ঞতা - পর্ব ১-৬ :( :(

১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:১৬

পর্ব - ০১

বাড়ি থেকে যখন পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে এলো আমি তখন ভালো করে জামাটাও পড়ার টাইম পাইনি । নাইট ড্রেসটা পড়ে ছিলাম, একটু পরই ঘুমাবো বলে । তার আগে ব্যস্তভাবে ডিনারটা সেরে নিচ্ছিলাম । আমার স্ত্রী নূপুর আমার সাথেই বসে খাচ্ছিল । সারাদিন ব্যস্ততা শেষে এই ডিনার টাইমেই দুইজন একসাথে বসে খাবার টাইমটুকু পাই । ব্যস্তভাবে খাওয়া-দাওয়া চললেও বিভিন্নরকম কথাবার্তা, গল্পগুজব কিংবা নূপুরের সারাদিনের কাজের তালিকা শুনতে শুনতেই ডিনার করতে করতে কখনও ১২ টা আবার কখনও ১টা বেজে যায় । পাগলিটা কেমন যেন, আমাকে ছেড়ে কখনই রাতের সময়টাতে খায় না । ওকে অনেকবারই বলেছি কিন্তু এ ব্যাপারে আমার কোন কথাই শোনে না । তাই তো রাতে যদি কখনও খেয়েও আসি তবুও ওর সাথে বসে হালকা হলেও খেতে চেষ্ঠা করি । অবশ্য এই সময়ে এসে কখনই বাচ্চাগুলোকে জাগ্রত অবস্থায় পাই না ।

যাই হোক, ঘড়িতে ঠিক তখন ১২টা বেজে ১৯ মিনিট, দরজায় নক । এত রাতে প্রতিবেশী যে এসে নক করবে না, এটাই স্বাভাবিক, এটাই সামাজিকতা । যাই হোক, একটু পর নকের তীব্রতা বাড়তে লাগলো । আমি ধৈর্য্যহারা হয়ে গেলাম । রাগ তখন চরমে । দরজা খুললাম, কিন্তু খুলেই পুলিশ দেখেই রাগ আমার কনফিউশনে পরিণত হলো । এত রাতে পুলিশ !!! কিন্তু পুলিশই কেন !!! মিঃ কালাম, আপনাকে আমাদের সাথে একটু পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে । আমরা আপনার এরেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি । আপনি দ্রুত ড্রেসটা চেঞ্জ করে নিন । This night will be so long for you । বাড়ির দরজায় হঠাৎ পুলিশের আগমন আবার সাথে এরেস্ট ওয়ারেন্ট, সব কিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগছে আমার কাছে !! খুব খারাপ কোন স্বপ্ন । তবে আমার কেন জানি মনে হলো পুলিশের মধ্যে যে এতক্ষণ আমার সাথে কথা বলছিল সে ভালোই শিক্ষিত । আমার কোনই আইডিয়া নেই যে কোন অপরাধে এই এরেস্ট ওয়ারেন্ট, তবুও আমি কথার প্রতত্ত্যুরে কিছুই বললাম না । নীরবেই ড্রেসটা চেঞ্জ করে পুলিশের সাথে চললাম । নূপুর এতক্ষণ ঘটনার আকস্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে ছিল । শুধু বেরিয়ে সময় বললো, আমি আসবো ? আমি শুধু বললাম, না থাক, বাচ্চারা তো ঘুমাচ্ছে । হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে ওরা তোমাকে খুঁজতে পারে । তুমি বরং সালামকে বলে কাল সকালে একবার আসতে পারো ওখানে । আগেই বলে নিই, সালাম আমার ছোট ভাই । নূপুর আর কিছু না বলেই আমার কথা মেনে নিলো । আর আমি চললাম পুলিশের সাথে ।

পুলিশ স্টেশনে বসে আছি আধা ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে । আমাকে একটি ছোটখাট বেঞ্চে বসিয়ে রেখেছে তারা । সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হয়তো হওয়া উচিৎ যে বেঞ্চের হাতলের সাথে আমার হাত হ্যান্ডকাফ দিয়ে আটকানো, তবু আমার কাছে এই ব্যাপারটাতে খুব একটা আশ্চর্য ভাব আসছে না । জায়গাটির মধ্যে আর আমার সাথে কেউ কথা বলছে না । এমনকি আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছেও না । মনে হচ্ছে আমি অদৃশ্য কেউ একজন । তাই আমি বাধ্য হলাম আশেপাশে চোখ বুলানোর জন্য । বেঞ্চে আমি একা না, আরও দুইজন বসে আছে । এদের মধ্যে একজন মহিলা আর একজন পুরুষ । মহিলাটি আমার পাশে আর পুরুষটি আরেক কোনায় । ঐ পুরুষটিকেও আমার মত হ্যান্ডকাফ দিয়ে হাত আটকিয়ে রেখেছে বেঞ্চের হাতলের সাথে । মহিলাটির মুখে অতিরিক্ত মেক-আপ । বুঝলাম, রাস্তা থেকে ধরে এনেছে, হয়তো টাকা নিয়ে বনিবনা হয়নি । পুরুষটিকে দেখে মনে হচ্ছে টাল হয়ে আছে । যে কোন মুহূর্তে বেঞ্চ থেকে পড়ে যেতে পারে । আবার রুমটির এক কোনায় একটি বাচ্চা অবিরত কেঁদেই চলেছে । কিন্তু সবাই যে রকম ভাবে ছোটাছুটি করছে, মনে হচ্ছে কেউ এই বাচ্চাটির কান্না শুনতেই পাচ্ছে না । আমি আশেপাশে তাকিয়ে বাচ্চাটির মা কিংবা অভিভাবককে খুঁজার চেষ্ঠা করলাম কিন্তু না, কেউই নেই আশেপাশে । আবার সেখানে বসেই শুনতে পেলাম পুলিশ পেট্রলের গাড়িগুলো একটা স্টেশন ছাড়ছে তো আরেকটা এসে ভিড়ছে । তাই একটু পর পর সাইরেনের আওয়াজ একবার বাড়ছিল আবার একবার কমছিল ।

পর্ব - ০২

হঠাৎ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম । ঘড়িতে যখন প্রায় ৩ টা বেজে ৪০ মিনিট, তখন পুলিশেরই একজন এসে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুললো । "আপনাকে স্যার ডাকছে, চলুন ।" হঠাৎ কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে আমি একটু অস্বস্তিতে ভুগছি । তাছাড়া বসে বসে ঘুমানোর অভ্যাস নেই বলেও হয়তো এই অস্বস্তিটা আসতে পারে । তবু ঘুম ঘুম অবস্থাতেই চোখ কচলাতে কচলাতে আমি শুধু এই কথাটি বললাম, একটু পানি হবে ? পুলিশের ঐ লোকটি মনে হয় ভালোই । আমার হ্যান্ডকাফ খুলে দিয়ে আমার হাতে একটি পানির জগ এনে দিলো । আমি চোখেমুখে পানি ছিটালাম আবার কিছুটা খেলামও । ঐ পুলিশের লোকটি এরপর আমাকে তার স্যারের কাছে নিয়ে গেলো । আমি স্যারের কাছে পৌঁছেই সরাসরি তার নেমপ্লেটের দিকে খেয়াল করলাম । বদরুল লেখা । লোকটির মুখ পানে লাল । সামনে ছোটখাট একটি পানবাটা । মনে হচ্ছে একটির পর আরেকটি পান খাওয়া অভ্যাস তার । "স্যার, আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে ?" আমি আর অপেক্ষা না করেই জিজ্ঞেস করে বসলাম । জনাব বদরুল এতক্ষণ কোন একটি ফাইলের দিকে মনোনিবেশ করে ছিলেন, আমার প্রশ্ন শুনে মুখ উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন । কিছুক্ষণ আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলেন, এই সময়টুকুতে পান চিবানোর কথাও ভুলে গেছেন যেন । আমি আবারও বললাম, "স্যার, আমাকে এখানে কেন আনা হয়েছে ?", এই ভেবে যে উনি হয়তো শুনতে পাননি । লোকটির ভ্রূ ধীরে ধীরে কুঞ্চিত হলো । লোকটি এরপর রেগে গিয়ে বলে উঠলো, "কেন, এক রাত আমাদের সাথে থাকলে কি আপনার জাত যাবে ? আমরা কি মানুষ না আপনাদের কাছে ?" পুলিশের এই একটা স্বভাব । এরা কথায় কথায় রেগে যায় । বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই কথাগুলো খুব সামান্যই হয় । তবে আমি আর ঘাঁটালাম না । তাই কিছু না বলে চুপ হয়ে গেলাম । একটু পর জনাব বদরুলের নির্দেশে আমাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হলো ।

হাজতে আমার প্রথম রাত্রি । জীবনে যে কতরকম অভিজ্ঞতা হলো, তবে এরকম ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হয়েছে কিনা, এই মুহূর্তে তা মনে করতে পারছি না । সত্য হলো, জীবনে এরকম ভয়ংকর অভিজ্ঞতাগুলো সহজে ভোলা সম্ভব না । হাজতে অবশ্য আমি একা না । দেখলাম আরও অনেকেই আছে । হাজতে সবচেয়ে বড় যে সমস্যা সেটি হচ্ছে, খাওয়া আর টয়লেটের জায়গা কাছাকাছি । ঐ গন্ধের মধ্যে বসেই খাওয়া, ঘুম সব । আমি ভাবছি আমাকে কেন গ্রেফতার করে আনা হয়েছে । আমি ভেবে কোন কূল কিনারা পাচ্ছি না । আবার মনের এক কোনায় এই ভাবনাও আসছে যে আমি হয়তো এই হাজত থেকে আর কোনদিন ছাড়া পাবো না । আর কোনদিন নূপুরের মায়াবী মুখটা দেখতে পাবো না । দুই ছেলে-মেয়ে আফনান আর জারিনকেও মিস করবো । হয়তো এখানেই আমার মৃত্যু হবে । আশেপাশের লোকগুলোর চোখের দিকে তাকানো যায় না । সবার চোখেমুখে এক ধরনের আতংক । একজনের সাথে কথা বলে বুঝলাম, লোকটিকে ধরে আনা হয়েছে ছিনতাই এর কথা বলে । অথচ লোকটি নাকি ছিনতাই-এর ঐ ঘটনার সময় নিজের বাসায় ঘুমাচ্ছিল । সন্দেহবশত ধরে আনা হয়েছে আরও চারদিন আগে । বাসার লোকজন প্রতিদিন ধরনা দিলেও মোটা অংকের টাকা চাওয়া হয়েছে ঘুষ হিসেবে । সেই টাকা জোগাড় করতে বিলম্বিত হচ্ছে বলেই লোকটি এখনও হাজতেই আছে । আমার ক্ষেত্রেও কি এমন কিছু হবে ? নূপুর বেশি চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পরবে না তো ? এত রাতে আবার সালামকে ঘুম থেকে জাগিয়ে বসবে না তো ? বাচ্চাগুলোকে দেখবে কে ? আমার চিন্তাগুলো ক্রমশ বাড়ছে । চিন্তা বাড়ার সাথে সাথে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ক্রমশ চিন চিন করে ব্যাথা শুরু হয়েছে । মনে হলো, প্রেশার বাড়ছে ।

আমি হাজতের শিক ধরে এক কোণার দিকে বসে ছিলাম । হাজতে কেউ কারও বন্ধু হয় না । তবে শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই থাকে । যদি আপনার কোন আত্মীয় এক প্যাকেট সিগারেট ধরিয়ে দিতে পারে আপনার আশেপাশের হাজতিদের, তাহলে তো আর কোন কথাই নেই... আপনি তখন তাদের কাছে বস । এক্ষেত্রে কখনও কখনও বিড়িতেও কাজ হয় । কোনরকমে হাতে ধরিয়ে দিতে পারলেই ব্যস । আপনার আদেশ তাদের ক্ষেত্রে তখন শিরোধার্য । আপনার হাত-পা টিপে দেবে । আপনার মাথাও টিপে দেবে আর হাত দিয়ে ডলে শরীর মালিশ করা তো আছেই । আমি বসে বসে দেখছিলাম এমন একজনকে তিন-চারজন ঘিরে সেবা করছে । পাশে বসা একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, "ঐ লোকটি কে ?" সে উত্তর করলো, "আপনি তাকে চেনেন না ? ধুর, মিয়া, আপনি তো তাইলে এই শহরে থাকেনই না !!! সে হইলো কালা মজিদ । প্রতি মাসের দুই-তিনদিন হাজতে এসে হাজতবাসীদের খোঁজখবর নিয়ে যায় । শহরে বিরাট ত্রাস ওর । এমনও শোনা যায়, মাসে একটা মার্ডার না করলে নাকি ওর ভাব আসে না......" । আমি আর ভাব আনার তালে থাকলাম না । এই কথা শুনে আরও জড়সড় হয়ে বসলাম । কালা মজিদ মনে হয় আমার পাশে বসে থাকা লোকটির মুখে নিজের প্রশংসা শুনতে পেয়েছে আর আমাকেও খেয়াল করেছে । কালা মজিদ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "কি কেস ? ছিনতাই ? নাকি মার্ডার ? নাকি দুই নম্বরি ? কোনটা ?" আমি একটু ভয়ে ভয়েই উত্তর করলাম, "একটাও না । আমার মনে হয় এরা ভুল করেছে । আমাকে অন্য কারও সাথে গুলিয়ে ফেলেছে ।" কালা মজিদ মনে হয় আমার উত্তরে খুশি হলো না । আবার বেশ রাগও হয়েছে । রাগের ব্যাপারটা আমি বুঝলাম, এর পরপরই তার কথা শুনে । "ভুল করে মানে ? ঐ মিয়া, মশকরা করেন ? এখানে কেউ কাউকে ভুল করে আনে নাকি ? জলদি জলদি হাছা কথা কইয়া ফালান । নাইলে কিন্তু হাছা কথা কওয়ানোর অনেক উপায়ও আমার জানা আছে ।" কালা মজিদের মুখে এই কথা শুনে আমি ঢোক গিললাম । ভালোই বিপদে পড়েছি, মনে হচ্ছে ।

পর্ব - ০৩

আমাকে হুমকি দেওয়ার পর কালা মজিদের সাগরেদদের তার গা মালিশ করার গতি অনেকাংশে বেড়ে গেলো । বুঝলাম না, সে কি তাহলে ঝি কে মেরে বউকে শেখালো ? একটু পর দেখি কালা মজিদ বসা অবস্থা থেকে আবার শুয়ে পড়লো । আরামে তার চোখ বুজে আসছে । মনে হয় সে ঘুমিয়ে পড়বে । আমার কথা এখন আর তার মাথায় নেই । একটু পরই বলা যায় মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরই তার নাক ডাকার আওয়াজ আসতে লাগলো । তার ঘুমের ভাব দেখে আমি বেশ অবাক হলাম । এরকম প্রচণ্ড গরমের মধ্যে, গন্ধের মধ্যে, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে সে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই ঘুমিয়ে গেলো !!! অথচ আমাদের ঘুম প্রচণ্ড গতির ফ্যান কিংবা এসি ছাড়া তো হয়ই না । হায় রে মানুষ, কতটা আরামপ্রিয় !! এবার প্রকৃত অর্থে প্রমাণ পেলাম, শরীরের নাম আসলেই মহাসয়, যত সহানো হবে ততই সইবে । আমি এবার এই চিন্তা থেকে সরে এসে আবার বাড়ির লোকদের চিন্তায় মশগুল হলাম । এখন বাড়ির কি অবস্থা কে জানে !! নূপুর যে এখন কি করে !! ঘুমায় নাকি জেগে আছে ? নাকি কাঁদছে অবিরত ? আবার আমাকে ভুল বুঝবে না তো ? আমি তো আসলে অপরাধী নই ।

আমরা চুয়াডাঙ্গার স্থানীয় । আমার কাপড়ের ব্যবসা । জেলার মেইনশহরে যেখানে বড় বাজারটি বসে, সেটির রাস্তার ধার ধরে আমার মোট চারটি দোকান । আব্বা মারা যাওয়ার আগেই আমার ভাগে এই চারটি দোকানই পড়ে । এর মধ্যে তিনটি ভাড়া দিয়ে দিয়েছি আর একটিতে নিজেই ব্যবসা করি । আসলে দোকানটি মূলত পাইকারি বা হোলসেলের । ঢাকা থেকে লট এনে পরিচিতদের সাথেই মূলত আমার ব্যবসা । আমার আব্বাও এই কাপড়ের ব্যবসা করতেন । ছোট ভাইটিও অবশ্য ব্যবসা করে কিন্তু ও কাপড়ের ব্যবসায় আসেনি । ও জুতার ব্যবসা করে । আমি বেশ কয়েকটি নামকরা কোম্পানির লোকাল ডিলার আর তাছাড়া ঢাকার কয়েকটি নামকরা গার্মেন্টসের সাথেও আমার যোগাযোগ আছে । ওদের রিজেক্টেড মালগুলো মূলত আমার কাছেই আসে, সেগুলো আবার আমার সাথে কন্ট্রাক্ট থাকা লোকাল পাইকারি দোকানগুলো নিয়ে যায় । আমার ব্যবসা আল্লাহ্‌ দিলে মাশাল্লাহ্‌ । দোকানে কর্মচারির সংখ্যা অনেক । ম্যানেজার আছে একজন আর ঘুরে ঘুরে অর্ডার নেওয়ার জন্য আছে পাঁচ জন আর দোকানের ভিতরে আছে আটজন । এতজনের মধ্যে আমার দেশী মানুষই আছে প্রায় দশ জনের মত । বুঝতে পারছি যে ঘাপলা যা হইছে তা দোকানেরই কোন কর্মচারি করেছে কিন্তু কাকে অবিশ্বাস করবো ? এর দায়ভার যে আমার ঘাড়ে আসবে, এতে আর সন্দেহ কিসের ? আচ্ছা, এই ব্যাপারটির তদন্ত হবে তো ? নাকি বিনা দোষেই শাস্তি পেয়ে যাবো ?

ভাবতেই ভাবতেই কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিল, বুঝতে পারিনি । একটু পর হঠাৎ-ই চোখ খুলে গেলো, হয়তো পাখির কিচিরমিচির ডাক শুনে । ভোর হয়ে গেছে অনেক আগেই, প্রকৃতিও যেন ঘুম থেকে আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠছে । পাখিগুলো তো পাল্লা দিয়ে একজন আরেকজনের চেয়ে জোরে ডেকে চলেছে । রাতে দেখেছিলাম, পুলিশ স্টেশনে কোন চাঞ্চল্য ছিল না । সবাই যে যার মত হয় ঢুলছিল, না হয় বসে বসে ঝিমাচ্ছিল আবার কারও কারও তো নাক ডাকারও আওয়াজ আসছিল । এখন সকাল হওয়ার সাথে সাথে পুলিশ স্টেশনও জেগে উঠেছে । ছোটাছুটি আরম্ভ হয়ে গেছে । আমি যেখানে বসে আছি, সেখান থেকে খুব কষ্ট করে স্টেশনের ঘড়িটা দেখা যায় । আমি চেষ্ঠা করলাম, কয়টা বাজে এটা দেখার জন্য । ঠিক ৮ টা বেজে ১৩ মিনিট । তার মানে ভালোই সকাল হয়ে গেছে । হঠাৎ খেয়াল করলাম, পিছন থেকে কালা মজিদ আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে । সে জেগে উঠায় হাজতের মধ্যে নিরবতা এসেছে । কারণ তার নাক ডাকার শব্দটা থেমে গেছে । সেই নিরবতার কারণেই মনে হলো অনেকেই এক সাথে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে । ঠিক যেন কোন ঘরের শব্দ করে ঘোরা ফ্যানের মত । ফ্যানটি যখন শব্দ করে ঘুরতে শুরু করে, প্রথম প্রথম কষ্ট হলেও এক সময় ঘুম কিন্তু চলেই আসে । তখন ফ্যানের ঐ অবিরত শব্দের সাথে মানিয়ে নিয়ে ঘুমও ধীরে ধীরে গভীর হয় । কিন্তু কারেন্ট চলে যাওয়া বা অন্য কোন কারণে যদি ফ্যানটি থেমে যায়, তাহলে আবার ঘুম ভেঙ্গে যায় । কালা মজিদের ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে ঠিক এমনটাই হয়েছে হাজতে । এত কষ্টের মাঝেও এটা দেখে আমার হাসি পেয়ে গেলো । আমি অনেক কষ্ট করে হাসি চাপার চেষ্ঠা করলাম কিন্তু কালা মজিদের চোখে সেটি এড়ালো না । সে দেখি আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে আবার তার ভ্রূও বেশ কুঞ্চিত । আমি আবার জড়সড় হয়ে বসলাম ।

পর্ব - ০৪

তবে এ যাত্রায় আর কালা মজিদ আমাকে ঘাঁটলো না, নিজের আশেপাশে থাকা দুই সাগরেদকে পাশে ডেকে আবার হাত-পা মালিশ করতে বললো । কেন জানি মনে হচ্ছে, এই লোকটার শরীরে সবসময় এক ধরনের জড়তা লেগেই থাকে । যখনই বসে আছে তখনই কাউকে না কাউকে দিয়ে নিজের শরীরের জড়তা ভাঙ্গানোর কাজে লাগিয়ে রেখেছে । যাই হোক, কালা মজিদের কর্মকাণ্ড দেখে বাকি সময়টুকু কাটানোর ইচ্ছা নেই আমার । হাজতে পুরো একটা রাত কাটিয়ে ফেললাম আমি । কি সাংঘাতিক ব্যাপার !! আমার বাপ-দাদা চৌদ্দ-গুষ্ঠির মধ্যে কেউ কোনদিন পুলিশের হাতে ধরা খায়নি । আমিই এক প্রকার রেকর্ড করে ফেললাম । তবে এটা এমনই একটা রেকর্ড, যা নিয়ে গর্ব করা যায় না । আমারও গর্ব করতে ইচ্ছা করছে না মোটেও । যদিও আমি অপরাধী নই, তবুও নিজেকে কেন জানি খুব ছোট মনে হচ্ছে । কেন জানি মনে হচ্ছে দুনিয়ার চোখে সেই আগের সম্মানটুকু আর দেখতে পাবো না । লোকে আমাকে দেখে মশকরা করবে । বলবে ঐ দেখ সন্ত্রাসী কালাম যাইতেছে । আমার কাপড়ের ব্যবসায় লালবাতি জ্বলবে । নাকি ইতিমধ্যেই জ্বলে গেছে, কে জানে । আমার ছেলেটার স্কুলে ওর বন্ধু-বান্ধবীর অভিভাবকরাও এটা নিয়ে বলতে ছাড়বে না, আমি জানি । মেয়েটাকে তো এখনও স্কুলেই দেইনি, যদি দিতাম, তাহলে হয়তো ওর সাথেও...... থাক, আমার ভাবনাগুলো গুলিয়ে যাচ্ছে । আমি নিজেকে হারাচ্ছি খুবই ধীরে ধীরে । এটাই কি আসল আমি ?

একটু পর দেখতে পেলাম নূপুর প্রায় হন্তদন্ত হয়ে থানায় ঢুকলো । আমার হাজত থেকে আমি ওকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি । সাথে সালাম । ওরা দুইজনই জনাব বদরুলের সাথে কি যেন বললো, একটু পর ওরা দুইজনই আমার কাছে আসলো । নূপুর বেচারীর চোখ দুটোর নিচে হালকা কালি পড়েছে, ঠিক যেমনটা এক রাত না ঘুমালে কারও চোখে পড়ে । বুঝলাম, চিন্তায় ঘুমাইনি বেচারী । বেশ কিছুক্ষণের নিরবতা ভেঙ্গে প্রথমে সালামই কথা শুরু করলো । "কি হয়েছে ভাইয়া ? তোমাকে এখানে ধরে এনেছে কেন, বলতে পারো ?" আমি উত্তরে বললাম, "মনে হয় গত মাসে যে তিনটা লট এসেছে সেখানে কোন ঘাপলা থাকতে পারে । আমাকে ম্যানেজার সাহেব রিপোর্ট করেছিলেন যে তিনি হিসাব মেলাতে পারছিলেন না । আমি অবশ্য আরেকটি কন্ট্রাক্টে ব্যস্ত ছিলাম, তাই ঐ ঝামেলায় মন দিতে পারিনি । কিন্তু ম্যানেজার সাহেবের তো ঐ সমস্যা সমাধান করে ফেলার কথা... আমি তো উনাকেই এই দায়িত্ব দিয়েছিলাম । আচ্ছা, দোকানের কেউ জানে আমার থানায় থাকার কথা ?" সালাম আবার বললো, "হ্যাঁ, জানে, জানবে না কেন !! তবে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে আজকে সকালেই ম্যানেজার সাহেব ফোনে জানিয়েছেন তোমার দোকানের দুইজন কর্মচারী নাকি আচমকা ছুটি নিয়ে বাড়ির দিকে গেছে আর যাবার সময় বলে গেছে, ফিরতে দেরিও হতে পারে ।" আমার দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে সময় লাগলো না । তবে আমি সালামকে আর কিছুই বললাম না এই ব্যাপারে ।

"আচ্ছা, তুমি কি গো ? এত বড় ঝামেলাকে এভাবে কেউ ছোট করে দেখে !! এখন এখানে বড় কোন ঝামেলা হলে আমার কি হবে, একবার ভেবেছো ?" নূপুর আহ্লাদী ছোট মেয়ের মত আমার কাছে একটার পর একটা নালিশ করতে লাগলো । এই মেয়েটার সাথে বিয়ে হয়েছে আজ প্রায় আট বছর হলো । গ্রামের মেয়ে, বেশি উচ্চশিক্ষিতও না, মাত্র এইট পাশ । দেখতে মুখশ্রী সুন্দর, ফর্সা, গোলগাল চেহারা, স্লিম দেহের গঠন । মেয়েটার সাথে থাকার এই আট বছরে প্রতিটি দিন আমি নতুনভাবে প্রায় প্রতিদিনই ওর প্রেমে পড়েছি । অথচ এরেঞ্জ মেরেজ, আব্বা যখন প্রথম ওর ছবি দেখান, তার আগেই নাকি তিনি মেয়ের বাড়িতে হ্যাঁ করে দিয়ে এসেছিলেন । আমাকে ছবি দেখানো ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা । আমি রাগ করে ছবিটা ভালো করে দেখিনি, কারণ আমি সেই সময় বিয়ের জন্য মোটেও রেডি ছিলাম না । একটা বেকার ছেলে, যে কিনা নতুন ব্যবসা করার চিন্তা করছে, তার কপালে কি আদৌ কোন রাজরানী জুটবে !! ভেবেছিলাম, আব্বা হয়তো কোন গেয়ো ভূতকেই আমার কপালে জুটাবেন, এই জন্যই বাসর রাতে বউয়ের ঘুমটা খুলে প্রথমবারের মতন মুখ দেখার ইচ্ছাটুকুও ছিল না আমার । অনেক রাত পর্যন্ত বসে থেকে যখন মেয়েটি বুঝলো, তার জীবনের সবচেয়ে আপন মানুষটির আপাতত তার মুখ দেখার ইচ্ছা নেই, সে তখন ঐ মুখ ঘোমটাতে ঢাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়লো । ঘুমিয়ে ঢুলে পড়া মাত্রই তার মুখ থেকে ঘোমটা সরে গেলো আর আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার দিকে খেয়াল করলাম । এ আমি কি দেখলাম !!! এ তো রাজরানী নয়, সাক্ষাৎ কোন পরী...... আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, এটা কি সত্যিই নাকি কল্পনা ?

পর্ব - ০৫

পাগলিটার ঘুমরত অবস্থাই আমি আমার জীবনে প্রথম প্রেমে পড়লাম । পড়লাম মানে একেবারে ডুবে গেলাম । রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের মত বলতে ইচ্ছে করছিল তখন, "আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম" । সেই মুহূর্তেই আমার নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছিল । এত খুশি খুশি অবস্থায় আছি যে যে কোন মুহূর্তে হার্টফেল করে বসতে পারি, এই ভয়তে আমি তখনই ওর পাশের জায়গাটুকুকে শুয়ে পড়লাম । শুলাম অবশ্য ওর দিকে মুখ করে । ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আর মুচকি মুচকি হাসছি । কখন যে এভাবে ঘুমিয়ে পড়েছি, তা নিজেরও মনে নেই । যাই হোক, সকালে আমার ঘুম কখনই খুব ভোরে ভাঙ্গে না । বরং বিয়ের আগে থেকেই বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার পর মা এসে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিয়ে যেতো । বেকার মানুষ, এই ঘুম ছাড়া আর আছেই বা কি । এখন তো বিয়ে করেছি, তাই এই দায়িত্ব থেকে যে মা অবসর নেবেন, সেটা তিনি আগেই বলে দিয়েছেন । আমি যখন ঘুম থেকে উঠলাম তখন ঘড়িতে বারোটা পার হয়ে গেছে । হ্যাঁ, কেউ আমাকে ডাকেনি, নিজে নিজেই উঠেছি ঘুম থেকে । ঘড়ির সময় দেখে আবার মেজাজ গরম হলো । তাছাড়া উঠে পাশে মেয়েটিকেও পেলাম না । আসলে তখন পর্যন্ত মেয়েটি মেয়েটি করছি কারণ তখন পর্যন্ত ওর নামটিই শোনা হয়নি আমার ।

যাই হোক, আমাদের বাড়িতে সবাই যে যার মত থাকলেও তিন বেলা খাওয়াটা সবাই এক সাথে একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাওয়া হয় । সকাল বেলার নাস্তা খাওয়ার সময় সকাল দশটা । এখন তো আরও দুই ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, মনে হয় আজকের সকালের নাস্তাটা গেলো । ধুর, মেয়েটির উপর আবার রাগ আসছে । তবু নিজেকে বুঝ দিলাম, ধুর, এই মেয়েটার না আমি প্রেমে পড়েছি, তাহলে আবার রাগ কিসের !!! হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম খাটের পাশে একটি চেয়ার রাখা আর সেই চেয়ারের উপর নাস্তা রাখা । মুহূর্তেই আমার চেহারা ১০০ ওয়াটের লাইটের মত উজ্জ্বল হয়ে গেলো ।

ফ্রেশ হয়ে নাস্তাটা সেরে নিলাম । ঐ যে একটা কথা আছে না, "পুরুষ মানুষের মনের রাস্তা শুরু হয় তাদের পেটের মাধ্যমে", আমার এই কথাটিই বারবার মাথায় আসছিল । কারণ আজকের নাস্তার স্বাদ অন্য রকম হয়েছে, মা যে বানায়নি আমি নিশ্চিত । তাহলে কি পাগলিটাই !!! আমি তদন্ত করতে ধীর পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম । প্রায় রান্নাঘরে ঢুকবো এমন সময় পিছন থেকে মা বলে উঠলেন, "কি রে কালাম ? আজকে এত দেরি করে ঘুম থেকে উঠলি যে ? কাজ-কাম নাই তোর ?" ততক্ষণে পাগলিটার দিকে আমার চোখ গেছে । আমি খেয়াল করলাম কথাগুলো শুনে মেয়েটি মুচকি মুচকি হাসছে । তবু এখন মেয়েটির কর্মকাণ্ডে আমার মোটেও রাগ আসছে না । "হ্যাঁ, মা, যাবো তো । মানে ভাবলাম ওর সাথে একটু দেখা করে যাই, তাই আর কি...... " আমি মায়ের কথার উত্তরে বললাম । "ও তো তোর বিয়ে করা বউ । এত পিরিতির কি আছে ? ও কি কোথাও চলে যাচ্ছে নাকি? এখানেই আছে । তুই যা, আমি বউমাকে একটু কাজ শিখিয়ে নিচ্ছি ।" মায়ের গলা দেখছি ধীরে ধীরে চড়া হচ্ছে । বাড়িতে নতুন বউ আসলে মায়েরা যে নিজেদেরকে অনিরাপদ মনে করে, তার প্রমাণ পাচ্ছি হাতেনাতে । তারা ভয়ে থাকে তাদের ছেলে হয়তো পর হয়েই গেলো । আচ্ছা, এমন ভয় থাকলে ছেলেকে আবার বিয়ে দেওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায় কেন এই মায়েরা ? না বাপু, এত কথা আমার মাথায় ঢোকে না । অন্য সময় না হলেও এখন তো মায়ের কথা শোনাই লাগবে, মায়ের ভয় যদি আবার বিশ্বাসে পরিণত হয়, তাহলে তো বিপদ । তাই কি আর করার...... পাগলিটার সাথে দেখা না করেই আমি গুছিয়ে বাইরে বের হয়ে গেলাম । আব্বার সাথে নিয়মিত দোকানে বসছি, কাজ শিখতে হবে । নতুন দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়েছে, এবার নিজের পায়ে দাঁড়ানোর একটা তাগিদ অনুভব করছি ।

দোকানে বসে আছি অনেকক্ষণ, কাজে মন বসছে না । খালি বাড়ি ছুটে যেতে ইচ্ছে করছে । পাগলিটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে, অনেক কথা । ছোটবেলা থেকে যে কথাগুলো জমিয়ে রেখেছি, যেই কথাগুলো বাবা-মাকে বলা যায় না, বড় কিংবা ছোট ভাই-বোনকেও বলা যায় না, সেই কথাগুলো, মনের অনুভূতিগুলো, ইচ্ছেগুলো ওকে বলতে ইচ্ছে করছে খুব । আমার অমনযোগী ভাব আব্বার চোখ এড়ালো না । "কালাম, কোন সমস্যা ?" "না, তো আব্বা, কোন সমস্যা নেই ।" আমার উত্তর শুনে আব্বা দেখি মুচকি মুচকি হাসছেন । "ক্ষুদা লাগছে, কিন্তু আজকে বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না । তুই গিয়ে বাড়ি থেকে টিফিন বাটিতে করে আমার খাবারটা নিয়ে আয় ।" আব্বা এই কথা বলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন । আব্বার এই কথা শুনে মনের মধ্যে খুশির বোমা ফুটলেও, আমি এমন ভান করার চেষ্ঠা করলাম, যেন আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার আদেশ পালন করছি । আমি বাড়ির পানে রওনা হলাম । এত খুশি লাগছে যে মনে হচ্ছে নাচতে নাচতে বাড়ি যাই ।

পর্ব - ০৬

বাড়ি পৌঁছানোর পথে চলতে চলতেই মনে মনে চিত্র আঁকছিলাম, নিকট ভবিষ্যৎ টা কেমন হতে পারে !! হয়তো আমি বাড়ি গিয়ে পৌঁছাবো আর দেখবো পাগলিটা কেবল গোসল খানায় ঢুকেছে । আমি মা কে বলবো, মা, আব্বা বলেছেন, তিনি আজকে বাড়ি আসবেন না । তুমি আব্বার টিফিন বাটিতে ভাত বেড়ে দাও । আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি আমার রুম থেকে । আর হ্যাঁ, ভালো কথা, আমি কিন্তু বাড়ি থেকেই খেয়ে যাবো । আমার কথা শুনে মা রান্নাঘরের দিকে চলে যাবেন, নতুন বউকে আর কতই বা খাটানো যায় । আমি রুমে ঢুকেই শুনতে পাবো ঝর্নার আওয়াজ । আমার জীবনকে নতুন প্রেমময় বানিয়ে দেওয়ার কারিগর, আমার নতুন বউটি গোসল করছে, হয়তোবা এখন চুল ধুচ্ছে । আচ্ছা, আমি কি করবো এখন ? নক করবো দরজায় ? আচ্ছা, এটা কি ঠিক হবে ? ও লজ্জা পাবে না ? পাবে তো, অবশ্যই পাবে । তাহলে কি নক করা ঠিক হবে ? কিন্তু আমার তো পাগলিটার সাথে একসঙ্গে গোসল করতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে । তাহলে উপায় ? আচ্ছা, এক কাজ করলে কেমন হয় !! দরজায় নক করে বলি, বাথরুমের সাবানটা দাও তো । আচ্ছা, শেষে কি “বউ” বলবো ? এভাবে যে বাথরুমের সাবানটা দাও তো, বউ !! ধুর, এত নেকামি এই যুগে ভালো না । ইশ, মেয়েটার নাম যে কেন জিজ্ঞেস করলাম না । নতুন বউয়ের মুখ না হয় না দেখতাম কিন্তু নাম তো জানতাম । আমি না আসলেই ছাগল একটা । আচ্ছা, তাহলে সাবান দিতে গেলে দরজা খুললেই ঢুকে যাবো আমি ?? ইশ, কি চিন্তা করছি আমি !! আমার কি বুদ্ধি সব লোপ পেলো নাকি ? এটা মোটেও ঠিক হবে না । মেয়েটা আমার সম্পর্কে কি ভাববে ? আমাকে হয়তো খারাপ একজন মানুষ অথবা চরিত্রহীনই ভাবতে পারে । নাহ, অন্য কিছু ভাবতে হবে ।

আচ্ছা, এক কাজ করলে কি হয় ? চিত্র প্রথম থেকে আঁকি আবার !! বাড়ি গিয়েই হয়তো দেখবো ও রান্নাঘর থেকে কেবল ঘামতে ঘামতে বেরিয়েছে । মা অবশেষে তার নতুন বউকে ছুটি দিয়েছেন । হয়তো রুমে গিয়ে ফ্যানটা ছেড়ে দিয়ে খাটে শুয়েছে । আচ্ছা, ও তো অনেক ক্লান্ত !! আবার না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে না তো ? না, এটা তো করতে দেওয়া যাবে না । মা হয়তো ভালোই জন্যই বউকে শেখাচ্ছেন কিন্তু মেয়েটি কি ভাববে ? নতুন বাড়িতে কি সে কাজের লোক নাকি !!! না, ভাবতেও তো পারে, তাই না ? ধুর, কি করবো তাহলে আমি ? এক কাজ করা যায়, আমি ওর জন্য একটা কোল্ড-ড্রিংকস্‌ কিনে নিয়ে যাই । মা যদি জিজ্ঞেস করে বলবো, দোকানের জন্য কিনেছিলাম, কেউ খেলো না ভাত না খেয়ে, তাই বাড়ি নিয়ে আসলাম । হুম, কাজ হবেই এই কথা বললে । নাহ, প্রথমে রুমে গিয়েই ওর নামটা জিজ্ঞেস করতে হবে । হয়তো আমার গলা শুনেই ও ফ্যানের নিচ থেকে সরে গিয়ে আমার জন্য বসার জায়গা করে দেবে অথবা দাড়িয়ে গিয়ে এক কোণায়ও সরে যেতে পারে । তখন লম্বা এক ঘোমটার মাঝে আবারও নিজেকে লুকিয়ে ফেলবে । তখন আমি কি করবো ? হুম, ওর হাত ধরে ওকে আবার ঠিক সেই একই জায়গায় বসাবো । বলবো, তুমি অনেক ক্লান্ত । এই ফ্যানের বাতাস আমার থেকে তোমার দরকার বেশি । আরও বলবো, আর আমার সামনে এভাবে লম্বা করে ঘোমটা দেওয়ার দরকার নেই । আমার আর তোমার মাঝে আবার এত বিধিনিষেধ কিসের ? এত পর্দাই বা কিসের ? মেয়েটি নিশ্চয়ই তখন আমার কথায় আশ্বস্ত হবে । দাঁড়ানো থেকে আবার সেই আগের জায়গায় গিয়ে বসবে । আমি ঠিক ওর পাশের জায়গাটিতে গিয়ে বসবো । এরপর ওর হাতটা নিজের হাতে নেবো । ও ঠিকই লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেবো । আমি ওর মুখের থুতনিতে ধরে ওর মুখটা আমার দিকে ঘুরাবো । আমার দিকে মুখ ঘুরিয়েও সে ঠিকই চোখ নিচে নামিয়ে রাখবে । আমি তখন বলবো, এই মেয়ে, আমি কিন্তু তোমার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম । তুমি কিন্তু এখনও বলোনি !! ও তখন নিশ্চয়ই ওর নাম বলবে । আমি তখন ওর নাম ধরে ডাকবো ওকে আর সাথে এও বলবো, কাল রাতের ব্যবহারের জন্য আমি অনেক দুঃখিত । আমাকে কি মাফ করা যায় ? মেয়েটি তখন একটা হাসি দিয়ে ঠিক আবার মুখটা ঘুরিয়ে নেবে । ওর সেই মুখ ঘুরানোর কারণ হবে লজ্জা আর ভালোবাসার মিশ্রণ । আর ঐ অবস্থাতে ওকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে ।

ভাবতে ভাবতেই কখন যে বাড়ি চলে আসলাম, টেরই পেলাম না । ভাগ্য ভালো, রিকশা নিয়েছিলাম । সাইকেল কিংবা মোটরসাইকেল নিয়ে আসতে আসতে ভাবনার জগতে ডুবে গেলে এক্সিডেন্ট অবশ্যই হতো । অবশ্য বাড়ি আসার পথে ঠিকই ওর জন্য কোল্ড-ড্রিংকস কিনে এনেছি ২ লিটারের এক বোতল । বাড়ি ঢুকতেই যাবো, দরজার থেকেই শুনতে পেলাম মা চিৎকার করছে । আমি ভিতরে ঢুকলাম । দেখি আমার পাগলিটার চোখে পানি আর মায়ের সামনে কাঁচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে আছে । আমার মাথায় আর কিছুই ঢুকছে না, ওর ঐ কান্নারত চিত্রটা আমার ভাবনার জগৎকে সব তছনছ করে দিয়েছে । আমার নিজেকে অনেক ছোট লাগছে, অনেক ছোট । মা হয়তো ওকে কোন ন্যায্য কারণেই কিছু বলছেন, উগ্রতার সাথে । কিন্তু আমার মন কেন জানি মেনে নিতে পারছে না কিছুই । হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, মায়ের সামনেই ওর হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ওকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে একটা দৌড় দিলে কেমন হয় !! পরক্ষনেই নিজেকে নিজেই তিরস্কার করলাম । পাগল নাকি আমি ? কি ভাবছি এসব উল্টাপাল্টা ?

আমি হেঁটে হেঁটে আর একটু সামনের দিকে এগুলাম । সামনের দিকেই এগুতেই আমার আগমন মা আর মেয়েটি দুজনেরই চোখে পড়লো । মেয়েটি আমাকে দেখামাত্রই চোখ মুছতে লাগলো আর ওদিকে মা দেখি আমার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন । আমি কিছু বলবো কিনা, ভেবে পাচ্ছি না ।

(বাকীটা আগামী পর্বগুলোতে)

মন্তব্য ১ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ১২:২০

জগতারন বলেছেন:
সুন্দর ও সাবলীলভাবে লিখা।
সাহিত্য উপাদানে ভরপুর।
একটানে পড়ে ফেললাম।
পরের পর্বের অপেক্ষায় র'লাম,
এবং অনুসরনে র'লাম।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.