নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেলাশেষে ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় আসলাম সামুর তীরে, রেখে যেতে চাই কিছু অবিস্মরণীয় কীর্তি । পারি না আর না পারি, চেষ্ঠার ত্রুটি রাখবো না, এই ওয়াদা করছি ।

মোশারফ হোসেন ০০৭

একজন শৌখিন লেখক আমি, আবার কবিও বলা যেতে পারে । যখন যা ভালো লাগে তাই লিখি ।

মোশারফ হোসেন ০০৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

চাঁদের কালো জোছনার গল্প ।। পর্ব ১-৬ ।।

২০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ রাত ১:৪৭


[ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত]

পর্ব - ১

ঘড়িতে রাত আটটার মত বাজে । হঠাৎ পাশের ঘর থেকে আওয়াজ আসলো,

- সিয়াম, এই সিয়াম, এইদিকে আয় তো ।

কম্পিউটারে গেমস খেলছিল সিয়াম । ফিফা-১৬, সারাদিন ধরেই খেলে সে । কম্পিউটারের সামনে থেকে সিয়ামের উঠা মানেই, বিরাট কিছু । হঠাৎ মায়ের ডাক শুনতে পেলো, না উঠেই বা উপায় কি । অগত্যা, গেমস কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠলো সে ।

- কি ব্যাপার, মা, ডাকছিলে কেন ?
- তোর আসলাম মামা আসছে ।
- ওয়াও, আসলাম মামা !! সে তো বহুদিন পর । যাক আজকে অনেক মজা হবে ।
- অফিসের কাজে দুইদিন আগেই চুয়াডাঙ্গা থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে গিয়েছিল ও । দুইদিন খাঁটা-খাটুনির পর, তোর মামা আসছে আমাদের বাড়িতে । জার্নি করার পর এমনিতেই আজকে খুব ক্লান্ত থাকবে । তাই খবরদার, মামাকে একেবারেই ঘাঁটানো যাবে না ।
- ওহ, আচ্ছা । ঠিক আছে, তা কখন আসছে মামা, মা ?
- আসলাম অবশ্য আজই আবার চুয়াডাঙ্গা ব্যাক করতো কিন্তু ঢাকার উপর দিয়ে যাওয়ার সময় আমাদের সাথে দেখা না করলে কেমন হয়, তাই আসছে । তবে তুই কিন্তু আজকে ঐ কোণার ঘরটাতে থাকবি । মামার সাথে থাকলে মামাকে শান্তিমত ঘুমাতে দিবি না, ও আমি জানি ।
- কই, আমি আবার কি করবো !!
- কি আর, সারাক্ষন ঘ্যানর ঘ্যানর করবি !! নাহ, তোকে আসলামের সাথে রাখবো না আমি ।
- তাই বলে, ঐ কোণার ঘরে !!
- হ্যাঁ, কোণার ঘরে । আজকে রাতটা ঐ ঘরেই থাকবি তুই ।
- না, মা, আমি পারবো না ।
- পারবো না মানে ?
- আমি কোণার ঘরে যেতে পারবো না ।
- তুই পারবি না, মানে ? তোকে না যেতে বলেছি, চুপচাপ যা ।
- কিন্তু মা, আমার তো ভয় করে ।
- ভয় করে !! নাটক করিস, না ? রাত জেগে গেমস আর ফেসবুক টা গুঁতাতে পারবি না, তাই তো !! ও আমি ভালো করেই বুঝছি ।
- না, মা, তুমি বিশ্বাস করো, গেমস না হয় এক রাত খেললাম না । কিন্তু ঐ কোণার ঘরে থাকলে তো আমি ভয়েই শেষ হয়ে যাবো ।
- এত বড় ধারী ছেলের ভয় করে ?! এইবার অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে উঠবি, আর এখনও ভয় ভয় করিস !! ছিঃ, লজ্জা করে না, তোর ?
- ধুর, লজ্জা করে বেঁচে থেকেও লাভ আছে । মরে গেলেই তো সব শেষ ।
- ঠিক আছে, আর ফাউ বকতে হবে না । খালি আজকের রাতটাই তো । তুই তো আবার কাল থেকে শুতে পারবি নিজের ঘরে । একটা রাত ম্যানেজ করে নে, না ।
- কিন্তু মা...
- কিন্তু কি ?
- ঐ কোণার ঘরে যেতে গেলে তো ঐ বারান্দা দিয়ে যেতে হবে । আমার তো সন্ধ্যার পর বারান্দায় যেতেই তো ভয় করে, তুমি তো জানোই ।
- অতসব আমি বুঝি না । যেভাবে হোক একটা ব্যবস্থা করে নে । আমি আর এই বিষয়ে কোন কথাই শুনতে চাই না ।
- কিন্তু...
- আর কোন কিন্তু না । আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে আমাকে মাফ কর তোরা সব । সারাদিন সংসারের ঘানি টেনে তোদের সকলের সাথে এত বকবক করার শক্তি থাকে না ।

মায়ের এই কথা শুনে অগত্যা সিয়ামকে চুপ করতে হলো । কিন্তু বারান্দার কথা হঠাৎ আবার মনে হতেই ভয়ের একটা শিহরণ বয়ে গেলো ওর পুরো শরীরে । কি ব্যবস্থা করা যায়, ভাবতে ভাবতে আবার নিজের ঘরে চলে গেলো সিয়াম ।


পর্ব - ২


মায়ের কথাটাই আসলে সত্যি । আসলেই রাত জেগে ঐ ফিফা গেমস খেলার নেশা হয়ে গেছে সিয়ামের । ওহ, ফিফা ছাড়া এক রাত থাকা !! ভাবাটাই কষ্ট । তবে ভয়ের ব্যাপারটাও একেবারে অমূলক না । সিয়াম যে বারান্দার কথা বলছিল, সেই বারান্দাটা এই বাড়ির তৈরি হওয়ারও আগে তৈরি । সিয়ামের দাদুভাই প্রথম এক তলা বিল্ডিং বানিয়ে তাতে টিনশেড দিয়েছিলেন । তার আবার বারান্দায় বসে চা খাওয়ার ভীষণ ব্যারাম ছিল । তাই তো, বাড়ির বারান্দাটা নিজের মত করেই বানিয়েছেন আর পরবর্তীতে সাজিয়েছিলেনও । এই বারান্দায় বসেই বিকেল থেকে সন্ধ্যা পার করে দিতেন সমির আলী, সিয়ামের দাদা । তখনও কোণার ঘরটা তৈরি করা হয়নি । এরপর সিয়াম যখন ক্লাশ এইটে পড়ে তখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেন সমির আলী । সিয়ামের দাদী অবশ্য তারপরও দুই বছর বেঁচে ছিলেন ।
যাই হোক, সিয়ামের বাবা আয় করা শুরু করার পর, তিনি যখন বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার মত সমর্থ হন, তখন তিনি প্রথম বারান্দা ঘেঁষে একটা ঘর তৈরি করেন । এটা সাধারণত গেস্ট রুম আকারে তৈরি করা হয়েছে । কোন আত্মীয়-স্বজন আসলে এই ঘরে থাকার ব্যবস্থা করা হয় । দুইতলা বিল্ডিং এর এক পাশ দিয়ে বারান্দা আর বারান্দা ঘেঁষে একটা মাত্র ঘর । বেশ ভালো ব্যবস্থা । সিয়ামের ফুফু দুইজন, চাচা নেই । ফুফু দুইজনও বাবার থেকে ছোট ।

সিয়াম আগে কোনদিন এই কোণার ঘরে রাতে থাকেনি । বেশ কয়েক বছর আগে সিয়ামের এক দূর সম্পর্কের দাদী এসেছিল গ্রাম থেকে, তখন সিয়ামের দাদা-দাদী দুইজনই বেঁচে ছিল । সেই দূরসম্পর্কের দাদীই এক রাতে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, এই বাড়িতে নাকি ভূত আছে । গভীর রাতে বারান্দা দিয়ে কেউ হাঁটে বলে নাকি শব্দ পাওয়া যায় । সেই থেকে, বারান্দাটা একটু ভৌতিক হয়ে আছে বাড়ির সকলের জন্য । অবশ্য গেস্ট রুমে বাদবাকী আর যারা ছিল, তারা এমন কোনদিন শব্দ পায়নি, এমনকি ভৌতিক কিছুর অস্তিত্ব টেরও পায়নি ।

সিয়ামের আসলাম মামা অবশ্য ঠিক দুই ঘণ্টা পরই কলিংবেল চাপলো । সিয়াম এই দুই ঘণ্টায় ফিফার আরও কয়েকটা ম্যাচ খেলে নিয়েছে । দরজা খুলতেই আসলাম মামা হাসিমুখে ঘরে প্রবেশ করলো, হাতে দুই প্যাকেট মিষ্টি । দরজা খুললো সিয়ামের মা ই ।

- আসসালামু আলাইকুম আপা । কেমন আছেন ?
- এই তো ভালো রে । তোর শরীর কেমন ?
- অফিসের কাজে এত দৌড়াদৌড়ি !! শরীর ভালো রাখাই তো কষ্ট । তা দুলাভাইয়ের খবর কি ?
- হ্যাঁ, ভালোই । তোর দুলাভাই অবশ্য এখনও আসেনি ।
- না, আমি জানতাম এখন আসলে দুইলাভাইকে দেখতে পাবো না । সমস্যা নেই, হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসার আগে দুলাভাই আর শালা মিলে একসাথে খেতে পারলেই হলো ।
- হুম, তা ঠিক । যা ফ্রেশ হয়ে নে । বাথরুমে আমি তোয়ালে দিয়ে রেখেছি ।

আসলাম মামা ফ্রেশ হতে চললো । আর মা রান্নাঘরে খাবার বাড়ার জন্য গেলো । মামা চলে এসেছে, তার মানে আজকে রাতের মত সিয়ামের নিজের ঘরে সিয়ামের রাজত্ব থাকলো না । কিন্তু তাই বলে কোণার ঘর !! নাহ, সিয়াম অন্যকিছু ভাবতেও পারছে না । টেবিলে খাবার বাড়তে বাড়তে সিয়ামের মা আরেকবার সিয়ামের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে ইশারা দিয়ে বুঝিয়ে দিলো, যা বলেছি, মনে আছে তো ? সিয়াম সেই ইশারা বুঝে খালি একবার ঢোক গিললো । অর্থাৎ, হ্যাঁ, মনে আছে । মায়ের সামনে থেকে সরে পরাটাই এখন ভালো হবে । হঠাৎ সিয়ামের লোপার কথা মাথায় আসলো । ছোটবোনটা কি করছে, সেটা দেখা দরকার ।


পর্ব - ৩


লোপা সিয়ামের ছোট বোন । সিয়ামের চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট লোপা । লোপা অন্ধ । জন্ম থেকেই । চাঁদের মত ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটার এই একটাই সীমাবদ্ধতা । যে-ই ওকে দেখে সেই আফসোস করে । অন্ধ হলে কি হবে, কাজ-কামে ভীষণ আগ্রহ তার । মায়ের কাছ থেকে টুকটাক রান্নাও শিখেছে সে । তাছাড়া ঘরের কাজও করে নিজে নিজে । ভাই-বোনের মধ্যে বিশাল ভাব । ভাই ছাড়া যেমন বোনের চলে না, ঠিক তেমনি বোন ছাড়াও ভাইয়ের চলে না ।

লোপা প্রতিবন্ধী এক স্কুলে পড়ে ক্লাশ টেনে । ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশুনা । লোপার পড়াশুনা করার আগ্রহ প্রবল । সিয়ামের অবস্থা আবার ঠিক উল্টো । ওর পড়াশুনা করতে তেমন ভালোই লাগে না । কোনরকমে এসএসসি আর এইচএসসি টা আর্স বিভাগ নিয়ে পাশ করার পর বাড়ির কাছেই এক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে সে, ইংলিশে । পড়াশুনা নামমাত্র, চারবছর পর সার্টিফিকেট পেলেই সাড় হবে তার । সন্ধ্যার পরপরই লোপার পড়াশুনা শুরু হয় । হয় একাডেমিক বই নয়তো কোন গল্পের বই নয়তো কোন সাধারণ জ্ঞানের বই, আরও কত কি । সিয়াম উঁকি মেরে আগে দেখে নিয়ে, এরপর পা টিপেটিপে লোপার ঘরে ঢুকলো । উদ্দেশ্য লোপাকে চমকে দেওয়া । কিন্তু সিয়ামের ঘরে ঢুকার ব্যাপারটা কিভাবে জানি লোপা টের পেয়ে গেলো ।

- কে ?

ধুর, মজাটাই নষ্ট হয়ে গেলো সিয়ামের । এর আগেও সিয়াম এমন যতবার করতে চেয়েছে, লোপা ঠিকই টের পেয়ে গেছে । কিভাবে টের পায় ও !! একমাত্র আল্লাহ্‌ই জানে । অন্ধ মানুষদের ষষ্ঠইন্দ্রিয় খুব প্রখর হয়, হয়তো তাই । ওদিকে লোপা তার করা প্রশ্নের অপেক্ষায় বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলো ।

- কে ? কে ঢুকলো ঘরে ? মা, তুমি নাকি ?

সিয়াম উত্তর করলো না কোন । এভাবেও তো মজা নেওয়া যায় । যেভাবে পা টিপেটিপে ঘরে ঢুকেছে সে, সেভাবেই পা টিপেটিপে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেই তো হয় । সিয়াম সেটা করতেই উদ্যত হলো, ফিরতি পথে পা বাড়াতেই লোপা বুঝে ফেললো যে ঘরে ঢুকা ব্যাক্তিটা আর কেউ নয়, সিয়ামই ।

- ভাইয়া, কি করো তুমি এখানে ?

কোন চোর হঠাৎ ধরা পড়লে যেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, সিয়ামের অবস্থাও এখন তাই ।

- কি করি, মানে কি !! তুই কি করিস তাই দেখতে এসেছিলাম ।
- তাই বলে পা টিপেটিপে !! এভাবে নীরবে আসতে হবে কেন ?
- না, মানে, তোর যাতে ডিস্টার্ব না হয়, তাই ।
- তুমি জানো না, এই সময় আমি কি করি ?
- হ্যাঁ, জানি তো । জানবো না কেন !! এই সময় তুই পড়িস ।
- তাহলে ?
- তাহলে, তুই ঠিক এই সময় কি পড়িস, এইটা তো দেখতে পারি, তাই না ?
- হুম, তা পারো । একটা গল্পের বই পড়ছিলাম । চাঁদের কালো জোছনার গল্প ।
- কালো জোছনা !! সে আবার কেমন ?
- আসলে এটা একটা মেয়ের গল্প । মেয়েটা আমার মতই অন্ধ । তার কাছে চাঁদের আলো, জোছনা কোনকিছুই তো দৃশ্যমান না । সবকিছুই তো কালো । কিন্তু মেয়েটার চাঁদ খুব ভালো লাগে, বিশেষ করে চাঁদের জোছনা কিন্তু এই ভালো লাগার বিষয়টা দেখে হয়নি, হয়েছে অনুভব করে । তাই এমন নাম ।
- তোকে না বলেছি, তুই যে অন্ধ, এটা নিয়ে গেজাবি না !!??
- কই গেজালাম আমি ?
- তাহলে এসব গল্প পড়িস কেন ?
- আমার ভালো লাগে ।
- এমন গল্প ভালো লাগানো যাবে না একেবারেই ।
- ও মা, ভালো লাগলে কি করবো ?
- না, লাগানো যাবে না ।
- আচ্ছা, ভাইয়া, ভালো আবার না লাগানো যায় কিভাবে ?
- আমি জানি না । তুই খুঁজে দেখ কোন উপায় ।
- আমি অন্ধ মানুষ, খুঁজবো কি করে ? তুমি খুঁজে দাও না একটু, ভাইয়া !!
- আবার !! ধুর, তুই থাক, আমি যাই ।


পর্ব - ৪


লোপার ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সিয়াম । লোপার সাথে কথা বললে এই এক সমস্যা । ভালো করেই কথা বলবে কিন্তু একসময় না একসময় নিজের অন্ধত্ব হওয়ার সীমাবদ্ধতার কথা বলবেই । যাই হোক, কোণার ঘরে যাওয়ার যুদ্ধে নামার আগে আসলাম মামার সাথে একটু গল্প করা দরকার । মামার সাথে আজ প্রায় তিনবছর পর দেখা বাড়ির সবারই । বাকী সব মামার থেকে এই আসলাম মামাকেই ভালো লাগে সিয়ামের । অবশ্য আসলাম মামাকে লোপারও ভালো লাগে । সিয়াম যখন খুব ছোট, তখন মামা এই বাড়িতে আসলেই সুন্দর সুন্দর গল্প বলতো । সেই থেকেই আসলাম মামা সিয়ামের কাছে বেশ প্রিয় । সিয়াম ডাইনিং রুমে যেয়ে দেখলো, আসলাম মামা খেতে বসেছে আর পাশের এক চেয়ারে বসে আছে মা । দুই ভাই-বোন মিলে বেশ গল্প চলছে ।

হঠাৎ কলিংবেল বাজলো । বোধ হয়, হামিদুর রহমান ফিরেছে । জনাব হামিদুর রহমান সিয়াম আর লোপার বাবা । ব্যবসা করেন, মোটর পার্টসের । প্রতিদিন রাত দশটা নাগাদই ফেরেন তিনি । কলিংবেলের শব্দ শুনে সিয়ামের মা আর আসলাম মামার গল্পে একটু বিরতি হলো । সিয়ামের মা দরজা খুলতে উঠার আগেই সিয়াম এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো । দরজা খুলতেই হামিদুর রহমান সাহেব সিয়ামকে দেখে বেশ অবাক হলো । কারণ সিয়াম কখনই দরজা খোলে না । সারাদিন তো ঐ গেমস নিয়েই ব্যস্ত । যাই হোক, দরজা খুলে দিয়েই সিয়াম আবার সরে পড়লো । বাড়ির মেইন গেট দিয়ে হামিদুর রহমানের সাহেবের ঘরে ঢুকতে গেলে ডাইনিং রুম দিয়েই যেতে হয় । ডাইনিং রুমে আসতেই আসলাম মামাকে দেখতে পেলো সিয়ামের বাবা ।

- আরে আসলাম, কখন এলে ?

আসলাম মামার ভাত খাওয়া অনেক আগেই শেষ । বড় বোনের সাথে বসে বসে গল্প করার কারণেই হাতটা ধোঁয়া হয়নি তার । তবে দুলাভাই ঘরে ঢুকতেই আসলাম মামা দুলাইভাই হামিদুর রহমান সাহেবের দিকে খেয়াল করলো ।

- আসসালামু আলাইকুম দুলাভাই । আছেন ভালো ?
- হ্যাঁ, আল্লাহ্‌ তো ভালোই রেখেছে আর তোমাদের সবার দোয়া ।
- হ্যাঁ, তা তো ঠিক । আসলাম এই তো ঘণ্টা খানেক আগে । ভেবেছিলাম আপনি আসবেন আরেকটু আগে । তাহলে হয়তো দুলাভাই আর শালা মিলে রাতের খাবারটা খাওয়া যেতো ।
- ওহ, তাই নাকি !! সিয়ামের মা কিংবা বাড়ির কেউ তো আমাকে ফোন করে বলেনি । বললে হয়তো চলে আসতাম আরেকটু আগেই ।

এই বলে সিয়ামের বাবা সিয়ামের মায়ের দিকে তাকালো । সিয়ামের মা কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো । সকালে দোকানে যাওয়ার আগে সিয়ামের মা আর সিয়ামের বাবার মধ্যে সাংসারিক একটা বিষয় নিয়ে সামান্য ঝগড়া বেঁধে গিয়েছিল । হামিদুর রহমান সাহেব বুঝে গেলেন, গিন্নীর মন এখনও একটু খারাপ । তবে স্ত্রীকে আর ঘাঁটালেন না এ যাত্রায় ।

- তাহলে দুলাভাই, আপনি ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া করে নেন । এরপর না হয় গল্প করা যাবে ।
- হ্যাঁ, সেটাই ঠিক হবে । তাইলে তুমি বসো, আমি ফ্রেশ হয়ে নিই ।

এই কথা বলে সিয়ামের বাবা ঘরের দিকে চলে গেলো । সিয়ামের মা আর বাবার মধ্যে মন কষাকষির ব্যাপারটা তার মোটেও দৃষ্টিগোচর হয়নি । আসলাম মামা হাত ধুয়ে টিভির সামনের সোফায় গিয়ে বসে পড়লো । আজকের নিউজটা দেখা দরকার তার । অফিসের কাজ আর জার্নির কারণে নিউজই দেখা হয়নি সারাদিন ।


পর্ব - ৫


টিভির সামনে বসেই টিভির রিমোট খুঁজতে লাগলো আসলাম মামা । কিন্তু আশেপাশে না দেখে সিয়ামকে ডাক দিলো সে ।

- সিয়াম, এই সিয়াম, বাবা, এদিকে আয় তো ।

সিয়াম না পারছে নিজের রুমে যেতে, না পারছে অন্য কোথাও যেতে । তাই বাধ্য হয়ে সে ডাইনিং রুমের পাশ দিয়েই ঘুরাফিরা করছিল । মামার ডাক শুনতে পেয়েই মামার দিকে এগিয়ে গেলো সে ।

- হ্যাঁ, মামা, বলো ।
- বলো কি রে, এইদিকে আয় । বস আমার পাশে । সেই কখন আসলাম, তোর সাথে তো দেখা করাই হলো না । খুব ব্যস্ত নাকি তুই ?
- না তো মামা । আমি তো লোপার ঘরে ছিলাম । ওর সাথেই টুকটাক গল্প করছিলাম ।
- ওহ, লোপা মামনি !! সে আবার কোথায় ?
- ওর ঘরেই ।
- কি করছে ?
- কি জানি একটা বই পড়ছে । গল্পের বই নাকি !!
- ব্রেইলে লেখা গল্পের বই !! বাহ, দুনিয়া এখন কত এগোনো । আমাদের সময় এগুলো চিন্তাও করা যেতো না । আচ্ছা, গল্পের নামটা কি রে ?
- কি এক উদ্ভট নাম । চাঁদের কালো জোছনার গল্প ।
- চাঁদের কালো জোছনার গল্প !! বাহ, আসলেই তো অদ্ভুত নাম । জোছনা তো আলোকিত হয়, উজ্জ্বল হয় । তাহলে এই কালো ব্যাপারটা এলো কোথেকে ? তুই জানিস নাকি কিছু ?
- হ্যাঁ, লোপার কাছ থেকে শুনতে পেলাম কিছুটা । এক অন্ধ মেয়ের নাকি চাঁদ ভালো লাগে, জোছনা ভালো লাগে ।
- দাড়া, দাড়া, একটু থাম । অন্ধ মেয়ের চাঁদ-জোছনা এগুলো কিভাবে ভালো লাগবে ? আজব তো ব্যাপারটা । সে চাঁদ-জোছনা দেখলোই বা কিভাবে ? আর না দেখে ভালো লাগেই বা কিভাবে ?
- সে আমি এত ডিটেইলস্‌ জানি না । আমাকে যা বললো লোপা, সেটাই বলছি । অন্ধ মেয়েটার এই চাঁদ-জোছনা ভালো লাগা নাকি ফিলিংস দিয়ে, চোখ দিয়ে দেখে নয় ।
- বাহ, ফিলিংস এর ভালো লাগা !! অদ্ভুত তো । তারপর ?
- তো সেই অন্ধ মেয়েটির কাছে চাঁদ-জোছনা ভালো লাগলে কি হবে, সে তো আর ঐগুলো দেখতে পায় না । তার কাছে চাঁদ-জোছনা সবকিছুই কালো । এই কারণেই গল্পের নাম চাঁদের কালো জোছনার গল্প ।
- বাহ, ভাগ্নী তো আমার জব্বর বই পড়তেছে । নাহ, আমার কিন্তু বইয়ের কনসেপ্ট টা বেশ পছন্দ হইছে । এখন তো আমার ঐ বইটা দেখারও সাধ জাগছে মনে মনে । যাই, লোপার ঘরে গিয়েই দেখি গিয়ে ।

বলা মাত্রই আসলাম মামা উঠে দাঁড়ালো । মামার সাথে সাথে সিয়ামও বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো । ঐ বইটার মধ্যে অদ্ভুত কি খুঁজে পেলো মামা !!! এই ব্যাপারটাই অদ্ভুত লাগছে সিয়ামের কাছে । আসলাম মামা লোপার ঘরের দিকে হাঁটতে লাগলো আর তার পিছন পিছন সিয়াম ।

লোপার ঠিক ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে আসলাম মামা দাড়িয়ে গেলো । আর তাকে দেখাদেখি সিয়ামও দাড়িয়ে গেলো ।

- মামনি, আসবো ?

আসলাম মামার গলা শুনে লোপা গল্পের বইটা বন্ধ করে ঠিক পাশে রেখে দিলো ।

- কে, মামা ? আসো মামা । আমার মত অন্ধের ঘরে ঢুকতে কি আবার অনুমতি লাগে নাকি ?

আসলাম মামা ঘরে ঢুকে লোপা যে খাটে বসে ছিল তার ঠিক কোণায় গিয়ে বসলো ।

- অন্ধ মেয়ে মানে ? তুই নিজেকে অন্ধ অন্ধ বলিস কেন ? এই বিষয়টা কিন্তু মোটেও ঠিক না ।

মামার কথার সাথে নিজের কিছুক্ষণ আগে বলা কথা ঠিক ঠিক মিলে যাওয়ার সিয়াম মনে মনে খুশি হয় । সাথে সাথে মামার সাথে সুর মিলিয়ে বলে ওঠে

- মামা, এই ব্যাপারটা এই পাগলিটাকে বুঝাও তো । ওর কি বারবার নিজেকে অন্ধ অন্ধ বলার দরকার আছে ?

সিয়ামের মুখের কথা শুনে লোপা এবার ফিক করে হেসে দিলো । ভাইবোনের কথোপকথনের মাঝে আসলাম মামা পড়তে চাইলেন না । তাই তিনি কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন ।

পর্ব - ৬

লোপা অনেকটা হাসিমুখ রেখেই সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললো –

- ভাইয়া, তুমি এক কথা আর কতবার বলবে ?
- হাজারবার বলবো । যতদিন তুই নিজেকে অন্ধ বলা না থামাবি ।
- নিজেকে অন্ধ বলা থামালেই কি আমি চোখে দেখা শুরু করবো নাকি ?
- ওহ, আচ্ছা, আমরা তোর আশেপাশে থাকতে তোর নিজেকে এতটা অসহায় কেন মনে হয় ?
- কই, অসহায় মনে হয়, কোনদিন বলেছি ?
- বলা লাগবে কেন !! তোর কথাতেই তো স্পষ্ট বোঝা যায় ।
- কচু বুঝা যায় !! থাক, তুমি চুপ করো । মামার সাথে গল্প করবো । মামা, কই তুমি, চলে গেলা নাকি ?

আসলাম মামা এতক্ষণ পর কথা বলার প্রসঙ্গ নিজের দিকে আসতেই কথা বলা শুরু করলেন –

- না, যাইনি । আছি এখানেই । তোদের দুই ভাইবোনের খুনসুটি দেখছিলাম ।
- জানিস, তোর রুনু খালা আর আমার ব্যাপারটাও এরকম ছিল । আমরাও সারাদিন ভীষণ খুনসুটি করতাম । বড় আপা, মানে তোদের মা, সেই বলতে গেলে আমাদের দুইজনকে শাসনে রাখতো । তবে আমরা দুইজন অনেক দুষ্টুমি করতাম ছোটবেলায় ।
- রুনু খালার সাথেও অনেকদিন গল্প করি না । আসলে আমরা ঢাকায় চলে আসার পর, আত্মীয় স্বজনদের সাথে যোগাযোগই হয় না তেমন । খুলনায় ভালোই ছিলাম আমরা ।
- না, তা ঠিক । তোরা খুলনায় যখন ছিলি, তখন তো আমাদের ছোটখাট রি-ইউনিয়ন হয়ে যেতো ।
- হ্যাঁ, অনেক মজা হতো তখন । আমি তো কাউকে দেখতে পেতাম না, তবে মজাটা অনেক অনুভব করতাম ।
- থাক, দেখাদেখির গল্প বাদ । আচ্ছা, সিয়াম বললো, তুই নাকি কি একটা অদ্ভুত বই পড়ছিলি ?
- ভাইয়া কি বলেছে তোমাকে আমার বই নিয়ে ?
- কি নাকি একটা অদ্ভুত বই, আবার বইয়ের নামটাও অদ্ভুত । “চাঁদের কালো জোছনার গল্প” । আমার কিন্তু থিমটুকু শুনে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে । জোছনা, তাও আবার কালো !!
- ভাইয়া একটু বাড়িয়েই বলেছে তোমাকে । তার তো আবার বাড়িয়ে বলাই স্বভাব ।

বোনের মুখ থেকে এরকম কথা শুনে সিয়াম বেশ অবাক হলো কিন্তু মামা-ভাগ্নির কথোপকথনের মাঝখানে সে নিজেই কিছু বললো না ।

- না, বাড়িয়ে আর কি !! ও যা বললো, তার যদি অর্ধেকও সত্যি হয়, তাহলে গল্পটা পড়তে নিশ্চয় অনেক মজা লাগার কথা ।
- (আসলাম মামার এরকম কথা শুনে লোপা বেশ অবাক হলো) মামা, তুমি কি আমার সাথে মজা করার চেষ্ঠা করছো ?
- ছিঃ, মামনি, মজা করবো কেন !! অন্ধ মেয়ের কাছে চাঁদ-জোছনার ফিলিংস, সেখানে কালো জোছনার গল্প !! একটু ইন্টারেস্টিং তো বটেই ।
- (মামার দেওয়া ব্যাখ্যা শুনে আশ্বস্ত হলো লোপা) হুম, তা ইন্টারেস্টিং তো আছেই । আমি কেবল ওয়ান থার্ড পড়েছি । আজ আর পড়বো না । বাকীটা কাল পড়বো । এখন শুধুই তোমার সাথে গল্প করবো ।
- এই যাহ, আমার তো দুলাভাইকে শিডিউল দেওয়া । তোকে তো এখন শিডিউল দিতে পারবো না, মামনি !!
- (লোপা একটু অভিনয় করার ভান করে) কি বলো মামা !! তুমি তো আমার মনটাই ভেঙে দিলে ।

লোপা এই কথা বলা মাত্রই আসলাম মামা আর লোপা দুইজনেই হো হো করে হেসে ওঠে । তাদের দেখাদিখি সিয়ামও হেসে ওঠে । সাধে কি মানুষ বলে যে, হাসি সংক্রামক ।


(গল্পটা আরও বাকী আছে । গল্পের সৃষ্টি হয় পাঠকের প্রয়োজনে, পাঠকের উৎসুকতায় । তাই পাঠকের সাড়াই গল্পের পরবর্তী পর্বগুলোর সৃষ্টি হওয়ার অনুপ্রেরণা হবে ভবিষ্যতে । হয়তো ব্লগের এই দুনিয়ায় গল্পটির সমাপ্তি এখানেই । আবার হয়তো গল্পটি মেলতে পারে শাখা-প্রশাখা । যাই হোক, সৃষ্টি লেখকের আনন্দ আর পাঠকের স্বস্তি - এই দুইটির সমন্বয় ব্যতিত সৃষ্টির সৃষ্টি হওয়াতেও কোন সার্থকতা নেই) ।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে জানুয়ারি, ২০১৭ সকাল ৮:২২

একজন সত্যিকার হিমু বলেছেন: সবটাই পড়েছি ।ভাল লেগেছে ।তবে গল্পের শেষটা দেখানো উচিত ।শেষ ব্যতীত গল্পটা স্বার্থক নয় ।এটা মাঝখানেই শেষ করেছেন ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.