নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বেলাশেষে ক্লান্ত-তৃষ্ণার্ত পথিকের ন্যায় আসলাম সামুর তীরে, রেখে যেতে চাই কিছু অবিস্মরণীয় কীর্তি । পারি না আর না পারি, চেষ্ঠার ত্রুটি রাখবো না, এই ওয়াদা করছি ।

মোশারফ হোসেন ০০৭

একজন শৌখিন লেখক আমি, আবার কবিও বলা যেতে পারে । যখন যা ভালো লাগে তাই লিখি ।

মোশারফ হোসেন ০০৭ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মিলান ও ছবির ভালোবাসার গল্প - যেন এক দীর্ঘ উপন্যাস (১ম পর্ব)

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ২:১৬

১.

- তোমার হাতটা একটু ধরি ?

মিলানের কথায় ছবি একটু ধাক্কামত খেলো । মাত্র কয়েকদিনের পরিচয়ে ছবি মিলানকে যতটুকু চিনেছে, সেখানে ছেলেটির পক্ষে হাত ধরার ব্যাপারটা অনেকটা অবাক হওয়ার মত । ছবি আর মিলান এখন যেখানটা বসে আছে, সেটা পার্কের এক কোণায় । ছবির খুব পরিচিত একটা জায়গা কিন্তু মিলানের জন্য নতুন জায়গাটা । ছবির বন্ধুরা কয়েকজন আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে, সম্ভবত ওরা মিলানকে ছবির সাথে দেখতে পেয়েছে । বন্ধুদের কাজই তো আরেক বন্ধুর বিষয় নিয়ে মজা করা । ছবির সাথেও মজার পর্ব চলছে মিলানের সাথে পরিচয় হওয়ার পর এক বন্ধকে কথায় কথায় বলার পর থেকে । আশেপাশে ভালো করে একবার তাকিয়ে ছবি মিলানের দিকে তাকালো ।

- কি হলো, দেবে না হাতটা ?

ছবি মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো, না, সে হাতটা দেবে না । মিলান একটু মন খারাপ করে পাশে তাকাতেই ছবি ফিক করে হেসে দিলো । আর কি !! মিলানের মনটা গলে গেলো । এই মেয়েটাকে হাসতে দেখা মিলানের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটি এই মুহূর্তে । হাত না ধরতে পারায় যতটুকু মন খারাপ হয়েছিল এতক্ষণ মিলানের, এখন কেন জানি সেই মন খারাপ লাগাটুকু কাজ করছে না ।

- কি ব্যাপার, হাত না দিয়ে আবার হাসো কেন ?

মিলান দুষ্টুমি করে জিজ্ঞেস করলো ছবিকে । ছবি উত্তর করলো, এমনিতেই, কিছু না । এই দুষ্টুমির ব্যাপারটাই অনেক উপভোগ করছে মিলান । আচ্ছা, মেয়েটার সাথে পরিচয়ের ব্যাপারটাও অনেকটা অদ্ভুত । কেমন জানি, বললে কেউ বিশ্বাসই করবে না । তবে সেটা একটা লম্বা ইতিহাসও বটে । সেই কথা মনে করে এখনকার সুন্দর মুহূর্তটুকুকে নষ্ট করতে চাইছে না মিলান ।

- কি ব্যাপার, কি চিন্তা করেন ?

ছবির প্রশ্নটাই কেমন জানি চিন্তার জগত থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো মিলানকে । মিলানের ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেলো ।

- উহু, কিছু না । কিছু খাবে ? চলো, কোথাও বসে কিছু খেতে খেতে গল্প করি ।

কমপক্ষে এসির বাতাস কিংবা ফ্যানের বাতাস খেতে খেতে তো গল্প করা যাবে । গরমে বসে বসে ঘামের চেয়ে সেটা ঢের উত্তম । মিলানের প্রস্তাবে ছবি রাজী হলো । ফলাফল, তারা পার্ক থেকে বেরিয়ে ভালো একটা বসার জায়গা খুঁজতে লাগলো ।

২.

ছবি তার হাতটা মিলানের হাতে দিতেই মিলান অনেকটা শক্ত করে হাতটা ধরলো যেন তার হাত থেকে ছবির হাতটা কোনভাবেই ছুটে না যায় । ছবি অবশ্য বিষয়টা টেরই পায়নি । তার সম্পূর্ণ মনোযোগ এখন নদীর দিকে আর দূরের অনেক অনেক লাইটসের দিকে । মিলান আর ছবি নৌকা ভ্রমণে বেরিয়েছে, অবশ্য একা না, আশেপাশে অনেক লোকজন আছে । সন্ধ্যার পর নদীর চারপাশ খুব শান্ত হয়ে যায় । নদীর ধীরলয়ের ঢেউগুলো তখন যেন গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করে । অনেক অস্পষ্ট সেই গান কেউই বুঝতে পারে না, শুধু চোখ বন্ধ করে উপলব্ধি করতে পারে সেই গানের মাধুর্য ।

- অনেক সুন্দর না চারপাশটা ? আমি না কখনই রাতের বেলা এরকম নদীর পারে এসে দাড়াইনি । কখনও রাতের বেলা নৌকাতে উঠিনি । বিষয়গুলো আমার কাছে এখনও স্বপ্নের মত লাগছে । দেখেন দেখেন, ঐ যে দূরে ব্রীজের গা ঘেঁষে ভিড় করা আলোর মিছিলগুলো কেমন মায়াবী না ?

মিলান ছবির করা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না । নদীর দিকে তার মনোযোগটা কমই বরং ছবির দিকে তার মনোযোগটুকু বেশি । মেয়েটা কেমন জানি শিশুসুলভ আচরণ করছে সেই শেষ বিকেল থেকেই । এমন না যে তাকে জোর করে আনা হয়েছে কিংবা এমন কিছু বলা হয়েছে যার কারণে মন খারাপ করে মেয়েটা এখানে এসেছে কিন্তু সেই ঘণ্টা দুয়েক ধরেই মেয়েটা আনমনে বলেই চলেছে, ইশ, কত দেরী হয়ে যাচ্ছে । বাড়ির লোকজন চিন্তা করবে, আমার আসলেই এখানে আসাটা উচিৎ হয়নি । মিলান ছবির এই কথাগুলো প্রথম দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেও এখন আর শুনছে না । অনেকটা কথা পাশ কাটিয়ে দেবার মত । মিলানের মনে হলো, এখন একটা গান গাইলে কেমন হয় । সে নদীর দিকে তাকিয়েই হঠাৎ গুনগুন করে গান ধরলো । ছবি এতক্ষণ নদীর দিকেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল কিন্তু মিলানের গুনগুন করা গান শুনে চারপাশ ভুলে মিলানের দিকেই দৃষ্টি চলে গেলো ছবির ।

- কি গান গাচ্ছেন ? একটু জোরে গান । আমিও শুনি ।

- কি যে বলো না !! আমার মত বেসুরোদের কাছ থেকে আবার গান শোনার আবদার !! জোরে গাইলে আশেপাশের মানুষ নৌকা থেকে হয় নদীতে লাফ দেবে নয়তো ঘুরে সবাই মিলে গণপিটুনি অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে । তখন কেমন হবে, বলো তো ?

- ভালো হবে তো । অনেক মজা হবে ।

ছবির মুখে এই কথা শুনে মিলান কিঞ্চিৎ বিরক্তি প্রকাশ করে উল্টো দিকে তাকাতেই মিলানের মুখের দিকে তাকিয়ে ছবি ফিক করে হেসে দিলো । আবারও সেই হাসি !! আচ্ছা, মেয়েটা কি সত্যি মিলানকে পাগল করার ফন্দি এঁটেছে ? মিলান মনে হচ্ছে স্বপ্ন দেখছে । এই মেয়েটার সাথে পরিচয় হওয়ার পর সবকিছুই তো তার স্বপ্নের মতই লাগছে । মিলান নিজের গায়েই সামান্য চিমটি কেটে নিলো । উহু !! ব্যাথা করলো তো, তার মানে এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব । অনেক মধুর আর স্বপ্নিল বাস্তব ।

৩.

- আমার কাছে না সবকিছু কেমন স্বপ্নের মত লাগছে ।

- মানে ?

- এই যে হঠাৎ পরিচয় । এরপর শখের বশে দেখা করতে আসা । দেখা করতে এসেই যেন মোহে আটকে পড়া । তারপর থেকেই পরপর দেখা করা, তবু মনে অতৃপ্তি থেকে যাওয়া । এরপর বাসায় যাওয়া, সেখানেও পূর্বে যা হয়নি, সেরকম হওয়া, আপনার কথা স্মরণ করা । এসব কি আদৌ বাস্তব ?

ছবির কথাগুলো শুনে মিলান কিছুক্ষণ অবাক হয়ে ছবির দিকে তাকালো । তারপর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে তাকালো । মিলান ভাবছে, ছবির করা প্রশ্নের উত্তর কি সে মজা করে দেবে নাকি সিরিয়াস হয়ে । মজা করে দিলে উত্তরটা হতো এরকম যে,

- কি ছবি, something something নাকি ?

অনেকটা উত্তরের বদলে আরেকটি প্রশ্ন । আর নতুন করা প্রশ্নের উত্তরে ছবি কিছুই বলতো না, খালি একটুখানি ফিক করে হেসে দিতো । আর পরিবেশটাও বেশ হালকা হয়ে যেতো কিন্তু না, মিলান সিরিয়াস হয়েই উত্তর করলো,

- দেখো, ছবি । আমার ফিলিংসের ব্যাপারটা তোমাকে আগেই জানিয়েছি, তুমি জানতে আমাদের মধ্যে কিছু শুরু হলে সেটা কোন দিকে গড়াবে । বিষয়গুলো শুরুও কিন্তু তোমাকে জোর করে করা হয়নি । তুমি সবই জানতে । কিন্তু তুমি লুকোচুরি খেলতে চেয়েছিলে । অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই তুমি প্রশ্রয় দিয়েছিলে । আজ তুমিই যদি এই কথাগুলো বলো, তাহলে আমাদের মধ্যবর্তী অবস্থান কিন্তু আরও জটিলতর হবে, এটা কি তুমি জানো ?

মিলানের করা প্রশ্নের উত্তর কি ছবির কাছে আছে ? হয়তো আছে কিন্তু ছবি উত্তর দিতে চায় না । সে চায় মজাটুকু থাকুক, সম্পর্কের পরিণতি ভাবার সেই কাঙ্ক্ষিত সময়টুকু এখনও আসেনি । বিষয়গুলো কখনই জটিল করার ইচ্ছা ছবির ছিল না বরং মজা আর সহজতর করে সম্পর্কটা সাজাতে চেয়েছিল ছবি কিন্তু মিলানকে কিছুই বুঝতে দেইনি সে । তারা দুইজনে হাঁটছে, আনমনে, পাশাপাশি । খোলা রাস্তার কোলাহল, ধূলিযুক্ত অবস্থা, রাস্তার পাশের ব্যস্ততা কিছুই তাদের ছুঁতে পারছে না । মনে হচ্ছে, পৃথিবীতে এখন দুইটাই মাত্র মানুষ । মিলান আর ছবি । আর তাদের মধ্যে লুকিয়ে আছে অসংখ্য না বলা কথা-প্রশ্ন । যেগুলোর উত্তর মিলান আর ছবির কাছে আছে কিন্তু পৃথক পৃথক । এমন সম্পর্কই কি তারা চেয়েছিল ? যেই সম্পর্কে বিশ্বাসটুকু নেই, সেটা আবার কিসের সম্পর্ক !! এই কথাটা মিলানও জানে, ছবিও জানে কিন্তু তাদের জানার পথটুকু কোথায় গিয়ে মিলিত হয়েছে, সেটা তাদের কেউই জানে না ।

৪.

- তুমি একবার ভেবে নাও তবুও ।

হঠাৎ-ই ছবি এই কথাটি বললো মিলান কে । হ্যাঁ, তাদের সম্পর্ক এখন আগের চেয়ে একটু ঘনিষ্ঠ । সম্বোধনও "আপনি" থেকে "তুমি" হয়েছে । ছবির কথা ধরতে না পেরে, মিলান জিজ্ঞাসা করলো,

- কি নিয়ে ভাববো ?
- এই যে, আমরা যে স্পেশাল সময়গুলো কাটাচ্ছি, সেগুলো তোমার ক্ষণিকের ঝলক না তো ?
- মানে ?
- এই যে, আজকে তুমি আগ বাড়িয়ে এলে, ভালো লাগার কথা বললে । আমি তোমাকে এও বললাম যে আমার লাইফে অন্য একজন আছে । তবু তুমি কিছুই মানলে না । আমাকে নিয়ে যেন হারিয়ে গেলে একেবারে স্বপ্নের দুনিয়ায় । যেই দুনিয়ায় নিজেকে রাজা বানালে আর আমি না চাইতেও রানী হয়ে গেলাম ।

ছবির কথা থামার আগেই যেন মিলানের শরীরে একটু ঝটকা লেগে গেলো । কি বললো মেয়েটা ? নিজেকে কি স্বপ্নের দুনিয়ার রানী বললো মেয়েটা ? তাহলে কি অবশেষে... !! এতদিনের চাওয়া কি অবশেষে পূরণ হওয়ার পথে মিলানের ? ছবির মত ঘুরিয়ে কথা বলার ইচ্ছা নেই এখন মিলানের । সে এখন আসল কথাটাই শুনতে চায় ছবির মুখ থেকে । কিন্তু মেয়েরা কি মুখ ফুটে এই কথাগুলো আগ বাড়িয়ে বলে কখনও !! ছবি কি ব্যতিক্রম হবে ?

- তার মানে তুমি বলতে চাইছো...... !!
- দেখো, তোমার সাথে দেখা করার আগে, তোমার সাথে সময় কাটানোর আগে, তোমার কথাগুলো শুনার আর বুঝার আগে আমি কখনই সিরিয়াস ছিলাম না কোনকিছুতেই । আমার লাইফটা একটু এলোমেলো, অদ্ভুত । আমি এই লাইফ নিয়ে কখনই সিরিয়াস হয়ে কিছু ভাবিনি । বাড়ির ছোট মেয়ে হওয়ার সুবাদে কখনই একটা জিনিস একবারের চাইতে বেশি চাওয়া লাগিনি । আমার লাইফে কখনই দুঃখের কোন ছায়া পড়েনি । আমি ভালো করে কখনও চোখের পানি ফেলিনি । আজকে তোমার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো আমাকে অভয় দিচ্ছে, সাহস দিচ্ছে আর লাইফে সিরিয়াস হওয়ার তাড়না যোগাচ্ছে । কিন্তু ভয় হচ্ছে । এই আনন্দটুকু ফিকে হয়ে যাবে না তো ? আজকে যেভাবে তুমি আমাকে সময় দিচ্ছ, এটা কমে যাবে না তো ? সারাদিন আমাকে পাওয়ার তাড়না শেষ হয়ে যাওয়ার পর তোমার আগ্রহ কমে যাবে না তো ? ভাবো, তুমি, ভালো করে ভাবো ।

ছবির কথাগুলো শুনতে হয়তো একটু খারাপ লাগছে কিন্তু কথাগুলো অনেকটা বাস্তব । এতকিছু ভেবে হয়তো মিলান ছবিকে পছন্দ করেনি । জীবনে প্রথম কোন মেয়েকে দেখে ভালো লাগা, পিছনে লেগে থাকার তাড়না, মেয়েটির কথা বলার ধরন, আচরণের মোহে পড়ে সেই যে পিছনে লাগা, এতকিছুর পিছনে কোন কারণ কি ছিল ? মিলান জানে, না, ছিল না । কিন্তু আজকে মেয়েটা এতটা সিরিয়াস হওয়ার তাড়না দিচ্ছে । মেয়েটার কথাও তো ফেলার মত না । আসলেই কি পারবে সিরিয়াস হতে ? রিলেশনে যাওয়ার পর পুরো দায়িত্ব নিজের কাধে নিতে ? ভবিষ্যতের অনেক দূরের পথের চিন্তা করতে ? মিলান উপরে তাকালো । আপাত দৃষ্টিতে মিলান উপরে তাকিয়ে আছে বলে মনে হলেও তার দৃষ্টি শুন্যে, যাকে আবার অসহায় দৃষ্টিও বলা চলে ।

৫.

- চলো, কোথাও নিরিবিলি যেয়ে বসি ।

আজও মিলান আর ছবি ঘুরতে বেরিয়েছে । তাদের একসাথে দুইজনের ঘুরতে বেরুনো অনেকটা প্রাত্তাহিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে । যদিও এটা মিলানের এক প্রকার পাগলামির জন্যই ঘটছে কিন্তু ছবিরও ভালো লাগছে মিলানের এই পাগলামিগুলো, কেন জানি ।
মিলানের কোথাও বসতে চাওয়ার প্রস্তাবে ছবি রাজী হয় । তাদের প্রথম দেখা হওয়া পার্কটিতে সন্ধ্যার পর অনেক লোকজন যায়, আজকে তারা আবার গেলো । যেখানে যেয়ে এক জায়গায় ফাঁকা দেখে ছবি আর মিলান বসলো । জায়গাটা একটু অন্ধকার । আলো আধারি মুহূর্তগুলো ভালো লাগার ফিলিংসগুলো অনেকাংশেই বাড়িয়ে দেয় । হয়তো এই কারণেই সেখানে বসা । পাশেই ঘাস থেকে ছোট্ট একটা ফুল ছিঁড়ে ছবি মিলানের হাতে দিলো । মিলান ফুলটি নিয়ে কি করবে কিছুক্ষণ ভেবে হঠাৎ ফুলটিকে আংটির মত করে ছবির আঙ্গুলের ফাঁকে গুঁজে দিলো । সত্যিই, মনে হচ্ছে মেয়েটা একটা আংটি পড়ে আছে ।

- যাও, তোমার আর আমার এঙ্গেজমেন্ট হয়েই গেলো !!

মিলান এই কথা বলতেই দুইজনে মিলেই হেসে ফেললো । এরপ ঘাসের আরও কয়েকটা ফুল ছিঁড়ে ছবি এদিক ওদিক তাকিয়ে দড়ি খুঁজতে লাগলো । উদ্দেশ্য ফুলগুলোলে একজায়গায় বাঁধা । কিছুক্ষণ পর কিভাবে যেন দড়ি ম্যানেজ করে ফেললো ছবি আর বেঁধে ফেললো ফুলগুলো । এরপর যেই কাজটা করলো, তার জন্য মিলান প্রস্তুত ছিল না একেবারেই । ছবি মিলানকে ফুলগুলো দিলো । কিন্তু মিলান ফুলগুলো হাতে নিলো না ।

- উহু , হবে না । ফুলগুলো দিতে চাইলে, সাথে মুখে কিছু বলতে হবে ।
- ও মা, আমি আবার কি বলবো ?
- যা ইচ্ছা । বলতে পারো, এই ফুলগুলো শুধু তোমারই জন্য । অথবা এই বদমাইশ ছেলে, এই ফুলগুলো নাও । অথবা এই বজ্জাত ছেলে, ফুলগুলো হাতে নিয়ে ফেলে দাও ইত্যাদি ।

মিলানের কথা শুনে ছবি কি যেন একটা ভাবলো বেশ অনেকক্ষণ ধরে । এরপর প্রায় কিছু একটা বলতে গিয়ে হেসে দিলো । মিলান বুঝতে পারলো না এই হাসার পিছনে কারণটা কি । মিলানের দেওয়া শর্ত মানলো না ছবি, কিছু না বলেই ফুলগুলো মিলানের দিকে ছুঁড়ে মারলো ছবি ।

মিলান বুঝলো না কিন্তু ছবির অবস্থা এদিকে সঙ্গিন । তো সে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছিল, মিলানকে সে তার ভালোবাসার কথাটি আজই বলে ফেলবে । কিন্তু জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত অনেক ভেবেচিন্তে নিতে হয় । তাই তো ছবিও প্রথমে I LOVE YOU বলবে ভেবেও আর বললো না । ছুঁড়েই যেহেতু দিয়েছে, কি আর করার !! মিলান ফুলগুলো হাতে নিলো । হোক না, রাস্তার এক কোণার ঘাসের পাশে ধরেছে ফুলগুলো কিন্তু এই ফুলগুলো তো ছবি তাকে দিয়েছে, তাই এই ফুলগুলোর মূল্য এখন মিলানের কাছে অনেক বেশি । মিলান মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, এই ফুলগুলোকে রেখে দেবে নিজের কাছে, পারলে সারাজীবনের জন্য ।

৬.

হঠাৎ মোবাইল হাতে নিয়ে মিলান দেখতে পেলো ১২ টি মিস কল । এতগুলা মিসকল দেখেই সে অবাক হয়ে গেলো । কি দিতে পারে এতগুলা মিসকল !! হ্যাঁ, ছবি । তাই বলে ১২টি !! যে মেয়েটা নিজেই ফোন দিলে বেশিরভাগ সময় ধরতে চায় না, আজকে সে-ই কিনা নিজে ১২ বার কল !! মিলানের অবাক হওয়ার ব্যাপারটা ক্রমান্বয়ে বাড়তে লাগলো । মিলান মেলায় এসেছে, তার ক্যাম্পাসের বৈশাখী মেলায় । হ্যাঁ, আজকে পহেলা বৈশাখ, বাংলা বছরের প্রথম দিন । বাঙালি সংস্কৃতির অনেক আনন্দের দিন । বন্ধুদের আড্ডায় এতটাই ব্যস্ত ছিল মিলান যে ছবি যে তাকে এতবার করে কল দিচ্ছে সেটাই টের পায়নি সে । কিন্তু ছবির এতবার কল দেবারই বা উদ্দেশ্য কি !! জানার জন্য মিলান ছবিকে কল ব্যাক করলো । না, কল টা ধরলোই না মেয়েটা । কি ব্যাপার, আবার রাগ করলো না তো ? মিলান আরও ২-৩ বার ট্রাই করলো কিন্তু নাহ, কোনবারই ফোনটা ধরলো না মেয়েটা । মিলান কিছুটা চিন্তাগ্রস্থ হয়ে আবার আড্ডায় শরীক হয়ে গেলো ।

তারও প্রায় আধা ঘণ্টা পর মিলানের মোবাইল মেসেজ, ছবির মোবাইল থেকে । "তোমার ক্যাম্পাসের মেলায় এসেছিলাম কিন্তু মানুষজন তো অনেক ব্যস্ত । ঠিক আছে, আমি চললাম । পরে যেন কেউ না বলে, তার এত করে বলার পরও আমি আসিনি" । মেসেজটা পড়ার পরই মিলান ফিক করে হেসে ফেললো । তার মানে ছবি তার ক্যাম্পাসে ? মিলানের মনে হলো হঠাৎ আনন্দে সে একটা চিৎকার দেয় । কিন্তু নাহ, আশেপাশে অনেক মানুষ । চিৎকার দিলে তাকে পাগল ভাবার সম্ভাবনা অনেক । মিলান কিছুক্ষণ চিন্তা করে ছবিকে কল দিলো । অবশেষে মেয়েটা ফোনটা ধরলো ।

- কোথায় তুমি ?
- আমি চলে যাচ্ছি । তোমার ক্যাম্পাসে এসেছিলাম কিন্তু পরিচিত কাউকেই তো পেলাম না । ভালো লাগছে না । তাই চলে যাচ্ছি ।
- ইয়ার্কি করো নাকি তুমি ? এই মুহূর্তে কোথায় তাই একবার বলো ।
- কেন, বললে কি হবে ?
- কিছু না । এমনিতেই জিজ্ঞেস করছি, কোথায় তুমি ?
- এমনিতে জিজ্ঞেস করলে যদি আমি এমনিতে উত্তর না দেই ?
- দেখো, ছবি, প্লিজ বলো না, কোথায় তুমি ?
- তোমার ক্যাম্পাসের মেইন গেটে । কিন্তু তুমি এখন দৌড়ে আসলেও লাভ নেই । আমি এখনই চলে যাবো । খুঁজে পাবে না আমাকে ।

মিলান আর কিছু না বলে ফোনটা রেখেই দৌড় লাগালো তার ক্যাম্পাসের মেইন গেটের দিকে । বন্ধুদের আড্ডা, ক্যাম্পাসের এত জনসমাগম কিংবা এত এত উৎসব, অনুষ্ঠান কিছুই আর তাকে টানছে না । তার ভালোলাগার, ভালোবাসার মানুষটার এরকম সারপ্রাইজ তার মনোযোগ আকর্ষণ করে ফেলেছে পুরোটুকুই । আচ্ছা, মেয়েটা কি সত্যিই পাগল ? মিলান দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মেইন গেটের সামনে গিয়ে দেখলো, একটা মেয়ে দাড়িয়ে আছে শুধু তার জন্যই । হ্যাঁ, মেয়েটা ছবিই । মিলান দৌড় থেমে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো । ছবি কিছুক্ষণ কপট রাগ দেখিয়ে সেও মিলানের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো । হাজার হলেও উদযাপনগুলো প্রিয়জনদের সাথেই ভালো হয় । প্রিয়জন ছাড়া আবার কিসের উৎসব ? কিসের উদযাপন ?

৭.

হন্তদন্ত হয়েই হাসপাতালে ঢুকলো ছবি । আশেপাশের কাউকে ভ্রূক্ষেপ না করে একেবারে মিলানের বেডের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো । মিলান অবশ্য ছবির এমন আচরণ আশা করেনি । মিলানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ছবি বলতে লাগলো,

- কি হয়েছে তোমার ? কি ভাবে হলো ? দেখে সাইকেল চালাতে পারো না ? কি ভাবছিলে উল্টাপাল্টা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ? এখন তো হাতের উপর দিয়ে সামান্য প্যাড়া গেলো কিন্তু যদি বেশিকিছু হয়ে যেতো ? যদি প্রাণটাই যেতো ? কারও কথা ভাবতে চাও না, তাই না ? তোমার কিছু হলে আমার কি হতো ? এটা কি ভেবে দেখেছো ? নাকি এখানেও তোমার হেঁয়ালিপনা ?

প্রায় এক নিঃশ্বাসেই কথাগুলো বলে গেলো ছবি । মেয়েটা হাঁপাচ্ছে, ভালো পরিমাণেই । এক পলক ছবিকে দেখে মিলানেরই ভয় ধরে গেলো । ও মা, মেয়েটা আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে না তো !! কিন্তু মিলানের বিছানার পাশেই মিলানের মা আর মিলানের এক চাচা বসে ছিল, এই বিষয়টা ছবি একেবারেই খেয়াল করেনি এতক্ষণ । ওদিকে মিলানও সরাসরি বলতে পারছে না । মিলান ইচ্ছা করে কাশি দিয়ে ছবির মনোযোগ ঘুরানোর চেষ্ঠা করতেই ছবি আবারও বলে উঠলো,

- কি ব্যাপার, কাশিও বাঁধিয়েছ ? বাহ, আর কিছু ? আচ্ছা, কবে থেকে নিজের শরীরের প্রতি যত্নটা নেওয়া শুরু করবা, একবার বলো তো...

অবস্থা বেগতিক আর ছবির বেখেয়ালি মনোভাব বুঝতে পেরে মিলান এবার মায়ের দিকে তাকিয়ে মা কে বললো,

- মা, ও ছবি । আমার বান্ধবী । তুমি মনে হয় ওকে কোনদিন দেখোনি !!!

মিলানের মা একটা ছোট্ট করে মুচকি হেসে বললো,

- তোর বান্ধবীর মনে হয় তোকে নিয়ে চিন্তা অনেক । এক কাজ কর, আমি আর তোর চাচা একটু বাইরে যাচ্ছি, তোরা কথা বল ।
এতক্ষণ মিলানের মা যে মিলানের পাশে বসে ছিল, এটা এতপরে বুঝতে পেরে ছবি নিজের জিহ্বাতে কামড় দিলো । ইশ, কি লজ্জা !! মিলানের মায়ের সামনেই এতকিছু করা হয়ে গেছে অথচ মিলান তো ছবির ব্যাপারে তার মা কে কিছুই জানায়নি । ছবি মিলানের মা কে সালাম দিলো । ঘটনার আকস্মিকতায় মিলান অনেকটা নীরব হয়ে গেছে । ছবিও বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিৎ !! মিলানের মা অবশ্য সবই বুঝতে পেরেছে । ছেলের সাথে এই ব্যাপারে পরে কথা বলা যাবে, এই চিন্তা করে মিলানের চাচাকে নিয়ে হাসপাতালের রুমের বাইরে চলে গেলো মিলানের মা । মা চলে যেতেই ছবি আর মিলান দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো । তাহলে এতদিনে, বাসায় জানানোর সময় চলে এসেছে !! ওদিকে মিলান আবার ভাবতে লাগলো মা সবকিছু ভালোভাবে নেবে তো !!

৮.

- একটা গান গাও না ?
- আবার ?
- আবার !! মানে ?
- তুমি কি চাও আশেপাশের মানুষগুলো সব দৌড়ে পালাক ?
- পালালে তো ভালোই হবে । তুমি আর আমি একাকী কিছু সময় পেয়ে যাবো । একে অন্যের সাথে গল্প করবো, হাসবো, খুনসুটি করবো - আরও কত কি ।
- তাহলে এর জন্য আমার গান গাবার দরকার কি ? এর থেকে নিরিবিলি কোথাও গেলেই তো হয় ।
- না, এমনিতে আমার খুব গান শুনতে ইচ্ছে করছে । তোমার কাছ থেকে, তুমিই গাইবে ।

ছবির আবদারগুলো ছেলেমানুষি টাইপের । মিলান যতই না করবে, মেয়েটার ছেলেমানুষি আবদার ধীরে ধীরে কপট রাগে পরিণত হবে, সেই রাগ ভাঙ্গাতে ভাঙ্গাতে আবার অতিরিক্ত পনেরো-বিশ মিনিট তো লাগবেই । এর থেকে গান গেয়ে ফেলাটাই ভালো । মিলান চোখ বন্ধ করে গান ধরলো, "মিলন হবে কত দিনে ? আমার মনের মানুষেরই সনে" । বেশ খানিকক্ষণ গাওয়ার পর মিলান থেমে গেলো, চোখ খুলেই ছবির দিকে তাকালো । মেয়েটা এতক্ষণ খুব মজা করেই গানটি শুনছিল । আচ্ছা মেয়েটা কি বুঝছে মিলন কার সাথে হওয়ার জন্য মিলান এই গানটা ধরেছে ? হয়তো বুঝেছে, হয়তো না । হঠাৎ ভাবতেই ভাবতেই মিলান হেসে দিলো । হঠাৎ মিলানের হাসি দেখে ছবি অবাক হয়ে গেলো ।

- ও মা, পাগলের মত হঠাৎ হেসে দিলা কেন ?
- না, ভাবছি, মায়ের কথাটা ।
- ওহ, তাই তো । আমি তো ভুলেই গেছিলাম । তোমার মা শেষমেশ কি বললেন ?
- সে তো এক লম্বা ইতিহাস । তাও সংক্ষেপে বলি শোনো, হাসপাতাল থেকে রিলিজ পাওয়ার পর প্রথম যেদিন বাসায় পৌঁছালাম সেদিন দেখি মা আশেপাশে বেশ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন । আমি বুঝতে না পেরে মা কে জিজ্ঞেস করলাম, "কি খুঁজো ?" মা বললেন, "একাই এসেছো ? বান্ধবী আসেনি সাথে ?" মা এই কথা বলার পরপর আমার বেশ হাসি পেয়ে গেলো । মা-ছেলে দুইজনই বেশ প্রাণখুলে হাসলাম ।
- এরপর ?
- এরপর আর কি !! মা কে বলে দিলাম পুরোটা ।
- ও মা, পুরোটা মানে ? কি বলেছো তুমি অ্যান্টিকে ?
- তুমি কি মনে করেছো, আমি ভয় পাই ?
- এ্যা, এসেছে আমার বীরপুরুষ !! তা তোমার আব্বুর কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি খবরটা এখনও ?
- ওরে বাবা !! আব্বু জানলে তো একটু প্রব্লেম হবেই । বেকার ছেলের আবার প্রেম !! বাড়ি থেকে কান ধরেই তাড়িয়ে দেবে ।

এই কথা শোনা মাত্রই ছবি খিল খিল করে হেসে উঠলো । একনাগাড়ে হাসতেই লাগলো । কি হাসি মেয়েটার !! মিলান ছবির হাসির দিকে তাকিয়ে আছে । কি অপূর্ব ভাবে হাসে মেয়েটা !! আব্বু তাড়িয়ে দেওয়ার ভাবনাটা হয়তো এখনও মিলানের মনে আসেনি কিন্তু ছবিকে ছাড়া থাকার ভাবনাটা এসেছে । কি ভয়ংকর সে ভাবনা !! মিলান শিউরে উঠে আবারও । কি মধুর সময়গুলো কাটছে এখন !! স্বপ্ন নয়তো এগুলো ? যে স্বপ্ন ভাংলে হয়তো জীবনটাই তছনছ হয়ে যাবে । নাহ, মিলান চাই-ও না যে এই স্বপ্নটা ভেঙে যাক ।

৯.

মিলান সকাল ধরেই বেশ টেনশনে আছে । এতবার করে ফোন দিলেও ছবি ফোন ধরছে না । গত বেশ কয়েকদিন ধরে সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছবিকে ফোন দিয়ে কথা বলার মাধ্যমে দিনের শুরু হয় মিলানের । প্রথম প্রথম ছবিই মিলানকে বলেছিল, "এমন ছেলেমানুষি কেন করছো ?" মিলান উত্তরে কিছুই বলেনি, শুধু হেসেছিল । মেয়েটা কখনও কি বুঝবে তার এই ছোট ছোট ছেলেমানুষিগুলোই মিলানকে অত্যন্ত আনন্দ দেয় । কিন্তু আজকে ছবি মোটেও ফোনটা ধরছে না । সম্ভবত রাগ করেছে, মনে হচ্ছে কঠিন রাগ ।

ঘটনার সূত্রপাত আসলে গতকাল রাত থেকেই । গতকাল দুপুর থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত ছবিকে অনলাইনে আসতে না দেখে মিলানের রাগ হয় । অনেক আশা করে ফেসবুকে বসে থাকা ছেলেটা সেই রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আরেকটি ছেলেমানুষি সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে যে আজকে আর সারারাতই ছবির সাথে কথা বলবো না, এমনকি ছবি বলতে চাইলেও না । ওদিকে সন্ধ্যার কিছুপর ছবি যখন অনলাইনে আসে তখন মিলান কিছু এলোমেলো কথা বলে ফেসবুক থেকে বেরিয়ে যায় । মিলানের এরকম আকস্মিক আচরণ ছবিকে অত্যন্ত বিস্মিত করে কিন্তু কারও কাছ থেকে অবহেলাটুকু এই মেয়ে যে কোনভাবেই সহ্য করতে পারে না । অনেকবার নক করার পরও যখন মিলান ফিরতি রিপ্লাই দেয় না, তখন থেকেই রাগের সূত্রপাত হয় । পরবর্তীতে প্রায় ঘণ্টা খানেক পর মিলান অবশ্য ফেসবুকে এসে ছবিকে সরি বলে কিন্তু এই সরিটুকু মন গলাতে পারে না ছবির । তাহলে এখন মিলানের কাছে উপায় ?

ছবি মেয়েটার সবকিছুই ভালো । সুন্দর করে কথা বলে, হাসে, খুনসুটি করে, দুষ্টুমি করে কিন্তু যত্তঅসব গণ্ডগোল তার এই রাগেই । রাগ হলে সে একেবারেই আলাদা মানুষ । ছবির রাগ হলে পৃথিবীর কোন মানুষকেই তার তখন ভালো লাগে না । এই মুহূর্তে যেমন মিলানকে ভালো লাগছে না । কিন্তু মিলান তো তার ভুল বুঝতে পেরেছে, ফেসবুকে যেয়েও অসংখ্যবার সরিও বলেছে । তবু মেয়েটার রাগ ভাংছে না কেন ?

সকাল থেকে দুপুর আবার দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো । এই সময়ের মধ্যে মিলান কমপক্ষে ১০০ বারের চেয়ে বেশিবার ফোন দিয়ে ফেলেছে ছবি মেয়েটাকে কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই ফোন ধরছে না । ছবির এমন রাগটুকু মিলানের দুনিয়াটাকেই যেন উল্টে দিয়েছে । মিলানের কাছে সবকিছুই অস্থির লাগছে, কোন স্বাভাবিক কাজেও তার মনোযোগটুকু আসছে না । ছবির রাগ কি আদৌ ভাঙবে ? না ভাংলে তো মিলান নিজে থেকেই ভেঙে যাবে । আচ্ছা, মেয়েটা এমন অবুঝ কেন ? এত দুশ্চিন্তার পরও মিলানের হঠাৎ হাসি পেয়ে গেলো । একটি অবুঝ মেয়ের জন্য সে কিনা নিজের জীবনটাকেই অনেকাংশে বদলে ফেলেছে আর সেই মেয়েটিই কিনা রাগের মাথায় তাকে ভুলে গেছে !! মিলানের তো হাসি আসবেই, অন্য কিছু করার কি আদৌ জো আছে ?!!

১০.

- এই ছবি !! ছবি, কি ব্যাপার, শুনতে পাচ্ছ না ?

মিলানের পিছন দিক থেকে বারবার ডাকার পরও ছবি শুনতে না পেয়ে হাঁটতে লাগলো । ঝুম বৃষ্টি পড়ছে । ছবির হাতে ছাতা । বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য মিলান একটি দোকানের সামনে আশ্রয় নিয়েছিল, অবশ্য সে ছবির জন্যই অপেক্ষা করছিল । ছবি সামনে দিয়ে চলে গেলো, এমনকি মিলান এতবার করে ডাকলো কিন্তু মেয়েটার কানেই ঢুকলো না । আজব তো !! অগত্যা মিলান বৃষ্টিতে ভিজেই ছবির পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো । অবশ্য মাত্র কয়েক সেকেন্ড জোরে হেঁটেই মিলান ছবিকে ধরে ফেললো ।

- কি ব্যাপার, শুনতে পাচ্ছ না ? সেই কতবার করে ডাকলাম ? নাকি আমাকে এই বৃষ্টিতে ভেজাতে চাচ্ছ ?

মিলানের ডাক সত্যিই সত্যিই শুনতে পায়নি ছবি । মিলানকে দেখে ছবি বেশ অবাক হলো কিন্তু একম একটা ভান করলো যেন তার তাড়াহুড়া অনেক । ছবির মাথার উপর ছাতা কিন্তু মিলান প্রায় ভিজে গেছে অনেকটা । মিলানের অনুরোধেই তারা দুইজনে আরেকটি বিল্ডিং এর সামনে আশ্রয় নিলো ।

- কি ব্যাপার, তুমি এখানে কেন ?
- কেন, মানে !! তোমার জন্য ।
- সে না হয় বুঝলাম । কিন্তু এরকম পাগলের মত বৃষ্টিতে ভিজছো কেন ? ঠাণ্ডা লেগে যায় যদি ?
- গেলে যাবে । হয়তো কেউ একজনকে পেয়েও যেতে পারি সেবা করার জন্য !!
- (মিলানের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ছবি হাসতে হাসতেই বললো) ইশ !! বয়েই গেছে সেই একজনের ।

ছবি এই কথা বলতেই মিলান আর ছবি একসাথেই হেসে উঠলো । মিলানের ইচ্ছা করছে এই ঝুম বৃষ্টিতে ছবির হাতের ছাতাটা ফেলে দিয়ে ছবিকে হাত ধরে টেনে এনে একসাথে বৃষ্টিতে ভিজতে কিন্তু হঠাৎ কি মনে হওয়ায় মিলান নিজের ইচ্ছাটুকুকে দমন করলো । কিন্তু একটু পর ছবিই প্রস্তাব দিয়ে বসলো,

- ভিজবা ?

মিলানের মনের কথাটিই যেন বেরিয়ে এলো ছবির মুখ থেকে । মিলানকে আর ঢেকায় কে !! অমনি বিল্ডিং এর সামনের থেকে বেরিয়ে এসে খোলা রাস্তায় এসে হাঁটা শুরু করলো সে । একটু পর ছবিও । ভালোই বৃষ্টি, তাই রাস্তায় লোকজন নেই বললেও চলে । যারা আছে তারাও আশেপাশে কোথাও আশ্রয় নিয়েছে বৃষ্টি থেকে না ভেজার জন্য । এই খালি রাস্তায় দুইটি ছেলে-মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে একসাথে । দেখার মত একটি দৃশ্য বটে !! মিলানের খুব ইচ্ছে করছে ছবির হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে কিন্তু এবারও সে ইচ্ছাটুকুকে দমন করলো । ছবি মেয়েটাকে কেমন জানি অনেক সময়ই অচেনা লাগে মিলানের কাছে । হঠাৎ করেই কেন জানি মনে হয়, এই মেয়েটাকে সে মোটেও চেনে না । অথচ এমনটা তো মোটেও হওয়ার কথা ছিল না ।

১১.

- চলো, যাবা ?
- হুম, যাবো কিন্তু কোথায় ?
- হারিয়ে যাবো তোমাকে নিয়ে ।

মিলানের পাগলামিমূলক কথা শুনে ছবি হেসে দেয় । আজকালকার যুগে কেউ আবার হারায় নাকি !! মোবাইল-ফেসবুক তদপুরি ইন্টারনেটের জগতে কেউ চাইলেও হারাতে পারে না । ছবি এটা জানে, মিলানও । মিলানের এই কথাটির অর্থ আসলে আক্ষরিক অর্থে হারিয়ে যাওয়া নয় বরং ছবিকে নিয়ে দুনিয়ার সবকিছু থেকেই আলাদা হয়ে যাওয়া । নিজেদের মত করে একাকী সময় কাটানো । ছবি মিলানের এই ব্যাপারটি ভালোই বুঝে ।

- হুম, যাবো ।
- সত্যিই যাবা ?
- অবশ্যই । তুমি নিয়ে যেতে পারলে আমার আপত্তি কোথায় ?
- বাড়ি ফেরার তাগাদা থাকবে না তো তোমার ? ভালো করে ভেবে নাও কিন্তু ।
- উহু, না, থাকবে না । চলো যাই ।

ছবিকে অবাক করে দিয়ে মিলান ছবিকে স্টেশনে নিয়ে যায় । ওহ, তাহলে কি সত্যি সত্যিই ? তারা দুইজন স্টেশনে পৌঁছাবার সাথে সাথেই একটি ট্রেন হুইসেল দিতে থাকে, এখনই ছেড়ে দেবে । মিলান আর ছবি দুইজনই ট্রেনে চড়ে বসলো । ছবির কাছে গন্তব্য এখনও অজানা কিন্তু সে মজাটুকু রাখতে চাইছে তাই মিলানকে কিছুই জিজ্ঞেস করলো না সে । একটু পর সত্যিই ট্রেন ছেড়ে দিলো । মিলানকে দেখে মনে হচ্ছে অনেক খুশি সে । একটু পর পর ছবির দিকে তাকিয়ে হাসি দিচ্ছে সে, আর এতেই তার খুশিটুকু বুঝা যাচ্ছে । ট্রেনের ভিতর অনেক গল্প করলো তারা ।

প্রায় ঘণ্টা দুই পর ট্রেন একটি স্টেশনে এসে দাড়াতেই মিলান ছবির হাত ধরে ট্রেন থেকে নেমে গেলো । ছবি এখনও জানে না তাদের গন্তব্য আসলে কোথায় । স্টেশনে নেমেই একটি রিকশা ডাকলো মিলান । তাতে চড়ে বসলো দুইজনই । ছবিকে অবাক করে দিয়ে প্রায় পনেরো মিনিট পরই মিলানদের বাসাতে পৌঁছে গেলো তারা । ছবি এবার সত্যি অবাক । এমন কিছু যে হবে, ছবি কখনই ভাবেনি । মিলানদের বাসাতে কোন পরিচয়ে যাবে সে ? যদিও মিলানের মা তাকে একবার দেখেছে কিন্তু এবার দেখলে তিনি কি বলবেন ? বুঝে তো আগেই গেছেন কিন্তু তবুও ।

- কি ব্যাপার, আসো ।
- (মিলানের কোথায় ভাবনায় ছেদ পড়লো ছবির) বাসায় নিয়ে এলে কেন ?
- ও মা, হারিয়ে যাবো না ? তার আগে একটু বাড়ির লোকগুলোকে দেখে যাই ।
- (মিলানের রসাত্মক কথাতে ছবির একটুও হাসি এলো না) আচ্ছা, চলো ।

মিলান নিজেও বিশ্বাস করতে পারছে না ছবি সত্যি সত্যি তাদের বাড়িতে চলে এসেছে । বাসায় কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুললো মিলানের ছোট বোন, মীরা । ওহ, ভাইয়া !! কিন্তু ভাইয়ার সাথে একটি মেয়েকে দেখেই চোখ ছোট করে ফেললো মীরা । দরজাতে দাড়িয়েই মীরাকে হাজারটা প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে মিলান ছবিকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলো আর সোজা নিজের ঘরটাতে নিয়ে গিয়ে বসালো ।

১২.

- এবার ?
- এবার কি ?
- নিয়ে এলে তো বাড়িতে । এখন কি করার ইচ্ছা ?
- হু হা হা হা, তোমাকে একা পেয়েছি, এবার কে বাচাবে তোমাকে ?

মিলানের এই কথাটিতে ছবি বেশ মজা পেলো । ওদিকে মীরা যে দরজার পাশে দাড়িয়ে আড়াল থেকে তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে, সেটা এতক্ষণ মিলান কিংবা ছবির কেউই খেয়াল করেনি । তবে একটু পরই পায়ের আওয়াজ শুনেই মিলান বুঝতে পারলো দরজার ঠিক পাশেই মীরা দাড়িয়ে আছে । মিলান মীরাকে ডাক দিলো ।

- মীরা, এই মীরা, শোন তো ।
- (মিলানের ডাক শুনে মীরা ঘরে ঢুকলো আর এমন ভান করলো সে নিজের ঘর থেকেই এসেছে) হ্যাঁ, বলো ।
- আম্মু কই রে ? আর লীরা আর তনু কোথায় ?

মিলানরা মোট চার ভাইবোন । সিরিয়ালি বলতে গেলে মিলান, মীরা, লীরা আর তনু । মিলান তিন বোনের একমাত্র ভাই, আবার ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড় ।

- আম্মু বাজারে, লীরাকে নিয়ে গেছে আর তনু স্কুলে ।
- তোর কলেজ নেই ?
- হুম, আছে কিন্তু আজকে যাইনি ।

মিলান আর জিজ্ঞেস করলো না কেন কলেজে যায়নি সে । ছবির ব্যাপারটি জিজ্ঞেস করার সাহসই পেলো না মীরা কিন্তু ভাইয়া হঠাৎ করে একটি মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে আসবে এইটা নিঃসন্দেহে মীরা আশা করেনি । মিলানের কথা শেষ হতেই মীরা নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো । ভাইবোনের কথোপকথনের মধ্যে এতক্ষণ ছবি কিছুই বলেনি । কিন্তু মীরা চলে যেতেই বলে উঠলো,

- আচ্ছা, সত্যি তুমি কি করতে চাও ? বলো তো ।
- কিছু না । অনেকদিন থেকেই ইচ্ছে ছিল তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে আসবো । হাজার হলেও একদিন তো সারাজীবনের জন্য তোমাকে এখানেই আসতে হবে, তাই না ?
- (মিলানের কথা শুনে ছবি ঢং করে উত্তর দিলো) এ্যা, শখ কত !! তুমি বললে আর হয়ে গেলো ?
- কেন, আমি ছাড়া অন্য কাউকে বলতে হবে নাকি ?

মিলানের প্রশ্ন শেষেই মিলান আর ছবি দুইজনেই হেসে দিলো । একটু পর কলিংবেলের আওয়াজ । সম্ভবত মিলানের মা এসেছে বাইরে থেকে । মীরা দরজা খুলতেই মিসেস রহমান বাড়ির ভিতরে ঢুকলেন । এমনিতেই বাইরে প্রচণ্ড গরম, এরপর আবার বাজার, একেবারেই ঘেমে চপচপ ভদ্রমহিলা । ঘরে পা দিতেই মীরা খুব আস্তে মিসেস রহমানকে জানালো, মা, ভাইয়া এসেছে আর সাথে একজন বান্ধবীও নিয়ে এসেছে । মীরার মুখ থেকে এই কথা শোনামাত্রই মিসেস রহমানের আর বুঝতে বাকী থাকলো না আসলে বাড়িতে কে এসেছে ।

মায়ের গলা শুনে মিলান ঘর থেকে বেরিয়ে এলো । মিলানকে দেখে মিসেস রহমান শুকনো একটি হাসি দিয়ে বাজার নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন । মায়ের কাছ থেকে এই শুকনো হাসিখানা প্রত্যাশা ছিল না মিলানের । প্রচণ্ড ঝড়ের আগে প্রকৃতি যেমন সুন্দর হয়ে যায়, মিলানের কাছে তার মায়ের হাসিখানা ঠিক তেমনই লাগলো । তবে কি......!! না, ছবি আর তার নিজের ব্যাপারে কোনোরকম নেগেটিভ চিন্তাভাবনা করা ছেড়ে দিয়েছে মিলান । যা হবে, ভালোর জন্যই হবে, ইনশাআল্লাহ্‌ ।

১৩.

মীরা আবার দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । মিলান বুঝতে পেরে এবার মীরাকে ভিতর আসতে বললো অবশ্য ছবির কথায় । মীরা ভিতর আসতেই ছবি মীরার হাত ধরে ছবির পাশে খাটে বসালো । মীরার সাথে সাথে লীরাও দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । মিলান না ডাকাতে সে ভিতরে আসেনি । ছবি আর মীরাকে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে মিলান রান্নাঘরের দিকে গেলো, তার মা কি করে দেখতে ।

বেশ বেলা হয়ে গেছে । মিসেস রহমান এখনও রান্না বসান নি । বাসায় তাকে সাহায্য করার মত কোন কাজের লোকও নেই, মিলানের বোনগুলোও বেশ আলসে ধরনের । তাই বাসার সকল ঝামেলা একা মিসেস রহমানের ঘাড়ে এসেই পড়ে । মিলান রান্নাঘরের দিকে এসেই দেখলো মিসেস রহমান তরকারী কাটাকুটি করছেন । মিলানকে দেখেই মিসেস রহমান থেমে গেলেন আর মিলানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

- কিছু বলবি ?
- মা, তুমি কি রাগ করেছো ?
- রাগ !! কেন ?
- এই যে বান্ধবীকে নিয়ে এসেছি বলে !!
- তোর বান্ধবী । তুই তো নিয়ে আসতেই পারিস ।
- (মায়ের কথাটুকু কেমন জানি মিলানের কাছে অবিশ্বাসের মত ঠেকছে । তাই মায়ের চোখের দিকেই তাকিয়ে এবার মিলান জিজ্ঞেস করলো) মা তুমি সত্যি বলছো তো ?
- (মিলানের এভাবে সরাসরি চোখের তার চোখের দিকে তাকানোটা আশা করেননি মিসেস রহমান কিন্তু কি মনে করে তিনি চোখটা নামিয়ে নিলেন) হ্যাঁ, সত্যি রাগ করিনি । তুই যা, দেখ, তোর বান্ধবীর কিছু লাগবে কি না ? এই বেলায় নিয়ে এসেছিস, তার উপর আজকে আবার রান্না বসাতে দেরী হয়ে গেছে । সব ঝামেলা তো একা আমার উপরই ।

এই যা !! মায়ের অভিযোগের বাক্স বুঝি খুলে গেলো । এখন একের পর এক অভিযোগ আর তার উপর কি পরিমাণ কষ্ট গেছে, সেই দুঃখগাথা শুরু হয়ে যাবে । আর কেউ মনোযোগ দিয়ে শুনলে তো কথাই নেই । মিলান তাই মায়ের চোখের সামনে থেকে সরে গেলো । মিলান সামনে থাকলে অভিযোগের সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাবে ।

ঘরে ঢুকতেই মিলান দেখলো ছবি মীরা আর লীরা দুইজনকে ডেকেই গল্প করছে । গল্প না বলে একসাথে হাসাহাসি করছে বলে ভালো হবে । বাহ !! মেয়েটা প্রথম আশাতেই বাড়ির লোকগুলোর মন জয়ের চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছে । ভালোই । তাদেরকে গল্প করার সুযোগ করে দিয়ে মিলান অন্য ঘরে চলে গেলো ।

এতটুকু দেখার পর ছবির ঘুম ভেঙে গেলো । তার মানে কি সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল ??!! মিলানের বাড়িতে যাওয়া, মিলানের বোনদের সাথে এমন খুনসুটি, সব কি স্বপ্ন ছিল ? ওহ, তাই তো । কিন্তু কি মধুর ছিল স্বপ্নটা !! গভীর রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর ছবির অত্যন্ত হাসি পেলো কেন জানি । সে প্রায় জোরে জোরে হাসতেই, পাশ থেকে তার কাজিন ছোটবোন, ছিনথিয়া হঠাৎ ঘুম ভেঙে ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো,

- কি হয়েছে আপু ? কোন সমস্যা ?
- নাহ, কিছু না তুই ঘুমা ।

এই কথা বলতেই ছিনথিয়া ঘুমিয়ে পড়লো । আর ওদিকে ছবি ভাবছে, সকালে অবশ্যই এই স্বপ্নের কথা মিলানকে জানাতে হবে । নিশ্চয় সেও অনেক মজা পাবে স্বপ্নের পুরোটুকু শুনে ।

১৪.

- ভাবছি মা কে বলবো ।
- কি বলবা ?
- সব কিছুই ।
- মানে ?
- এই যে তোমার সাথে পরিচয়, এরপর দেখা করা, ধীরে ধীরে ভালো লাগা, একসাথে ঘুরাঘুরি, এরপর ভালোলাগাটা আরও গাঢ় হওয়া সবকিছুই ।
- কিন্তু... !!
- কিন্তু কি ?
- এখনও একমাসও হলো না । এত দ্রুত কেন ?
- দেখো, আমি জীবনে যাই করেছি মা কে জানিয়েছি । মা আমার জীবনে অনেকটা বন্ধুর মত । আমার সব সিদ্ধান্তে সে সবসময় আমাকে শক্তি যুগিয়েছে, সাহস যুগিয়েছে । এখন জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাকে না জানিয়ে কিভাবে... !!
- আচ্ছা, সে না হয় বুঝলাম কিন্তু তোমার মা যদি না করে দেয় !!
- তাহলে কি বলবো না ?
- তোমার ইচ্ছা থাকলে অবশ্যই বলতে পারো কিন্তু দেইখো, তোমার মায়ের উত্তর যদি না-ও হয়, তবুও তুমি কিন্তু একটু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিও । তুমিই তো বললে এটা তোমার জীবনের একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ।

মিলানের কথায় ছবি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লো । তাই তো !! তার মা তো না করে দিতেই পারে, তখন এই সম্পর্কের পরিণতি কি হবে ? তার কি আসলেই মা কে বলা উচিৎ নাকি উচিৎ না, এই মুহূর্তে তার মাথায় আসছে না । তবে একটা কথাই বারবার মাথায় আসছে মায়ের কাছ থেকে আজ পর্যন্ত কিছুই লুকাইনি ছবি ।

এই ব্যাপারে তাদের মধ্যে আর কোন কথাই হলো না । আসলে মিলান চায় না ছবির কোন কাজে বাঁধা দিতে । এই মেয়েটা ভীষণ পরিমাণে স্বাধীনচেতা । ছোট বেলা থেকেই বাড়ির ছোট মেয়ে হিসেবে সবার কাছে ভীষণ পরিমাণে উৎসাহ পেয়েছে যে কোন কাজেই এখন ব্যাপারটা এমন যে কোনোরকম বাঁধা আসলেই সে নিজের স্বাধীনতার জন্য হুমকি মনে করে আর হুমকি হয়ে তো কখনই কাউকে সম্পর্কে বেঁধে রাখা যায় না, এইটা মিলান ভালো করেই জানে ।

ঠিক দুইদিন পর ছবি মায়ের সাথে গল্প করে বসলো । ছবি অত্যন্ত খুশি কারণ তার মা আসলেই তার বান্ধবী । মায়ের কাছে কোনকিছুই আজ পর্যন্ত তাকে লুকাতে হয়নি । আজও লুকাবে না । মিলান হয়তো একটু সাহস যুগিয়েছে কিন্তু আসল আগ্রহ এই ছবিরই । ছবির চোখেমুখে আনন্দ দেখে ছবির মা বুঝে গেলেন মেয়ে তাকে কিছু বলতে চায় । মা মেয়ের পরবর্তী আলোচনাগুলো ছিল ছবির একান্ত আগ্রহের সহিত উপস্থাপন আর তার মায়ের মনোযোগ দিয়ে শুনে যাওয়া । কিন্তু ফলাফল সেটাই হলো যেটা ছবি আশাই করেনি ।

সবকিছু শুনে মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক মেনে নিতে পারলেন না ছবির মা । সরাসরি না করে দিলেন । আসলে আমাদের দেশে বিয়ের আগে প্রেমের সম্পর্কগুলো নিয়ে অনেক ভয়ে থাকেন বাবা-মায়েরা, তা ছেলে যতই যোগ্য কিংবা ভালো পরিবার থেকে আসুক না কেন । মায়ের উত্তর না হতেই সব খুশি উবে যায় ছবির । ছবি তো এটা ভাবেইনি যে মায়ের উত্তর না হতে পারে, তাহলে এখন উপায় ?

মিলানকে ভুলতে হবে এটা ছবি স্বপ্নেও ভাবেনি । মিলানকে মায়ের উত্তর শুনালে তার কি অবস্থা হতে পারে, সেটা ছবি অনুমান করতে পারছে । কিন্তু এমন করুণ পরিণতি দিয়েই কি আসলে তাদের সম্পর্ক শেষ হবে ? হয়তো হবে, হয়তো না । ছবি এই মুহূর্তে সেটা জানে না । ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছবি ।

১৫.

- আমার না পা ব্যাথা করছে !!
- কি !! এখনই ? মাত্রই তো হাঁটা শুরু করলাম ।
- মাত্র !! (ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে) সেই সন্ধ্যার পর পর হাঁটা শুরু করেছি আর এখন ঘড়িতে প্রায় সাতে আটটা । তার মানে প্রায় ২ ঘণ্টারও বেশি হেঁটে ফেলেছি ।

ছবির কথা শুনে মিলান একটু অবাক হলো । আচ্ছা, মেয়েটা ঘড়ি দেখে কেন ? সময়ের হিসাব রাখে কেন ? তার সাথে থাকলে মিলান যেমন তার সব কাজ-কাম ভুলে যায়, এই মেয়েটা তেমন ভুলে না কেন !!

- আচ্ছা, বলো তো, তোমার কি কষ্ট হয় ? ইচ্ছা করে না ? নাকি আমিই জোর করি তোমাকে ?

মিলানের কথা শুনে ছবি একটু অবাক হলো । হঠাৎ এরকম প্রশ্নের তীর ধেয়ে আসতে পারে, ভাবেনি ছবি ।

- তোমার কি মনে হয় ?
- আমার কি মনে হবে !!
- না, বলো, তোমার কি মনে হয় যে আমার অনেক কষ্ট হয় ? তুমি জোর করে হাঁটাও আর আমিও হাঁটতে থাকি ? এতদিনে তোমার এই মনে হলো ?

ছবির কথাগুলো কেমন জানি ঠিক প্রশ্ন না, অভিযোগ মনে হলো মিলানের কাছে । অভিযোগগুলো শুনে ফিক করে হেসে দিলো মিলান । আরেকটি উদ্দেশ্য অবশ্য ছবি যাতে রাগ না করে, সেটাও । মিলানের হাসি দেখে ছবির মনটাও হালকা হয় ।

- আচ্ছা, তাহলে কি কোথাও বসবো ?
- (কিছুক্ষণ চুপ থেকে) উহু, না, হাঁটতে থাকি ।
- কিন্তু তুমি যে বললে তোমার নাকি পায়ে ব্যাথা করছে !!
- ও কিছু না, সমস্যা নেই, হাঁটো ।

ছবির কথা শুনে মিলান বুঝে গেলো তার কথাতে ছবি রাগ করেনি ঠিকই কিন্তু একটু কষ্ট পেয়েছে । মেয়েটা কেমন যেন !! অনেকটা বাচ্চাদের মত । অল্পতেই রাগ করে, অল্পতেই কষ্ট পায়, অল্পতেই খুশি হয় আবার অল্পতেই যেন হারিয়ে যায় । মিলান জানে এই মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে সে নিজেও শান্তি পায় না । ছবি হাঁটতে বললেও মিলান হঠাৎ দাড়িয়ে গেলো । মিলান আর ছবি এতক্ষণ একসাথেই হাঁটছিল । মিলান হঠাৎ দাড়িয়ে যাওয়ার কারণে ছবি কিছুদূর সামনে চলে যায়, এরপর সেও দাড়িয়ে যায় । ছবি আশা করেনি মিলান এভাবে হঠাৎ দাড়িয়ে যেতে পারে !! পিছন ঘুরে তাই অবাক দৃষ্টিতেই ছবি মিলানকে জিজ্ঞেস করলো,

- কি ব্যাপার ? হঠাৎ দাড়িয়ে গেলা কেন ?
- ছবি, সরি । আমি আসলে তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ঐ কথাগুলো বলিনি । বিশ্বাস করো ।

মিলানের এই কথাতে এবার ছবি হেসে দেয় । এরপর পিছনে কিছুটা হেঁটে এসে মিলানের হাত ধরে মিলানকে অনেকটা জোর করে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে ছবি বুঝিয়ে দেয়, হাঁটতে থাকো । ও ব্যাপার না । এমনটা তো হয়ই । মিলান ঠিকই হাঁটা শুরু করলো তবে এবার ছবির হাত ধরে ।

এই দুইটা ছেলে-মেয়ের জীবনটা কেমন একটা সম্পর্কে এসে যেন দাঁড়িয়েছে !! রাগ-দুঃখ-কষ্ট-হাসি ইত্যাদিগুলো যেমন খুব দ্রুতই ঘটছে ঠিক তেমনি একে অন্যের প্রতি ভালোলাগার পরিমাণটাও ধীরে ধীরে বাড়ছে । তারা একে অন্যকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে ঠিকই কিন্তু কেন জানি একে অন্যকে জানানোর সাহসটুকুও পাচ্ছে না । তবে মিলান আর ছবি দুইজনেই চায় তাদের জীবনের এই ছোট ছোট খুনসুটিগুলো যেন আজীবন বজায় থাকে ।

১৬.

- কি মজা !! তোমার সাথে আমার আগামী ১০ দিন দেখা হবে না । কত্ত মজা না, বলো ?

মিলান ছবির কথা শুনে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্ঠা করলো সে আসলে ইয়ার্কি করছে কি না !! এরকম বাচ্চাদের মত ব্যবহার ছবি প্রায়ই করে । মিলানকে জ্বালিয়ে, ক্ষণিকের কষ্ট দিয়ে মেয়েটা অনেক মজা পায় । মিলান আগেও এটা খেয়াল করেছে । ছবির কথার উত্তরে মিলান কিছু বললো না, শুধু মাথাটা নিচু করে ফেললো । ছবি অনেক পরে বুঝতে পারলো মিলানের মনটা খারাপ হয়েছে, এই কারণেই হয়তো ছেলেটা একেবারে চুপ হয়ে গেছে ।

- কি ব্যাপার ?
- কি ?
- কথা বলো না কেন ?
- কই !! বলি তো ।
- এতক্ষণ একেবারে চুপ থাকার পর আবার বলছো, বলি তো !! এ কেমন কথা বলার নমুনা ?
- জানি না ।
- আমার প্রশ্নের উত্তর কিন্তু দাওনি তুমি !! আমি দূরে গেলে অনেক খুশি হয় না তোমার ? অনেক মজা লাগে না ?
- (ছবির কথা শুনে মিলান আবারও ছবির দিকে তাকালো, এরপর কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর অবশেষে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো) হ্যাঁ, অনেক ভালো লাগে আমার । দারুন খুশি লাগে । তুমি তো জানোই, তাই না !!

ছবি জানে মিলান আসলে কথাটা ঘুরিয়ে বলেছে । ছেলেটার মুখে এই কষ্টটুকুর কথা শুনে মেয়েটা কি যেন এক আজব আনন্দ পায় !! আচ্ছা, মেয়েটা কি সত্যিই বুঝে না নাকি মজা নিতে চায় সবসময় ? মিলান আবার মাথা নিচু করে ফেলেছে । হঠাৎ ছবি মিলানের হাতটা ধরলো । মিলান কি মনে করে যেন হাতটা ছেড়ে দিলো । মিলানের এহেন ব্যবহারে ছবি বেশ অবাক হলো । অথচ এই ছেলেটারই কিনা ছবির হাত ধরতে অনেক ভালো লাগে ।

- কি ব্যাপার, হাত সরিয়ে নিলা কেন ?
- ভালো লাগছে না ।
- এই ছেলে !! সাহস বেশি হয়ে গেছে না ? হাতটা দাও এখনই । কি হলো, দিতে বলেছি না ?

ছবির এরকম অধিকার খাটানো মিলানের অনেক পছন্দের । মুহূর্তের মধ্যে মিলানের মন ভালো হয়ে গেলো । এরপর সে-ই স্বইচ্ছায় ছবির হাতে নিজের হাতটা দিলো । মিলান হাত দিতেই ছবি মিলানের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিলো । সেই মিষ্টি হাসি !! কিছুদূর হাঁটতেই হঠাৎ রাস্তার ধারে ফুচকাবিক্রেতা দেখে মিলান দাড়িয়ে গেলো । ছবির সবচেয়ে পছন্দের খাবার নাকি ফুচকা আর আইসক্রিম । তবে ফুচকা পেলে তো মেয়েটার স্বভাব একেবারে বাচ্চাদের মত হয়ে যায় । মিলান ছবিকে ফুচকা খাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই ছবি কিছুক্ষণ চিন্তা করে না করে দেয় । ছবির উত্তরে মিলান বেশ অবাক হয় । কিন্তু এই না শোনার মত ইচ্ছা এখন মিলানের মোটেও নেই । ছবির অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিলান ঐ ফুচকাবিক্রেতার কাছে দুই প্লেট ফুচকার অর্ডার করে বসলো । মিলানের এরকম কাজে ছবি কপট রাগ দেখালেও একটু পর ঠিকই দুইজন মিলে ফুচকা খুব মজা করেই খেলো ।

মাঝে মাঝে প্রিয়জনদের ইচ্ছাগুলোও নিজের ইচ্ছায় পরিণত হয় । তখন সেই কাজগুলো করতে আরও যেন ভালোই লাগে ।

১৭.

একসাথে বসে থাকার পরও ছবি কেমন জানি আনমনা । তার সম্পূর্ণ মনোযোগ পাশ থেকে ঘাস ছিঁড়ে সেটা হাতে নিয়ে সেগুলো আরও ভালোভাবে ছিঁড়ে যাওয়া । সে অবশ্য খেয়ালও করেনি যে তার দিকে মিলান তাকিয়ে আছে একটানা অনেকক্ষণ ধরে । যখন খেয়াল করলো, তখন কেন জানি ফিক করে হেসে দিলো । এবার ছবিও ঠিক মিলানের চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

- কি দেখো ?
- তোমাকে ?
- ও মা, আমাকে এভাবে দেখার কি আছে ? মনে হচ্ছে দেখোনি কোনদিন !!
- দেখলে দেখেছি !! কেন, এখন দেখলে কি তোমার কোন সমস্যা ?
- না, আমার আবার কি সমস্যা !! তোমার চোখ দিয়ে তুমি দেখবা, আমি বলার কে কোনকিছু ?

ছবির কথা শুনে এবার মিলানও হেসে দিলো ।

- তুমি না দিন দিন খুব মজা করে কথা বলতে শিখে যাচ্ছ । আমার সাথে থেকে ভালোই ট্রেনিং হচ্ছে দেখি ।

মিলানের কথা শেষ হওয়া মাত্রই ছবি আর মিলান দুইজনেই হেসে দিলো । এরপর আবার কিছুক্ষণ নীরবতা । অবশেষে মিলানই নীরবতা ভাঙ্গলো ।

- তোমার মনে আছে আজকের দিনটার কথা ?
- মানে ?
- আজকের তারিখের কথা ?
- (মিলানের কথায় খানিকটা অবাক হয়ে) ঠিক মনে পড়ছে না স্পেশাল কিছুর কথা । আচ্ছা, দাঁড়াও একটু ভেবে নিই ।

মিলানের কথায় ছবি ভাবা শুরু করলো । কি হয়েছিল আজকের এই দিনে ? ঠিক এক বছর আগে, কি ? কিন্তু এক বছর আগে তো দূরের কথা ২ মাস আগেও ছবির সাথে মিলানের পরিচয় ছিল না । তাহলে মিলান ঠিক কি জানতে চাচ্ছে ? অনেকক্ষণ ভাবার পরও ছবি আজকের দিনটার স্পেশাল হওয়ার কারণটা খুজেই পেলো না ।

- আচ্ছা, তুমিই বলো...
- তার মানে তোমার মনে নেই ?
- ওহ, ভনিতা বাদ দিয়ে বলো তো ।
- আচ্ছা, বাবা, বলছি । গত মাসের ঠিক আজকের এই দিনে আমাদের মধ্যে ভালোলাগাটা ভালোবাসায় পৌঁছায় । হয়তো তুমি আমি দুইজনেই বুঝতে পারি, একে অন্যকে চূড়ান্ত বিশ্বাস করা যায় । একটা সুন্দর সম্পর্কে যাওয়া যায় ।

মিলানের কথাগুলো শুনে এবার ছবি মিলানের মুখের দিকে তাকালো । ওহ !! তাই তো । আজকেই তো সেই দিন । ঠিক ১ মাস পূর্ণ হলো তাদের সম্পর্কের । ছবির মনে ছিল কিন্তু আচমকা মনে আনতে পারেনি সে । অথচ মিলানের ঠিকই মনে ছিল । ছবি মিলানের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্ঠা করে ছেলেটা আসলেই কেমন যেন !! সম্পর্কের এই ছোট ছোট স্পেশাল ঘটনাগুলোর মনে রাখা, উদযাপন সম্পর্কগুলোকে আরও ভালো রাখে, দৃঢ় করে । ছবি মিলানের হাতটা ধরে মিলানের ঘাড়ে মাথাটা এলিয়ে দেয় । মনে হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য একটা সম্পর্কে জড়িয়েছে সে । তবে পরিণতি !! সেটা তো সম্পূর্ণ ভাগ্যের উপর, তাই নয় কি ?!

১৮.

শত শত পাখির দল একসাথে ফিরছে নীড়ের দিকে । আকাশটা কেমন জানি কালো কালো হয়ে আছে । সহসা এরকম কালো হলে বৃষ্টি হয় না । বৃষ্টি হতে হলে আরেকটু বেশিই কালো হতে হয় । তবে যেহেতু আকাশটা কালো মেঘে ছেয়ে গেছে তাই গরমের ছিটেফোঁটাও নেই । আশপাশটা একবার কেউ চোখ বুলিয়েই বলবে, সুন্দর, অনেক সুন্দর । কিন্তু মিলানের কেন জানি শীত লাগছে । শরীরটা তো সেই দুপুর থেকেই দুর্বল লাগছিল । মনে হয় জ্বরটা উঠেই গেছে । সহসা জ্বর হয়না মিলানের । শেষ কবে জ্বর হয়েছিল সেটা অনেকক্ষণ যাবৎ চিন্তা করেও মনে করতে পারলো না সে । মিলান অনেকটা সময় জুড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে পাখির দলবেঁধে চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখলো । যে কারোরই এই দৃশ্য অনেক ভালো লাগার কথা কিন্তু মিলানের ভালো লাগছে না ।

মিলান একটু পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করার চেষ্ঠা করলো । ছবি বলেছিল যদি তাদের ১০ দিন দেখা না হয়, তাহলে মিলানের কেমন লাগবে ? মিলান মিথ্যা বলেছিল । বলেছিল, হ্যাঁ, অনেক ভালোই তো লাগবে । এরপর ছবি সত্যি সত্যি চলে যায় ঢাকায়, এক আত্মীয়র বাসায় । এরপর সে টানা ৭ দিন কাটিয়ে অবশেষে গতকালকেই ফিরেছে । ছবি যাওয়ার আগে অবশ্য মিলান ওকে বলেছিল, মরে গেছি না বেঁচে আছি, একটু খোঁজ নিও মাঝে মাঝে । আবেগিয় এরকম কথাগুলো শুনতেও হাস্যকর লাগে । মিলানের এই কথা শুনে ছবি কোন উত্তর দেয়নি, শুধু একটু হেসেছিল ।

১০ দিন কিংবা ৭ দিন, বেশ অনেকটা ব্যপ্তি । মিলান জানে তার এই জ্বর অবস্থাতেও এখানে দাড়িয়ে থাকার পিছনে একমাত্র কারণ তার মনের অস্থিরতাটুকু । ছবিকে যে করে হোক তাকে একবার দেখতেই হবে । আচ্ছা, ছবিরও কি এরকম কিছু হয়েছে ? তার ইচ্ছেটুকু কি এমন প্রবল ? এই প্রশ্নের উত্তর মিলানের কাছে নেই বরং কেমন জানি দ্বিধা কাজ করছে । এরপর বেশ খানিকক্ষণ ভেবে মোবাইল হাতে নিলো মিলান, কললিস্ট ঘেটে ছবির নাম্বার বের করে ফোন দিলো । চার-পাঁচবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো । হ্যাঁ, ছবিই রিসিভ করলো ।

- হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম ।
- ওয়ালাইকুম আসসালাম । কি খবর, ভালো আছো ?
- হ্যাঁ । তুমি ?

মিলান জানে এখন যদি সে "ভালো আছি" বলে, কথাটা একরকম মিথ্যা হয়ে যাবে । তাই সে কথাটা ঘুরিয়ে জবাব দেয়,

- আছি কোনোরকম । বের হবা ? আমি রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে আছি ।
- (ছবি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললো) আচ্ছা, আর মিনিট পাঁচেক দাঁড়াও । আমি আসছি ।

এই বলেই ছবি ফোন কেটে দিলো । ফোন পকেটে রেখেই মিলান তার কপালে হাত দিলো, জ্বরটা এখনও পুরোপুরি কাবু করতে পারেনি তাকে । তবু ছবি বুঝে ফেললে একটু তো রাগ করবেই । এরকম ছেলেমানুষি নাকি তার একদম পছন্দ না । অথচ মিলান ভাবে এই ছেলেমানুষিগুলোই তো জীবনকে আরও আনন্দময় করে তোলে ।

১৯.

- যাবা ?
- কোথায় ?
- কোথায়, কেন, কখন, কিভাবে ইত্যাদি এইসব তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও । তুমি শুধু যাবা ।
- কিন্তু...
- কোন কিন্তু না । তুমি যাবা কি যাবা না, কোনটা ?

মিলানের কথায় ছবি একটু কনফিউশনে পড়ে গেছে । যদিও মিলানের উপর বিশ্বাসটুকু ছবির ঠিকই আছে । তবু হুট করে এভাবে কোথাও যাওয়া, তাও আবার রহস্য রাখাটা আসলেই কেমন জানি একটি আজব । তবু বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করে ছবি উত্তর দিলো,

- আচ্ছা, চলো ।

মিলান এতক্ষণ হয়তো ছবির পজেটিভ উত্তরের আশাতেই ছিল । ছবি হ্যাঁ বলে দিতেই, পাশ থেকে চলে যাওয়া একটি রিকশা ডাক দিলো মিলান । রিকশা দাড়াতেই মিলান উঠে পড়লো, একটু পর ছবিও উঠে পড়লো পাশে । ছবি এখনও বুঝতে পারছে না তাদের গন্তব্য ঠিক কোথায় । মিলান তো সাধারণত এমনটা করে না । ওদিকে মিলানও রিকশাওয়ালাকে বলেনি যে কোথায় যাবে তারা । ছবির কাছে রহস্যটুকু রাখতে চাচ্ছে সে । রিকশাওয়ালা রিকশা চালানো শুরু করার পর থেকেই মিলান তাকে পথ বলে বলে দিচ্ছে ।

প্রায় আধা ঘণ্টা চলার পর নদীর ঠিক পাশে এসে রিকশা দাড় করালো মিলান । এই জায়গাটা মিলানের অনেক পছন্দের । ছবিকেও মিলান বেশ কয়েকবার এখানে নিয়ে এসেছে । তাই জায়গাটা ছবির অপরিচিত নয় । এতক্ষণে ছবি বুঝতে পারলো ঠিকই কিন্তু মিলান কেন এই চেনা জায়গাটা নিয়েও রহস্য ধরে রেখেছিল, সেটা সে বুঝতে পারছে না । ভাড়া চুকিয়ে রিকশা বিদায় করে দিয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে মিলান একটা হাসি দিলো । কিন্তু ছবি তাকে প্রশ্ন করেই বসলো,

- এই জায়গায় আসবে বললেই হতো !! এরকম রহস্য করার দরকার কি ছিল ?
- কেন জানি, বলতে ইচ্ছে করছিল না তখন তোমাকে । এই জায়গাটা আমার অনেক প্রিয়, জানো ? এই জায়গাতেই তোমাকে প্রথমে নিয়ে এসেছিলাম, আমাদের অনেক অনেক গল্প হয়েছিল সেদিন, প্রথম ভালোলাগার শুরুও এখান থেকে, মনে আছে তোমার, ছবি ?
- (মিলান যদিও কথা ঘুরিয়ে নিয়েছে তবু মিলানের কথাগুলো ভালো লাগলো ছবির) হুম, খুব মনে আছে । আমারও এইখানে আসতে খুব ভালো লাগে ।
- চলো কোথাও বসি ।
- প্রথম সেই দিনের মত ?

ছবির কথা শুনে মিলান হেসে দিলো, সাথে ছবিও যোগ দিলো । মানুষ যতই ভালোলাগার মুহূর্তগুলোকে ফিরিয়ে আনতে চায়, সবসময় পেরে ওঠে না ।

মিলান ভাবতে থাকে, এখন আকাশ ফেটে বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না । বৃষ্টি শুরু হলে সেই বৃষ্টির মধ্যে সে আর ছবি হাত ধরে হাঁটতে থাকবে । ওদিকে ছবি ভাবছে অন্য কথা । কতক্ষণ থাকবে তারা এখানে !! কোথাও না বসে হাঁটলেই হয়তো ভালো হয় । ভাবনা উদয় হওয়ার সাথে সাথে ছবি মিলানকে হাঁটার প্রস্তাব করলো । ছবির প্রস্তাবে মিলানও রাজী হলো । নদীর ঠিক পার ঘেঁষে দুইটি মানুষ হাঁটতে লাগলো হাত ধরে । এই মুহূর্তে পৃথিবী থেমে গেলেও হয়তো মন্দ হয়না । ভালোলাগা মুহূর্তগুলোতে পৃথিবী থেমে গেলে বরং আরও আনন্দ হওয়ার কথা । জীবনে এর থেকে সত্যিই বেশি কিছু চাওয়ার থাকে না ।

২০.

- কি ব্যাপার, কথা বলো না কেন ?

মিলান আর ছবি হাঁটছে সেই অনেকক্ষণ ধরেই । মিলান কিছু একটা ভাবছে অনেক আগে থেকেই । তাই চুপ করে আছে । মিলান স্বাভাবিকভাবে এমন চুপ থাকে না । এমন অস্বাভাবিক কোন কর্ম দেখলে যে কারও কৌতূহলী হওয়াটা খুব স্বাভাবিক । ছবিও কৌতূহলী হয়েই মিলানকে জিজ্ঞেস করলো কথাটা ।

- কই, বলি তো ।
- বলো না !! কোথায় বলো । সেই তখন ধরে তো নীরব হয়ে আছো !! কি ব্যাপার কি ভাবছো ?
- কই, কিছু না তো ।
- ঐ, মিথ্যা বলো কেন ? বলো জলদি, কি ভাবছো ?
- না, ভাবছি, পড়াতে যাবো কি না, শরীরটা ভালো লাগছে না ।
- ওহ, আচ্ছা !! আমার সাথে থাকার পরেও ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে ভাবনা, তাই না ? তা ছাত্র-ছাত্রীর মুখ না দেখলে দিনটা বুঝি ভালো যায় না ?

এই কথা বলামাত্রই ছবি হেসে দিলো কিন্তু মিলান মোটেও হাসির মুডে নেই । ছবির এমন কথাও কেন জানি তার ভালো লাগছে না ।

- ধুর, ইয়ার্কি করো না, এগুলো নিয়ে ইয়ার্কি করতে ভালো লাগে না ।

মিলানের কথা শুনে ছবি হাসি থামিয়ে দিলো বরং কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো । ছোটখাট এমন খুনসুটিগুলোতে বাধা আসলে একটু বিরক্ত লাগাটাই স্বাভাবিক ।

- আমি শুধু ইয়ার্কি করি, তাই না ? ঠিক আছে, আর কিছু বলবোই না, খুশি ?
- ও মা !! আমি কি সেটা বলেছি নাকি ? আমি তো বলেছি শুধুমাত্রই ওরকম কথা বলে ইয়ার্কি করো না । আগে আমার কনফিউশনটা দূর করতে একটু সাহায্য করো ।
- তোমার ভালো লাগলে যাও, আর না লাগলে যেও না । এখানে কনফিউশনের কি আছে !!

মিলান বুঝতে পেরেছে ছবি রাগ করেছে । এই মেয়েটা কেমন যেন !! পুরাই ছেলেমানুষি সবকিছুতেই । ছোট মানুষের মত কথায় কথায় রাগ করাটা স্বভাব আবার অল্পতেই খুশিও হয়ে যায় !! পুরাই অদ্ভুত । এখন যদি ওকে ঘাঁটানো হয়, তাহলে ওর রাগটুকু খালি বাড়বে, কমবে না । তাই মিলান আর ছবিকে ঘাটালো না । দুইজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটছে কিন্তু দুইজনের মনের ভাবনা দুইরকম । কেমন জানি অদ্ভুত বিষয়টা ।

হাঁটতে হাঁটতেই রাস্তার ধারে একজন ফুচকাওয়ালাকে দেখে মিলান ছবির দিকে তাকালো । ছবি মিলানের মনের কথা বুঝতে পেরে, ওর হাত ধরে সামনের দিকে টেনে নিয়ে চললো । ছবির মুখে এখন হাসি, মিলানেরও । মেয়েটার এমন সব ছেলেমানুষিগুলোকেই তো মিলানের ভালো লাগে । সারাজীবন ধরেই এসব ছেলেমানুষিগুলোকে আগলে রাখতেও তার কোনই আপত্তি নেই ।

( চলবে )

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ২:৩৯

স্বপ্নের শঙ্খচিল বলেছেন: বেশ ভালো
বেশ ভালো

২| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ রাত ৩:০৯

কাওসার চৌধুরী বলেছেন:



ভাল লিখেছেন; ৩টি পর্ব পড়লাম৷এক সাথে এতো পর্ব না দিয়ে ছোট ছোট ভাগ করে শেয়ার করলে পড়তে সুবিধা হবে৷পরবর্তী পর্বগুলোর জন্য শুভ কামনা রইলো ৷+++

৩| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ ভোর ৬:২০

সনেট কবি বলেছেন: ভাল লিখেছেন

৪| ১৩ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৮ সকাল ৯:১৮

রাজীব নুর বলেছেন: বিশাল গল্প।
পড়ছি তো পড়ছি, শেষ আর হয় না।

ওআইসির মতো এমন নিষ্কর্মা প্রতিষ্ঠান পৃথিবীতে আরও আছে?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.