নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

গাওয়াল

২১ শে মার্চ, ২০১৩ রাত ৯:২৪

নবদ্বীপ গোঁসাই যখন নাচের ভঙ্গিতে হনুমানের অনুকরণে ছোট্ট একটা লাফ মেরে বলেন, ‘তারপরে হনু এসে লাফিয়ে পড়িল।’ তখন উঠোনময় অনেক ভক্তের ভিড়ে বসে থাকা নীলু সত্যি সত্যিই দু-পায়ে ভর করে নড়ে ওঠে। আবার রামচন্দ্র যখন রাজ্য ছেড়ে স্ত্রী সীতাদেবী আর ভাই লক্ষ্মণকে নিয়ে বনবাসে যাত্রা করেন, তখন সত্যি সত্যিই কেঁদে বুক ভাসায় নীলু। শুধু নীলু একা নয়, ভক্তগণের অধিকাংশই তখন কেঁদে বুক ভাসায়। বুড়োরা কাঁদে, সধবা-বিধবারা ঘন ঘন আঁচলে চোখ মোছে। নবদ্বীপ গোঁসাই নিজেও তখন কেঁদে বুক ভাসান। নিজে না কাঁদলে তো আর ভক্তকুল কাঁদে না! নিন্দুকেরা যে যাই বলুক, এমন রামমঙ্গল গাইয়ে ক’জন দেখেছে মানুষ! কি বাহারী সুদর্শন পুরুষ! যেমনি দেখতে, তেমনি গাইয়ে। এই পয়ষট্টি বছর বয়সেও আলো যেন ঠিকরে বেরোয় শরীর থেকে। নীলুর অনেক দিনের স্বপ্ন, সেও একদিন নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মতো রামমঙ্গল গান গাইবে। তো গান বাজনা হলো গুরুমুখী বিদ্যা। একজন গুরু না ধরতে পারলে তো চলবে না। আর নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মতো এমন সুদ গুরু হাতের কাছে থাকতে গুরু খুঁজতে আর দূরে যাওয়া কেন! কিন্তু নবদ্বীপ গোঁসাই অনেক উঁচু দরের গায়েন। দেশব্যাপী তার কত খ্যাতি! তাঁর দোহাররাও কত ভাল গায়। এমন নামী গায়েনের কাছে কথাটা বলতেই ভয় হয় নীলুর। শুনে যদি রাজি না হন? তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করেন! তখন এই অপমান সে সইবে কেমনে! হাসি-তামাশা করার ব্যাপারও আছে বটে। তার টাইটেল রুইদাস। তবে চার পুরুষ ধরে তারা আর মুচির কাজ করে না। ছাতা বিক্রি করে, ছাতা সেলাই করে, ভাঙা ছাতা মেরামত করে। তার বাবা গ্রামে গ্রামে ছাতা মেরামত করে বেড়ায়। অবশ্য নীলুর দাদা নিখিল বাবার অনুমতিতে পেশা বদল করেছে। পৈত্রিক পেশায় সংসারের অভাব দূর হয় না। শরীরের মলিন জামার মতো সংসারে সেঁটে থাকে অভাব। তাই নিখিল এখন সিট কাপড় আর শাড়ী কাপড়ের ব্যবসা ধরেছে। সাইকেলের পিছনে কাপড়ের গাট্টি চাপিয়ে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বেড়ায়। নীলু মাধ্যমিক দুবার ফেল করার পর কিছুদিন মামার ছাতার দোকানে কাজ করেছে। কিন্তু ও কাজ তার মন টানেনি। মন পড়ে থাকে রামমঙ্গল পালায়। নবদ্বীপ গোঁসাইকে বলতে ভয় হওয়ার এর চেয়েও বড় কারণ হলো সে বামন। তার উচ্চতা তিন ফুঁট। এই কম উচ্চতার জন্য মানুষ তাকে এমনিতেই উপহাস করে। বলে, ‘কেন এখানে পড়ে আছিস? সার্কাসের দলে যা রঙ-ঢঙ করে দু-পয়সা কামাতে পারবি।’ ‘তোর কি গতি হবে রে নীলে, তোকে বিয়ে করবে কে?’ নিজের পরিবারেও সে একজন গুরুত্বহীন মানুষ, অপাঙক্তেয়। পাড়ার মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ছেলে ছোকরারা হাসে।

স্কুলেও তাকে নিয়ে অনেকেই হাসি-ঠাট্টা করতো। কেউ কেউ জোকার বলতো। একদিন তাকে জোকার বলার জন্য একছেলের বিরুদ্ধে বাংলা স্যারের কাছে নালিশ করেছিল সে। বাংলা স্যার কাসে সবার সামনে সেই ছেলেকে শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি নীলুকে ডেকে বলেছিলেন, ‘নীলু, তুমি বামন হয়ে জন্মেছ বলে মনে কষ্ট রেখ না। একজন ছয় ফুঁট মানুষও ছোট হয়ে যায় তার কর্মের জন্য। আবার তোমার মতো মানুষও বড় হতে পারে। সেও ঐ কর্ম দিয়েই। আজ একজন তোমাকে জোকার বলেছে বলে আমি তাকে শাস্তি দিয়েছি। কিন্তু এই সমাজে আরো অনেক মানুষ আছে। যাদের কেউ কেউ তোমাকে জোকার বলতে পারে। তাদেরকে কে শাস্তি দেবে বলো? যারা তোমাকে জোকার বলে তারা হয়তো অনেক লম্বা-চওড়া মানুষ। কিন্তু ওরা তোমাকে জোকার বলে নিজেকেই ছোট করছে। তুমি তোমার বড়ত্ব দিয়ে ওদেরকে মা করে দিও। উচ্চতা দিয়ে মানুষকে পরিমাপ করা যায় না নীলু। মানুষকে পরিমাপ করতে হয় তার কর্ম দিয়ে, আচার-আচরণ দিয়ে।’

সেদিন বাংলা স্যারের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছিল নীলু। কেঁদে ফেলেছিল সে। স্যার তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। বাংলা স্যার আজ বেঁচে নেই। কিন্তু বাংলা স্যারের বুকের উষ্ণতা আজও সে অনুভব করে। বাংলা স্যারের কথাগুলো আজও তার হৃদয়ে গেঁথে আছে। ঐ কথাগুলোই তাকে বড় হবার স্বপ্ন দেখায়। রামমঙ্গল পালার গায়েন হবার স্বপ্ন।

ধারে কাছে যেখানেই নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের রামমঙ্গল গানের পালা হয়, সেখানেই হাজির হয় নীলু। কিন্তু মনের কথাটা নবদ্বীপ গোঁসাইকে বলা হয়ে ওঠে না। একরাতে পালা শেষ করে দোহারদের নিয়ে বাড়ি ফিরছেন নবদ্বীপ গোঁসাই। তাঁদের পিছু নিল নীলু। নরেন হারমনিয়াম আর শম্ভু খোল নিয়ে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের পিছু পিছু হাঁটছে। অন্য দুই দোহারের বাড়ি অন্যপাড়ায়। তাই তারা ধরলো উল্টো পথ। নবদ্বীপ গোঁসাই টর্চ জ্বেলে আগে আগে হাঁটছেন। পিছনে নরেন আর শম্ভু। তাদের থেকে খানিকটা পিছনে চুপি চুপি হাঁটছে নীলু।

শীতের রাত। এই শেষ রাতে শীত আরও জেঁকে বসেছে। নিবিড় কুয়াশা। বটগাছের নিচ দিয়ে যাবার সময় বটের পাতা চুইয়ে টপ টপ করে শিশিরের ফোঁটা পড়ছে মাথায়, মাটিতে, তলায় পড়া শুকনো বটের পাতায়। সুনসান রাত্রি। শুধু শিশিরের ফোঁটা পড়ার শব্দ আর নরেনের পায়ের স্যান্ডেল পটাত পটাত করে আওয়াজ করছে। শম্ভু থেকে থেকেই কাঁশছে। তামাক কাশি। বেচারার ক্ষীণকায় দূর্বল শরীর। ভাঙা চোয়াল। কিন্তু দিনে দেড় প্যাকেট আজিজ বিড়ি কালো চামড়ার ঈষৎ ঝলসানো চিতায় চড়ায় সে। আর খুঁক খুঁক করে কাশে।

মোড়টা ঘুরতেই নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে প্রণাম করলো নীলু। নবদ্বীপ গোঁসাই এই শেষ রাতের বেলে জোছনায়, ঘন কুয়াশায় রাস্তার ওপর প্রণাম পেয়ে অনেকটা অবাক হলেন, বোধহয় খানিকটা চমকেও গেলেন। বললেন, ‘কে রে তুই?’

তারপর নিজেই বললেন, ‘ও তুই! আমাকে তো চমকে দিয়েছিস।’

সব জায়গায় দেখতে দেখতে নীলুও নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মুখচেনা হয়ে গেছে।

নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘তা এতরাতে রাস্তার উপর প্রণাম কেন রে? কি নাম যেন তোর?’

নীলু বললো, ‘আমি নীলকমল রুইদাস বাবা গোঁসাই। সবাই নীলু বলে ডাকে। যদি অভয় দেন তো একটা কথা বলি।’ নীলু সাধ্যমতো চেষ্টা করলো শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে।

নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘বল, কি বলতে চাস?’

নীলু বললো, ‘বাবা গোঁসাই, রামমঙ্গল গান শেখার বড় সখ আমার। আমি আপনাকেই গুরু মেনেছি। আপনার গান শুনতে শুনতে একটু একটু গাইতেও চেষ্টা করি। আমি আপনার দোহার হবার চাই। আমার বড় আশা।’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো নীলু। নবদ্বীপ গোঁসাই বেশ অবাক হলেন। এমন কথা শোনার জন্য তিনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। বললেন, ‘তুই পারবি গাইতে?’

নীলু কপালে দুহাত ঠেকিয়ে বললো, ‘আপনার আশির্বাদে নিশ্চয় পারবো বাবা গোঁসাই।’

নবদ্বীপ গোঁসাই নরেনকে বললেন, ‘ও নরেন, ওর যখন সখ হয়েছে দেখ ঘষে মেজে কিছু হয় কি না! কি নাম বললি তোর?’

‘আজ্ঞে নীলকমল বাবা গোঁসাই। নীলু বলে ডাকে সবাই।’

নরেন বিরক্ত হয়ে বললো, ‘ও পারবেন না বাবা গোঁসাই। খালি খালি দল ভারি করার দরকার কি!’

নবদ্বীপ গোঁসাই বললেন, ‘দেখ না, পারে কিনা। কাকে দিয়ে কি হয় আগে থেকে কি কিছু বলা যায়! তুই এখন যা। পরশু মথুরাপুর পালা আছে। নরেনের সাথে চলে আসিস।’

নবদ্বীপ গোঁসাইকে আবার প্রণাম করলো নীলু। তিনি নরেন আর শম্ভুকে নিয়ে চলে গেলেন। এই বেলে জোছনায়ও নরেনের মুখ দেখে বেশ বোঝা গেল সে খুব বিরক্ত হয়েছে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের আদেশ শুনে। সেদিকে খেয়াল করার সময়ই পেল না নীলু। সে পালার মুখস্ত করা কিছু অংশ গাইতে গাইতে, নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরলো।

প্রথম যেদিন মথুরাপুরে পালা গাইতে গেল নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সঙ্গে, সে কি আনন্দ নীলুর! সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মহাদেব নাপিতের সেলুনে গেল চুল কাটাতে। তার চুল এমনিতেই ঘাড় পর্যন্ত। তবু চারপাশটা একটু ছাঁটাই করালো। দাড়ি-গোঁফ কামালো। তারপর হান্নানের দোকান থেকে একটা শ্যাম্পুর পাতা কিনে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বাড়ি ফিরলো।

বৌদির কাছ থেকে সুগন্ধি সাবান চেয়ে নিয়ে কুমার নদীতে স্নান করে এলো। কানাই জ্যাঠার কাছ থেকে তার মেয়ে-জামাইয়ের দেওয়া কাশ্মীরি শালটা চেয়ে নিয়ে এলো। বলাইয়ের মায়ের শ্রাদ্ধে পাওয়া একখানা ধুতি কম দামে কিনে রেখেছিল সে। সেই ধুতিখানা ট্রাঙ্ক থেকে বের করে নাকের কাছে নিয়ে শুকলো। কি সুন্দর ন্যাপথলের গন্ধ! ধুতির বেশ খানিকটা কোমরে গুঁজে কায়দা করে পড়লো। গতবার দূর্গাপূজায় বড়দির দেওয়া ফতুয়াটা গায়ে চড়ালো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখে চিরুনী দিয়ে মাথার মাজখানটায় সিঁথি করলো। তারপর যত্নের সাথে শালটা কাঁধে ফেলে রামচন্দ্রের ছবিতে প্রণাম করে, বাবা-মা, বৌদি এবং কানাই জ্যাঠার পা ছুঁয়ে রাস্তায় পা বাড়ালো।

নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের বাড়িতে গিয়ে খোলটা ঘাড়ে নিয়ে সবার পিছন পিছন গিয়ে বাসে উঠলো। বিকেলে যখন মথুরাপুরের অজিত কুন্ডুর বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলো, তখন তাঁদের দেখতে কত লোকের ভিড়। নবদ্বীপ গোঁসাইকে তো বটেই, দোহারদেরও কত খাতির যত্ন করলো! পালা না গাইতেই দেখা গেল দলে জনপ্রিয়তার দিক থেকে নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের পরেই সে। লোকে তাকে নিয়ে কানাকানি করতে লাগলো। হয়তো সে বামন বলেই তাকে নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ।

সেদিনের পালায় দোহারকি বেশ ভালই করেছিল নীলু। কৃষ্ণকাঁঠি বাঁজিয়েছিল। নবদ্বীপ গোঁসাইকে তো সবাই প্রশংসা করেছিল। তাকেও আলাদাভাবে কেউ কেউ প্রশংসা করেছিল।

নীলু নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের দোহার হয়েছে একথা এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে কেউ কেউ তাকে বাহবা দিল, ‘বা! বেটা, বা! লেগে থাক।’ আবার অনেকে কটু কথাও বললো। কিন্তু বাংলা স্যারের কথা মনে রেখে এখন আর কোন কটু কথাই গায়ে মাখে না সে। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের সঙ্গে সে লেগে রইলো। বছরখানেক এখানে ওখানে রামমঙ্গল পালার দোহারকি করলো। এর মধ্যে তার অনেক সম্মান বাড়লো পরিচিত মহলে। যারা তাকে তাচ্ছিল্যভরে নীলে নীলে বলে ডাকতো, তারাও এখন তাকে সম্ভ্রমে নীলকমল অথবা নীলু বলে ডাকে। নিজের পরিবারেও তার সম্মান বেড়েছে। তাকে এখন পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হিসেবে মনে করা হয়। তার মতামতকে মূল্যায়ন করা হয়। নীলু নিজেই বুঝতে পারে যে সে কিছুটা বড় হয়েছে। সে আরও বড় হতে চায়। আরও সম্মান চায়।

কিন্তু এই সম্মান তার কপালে বেশিদিন সইলো না। হঠাৎ একদিন মারা গেলেন নবদ্বীপ গোঁসাই। নবদ্বীপ গোঁসইয়ের সঙ্গে তার স্বপ্ন, সম্মানও যে চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল তা সে তখন বুঝতে পারেনি। নবদ্বীপ গোঁসাইয়ের মৃত্যুর পর খুব কেঁদেছিল সে। মন মরা হয়ে বসে থাকতো। তারপর কিছুদিন পর শোক কিছুটা কমে এলে নরেনকে গিয়ে বললো, ‘নরেদা, বাবা গোঁসাই তো আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন। চল তাঁর নাম রাখতি আমারা আবার দলটা দাঁড় করি।

নীলুর কথা শুনে নরেন যেন আকাশ থেকে পড়লো। বললো, ‘দল দাঁড় করবো, গাইবে কে?’

নীলু দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, ‘আমি গাইবো।’

নরেন আরও অবাক হয়ে বললো, ‘পাগল বলে কি! তুই পালা গাইবি! কে শুনবে তোর গান? আসরে তো মানুষ তোরে দেখতিই পাবেন না।’

নরেনের কথা শুনে খুব মর্মাহত হলো নীলু। তবু সে বললো, ‘তুমি যাই কও নরেনদা। আমি ঠিক পারবো।’

এবার ধমক দিল নরেন, ‘এই যা তো। বাজে বকিস না। উনি পালা গাইবে আর সেই সঙের পালা মানুষ শুনবে!’

ব্যথিত হয়ে ফিরে এলো নীলু। অন্য দুই দোহারের কাছে গেলে তারাও একই ভাবে ভৎর্সনা করলো তাকে। অন্যদের নিয়ে দল গড়ার কথা ভাবলো সে। কিন্তু তেমন কাউকে পেল না। আস্তে অস্তে তার স্বপ্ন ফিকে হতে লাগলো। আবার পাড়া-প্রতিবেশীরা কটু কথা বলতে শুরু করলো। আয়-রোজগার নেই বলে পরিবারেও আবার অপাঙক্তেয় হলো। অবশেষে একদিন তার বাবার গাঁটরিটা কাঁধে নিয়ে পৈত্রিক পেশা অবলম্বন করে বেড়িয়ে পড়লো গাওয়ালে।

সেই যে তিন বছর আগে গাওয়ালে বেড়িয়েছিল নীলু। তারপর আর বাড়ি যায়নি সে। এখন এই পরিত্যক্ত রেলস্টেশনটিই তার বাড়ি। কালুখালী-ভাটিয়পাড়া লাইনে রেল চলাচল অনেকদিন ধরেই বন্ধ। রেললাইনের ওপর দিয়ে ঘাস ছেয়ে গেছে। স্টেশনটিও দিনের পর দিন অযত্ন অবহেলায় বিবর্ণ হয়ে গেছে। তিনবছর আগেও স্টেশন ঘরটি ছিল তালাবন্ধ। লতাপাতায় ছেয়ে ছিল। স্টেশনটির প্লাটফর্মে গরু-ছাগল বিচরণ করতো। ঘুরে ঘুরে ঘাস লতা-পাতা খেতো, পেট ভরলে স্টেশনের বারান্দায় এসে দিবা-নিদ্রা দিত। আবার যাবার সময় পেট হালকা করে যেত। একরকম বলা চলে স্টেশনের বারান্দা গরু-ছাগলের টয়লেট হয়ে গিয়েছিল। এই পরিবেশ দেখে কে বলবে এই স্টেশনটিই একদিন মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে থাকতো! বৃটিশ আমলে এই অঞ্চল নীল চাষের জন্য খুব বিখ্যাত ছিল। বাঙালীর রক্তে ভেজা নীলের বস্তা এপথেই কলকাতা হয়ে ইংল্যান্ড চলে যেত। সে সব আজ ইতিহাস। অনেকদিন হলো রেলগাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। স্টেশনটিও তার যৌবন হারিয়েছে। বছরের পর বছর স্টেশনটি গরু-ছাগলের বৈঠকখানা হয়ে থাকলেও কতৃপরে এ নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই। লাইনেই ট্রেন নেই।

যাইহোক বছর তিনেক আগে এই এলাকাতেই গাওয়ালে বেড়িয়েছিল নীলকমল। প্রথম কয়েকদিন কাজ শেষ করে স্কুলের বারান্দায় শুয়ে থাকতো সে। ইটের ওপর দুটো চাল-ডাল ফুঁটিয়ে খেত। তার মতো আরো অনেকেই ফরিদপুরের ভাঙ্গা এবং বোয়ালমারী থানা থেকে রাজবাড়ী জেলায় গাওয়ালে আসে। গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাজ করে এসে স্কুলের বারান্দায় রাত্রিযাপন করে। কয়েকদিন পরেই আবার অন্য এলাকায় চলে যায় অথবা বাড়ি ফিরে যায়। একদিন গ্রাম থেকে স্কুলে ফেরার পথে নীলুর নজরে পড়লো স্টেশন ঘরটি। যদিও ময়লা-আবর্জনা আর লতাপাতায় ভরপুর। তবু তার বেশ পছন্দ হলো। চারিদিকে বেশ নির্জন। আম গাছ, কাঁঠাল গাছ, দুটো বড় বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ, একটা মান্দার গাছ। পিছনের দিকটায় রয়েছে আরও নানান গাছ। একেবারে ছায়া-সুনিবিড়। ভাবলো থাকার জন্য ঘরটি মন্দ নয়। একটু পরিষ্কার-পরিছন্ন করে নিতে এবে এই যা। কাছেই স্টেশন মাস্টারের বাড়ি। খোঁজ করে নীলু তাঁর বাড়িতে গেল। নীলুর আগ্রহের কথা শুনে স্টেশন মাষ্টার বললেন, ‘ঠিক আছে তোমার যখন পছন্দ থাকো। কিন্তু মাসে দুশো টাকা দিতে হবে।’

তাতেই রাজী হয়ে গেল নীলু। লতাপাতা, গরু-ছাগলের মলমূত্র পরিষ্কার করলো। ঘর খুলে দেখলো চড়ুই পাখির বাসা, চামচিকার আবাস, একটা সাপের খোসা, মাকড়সার জাল, আরও নানা পোকা-মাকড়ের বাসা। সব পরিষ্কার করলো সে। টিনের বেড়াগুলোতে মরচে ধরেছে। কিন্তু এখনও বেশ শক্ত।

স্টেশনের টয়লেটটি একেবারেই ব্যবহারের অযোগ্য। ধুলোবালি, শুকনো লতাপাতায় একেবারে ভরে গেছে। দুটো রিং নতুন করে বসিয়ে নিল সে। স্টেশন মাষ্টারের বাড়ি থেকে বিদ্যুতের লাইনও আনলো। এভাবেই তিন বছর আগে শিকড় গেড়েছিল নীলু।

এখানে সে ভালই আছে। কাছেই বাজার। সপ্তাহে দুদিন হাট বসে। সোম ও শুক্রবার। হাটের দিন সে রেললাইনের ধারে দোকান খুলে বসে। রোজগার ভালই হয়। হাটের দিন বাদে অন্য দিনগুলোতে সে গাওয়াল করে বেড়ায় গ্রামে গ্রামে। গাঁটরি আর কাঠের বাটের ছাতাটি নিয়ে সে সকালে বের হয় আর সন্ধ্যায় ফিরে আসে। এই এলাকার মানুষজন এখন তার পরিচিত। স্টেশন মাষ্টারও তাকে খুব স্নেহ করেন। মাঝে মাঝে নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়। স্টেশন মাস্টারের ছেলে-মেয়ে গুলোও নীলুর খুব ভক্ত। এখানে এসে সে একেবারেই বাড়ির কথা ভুলে আছে। জীবনে দুঃখ তার একটাই রামমঙ্গল পালার গায়েন হওয়া হলো না। সেই কষ্টেই তো বাড়ি ছাড়লো।

রামমঙ্গল পালার গায়েন সে হতে পারেনি সত্য। কিন্তু এখন সে গান লেখে। নিজেই সুর দিয়ে গায়। গানের গলা তার একেবারে মন্দ নয়। আবার সখ করে বাঁশ-কাঠ দিয়ে ভাস্কর্যও বানাতে শুরু করেছে।

আজ হাটবার। গাওয়ালে যায়নি নীলু। কারণ দুপুরের পর পরই হাট জমতে শুরু করে। মধ্যাহ্নভোজ সেরে একটু বিশ্রাম নিয়েই হাটে চলে যায় সে। এজন্য আজ আগেভাগেই দুপুরের রান্না করছে। সকালে রান্না করেনি। পান্তা খেয়েছে। সকালে বাজার থেকে পুটিমাছ এনেছিল, আলু-বেগুন দিয়ে রান্না করবে এখন। ভাত চড়িয়ে দিয়েছে। তরকারী কাটার জন্য বটিটা টেনে নিয়ে বসলো। তাকে চমকে দিয়ে পিছন থেকে সুরেলা গালায় গাইতে শুরু করলো ডালিম-

‘বলি ও ননদী আর দু-মুঠো

চাল ফেলে দে হাঁড়িতে

ঠাকুর জামাই এলো বাড়িতে।’

নীলুর হাত ধরে টেনে তুললো ডালিম। গান গাইতে গাইতে হাত ধরে ঘুরতে লাগলো দুজন।

‘ইস্টিশনের বাবুর মতো

মিষ্টি পান খেয়ে

দ্যাখেন তোরে দেখতে কেমন

ড্যাবডেবিয়ে চেয়ে।

আমি তাইতো বলি চুল বেঁধে সাজ

হলুদ রাঙা শাড়িতে।

ঠাকুর জামাই এলো বাড়িতে....’

গান শেষ হতেই হাত ছেড়ে দিয়ে হাসিতে ফেঁটে পড়লো দুজনই। পরণেই নীলুর কপট অভিমান, ‘এতোদিনে মনে পড়লো মিতে?’

ডালিম মুচকি হেসে বললো, ‘মনে আবার পড়ে না! তুমি যে আমার রসের নাগর। তোমারে ভুলি কি করে, মন পোড়ে!’

কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা রেখে ডালিম নিজেই পিড়ি টেনে বসলো, ‘কি রান্না করো মিতে?’

‘বাজারের তে কয়ডা পুটিমাছ আনছিলাম। তাই আলু-বেগুন দিয়ে রান্না করবো। সেই যে পুজোর পরে গেলে আর মিতের দ্যাহা নাই!’

‘আসপো ক্যামনে মরেই তো গিছিলাম!’

‘ওমা, ক্যান?’ নীলুর গলায় দরদ মাখানো উদ্বেগ। উবে গেছে অভিমান।

‘দুইদিন পরপরই রাত্তিরি রাত্তিরি জ্বর আসতো। আর তার সাথে প্যাটের ব্যথা। শরীলের কোন হাল ছিল নাকি! এহনও বল পাইনে ঠিক মতো। প্যাটে টান পড়ছে তাই আবার আজ বাইর হলাম।’

‘চোখ-মুখ তো এহনও কেমন বসা বসা ভাব। কদ্দিন পর তোমারে পাইছি। সহজে আর ছাড়বান না। এবার কিন্তু অনিকদিন থাকপা। আমি হাটের তে আসি, তারপর দুইজনে রাতভর গান-বাজনা করবো। রোজই ভাবি আজ মিতে আসপি। কিন্তু মিতের আর দ্যাহা নাই। যাও চান করে আসো।’

‘তোমার কথা ফেলি কেমন করে। দ্যাও আলু-বেগুন কডা কুটে দিয়ে যাই।’

‘আমি কুটপানে তুমি যাও চান করে আসো।’

‘দ্যাও তো আমি পট করে কুটে দিয়ে যাই।’

নিজেই বটি টেনে তরকারী কাটতে লাগলো ডালিম। কাটা শেষ হলে হাত বাড়িয়ে দিল নীলুর দিকে, ‘দ্যাও, এট্টু ত্যাল দ্যাও। চান করে আসি।’

মাথায় তেল ঘষতে ঘষতে স্টেশন মাস্টারের পুকুরের দিকে গেল ডালিম। ডালিম নীলুর মতোই এক দুর্ভাগা! নীলু যেমনি বামন, তাই সে নিজেকে পৃথিবীর অবাঞ্চিত অতিথি মনে করে। সকল ভোজে তার হয় না নিমন্ত্রণ। তেমনি ডালিমেরও একটা শরীর আছে, হাত-পা আছে, বুদ্ধি আছে, একটা বড় মন আছে। টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ পেয়েছে। তবু সে পৃথিবীর ভোজে অপাঙক্তেয়। কারণ নিজেকে সে নারী বা পুরুষ হিসেবে দাবী করতে পারে না। এই শরীর তাকে সেই পরিচয় দেবার অনুমতি দেয়নি।

কাস টেনের পরীক্ষায় একবার প্রবন্ধ এসেছিল ‘আমার ছেলেবেলা’। একটা মেয়ে প্রতিবাদ করে স্যারকে বলেছিল, “স্যার আমি ‘আমার ছেলেবেলা’ কেন লিখবো? আমি লিখবো আমার ‘মেয়েবেলা’।” স্যার বলেছিলেন, “ঠিক আছে, তুমি ‘তোমার মেয়েবেলা’-ই লেখ।” দুষ্টু প্রকৃতির একটি ছেলে তখন দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘স্যার তাহলে নাজমা কি লিখবে?’ কাসের সবাই হেসে উঠেছিল। লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল নাজমা। কলম থেমে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য। বিব্রত স্যার সেই দুষ্টু ছেলেকে ধমক দিয়েছিলেন আর হাত বুলিয়েছিলেন নাজমার মাথায়। সেদিন নাজমা সেই দুষ্টু ছেলেটির ওপর একটুও রাগ করেনি। কারণ নাজমা উপলব্দি করেছিল, দুষ্টু ছেলেটি দুষ্টুমীর ছলে নির্মম সত্য কথাটাই বলেছে। ওর কোন দোষ নেই। কিন্তু নাজমার অভিমান হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার ওপর। তাই সৃষ্টিকর্তাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কথা বলেছিল নাজমার কলম। নাজমা সেদিন প্রবন্ধ লিখেছিল ‘আমার ছোটবেলা’।

নানা প্রতিকুলতায় নাজমার লেখাপড়া আর বেশিদূর এগোয়নি। কাস টেন পর্যন্তই শেষ। তারপর সে নাজমা থেকে ডালিম হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে নাজমা। নলিয়া গ্রামের মেঠোপথে ছুটতো যে নাজমা, স্কুলের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় গান গেয়ে প্রথম হতো যে নাজমা, গাবগাছ তলার দড়ি খেলার মধ্যমনি ছিল যে নাজমা, সাঁতরে বাবুদের দীঘি পাড়ি দিত যে নাজমা, সেই নাজমাকে মেরে ফেলেছে ডালিম। ডালিম এখন বাচ্চা নাচায়, বিয়েতে নাচে।

বছর দেড়েক আগে সখ্যতা গড়ে ওঠে নীলুর সাথে। তারপর থেকে এদিকে এলেই নীলুর এখানে এসে ওঠে। একে অপরকে মিতে বলে সম্ভোধন করে। ডালিম মিতের কাছে মাঝে মাঝে দু-চারদিন থাকে, আবার চলে যায়। দুজনের মনের মিল খুব। দুজনে মিলে রান্না করে। একে অপরের সুখ-দুঃখের কথা বলে, হাসে, গান গায়। আবার কাঁদেও।

খেতে বসার আগে ডালিম তার ঝোলা থেকে চকচকে একটি কাসার গ্লাস বের করলো। নীলুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমতলীর পরেশ কাকার নাতিরে নাচায়ে গ্লাসটা পাইছি। তুমি জল খাইয়ো।’

নীলু বাঁধা দিয়ে বললো, ‘থাক মিতে। আমার তো গ্লাস আছে। বেচলি তোমার দুডে পয়সা হবেনে।’

ম্লান হেসে ডালিম বললো, ‘পয়সা তো জীবনে কতই কামাই। থাহে আর কই! তুমি ন্যাও। ভালবাসার দান ফিরাতি নাই।’

ডালিমের মুখের দিকে তাকালো নীলু। ডালিম আবার বললো, ‘কি দেখতেছো অমন করে! ন্যাও।’

হাত বাড়িয়ে গ্লাসটি নিল নীলু। ডালিম বললো,‘আমি যহন থাকপো না, তহন জল খাবার গিলি আমার কথা তোমার মনে পড়বি।’

‘তোমার কথা কি আর ভুলবার পারি মিতে! সারাণই তোমার কথা মনে হয়। তুমি ছাড়া জগতে আমার এমন বন্ধু আর কিডা আছে কও! আপনজন যারা ছিল তারা তো দূরে ঠেলে দিল।’

বলতে বলতে নীলুর চোখ ছলছল করে উঠলো। তা ছড়িয়ে পড়লো ডালিমের চেখেও।

দিন চারেক থেকে ডালিম চলে গেল। আবার নীলু একা। রাতে বিছানায় শুয়ে নতুন একটা গানের সুর ভাঁজছে সে। খুব সরেস একটা গান লিখেছে আজ। মিতে থাকলে তাকে শোনাতে পারতো। মিতে কিছুতেই আজ থাকলো না। হঠাৎ তার কানে কাঁন্নার সুর ভেসে এলো। কান খাড়া করলো কোনদিক থেকে আসে। উত্তর দিক থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে। মেয়েলি কাঁন্নার সুর। আবার কোন ভুত-প্রেত নয় তো! তাকে ভোলাবার জন্য মেয়েলি কন্ঠে কাঁদছে! এমনটা সে ছেলেবেলায় শুনেছে। ভুত-প্রেত নাকি এমন করে কাঁদে! সেই কাঁন্নার ফাঁদে পা দিয়ে কাছে গেলেই নাকি বশ করে ফেলে। দিক ভুল করিয়ে অনেক দূরে নিয়ে যায়। তারপর কোন এক ফাঁকা মাঠ কিংবা জঙ্গলের ভিতর নিয়ে মেরে মাটিতে পুতে ফেলে।

কাঁন্নার সুর থামছে না। থেকে থেকে বেশি আবার কম। যদি মানুষ হয়! ভাবছে সে। শীতের রাত। উঠতেও ইচ্ছা করছে না। আবার ভয়ও করছে। যদি ভূত-প্রেত হয়! তবু সে সাহস করে উঠলো। বিদ্যুৎ গেছে ঘন্টা দেড়েক আগে। কখনও আসবে তারও ঠিক নেই। চকির নিচ থেকে হারিকেনটা নিয়ে টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা সলতে বাড়িয়ে দিল। বালিশের পাশ থেকে টর্চটা নিয়ে হারিকেন ঘরে রেখেই দরজা খুলে বের হলো। বাইরে আসতেই শীত যেন হাড়ে কামড় বসিয়ে দিল। একে তো অন্ধকার তার ওপর চারিদিকে ঘন কুশাশা। দূরের কিছু দেখা যায় না। বারান্দা থেকে নেমে আস্তে আস্তে এগোলো যেদিক থেকে কাঁন্নার শব্দ আসছে সেদিকে। প্ল্যাটফরম থেকে রেললাইনে নেমে সামনে যেতেই চোখে পড়লো লাইনের উপর বসে কেউ একজন কাঁদছে। টর্চ না জ্বেলে আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে পিছন থেকে সে বললো, ‘আপনি কিডা?’

নীলুর কথা শুনে চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকালো ঘোমটা মাথার বধূটি। আবছা অন্ধকারেও নীলু চিনতে পারলো বধূটিকে। কিন্তু তার ভয় এখনও কাটেনি। ভূত-প্রেতরা নাকি পরিচিত মানুষের রুপ ধরেই আসে! সে ভাবলো যা হবার হবে। তার মরণ যদি এভাবে অপঘাতে লেখা থাকে তো মরবে। সাহস নিয়ে বললো, ‘আপনি তপনদার বউ না?’

ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো উঠলো বধূটি। সে নীলুকে চেনে। তপনের বাড়ির কাছ দিয়ে আসার সময় কয়েকবার দেখা হয়েছে। তপন বাজারের সবচেয়ে বড় মুদি দোকানদার। তেলের ব্যবসাও করে সে। স্টেশনের উত্তরদিকে ধানতে। তারপরই তপনের পুকুর। পুকুরের ওপাশেই তার বাড়ি। তপন বিয়ে করেছে গত আষাঢ়ে।

বধূটি কোন কথা না বলে শুধু কাঁদছে। নীলুর ভয় আরো বেড়ে গেল। আফসোস হচ্ছে ম্যাচটা সঙ্গে আনেনি বলে। ম্যাচ থাকলে আগুন জ্বালতে পারতো। আগুন দেখলে তেনারা নাকি ভয় পান! ভূত শব্দটা মনে আনতেও এখন ভয় করছে তার। কাঁপা গলায় সে বললো, ‘এই শীতের মধ্যে আপনি এই জায়গা বসে কাঁদতেছেন ক্যান? আপনার গায়ে তো গরম কাপড়ও কিছু নাই। যান বাড়ি যান। ঠান্ডা লাগবেনে।’

এবারও বধূটি কোন কথা বললো না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। নীলুর হাঁটু এবার কাঁপতে শুরু করেছে। গলা শুকিয়ে আসছে। এবারই বুঝি তার ঘাড়টা ধরে মটকে দেবে! আর রা নাই! ইহলীলা সাঙ্গ হবে! কাঁপা কাঁপা গলায় সে আবার বললো, ‘আপনি কথা কতেছেন না ক্যান?’

এবার মুখ খুললো বধূটি। কাঁন্না জড়ানো গলায় বললো, ‘আমারে মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। বলছে অন্য ঘরে তার মায়ের কাছে শুয়ে থাকতি।’

কথায় কুষ্টিয়ার টান। তার মনে পড়লো তপন তো কুষ্টিয়াতেই বিয়ে করেছে। সে বললো, ‘দাদার মনে হয় মেজাজটা ঠিক নাই। এখন যান দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।’

বধূটি এবার অনেকটা স্বাভাবিক গলায় বললো, ‘মদ খেয়ে সে অন্য মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করতিছে। আমারে মেরে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।’

শুনে হতভম্ব হয়ে গেল নীলু। তপনের সম্পর্কে সে অনেক খারাপ কথা শুনেছে। তাই বলে বাইরের মেয়েমানুষ ঘরে এনে নিজের বউকে ঘর থেকে বের করে দেবে! মানুষ এমন জঘন্য নিষ্ঠুর হয়! বধূটির জন্য খারাপ লাগছে তার। শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে। বয়সও বেশি না। কুড়ি-একুশ হবে। বিয়েও হয়েছে সাত-আট মাস। এরই মধ্যে এত যন্ত্রনা সইতে হচ্ছে তাকে!

এখন ভয় কেটে গেছে তার। তপনের প্রতি ঘৃনা হচ্ছে। ক্রমশ ঘন হচ্ছে কুয়াশা। প্রচন্ড শীত। বধূটিকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়াটা অমানবিক মনে হলো তার কাছে। আবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়াও বিপদ। যদি কেউ দেখে ফেলে! তবু সে বললো, ‘এ জায়গা থাকলি তো আপনি শীতে মরে যাবেন। আপনার যদি কোন অসুবিধা না থাকে তালি আমার ঘরে আসে বসপার পারেন।’

ডুকরে কেঁদে উঠলো বধূটি। কিন্তু নিজেই হাঁটতে শুরু করলো স্টেশন ঘরের দিকে। তার পিছন পিছন হাঁটতে লাগলো নীলু। ঘরে এসে মেঝে থেকে হারিকেনটা নিয়ে খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে রেখে বধূটিকে বললো, ‘বসেন।’

নিজে সোয়েটার গায়ে দিয়ে চাদরটা এগিয়ে ধরলো বধূটির দিকে। বধূটি নীলুর দিকে তাকালো। তারপর চাদরটা হাতে নিয়ে শরীরে জড়িয়ে বিছানায় বসলো। নীলু বসলো মেঝেতে মোড়া পেতে ।

বধূটি এবার নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো, ‘আমার সৎ মাসির মেয়ে। কিন্তু আমি নিজের বোনের মতোই দেখতাম। আমার মাসি গরিব। অনেকগুলো ছেলে-মেয়ে। তাই রুপালীরে আমি মাঝে মাঝেই নিয়ে আসতাম। দশ-বিশ দিন করে কাছে রাখতাম। ওর কাপড়-চোপর, সাজগোজের যত যা লাগে আমি দিতাম। ভাবতাম আমার ছোটবোন থাকলিও তো দিতাম। সেই বোনই আমার সংসারে আগুন ধরালো। মানুষটারে কি জাদু করলো যে আমার উপর থেকে তার মন একেবারেই উঠে গেল। আমি না চাইলেও সে নিজে গিয়ে রুপালীরে নিয়ে আসে। আমি প্রথমে বুঝি নাই। যখন বুঝতি পারলাম তখন আমার মাসিরে আমি হাত জোড় করে বলিছি, রুপালীরে আর আমার বাড়িতে পাঠায়ো না মাসি, আমার সংসারটায় ভাঙন লাগায়ো না। মাসি শোনে না। তারপরও মেয়ে পাঠায়। বেহায়া মেয়েটাও আসে। মনে হয় ওর নিজের সংসার। আমি কিছু বললি মানুষটার কান ভাঙানি দেয়। আর মানুষটা আমারে মারে। আমারে বাপের বাড়ি পাঠায়ে দিতি চায়।’

কথা শেষ হতেই বধূটি নীলুর চাদরে চোখ মোছে। সংসারের অভিজ্ঞতা নীলুর নেই। সে কি করবে বুঝতে পারে না। চুপ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু ঘেন্না হয় তপনের প্রতি, ঐ নির্লজ্জ রুপালী নামের অচেনা মেয়েটির প্রতি। এরপর বাবার বাড়ির কথা বলতে শুরু করলো বধূটি, ‘আমি গৃহস্থ বংশের মেয়ে। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। বড় আদরে মানুষ হইছি। কপাল দোষে আজ আমার এই অবস্থা।’

কথা শুনেই নীলু বুঝেছে মেয়েটি সরল। কিন্তু নির্বোধ নয়। চোখে মুখে বুদ্ধিদৃপ্তির ছাপ। কিন্তু অভিমানী। তার ভেতর ব্যথায় চৌচির হয়ে যাচ্ছে। তাই হয়তো আবেগে গড় গড় করে তাকে সব কথা বলছে।

চোখের জল মুছে ফেললো বধূটি। বললো, ‘এখানে আপনি একা থাকেন?’

নীলু যেন ঘোরের মধ্যে ছিল। বধূটির কথায় ঘোর কাটলো। বললো, ‘হ।’

‘আপনার ভয় করে না?’

‘না। ভয় কিসের!’

হারিকেনের আবছা আলোয় ঘরের চারদিকে চোখ বোলাতে লাগলো বধূটি। তারপর মেঝেতে এক কোনার দিকে হাঁড়ি-পাতিল দেখে বললো, ‘আপনি রান্না করতি পারেন?’

নীলু যেন খানিকটা লজ্জা পেল। বললো, ‘ঐ একটু-আধটু পারি।’

‘ওমা আপনি লজ্জা পাচ্ছেন কেন! রান্নার গুণ সবার থাকা উচিত। আমার এক মামাতো দাদা খুব ভাল রান্না করে।’

বধূটি এখন যেন ভুলেই গেছে যে তার স্বামী তার-ই সৎ মাসতুতো বোনের সাথে রাত কাটাচ্ছে। শুরুর আড়ষ্ঠ ভাবটাও এখন কেটে গেছে। কন্ঠস্বর পরিষ্কার এবং মিষ্টি।

মাসখানেক আগে মদন মিস্ত্রিকে দিয়ে বানানো তাকের দিকে তাকিয়ে আছে বধূটি। উপরের তাকে রাখা বাঁশের মোথা দিয়ে বানানো নারীর মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে আছে। তার পাশে আরেকটি অসম্পূর্ণ মুখমন্ডল। নিচের তাকে কয়েকটি বাঁশের খন্ড। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে হাত দিয়ে ধরে দেখে বধূটি বললো, ‘আপনি তো বেশ সৌখিন। আমার মামাতো দাদার এসবের খুব সখ। শিল্পী মানুষতো। খুব ভাল গান গায়। সৌখিন জিনিসে তার ঘর বোঝাই। কিন্তু বাঁশের মোথার এমন সুন্দর মূর্তি আমি তার ঘরেও দেখিনি। আপনি এটা কোথা থেকে কিনছেন?’

প্রশ্ন করেই নীলুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো উত্তরের অপেক্ষায়। নীলু সংকোচ বোধ করছে। তবু বললো, ‘কিনি নাই। আমি-ই একটু চেষ্টা করছি বানাবার। ভাল হয় নাই। যেমন বানাবার চাইছিলাম তেমন পারি নেই।’

নীলু কথা শুনে একটু অবাকই হলো বধূটি। ছোট-খাটো একজন বামন মানুষ। ছাতা মেরামত করে বেড়ায়। দেখে মনে হয় লেখা-পড়ার দৌড়ও তেমন নেই। এই মানুষ শিল্পের কি বোঝে! অথচ দিব্যি সুন্দর মুখটি বানিয়েছে। সে তার মামাতো দাদার সাথে নীলুকে তুলনা করার চেষ্টা করে। তার দাদার চুল বড় বড়। বেশির ভাগ সময় পাঞ্জাবী পড়ে। ঘাড়ে ঝোলা থাকে। ভারি ভারি কথা বলে। চল-চলনে গাম্ভীর্য। দেখেই তাকে শিল্পী শিল্পী মনে হয়। আর একে দেখে তো কিছু মনেই হয় না! মনে হয় ছাতা সারার জন্যই সে জন্মেছে। অথচ বলছে কিনা এসব আমি বানিয়েছি! মনে সন্দেহ, তবু মুখে বললো, ‘ওমা, আপনার কতো গুণ! আমি তো শুনেছি আপনি শুধু ছাতা সারেন। এখন দেখছি আপনার গুণের শেষ নেই!’

লজ্জা পেল নীলু। মাথা নিচু করে চুপ করে রইলো। বধূটি যতোটা প্রশংসা করছে শিল্পকর্মটি অতটা ভাল হয়নি তা সে নিজেও জানে। কপালের ফিনিশিং ভাল হয়নি। নাকটা থেবড়ে গেছে। অথচ সে চেয়েছিল চোখা নাক। থুতনিটাও মন মতো হয়নি। তবে সে সবে শিখছে। পরেরটাতে চেষ্টা করছে আরো নিখুঁতভাবে কাজ করতে।

হঠাৎ করেই নীলুর মাথায় এই খেয়াল চেপেছে। স্টেশন মাস্টারের ছেলে শোভন চারুকলায় পড়ার কারণে তার বাড়িতে শিল্পকর্মের ছড়াছড়ি। ওর ঘরে অনেক রকম ছবি আর ভাস্কর্য আছে। সেই সব ভাস্কর্য দেখেই তার মাথায় হঠাৎ ভাস্কর্য বানানোর খেয়াল চেপেছে। তার তো এমনিতেই অনেক সময় নষ্ট হয়। একটু চেষ্টা করে দেখলে তি কি! পারলে পারবে, না পারলে না পারবে। এই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু করেছে সে। রামঙ্গল পালার গায়েন হওয়া তার কপালে নেই। তাই বলে সেই আক্ষেপে তো আর গোটা জীবন থেমে থাকছে না। সে গাওয়ালে যাচ্ছে, রান্না করছে, খাচ্ছে। সবই করছে। অবসর সময়টুকু অপচয় না করে নিজে নিজে ভাস্কর্য বানালে তো তি কি! যেই ভাবা সেই কাজ। অধীর কামারকে দিয়ে বিভিন্ন মাপের কয়েকটি বাটাল বানিয়েছে। হাতুরী, শিরিষ কাগজ, যা যা লাগবে মনে করেছে কিনেছে। বশির আলীর বাঁশ ঝাড় থেকে বাঁশের মোথা আর বাঁশ কিনে এনেছে। হাবিবের স’মিল থেকে কিছু কাঠ কিনেছে। ঝোঁকের মাথায় এতো আয়োজন করেছিল সে। কিন্তু কাজে হাত দিয়েই বুঝেছে এ অসীম ধৈর্য্যের কাজ। যতটা সহজ সে মনে করেছিল, ততটা সহজ না। সময় এবং ধৈর্য্য তার ঠিকই আছে। কিন্তু যেমনটা চাইছে, তেমনটা করতে পারছে না। এজন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছে।

বধূটি বিছানায় বসে বালিশে হেলান দিয়েছিল। গল্প করতে করতে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। হারিকেনের আলো খেলা করছে তার মুখের উপর। অবচেতনেই নীলু দেখছে তাকে। টকটকে ফর্সা রঙ। এ গ্রামে সে এমন সুন্দরী বউ দেখেনি। এতো কাছ থেকে দূরের কথা, এর আগে সে মা ছাড়া অন্য কোন ঘুমন্ত নারীকে দেখেনি। কি নিষ্পাপ দেখাচ্ছে! চোখের পাতায়, পাপড়িতে, ঠোঁটে, চিবুকে যেন মায়া খেলা করছে। ঘুমন্ত নারী এতো মায়াবী হয়! ছোট্ট কপালে জ্বল জ্বল করছে সিঁদুরের ফোঁটা। তার মনে হচ্ছে এমন দৃশ্য দেখতে দেখতে এমনি ভাবে রাত জেগে বসে সে হাজার রাত কাটিয়ে দিতে পারে। বধুটি নড়ে খানিকটা উঠলো। নীলুও যেন সম্বিত ফিরে পেল। নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিল সে। ছিঃ নীলু! একজন অসহায় নারী বিপদে পড়ে তোর কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তোকে বিশ্বাস করে তোরই বিছানায় অবোধ বালিকার মতো ঘুমাচ্ছে। আর এই সুযোগে তুই তাকে হ্যাংলার মতো দেখছিস? ছিঃ! আত্মলজ্জায় লজ্জিত হয়ে সৌন্ধর্য পিয়াসী দু-চোখ নামিয়ে দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল খোলা দরজা দিয়ে বাইরের অন্ধকারে। বাইরে তাকাতেই তার শীতের অনুভূতি তীব্র হলো। মনে হলো খোলা দরজা দিয়ে শীত হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকছে। চারিদিকে কোন সাড়াশব্দ নেই। শুধু ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কানে তালা দিচ্ছে। এখন রাত একটার কম না। কি করবে সে বুঝতে পারছে না। ঘরে একজন পরনারী। লোক জানাজানি হলে শুধু নিন্দাই হবে না, অপমানিত হয়ে তাকে এই এলাকা ছাড়তে হবে। তখন শীতের তীব্রতা অনুভব করে ঝোঁকের মাথায় বধূটিকে ঘরে এসে বসতে বলেছিল আগু-পিছু কিছু না ভেবেই। কিন্তু এখন নানান চিন্তা তার মাথায় ভর করছে। বধূটি তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সে কি ভোর অব্দি বসে থাকবে? ঘুমে তার দু-চোখের পাতা ভেঙে আসছে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে ভোরে যদি দু-জনের কেউ-ই টের না পায় তবে তো সর্বনাশ হবে! সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে উঠলো নীলু। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে লেপটা টেনে দিল বধূটির গায়ে। বিভোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক। কিন্তু সে ভেবে পাচ্ছে না। বধূটি তাকে এতো বিশ্বাস করলো কেন? হাজার হোক পরপুরুষ তো! তার উপর আগে যার সাথে কখনও কথা হয়নি। অথচ এক কথায় সে তার সাথে চলে এলো। আবার হাই তুলে বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এতো আস্থাশীল সে কিভাবে হলো? নিশ্চয় লোকমুখে তার সম্পর্কে কিছু জেনেছে। এখানকার মানুষের কাছে ভাল মানুষ হিসেবে তার সুনাম আছে। নাকি তাকে অপৌরুষেয় বামন ভেবে তাচ্ছিল্য করলো বধূটি!

মেঝেতে পাটি পেতে তার উপর দুটো কাঁথা পেতে নিল সে। মিতের বালিশটা বিছানা থেকে নিচে নিয়ে এলো। অতিরিক্ত একটা ছোট পাতলা কম্বল আছে। তাক থেকে কম্বলটা বের করে মেঝেতে রাখলো। হারিকেনের আলো কিছুটা কমিয়ে কম্বলটা গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। শোয়ার কিছুণ পরই বিদ্যুৎ এলো। বাতি জ্বলে উঠলো ঘরে। উঠে বাতি নিভিয়ে আবার শুয়ে পড়লো নীলু। পাতলা কম্বলে শীত মানছে না। তার উপর নিচ থেকে ঠান্ডা উঠছে। কিন্তু কিছু করার নেই। একটা রাত তাকে কষ্ট করতেই হবে এই অসহায় অতিথির জন্যে।

নীলুর যখন ঘুম ভাঙলো তখন ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ঘরে আলো ঢুকছে। টিনের ছিদ্র দিয়ে ঢুকে ঝক ঝক করছে আলোর রেখা। ঘুমের ঘোর কাটতেই সে অনুভব করলো সে মেঝেতে শুয়ে আছে। তার গায়ে লেপ। গা থেকে লেপ সরিয়ে ধড়মড় করে উঠে বসে বিছানার দিকে তাকালো। বিছানা শূন্য। হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে। বোধহয় আলো ফোঁটার আগেই বধুটি চলে গেছে। দরজা ভেজানো। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে। সে ঘুমাচ্ছিল তাই বোধ হয় তাকে না ডেকেই চলে গেছে বধূটি। বিছানায় চাদরটা ভাঁজ করে রেখে গেছে। আর লেপটা দিয়ে গেছে তার গায়ে। অদ্ভুত এক ভাললাগা ছড়িয়ে পড়লো তার সমস্ত শরীরে-মনে। বধূটির প্রতি মায়া বেড়ে গেল। মা ব্যতিত এই প্রথম কোন নারী তার গায়ে লেপ টেনে দিয়েছে। লেপটা নিয়ে সে বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়লো। লেপের ওম্ নিবিড় ভাবে অনুভব করলো শরীরে। বধূটির মুখ ভেসে উঠলো চোখের সামনে। মায়াবী মুখ, মায়াবী লেপ!

এরপর মাঝে মাঝেই বধুটিকে তাড়িয়ে দিতে শুরু করলো তপন। এখন মারতে এলেই পালিয়ে যায় বধুটি। জানে, বিছানায় পড়লে সকাল হবার আগে আর হুশ ফিরবে না। তাই বধুটি চলে আসে নীলুর কাছে। ভোররাতে ফিরে যায়। এখন আর মোটেও কাঁদে না বধুটি। কষ্ট সয়ে গেছে। নীলুর সাথেও এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। বন্ধুর মতো। সুখ-দুঃখের গল্প করে, হাসি-ঠাট্টা করে। নীলুর জীবন কাহিনী শোনে। এভাবেই কেঁটে যায় সময়। বধুটি এখন নীলুকে সখা বলে সম্ভোধন করে। নীলুও বধুটিকে রাঙাবউ বলে ডাকে। নীলু নিজের লেখা ও সুর করা গান রাঙাবউকে শোনায়। রাঙাবউ তন্ময় হয়ে শোনে। তার গানের প্রশংসা করে।

রাঙাবউ মাঝে মাঝে সখার জন্য এটা ওটা খাবার নিয়ে আসে। ভাল কিছু রান্না করলেই আঁচলের নিচে করে নিয়ে আসে। একদিন নীলু নিষেধ করে বললো, ‘এইডে কিন্তু ঠিক হতেছে না রাঙাবউ। দাদা জানলি তোমারে মারবেনে আর লোকে শুনলেও ছিঃ ছিঃ করবেনে।’

রাঙাবউ অভিমান করে বললো, ‘খাবা না তো? তাহলে কাল থেকে আর রাঙাবউয়ের মুখ দেখতি পাবা না।’

নীলু বললো, ‘রাগ করো না রাঙাবউ। আমি তোমার ভালোর জন্যই কোতেছি। তাছাড়া অমন একটা অমানুষের রোজগারের কিছু খাতি আমারও ভাল লাগে না।

রাঙাবউ আঁচলে চোখ মুছে বললো, ‘স্বামীর মনেই যখন জায়গা হলো না। আমার আর ভাল দিয়ে কি হবি সখা! একটু থেমে রাঙাবউ আবার বললো, ‘রোজগারের কথা বললে তো সখা? আমি বাড়িতে কাজ করি না? আর বিয়ের সময় আমার বাপের বাড়ি থেকে যে এতগুলো টাকা আনলো সেগুলো কি ওর!’

আর কিছু বললো না নীলু। রাঙাবউয়ের আনা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে শুরু করলো। আর রাঙাবউ চেয়ে চেয়ে সখার খাওয়া দেখতে লাগলো।

কয়েকদিন পর একরাতে রাঙাবউ বললো, ‘সখা, আমারে নতুন একটা জীবন দিবা তুমি? দিবা সত্যিকারের সংসার!’

নীল রাঙাবউয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললো, ‘তুমিও আমার সাথে ঠাট্টা করছ রাঙাবউ! করবেই তো। বামনের সাথে সবাই ঠাট্টা করে, তুমি ক্যান করবা না!’

রাঙাবউ অভিমানের সুরে বললো, ‘তুমি বামন বলে আমি তোমারে নিয়ে কখনও ঠাট্টা করছি সখা?’

‘না তা করোনি।’ বললো নীলু।

‘আমি অন্তর থেকে কইছি, তোমার যাযাবর জীবনে আমায় সঙ্গী করে নাও।’

‘ছিঃ! অমন কথা বলে না রাঙাবউ। তোমার স্বামী আছে।’

‘আমার স্বামী যে কেমন আছে তা তো তুমি দেখতিই পাচ্ছো।’

‘তবু তো তোমার স্বামী।’

‘তুমিও আর পাঁচজনের মতো কথা কইলে সখা! তুমি না শিল্পী!’

নীলু চুপ করে রইলো। রাঙাবউও কিছুণ চুপ করে থেকে বললো, ‘ মেয়েরা পুরুষ মানুষের মন বোঝে সখা। সত্যি করে বলতো আমায় তোমার মনে ধরেনি?’

নীলু মেঝেতে চোখ রেখে বললো, ‘মিথ্যে কব না রাঙাবউ। তুমি যখন হাসি-তামাশা করো, তখন আমার বুকের ভেতরটায় তোলপাড় করে ওঠে। আমার ভেতরে সংসারের বাসনা জাগে রাঙাবউ। কিন্তু আমি সব চাপে রাখি। তোমারে নিয়ে আমি কত গান বাঁধেছি। তোমারে শুনাইছিও। তুমি বুঝবার পারছো কিনা জানি না।’

রাঙাবউ মৃদু হেসে বললো, ‘তোমার গানের অর্থ আমি ঠিকই বুঝেছি সখা। তাইতো মনে মনে নিজেকে তোমায় সঁপে দিয়েছি। তুমি মানুষটা ছোট হতি পারো কিন্তু তোমার ভেতরে অনেক বড় একজনের বাস। তোমার ভেতরে যা আছে, আমার লম্বা-চওড়া স্বামীর মাঝে তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। তুমি অনেক বড় মানুষ।’

‘কিন্তু রাঙাবউ, এ যে পাপ!’

‘তুমি তো আমায় জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছো না সখা। আমি স্বেচ্ছায় তোমার সাথে যাচ্ছি। দিনের পর দিন আমার উপর অন্যায়-অত্যাচার করা হচ্ছে। শারীরিক-মানসিক অত্যাচারে আমি খাঁচার পাখির মতো হাঁফায়ে উঠছি সখা। এই বন্দী জীবন থেকে তুমি যদি আমায় মুক্তি দাও, এতো পাপ নয়। আমি মুক্তি চাই সখা। এই শেকল বাঁধা জীবন থেকে মুক্তি চাই। তুমি আমারে মুক্তি দেবে না সখা!’

রাঙাবউ নীলুর হাত ধরলো। নীলু রাঙাবউয়ের চোখের দিকে তাকালো। চোখের মনিতে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় হাজার বন্দী পাখির ডানা ঝাঁপটা-ঝাঁপটি। রক্ত ক্ষরণ। শক্তি খুঁজে পেল সে রাঙাবউয়ের চোখের দৃষ্টি থেকে। রাঙাবউয়ের হাত শক্ত করে ধরে বললো, ‘চলো রাঙাবউ।’

রাঙাবউ হাসতে গিয়ে কেঁদে ফেললো। নীলুকে জাপটে ধরলো বুকের সাথে। রাঙাবউ টের পেল নীলু কাঁদছে। নীলুর চোখের জল রাঙাবউয়ের বুকে পড়ে দুই স্তনের মাঝখানের উষ্ণ সরোবর দিয়ে গড়িয়ে গেল নিচের দিকে। কিন্তু তপ্ত ঢেউ ছড়িয়ে পড়লো রাঙাবউয়ের সারা শরীরে। দুহাতে নীলুর মুখটা তুলে ধরে চোখের জল মুছিয়ে দিল। নীলু রাঙাবউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার চোখ থেকে এখন গড়িয়ে পড়ছে নোনা জলের ধারা। হঠাৎ তার ঠোঁটে নোনা ঢেউ আছড়ে পড়লো।

ভাটার টানে ঢেউ থেমে গেলে নীলু বললো, ‘চলো রাঙাবউ, আমরা আজ ভোরেই পালায়ে যাই।

রাঙাবউ নীলুর চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললো, ‘ আজ নয় সখা। কাল ভোরে আমরা কোথাও চলে যাব। আমার কিছু সোনার গহনা আছে। বিয়ের সময় বাবা-মা আমারে দিছিলো। ওগুলো নিয়ে যাব।’

‘ওসবের দরকার নাই রাঙাবউ।’

‘না সখা। গহনা গুলো নিয়ে যাই। বিপদে কাজে লাগবে। তুমি শিল্পী মানুষ। সংসারের জ্ঞান তোমার একদম নাই। আমরা দূরে গিয়ে সংসার পাতবো। সেখানে গিয়ে তুমি শুধু তোমার শিল্পচর্চা করবা। গান লিখবা, ভাস্কর্য বানাবো। আর আমি, সংসার সামলাবো।’

নীলু বাচ্চা ছেলের মতো রাঙাবউয়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। বললো, ‘তোমারে নিয়ে আমি নতুন করে গাওয়ালে বের হবো।’

পরদিন সন্ধ্যাবেলা রাঙাবউ এসে ছোট্ট একটা পুটলিতে সোনার গহনা আর কিছু টাকা রেখে গেল নীলুর কাছে। যাতে রাতে খালি হাতে বেড়িয়ে আসতে পারে।

রাত বাড়ছে। নীলু রাঙাবউয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। জিনিস-পত্র সব গুছিয়ে রেখেছে। ভোর হলেই দুজনে চলে যাবে। কিন্তু রাঙাবউয়ের দেখা নেই। তার তো এখনই চলে আসার কথা। আসছে না কেন? নাকি তপন আজ বাইরে থেকে মদ খেয়ে আসেনি? ঘুমায়নি? তাহলে বোধহয় রাঙাবউ একবারে ভোরেই আসবে। তবু সে ঘর থেকে বের হলো। প্ল্যাটফরমে পায়চারি করতে লাগলো। সুনসান রাত্রি। এই সময় রেললাইনের পাশে এসে দাঁড়ালে, ঘুমন্ত রেললাইনের দিকে তাকালে ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। কিন্তু আজ তার ভেতরে হাহাকার নেই। আজ উত্তেজনার তুমুল ঢেউ। ঘরে ফিরে এলো নীলু। বিছানায় গা এলিয়ে ভাবতে লাগলো। ইচ্ছে মতো সাজাতে লাগলো অনাগত দিনের স্বপ্ন।

নীলুর যখন ঘুম ভাঙলো, যখন তখন বেলা অনেক হয়ে গেছে। টিনের ছিদ্র দিয়ে রোদ এসে পড়েছে ঘরে। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলো সে। ভাবলো, ‘যা! ঘুমায়ে পড়ছিলাম। রাঙাবউ বোধহয় আসে আমারে ডাকে সাড়া না পায়ে ফিরে গেছে।’ নিজের ওপরই সে খুব বিরক্ত হলো। রাগে নিজের গা খামচে ধরতে ইচ্ছে করছে। আবার ভাবলো, নাকি রাঙাবউ-ই ঘুমায়ে পড়ছে, আর জাগে নাই! দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে এলো নীলু। বারান্দা থেকে নেমে রেললাইনের ধারে গিয়ে দাঁড়িয়ে তপনের বাড়ির দিকে তাকালো। পুকুর পাড়ের গাছের ফাঁক দিয়ে উঠোনের একটু অংশ দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বাড়িতে অনেক মানুষ। পুকুরের পশ্চিম পাড়েও মানুষ। বাড়িতে ঢোকার রাস্তায়ও মানুষ। অতো মানুষ ক্যান ও বাড়িতে? এক পা দু-পা করে খানিকটা এগিয়ে গেল নীলু। হ্যাঁ তাইতো, অনেক মানুষের ভিড় উঠোনে। বাজারের অনেক মানুষ। গনেশ ময়রা, হানিফ, আকতার আরো অনেকে। নীলুর বুকের মধ্যে ঢিপ ঢিপ করতে লাগলো। কিছু একটা ঘটেছে ও বাড়িতে। নইলে এতো মানুষ আসবে কেন! তপনের মা মরে গেছে নাকি! নাকি রাঙাবউয়ের কিছু....। এই শীতেও ঘামছে নীলু। পা ভারী হয়ে আসছে। সে যত দ্রুত হাঁটতে চাইছে, ততই পা ভারী হয়ে আসছে। পথ যেন কিছুতেই ফুরোচ্ছে না। কিছুতেই না...।







মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.