নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিশু মিলন

মিশু মিলন

আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।

মিশু মিলন › বিস্তারিত পোস্টঃ

পরানপুরাণ

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৩:২৫

এক

নাভির নিচে তুলির শেষ পোঁচ দিয়ে ভবতোষ কুঁজো অবস্থা থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো প্রতিমার মসৃণ বুকের ওপর। কোমর ধরে গেছে তার, মেরুদণ্ড টনটন করছে। সামান্য তফাতে হাঁটু ভাঁজ করা বাঁ পা ঊরুর কাছে আর ডান পা ছড়িয়ে বসে দু-হাতের আঙুলে কেশ বিন্যাস করছে সাধু, প্রতিমার দীর্ঘ কালো কেশ। সাধুর মুখে সিগারেট। পর পর কয়েকটা টান দিয়ে সিগারেট বাড়িয়ে দিলো ভবতোষের দিকে। ভবতোষ সিগারেট হাতে নিয়ে বেশ লম্বা একটা টান দিলো। পাকানো ধোঁয়া ছাড়লো প্রতিমার বুকের কাছে, ঊর্ধ্বমুখী ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লো মুখেও; নির্বিকার সরস্বতী প্রতিমা!

খুক খুক করে বার কয়েক কাশলো সাধু। কাল রাতে মাথার কাছের জানালাটা খোলা ছিল। ভোরবেলার বালিকা শিশিরের আদরমাখা শীতল বাতাসে ঠাণ্ডা লেগেছে তার। ভবতোষ সিগারেটটা সাধুর হাতে ফেরত দিতে দিতে বললো, ‘কাল তালি পদ্মবিলে যাতেছিস?’

‘হ, আমি ছাড়া তো আর উদ্ধার নাই!’ সিগারেটে টান দিলো সাধু।

ভবতোষ ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দিয়ে বললো, ‘গঙ্গাছিনান করতি সখিপুর যাবেন নাকি?’

সাধুর হাঁ করা মুখ থেকে মোলায়েম ধোঁয়ার রিং বের হলো পর পর কয়েকটা। যেন ধোঁয়ার ভেতর উত্তাল গঙ্গার ঢেউয়ের ফণা দেখছে এমন ভাবে তাকিয়ে বললো, ‘পদ্মিবিলে যাবো আর অহানতে সখিপুর যাবো না গঙ্গািছনান করতি, তাই অয় নাকি! গঙ্গায় ডুব তো দেবোই, পারলি ডুবে মরবো!’

হাসলো দু’জনই। সখিপুর এবং গঙ্গাছিনান দুটোই ওদের প্রতীকী শব্দ! ভবতোষ আবার সরস্বতী প্রতিমার নাভির নিচে তুলির পোঁচ দিতে শুরু করলো। রঙের কাজ শেষের পথে। শুধু সরস্বতীর আংশিক আর কার্তিক বাকি। কাল থেকে শুরু হবে চুল লাগানো, কাপড় পরানো আর সাজসজ্জার কাজ। সবশেষে চক্ষু দান।

ভবতোষের বাবা ভবেশ পাল প্রায় বছর ত্রিশেক যাবৎ এই শিবগঞ্জ গ্রামের প্রতিমা গড়ার কাজ করছেন। ভবতোষ নয়-দশ বছর বয়স থেকেই বাবার সাথে প্রতিমা গড়তে আসা শুরু করেছে। পা ছড়িয়ে বসে কাঁচা মাটি দিয়ে পুতুল গড়তে গড়তে, বাবাকে এটা-সেটা এগিয়ে দিতে দিতে, যোগালিয়ার কাজ করতে করতে এক সময় সেও হয়ে উঠেছে নিপুণ প্রতিমা শিল্পী। এখন ভবতোষের বয়স পঁচিশ, বাবার চৌষট্টি। এখন সে প্রধান প্রতিমাশিল্পী, বাবা তার যোগালিয়া।

ভবেশের বয়স হয়েছে। চোখের জ্যোতি কমায় রাতের বেলা রঙের কাজ নিখুঁতভাবে করতে পারেন না। তার ওপর হাঁপানির রোগী। এই খোলা মন্দিরে রাতে কাজ করলে তার হাঁপানি বেড়ে যায়। আশ্বিন প্রায় শেষ। রাতে মৃদুমন্দ শিশির পড়ে, হালকা শীতল বাতাস বয়, হাঁপানির রোগীর তা সয় না। তাই ভবতোষ বাবাকে রাতে কাজ করতে দেয় না।

সন্ধ্যার পরপরই ভবেশ শুতে চলে যান। এ বছর তাদের থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন গিরীশ মাতব্বর। একেক বছর, একেকজন অবস্থাপন্ন এবং মাতব্বর গোছের লোক এই দায়িত্ব নেয়।

সন্ধ্যার পর ভবেশ চলে গেলেও একা হয় না ভবতোষ। গ্রামের ছেলে-ছোকরা, মাতব্বর গোছের লোকজন আসে-যায়। সবাই চলে যাবার পরও থাকে সাধু। ভবতোষের কাজে সাহায্য করে। সেই বাঁশ চাছা থেকে শুরু করে প্রতিমার সাজসজ্জা পর্যন্ত সব কাজেই থাকে সাধুর হাতের ছোঁয়া। গিরীশ মাতব্বরের বাড়ি থেকে ভবতোষের জন্য মন্দিরেই খাবার আসে। কিন্তু রাতের বেলা সে শোয় সাধুর সঙ্গে। দুজনের বন্ধুত্ব এমনই গাঢ় যে, মাঝে মাঝে সাধুও বেড়াতে যায় ভবতোষদের বাড়িতে।

সাধু এই গ্রামেরই ছেলে, ভবতোষের সমবয়সী। ভবতোষ যখন বাবার সাথে প্রথম আসে এই গ্রামে, তখন থেকেই সাধুর সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ভবতোষ তখন বাবাকে এটা-সেটা যোগান দিতো। সাধু এসে বসে থাকতো প্রথম প্রথম। ভবতোষ কাঁচামাটির পুতুলবউ বানালে সে বানাতো পুতুলবর। তারপর সেও কাজে হাত লাগাতো। সাধুর তো আর অন্যদের মতো স্কুলে যাবার তাড়া ছিল না। স্কুলের পাট সে ক্লাস থ্রি-তেই চুকিয়েছিল। অন্য ছেলেরা যখন পূজার ছুটি কখন হবে সেই অপেক্ষায় মুখিয়ে থাকতো, স্কুলে যাওয়া-আসার পথে মন্দিরের খুঁটিতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পিঠ ঘষতে ঘষতে ভবেশের মূর্তি গড়া দেখতো আর মাঝে মাঝে সাধুর দিকে ঈর্ষাকাতর দৃষ্টি ছুড়ে দিতো; সাধু তখন তাদের দিকে গর্বিত চোখে তাকাতো আর দ্বিগুণ উৎসাহে ব্যস্ততার ভান করতো। সেই অন্য ছেলেরা বড় হয়ে কবেই লেখাপড়ার জন্য গ্রাম ছেড়েছে। কিন্তু সাধু এখনও আছে সেই বাল্য-কৈশোরের সাধুর মতোই! এখনও মূর্তি গড়ার সময় মন্দিরের মেঝেতে পশ্চাৎদেশ ঘষতে ঘষতে সময় পার হয় তার।

সাধুর আসল নাম সাধন। সাধু তার ডাক নাম। এই ডাক নামের পিছনে তার একান্ত নিজস্ব এক ইতিহাস আছে। ছেলেবেলায় গ্রামে কোনো সাধু-সন্ন্যাসী এলে তার পিছন পিছন ঘুরতো সে। জটাধারী অথবা লম্বা চুলের, গেরুয়া কিংবা লাল বসন পরিহিত সন্ন্যাসীদের মুগ্ধ হয়ে দেখতো। আগন্তুক সন্ন্যাসীরাও এমন ন্যাওটা পেয়ে খুশি হতেন। দিব্যদৃষ্টি সুলভ চোখে তাকিয়ে তামাটে দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে কালচে ময়লা দাঁত বের করে মৃদু হেসে তার মাথায় হাত রাখতেন। পরক্ষণেই আবার গম্ভীর হয়ে বিড়বিড় করে মন্ত্র জপতেন।

একবার এক সন্ন্যাসী সাধুর মাকে বলেছিল, ‘বেটিয়া, তোর ব্যাটা বহুত সাধু আছে, দিব্যজ্ঞানী হইবে!’

তারপর আশির্বাদ প্রদান এবং দক্ষিণা গ্রহণপূর্বক সাধু সাধু বলতে বলতে প্রস্থান করেছিল সন্ন্যাসী। সেই আনন্দেই সাধুর মা দু-দিন গোপনে কেঁদে চোখের পাতা ফুলিয়েছিল। আর ছেলের সাধন নাম ঘুচিয়ে ডাকতে শুরু করেছিল সাধু বলে। সেই থেকেই সাধন হলো-সাধু।

সাধুর বাবা বাজারে সবজির ব্যবসা করে, খুচরা ব্যবসায়ী। সাধুরা দু-ভাই, এক বোন। বোনটার বিয়ে হয়েছে চৌদ্দ বছর বয়সে। বড় ভাই বিধান বাবাকে সবজির ব্যবসায় সাহায্য করে, সাধুও করে মাঝে মাঝে। খেয়ে পরে চলে যায় তাদের সংসার। সন্ন্যাসীর ভবিষ্যৎ বাণী শোনার পর থেকেই সাধুর মা ডিমের বেশিটা, মাছের বড় টুকরোটা সাধুর পাতেই দিতো। দিব্যজ্ঞানী হলে সাধু যদি আমিষ ত্যাগ করে! মায়ের মন!

ঐ সন্ন্যাসীদের পিছনে ঘুরতে ঘুরতে চৌদ্দ বছরেই দিব্যজ্ঞান লাভ করেছিল সাধু, এক সন্ন্যাসীর গাঁজার পোটলা চুরির মাধ্যমে! গাঁজা তো হলো কিন্তু কলকে? সাধু তখনো জানতো না যে বিড়ি-সিগারেটের তামাক ফেলে দিয়ে তাতে গাঁজা ভরেও সেবন করা যায়। ওর ধারণা ছিল গাঁজা কেবল কলকেতেই টানতে হয়, এবাড়ি-ওবাড়ি ত্রিনাথের পূজায় বড়দেরকে কলকেতেই গাঁজা টানতে দেখেছিল। ফলে তক্কে তক্কে থেকে সেদিন বিকেলেই পকেটে গাঁজা আর বুকে সাহস নিয়ে বিনয়দের গোয়ালঘর থেকে হাত-ছাফাই করলো কলকে, ক’দিন আগেই ত্রিনাথের পূজা হয়েছিল বিনয়দের বাড়িতে, গাঁজা-ভাঙ সেবনের পর কলকের ভেতরে দড়ি ঢুকিয়ে গিঁট দিয়ে গোয়ালঘরের বেড়ায় ঝুলিয়ে রেখেছিল বিনয়ের বাবা। সাধু তা জানা ছিল। এরপর অনিলদের পোড়ো ভিটেয় গিয়ে কলকের ভেতর নারকেলের ছোবড়া ঢুকিয়ে গাঁজা সাজিয়ে সন্ন্যাসীকে অনুকরণ করে আপন মনে কলকে টানলো প্রায় ফুরোনো বিকেলে। দিব্যজ্ঞান পেয়ে বসলো তাকে। সূর্যদেবের দর্শন লাভ করলো পাশের গ্রামের মণ্ডলদের নারকেল গাছের মাথায় লাল টকটকে তিনটে সূর্য দেখার মাধ্যমে!

তারপর সেই বিকেল ফুরোনো সন্ধ্যায় বাঁশঝাড়ে শালিকেরা হাজার কণ্ঠে গাইলো ওদের ভাষায় পুরবী রাগ-খেয়াল! থেমেও গেল। বকফুল গাছ থেকে ডেকে উঠলো কোকিল। সাধু শুধু হাসলো। হাসতে হাসতে কোকিলের ডাকের অনুকরণ করলো, ‘কু..উ...!’ তারপর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে গেল, আর ঘাসের ওপর শুয়ে কেবল হাসতে লাগলো, হাসতেই লাগলো....!

পরদিন সকালে বকফুল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যখন সন্ন্যাসীর ত্রিশূলের মতো রোদ্দুর পড়লো চোখের কোমল পাতায়, তখন সাধু আড়মোড়া ভাঙলো। চোখ মেলে দেখলো বকফুল গাছের ডালে তিড়িং-বিড়িং করছে দুটো চড়ুই। ওদের নাচানাচিতে কয়েকটি শুকনো পাতা ঝরে পড়লো তার মুখের ওপর। বিস্ময়ে ধড়মড় করে উঠে বসলো সে। সামনে সবুজ ধানক্ষেতে চকচক করছে রোদ্দুর। দূরের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে কেউ। তার সামনে একটা মোষের গাড়ি। দৃষ্টি গুটিয়ে আনলো সে, পোড়ো ভিটের পশ্চিমেই পুকুর। পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে অনিলের ঠাকুমাকে পুড়িয়েছিল। পোড়া-বাঁশ-কয়লা এখনও চোখ মেলে আছে। এখানে কেন সে! দৃষ্টি আরো সংকুচিত করলো আর পরমুহূর্তেই দৃষ্টি স্থির হলো সামনে পড়ে থাকা কলকেটার ওপর। এক ঝটকায় তার সব মনে পড়ে গেল। কাল বিকেলে সে গাঁজা টেনেছিল। আর এখন সকাল। তার মানে সে এখানেই ঘুমিয়েছে রাতে! বাড়ির লোক কি তার খোঁজ করেছে? নিশ্চয় করেছে। কিন্তু খুঁজে পায়নি তাকে। বাড়িতে গিয়ে কি বলবে? ধুর! বলবে একটা কিছু। শুরুর বিস্ময়, ভয় কাটিয়ে উঠলো সাধু। তারপর পায়ের কাছ থেকে কলকেটা হাতে নিয়ে নাকের কাছে ধরে গন্ধ শুকলো। মুখ টিপে হাসলো, অতঃপর কলকেটা জামার পকেটে রেখে বাড়ির পথে পা বাড়ালো।

এই ঘটনার আগেই বাবার পকেট থেকে মাঝে মাঝে বিড়ি চুরি করতো সে, আর গাঁজার সেবনের পরপরই পুরোদস্তুর সিগারেট ধরেছিল; ঐ চৌদ্দতেই। ষোলোয় পা দিয়ে ধরেছিল সুভাসের আধপাগলী মেয়েটার বুক, তারপর সারা শরীর। আধপাগলী মেয়েটা ওকে একা করে কয়েক মাস পরেই মরেছিল সাপের কাপড়ে। আর আঠারোতে সাধু ধরেছিল ওদের ভাষায় সখিপুরের পথ!

সরস্বতী প্রতিমার রঙ করা শেষ। ভবতোষ তুলি-হাত ধুয়ে খুঁটিতে বাঁধা গামছায় হাত মুছতে মুছতে বললো, ‘চল, যাইগে।’

সাধু চুলগুলো গুছিয়ে রাখলো মন্দিরের একপাশে। পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে ভবতোষের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘ধরা’।

দুই বন্ধু হাত বদল করে সিগারেট টানতে টানতে নির্জন রাতের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো গল্প করতে করতে। হেমন্ত নিঃশ্বাস ফেলছে শরতের ঘাড়ে; প্রকৃতিতে কিছুটা শীতল আবহ, রাত যতো বাড়ে ততো বেশি অনুভূত হয়।
সারা গ্রাম এখন সুনসান। দু-একটি বাড়িতে বিজলি বাতি জ্বলছে। গাছের পাতার ফাঁক গলে ঠিকরে বেরোচ্ছে আলো। মাত্রই কয়েক মাস হলো বিদ্যুৎ এসেছে গ্রামে।

পিছনে টিং টিং শব্দ হলো। উঁচু-নিচু মাটির রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছে সুশীল ডাক্তার। কাছে এসে ডাক্তার বললেন, ‘সাধু নাকি রে?’
‘হ কাকা।’
‘প্রতিমার কাজ কদ্দুর?’
‘পিরায় শ্যাষের দিক।’
‘অ।’

ওদেরকে ছাড়িয়ে দূরে চলে গেলেন সুশীল ডাক্তার। ওরা আবার নিজেদের আলোচনায় ফিরলো। দু’জনের আলাপের মধ্যেও আগামীকালের অনাগত রাতটির কথা মনে করে বুকের ভেতরে এক অদ্ভুত শিরশিরানি অনুভব করলো সাধু। সেটা ছড়ালো সারা শরীরে। ভাল লাগায় আপ্লুত হয়ে দারুণ জোশে সিগারেটের গুহ্যদ্বারে একটা লম্বা সুখটান দিলো!

পরদিন বেলা দশটা নাগাদ পদ্মবিলে এসে পৌঁছলো সাধু। আরো আগেই আসতে পারতো। মাঝ পথে বাসটা নষ্ট হয়ে গেলে পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে, পাকা চল্লিশ মিনিট পর এসেছে বাস। তাও সে কী গাদাগাদি ভিড়! ঐ ভিড়ের মধ্যেই ঠেলেঠুলে উঠেছিল সে।

পদ্মবিলের পাড়ে এসে দাঁড়ালে চোখ জুড়িয়ে যায়। বিশাল বিল। বিলের শরীরের ভাঁজে ভাঁজে অসংখ্য পদ্মফুল ফুটে আছে। পূজা-পার্বণে মানুষ এখান থেকেই পদ্মফুল সংগ্রহ করে। দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ আসে। আশ-পাশের অনেক মানুষ দূর্গাপূজা-লক্ষ্মীপূজার সময় পদ্মফুল তুলে নিয়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি করে। বর্ষাকাল আর শরৎকালে বিলে ঘুরতেও আসে প্রচুর মানুষ। ভাড়ায় নৌকা পাওয়া যায়।

সাধু রাস্তা থেকে নেমে কাঁশফুলের ভেতর দিয়ে পায়ে চলা পথে হাঁটতে লাগলো। এদিকে জল ওঠেনি, তাই শুষ্ক চড়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কাঁশবন। অসংখ্য কাঁশফুল যেনবা শরতের আকাশের আয়নায় তাকিয়ে বাতাসে মাথা দুলাচ্ছে, আকাশের বুকের সাদা মেঘ যেন কাঁশফুলের প্রতিচ্ছবি! সাধু হারিয়ে গেল কাঁশবনের শরীরে।

মিনিট খানেক পর দেখা গেল কাঁশবনের কোল থেকে বেরিয়ে নৌকার বহরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সাধু।
নৌকার ভাড়া ঘণ্টা প্রতি। সাধু একটা নৌকা ভাড়া করলো। যতোক্ষণ বিলে থাকবে ততোক্ষণের ভাড়া দেবে। বিলে ঘুরে ঘুরে তুলবে পদ্মফুল। কালকের দিন বাদে পদ্মফুল ঠাঁই পাবে দেবী দূর্গার চরণে!

বিলে বাতাস বইছে। আকাশে মেঘের ছুটোছুটি; না, আছড়ি-পিছাড়ি! ক্ষণে ক্ষণে মেঘ ফুঁড়ে ঠিকরে বের হচ্ছে তেজী সূর্য, আর তখনই বিলের পশ্চিমদিকের গাছ-গাছালির চোয়ালের-ঠোঁটের-চুলের ফাঁক দিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসছে একটি টিনের বাড়ির চালা। সে ঐ ক্ষণিক ক্ষণিক-ই। তারপরই জেদি মেঘ পিঠ পেতে দাঁতে দাঁত চেপে খাচ্ছে রোদের চাবুক! বৃষ্টি নামবে নিশ্চিত, ছিটে ফোঁটাই হোক আর অঝোর ধারায়-ই হোক।

নৌকা এখন বিলের মাঝখানে চলে এসেছে, এদিকটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পদ্মফুল। মাঝি ধীরে ধীরে বাইছে নৌকা, কখনও থামছে। সাধু একটি একটি করে পদ্মফুলের কুড়ি বা আধফোটা পদ্মফুল তুলে গুছিয়ে রাখছে নৌকার পাটাতনে। ফুটন্ত পদ্মফুল নিলে এক-দুদিনেই পাপড়ি ঝরে যায়, তাই নিতে হয় পদ্মকুড়ি বা আধফোটা ফুল।

ফুটন্ত ফুলগুলোতে মৌমাছিরা বসছে, আবার উড়ছে। নিশ্চয় বিলের পাড়ের গৃহস্থবাড়ির কোনো গাছে অস্থায়ী বসতি গড়েছে ওরা। সেখান থেকে এই মাঝ বিলে এতোদূরে চলে এসেছে মধু সংগ্রহের জন্য। এই নিভৃত বিলে মধু সঞ্চয়কালে হঠাৎ মানুষের আগমনে ওরা বিরক্ত হয়ে উড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে বসছে অন্য ফুলের ওপর। একই কারণে জলপোকাগুলোও জায়গা পরিবর্তন করছে।

সাধু নৌকার পাটাতনে হাঁটু মুড়ে জলের দিকে ঝুঁকে ফুল তুলছে। মেঘে-বিলে এখন রোদের আধিয়ারি। সাধুর মাথার ছায়া পড়ছে পদ্মপাতায়-জলের ওপর; পড়ছে পদ্মফুলের ছায়াও, পদ্মপাতায়-জলে। সবুজ সতেজ এবং মরে আসা হলুদ পদ্মপাতায় পায়চারি করছে নানান রকম জলজ পোকা। একটা জলঢোঁড়া পদ্মপাতার বুক বেয়ে ডুব দিলো জলের তলে। কয়েক মুহূর্ত পর আবার জলের ভেতর থেকে শ্যাওলার টুপি মাথায় উঁকি দিলো। সাধু মুখে হুস হুস শব্দ করে সেদিকে জল ছিটাতেই আবার ডুব দিলো জলঢোঁড়াটি। আর দেখা গেল না।

সেই ছোটবেলা থেকে সাধু শুনে আসছে পদ্মফুলে সাপ থাকে, পদ্মফুলকে জড়িয়ে ফণা তুলে ভ্রমরের সাথে খেলা করে। খেলা নাকি যুদ্ধ! সুশীল ডাক্তারের বাড়ির দেয়ালে টাঙানো একটা ছবিতে দেখেছে যে শ্রীকৃষ্ণ পদ্মফুলের ওপর দাঁড়িয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে আর তাঁর মাথার ওপর ছাতার মতো ফণা তুলে আছে সাত মাথার সাপ। সাত মাথার ফণা তোলা সাপ দূরে থাক, এক মাথার ফণা তোলা সাপও এই বিলে কোনোদিন দ্যাখেনি সে! দেখেছে ঐ নির্বিষ জলঢোঁড়া! অবশ্য ভ্রমর দেখেছে মাঝে মাঝে। আজও দেখেছে একটা, নিঃসঙ্গ কালো ভ্রমর!
সত্তরটি ফুল তোলা হয়েছে। দূর্গাপূজার জন্য আরো আটত্রিশটি ফুল লাগবে। অবশ্য একশো আটটিতেই থেমে যাবে না সাধু। সে অন্তত দেড়শো ফুল তুলবে। ক’দিন বাদেই ল‏‏ক্ষ্মী পূজা। তখন পদ্মফুল লাগবে। তাই পাড়া-পড়শিরা প্রতিবছরই সাধুর কাছে আবদার করে পদ্মফুলের। সাধু বঞ্চিত করে না তাদের।

কিছুক্ষণ জিরানোর জন্য নৌকার পাটাতনে পা ছড়িয়ে বসলো সাধু। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে আজাদের উদ্দেশে বললো, ‘সিগারেট খাও?’
নৌকার মাঝি ছেলেটার নাম আজাদ। বয়স কুড়ি-একুশ হবে। দেখে মনে হয় আরো কম, সতেরো-আঠারো। শ্যামলা, গোলগাল চেহারা। মুখের হাসিটি সুন্দর। দেখেই বোঝা যায় ছেলেটি সরল। দুনিয়ার গরল বিষয়গুলো এখনও ওকে স্পর্শ করতে পারেনি।
‘হ, খাই।’ উজ্জ্বল হলো আজাদের মুখ।

আজাদের কোলের ওপর একটা সিগারেট ছুড়ে দিলো সাধু। তারপর নিজে একটা ধরিয়ে দুটো টান মেরে জলন্ত সিগারেটটা আজাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘বাড়ি কই তুমার?’

‘ঐ যে উচো তালগাছ দ্যাহা যায়, তার পুব পাশে।’ বাওড়ের পশ্চিমদিকের একটা তালগাছের দিকে আঙুল তুলে দেখালো আজাদ।
সাধু তালগাছ থেকে চোখ ফেরালো আজাদের মুখে। সিগারেটটা ফেরত নিয়ে বললো, ‘বিয়ে করছো?’
লাজুক হাসি হাসলো আজাদ। ঘাড় নেড়ে বললো, ‘না’।
‘পেমিকা আছে?’
আচম্বিত এমন প্রশ্নে যেন আরও লজ্জা পেল আজাদ। সাধু আবার বললো, ‘লজ্জার কী আছে! থাকলি কও।’
মুখ টিপে হেসে একটু জোর দিয়ে টেনে বললো আজাদ, ‘না, নাই!’

সাধু হাসলো। সিগারেট টানতে টানতে কী যেন ভাবতে লাগলো। হয়তো কোনো পুরনো স্মৃতি মনে পড়েছে! সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে জলে ছুড়ে দিলো। মৃদু তরঙ্গ উঠলো জলে। আর সেই মৃদু তরঙ্গের তোড়ে জলপোকাগুলো তরঙ্গবুক বেয়ে পরি-মরি করে নিরাপদ দূরত্বের দিকে ছুটলো।

পায়ে পায়ে আবার সরে গেছে রোদ্দুর। বিলের ওপর মেঘ এখন যেন কিছুটা নিথর। বাতাস কমে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আজাদকে তাড়া দিলো সাধু, ‘আগাও, আগাও।’

উত্তরের দিকে নৌকা এগোতে লাগলো। সামান্য দূরত্বে আরো কয়েকটি নৌকা নিয়ে ফুল তুলছে কিছু মানুষ। কলার ভেলায় চড়ে ফুল তুলছে একটি শ্যামলা কিশোরী আর দুটি উদোম গায়ের কিশোর। কিশোর দুটির পরনে কাঁছা মারা গামছা। পূজা উপলক্ষে ওরা ফুল তুলে বাজারে বিক্রি করে।

ওদের তিনজনকে দেখে নিজের কৈশোরের কথা মনে পড়ে গেল সাধুর। বর্ষার সময় ওদের গ্রামের পশ্চিম পাশের বিলে অনেক জল হয়। সাধুর ছেলেবেলায় কোনো কোনো বছর সেই জল ধাবিত হতো গ্রামেও। থাকতো কিছুদিন। তারপর একসময় বর্ষারানি তার ভরন্ত সংসারের ছানাপোনা-সাপ, ব্যাঙ, মাছ, কচ্ছপ, নানান রকম জলজ পোকামাকড়; কিছু ফেলে, কিছু নিয়ে লোকালয় ছেড়ে বিলে নামতো। শীতের সময় বিলও শুকিয়ে যেতো। এখনও বিলে জল হয়, কিন্তু সে জল গ্রাম অব্দি পৌঁছয় না। নদীতে বাঁধ পড়ায় বিলের অমন দৈন্যদশা!

তখন ভরা বর্ষায় বড়রা কলাগাছের ভেলা বানাতো। সবার তো আর নৌকা বানানোর সামর্থ্য ছিল না। গ্রামের নিন্মবিত্তদের জন্য ভেলাই ছিল বর্ষার একমাত্র কাণ্ডারি। তারা ভেলা নিয়ে হাট-বাজার করতো, আত্মীয়স্বজন কে কেমন আছে খোঁজ-খবর নিতো। বড়দের কাজ শেষে ভেলার যখন একটু অবসর মিলতো, তখনই অবসর ভাঙতে হাজির হতো সাধুরা। সাধু, তুলিকা, নিমাই, দীপন, নীলা। সবাই অবশ্য একইদিনে থাকতো না, এক-দুজন অনুপস্থিত থাকতোই। তবে সাধু থাকতো রোজ। ওর কোনো বাঁধন ছিল না। না স্কুলের, না পরিবারের। তার মতো ভেলা বাইতে কেউ পারতো না। ওই বয়সেও শরীরের মজবুত গড়ন আর অদম্য সাহসও ছিল।

একদিন দুপুরবেলা সাধুর মা বললো, ‘কডা শাপলা তুলে আন দিনি। বড়া ভাজে দিবানে।’

চললো সাধু শাপলা তুলতে। অন্যের ভেলা নিলে প্রায়ই বকা খেতে হতো। তাই সে বছর নিমাই আর দীপনকে সঙ্গে নিয়ে নিজেরাই একটা ভেলা বানিয়েছিল। সাধু বিলের ধারে এসে দেখলো ওদের ভেলাটা যেখানে রাখা থাকে সেখানে নেই। কে নিলো? নিমাইরা? না, ওরা নিশ্চয় স্কুলে গেছে। তবে কে নিলো? যে-ই নিক আচ্ছা মতো ঠ্যাঙাবে। ভেলা বানাতে অনেক ধকল গেছে। সুশীল ডাক্তারের কলাবাগান থেকে সন্ধেবেলা বিচিকলার গাছ চুরি করে আনতে হয়েছে সাপ-খোপের ভয় উপেক্ষা করে! সেই সাধের ভেলা আরেকজন বাইবে, তা হবে না। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলো সাধু। কিন্তু ভেলার দেখা নেই। পাশেই তখন সুবলদের ভেলাটা ঢেউয়ের তালে নাচছিল। সাধু আশপাশে তাকিয়ে দেখলো কেউ নেই। তারপর দড়ি খুলে ঐ ভেলাতেই চড়ে বসলো। রোদহীন দিন, মাথার ওপরে নকুলের ঠাকুমার ময়লা ভেজা থানের মতো মেঘলা আকাশ। বাতাসে সুভাষের পাগলী মেয়েটার গায়ের জোর! বিলে তখন প্রচণ্ড ঢেউ, ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে রাস্তায়। মাটির রাস্তার পাড় ভাঙছে। প্রতিবারই ভাঙে। ভাঙতে ভাঙতে চওড়া রাস্তা সরু হয়ে যায়, রাস্তার পাশের জমির মালিকের লোভী কোদালের কোপে রাস্তার ধ্বসে যাওয়া অংশ চাষের জমি হয়ে যায়। বছর বছর রাস্তা কমে আর চাষের জমি বাড়ে। গায়ে মাখে না কেউ!

আউশ ধান জলের অনেক উপরে উঠে গেছে। আউশের সবুজ ক্ষেতের ভেতর দিয়েই জলের সাদা পথ। একটা দুইটা নয়। অনেকগুলো পথ। যার যেখান দিয়ে খুশি ডিঙ্গি নৌকা বা ভেলা চালিয়ে দেয়, আর নতুন নতুন পথ পড়ে। ধানগাছগুলো শুয়ে পড়ে। এই কাজটা বেশি করে যারা রাতে জাল পেতে মাছ ধরে তারা।

সাধু ভেলা বাইতে লাগলো। আউশের ক্ষেত পাড়ি দিয়ে যেতে হবে গভীর বিলের দিকে। ওদিকটায় অথৈ জল। অনেক শাপলা। একেকটা শাপলার ডাটা প্রায় মানুষ সমান লম্বা। সাধু নৌকা থামালো। ধানক্ষেতের কোল ঘেঁষে কেউ জাল পেতেছে। জালের টোন নড়ছে, ধানগাছ নড়ছে। বোধহয় শোল-মাগুর কিছু আটকেছে জালে! সে হাতের বাঁশ দিয়ে জাল উঁচু করে ধরলো। কোথায় শোল? মস্ত এক জলঢোঁড়া জড়িয়ে আছে জালে! যতোই মুক্ত হবার চেষ্টা করছে ততোই জড়িয়ে যাচ্ছে। সামান্য দূরত্বে জালে জড়ানো একটি জ্যান্ত টাকি ভীত চোখে সাপের কসরত দেখছে এবং নিজেও মুক্ত হবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। সে সতর্কভাবে টাকিমাছটাকে মুক্ত করে দিলো।

সাধু কান খাড়া করলো। ধানক্ষেতের ওপাশ থেকে কারা যেন নিচু স্বরে কথা বলছে। আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। আবার শোনা গেল কথা। কথা বোঝা যাচ্ছে না। সাধু সন্তর্পণে জাল নামিয়ে ভেলা বেয়ে বাম পাশের ধানক্ষেত অতিক্রম করলো। দুটো ধানক্ষেতের মাঝখানে তাকালো সে, নিমাই!

পরক্ষণেই নিমাইয়ের মাথার পাশ দিয়ে বের হয়ে তুলিকার বিস্ফারিত চোখ পড়লো সাধুর চোখে! দু-হাতে ধরে থাকা তুলিকার মাথা ছেড়ে দিয়ে নিমাইও ঘুরে তাকালো বিস্ময়ে! সাধু ক্ষিপ্রতার সাথে ভেলার মাথা ঘুরিয়ে জলের বুক কুপিয়ে চললো বিলের গভীরের দিকে। বুকের ভেতরটা মুচড়ে যেতে লাগলো ঈর্ষায়। ঈর্ষার গহ্বরে জন্ম হলো ক্ষোভের। আর সেই ক্ষোভ গিয়ে পড়লো নিরীহ ভেলার ওপর। বিকেলে গিয়ে দা দিয়ে কুপিয়ে ফালা ফালা করলো নিজ হাতে বানানো ভেলা! তারপর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন ভেলার পাশে বসে কাঁদলোও!

সাধু আনমনে হাসলো। আজ এতোদিন বাদে পদ্মবিলে এই তিনটে কিশোর-কিশোরীকে দেখে তার মনে পড়লো সে-দিনের ঐ ঘটনাটা। ‘শালা নিমাইটা একটা হারামী!’ মনে মনে গাল দিল নিমাইকে। তুলিকাকে ল্যাঙ মেরে এখন এক শহুরে মেয়ের সাথে প্রেম করছে। তাকেই নাকি বিয়ে করবে। আর ল্যাঙ খেয়ে তুলিকা বিয়ে করেছে এক উকিলকে।

সাধুর ছেলেবেলার বন্ধুরা সবাই শিক্ষিত। কেউ চাকরি করছে, কেউ এখনও পড়ছে। ওদের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হয়েছে অনেক আগেই। ওরা যখন লেখাপড়ার জন্য গ্রাম ছেড়েছে তখন থেকেই। তারপর তো সাধুর গায়ে বখাটে ছেলের তকমা লেগেছে, গাঁজাখোর-মাগিবাজের তকমা লেগেছে! গ্রামে এলেও সবাই ওকে এড়িয়েই চলে। কেবল দীপন বাড়ি এলে ওর সাথে কথা বলে, খোঁজ-খবর নেয়। সাধুর তখন অন্যদের কথা মনে পড়ে, শৈশবের কথা মনে পড়ে। মন খারাপ হয়।

বৃষ্টি শুরু হলো। পুরো বিল এখন ভিজছে। পদ্মফুল-পদ্মপাতা ভিজছে, কলমীলতা-শালুকফুল জলে হাবুডুবু খাচ্ছে, মৌমাছি, জলপোকারা পদ্মফুলের বুকের কন্দরে লুকোতে চাইছে। ডিঙ্গি নৌকায় ছই নেই। বড় একটা ছাতা রাখে আজাদ। সেটার নিচেই দুজন আশ্রয় নিলো। অঝোর ধারায় নামছে বৃষ্টি। বিলের পাড়ের গ্রামগুলো এখন ঝাপসা। বালিহাঁসগুলো হুটোপুটি খাচ্ছে। পানকৌড়িগুলো থম মেরে বসে আছে কলমী লতার ওপর। দারুণ মিষ্টি একটা গন্ধ এখন ভাসছে বিলে। পদ্মফুলের গন্ধ নয়, শালুকফুলের গন্ধও নয়; বিলের শরীরের গন্ধ, জলের উলঙ্গ বুকের গন্ধ, বৃষ্টি পেয়ে উথলে উঠেছে। আজাদ ছাতা ধরে আছে মাথার ওপর। সাধুর চোখ পদ্মফুলে। পদ্মফুলে হাসছে সখিপুরের মেয়ে!

দুই

রাত পোহালেই দেবী দূর্গাকে খাটে চড়ানো হবে। প্রতিমার সাজ-সজ্জার কাজ শেষ। দেবীকে বরণ করার সকল আয়োজন শেষ। কিন্তু সাধুর দেখা নেই! গতকাল-ই ফেরার কথা তার। অথচ কাল রাত গিয়ে, আজ দিন ফুরিয়ে সন্ধে উতরে আবার রাত, তবু সাধুর দেখা নেই! পূজা কমিটির সভাপতি অশোক নন্দী চিৎকার-চেঁচামেচি করে সাধুর পিণ্ডি চটকে বাড়ির দিকে গেছেন। অন্য মাতব্বরেরাও গজগজ করতে করতে বাড়িমুখো হয়েছেন।

রাত বাড়তে লাগলো। ছেলে-ছোকরারা মন্দিরের চাতাল ফাঁকা করে ঘরে ফিরে গেল। এখন মন্দিরের বারান্দায় বসে সংযমী তিনজন নিজেদের অন্তরের সংযম ভুলে দেবতাদের সামনে সাধুর স্বভাব-চরিত্র নিয়ে নানান কথার রঙিন যে জাল বুনছে, তা শুনে দূর্গার পিছনের কৃত্রিম পাহাড়ে অধিষ্ঠিত কামপটু মহাদেবের শরীরে প্রাণ থাকলে তিনিও হয়তো কিছুটা বিব্রত বোধ করতেন!

এ বছর মন্দিরের সংযমীর দায়িত্বে আছে ষাটোর্ধ্ব আরতী দিদিমা, বছর চল্লিশের দুলাল আর মধ্য ত্রিশের গৌর। আরতি দিদিমা মন্দিরের পাশেই সুবলদের ঘরে শোবে। দুলাল আর গৌর শোবে মন্দিরের বারান্দায়। গল্প করতে করতে হঠাৎ আরতি দিদিমার চোখ উল্টে গেল! তার এই এক অদ্ভুত স্বভাব, এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকলেই চোখে ঘুম নেমে আসে! ঘুমোলে চোখের পাতা অর্ধ-নিমীলিত থাকে, মণি’র অর্ধেকটা থাকে পাতার আড়ালে আর অর্ধেকটা বাইরে; ভয়ংকর দেখায়! গৌর মুখ টিপে হেসে দুলালকে খোঁচা মেরে আরতী দিদিমাকে দেখালো।

‘ও দিদিমা।’ ডাকলো দুলাল।
ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বসলেন আরতি দিদিমা, ‘সাধু আসলো রে?’
দুলাল বললো, ‘না। সাধুর আশায় বসে থাকলি, শুকতারা ডুবে যাবেনে। তুমি যাও, ঘুমাও গে।’

কাপড়ের আঁচল মাটি থেকে কুড়িয়ে ব্লাউজবিহীন চিমসে স্তন দুটো ভালমতো ঢেকে আঁচলটা কাঁধের ওপর ফেলে আরতি দিদিমা শুতে গেলেন। বিছানা পেতে গৌর আর দুলালও শুয়ে পড়লো।

সারা গ্রাম এখন সুনসান। মন্দির প্রাঙ্গণ খাঁ খাঁ করছে। গৌর শোয়া মাত্রই নাক ডাকতে শুরু করেছে। দুলালের ঘুম আসি আসি করছে। সুবলদের কুকুর কালু ওর সাধনসঙ্গীনিকে নিয়ে মন্দিরের চাতালে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। তখনই মন্দিরের চাতালের সামনের রাস্তায় একটা ভ্যান এসে দাঁড়ালো। কালু ঘাড় উঁচিয়ে দেখলো আর কালুর সাধনসঙ্গীনি ঘেউ ঘেউ করতে করতে ভ্যানের দিকে তেড়ে গেল। ভ্যান থেকে নামলো সাধু, অন্য সময় হলে সে হাত উঁচিয়ে মুখ খিস্তি করে কুকুরটির দিকে তেড়ে যেতো, ‘চুপ কর খানকি-মাগি!’

কিন্তু এখন বললো, ‘এই চুপ কর, আমি আমি।’

সাধুকে চিনতে পেরে নীরবে থমকে দাঁড়ালো কুকুরটি! মাটির রাস্তায় ভ্যানের শব্দ আর কুকুরের ডাকে আগেই ঘাড় উঁচিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়েছে দুলাল; গলা শুনেই সাধুকে চিনতে পেরেছে সে, কিন্তু সাধুর সাথে কিডা? বিটিমানুষ মনে অয়! সাধু আর তার সঙ্গের মানুষটি মন্দিরের চাতাল পেরিয়ে বারান্দার কাছে এসে দাঁড়াতেই দুলাল সোজা হয়ে বসলো ওদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে, কম বয়সী বউ-ই তো ঠ্যাহে!

সাধু পদ্মফুলের ব্যাগটা দুলালের হাতে দিলো। দুলাল হতবাক হয়ে একবার সাধুর দিকে আরেকবার বউটির দিকে তাকাতে লাগলো।
‘কী, আহাশের তে পড়লে মনে অতেছে! আগে রাহে আসো তারপর কোতেছি।’ বললো সাধু।

দুলাল ব্যাগটা মন্দিরের ভেতরে রেখে এসে সাধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বেত্তান্তডা ক দেহি?’
‘আমার বউ।’
‘অ্যাঁ...! সত্যি?’ দুলালের কণ্ঠে অবিশ্বাসের সুর।
‘তয় মানষির বউ ধরে আনছি নাকি!’ এরপর বউয়ের উদ্দেশে বললো, ‘পোনাম করো, ইনি দুলাল কাকা।’

প্রণাম গ্রহণ শেষে দুলাল গৌর’র পিঠে ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘অ গইরো, গইরো...। মরার মতো ঘুমাতেছিস! এই দ্যাখ হতচ্ছাড়া কামডা করছে কী! ক্ষ্যামতা আছে ব্যাটার। পিত্তিমের নাহাল বউ বিয়ে করে আনছে। অ গইরো...’
গৌর চোখে মুখে বিরক্তি ফুঁটিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বললো, ‘কী অইছে?’
‘দ্যাখ সাধুর বউ!’
গৌর কাঁচা ঘুমের রেশ কাটাতে কাটাতে উঠে বসলো।
‘বৌমার বাপের বাড়ি কনেরে?’ দুলালের প্রশ্ন।
‘ঐ তো পদ্মবিলের দিকেই।’

সাধুর বউয়ের মুখের দিকে তাকাতেই গৌর যেন খানিকটা চমকালো! ঘুমের রেশ যেটুকুবা ছিল তাও নিমেষেই মিলিয়ে গেল। বউয়ের চোখ থেকে দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো সাধুর দিকে।
‘এহন আর দাঁড়াবো না কাকা। কাল সহালে আসপানে।’

বউকে নিয়ে চলে গেল সাধু। গৌর স্থির চোখে ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো গালে হাত দিয়ে।
দুলাল চিৎ হয়ে শুয়ে বললো, ‘সাধুর বউডা ফাইন অইছে নারে?’
‘হুম!’

দুলাল চোখ বুজলো। কালুর সাধনসঙ্গীনি কালুর মুখে সোহাগ বুলিয়ে পুনরায় আগের জায়গায় শুয়ে পড়লো। গৌর’র চোখের ঘুম ছুটে গেছে, সে গালে হাত দিয়ে বসেই রইলো!

পরদিন সকালে গ্রামে খবর ছড়িয়ে পড়লো সাধু বিয়ে করেছে। সুন্দরী বউ। পাড়া-পড়শিরা দলে দলে দেখতে এলো সাধুর সুন্দরী বউ। সাধুর মা আহ্লাদে আটখানা, বউয়ের জন্য কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না, তার ভাঙা ঘরে যে এমন চাঁদের মতো বউ এসেছে!

সপ্তমীর রাতে সবাই যখন ঘুমালো, তখন সাধু দরজায় শিকল তুলে চুপি চুপি বউকে নিয়ে বাড়ির সামনের কালভার্টের ওপর এসে বসলো। বিছানায় শুয়ে যে বউকে আদর করতে করতে নিরিবিলি দুটো মনের কথা বলবে, সে উপায় কী আছে! চাটাইয়ের বেড়ার ওপাশেই যে বাপ-মা ঘুমায়!

কালচে অন্ধকারে হালকা শিশির পড়ে রাতের শরীর ক্রমশ ভারী হচ্ছে যেন। এখন নৈঃশব্দের প্রহর। তবু নৈঃশব্দের গা থেকেই যেন পলেস্তারার মতো খসে পড়ছে কিছু শব্দ। রাস্তার ধার ঘেঁষা বাবলা গাছের পাখির বাসায় থেকে থেকেই খসখস শব্দ হচ্ছে। কালভার্টের দক্ষিণের ডোবার মাথায় ঘন কোঁকড়া চুলের মতো কচুরীপানা, ওই কচুরীপানার ভেতর থেকেই একটা অদ্ভুত ডাক ভেসে আসছে কিছুক্ষণ পরপর; কচ্ছপের ডাক। ওপাশের মাঠের জল ডোবায় এসে নামে, তারপর কালভার্টের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে নালা দিয়ে নেমে যায় বিলে। শীতের শেষে যখন জল শুকিয়ে যায়, তখন মাছের সাথে কাদার গভীরে কচ্ছপও পাওয়া যায় ডোবায়।

ওরা দুজন কালভার্টের ওপর বসলো পা ঝুলিয়ে। পায়ের নিচে কলকল শব্দ, কালভার্টের মুখ দিয়ে জল নেমে যাচ্ছে ইংরেজি বর্ণ এল আকৃতির নালা বেয়ে বিলে। ওরা কখনও পাশাপাশি বসে একে অন্যের কাঁধে মাথা রেখে, কখনও একজন আরেকজনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে, কখনও একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে চাঁদটাকে ডুবিয়ে তবেই ঘরে ফিরলো।

অষ্টমী পূজার দিন সাধু আর তার মায়ের সাথে নতুন বউ অঞ্জলি দিতে গেল মন্দিরে। মন্দিরের চাতালে পা দিতেই সমবেত নারী-পুরুষের মধ্যে শুরু হলো কানাঘুষা। সবাই সাধুর বউয়ের দিকে তাকাচ্ছে, নিজেদের মধ্যে কানাকানি করছে, কেউবা মুচকি হাসছে। চরিত্রহীন, গাঁজাখোর, বখাটে সাধু আজ সকলের আলোচনার কেন্দ্রে অবস্থান করছে। অথচ সাধু বা তার মা কেউ-ই তা টের পাচ্ছে না। টের পেলো তখন, যখন সাধুর মা নতুন বউকে নিয়ে মন্দিরের বারান্দায় উঠতে গেল দেবী দূর্গাকে প্রণাম করার উদ্দেশ্যে।

সাধুর মা মন্দিরের বারান্দায় পা দিতেই নলিনী গোঁসাইয়ের বউ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘খবরদার সাধুর মা, ঐ বউ নিয়ে তুই বারান্দায় উঠপিনে!’
সাধুর মা অবাক, ‘কী কতা কন মা গুসাই! নতুন বউ মারে পোনাম করবিনে?’
‘এ...বেবুশ্যের আবার সগ্গে যাবার সখ!’

কাছেই ছিল সাধু। বেবুশ্যে শব্দটা কানে যেতেই সে ঘুরে তাকালো নলিনী গোঁসাইয়ের বউয়ের দিকে। সাধুর মা কিছু বলতে যাবে তার আগেই নলিনী গোঁসাইয়ের বউ আবার বললেন, ‘তোর ছাওয়াল যে বেশ্যা বিয়ে করে আনছে, এ খবর জানিসনে তুই! এই বউ ঘরে তুলছিস!’

বিস্ময়কর হলেও ঘটনা সত্য! পদ্মবিল থেকে পদ্মফুল তুলে সাধু গিয়েছিল ওদের ভাষায় সখিপুরে, যেখানে সখিরা থাকে, টাকার বিনিময়ে সখিদের কাছ থেকে সুখ কেনা যায়; অর্থাৎপতিতালয়ে। পূজা কমিটি গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে সাধুকে পদ্মফুল আনার দায়িত্ব দেয়, আর সাধু পদ্মফুল তোলার পর যায় পতিতালয়ে, তারপর বাড়ি ফিরে আসে। কোনো বছর বিপত্তি বাঁধেনি, বাঁধলো এবার।

মেয়েটা ছায়ার মতো নয়, চিকের আড়ালের আবছা আলোর মতোও নয়; দীপাবলির আলোর মতো উজ্জ্বল-মাধুরী! মাধুরী, মেয়েটার নাম।
পতিতালয়ে সাধু প্রায়-ই যায়। যার ঘরে ঢোকে তাকে তুই-তোকারি করে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এমন ভাব দেখায় যেন সে একজন ওজনদার খরিদ্দার। তাতে তার আপ্যায়নে ত্রুটি হয় না। দেখতে সে একেবারে সুপুরুষ না হলেও সুশ্রী, তার লেখাপড়া না জানার খামতিও সহজে ধরা পড়ে না।

দ্বিগুণ রেট দিয়ে এবার সে ঢুকেছিল মাধুরীর ঘরে। মাধুরীর রূপের আভায় থতমত খেয়ে গিয়েছিল প্রথমে। ‘তুই’য়ের বদলে মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল-‘তুমি’। আড়ষ্ট হাতে মাধুরীকে ছুঁয়েছিল ঘরের আলো নেভানোর পর। অবশ্য আড়ষ্টভাব কাটিয়ে উঠেছিল অল্পক্ষণেই। কামগঙ্গার নিপুণ সাতারু সাধু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গিয়েছিল এ গঙ্গায় স্রোত বড় কম, দু-কূল উছলানো লীলায়িত উল্লোল নেই, নেই ছলাৎ ছলাৎ শব্দও! কথায়ও চকচকে শাণিত ছুরির ধার নেই। পরিপাটি চেহারার মতো কথায় পরিপাটির সুস্পষ্ট ছাপ। বোঝাই যায় এ পাড়ার বুনট ধুলোর আস্তরণ, ঘন কাদার প্রলেপ মাধুরীর দেহ-মনের ওপর এখনও পুরু হয়নি। এ মেয়ে হয়তো নতুন! তাই কামবিদ্যা এখনও ভাল মতো রপ্ত করতে পারেনি, খরিদ্দার ধরে রাখার ছলাকলা শেখেনি। এখানকার মেয়েদের শুধু শরীরের ছলাকলা জানলেই হয় না, ছাল ছাড়ানো খানিকটা তেঁতুল, লবণ আর গুড় মেশানো কথাও জানতে হয়। আবার ধানি মরিচের ঝাঁঝও থাকতে হয়। মাধুরীর যেন কোনোটাই নেই! আছে অপূর্ব সুন্দর মায়াময় ফর্সা মুখমণ্ডল, মোহনীয় দেহবল্লরী আর মন কেমন করা দুটো চোখ। যে চোখদুটির কাছে নতজানু হয়ে গেছে সাধু।

‘তুমি নতুন?’ কামগঙ্গায় ডুবসাঁতার শেষে মাধুরীর পাশে রতিক্লান্ত শরীর রেখে বললো সাধু। তখনও ঘর অন্ধকার।
‘হুম।’ কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে বললো মাধুরী।
‘কদ্দিন হলো?’
‘তিন মাস।’
‘তোমার এতো সুন্দর চেহারা! এই লাইনে আসলে ক্যা?’
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মাধুরী। সাধু মাধুরীর মুখে, চুলে হাত বুলিয়ে ওর মাথাটা টেনে নিলো নিজের রোমশ বুকের কাছে।

মাধুরীর এখানে আসার গল্প এখানকার আর পাঁচটা মেয়ের মতোই চেনা গল্প। গ্রামের নিন্ম মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে। মফস্বল শহরের একটি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। কয়েকটি মেয়ের সঙ্গে মেসে থাকতো। ফোনে কথা হতো অচেনা এক ছেলের সঙ্গে। ছেলেটি ব্যাংকার, ঢাকায় নিজস্ব ফ্ল্যাটে বাবা-মা’র সঙ্গে থাকে, আর কোনো ভাই-বোন নেই, বাবা-মা দু’জনই সরকারী কর্মকর্তা ইত্যাদি; বলেছিল মাধুরীকে। অতঃপর প্রেম। সেদিন বিকেলে ছেলেটির হাত ধরে নৌকায় ঘুরতে বেড়িয়েছিল পদ্মার বুকে। ছেলেটির কাঁধে মাথা রেখে আগামী দিনের স্বপ্ন বুনছিল মাধুরী। কথা জানতো ছেলেটি। কথার মনোমুগ্ধকর বুননে আরেক জগতে নিয়ে যেতে পারতো। কী করে যে সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিল জানে না। যখন তন্দ্রা ভাঙলো, তখন সে সত্যি সত্যিই নিজেকে আবিষ্কার করলো আরেক জগতে, যে জগতের মোহে মানুষ রাতেরবেলা মৌমাছির মতো ভিড় করে!

অবশ্য সাধুকে সে অতীত জীবনের সব কথা খুলে বলেনি। সে যে শিক্ষিত, লেখাপড়া করতো, সে কথাও বলেনি। শুধু বলেছে, সে ভালবাসার মানুষটির সাথে ঘুরতে বেড়িয়েছিল। মানুষটি তাকে এখানে বেঁচে দিয়েছে।
‘আমারে তুমি বিয়ে করবা?’
আচম্বিত এমন প্রশ্ন শুনে মাধুরী প্রথমে থমকালো। তারপর বাম হাত দিয়ে সুইচ টিপে বাতিটা জ্বেলে সাধুর মুখের দিকে তাকালো। তার ভালবাসার মানুষটির মুখের সাথে মেলানোর চেষ্টা করলো সাধুর মুখ। এও কী আরেক প্রতারক? তাকে নিয়ে নতুন কোনো প্রতারণার ফাঁদ পাতছে?
‘মা কালির কিরে, তুমি যদি আমারে বিয়ে করো তালি আর কোনোদিন আমি মাগিপাড়া আসপো না। কোনো নেশাও করবো না।’ উলঙ্গ শরীরেই উঠে বসলো সাধু।
‘তুমি নেশা করো?’
‘করি। গিরামে আমার হেভি বদনাম। সিগারেট খাই, মাঝে মাঝে গাঁজা আর বাংলা মদও খাই।’

মাধুরীর তালগোল পাকিয়ে গেল। তাকে বিয়ে করতে চাইছে, আবার নিজের সম্পর্কে এমন একান্ত গোপন মন্দ স্বভাবের কথাও বলছে! নাকি তাকে নিয়ে কোনো ছক কষছে ও? এখান থেকে তাকে বের করে অন্য কোথাও বিক্রি করে দেবে? সে শুনেছে, দেহ বিকিকিনির এই রঙবাজারে তার নাকি দারুণ চাহিদা! এখানকার মাসি নাকি তাকে চড়া দামে ঢাকার একটা পার্টির কাছে বিক্রি করে দেবে। এরপর তার দেহসুধারস ঢালতে হবে দামী হোটেলে, ধনী খরিদ্দারের লালসার কামপল্লবে।

অতঃপর ভোর রাতে সাধুর হাত ধরে পালালো মাধুরী। কিছুদূর আসার পর পিছনে তাড়া করেছিল দালালরা। ধরতে পারেনি। গৃহস্থ বাড়ির উঠোন, আদাড়-বাদাড় পেরিয়ে পতিতালয়ের অল্প দূরত্বে নদীর পাড়ে এসে নৌকায় এসে উঠেছিল ওরা। ক্ষিপ্র গতিতে নৌকা বেয়ে সাধু তাকে নিয়ে অচেনা জনপদের ধার ঘেঁষে অনেকটা পথ অতিক্রম করে যখন শ্রান্তিতে বৈঠাখানা নৌকার ওপর তুলে রাখলো একটু জিরিয়ে নেবার জন্য, তখন সূর্য উঠে গেছে। তখন মাধুরীর মাথায় যুদ্ধ চলছিল। যে করেই হোক সাধুর কাছ থেকে তাকে পালাতে হবে। কিন্তু তারপর কী করবে? বাড়ি ফিরে যাবে? বাবা-মাকে কী বলবে? গ্রামের লোকজন তাকে দেখতে ভিড় করবে, তাদের কৌতুহলী প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবে সে। কোনো বিশ্বাসযোগ্য উত্তর কি সে তাদের দিতে পারবে? নাকি গত তিনমাসে বাবা-মা’র অন্তরে মেয়ে হারানোর থিতিয়ে আসা শোকের সাথে নতুন করে যুক্ত হবে অপমান? তাকে নিয়ে বিব্রত হবেন বাবা-মা। আবার সাধুর মতো অশিক্ষিত, চরিত্রহীন গোঁয়ারকেই বা সে কেমন করে বিয়ে করবে? যদিও সাধুকে বিয়ে করবে বলে সে কথা দিয়েছে। কিন্তু সে তো কেবল পালানোর জন্য! এলেমেলো চিন্তায় তার মাথার ভেতরে ঝড় বইতে লাগলো।

সাধু হঠাৎ বললো, ‘চলো, তোমারে তোমার বাড়ি পৌঁছে দেই।’
মাধুরী অবাক হয়ে তাকালো সাধুর দিকে।
সাধু আবার বললো, ‘আমি গরিবির ছাওয়াল। মানষি কয় বখাটে। তোমার পাশে আমারে মানাবেন না। তুমি বাড়ি-ই ফিরে যাও।’

গত তিনমাসে পুরুষজাতটার প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে মাধুরীর। তার কাছে পুরুষ মানেই প্রতারক আর দেহলোভী এক অদ্ভুত পিশাচ! সাধুকেও সে তাই মনে করেছে। বিয়ে করে আজীবন তার শরীরটাকে ভোগ করবে বলেই পতিতালয় থেকে তাকে মুক্ত করে এনেছে। অথচ সকালের আলোয় সাধুকে আবার নতুন করে চিনতে হচ্ছে।
‘নইলে এক কাজ করো। তোমার বাবা-মা’রে ফোন করো, তারা আসে তোমারে নিয়ে যাক।’
‘না।’
‘না ক্যান?’
‘তুমি না কইলে আমারে বিয়ে করবা?’
‘তুমি দেখতি কতো সুন্দর! আমার চেয়ে অনেক ভাল বর পাবা তুমি।’
‘কে আমারে বিয়ে করবে? আমি যে.....।’
‘ধুর! ওসব কতা ভুলে যাও। তুমি তো আর ইচ্ছে করে যাও নাই। অ্যাকসিডেন্ট! সংসারে থাহেও কতো মানুষ ছেনালিপানা করতেছে, আবার সংসারও করতেছে। তাগের চেয়ে বেশ্যারাও ভাল।’

বেশ্যা শব্দটা শুনেই জলের দিকে চোখ নামিয়ে নিলো মাধুরী। সাধু হয়তো সেটা বুঝতে পেরেই বললো, ‘তুমি কিছু মনে কোরো না। আমি অমনই। মুহি যা আসে কোয়ে ফেলি। তাছাড়া এহন তো তুমি আর বেশ্যা না।’

মাধুরী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে সাধুকেই বিয়ে করবে। সাধু পুরুষজাত, সাধু চরিত্রহীন। কিন্তু সাধু অন্যরকম। শুধু সঠিক পরিচর্যার অভাবেই হয়তো সাধু বখাটে হয়েছে। কিন্তু ওর ভেতরে ঘুমিয়ে আছে একজন ভাল মানুষ। সাধুর মতো আরো অনেক সাধুর জীবন হয়তো বখে যায় এমনিভাবে। কিন্তু সুললিত পরিচর্যা পেলে সাধুদের জীবনও যে সুন্দর হতো না তা কে বলতে পারে! সাধুকে আরেকবার বাজিয়ে দেখতে মাধুরী বললো, ‘আমার ইজ্জত নাই, লোকে আমারে মন্দ বলবে, এজন্যে তুমি আমারে বিয়ে করতি চাও না, না?’

সাধুর মুখটা কালো হয়ে গেল। এমনটা সে একবারের জন্যও ভাবেনি। এক অচেনা বাজারের ঘাটে নৌকা থামিয়ে সাধু খাবার আনতে গেল, ফিরে এলো মিনিট বিশেকের মধ্যেই। দুজনে রুটি-শবজি-ডিম খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করলো। কিছুদূর যাবার পর বৈঠাটা নৌকার পাটাতনে রেখে মাধুরীর কাছে গিয়ে বসলো। নৌকা স্রোতের টানে এলোমেলোভাবে ঘুরতে ঘুরতে ভাটির দিকে যেতে লাগলো।

‘বৈঠা তুলে রাখলে যে? নৌকা তো ডুবে যাবে!’ বললো মাধুরী।
‘ডুবুক! ডুবলি দুইজন একসাথে মরবো!’

সাধুর দৃঢ় উত্তর শুনে মাধুরী তার মুখের দিকে তাকালো, ‘কী হলো?’
‘সাধু কোনো কিছুতে ভয় পায় না, সাধুর কোনো লজ্জা-শরমের বালাই নাই, সাধু বুক ফুলাইয়ে কইতে পারে যে তার বউ তিনমাস বেশ্যাখানায় ছিল, সাধু কাউরে পরোয়া করে না!’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে পকেট থেকে একটা সিঁদুরের কৌটো বের করলো সাধু। দু-আঙুলে এক চিমটি সিঁদূর নিয়ে পরিয়ে দিলো মাধুরীর সিঁথিতে, কনিষ্ঠাঙ্গুলের মাথা সিঁদূরে ডুবিয়ে কপালে দিলো ফোঁটা! তারপর সিঁদুরের কৌটােটা মাধুরীর হাতে দিয়ে পদ্মফুলের ব্যাগ থেকে একটা পদ্মফুল বের করে পুনরায় মাধুরীর কাছে গিয়ে বললো, ‘নতুন বউরে দেবার মতোন কিছুই আমার নাই এই পদ্মফুল ছাড়া!’

পদ্মফুলটা মাধুরীর খোঁপায় পরিয়ে দিলো সাধু। মাধুরীর মুখ থেকে একটা কথাও বের হলো না। সে কেবল বিস্ময়ে সাধুর দৃঢ়তা দেখলো।মুহূর্তেই চোখটা ভারী হয়ে উঠলো। জল ছলছল চোখ সে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলো সাধুর দিকে।

মন্দিরের চাতালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কৌতুহলী লোকজন ঘন হয়ে এলো। তাদের দৃষ্টি উড়ছে মাধুরীর মুখে, সারা শরীরে। বেশ্যার শরীর-মুখ বলে কথা! আগত লোকের অনেকেই যেন শাড়ীতে আবৃত-অষ্টমীর সাজে সজ্জিত মাধুরীকে দেখছে না, দেখছে উলঙ্গ এক বেশ্যাকে!

পরিবেশ আর সাধুর অনুকূলে থাকলো না। মন্দিরের বারান্দায় বসে অঞ্জলি দেওয়া দূরে থাক। সাধুর পরিবারকে একঘরে করার কথা উঠলো, কথা উঠলো সস্ত্রীক সাধুকে গ্রামছাড়া করার। সাধুর মা চাতালের একপাশে বসে আঁচলে মুখ ঢেকে কপাল চাপড়ে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। সাধু বুঝলো কথা বলে আর কোনো লাভ নেই। এই সমাজে গৃহী-সংসারী পতিতার স্থান আছে, মাধুরীর মতো দূর্ঘটনার শিকার হওয়া পতিতার স্বীকৃতি নেই, সমাজে ঠাঁই নেই। এরপর সবাই তাকে নিয়ে সালিশে বসবে, তারপর হয়তো তাকে গ্রামছাড়া করবে; নয়তো করবে একঘরে। সেই অপমানের চেয়ে এখনই গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া ভাল। কিন্তু একটা ব্যাপার সাধু কিছুতেই বুঝতে পারলো না, মাধুরী যে পতিতালয়ে ছিল এই খবর গ্রামে চাউর হলো কী করে! সে তো কাউকেই বলেনি, আর মাধুরীর তো বলার প্রশ্নই আসে না। মাধুরীর নিজের গ্রামও ধারে-কাছে নয়, অন্য জেলায়। তাহলে কথাটা ছড়ালো কী করে! সাধু মাধুরীর হাত ধরে বললো, ‘চলো। এই গ্রামের তে আজ আমার বরাত উঠলো।’

মাধুরী সাধুর দিকে তাকালো। সাধু কেমন অনুদ্বিগ্ন, যেন এর জন্য সে প্রস্তুতই ছিল! মন্দিরের দিকে দৃষ্টি ফেরালো মাধুরী, দেবী দূর্গার চোখে চোখ রেখে যেন মৌন অনুযোগ ছুড়ে দিলো সে-তোমাকে গড়ার সময় যে নবকন্যার ঘরের মাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার মধ্যে পতিতালয়ের মাটিও ছিল। পতিতালয়ের মাটি শুদ্ধ হলো, পতিতালয়ের মাটির প্রতিমা তুমি হলে পূজিত আর আমি হলাম অচ্ছুত? মানুষের জীবন নিয়ে কী উপহাস তোমার! অঞ্জলি দেবার সুযোগটুকুও দিলে না, সত্যিই মাটির প্রতিমা তুমি, তোমার হৃদয় বলে কিছু নেই। আর তোমার এই ভক্তরা? এরা তো না বোঝে মানুষের পরান, না বোঝে পুরাণ; কেবল স্রোতে ভেসে যায়!

সাধু মাধুরীর হাতে চাপ দিলো, ‘চলো।’

সাধুর হাত ধরে কয়েক পা এগিয়ে পিছন ফিরে বারান্দায় বসে থাকা গৌর’র দিকে তাকালো মাধুরী। গৌর’র কপালে তিলক, গলায় তুলসীমালা, গায়ে সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে ধুতি; পরম ধার্মিকের বেশ। চোখাচোখি হতেই গৌর চোখ নামিয়ে নিলো। মাধুরী আনমনেই যেন মুখ টিপে হাসলো কাপুরুষ গৌর’র অবনত পরাজিত মুখের দিকে তাকিয়ে। গৌরদের মতো ভণ্ড ধার্মিক গৃহী চিরকাল মাথা নিচু করেই বাঁচে, কিন্তু সাধুরা বাঁচে মাথা উঁচু করে! সাধুর জন্য গর্বে মাধুরীর বুক ফুলে উঠলো। ঘাড় ফিরিয়ে মাধুরী আবার পা মেলালো সাধুর সাথে। মজা দেখতে থাকা মানুষগুলো পথ করে দিলো ওদের। ওরা রাস্তায় উঠতেই উচ্চস্বরে শোনা গেল সাধুর মায়ের কান্নার রোল। দাঁড়ালো না ওরা। রোদ চড়েছে। রোদ মাথায় করে সামনে অনেকটা পথ হাঁটতে হবে। শুকনো কাদামাটির অসমতল পথ, এরপর রোদজ্বলা কাঁকর বিছানো অমসৃণ আরও কতো পথ.....!


ঢাকা।
আগস্ট, ২০১৩

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.