নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
চৌদ্দ
আশ্রমের শিষ্যদেরকে শাস্ত্র এবং অস্ত্র শিক্ষা দিয়ে অনূকার জীবন বেশ আমোদেই কাটছিল, তার সেই আমোদপূর্ণ জীবনে হঠাৎই ছন্দপতন ঘটায় বিবাহ। বিবাহের বিষয়ে সে নিজের সঙ্গে নিজেই যুঝছিল, তার বিবাহ করা উচিত কি না সেই বিষয়ে কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিল না সে। এজন্য এখনই সে বিবাহ করতে চায়নি, বিবাহের জন্য আরো সময় নিতে চাইছিল। কিন্তু তার পিতা-মাতা কিছুতেই তার বিবাহের ব্যাপারে আর কালবিলম্ব করতে চাননি। তাদের এক কথা- ‘আশ্রম চালাতে চাও চালাও, আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু বিবাহটা এখনই সেরে ফেল, বিবাহের পরেও আশ্রম চালাতে পারবে।’
ফলে নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিবাহে সম্মতি দিতে হয় তাকে এবং অগ্নি সাক্ষী রেখে তাদেরই গোত্রের চব্বিশ বৎসরের তরুণ সত্যবাককে বিবাহ করতে হয়। সত্যবাক কর্মঠ এবং যুদ্ধে নিপুণ তরুণ। চল্লিশটির বেশি গাভী ও মহিষ আছে তাদের, ভেড়াও আছে বিশটির মতো, সে নিজেই সংসারের কর্তা। মাতা, ভগিনী আর বাক্শক্তিহীন একজন কনিষ্ঠ ভ্রাতা আছে তার।
সত্যবাক মানুষ হিসেবে ভালো, সংসারের প্রতি দায়িত্বশীল, স্ত্রীর প্রতি সোহাগ-ভালোবাসাতেও কোনো কমতি নেই। কিন্তু বিবাহের কিছুদিনের মধ্যেই সত্যবাকের সোহাগ-ভালোবাসায় আপ্লুত না হয়ে বরং ভেতরে ভেতরে হাঁফিয়ে ওঠে অনূকা! যে-কোনো নারীর কাছেই তার পতির সোহাগ-ভালোবাসা কাঙ্ক্ষিত বিষয়, কিন্তু অনূকার কাছে যেন তা বোঝা হয়ে ওঠে! সে না পারে ফেলতে, না পারে বইতে! বিষন্নতায় দিন কাটে অনূকার, আশ্রমের কন্যাদেরকে শাস্ত্র এবং অস্ত্র শিক্ষা দেয়, কিন্তু তাতে যেন আর আগের মতো মন লাগে না! তার কেবলই মনে হয় বিবাহের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা তার মারাত্মক ভুল ছিল, সে এখন এই ভুল শোধরাবার পথ খোঁজে। কিন্তু বিবাহের মতো একটি সামাজিক সম্পর্ক থেকে কী করে বের হবে সে? শাস্ত্রে যে তেমন কোনো পথের কথা বলা নেই!
বিবাহের অনেক আগে থেকে, অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই শারীরিক এবং মানসিকভাবে সে এমন এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যায়, যা কাউকে কখনো বলেওনি, নিজে নিজেই কেবল ভেবেছে। বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই সে কখনো কোনো পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট ছিল না, গুরুগৃহে থাকার সময় অবসরে সহপাঠীরা কখনো কখনো পুরুষদের নিয়ে গল্প করত, পুরুষদের প্রতি তাদের আকর্ষণ, এমনকি পুরুষের শরীর নিয়ে নানারকম রসিকতা করত। সে তখন চুপ করে বসে শুনত, রসিকতা শুনে হাসত, কিন্তু পুরুষের শরীর সম্পর্কিত কথা শুনেও পুরুষের প্রতি তার কখনো আকর্ষণ জন্মায়নি! বরং গুরুগৃহে থাকার সময় তারই মতো এক কন্যা সহপাঠী রোমাশা তাকে আকর্ষণ করত, ভালো লাগত রোমাশাকে, রোমাশার সান্নিধ্য তাকে আনন্দ দিত! অনেক সময় দুষ্টুমির ছলে রোমাশাকে জড়িয়ে ধরত, গালে গাল ঘষত, তখন তার শরীরে অদ্ভুত শিহরণ জাগত, রোমাশার শরীরের ঘ্রাণ তাকে মাধ্বীর নেশার মতো আচ্ছন্ন করে রাখত! ঝরনায় স্নানের সময় সিক্ত রোমাশার দিকে তাকিয়ে থাকত লোভাতুর চোখে, ওর কপালে-ঠোঁটে চুম্বন করতে ইচ্ছে করত, ভেজা পরিচ্ছদে দৃশ্যমান হয়ে ওঠা ওর স্তনযুগলে হাত বুলাতে আর জিহ্বার স্পর্শ দিতে ইচ্ছে করত। গুরুগৃহের সহপাঠীরা প্রায়শই একে অন্যের কেশ বিন্যাস করে খোঁপায় পুষ্পমাল্য জড়িয়ে কপালে চন্দন পরিয়ে সাজিয়ে দিত। অনূকা ইচ্ছে করে সর্বদাই রোমাশাকে সাজাত, কাঁকুই দিয়ে রোমাশার দীর্ঘ সোনালি কেশ বিন্যাস করতে করতে কখনো রসিকতার ছলে ওর কেশে নাক গুঁজে বলত, ‘সখি, তুই আজ আশ্রমের বাইরে কোথাও যাসনে, তোর কেশের গন্ধে যুবকেরা পিপীলিকার ন্যায় পিছু নেবে!’
আবার চন্দনের ফোঁটা দিয়ে সাজানোর সময় ইচ্ছে করে কালক্ষেপণ করত, ফোঁটা দেবার ছলে রোমাশার নরম গালে আঙুল ঘষত, ইচ্ছে করত রোমাশার কপালে-গালে-ঠোঁটে চুম্বন করতে!
কিন্তু তখন নিজেকে সামলে নিত সে, ভাবত এ তার মনের ভ্রম, নিজেকে বুঝ দিত এই বলে যে পুরুষের সান্নিধ্য পায় না বলেই হয়ত তার এমন হয়, পুরুষের সান্নিধ্য পেলে নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুতেই সে বুঝতে পারত না যে অন্য কন্যাদের মতো পুরুষের প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই কেন!
কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিয়েও তার এই সংকট দূর হবার পরিবর্তে বরং আরো ঘনীভূত হতে থাকে, তার চাল-চলনে পুরুষের প্রকৃতি প্রকট হতে থাকে, তার স্তনও অন্য কন্যাদের মতো যথেষ্ট পুষ্ট নয়। বিষয়টি নিয়ে সে কখনো কারো সঙ্গে আলোচনা করতে পারেনি লজ্জায়। তাই সে নিজের সঙ্গে যুঝছিল, দ্বিধাগ্রস্ত ছিল এজন্য যে যেহেতু পুরুষ তাকে আকর্ষণ করে না, তাই পুরুষকে বিবাহ করা উচিত হবে কি না! আশ্রম গড়ার পর যখন বাড়ি থেকে বিবাহের জন্য খুব চাপ দিতে শুরু করে, তখন সে এই ভেবে সম্মতি দেয় যে পুরুষের শারীরিক সংস্পর্শে এলে নিশ্চয় তার ভেতরের পুরুষ প্রকৃতি দূর হয়ে যাবে আর কন্যাদের প্রতি আকর্ষণ হ্রাস পেয়ে পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে!
কিন্তু কোথায় কী, পুরুষ সংসর্গে তার ভেতরের পুরুষ প্রকৃতি দূর তো হয়ইনি, বরং পুরুষ সংসর্গের প্রতি তার তীব্র বিরাগ জন্মেছে আর আরো অধিক আকর্ষণ বেড়েছে নারীর প্রতি। সংসর্গের সময় সে সত্যবাককে যোগ্য সঙ্গত দিতে পারে না তার শরীর সায় দেয় না বলে। প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে সত্যবাকের শরীরের নিচে এমন অসাড় হয়ে পড়ে থাকে যেন সে মানুষ নয়, একটি শয্যা মাত্র! তার এমন নিলিপ্ত আচরণে সত্যবাক অবাক হলেও প্রথম দিকে কিছু বলেনি, ভেবেছে অনভ্যস্ততার কারণেই অনূকার এই নির্লিপ্ততা, কিছুদিন পর অভ্যস্ত হয়ে গেলে এই নির্লিপ্ততা থাকবে না। কিন্তু দিন যায় কিন্তু অনূকার মাঝে কোনো পরিবর্তন আসে না। বরং রাত্রে শয্যায় শুয়ে সত্যবাক অনূকাকে কাছে টানলে অনূকা প্রায়ই শরীর খারাপের কথা বলে সত্যবাকের আহ্বান ফিরিয়ে দেয়। হয়ত একদিন সত্যবাকের আহ্বানে সাড়া দেয়, তারপর তিন-চারদিন শরীর খারাপের কথা বলে এড়িয়ে যায়। এক রাত্রে সংসর্গকালে সত্যবাক বলেই ফেলে, ‘সঙ্গমকালে মৃত হরিণীর ন্যায় তুমি এমন নিথর হয়ে থাকো কেন! আমি কি তোমাকে সুখ দিতে অক্ষম?’
বলব না বলব না করেও রতিভঙ্গের পরে সত্যবাকের পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে ভেড়ার লোমের কম্বলে শরীর ঢেকে শেষ পর্যন্ত সত্য কথাটা বলেই দেয় অনূকা, ‘তুমি অক্ষম নও প্রিয়, কেন জানি না সঙ্গমের প্রতি আমারই কোনো মোহ নেই!’
‘আশ্চর্য কথা! তুমি কি তপস্বিনী হতে চাও?’
‘না তো, তেমন বাসনা আমার মনে কখনোই জাগেনি।’
‘তবে সঙ্গমের প্রতি মোহ নেই কেন?’
‘জানি না, আমার শরীর সায় দেয় না। সঙ্গমকালে আমার কষ্ট হয়, ক্লান্তি লাগে।’ নারীর প্রতি তীব্র আকর্ষণের বিষয়টি গোপন করে যায় অনূকা।
সত্যবাক বলে, ‘নিশ্চয় তোমার কোনো কঠিন অসুখ করেছে, আমি কালই বৈদ্য’র সঙ্গে কথা বলব।’
সত্যবাক বৈদ্য’র সঙ্গে কথা বলে, বৈদ্য নানা প্রকার ঔষধি বৃক্ষের শিকড় ও বাকল দেয় প্রভাত-সন্ধ্যায় বেঁটে রস পান করার জন্য, লতা-পাতা দিয়ে তৈরি কিছু বড়িও দেয়। বৈদ্য’র কথা মতো অনূকা ঔষধি বৃক্ষের শিকড় ও বাকল বেঁটে প্রত্যহ দু-বেলা পান করে, বড়ি খায়।
এরই মধ্যে একদিন অনূকা তার বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে অশ্বে আরোহণ করে উদ্দেশ্যহীনভাবে অরণ্যে ঘুরে সরস্বতীর তীর ধরে বহির্ষ্মতীতে ফেরার সময় অপরিচিত একটি ষোড়শী কন্যাকে সরস্বতীর জলে বুনো ফল ধুতে দেখে অশ্ব থামায়। ষোড়শী কন্যাটি অপূর্ব সুন্দরী, চিকন গড়ন আর তার কোমর সমান সোনালি কেশের নিচের দিকটা সরস্বতীর জলে ভিজছে। কন্যাটিকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে অনূকা, রোমাশার কথা মনে পড়ে তার, এই বয়সে রোমাশাও ঠিক এমনি কোমনীয় সুন্দরী ছিল। বুক চিড়ে দীর্ঘশ্বাস পড়ে তার রোমাশার জন্য, কে জানে রোমাশা এখন কোথায় কোন পুরুষের সংসার করছে, হয়তো পুত্র-কন্যার জননীও হয়েছে এতদিনে! অনূকা অশ্বকে ধীরে ধীরে চালিত করে কন্যাটির আরো কাছে গিয়ে বলে, ‘তুমি কোন বাটীর কন্যা গো?’
এক মনে বুনো ফল ধুতে থাকা কন্যাটি ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় অনূকার দিকে, হাত দিয়ে কপালের সামনের কেশ সরিয়ে বলে, ‘আমার মাতামহের নাম নন্দ।’
‘ও আচ্ছা, তুমি নন্দ দাদুর নাতনী!’
‘হ্যাঁ, আমার মাতার নাম কাথি।’
কাথির মুখটি ভেসে ওঠে অনূকার চোখে, তার যখন ছয়-সাত বৎসর বয়স তখন শেষ দেখেছে কাথি পিসিমাকে, ব্রহ্মাবর্তের উত্তরদিকের একটি গোত্রের এক পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয়, বিবাহের কথাও মনে আছে তার। তারপর তো সে গুরুগৃহে চলে গিয়েছিল, বৎসরে দু-বার বাটীতে আসত, অনেকের সঙ্গেই আর দেখা হতো না।
অনূকা বলে, ‘কী নাম তোমার?’
‘শশীয়তী।’
‘বাহ, খুব সুন্দর নাম তোমার! বেড়াতে এসেছ বুঝি?’
‘না, আমার পিতাশ্রী মারা গেছেন তো, তাই আমরা একেবারে চলে এসেছি, এখন থেকে আমরা এখানেই থাকবো।’
‘তোমার পিতার আত্মার শান্তি হোক। কী করে মারা গেলেন তিনি?’
‘কঠিন অসুখ হয়েছিল, বৈদ্য’র ওষুধেও কোনো কাজ হয়নি।’
কন্যাটির সঙ্গে কথা বলতে খুব ভালো লাগে অনূকার, তাই ইচ্ছে করেই কথা বাড়ায়, ‘তোমরা কয়জন ভ্রাতা-ভগিনী।’
‘আমি আর আমার একজন ছোট ভগিনী আছে, ভ্রাতা নেই আমাদের।’
‘শোনো কন্যা, একা একা অরণ্যে ফল কুড়োতে যেও না, বাঘ-ভাল্লুকে ধরবে!’
শশীয়তী মৃদু হেসে বলে, ‘একা যাইনি তো, আমার মামাতো ভাইয়েরা ছিল, আমার কাছে ফল দিয়ে ওরা খরগোশ ধরতে গেছে অরণ্যের ভেতরের দিকে।’
‘তুমি আবার ওদের পাল্লায় পড়ে খরগোশ ধরতে যেও না যেন।’
‘না, না; আমি খরগোশ ধরতে গেলে মামাশ্রী বকবেন আমায়।’
‘তুমি ভীষণ মিষ্টি দেখতে, আর কথাও বলো সুন্দর করে!’
শশীয়তী লাজুক হাসি দিয়ে মাথা নত করে।
শশীয়তীর সঙ্গে অনূকার সেই প্রথম দেখা এবং কথা বলা। তারপর একদিন প্রভাতে শশীয়তী ওর মাতা আর বারো বৎসরের ভগিনীর সঙ্গে আশ্রমে আসে, অনূকা তখন তার শিষ্যদের নিকট শাস্ত্র ব্যাখ্যা করছিল। অতিথিদের উপবেশনের জন্য নিজেই গৃহ থেকে কুশ ঘাসের আসন এনে পেতে দেয় সে, ‘বসুন পিসিমা। কেমন আছেন?’
‘ভালো নেই গো মাতা, তোমার পিশেমশাই অন্যলোকে চলে গেলেন, তাই কন্যাদের নিয়ে পিতৃগৃহে চলে আসতে হলো।’ বলেই আসনে উপবেশন করেন মধ্য ত্রিশের কাথি।
শশীয়তী আর ওর ভগিনী দাঁড়িয়েই থাকে, অনূকা চোরা চোখে শশীয়তীর দিকে তাকায় বারবার। কাথি অনূকার উদ্দেশে বলেন, ‘আমার ছোট কন্যাকে তোমার শিষ্য করে নাও।’
অনূকা খুশি হয়ে বলে, ‘বেশ তো, খুব ভালো কথা। কন্যাদের শিক্ষার খুবই প্রয়োজন।’ তারপর বারো বৎসরের কন্যাটির দিকে তাকিয়ে আবার বলে, কী নাম তোমার?’
‘শিক্তা।’
‘বেশ নাম তোমার। আজকে ওদের সঙ্গে গিয়ে বসো। কাল থেকেই আরো আগে আসবে, কেমন?’
শিক্তা ঘাড় নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা।’
তারপর অনূকার শিষ্যদের পিছন সারিতে গিয়ে উপবেশন করে শিক্তা।
অনূকা শশীয়তীর দিকে একবার দৃষ্টি দেয়, তারপর কাথির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘শশীয়তীও তো শাস্ত্র আর অস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করতে পরে, কী শশীয়তী, আসবে তুমিও?’
শশীয়তী লাজুক হেসে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। কাথি বলেন, ‘ওর এসবে তেমন আগ্রহ নেই, ওর যত আগ্রহ রন্ধনে আর সংসারের কাজকর্মে।’
‘সেটাও কম দরকারী নয়। তবে কন্যাদের শাস্ত্র আর অস্ত্র শিক্ষার খুব প্রয়োজন।’
পরদিন প্রভাত থেকেই শিক্তা আশ্রমে আসতে শুরু করে, নিত্যদিন শিক্তাকে আশ্রমে নিয়ে আসে শশীয়তী। শিক্তার শাস্ত্র অধ্যায়ন আর অস্ত্র প্রশিক্ষণের সময় প্রথম দু-তিনদিন শশীয়তী বসে থাকত চুপটি করে কিংবা আশ্রমে একা একা হাঁটত। তারপর একদিন সে আশ্রমের এক কোনার দিকে কিছু ময়লা দেখে অনূকাকে বলে, ‘দিদি, ঝাঁট দিয়ে ময়লা পরিষ্কার করে দিই?’
যদিও প্রতিদিন অনূকা শিষ্যদের সঙ্গে নিয়ে আশ্রম পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে, বৃক্ষে জল দেয়, তবু সে শশীয়তীকে সম্মতি দেয়।
অনূকার সম্মতি পেয়ে শশীয়তী ঝাড়ু হাতে নিয়ে আশ্রমের ময়লা-শুকনো পাতা ঝাঁট দেয়। সেই শুরু, এরপর নিত্যদিন প্রভাতেই সে আশ্রম ঝাঁট দেয়, সরস্বতী নদী থেকে জল এনে পরম যত্নে পুষ্পবৃক্ষের গোড়ায় ঢালে, কোনো পুষ্পলতা বাতাসে পড়ে গেলে সেটাকে সে পুনরায় কোনো বৃক্ষে তুলে দেয়। অনূকা শিক্ষার্থীদের শাস্ত্র অধ্যায়ন করানোর ফাঁকে ফাঁকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে শশীয়তীকে, যতবার তাকিয়ে দেখে ততবারই তার বুকের ভেতর কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে, শশীয়তীকে একটি বার বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করবার তার জন্য দেহ-মন চঞ্চল হয়ে ওঠে!
দিনের পর দিন বৈদ্য’র দেওয়া বড়ি আর শিকড়-বাকলের রস পান করেও সত্যবাকের প্রতি কোনো আকর্ষণ জন্মে না অনূকার, বরং দিন দিন তার মন আরো বেশি উতলা হয়ে ওঠে শশয়তীর জন্য। সত্যবাকের সঙ্গে সংসর্গকালে তার অঙ্গ ঘিন ঘিন করে, অথচ শশীয়তীর সংসর্গলাভের জন্য তার অঙ্গ অস্থির হয়ে ওঠে। অঙ্গে নারী হলেও অন্তরে অনুভব করে- সে একজন পুরুষ!
অধিকাংশ রাত্রেই অনূকা সংসর্গের আহ্বান প্রত্যাখান করায় প্রথমদিকে মনের অসন্তোষ প্রকাশ করেনি সত্যবাক, সে ভেবেছিল যে অনূকার সংসর্গের প্রতি অনাগ্রহ কোনো রোগ, বৈদ্য’র ঔষুধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে বৈদ্য’র ওষুধ পান করার পরও যখন সংসর্গের প্রতি অনূকার আগ্রহ জন্মায় না, তখন আর সত্যবাক মনের অসন্তোষ গোপন রাখতে পারে না, বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকে। এক পর্যায়ে জোর করেই অনূকার সঙ্গে সংসর্গে লিপ্ত হয়, কয়েকদিন জোর করে সংসর্গ করার সময় প্রতিবাদী হয়ে ওঠে অনূকা, দু-জনের মধ্যে মান-অভিমান হয়, ঝগড়া হয়, এমনকি হাতাহাতিও হয়। মাঝে মাঝে গৃহে না ফিরে আশ্রমেই রাত্রিযাপন করতে থাকে অনূকা। আশ্রমে রাত্রিযাপন করা নিয়ে একদিন সন্ধ্যায় সত্যবাক অনূকার সঙ্গে ঝগড়া করে নিজেও আশ্রমে থেকে যায় আর রাত্রে শয্যায় শয়নের পর অন্ধকারে সংসর্গের উদ্দেশ্যে অনূকার অঙ্গ স্পর্শ করে। অনূকা নিজের বুকের ওপর রাখা সত্যবাকের হাত ধরে, বিরক্ত হয় না, রাগও করে না। শান্ত স্বরে সে বলে, ‘তোমায় একটা কথা বলি, তুমি উত্তেজিত না হয়ে ধৈর্য ধরে শোন।’
সত্যবাক কৌতুহলী হয়ে বলে, ‘বলো।’
‘আমাকে দিয়ে তোমার সংসার হবে না, এভাবে দিনের পর দিন একসঙ্গে থাকলে আমাদের দুজনের মাঝে দ্বন্দ্ব ক্রমশ বাড়বে, দূরত্ব বাড়বে, তাতে তুমিও সুখী হবে না, আমিও সুখী হবো না। তার চেয়ে বরং তুমি আবার বিবাহ করে সুখী জীবনযাপন করো আর আমি আশ্রমেই থাকি। আমি কখনোই তোমার সংসারে নাক গলাতে যাব না, তুমিও আমার জীবযাপনে বাধা দিও না।’
সত্যবাক মন দিয়ে অনূকার কথা শোনে, তারপর অনূকাকে বুকের কাছে টেনে বলে, ‘আমি যে তোমায় ভালোবাসি অনূকা।’
‘কে তোমায় নিষেধ করেছে আমায় ভালোবাসতে! কিন্তু ভালোবাসলেই যে তার শরীর পেতে হবে এমনটা ভাবা স্বার্থপরতা। আমি আশ্রমে থাকলেও তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়েই থাকবো, তুমিও তেমনি থেকো। আমাদের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক থাকবে, শুধু শারীরিক সম্পর্ক থাকবে না।’
সত্যবাক অনূকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে, অনূকা সত্যবাকের মাথায়-গালে হাত বুলিয়ে বলে, ‘বোকার মতো কাঁদছো কেন! তুমি আর্য পুরুষ, তুমি চাইলে আমার চেয়ে যোগ্য আর সংসারী আরো দশটা কন্যাকে বিবাহ করতে পারবে।’
‘কিন্তু আমি তো শুধু তোমাকে চাই!’
অনূকার হাতে সত্যবাকের অশ্রুর স্পর্শ লাগে, সে অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বলে, ‘মানুষের জীবনে সব চাওয়া পূর্ণ হয় না, অপূর্ণতার জন্য অনুতাপ করতে নেই, তাতে দুঃখ বাড়ে। তুমি আমার অনুরাধ রাখো সত্য, আবার বিবাহ করো। তাহলে তুমিও সুখী থাকবে, আমিও ভালো থাকব।’
‘বেশ, তুমি যদি সুখী হও আমি তাই করব। তবে আমার একটা অনুরোধ তোমাকে রাখতে হবে।’
‘কী অনুরোধ?’
‘যতদিন আমি বিবাহ না করি, ততদিন তুমি বাটীতে থাকবে, আশ্রমে নয়। তুমি আশ্রমে থাকলে মানুষ ভাববে আমাদের মধ্যে অশান্তি হয়েছে।’
‘বেশ, তাই থাকব। তবে কালই আমি মাতাকে বলব তোমার জন্য বিবাহের পাত্রী দেখতে।’
সত্যবাক চুপ করে থাকে, অনূকার কপালে কপাল ঠেকায়।
মাস খানেক পর সত্যবাক তাদেরই গোত্রের এক যুবতীকে বিবাহ করার পর অনূকা নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে আবার আশ্রমের গৃহে উঠে আসে, শুরু হয় তার নতুন জীবন।
(চলবে......)
©somewhere in net ltd.