নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি বর্তমানে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগে লিখি। আমার সকল লেখা আমি এই দুটি ব্লগেই সংরক্ষণ করে রাখতে চাই। এই দুটি ব্লগের বাইরে অনলাইন পোর্টাল, লিটল ম্যাগাজিন এবং অন্য দু-একটি ব্লগে কিছু লেখা প্রকাশিত হলেও পরবর্তীতে কিছু কিছু লেখা আমি আবার সম্পাদনা করেছি। ফলে ইস্টিশন এবং সামহোয়্যার ইন ব্লগের লেখাই আমার চূড়ান্ত সম্পাদিত লেখা। এই দুটি ব্লগের বাইরে অন্যসব লেখা আমি প্রত্যাহার করছি। মিশু মিলন ঢাকা। ৯ এপ্রিল, ২০১৯।
তেইশ
ব্রহ্মাবর্তে পূর্বেও যেমনি সূর্য উঠত, এখনো তেমনি ওঠে; পূর্বেও যেমনি বাতাস বইত, এখনো তেমনি বয়; পূর্বেও যেমনি মেঘ ভেসে বেড়াত, এখনো তেমনি বেড়ায়। কিন্তু সূর্যের আলো, বাতাস আর মেঘের অনুভূতি ব্রহ্মাবর্তের দুই শ্রেণির মানুষের কাছে এখন দুই রকম! এক শ্রেণি নৃপতি বেণের অনুগামী আর্য মানব ও বিভিন্ন অনার্য জাতি; এদের কাছে মনে হয় ব্রহ্মাবর্তের সূর্যের আলো অতীতের চেয়ে অধিক মায়াময়, বাতাস আরো বেশি প্রশান্তির, মেঘের স্পর্শ অধিকতর সুখকর! আরেক শ্রেণি ব্রাহ্মণ এবং ধর্ম ও শাস্ত্রের ভয়ে ভীত দেবগণ-ব্রাহ্মণগণের অনুগামী কিছু মানব; এদের কাছে মনে হয় সূর্যের আলো সর্বক্ষণ তাদেরকে উপহাস করে, বাতাসকে মনে হয় অগ্নির অদৃশ্য জিহ্বা, মেঘের স্পর্শ পাথরের ধারালো অস্ত্রের আঘাতের মতো বেদনাদায়ক!
ব্রহ্মাবর্ত এখন আর পুরোপুরি মনুর শাস্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হয় না, অনূকাকে দণ্ড দেবার পরদিনই নৃপতি বেণ বিদ্রোহী হয়ে ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা করার সময় জনসমুক্ষে কিছু অনুশাসন নীতির কথা বলেন, পরে সখা কুথান এবং বেদ ও মনুশাস্ত্রবিরোধী সমচিন্তার ঋষিদের সঙ্গে আলোচনা করে নতুন এক অনুশাসন নীতি তৈরি করেন, সেই অনুশাসন নীতি অনুযায়ী-ই এখন ব্রহ্মাবর্ত পরিচালিত হয়। বেণ মনুশাস্ত্র সম্পূর্ণরূপে বাতিল করেননি, মনুশাস্ত্রের যা কিছু মানুষের জন্য অকল্যাণজনক এবং ব্রাহ্মণ ও দেবতাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট তা বাতিল করে নতুন এক অনুশাসননীতি তৈরি করেন। বেণ জানান যে তাঁর তৈরি বর্তমানের এই অনুশাসনই ব্রহ্মাবর্তের শেষ কথা নয়; ভবিষ্যতে পরিস্থিতি অনুযায়ী এই অনুশাসনের কোনো কোনোটা সংস্কার এবং সংযোজন বা বিয়োজন হতে পারে।
সেদিন বেণের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মনুশাস্ত্র সংস্কার করে অনুশাসন নীতির বিষয়ে কথা বলার সময় ব্রাহ্মণগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, বেণের কথা শেষ হওয়ামাত্র তারা সমস্বরে চিৎকার করে বলেন, ‘আমরা তোমার এই অনুশাসন নীতি মানব না, মহামান্য মনুর যে বিধান আছে, সেই বিধানেই পরিচালিত হবে ব্রহ্মাবর্ত।’
বেণও চিৎকার করে বলেন, ‘আজ থেকে ব্রহ্মাবর্তে আমার কথাই শেষ কথা। মনুশাস্ত্র নয়, আমার তৈরি নতুন অনুশাসন নীতিতেই পরিচালিত হবে ব্রহ্মাবর্ত, আপনারা আমার অনুশাসন নীতি গ্রহণ করতে পারলে ব্রহ্মাবর্তে থাকুন আর গ্রহণ করতে না পারলে অন্যত্র চলে যান। ব্রহ্মাবর্তে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করলে তা কঠোর হাতে দমন করা হবে।’
তবু ব্রাহ্মণরা মনুর বিধান অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সমস্বরে চিৎকার করতে থাকলে বেণ তাঁর অনুগত বীরদের নির্দেশ দেন বাটীর সামনে থেকে ব্রাহ্মণদের বিতাড়িত করতে, বেণের অনুগত বীরগণ তখন লাঠি দিয়ে ঠেলে বিক্ষুব্ধ ব্রাহ্মণদের বিতাড়িত করতে শুরু করেন। ব্রাহ্মণরা পিছু হটতে হটতে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘ধ্বংস হয়ে যাবে বেণ! দেবগণ, ব্রাহ্মণগণ এবং ঋষিগণের রোষে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে, তোমার মতো দুষ্টু পাপাত্মার পতন অনিবার্য! আর্যজাতির কলঙ্ক তুমি, ভয়ংকর পরিণতি হবে তোমার, বীভৎস মৃত্যু হবে!’
ব্রাহ্মণদের অভিশাপ শুনে মৃদু হাসেন বেণ। অন্যদিকে আনন্দে বিহ্বল হয়ে কাঁদতে থাকেন নিষাদ, রাক্ষস, বানর, পণিজাতির অনার্যরা। বেণের প্রতিটি শব্দ এবং বাক্য তাদের মর্মে গেঁথে যায়, তবু মনে হয় ভুল শুনছি না তো, এও কী সম্ভব! তারা আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে একে অন্যকে আলিঙ্গন করেন আর বেণের নামে জয়ধ্বনি দিতে থাকেন। তাদের সম্মিলিত জয়ধ্বনিতে চাপা পড়ে যায় ব্রাহ্মণদের মুখ নিসৃত অভিসম্পাত।
বেণ যে-দিন ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন সে-দিন থেকেই বাইরের কিছু মানুষের সমালোচনা-ক্ষোভ যেমনি সামলাতে হচ্ছে, তেমনি তাঁর পরিবারের মানুষের সমালোচনা-ক্ষোভও তাঁকে সামলাতে হচ্ছে। ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণার দিন রাত্রেই পিতা অঙ্গ’র সঙ্গে তাঁর কলহ হয়, অঙ্গ বেণের এই দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। তিনি বেণকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে বেণ যা করছেন তা কেবল ভুলই নয়, একই সঙ্গে অন্যায় ও মূর্খতা। তিনি বেণকে পরামর্শ দেন যাতে শীঘ্রই বেণ নিজের ভুল স্বীকার করে দেবতা, ঋষি এবং ব্রাহ্মণদের কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রায়শ্চিত্য করেন। কিন্তু বেণ তাতে সম্মত হননি, পাল্টা তিনি তাঁর পিতাশ্রীকে বলেন, ‘বৎসরের পর বৎসর ব্রহ্মাবর্তের মানবদের ওপর দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের আধিপত্য চলতে পারে না পিতাশ্রী। আপনার মতো প্রবীণেরা পুরোনো বিশ্বাস আর রীতিকে আঁকড়ে ধরে আছেন বলেই ব্রহ্মাবর্তের মানুষের আজ এত কষ্ট। আমাদের কষ্টার্জিত সম্পদ নষ্ট করে একের পর এক যজ্ঞ করতে হয়, স্বর্গে কর পাঠাতে হয়। এভাবে চলতে পারে না।’
অঙ্গ গর্জে ওঠেন, ‘মূর্খ তুই, তাই ধর্ম ও শাস্ত্র মান্য করিস না।’
‘আপনি অন্ধ পিতাশ্রী, দৃষ্টি থাকতেও আপনি অন্ধ, তাই দেবতা আর ব্রাহ্মণদের চতুরতা আপনি দেখতে পান না।’
‘এই শাস্ত্র আমাদের পূর্ব-পুরুষেরাই তৈরি করেছেন।’
‘পূর্ব-পুরুষেরা সর্বদা সঠিক কাজ করবেন এমনটা ভাবা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাছাড়া এমনটাও তো হতে পারে যে অতীতে মনুগণ যে বিধান দিয়েছেন তা সম্পূর্ণটা তাদের নিজেদের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, কিছুটা দেবতা এবং ব্রাহ্মণদের দ্বারা প্রভাবিত। তাছাড়া কাল তো আর এক জায়গায় স্থির থাকে না, কালের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত সমাজ পরিবর্তিত হয়। ফলে নতুন সমাজে পুরোনো কিছু বিধান পরিবর্তনের প্রয়োজন পড়ে। আমি সেই পরিবর্তনটাই করেছি।’
‘ভুল করছিস তুই মূঢ়!’
‘পিতাশ্রী, যখন সামজে নতুন কোনো প্রথা চালু করা হয়, তখন অনেকে সেটার সমালোচনা করে, কিন্তু অনেকে সমালোচনা করে বলেই সেটা ভুল, এমনটা নাও হতে পারে। আজকের মানুষের কাছে যেটা ভুল মনে হচ্ছে, ভাবীকালের মানুষের কাছে সেটাই সঠিক মনে হতে পারে। আজকের দিনটাই সর্বশ্রেষ্ঠ এমনটা ভাবাই বরং মূঢ়তা, আগামীকালের দিনটা আরো ভালো হতে পারে।’
‘শাস্ত্রের কথা যদি বাদও দিই, আমি বলছি- তুই নৃপতি হিসেবে এই ব্রহ্মাবর্তে টিকে থাকতে পারবি না। দেবতা, ব্রাহ্মণ এবং ঋষিদের বিরুদ্ধে গিয়ে নৃপতি হিসেবে টিকে থাকা অসম্ভব।’
‘চেষ্টা করতে তো দোষ নেই!’
‘তুই আজ যাদের আপন ভাবছিস, কাল দেখবি তাদের অনেকেই গোপনে তোর বিপক্ষ শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।’
‘মিত্রতা, শত্রুতা, বিশ্বাসঘাতকতা এসবই মানব সভ্যতার অনেক প্রাচীন রীতি পিতাশ্রী; কিছু দুষ্টু মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার ভয়ে অন্যায়কে মেনে নেওয়া অনুচিত।’
‘আমি নিঃসন্তান ছিলাম ভালো ছিলাম, তোর মত কলঙ্কিত-কুলাঙ্গার সন্তানের পিতা হয়ে আজ আমি মানুষের ধিক্কার পাচ্ছি!’
‘আপনি ধর্মান্ধ পিতাশ্রী, কিছুটা ভীরুও বটে; তাই যারা আমাকে সাধুবাদ জানাচ্ছে, তাদের কণ্ঠস্বর আপনার কানে পৌঁছচ্ছে না। একারণে আমার পিতা হিসেবে আমিও আপনাকে নিয়ে গর্ববোধ করতে পারছি না, পারলে আনন্দ হতো।’
সেদিন বেণের সঙ্গে এইভাবে তর্ক-বিতর্কের পর তিনদিন গৃহে ফেরেননি অঙ্গ, মনুর গৃহে ছিলেন। তিনদিন পর গৃহে ফিরলেও বেণের সঙ্গে কথা বলেননি, বেণ ডাকলেও কোনো সাড়া দেননি।
বেণের প্রতি তাঁর মাতা এবং হংসপাদাও সন্তুষ্ট নয়, যদিও তাদের অসন্তুষ্টি তারা প্রকাশ করেননি অঙ্গ’র মতো। তবে তারা দুজনই শঙ্কিত এজন্য যে দেবতা, ব্রাহ্মণ এবং ঋষিদের রোষে বেণের জীবনাশঙ্কা দেখা না দেয়!
কিছুদিন পরেই বেণ আরেক কাণ্ড করে বসেন, যার ফলে তাঁর পিতা-মাতা ও স্ত্রী ভীষণ মর্মাহত হন।
নৃপতি হবার কিছুকাল পরেই দেবপতি ইন্দ্রের নির্দেশে ব্রহ্মাবর্ত থেকে একটি বানর গোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে বেণের কাঁধে তীর বিদ্ধ হয়, সেই ক্ষত সেরে যাবার পর দেবপতি আবার তাঁকে নির্দেশ দেন দক্ষিণের একটি নিষাদ জাতিকে উচ্ছেদ করে ব্রহ্মাবর্ত সম্প্রসারণ করার। বেণ তখন স্বর্গে দূত পাঠিয়ে দেবপতিকে বোঝাতে সক্ষম হন যে ব্রহ্মাবর্ত সম্প্রসারণ করা যেমনি প্রয়োজন, তেমনি মানবদের প্রয়োজনেই কিছু কিছু অনার্য জাতিকে ব্রহ্মাবর্তে রাখাও দরকার। ব্রহ্মাবর্তের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে যে-সব অনার্য জাতি আছে, তাদের কোনো কোনো গোত্র যদি ব্রহ্মাবর্তে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিয়মিত কর প্রদান করে, তবে তাদের উচ্ছেদ করা অনুচিত। আর যদি তারা ব্রহ্মাবর্তে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কর প্রদান করতে অস্বীকৃতি জানায়, তবে তাদেরকে উচ্ছেদ করে তাদের বসতি অধিগ্রহণ করা উচিত। কেননা অনার্যদের নিকট থেকে কর হিসেবে যে গবাদীপশু ও ফসল পাওয়া যাবে, তাতে মানবগণ এবং দেবগণ সমৃদ্ধ হবে। বেণের এই প্রস্তাব ইন্দ্রের পছন্দ হয়, তিনি কিছু কিছু অনার্যগোষ্ঠীকে সম্প্রসারিত ব্রহ্মাবর্তে রেখে দেবার সিদ্ধান্ত জানান বেণকে।
দেবপতি ইন্দ্রের সম্মতি পাবার পর বেণ দূত পাঠিয়ে দক্ষিণের কয়েকটি নিষাদ ও পণি গোষ্ঠীকে এই প্রস্তাব পাঠান যে হয় তাদেরকে ব্রহ্মাবর্তে অন্তর্ভূক্ত হয়ে কর প্রদান করতে হবে, অন্যথায় যুদ্ধের মাধ্যমে তাদেরকে বসতি থেকে উৎখাত করা হবে। আর্যদের সঙ্গে যুদ্ধ জেতার শক্তি নিষাদ ও পণিদের নেই, আবার পিতৃপুরুষের বসতি ছেড়ে যেতেও তাদের প্রাণ কাঁদে, ফলে তারা প্রথম প্রস্তাবটিই গ্রহণ করে।
বেণ নিষাদ ও পণিপল্লী ব্রহ্মাবর্তে অন্তর্ভূক্ত করার কিছুকাল পর প্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করতে এবং নৃপতি হিসেবে নিষাদ ও পণিদের খোঁজখবর নিতে নিষাদপল্লী ও পণিপল্লীতে যান সহযোদ্ধা অরুণ ও সঞ্জয়কে সঙ্গে নিয়ে। পণিপল্লী ঘুরে তারপর তারা নিষাদপল্লীতে প্রবেশ করেন; দুলকি চালে সবার আগে ছুটতে থাকে অরুণের অশ্ব, তারপর সঞ্জয়ের, শেষে বেণের।
হঠাৎ তেরো-চৌদ্দ বৎসর বয়সী এক কিশোর পথের ধারের একটি বাটীর ভেতর থেকে দৌড়ে এসে বেণের অশ্বের সামনে থমকে দাঁড়ায়, বেণ অশ্বের রজ্জু টেনে ধরেন, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের কিশোরটির সুন্দর মুখশ্রী ও শারীরিক গড়ন দেখে বেণ বুঝতে পারেন যে কিশোরটি বিশুদ্ধ নিষাদ রক্তের নয়, তার শরীরে আর্য রক্তও বইছে। বেণ কিশোরটির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কী হয়েছে বৎস, তুমি দৌড়াচ্ছ কেন?’
কিশোরটি বেণের প্রশ্নের উত্তর দেবার পূর্বেই বাটীর ভেতর থেকে লাঠি হাতে এক নারী বেরিয়ে আসে, ‘দাঁড়া বলছি মতঙ্গ।’
নারীও বেণকে দেখে থমকে দাঁড়ান, বেণের সঙ্গে তার চোখাচোখি হতেই পিছন ফিরে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘গৃহে আয় মতঙ্গ।’
গৃহের দিকে পা বাড়ান নারী, ক্ষণকালের জন্য নারীর মুখমণ্ডল অবলোকন করতে পারলেও তাকে চিনতে পারেন বেণ, অনেকদিন পূর্বের একটি ক্ষীণকায় নিষাদকন্যার মুখশ্রী তাঁর অর্ন্তচক্ষুতে ভেসে ওঠে। যদিও মুখশ্রী এবং শরীরিক গড়নে অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তবু তাকে চিনতে একটুও অসুবিধা হয় না বেণের। বেণ প্রায় চিৎকার করে অরুণ এবং সঞ্জয়ের উদ্দেশে বলেন, ‘সখা, তোমরা সর্দারের গৃহে গিয়ে বিশ্রাম নাও, আমি আসছি।’
এরপর বেণ অশ্বকে তাড়া দিয়ে মতঙ্গকে অতিক্রম করেন, তারপর নিষাদ নারীর সামনে গিয়ে তার মুখোমুখি দাঁড় করান অশ্বকে। নারী একবার বেণের দিকে তাকিয়েই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকেন। বেণ কয়েক নিমেষ তাকিয়ে থাকেন নারীর মুখশ্রীর দিকে, তারপর বলেন, ‘একবার দেখেই আমি তোমায় ঠিক চিনেছি- তুমি কেশিনী! তুমি এখানে থাকো কেশিনী?’
কেশিনী মুখে কিছু বলে না, হ্যাঁ-সূচক ঘাড় নাড়ে। মতঙ্গ নামের কিশোরটি কেশিনীর পাশে এসে অঙ্গ ঘেঁষে দাঁড়ায়। বেণ আবার বলেন, ‘আমরা তো তোমায় মারধর করিনি কখনো, তাহলে তুমি পালিয়েছিলে কেন কেশিনী?’
কেশিনী জানে যে বেণ এখন ব্রহ্মাবর্তের আর্য-অনার্য সকল জাতির নৃপতি, তাঁর এখন অনেক ক্ষমতা, তিনি চাইলেই তাদেরকে এখান থেকে উচ্ছেদ করতে পারেন। তার পালিয়ে আসার অপরাধে এখন কি আবার তাদের গোত্রকে উৎখাত করবেন নৃপতি? কিন্তু তিনি তো শুনেছেন যে- বেণ ভালো মানুষ, দয়ালু নৃপতি। তাদের গোত্রের সর্দারের সঙ্গেও বেণের খুব ভালো সম্পর্ক, সর্দারের মুখে বেণের প্রশংসা শুনেছেন, সর্দার বলেন, ‘নৃপতি বেণের দয়াতেই আমরা কর প্রদানের বিনিময়ে সুখে-শান্তিতে ব্রহ্মাবর্তে থাকতে পারছি, তাঁর জায়গায় অন্য কেউ নৃপতি হলে এতদিনে আমাদের উৎখাত করে ছাড়ত। তাঁর মঙ্গলের জন্য জীবন উৎসর্গ করার জন্যও আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’
তাহলে তার পালিয়ে আসার অপরাধ নৃপতি কি ক্ষমা করবেন? কেশিনী আমতা আমতা করে বলেন, ‘আমার অন্যায় হয়েছে, আমাকে ক্ষমা করে দিন নৃপতি।’
বেণ শব্দ করে হেসে ওঠেন। তারপর বলেন, ‘ধুর বোকা, তোমার ইচ্ছে হয়েছে পালিয়েছ, তাতে মোটেও অপরাধ করোনি তুমি, ক্ষমা চাওয়ারও কিছু নেই। এই কিশোরটিকে তাড়া করছিলে কেন তুমি?’
‘কথা শোনে না, বড্ড দুষ্টুমি করে, আমাকে লোকের গালমন্দ শুনতে হয়।’
‘পুত্রটি কী হয় তোমার?’
কেশিনী উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকেন মাথা নত করে। মতঙ্গ’র হয়ত বড়দের আলাপ পছন্দ হয় না, সে বেণের অশ্বকে ভেংচি কেটে গৃহের দিকে পা বাড়ায়। বেণ আবার বলেন, ‘কী হলো, বলো?’
‘আমার পুত্র।’
‘ও বুঝেছি, তুমি বুঝি কোনো আর্যকে বিবাহ করেছ?’
কেশিনী ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়লে বেণ বলেন, ‘পুত্রটিকে দেখেই তো বোঝা যায় যে তার শরীরে আর্য রক্তের মিশ্রণ রয়েছে! তাহলে কি তুমি পুত্রটিকে চুরি করেছে এনেছ?’
‘ঈশ্বরের দিব্যি দিয়ে বলছি- আমি ওকে চুরি করিনি, ওকে আমি গর্ভে ধারণ করেছি।’
‘তাহলে ওর পিতা কে?’
‘আপনি।’ বলেই দৌড়ে বাটীর দিকে চলে যায় কেশিনী।
বেণের মনশ্চক্ষে তখন ভেসে ওঠে অনেক বৎসর পূর্বে কেশিনীর সংস্পর্শে অতিবাহিত করা রাত্রিগুলির দৃশ্য, আর ভেসে ওঠে কেশিনীর পুত্র মতঙ্গ’র মুখশ্রী। সদ্য যৌবনে পা দেওয়া দুঃসাহসী বেণ যখন নিষাদদের সঙ্গে এক যুদ্ধে দারুণ অবদান রাখার ফলে কেশিনীকে দাসী হিসেবে উপহার পেয়েছিলেন তখনো তাঁর বিবাহ হয়নি, বিবাহ হলেও যে আর্য পুরুষরা অনার্য দাসীর সঙ্গে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয় না তেমন নয়। কেশিনী তখন ক্ষীণকায়া কিশোরী, কৃষ্ণবর্ণ হলেও মুখের গড়নটি মাধুর্যময়, মাথা ভর্তি ঈষৎ কোঁকড়া কেশ ছড়িয়ে থাকত পিঠে, পিতা-মাতা ও গোষ্ঠীর লোকদের হারিয়ে আর্যদের হাতে বন্দী হয়ে দাসীর কাজে নিযুক্ত হবার ফলে মনে কষ্ট থাকায় সে কখনো না হাসলেও কথা বলার সময় তার শুভ্র সুন্দর দাঁতগুলো দেখা যেত। ওই পাতলা গড়ন আর মুখের মাধুর্যময়তা সদ্য যুবক বেণের রক্ত উসকে দিয়েছিল যেন! একদিন রাত্রে আহারের পর নিজের শয্যায় শুয়েও ঘুম আসছিল না বেণের, উপাধানে মাথা রেখে এপাশ-ওপাশ করছিলেন, চোখে ভাসছিল কেশিনীর মুখশ্রী আর সারা শরীর। একই গৃহের পাশাপাশি দুটি কক্ষে ছিল বেণ আর কেশিনীর শয্যা। বেণ শয্যা থেকে উঠে বাইরে গিয়ে বসেন, বারবার তাকান কেশিনীর কক্ষের দিকে। তারপর কেশিনীর কক্ষের বাতায়নের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে ডাকেন, ‘কেশিনী...., কেশিনী….।’
কয়েকবার ডাকার পর ভেতর থেকে উচ্চকণ্ঠে সাড়া আসে, ‘কে?’
বেণ ফিসফিস স্বরেই ধমক দেন, ‘আস্তে কথা বলো। এদিকে এসো।’
কেশিনী অন্ধকারে শয্যা ত্যাগ করে বাতায়নের কাছে এসে নিচুস্বরে বলে, ‘ডাকেন কেন?’
বেণ বাতায়নের গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কেশিনীর হাত ধরেন, হাতে চুম্বন করে বলেন, ‘দ্বারটা খুলবে?’
কেশিনী বেণের মুখের তাকিয়ে থাকে, স্পষ্ট দেখা যায় না, তবু তাকিয়ে থাকে। বেণ আবার বলেন, ‘খুলবে দয়া করে?’
কেশিনী বেণের গৃহের দাসী, সে হয়ত বুঝতে পেরেছিল যে প্রভুর অনুরোধের মধ্যে নির্দেশ আছে, সে না চাইলেও হয়ত প্রভুর ইচ্ছেই পূরণ হবে, প্রভু জোর করবেন। পিতা-মাতা, স্বজন-গোত্র সবই তো গেছে; যেটুকু আছে তা আর জোর করে কতদিন সে ধরে রাখতে পারবে! সে বলে, ‘খুলছি।’
বেণ ঘুরে গৃহের সামনের দিকে গেলে দ্বার খুলে যায়, ভেতরে ঢুকে আবার দ্বারের রজ্জু বন্ধন করেন বেণ। বাতায়ন দিয়ে আসা চন্দ্রের আলোয় গৃহাভ্যন্তরে বেণ কেবল কেশিনীর অবয়ব দেখতে পান, তাঁর সারা অঙ্গে যেন দাবানল জ্বলে ওঠে! বেণের হাত খুঁজে নেয় কেশিনীর মুখমণ্ডল, বেণের ঠোঁট খুঁজে নেয় কেশিনীর ঠোঁট, বেণের শরীরের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে কেশিনীর শরীরে!
কেশিনী তাঁদের গৃহে দাসী হিসেবে কাজ শুরু করার মাস তিনেক পর বেণের বিবাহ হয় হংসপাদার সঙ্গে, বেণ বিবাহের পূর্বে অনেকবার এবং বিবাহের পরেও বেশ কয়েকবার শয্যাসঙ্গিনী করেছেন কেশিনীকে। বেণের বিবাহের দেড় মাস পর একদিন সরস্বতী নদীতে স্নান করতে গিয়ে পালিয়ে যায় কেশিনী।
এতদিন বাদে কাকতালীয়ভাবে আজ কেশিনীর সঙ্গে দেখা, কিন্তু কেশিনী যা বলছে, তা কি সত্য? মতঙ্গ নামের ওই পুত্রটির পিতা তিনি? অশ্বপৃষ্ঠে উপবেশন করে এই প্রশ্ন দুটি বারবার নিজেই নিজেকে করেন বেণ। তাঁদের গৃহে কেশিনী দাসী থাকার কাল আর মতঙ্গ’র বয়স মিলিয়ে দেখার পর কেশিনীর কথা মিথ্যে মনে হয় না। তাঁর ভেতরের মানুষটিও যেন বলে ওঠেন- ওই পুত্র তোমার বেণ, ওই পুত্র তোমার!
বেণ অশ্ব তাড়া করে কেশিনীদের গৃহের সামনের আঙিনায় গিয়ে অশ্ব থেকে নেমে দাঁড়ান। গৃহের সামনে এক প্রৌঢ় বসে আছেন, কেশিনী আর মতঙ্গকে দেখা যায় না কোথাও। প্রৌঢ় বেণকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে ভীত চোখে হাত জোর করে দাঁড়ান। প্রৌঢ়ের কাছে জিজ্ঞেস করে বেণ জানতে পারেন যে তিনি কেশিনীর মামাশ্রী, নাম- ধনদ। বেণ অশ্ব থেকে নেমে অশ্বটিকে একটি বৃক্ষের সঙ্গে বন্ধন করেন। ধনদ বুঝে উঠতে পারেন না তিনি কী করবেন, স্বয়ং ব্রহ্মাবর্তের দণ্ড-মুণ্ডের কর্তা তার বাটীতে! নিজেই গৃহের মধ্যে গিয়ে গরুর চামড়ার একখানা আসন এনে অলিন্দে পেতে দেন বেণের উপবেশনের জন্য। বেণ ধনদকে বলেন কেশিনীকে ডেকে দিতে। ধনদ কেশিনীর নাম ধরে কয়েকবার ডাকার পর কেশিনী ভয়-লজ্জা মেশানো মুখে গৃহ থেকে অলিন্দে এসে দাঁড়ান, বেণ জানতে চান তার কথা সত্য কি না এবং মতঙ্গ’র জন্মদাতার সম্পর্কে তার মামশ্রী ও পরিবারের অন্য লোকেরা কিছু জানে কি না? কেশিনী হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লে বেণ প্রশ্ন করে তার পালিয়ে আসার পরের বৃত্তান্ত সম্পর্কে জানতে পারেন।
আর্যদের আক্রমণে কেশিনী তার পিতা-মাতা এবং পরিবারের লোকেদের হারিয়েই বেণের গৃহে দাসী হয়েছিল। আর বেণের গৃহ থেকে পালানোর পর সে তার মামাশ্রীর বাটীতে আশ্রয় নেয়। বর্তমানের নিষাদপল্লী তখনো ব্রহ্মাবর্তের অন্তর্ভূক্ত হয়নি, নিষাদদের কোনো কর দিতে হতো না আর্যদেরকে, তারা ছিল স্বাধীন। মামাশ্রীর বাটীতে আশ্রয়ের কিছুদিন পরই কেশিনী অনুভব করে যে সে গর্ভবতী। তার গর্ভবতী হবার বিষয়টি প্রথমে জানতে পারে তার মামী, তারপর মামাশ্রীর গোটা পরিবার, তারপর ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ে গোষ্ঠীর অন্যান্য লোকজনের মধ্যে। নিষাদ সর্দার বঙ্কল এবং সমাজের শীর্ষস্থানীয় কিছু লোক কেশিনীকে একদিন জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে জানায়- যে আর্য পরিবার তাকে দাসী করে রেখেছিল সেই পরিবাবারের যুবক জোর করে তাকে শয্যাসঙ্গিনী করার ফলেই সে গর্ভবতী হয়েছে। সর্দার এবং সমাজের শীর্ষ লোকজন তাদের জীবনের বাস্তবতা জানে, অনার্যরা বারবার আর্যদের আক্রমনের শিকার হয়, বাস্তুচ্যূত হয়, অনেক নারী ও কিশোর-কিশোরীকে আর্যরা ধরে করে নিয়ে গিয়ে দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী করে, তাদের অধিকাংশই আর কখনো ফিরে আসতে পারে না। কেশিনী তো তবু সৌভাগ্যবতী যে সে পালিয়ে তার মামাশ্রীর গৃহে ফিরে আসতে পেরেছে। গর্ভবতী হবার বিষয়ে কেশিনীর কোনো দোষ না থাকায় সর্দার এবং সমাজের জ্যেষ্ঠরা তাকে কিছু না বললেও আর্য সন্তান গর্ভে ধারণ করার কারণে সামাজের সাধারণ লোকজন তাকে বাঁকা চোখে দেখত, তার মামাশ্রীর পরিবারের কারো সঙ্গে প্রতিবেশী কারো কোনো কিছু নিয়ে ঝগড়া হলে তারা তার গর্ভবতী হবার বিষয়টি নিয়ে কটু কথা বলত। ফলে মামী তাকে প্রায়ই মারতেন। যদিও সে চেষ্টা করত নিজেকে লোকচক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখতে। তারপর একদিন একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় সে, পুত্রের গাত্র তার মতো ঘন কৃষ্ণবর্ণ নয়, উজ্জল শ্যামবর্ণ। সেই পুত্রকে দেখতে প্রতিবেশীদের সে কী ভীড় আর আড়ালে হাসাহাসি-বক্রোক্তি, যেন পুত্রসন্তান নয়, সে এক অদ্ভুত প্রাণির জন্ম দিয়েছে!
কেশিনীর মামাশ্রী ধনদ নাতির নাম রাখেন মতঙ্গ, ক্রমশ মতঙ্গ যত বড় হতে থাকে ওর চেহারায় আর্য প্রভাব তত প্রকট হতে থাকে। বর্ণে আর্য-নিষাদ দুই প্রভাব, শারীরিক গড়নেও তাই। মাথার কেশ নিষাদদের মত মোটা নয়, অধিক সরু, কৃষ্ণবর্ণ হলেও সোনালি আভাযুক্ত; চোখের মণিও বাদামী। অনেকে তার আচরণেও আর্য স্বভাব খুঁজে পায়! তার সমবয়সী অন্য পুত্রেরা মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি করলে পড়শিরা খুব বেশি হলে সেই পুত্রকে ধমক দেয়, কিন্তু মতঙ্গ সামান্য দুষ্টুমি করলেও সকলে তার মধ্যে আর্যদোষ খুঁজে পায়! যেন আর্য ঔরসে জন্ম নিয়ে সে অপরাধ করে ফেলেছে!
মতঙ্গ’র বয়স যখন তিন বৎসর তখন কেশিনীর আবার বিবাহ হয়েছিল তাদের পাশের পাড়ার এক মধ্যবয়সী পুরুষ তারকের সঙ্গে। আর্য সন্তান জন্ম দেওয়ায় কেশিনীকে কোনো যুবক বিবাহ করতে চায়নি, কোনো পুত্রের পিতা-মাতাও কেশিনীকে তাদের গৃহের পুত্রবধূ করত চাননি। তবু ধনদ ভাগ্নীর জন্য পাত্র সন্ধান করছিলেন। তারকের একজন স্ত্রী ছিল, কিন্তু সেই স্ত্রী ছিল নিঃসন্তান, ফলে আবার বিবাহের জন্য পাত্রীর সন্ধান করছিলেন তিনি। যেহেতু তিনি মধ্যবয়সী এবং গৃহে এক স্ত্রী বর্তমান, তাই অনেক পিতা-মাতাই তাকে কন্যা দান করতে চাইছিল না। হঠাৎ একদিন কেশিনীর কথা মনে হয় তারকের, যেহেতু কেশিনীর একটি পুত্রসন্তান আছে তাই তারক মনে মনে ভাবেন যে কেশিনী তার পূর্বের স্ত্রীর মতো বাঁজা নয়। কেশিনীকে বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে একদিন তিনি নিজেই ধনদের কাছে যান। ধনদ একটি শর্তে ভাগ্নীকে বিবাহ দিতে চান তারকের সঙ্গে, শর্তটি হচ্ছে- কেশিনীর পুত্র মতঙ্গকেও পুত্র জ্ঞান করে লালন-পালন করতে হবে তারককে। এই শর্তেই সম্মত হন তারক আর কয়েকদিন পরই কেশিনীকে বিবাহ করে মতঙ্গসহ নিজের গৃহে নিয়ে যান। সতীনের গৃহে সংসার করতে কেশিনীর খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না, কেননা তার সতীন যেহেতু সন্তানের মা হতে পারেননি, তাই সর্বক্ষণ নিজেকে অপরাধী ভাবতেন আর নিজের ভেতরে গুটিয়ে থাকতেন। তারক এবং তার প্রথম স্ত্রী দুজনই কেশিনীকে আদর-যত্ন করতেন, মতঙ্গকেও অনাদর করতেন না। দিন ঘুরে মাস যায়, মাস ঘুরে বৎসর, কিন্তু কেশিনী গর্ভবতী হয় না। এমনিভাবে দুই বৎসর কাটার পর ক্রমশ তারকের কাছে কেশিনী আর মতঙ্গ’র আদর কমতে থাকে এবং এক পর্যায়ে দুজনই বিরক্তিকর হয়ে ওঠে তারকের কাছে। কেশিনীর কোনো কাজে সামান্য ত্রুটি পেলেই তারক বকাঝকা করতে শুরু করেন আর কেশিনীর প্রতি রাগ গিয়ে পড়ত মতঙ্গ’র ওপর, মতঙ্গকে তিনি প্রহার করতে শুরু করেন। মতঙ্গ পুত্র তো নয়, যেন কেশিনীর হৃদয়! তাই মতঙ্গকে প্রহার করলে, কেশিনী সহ্য করত না, বাঘিনী হয়ে উঠত, তারকের সঙ্গে তার ঝগড়া তো বটেই মারামারিও বেঁধে যেত। এমনিভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকলে বিবাহের তিন বৎসর পর কেশিনী মতঙ্গকে নিয়ে তারকের গৃহ ত্যাগ করে আবার মামাশ্রীর গৃহে ফিরে আসে। তার ফিরে আসার ছয় মাস পর তারক সর্প দংশনের মারা যান।
কেশিনী আর বিবাহ না করে পুত্রকে নিয়েই বাকি জীবন বেঁচে থাকার সংকল্প করে। দিনে দিনে পুত্র তার বড় হয়ে ওঠে, বাল্য পেরিয়ে কৈশোরে পা দেয়।
সকল বৃত্তান্ত শোনার পর বেণ জানতে চান তিনি যে মতঙ্গ’র পিতা এই কথা অন্য নিষাদরা জানে কি না? ধনদ জানান যে তার পরিবারের বাইরের কেউ জানে না যে নৃপতি-ই মতঙ্গ’র পিতা। বেণ ধনদ এবং কেশিনীকে অনুরোধ করেন কথাটি গোপন রাখতে আর প্রতিশ্রুতি দেন কেশিনী এবং মতঙ্গ’র ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবার।
বেণ সেদিন-ই নিষাদ সর্দার বঙ্কলকে নির্দেশ দেন- নিষাদপল্লী থেকে কর হিসেবে যে সম্পদ সংগ্রহ করা হবে তার তিন ভাগের একভাগ ধনদকে প্রদান করার এবং কথাটি গোপন রাখার। নৃপতি বেণের নির্দেশ নিষাদ সর্দার বঙ্কল যথাযথভাবে পালন করেন।
এরপর থেকে নিষাদপল্লীতে যাতায়াত বেড়ে যায় বেণের, অন্য নিষাদরা যাতে কোনো সন্দেহ না করে তাই প্রথমে তিনি যান নিষাদ সর্দারের গৃহে, ফিরবার পথে ধনদের গৃহে কিছুক্ষণ সময় কাটান।
ব্রহ্মাবর্তের স্বাধীনতা ঘোষণার পরে বেণ সিদ্ধান্ত নেন কেশিনীকে তিনি বিবাহ করে স্ত্রীর মর্যাদা দেবেন আর মতঙ্গকে দেবেন পুত্রের স্বীকৃতি। স্বাধীনতা ঘোষণার কয়েকদিন পর এক মধ্যাহ্নে নিষাদপল্লীতে যান বেণ, কেশিনীকে বিবাহ করে নিজের গৃহে নিয়ে যাবার কথা জানান ধনদকে, ধনদ আনন্দ চিত্তে সম্মত হন। নিষাদ সংস্কৃতি অনুযায়ী কেশিনীকে বিবাহ করে, কপালে-সিঁথিতে সিঁদূর পরিয়ে বেণ কেশিনী আর মতঙ্গকে গৃহে নিয়ে এসে সবাইকে ডেকে কেশিনীকে দেখিয়ে বলেন, ‘দেখ তো তোমরা একে চিনতে পারো কি না?’
অঙ্গ, সুনীথা, হংসপাদা তাকান কেশিনীর দিকে; কৃষ্ণবর্ণ শরীর, ঊর্ধাঙ্গে অনার্যদের তৈরি শুভ্র বস্ত্রের নিবি আর পরনে সামনের দিকে কুঁচি দেওয়া বাস। হাতে ধাতুর চুড়ি, গলায় এবং কর্ণেও ধাতুর গহনা। সিঁথিতে রক্তবর্ণ সিঁদূর আর কপালে সিঁদূরের ফোঁটা।
হংসপাদা কিছু একটা বলতে যাবেন তার আগেই সুনীথা বলেন, ‘এ সেই অনার্য দাসীটা না? কী যেন নাম….।’
‘কেশিনী।’ হংসপাদা স্মরণ করিয়ে দেন শাশুড়িকে।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ কেশিনী, একদিন স্নান করতে গিয়ে পালিয়েছিল। তখন অবশ্য ক্ষীণকায়া ছিল, এখন দেখছি শরীরে কিছুটা মাংস লেগেছে দাসীটার!’
বেণ মাতার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘অতীতে কেশিনী আমাদের দাসী ছিল মাতা, কিন্তু এখন তো আর দাসী নয়, ওকে ওর নাম ধরে সম্বোধন করো।’
‘দাসী তো দাসী-ই বাছা; দাসীর জাত আজও দাসী, কালও দাসী।’ সুনীথা এমনভাবে কথা বলেন যেন তিনি তার অজ্ঞান পুত্রের ভুল শুধরে দিচ্ছেন!
‘চিরকাল কেউ দাসী নাও থাকতে পারে মাতা, দাসত্ব ছেড়ে সে যদি মর্যাদাসম্পন্ন অন্য কাজ করে, তবে তো সে আর দাসী থাকে না। তাছাড়া ওকে তো আমরা অন্যায়ভাবে জোর করে দাসী করে রেখেছিলাম। যাইহোক, এখন কেশিনীর মর্যাদাসম্পন্ন অন্য পরিচয় আছে।’
‘দাসীর আবার কী এমন মর্যাদার পরিচয় থাকতে পারে বুঝিনে বাপু, অনার্যরা তোকে কালাযাদু করেছে, তাই তুই সর্বদা ওদেরকে প্রশ্রয় দিস, দাসদেরকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তুলতে নেই।’
বেণ মাতার দিকে তাকিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘কেশিনীর পরিচয়, সে এখন ব্রহ্মাবর্তের নৃপতির কনিষ্ঠ স্ত্রী, আর এই যে কিশোরকে দেখছ, ওর নাম মতঙ্গ, ও ব্রহ্মাবর্তের নৃপতির জ্যেষ্ঠ পুত্র।’
সবাই বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকান বেণের দিকে, তারপর তাকান কৃষ্ণবর্ণ কেশিনী এবং মতঙ্গ নামের উজ্জল শ্যামবর্ণের কিশোরটির দিকে!
সুনীথা পুত্রকে শাসনের সুরে বলেন, ‘পাগলের প্রলাপ বকছিস তুই! সত্যিই তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, একের পর এক তোর পাগলামী বেড়েই চলেছে!’
‘পাগলের প্রলাপ বকছি না মাতা, যা আকাশ-বাতাসের ন্যায় সত্য তাই বলছি- কেশিনী আমার দ্বিতীয় স্ত্রী, ওকে আমি বিবাহ করেছি, আর মতঙ্গ আমার জ্যেষ্ঠ পুত্র, আমারই ঔরসে ওর জন্ম।’
বেণ সকল বৃত্তান্ত খুলে বলার পর সবার উদ্দেশে বলেন, ‘আজ থেকে ওরা এই বাটীতেই থাকবে। তোমরা ওদের দুজনকে ওদের প্রাপ্য সম্মান দিতে না চাইলে সেটা তোমাদের ব্যাপার, কিন্তু ওদেরকে কেউ এমন কোনো কটুবাক্য বোলো না যা ওদের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’
(চলবে.......)
১৭ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ১১:১৪
মিশু মিলন বলেছেন: ধন্যবাদ।
২| ১৮ ই নভেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:৩৭
রাজীব নুর বলেছেন: লেখক বলেছেন: ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন।
১৮ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ৯:২০
মিশু মিলন বলেছেন: আপনিও সুস্থ, সুন্দর থাকুন।
©somewhere in net ltd.
১| ১৭ ই নভেম্বর, ২০২২ দুপুর ২:০১
রাজীব নুর বলেছেন: সুন্দর উপন্যাস হবে একটা।