![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কাশিপুর গ্রাম। গ্রামটির পাশ দিয়ে কূল-কূল ধ্বনিতে বয়ে গেছে ইছামতি নদী। বর্ষায় কানায় কানায় ভরে উঠলেও শীতকালে নদীতে থাকে হাঁটুজল । আর চৈত্র মাসেতো একদমই পানি থাকে না। নদীর পানির মতো জীবনের সুখের আশাটা বাড়ে বা হারিয়ে যায় এই নদীর উপর নির্ভরশীল জেলেদের।
সাধারণত কাশিপুর গ্রামের জেলেরাই এই নদীতে মাছ ধরে তাদের জীবিকা চালায়। “বাসু” সেই জালাদেরই একজন। ভাল নাম বাসুদেব হালদার। তার বাবা-দাদা সকলেই যুগ যুগ ধরে বাস করেছে এই গ্রামে, জীবিকা ছিল এই ইছামতি নদীরই উপর। আজ তারা বেঁচে নেই তবে বসু তাদের মতো করেই জীবন পার করছে। কোন পরিবর্তনের ছোঁয়া তাদের গায়ে লাগেনি।
সংসারে স্ত্রী আর একটি সাত বছরের ছেলে আছে বাসুর। ছেলের নাম কান্ত। গ্রামের প্রাইমেরী স্কুলে ভর্তি হলেও নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে না কান্ত। নদীতে মাছ ধরার জন্য প্রায়ই বাবার সাথে যেতে হয়। নদীতে জাল ফেলার সময় বাবাকে সাহায্য করে। মাছ ধরার পর স্থানীয় হাঁটে তা বিক্রি করে। সব কাজ শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।সকালে আবার বের হতে হয় তাদের। সবচেয়ে কষ্ট হয় শীতকালে, ঠাণ্ডা পানিতে নেমে জাল ফেলতে হয়।
তাই শীতকালে খুব ভোরে উঠেই সমস্ত শরীরে সরিষার তেল মেখে নেয় বসু। শরীরে তেল মাখতে মাখতে বসু তার ছেলেকে ডাকে, ‘ওই কান্ত, উডছ নারে? বেলা অইয়্যা গেল।‘
কান্ত জানে বাবা ডাকার পর আরও বেশি শুয়ে থাকলে কপালে অনেক দুঃখ আছে। তাই সে দেরি করে না, উঠে বসে। চোখ ডোলতে ডোলতে বলে, ‘এতো আগেই যাওন লাগবো?’
বসু বোঝে, এই শীতের মধ্যে পানিতে নামতে অনেক কষ্ট হবে কান্তর। কিন্তু কি আর করার। গরীবের ভাগ্যে যে সৃষ্টিকর্তা এইসবই লিখে রেখেছেন। তাই ছেলের প্রতি একটু মায়া হলেও তা প্রকাশ করার সাহস দেখায় না বসু, বরং মুখে বিরক্তির ভাব এনে বলে, ‘অহন না গেলে দুপুরে গেলে মাছ পাওয়া যাইব নি, নবাব হইছস?’
কান্তর মা ঘরের কনায় বসে কি যেন করছিল। বাসুর এমন কথা শুনে সে ছেলের পক্ষ নিয়ে বলে, ‘রাইতে জ্বর আইছিল, এহনও গাও গরম হইয়্যা আছে পুলার। আইজক্যা না গেল। আপনে একলাই যান।’
স্ত্রীর এমন অনুরধে কিছুটা বিব্রত হয় বসু। ওই ছেলে ব্যতিত তাকে সাহয্য করার আর কেউ নেই। একা একা জাল ফেলা যায় না। অন্য কাউকে বললে বিনিময়ে অর্ধেক মাছ সে নিয়ে যাবে।এদিকে নৌকাটাও তার ভাড়া করা। দিনশেষে নৌকার ভাড়া শোধ করতে গেলে সংসারের জন্য দু’কেজি চাল কেনার টাকা অবশিষ্ঠ থাকবে না।
এসব ভেবে মুখটি শুকিয়ে যায় বাসুর। কিন্তু সেই শুকিয়ে যাওয়া মুখ পুত্র কান্তর দৃষ্টি এড়ায় না। কান্ত মাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘না থাক, আমি যামু বাবার লগে।’ বলে আর বসে থাকে না কান্ত, বিছানা ছেড়ে উঠে পরে হাত-মুখ ধুয়ে বাবার সাথে যাবার জন্য।
কান্ত ঘর থেকে বের হবার পর বসু স্ত্রীকে বলে, ‘দুগা পানি ভাত দিয়া দাও। বেলা বাড়লে বাপ-পুতে খামুনে।’
-‘ভাততো যা আছিল রাইতেই শ্যাষ হইয়্যা গেল। ভাত নাই, দুগা চিড়া-মুরি দিমু?’, বাসুর স্ত্রী বলে।
বসু কোন উত্তর দেয় না। সে জানে পানি ভাত নেই মানে ঘরে চালও নেই। আজ দুপুরে তার স্ত্রীকে উপস থাকতে হবে ওই চিরাটুকু নিয়ে গেলে। মাটির দিকে তাকিয়ে অপরাধির মতো বলে, ‘কি করুম, বউ। কষ্টতো আর কম করি না। গত হপ্তার দুই দিনের নাউ ভাড়া বাকি আছিল। হেই টাহা দিলাম আর চাইল কিনার টাহা অইলো না।’
বাসুর এই কথাগুলো এর আগেও অনেকবার শুনেছে বাসুর স্ত্রী। তাই এখন আর এই কথাগুলো তেমন গায়ে লাগে না তার। বাসুকে বলল, ‘দুপুর অইলে কান্তরে পাঠায় দিয়েন। মোল্লাবাড়ি থেইক্যা ভাতের ফ্যান আইন্যা দিমুনে।’
পূব আকাশে মাত্র লাল সূর্য উকি দেয়া শুরু করছে। ইতোমধ্যে নৌকা বেয়ে বসু আর তার ছেলে কান্ত চলে গেছে দুই মাইল দূরে। সেখানে নদীর বাঁক আছে, ভাল মাছ পাওয়া যায়। কান্ত দাড় বাইছে আর বসু নদীতে জাল ফেলছে। দু’জনে যার যার মত কাজ করে যাচ্ছে, কারো মুখে কথা নেই। একসময় কান্ত সেই নিরবতা ভাঙল। গতরাতে দেখা একটা স্বপ্নের কথা বলল তার বাবাকে, ‘জানো বাবা, আইজ রাইতে একখান খোয়াব দেখছি।’
-‘কি খোয়াব দেখলি?’, বসু ছেলের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলল।
-‘দেখলাম, আমরা জানি কুন দ্যাশে মাছ ধরবার গেছি। হেইখানে অনেক অনেক মাছ। কত্ত মাছ...। আমরা দুইজনে মিল্ল্যা সব মাছ ধরতেছি। কিন্তু হুট কইর্যাি পানির নিচ থেইক্যা উইড্যা আসলো একটা কালা পানির ভুত। আমগো কইল, তোরা আমার মাছ ধরতাছস ক্যান? এইডা আমার নদী। এই বইল্যা ভুতটা আমগো ধরা সব মাছ নিয়া গেল।’
কান্ত চখে-মুখে একটা ভয়ের ছাপ ভেসে উঠেছে। বসু কান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কান্ত তার বাবাকে কিজ্ঞেস করলো, ‘আইচ্ছ বাবা, পানির তলে কি হাছাই ভুত-শয়তান থাকে?’
এবার বসু ছোট্ট একটা মুচকি হাসি হেসে ছেলেকে অভয় দিয়ে বলল, ‘আরে নারে পাগল।পানিতে ওইসব থাহে না। তয় হুনছি, সুমুদ্দুরে নাকি হাঙ্গর আর তিমি থাহে। অইগুলা অনেক বড় হয়। সামনে যারে পায়, তারেই খায়।’
হাঙ্গর নাম শুনেই কান্ত ভয়ে কয়েকবার ঢোঁক গিলে। বাবাকে বলে, ‘হাঙ্গর কি ডাঙ্গায় উইড্যা আসবার পারে?’
এই প্রশ্নের উত্তর বসু সঙ্গে সঙ্গে দেয় না। কান্ত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে বাবা কি যেন ভাবছে। একটু পর বসু উদাস ভাবে বলে, ‘হ পারে। তয় হাঙ্গর যহন ডাঙ্গায় থাহে, তহন আর আসল হাঙ্গরের মতো দ্যাহা যায় না, মাইনষের মতন মনে অয়।’
বাবার কথা শুনে কান্ত একটু অবাক হয়। কিন্তু এনিয়ে আর বেশি মাথা ঘামায় না। আবার নিজের কাজে মন দেয়। বসু নৌকায় দাড়িয়ে পানিতে খেপলা জালটি ছুড়ে দেয়। তারপর জালটি টেনে নৌকায় উঠায়। দু-চারটি ছোট ছোট তেংরা-পুটি জালে ধরা পড়েছে। মাছ গুলো জাল থেকে ছাড়িয়ে একটা হাড়িতে রাখতে রাখতে বসু আফসোস করে বলে, ‘আহারে, মাছগুলান সব গেল কোন দ্যাশে? ছোটকালে যহন বাপের লগে এই নদীতে মাছ ধরব্যার আইতাম, তহন কত্ত মাছ আছিল। মাছ দিয়্যা জাল ভইর্যাল যাইতো। কি যে দিনকাল আইল।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বসু। বাবার দিকে তাকিয়ে কান্ত বলে, ‘তাইলে মাছগুলান কি ওই ব্যাটা হাঙ্গরে খাইয়্যা ফেলছে?’
এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই বাসুর। ছেলের প্রশ্নের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসু আবার নদীর বুকে জাল ফেলে। তারপর আবার। আবার। আবার।
এভাবে দুপুরের শেষে তাদের শেষ হয় মাছ ধরা। তারপর বিকেলে সেগুলো নিয়ে যায় গ্রামের হাঁটে। সারাদিন দুই পিতা-পুত্র মিলে যে কয়তা মাছ নিয়ে হাঁটে আসলো তা তাদের পরিশ্রমের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। বিকেলের শেষে মাছগুলো কিনল এলাকার চেয়ারম্যান সাহেব। নায্য মূল্য দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব মাছগুলো কিনলেও সব টাকা দিল না বাসুকে। এ বছরে ভিটে-বাড়ির সরকারি খাজনা এখনও দেয়নি বসু। সেই খাজনার টাকা কেটে রাখলান চেয়ারম্যান সাহেব। শত আকুতি-মিনতি করেও পার পেল না বসু। চেয়ারম্যান সাহেব যে কয়টা টাকা দিলেন সেগুলোও দিয়ে দিতে হল নৌকার মালিককে নৌকা ভাড়া শোধ করার জন্য। রাতে রান্না করার জন্য আজও দু’কেজি চাল কিনতে পারলো না সে। তখন চারিদিকে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। বিষণ্ণ মনে, ক্ষুধার্ত পেটে আজও বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে বসু আর কান্ত।
রাতভর অনাহারে থেকে আবারও কাল সকালে তারা বের হবে মাছ ধরতে। কিন্তু তাদের জীবনের সেই সকালটি কবে আসবে তা কে জানে?
২৪ শে জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৫৫
মোঃ মিথুন হাসান বলেছেন: ধন্যবাদ
২| ০৭ ই আগস্ট, ২০১৩ বিকাল ৩:১৩
কামাল। আহমেদ বলেছেন: কিন্তু তাদের জীবনের সেই সকালটি কবে আসবে তা কে জানে?
++++++
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে জুন, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪০
অপূর্ণ রায়হান বলেছেন: ভালো লিখেছেন +++++