নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মিটন আলম

মিটন আলম › বিস্তারিত পোস্টঃ

শামসুর রাহমানের কবিতায় দেশপ্রেম

৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৯:৩৫

“শামসুর রাহমানের কবিতায় দেশপ্রেম”

ভূমিকা:
শামসুর রাহমান (জন্ম: অক্টোবর ২৩, ১৯২৯- মৃত্যু: আগস্ট ১৭, ২০০৬) বাংলাদেশ ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে দুই বাংলায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত। তিনি একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক কবি ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর লিখিত তাঁর দুটি কবিতা খুবই জনপ্রিয়।

জন্ম নানাবাড়িতে। বাবা মুখলেসুর রাহমান চৌধুরী ও মা আমেনা বেগম। পিতার বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরায় পাড়াতলী গ্রামে। কবি শামসুর রাহমানের ভাই-বোনের সংখ্যা ১৩ জন। তন্মধ্যে, কবি ছিলেন ৪র্থ। পুরোনো ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেছিলেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেননি। পাসকোর্সে বিএ পাশ করে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এম এ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি।

শামসুর রাহমানের পেশা:
শামসুর রাহমান পেশায় সাংবাদিক ছিলেন। সাংবাদিক হিসেবে ১৯৫৭ সালে কর্মজীবন শুরু করেন দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত রেডিও পাকিস্তানের অনুষ্ঠান প্রযোজক ছিলেন। এরপর তিনি আবার ফিরে আসেন তার পুরানো কর্মস্থল দৈনিক মর্নিং নিউজ-এ। তিনি সেখানে ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নভেম্বর, ১৯৬৪ থেকে শুরু করে সরকারি দৈনিক দৈনিক পাকিস্তান এর সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৭ এর জানুয়ারি পর্যন্ত (স্বাধীনতা উত্তর দৈনিক বাংলা)। ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ তে সামরিক সরকারের শাসনামলে তাঁকে পদত্যাগ বাধ্য করা হয়। অতঃপর তিনি ‘অধুনা’ নামীয় মাসিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

সাহিত্যধারা:
বিংশ শতকের তিরিশের দশকের পাঁচ মহান কবির পর তিনিই আধুনিক বাংলা কবিতার প্রধান পুরুষ হিসেবে প্রসিদ্ধ। তার প্রথম প্রকাশিত কবিতা ১৯৪৯ মুদ্রিত হয় সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকায়। শামসুর রাহমান বিভিন্ন পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয় লিখতে গিয়ে নানা ছন্দনাম নিয়েছেন। সে গুলো হচ্ছে: সিন্দাবাদ, চক্ষুষ্মান, লিপিকার, নেপথ্যে, জনান্তিকে, মৈনাক। পাকিস্তান সরকারের আমলে কলকাতার একটি সাহিত্য পত্রিকায় মজলুম আদিব (বিপন্ন লেখক) নামে কবিতা ছাপা হয় যা দিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট সমালোচক আবু সায়ীদ আইয়ুব।

প্রতিবাদী ও দেশপ্রেমিক কবি:
শামসুর রাহমান স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল (পত্রিকা) পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রাহমান যখন কারাগারে তখন তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখেন অসাধারণ কবিতা ‘টেলেমেকাস’ (১৯৬৬ বা ১৯৬৭ সালে)। ১৯৬৭ সালের ২২ জুন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী রেডিও পাকিস্তানে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্প্রচার নিষিদ্ধ করলে শামসুর রাহমান তখন সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত থাকা অবস্থায় পেশাগত অনিশ্চয়তার তোয়াক্কা না করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের পক্ষে বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন যাতে আরো স্বাক্ষর করেছিলেন হাসান হাফিজুর রাহমান, আহমেদ হুমায়ুন, ফজল শাহাবুদ্দীন। ১৯৬৮ সালের দিকে পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেন আইয়ুব খান যার প্রতিবাদে আগস্টে ৪১ জন কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন যাদের একজন ছিলেন শামসুর রাহমানও। কবি ক্ষুদ্ধ হয়ে লেখেন মর্মস্পর্শী কবিতা 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা'। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি গুলিস্তানে একটি মিছিলের সামনে একটি লাঠিতে শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১৯৭০ সালের ২৮ নভেম্বর ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর কবি লেখেন ‘আসুন আমরা আজ ও একজন জেলে’ নামক কবিতা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন। ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায় প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমন্ডুক মৌলবাদীরা। তাঁকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এতকিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়াগায় ছিলেন অনড়।

মৃত্যু:
কবি শামসুর রাহমান ২০০৬ সালের ১৭ই আগস্ট বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা বেজে ৩৫ মিনিটে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী ঢাকাস্থ বনানী কবরস্থানে, নিজ মায়ের কবরের পাশে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

প্রকাশিত গ্রন্থ:
শামসুর রাহমানের প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে এবং তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা: কাব্যগ্রন্থ- ৬৬, উপন্যাস- ৪, প্রবন্ধগ্রন্থ- ১, ছড়ার বই - ১। এলাটিং বেলাটিং, অনুবাদ - ৬
শামসুর রাহমানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে-
প্রথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে (১৯৬০), রৌদ্রকরোটিতে (১৯৬৩), বিধ্বস্ত নীলিমা (১৯৬৭), নিরালোকে দিব্যরথ (১৯৬৮), নিজবাসভূমে (১৯৭০), বন্দী শিবির থেকে (১৯৭২), দুঃসময়ের মুখোমুখি (১৯৭৩), ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা (১৯৭৪), আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি (১৯৭৪), এক ধরণের অহংকার (১৯৭৫), আমি অনাহারী (১৯৭৬), শূন্যতায় তুমি শোকসভা (১৯৭৭), প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে (১৯৭৮), বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে (১৯৭৭), উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ (১৯৮২) ইত্যাদি।

সম্মাননা ও পুরস্কার:
১। আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
২। বাংলা একাডেমি পুরস্কার
৩। একুশে পদক
৪। নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক
৫। জীবনানন্দ পুরস্কার
৬। আবুল মনসুর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার
৭। মিতসুবিসি পুরস্কার (সাংবাদিতার জন্য)
৮। স্বাধীনতা পদক
৯। আনন্দ পুরস্কার

ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে।

শামসুর রাহমানের দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার কাব্যকৃতি:
আধুনিক কাব্য নির্মাণে কিংবদন্তী কাব্যশ্রমিক শামসুর রাহমান রবীন্দ্র-নজরুল বলয় থেকে বের হয়ে আসা ত্রিশোত্তর পঞ্চপান্ডবের ধ্যান-ধারণা, কবিতার আঙ্গিক গঠন অনুসরণ করে তিনি কবিতা কাননে সাবলীল পদচারণা করেছেন। প্রকৃতি নির্ভর হলেও শহুরে শব্দ ব্যবহারে মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। তিনি দু’চোখ ভরে যা অবলোকন করেছেন তা শব্দের মজবুত গাঁথুনি দিয়ে প্রকাশ করেছেন। উপমা ও চিত্রকল্পে তিনি প্রকৃতি নির্ভর কিন্তু বিষয় ও উপাদানে শহর কেন্দ্রিক। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে তিনি যা দেখেছেন সে বিষয়ে লিখেছেন। তাঁর মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কবিতায় তখনকার আর্থ সামাজিক অবস্থার বাস্তব চিত্র প্রতিফলিত হয়। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য তিনি অসংখ্য জ্বালাময়ী-প্রতিবাদী-শক্তিশালী কবিতা লিখেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সব কবিতা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর কবিতায় মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, স্বাধীনতার প্রকাশ লক্ষণীয়। দেশ প্রেমের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন মনে প্রাণে একজন খাঁটি বাঙালি। দেশপ্রেম তাঁর কবিতার অন্যতম উপাদান। মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের চাওয়া-পাওয়া, মান-অভিমান, সংগ্রামের কথা বার বার এসেছে তাঁর কবিতায়। তবে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম তার কবিতার মুখ্য বিষয় হয়ে উঠেছে এবং যে ক্ষেত্রে তিনি বেশ পটু ও নৈপূণ্যতা প্রদর্শন করেছেন।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর- দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধ শেষে ত্রিশ লক্ষ প্রাণ ও দুই লক্ষ মা-বোনদের সম্ভ্রমের বিনিময় অর্জিত হয় স্বাধীনতা। শামসুর রাহমান স্বাধীনতাকে কবি নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের এলোমেলো দোলার সাথে তুলনা করেছেন। স্বাধীনতাকে রবি ঠাকুরের অমর গানের সুরের সাথে তুলনা করেছেন। কবির কাছে স্বাধীনতা যেনো কোকিলের গান, বয়সী বটগাছের ঝিলমিল পাতা। স্বাধীনতা কবির কাছে কবির লেখা খাতার মত। যেখানে কবির মনে যা চায় তাই নির্দ্বিধায় লিখতে পারে। কবি স্বাধীনতার চিত্র এঁকেছেন এভাবে- “স্বাধীনতা তুমি/রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/ স্বাধীনতা তুমি/কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা-/স্বাধীনতা তুমি/বাগানের ঘর, কোকিলের গান,/বয়েসী বটের ঝিলমিলি পাতা,/যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।” (স্বাধীনতা তুমি ঃ বন্দি শিবির থেকে)

স্বাধীনতা পেতে হলে অনেক ত্যাগ-সংগ্রাম করতে হয়। স্বার্থান্বেষী মহল সহজে কাউকে স্বাধীনতা দিতে চায় না। দেশ প্রেমিকেরা সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করে তবেই স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে আনে। যেমন এদেশ দীর্ঘ সংগ্রাম শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ঘাতক-শোষকদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে বাঙালিদের সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনো একক প্রচেষ্টায় অর্জন হয়নি। জাতি-বর্ণ বিভেদ ভুলে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সম্মিলিত চেষ্টা ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা এসেছে। বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায়, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফসল স্বাধীনতা। বাংলাদেশকে মুক্ত করতে কত হরিদাসী বিধবা হয়েছেন- কত সখিনা স্বামী-সন্তান হারায়েছেন, কত বোন ভাই হারা হয়েছেন। কত নারী বীরাঙ্গনা হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। রক্তের সাগর পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। শামসুর রাহমান তাই লিখেছেন- “তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ সকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর/তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা/অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতামাতার লাশের উপর।” (তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা ঃ বন্দি শিবির থেকে)

একাত্তরে পাকিস্তানী হায়েনারা সব কিছুর দখল নেয়। মানুষ বন্দি হয় পড়ে। গৃহবন্দী মানুষ সব সময় আতঙ্কে থাকে। কখন কার ঘর পুড়ে যায়; কখন কে প্রাণ হারায় তার নিশ্চয়তা নেই। এমতবস্থায় মানুষ জীবন বাঁচানো ভয়ে পৈত্রিক ভিটা মাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে। কিন্তু কবি শামসুর রাহমান দেশ ত্যাগ করতে রাজী নন। তিনি দেশকে অরক্ষিত রেখে কোথাও যেতে চান না। যারা ক্ষতিগ্রস্থ দুর্দশাপীড়িত তাদের পাশে থাকতে চান। প্রয়োজনে জীবন দিতেও প্রস্তুত তিনি। কিন্তু স্বদেশকে ছেড়ে কোথাও যেতে চান না তিনি। এখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন এখানেই মৃত্যুবরণ করে স্বদেশের মাটিতে সমাহিত হতে চান। যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে অনেকে বিদেশ-ভূঁইয়ে উদ্বাস্তু হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। দেশে লাশের স্তুপ। পঁচা-গলা-খসা লাশের গন্ধে বাতাস ভারী। তবু খাঁটি দেশ প্রেমিক কবি মৃত্যুজ্ঞানকে তুচ্ছ করে দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে নারাজ। সে কথাই শামসুর রাহমান লিখেছেন- “তবু আমি যাবো না কখনো/অন্য কোনো খানে/থাকব তাদের সঙ্গে এখানেই, বাজেয়াপ্ত হয়েছে যাদের/দিনরাত্রি, যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে সকল সময় সারিবদ্ধ/মৃত্যুর প্রতীক্ষা করা যাদের নিয়তি।’ (না, আমি যাব না ঃ বন্দি শিবির থেকে)

একাত্তরে সমস্ত বাংলাদেশ জুড়ে পাক-সেনারা জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে। চারদিক গুলির শব্দ, লাশের স্তুপ, শুকনো রক্তের গন্ধ। ভয়ার্ত মানুষ এমনকি পশু-পাখি। বাংলাদেশকে নিশ্চিহ্ন করাই পাক-সেনাদের লক্ষ্য। তাদের সামনে যা পড়ছে তাই ধ্বংস করছে। পবিত্র গ্রন্থ, প্রার্থনালয়, বই, দোকানপাট তথা সমগ্র বাংলাদেশকে ধ্বংস করে পাকিস্তানী শোষন-শাসন কায়েম রাখতে চায়। কিন্তু এই শত্রুদের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য দেশ প্রেমিকেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য বদ্ধ পরিকর। জীবন বাজি রেখে তাই যুদ্ধ করে। তারা শুধু চায় দেশ মাতৃকার মুক্তি। আবার মায়ের আঁচলের ¯েœহ ছাঁয়ায় গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাতে চায় তারা। শামসুর রাহমান তাৎপর্যময় সাহসী উচ্চারণ করেছেন এভাবে- “অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তা চষে জঙ্গি জিপ। আর্ত/শব্দ সবখানে। আমাদের দুজনের/মুখে আগুনের খরতাপ। আলিঙ্গনে থরথর/.../দাউ দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়াবাজার।” (তুমি বলেছিলে ঃ বন্দি শিবির থেকে)

দেশ-মাতার দুর্দিনে কোনো খাঁটি দেশ প্রেমিক স্থির থাকে না। অবস্থা উত্তরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। কোনো দেশ প্রেমিকের সামনে দেশের ক্ষতি হলে তাঁরা প্রতিবাদ করে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি জীবনও দিতে হয় তাতেও তারা প্রস্তুত। আর যারা দেশের জন্য প্রাণ দেয় তারা শহীদ। শহীদেরা কখনো মরে না। শহীদদের কপালে থাকে যৌবনের রাজটিকা। যতদিন দেশ তথা পৃথিবীর আলোবাতাস আছে ততোদিন তারা বেঁচে আছেন। এ বিষয়ে শামসুর রাহমানের পংক্তি হল- “গুলির ধমকে হাত ভূলণ্ঠিত পতাকা যেন বা,/জানু-দেহচ্যুত নিমেষেই, ঝাঁঝরা বুক।/মাটিতে গড়ায় ছিন্ন মাথা/মুকুটের মতো,/অথচ ললাট থেকে কিছুতেই নক্ষত্র খসে না।” (ললাটে নক্ষত্র ছিল যার ঃ বন্দি শিবির থেকে)

বিদেশী বেনিয়ার কোনো জাতিকে সহজে স্বাধীনতা দিতে চায় না। স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয়। আর শক্তিশালী শোষকদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে গেলে রক্ত ঝরাতে হয়। ক্ষতিগ্রস্থ হয় দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার। ধ্বংস, রক্তের সাগর পেরিয়ে স্বাধীনতা আসলেও তা শান্তির। অর্জিত স্বাধীনতা নতুন প্রাণের সৃষ্টি করে। এনে দেয় স্বর্গীয় সুখ। তাই স্বাধীনতা আমাদের চির কাম্য। কবি শামসুর রাহমান স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ রূপ অঙ্কন করেছেন এভাবে- “যখনই প্রবল আমি আসি,/আমার দু-চোখ জ্বল জ্বল/ধ্বংস আর সৃষ্টি/কাঁপে পাশাপাশি; আমি স্বাধীনতা।” (যে- পথে আমার পদধ্বনি ঃ বন্দি শিবির থেকে)

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ কালো রাত্রি পাকিস্তানী বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির উপর। শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। তারপর যুদ্ধ শুরু হয় স্বাধীন একটি দেশ পাওয়ার জন্য। কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন- “আমার মগজে ছিল একটি বাগান, দৃশ্যাবলিময়।/কখনো তরুণ রৌদ্রে কখনো বা ষোড়শীর যৌবনের মতো/জ্যোৎ¯œায় উঠত ভিজে। জ্যোৎ¯œাভুক পাখি/গাইত সু¯িœগ্ধ গান, আমার মগজে ছিল একটি বাগান।/এখন আমার কবিতার/প্রতিটি অক্ষরে বনবাদাড়ের গন্ধ, গেরিলার নিঃশ্বাস এবং/চরাচরব্যাপী পতাকার আন্দোলন।” (প্রতিটি অক্ষরে ঃ বন্দি শিবির থেকে)

একাত্তরে যুদ্ধের সময় চারদিক প্রকম্পিত মর্টার, শেলের শব্দে। সমগ্র দেশ দখল করেছে পাকিস্তানী মিলিটারিরা। বাঙালিরা প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। যারা শহরে আছেন তারাও ভয়ে বাইরে বের হয় না। চারদিকে শুধু পাকিস্তানী মিলিটারী আর মিলিটারী। কেউ যদি অপারগ হয়ে নিতান্ত প্রয়োজনেও বের হয় তবে খুব সাবধানে মাথা-চোখ-ঘাড় নিচু করে। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে যায়। তারা তাদের সব অধিকার হারায়ে ফেলে। শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই দৃশ্য কবিতায় তুলে ধরেছেন এভাবে-
“বস্তুত বিষণœ এ শহরে হত্যাময় এ শহরে/স্বদেশীর চেয়ে বিদেশীর সংখ্যা বেশি। নাগরিক/অধিকারহীন পথ হাঁটি, ঘাড় নিচ, ঘাড়ে মাথা/আছে কি বা নেই বোঝা দায়। এই মাথার ওপর/আততায়ী; শাসক সবার/আছে পাকাপোক্ত অধিকার। কেবল আমারই নেই।” (উদ্বাস্তু ঃ বন্দি শিবির থেকে)

বাঙালি স্বাধীনভাবে সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত। কিন্তু সে পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানী হানাদারেরা। কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য। তারা পুনরুদ্ধার করতে চায় ষোড়শীরা কলস নিয়ে পুকুর ঘাটে পানি আনতে নির্বাধে যাওয়া; ছোট ভাই আনন্দে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করতে পারে। বৃদ্ধ বাবা যেন গুড়গুড় শব্দ করে হুঁকো টানতে পারে। বাঙালি যেনো মনের সুখে জীবন যাপন করতে পারে নিজাবাসে। সে জন্য বাঙলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছে, যুদ্ধ করেছে। এই প্রসঙ্গে শামসুর রাহমান লিখেছেন-
“যাকে ভালোবাসি সে যেন পুকুর ঘাটে ঘড়া রোজ/নিঃশঙ্ক ভাসাতে পারে, যেন এই দুরন্ত ফিরোজ,/আমার দোসর, যেতে পারে হাটে হাওয়ায় হাওয়ায়,/বাজান টানতে পারে হুঁকো খুব নিশ্চিন্তে দাওয়ায়,/তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও এই এঁদো-গন্ডগ্রামে/ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম কী দুর্বার সশস্ত্র সংগ্রামে।” (গ্রামীণ ঃ বন্দি শিবির থেকে)

বহু আন্দোলন, সংগ্রাম, ত্যাগ ও রক্তের বিনিময় আমাদের বাঙলা ভাষা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাঙলা বর্ণমালা। নজস্ব ভাষা বাঙলায় নিজের মনের ভাব প্রকাশ করে স্বর্গীয় সুখ লাভ করছি কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী শাসকেরা আবার আমাদের কাছ থেকে ভাষা-দেশ কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র-যুদ্ধ করে। নিজস্ব ভাষা না থাকলে কোনো জাতির অস্তিত্ব থাকে না। তাই ভাষা-দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশ পায়। আমাদের বাঙলা তথা মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চা ও উন্নয়নকল্পে সচেষ্ট হতে হবে। কবি শামসুর রাহমান খেদোক্তি করেছেন-
“তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?/ঊনিশ শো, বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহীয়সী।/.../তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো/বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা।” (বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা)

যে আশা আকাঙ্খা নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল তা স্বাধীনতার পর আর বাস্তবায়িত হচ্ছে না। বিভিন্ন কুচক্রীমহল উঠে পড়ে লেগেছিল অর্জিত স্বাধীনতা বিপন্ন করতে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর দেশ চলতে থাকে টালমাটাল অবস্থায়। স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে পীড়িত হচ্ছিল বাংলাদেশ। দেশ চলতে থাকে স্বৈরশাসকের ইচ্ছায়। যেখানে নেই কোনো নিয়ম-কানুন, সংবিধান। অর্জিত স্বাধীনতাকে বিপন্ন হতে দেখে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিকের আর্তনাদ কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় এসেছে- “উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ/হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।/এর চেয়ে মর্মন্তদ বৃত্তায়ন কাহিনী আর কী হতে পারে।” (আসাদের শার্ট)

যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছেন সেই স্বপ্নর বাস্তবায়ন স্বাধীন দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যে ভাষার জন্য জীবন দিল সালাম-বরকতেরা সেই ভাষার শুদ্ধ চর্চার আজ আকাল। যে স্বাধীনতাকে পাওয়ার জন্য গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মিছিল ও মিটিং সেই স্বাধীনতা আজও আমরা পাইনি। যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে পারিনি জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে স্বাধীন একটি দেশ পেয়েছি আমরা। সেই বীর সন্তানদের যথাযোগ্য মর্যাদা দান করে জাতি হিসেবে আমরা কৃতজ্ঞ হব। “ফেব্রুয়ারী; ১৯৬৯” কবিতায় কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন- “স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেমখচিত গণচেতনা ও গণ-আন্দোলন/দেখলাম রাজপথে, দেখলাম আমরা সবাই।/জনসাধারণ/দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো/ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা/আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে এখনও বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রুজলে/ফোঁটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্ত্বরে।”

স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম শামসুর রাহমানের কবিতায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর কবিতা পাঠ করলে পাঠক হৃদয়ে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। পাকিস্তানীদের বিভৎস্য নির্যাতন, অত্যাচারের বাস্তব চিত্র এই কবিতাগুলো। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাঙালি জাতি দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করে অর্জন করে মাতৃভূমির স্বাধীনতা। প্রকৃতপক্ষে এই স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটেছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। একুশের ভাষা-আন্দোলনকে নিয়ে যেমন উন্নত কবিতা রচিত হয়েছে, তেমনি রচিত হয়েছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়েও। সাতচল্লিশের দেশবিভাগ, বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন, আটান্নর সামরিক শাসন, বাষট্টির শিক্ষা কমিশন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ - এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই আন্দোলনগুলো আমাদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্য পরিমন্ডলে বিরাট প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের কবিতায় এর প্রভাব ও প্রসার ঘটে ব্যাপকভাবে। ফলত ১৯৫০ সালে আশরাফ সিদ্দিকী ও আবদুর রশীদ খানের যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় নতুন কবিতা। পাকিস্তান আমলের প্রথম কবিতা-সংকলন হিসেবে নতুন কবিতার ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। এই সংকলনের পরই বের হয় হাসান হাফিজুর রাহমান-সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারী (১৯৫৩) সাহিত্য-সংকলনটি। একুশে ফেব্রুয়ারিকে উপলক্ষ করে রচিত কবিতাগুলোতে পাওয়া যায় অমিত সম্ভাবনার কথা, অসহায়তা ও আশাভঙ্গের করুণ চিত্র। একুশকে নিয়ে যাঁরা কবিতা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে হাসান হাফিজুর রাহমান (১৯৩২-৮৩), আলাউদ্দিন আল আজাদ (১৯৩২-২০০৭), বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৭), আবদুল গনি হাজারী (১৯২১-৭৬), ফজলে লোহানী (১৯২৮-৮৫), আনিস চৌধুরী (১৯২৯-৯০) আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (১৯৩৪-২০০১), আতাউর রাহমান (১৯২৭-৯৯), শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) ও সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫) উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জীবন ও মননে হীরকখন্ডর মতো দ্যুতিময়। বাঙালির শিল্প-সাহিত্য তথা রাজনীতি ও সমাজ-ভাবনায় এবং বাঙালির জাতীয়তার স্বরূপ চেতনায় মুক্তিযুদ্ধের গভীর প্রভাব পড়েছে। সময় যত অতিক্রান্ত হচ্ছে, আমাদের মুত্তিযুদ্ধের সাহিত্য ততই সমৃদ্ধ হচ্ছে নিজস্ব গৌরব ও অন্তর্নিহিত চেতনায়। সাহিত্যের প্রতিটি আঙিনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফুটে উঠেছে সগৌরবে। গল্প, উপন্যাস, নাটক, ছড়া ও কবিতায় যেমন মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে, তেমনি এসেছে সংগীতে। বস্তত মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালি জাতি ফিরে পেয়েছে নিজস্ব ভাষা, জাতিসত্তা, সংস্কৃতি, স্বাধিকার-চেতনা ও নিজস্ব একটি মানচিত্র। দীর্ঘ সাধনা ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই এক টুকরো মানচিত্রই বাঙালি জাতির গৌরব ও অহংকার।

একাত্তর সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামে বিশ্বের মানচিত্রে এক নতুন রাষ্ট্রের উদয় হলো। মুক্তিযুদ্ধ কবি-মানসে প্রচন্ড উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। তার খানিকটা ধরা পড়ে প্রখ্যাত কবি শামসুর রাহমানের ‘টেলেমেকাস’ নামক কবিতায়। হোমারের মহাকাব্য ওডিসির কাহিনি কবিতাটির প্রেরণা। অডিসিউস যখন দেবতার অভিশাপে সমুদ্রে দিকভ্রষ্ট তখন বিভিন্ন দেশের রাজা অডিসিউসের পতœী পেনেলোপকে বিবাহ করে ইথাকা দখল করতে চেয়েছিল। তাদের থামানোর জন্য পেনেলোপ একটি কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি একটি কাপড় বুনছিলেন, বলেন, এটি বোনা শেষ হলে স্বয়ম্বরা হবেন। কিন্তু দিনের বেলায় তিনি যা বুনতেন রাতের বেলায় তা খুলে দিতেন। সুতরাং বোনা আর শেষ হয় না। অন্যদিকে তার পুত্র টেলেমেকাস পিতার প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছেন। এই কাহিনি শামসুর রাহমান কীভাবে তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন, এখন তা দেখা যাক। তিনি ঢাকাকে ইথাকা আর নিজেকে টেলেমেকাস রূপে দেখেছেন। আর পশ্চিম পাকিস্তানি যেন আগ্রাসী বিদেশি রাজন্য। তিনি চাইছেন পিতা অডিসিউসকে, অর্থাৎ ঢাকার পরিত্রাতাকে

‘ইথাকায় রাখলে পা দেখতে পাবে রয়েছি দাঁড়িয়ে/ দরোজা আগলে, পিতা, অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।/ এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার/ বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ/ আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে এ টঙ্কার?’ (‘টেলেমেকাস’, নিরালোকে দিব্যরথ)

শামসুর রাহমান একজন সমকাল ও সমাজ-সচেতন কবি। সমকালীন বাঙালির জাতীয় জীবনের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্ত মূর্ত হয়েছে তাঁর কবিতায়। শামসুর রাহমানের কবিতায় ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীর জীবন, একটি বিশেষ জনপথ, শহর, মানুষ ও স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে বারবার। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। ছিল না তাঁর হাতে রাইফেল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কবিতা লিখে বাঙালি জাতিকে সাহসী হওয়ার মন্ত্র দিয়েছিলেন। আরো দিয়েছেন শক্তি, স্বপ্ন ও সাহস।

বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা একজন ব্যথিত কবির অভিজ্ঞতা ও ভাবনা বেদনার অভিজ্ঞান। শামসুর রাহমান এই কাব্যে যুদ্ধকে ছেঁকে তুলে আনতে চেষ্টা করেন তাঁর কবিতায়। তিনি নিজেকে একজন যোদ্ধা বা বন্দি হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন কবি হিসেবে। আর সেজন্য কবিতাও ধরা দেয় তাঁর কাছে। এ-কাব্যের শরীরে-মাংসে-রক্তে ধরা পড়েছে একাত্তরের বুলেটবিদ্ধ হৃৎপিন্ডের ওঠানামা। বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটি বিশ্লেষণ করা যাক - ‘স্বাধীনতা’ নামক শব্দটিকে তিনি দেখেছেন বিভিন্নভাবে। ‘স্বাধীনতা’ শব্দটিকে তিনি ভরাট গলায় উচ্চারণ করে তৃপ্তি পেতে চান। শহরের অলিতে-গলিতে, আনাচে-কানাচে, প্রতিটি রাস্তায়, বাড়িতে, সাইনবোর্ডে, পাখিতে, নারীতে ঝলকিত হতে দেখেছেন প্রিয় শব্দটিকে। স্বাধীন দেশের কবিদের সম্বোধন করে জানালেন যে, তিনি আজ ক্ষুব্ধ। কেননা স্বাধীনতা নামক শব্দটি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে বাংলায় - ‘অথচ জানে না ওরা কেউ/ গাছের পাতায়, ফুটপাতে/ পাখির পালকে, কিংবা নদীর দু’চোখে/ পথের ধুলায়, বস্তির দুরন্ত ছেলেটার/ হাতের মুঠোয়/ সর্বদাই দেখে জ্বলে স্বাধীনতা নামক শব্দটা।’ (বন্দী শিবির থেকে)

শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধের কবিতার মধ্যে বহুল প্রচারিত দুটো কবিতা হচ্ছে ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ এবং ‘স্বাধীনতা তুমি’। কবিতাদ্বয় যুগল কবিতা নামে পরিচিত। কবিতা দুটোর অভ্যন্তরে স্লোগানের প্রাবল্য লক্ষ করা যায়। অবশ্য সে-প্রাবল্যকে কবি শাসন করেছেন কবিতায় নরম আবেদনের মাধ্যমে। তাই যা হতে পারত নিছক স্লোগান, তা হয়ে উঠেছে বিষাদের গাথা। যেমন - ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে/ আর কতোকাল ভাসতে হবে রক্ত গঙ্গায়/ আর কতোবার দেখতে হবে খান্ডব দাহন?/ তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ সখিনা বিবির কপাল ভাঙলো/ সিথির সিঁদুর মুছে গেলো হরিদাসীর।’

এই কবিতায় শামসুর রাহমান স্বাধীনতাকাঙ্খী এমন কিছু মানুষের কথা বলেছেন যারা একেবারে খেটে-খাওয়া মানুষ, দরিদ্র সাধারণ মানুষ। যেমন - উদাস হাওয়ায় বসে থাকা এক থুত্থুরে বুড়ো - যার চোখের নিচে অপরাহ্নের দুর্বল আলোর ঝিলিক। দগ্ধ ঘরের নড়বড়ে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মোল্লাবাড়ির এক বিধবা মহিলা। পথের ধারে শূন্য থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকা এক অনাথ কিশোরী। ঢাকার রিকশাওয়ালা রতœসম শেখ, শাহবাজপুরের জোয়ান কৃষক সগির আলী, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি মতলব মিঞা এবং অন্য সবাই প্রতীক্ষা করছে স্বাধীনতা লাভের আশায়। কবিতাটিতে কবি আমাদের নিশ্চিত আশার বাণী শুনিয়েছেন - ‘পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিকবিদিক/ এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে/ হে স্বাধীনতা।’ (‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’)

‘স্বাধীনতা’ সম্বোধন ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় প্রায় গানে পরিণত হয়েছে। যদিও সম্ভাবনা ছিল স্লোগানে পরিণত হওয়ার। কবিতাটি যে-স্লোগানে শিহরিত না হয়ে সুর মুখরিত হয়েছে এর মূলে রয়েছে শামসুর রাহমানের নিঃসঙ্গ পাশে কেউ নেই, তাই সম্ভব শুধু একান্ত, আন্তরিক, রূপময়, অতিশয়োক্তি - উজ্জ্বল প্রিয় সম্বোধন। স্বাধীনতা নামক শব্দটিকে তিনি সাজিয়েছেন নানা বর্ণে-রূপে-সুরে এবং তিনি তা সংগ্রহ করেছেন বাংলার নৈসর্গিক জীবনাচার থেকে। স্বাধীনতাকে নজরুলের বাবরি চুল, রবীন্দ্রনাথের কবিতা, শহীদ মিনার, পতাকা মিছিল, ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি, গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার ইত্যাদির সঙ্গে তুলনা করেছেন। যেমন- ‘স্বাধীনতা তুমি/ রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান/ স্বাধীনতা তুমি/ কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো/ মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা -’

বন্দিত্বের ব্যথা, ক্ষোভ ও হতাশা ইত্যাদি ব্যক্ত হয়েছে বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের প্রায় সব কবিতায়। তিনি কখনো ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন, আবার কখনো ভীত হয়েছেন। ‘পথের কুকুর’ কবিতার মাধ্যমে ফুটে উঠেছে একাত্তরের সেই অবরুদ্ধ জীবনের কথা, যেখানে ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকত পুরুষ-নারী, ছেলে-মেয়ে-বুড়ো সবাই। সমস্ত শহরে ছিল সৈন্যদের অত্যাচার, যখন-তখন গুলির আওয়াজ। যত্রতত্র মরা মানুষের লাশ। সব মিলিয়ে একটা ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল মানুষের জীবনে-মননে। ‘পথের কুকুর’ নামক কবিতাটিতে বন্দি ও প্রাণভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের চিত্র বিধৃত হয়েছে এভাবে- ‘আমি বন্দি নিজ ঘরে। শুধু/ নিজের, নিঃশ্বাস শুনি, এত স্তবদ্ধ ঘর।/কবুরে স্তব্ধতা নিয়ে বসে আছি/ দেয়াল-বিহারী টিকটিকি-/ চকিতে উঠলে ডেকে, তাকেও থামিয়ে দিতে চাই,/ পাছে কেউ শব্দ শুনে ঢুকে পড়ে ফালি ফালি চিরে মধ্যবিত্ত/ নিরাপত্তা আমাদের। সমস্ত শহরে/ সৈন্যরা টহল দিচ্ছে, যথেচ্ছ করছে গুলি, দাগছে কামান/ এখন চালাচ্ছে ট্যাঙ্ক যত্রতত্র। মরছে মানুষ/পথে ঘাটে, ঘরে যেন প্লেগবিদ্ধ রক্তাক্ত ইঁদুর।’ (‘পথের কুকুর’)

এই কবিতায় কুকুরের অসীম সাহসের কথা বলা হয়েছে। জলপাই রং, সন্ত্রাস, সশস্ত্র কতিপয় সৈনিক বোঝাই একটি জিপকে বারবার তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে পথের কুকুর। কিন্তু অসহায় মানুষের সশস্ত্র সেই জিপ তাড়াবার সাহস নেই। তাই কবিতার উপামায় কবি ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ‘যদি অন্তত হতাম আমি পথের কুকুর’।
যুদ্ধকালীন প্রতিদিনের বাস্তবচিত্র ধরা পড়েছে ‘প্রাত্যহিক’ কবিতায়। পুলিশ এবং রাজাকারের দৌরাত্ম্য, নারীর চিৎকার, হাত বাঁধা মানুষ, রাইফেলধারী পাঞ্জাবি সৈনিক ইত্যাদির বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে এ-কবিতায়। চারিদিক পালাবার সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়েছে হানাদার বাহিনী। যেমন - ‘পশ্চিমা জোয়ান আসে তেড়ে/ স্টেনগান হাতে আর প্রশ্ন দেয় ছুঁড়ে ঘাড় ধরে/ ‘বাঙালী হো তুম?’ আমি রুদ্ধবাক, কি দেব জবাব?/ জ্যোতির্ময় রৌদ্রালোকে বীরদর্পী সেনা/ নিমেষেই হয়ে যায় লুটেরা, তস্কর।’

কবিতাটির শেষের দিকে একাত্তরের পরাজিত রাজনৈতিক শক্তি অর্থাৎ মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলাম প্রভৃতির সমন্বয়ে গঠিত রাজাকার, আলবদর, শান্তি কমিটি, আলশামস ফ্যাসিবাদীদের কর্মতৎপরতার বর্ণনা এসেছে এভাবে - ‘তুমুল গাইছে গুণ কেউ কেউ কুণ্ঠাহীন খুনী/ সরকারের। কেউ কেউ ইসলামী বুলি ঝেড়ে তোফা/ বুলবুল হতে চায় মৃতের বাগানে।/ অলিতে গলিতে দলে/ মোহাম্মদী বেগ ঘোরে, ঝলসিত নাঙ্গা তলোয়ার/ নেপথ্যে মীরজাফর বঙ্কিম গোঁফের নীচে মুচকি হাসেন।’ (‘প্রাত্যহিক’)

যুদ্ধকালীন সময়ে এ-দেশীয় দালাল এজেন্টদের সাহায্য-সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার ও নিপীড়ন ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। প্রথমদিকে পাকিস্তানি বাহিনী এদেশের পথঘাট কিছুই চিনত-জানত না। কিন্তু পরবর্তীকালে আমাদের দেশীয় স্বার্থপর ও লোভী দালালদের সঙ্গে হাত করে গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর এরা ধ্বংস ও লুটপাট করতে লাগল। একদিকে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী, অন্যদিকে এদেশীয় আলবদর-রাজাকার বাহিনীর হত্যা, লুণ্ঠন আর ধর্ষণের ফলে নিরীহ বাঙালির জাতীয় জীবন হয়ে উঠল অতিষ্ঠ। তাই এই দুর্যোগময় পরিস্থিতি থেকে বাঁচার পথ খুঁজতে লাগল বাঙালি। বাঙালি বুঝতে পারল যুদ্ধ ছাড়া উদ্ধার সম্ভব নয়। ‘উদ্ধার’ কবিতায় সেই কথাই বিধৃত- ‘বিষম দখলীকৃত এ শহর/ পুত্রহীন বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস করুন/ যন্ত্রণা জর্জর ঐ বাণীহীন বিমর্ষ কবিকে/... জননীকে হারিয়ে সম্প্রতি খাপছাড়া/ ঘোরে ইতস্তত তাকে জিজ্ঞেস করুন/ হায় শান্তিপ্রিয় ভদ্রজন,/ এখন বলবে তারা সমস্বরে। যুদ্ধই উদ্ধার।’ (‘উদ্ধার’)

‘উদ্ধার’ ও ‘কাক’ কবিতাদ্বয় শামসুর রাহমানকে উদ্ধার করেছে আটকেপড়া বৃত্তাবদ্ধ জীবন থেকে। ‘উদ্ধার’ কবিতাটির কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। ‘কাক’ কবিতাটি আকারে কাকের মতো ছোট হলেও এর মধ্যে বিধৃত হয়েছে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাসত্মব সমাজ আলেখ্য। মাঠে কোনো গরম নেই, রাখাল ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। শূন্য মাঠ, নির্বাক বৃক্ষ, নগ্ন রৌদ্র, স্পন্দমান কাক - এগুলো হাহাকার ও শূন্যতার প্রতীক। নিম্নে কবিতাটি তুলে ধরা হলো -

গ্রাম্য পথে পদচিহ্ন নেই। গোঠে গরম/ নেই কোনো, রাখাল উধাও, রুক্ষ সরম/ আল খাঁ খাঁ, পথ পার্শ্বে বৃক্ষেরা নির্বাক/ নগ্ন রৌদ্র চতুর্দিকে, স্পন্দমান কাক, শুধু কাক।
বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য স্মৃতিচারণমূলক কবিতা হচ্ছে ‘মধুস্মৃতি’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রেস্তরাঁর নাম মধুর ক্যান্টিন। যার নাম অনুসারে এই রেস্তরাঁর নামকরণ করা হয়েছে, তিনি হলেন ‘শ্রী মধুসূদন দে’। মধুদা বলে তিনি সকলের কাছে অতিপরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সকলের প্রিয় মানুষ। এই মধুর ক্যান্টিন ছিল আমাদের সকল জাতীয় আন্দোলনের সূতিকাগার। একাত্তরের ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে মধুদাকে ঘাতকরা নির্মমভাবে হত্যা করে। তাই মধুদার স্মৃতিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে শামসুর রাহমান লিখলেন অমর কবিতা ‘মধুস্মৃতি’ কবিতাটি। যেমন - ‘আপনার নীল লুঙ্গি মিশেছে আকাশে,/ মেঘে ভাসমান কাউন্টার। বেলা যায়, বেলা যায়/ত্রিকালোজ্ঞ পাখী উড়ে, কখনো স্মৃতির খড়কুটো/ ব্যাকুল জমায়। আপনার স্বাধীন সহিষ্ণু মুখ- /হায়। আমরাতো বন্দী আজো - মেঘের কুসুম থেকে/ জেগে ওঠে, ক্যাশবাক্স রঙিন বেলুন হয়ে উড়ে।’

মধুদার মতো প্রিয় মানুষকে খুন করায় কবি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মাতৃভূমিকে যারা গোরস্তানে পরিণত করেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি অভিশাপের বাণী উচ্চারণ করেছে। ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থে ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ কবিতায় তা ফুটে উঠেছে। এই ধরনের অভিশাপের বাণী বাংলা কবিতায় সম্ভবত প্রথম ধ্বনিত হয়েছে এবং তা শামসুর রাহমানের কবিতায়। যেমন - ‘আমাকে করেছে বাধ্য যারা/ আমার জনক জননীর রক্তে পা ডুবিয়ে দ্রুত/ সিঁড়ি ভেঙে যেতে,/ ভাসতে নদীতে আর বন বাদাড়ে শয্যা পেতে নিতে/ অভিশাপ দিচ্ছি, ওরা বিশাল গলায়/ নিয়ত বেড়াক বয়ে গলিত নাছোড় মৃতদেহ - / অভিশাপ দিচ্ছি। ওদের তৃষ্ণায় পানপাত্র প্রতিবার/ কানায় কানায় রক্তে উঠবে ভরে, সে রক্ত বাংলায়/ বইয়ে দিয়েছে ওরা হিং¯্র/ জোয়ারের মতো/ অভিশাপ দিচ্ছি।’

শামসুর রাহমান মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দীর্ঘ নয় মাসের করুণ চিত্র বর্ণনা করেছেন বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের ভূমিকাংশে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো - ‘তখন ঢাকা এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। সুদীর্ঘ ন’মাস আমরা যে পরিবেশে বাস করেছি তাকে কাফকার জগৎ বললে কিছুই বলা হয় না। উৎপীড়ন, হত্যা এবং সন্ত্রাস আমাদের চারপাশে রচনা করেছিল এক ভয়ংকর তমসাচ্ছন্ন ও বিভীষিকাময় পটভূমি। আমরা তৃষিত হয়ে পড়েছিলাম এক ঝলক আলোর জন্যে। নীরন্ধ শ্বাসরোধকারী সেলের ভিতর বন্দী যেমন ব্যাকুল হয়ে থাকে এক ফোটা আলোর জন্য, ঠিক তেমনি। ঘরের দরোজা জানালা বন্ধ, শিশুরা নিশ্চুপ,ফৌজী জিপের গর্জন, ট্রাকের ঘর্ঘর, বুটের শব্দ, আগুন, আর্তনাদ আমরা এই নিয়েই ঢাকা ছিলাম তখন। আমরা প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করতাম। সব সময় মনে হতো কেউ যেন দরজায় কড়া নাড়ছে। ঘুমের ভেতর চিৎকার করে উঠতাম কোনো কোনো রাতে। বধ্যভূমির ধারে বেঁধে রাখা জীবজন্তুর অনুরূপ আমরা আতঙ্কে জেনেছি নিত্যসঙ্গী বলে। এমন কোনো দিনের কথা মনে করতে পারি না, যেদিন হত্যা কিংবা ধরপাকড়ের কোনো না কোনো খবর কানে না আসতো।’ এই ছিল যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের বাস্তবচিত্র। এই বিভীষিকাময় সময়ে লেখা তাঁর একটি কবিতায় যুদ্ধের চিত্র প্রকটভাবে ধরা পড়েছে। যেমন - কখনো নিঝুম পথে হঠাৎ লুটিয়ে পড়ে কেউ গুলির আঘাতে।/মনে হয়, ওরা গুলিবিদ্ধ করে স্বাধীনতাকেই/ দিন দুপুরেই জীপে একজন তরুণকে কানামাছি করে/ নিয়ে যায় ওরা।/মনে হয়, চোখ বাঁধা স্বাধীনতা যাচ্ছে বধ্যভূমিতে।/বেয়নেটবিদ্ধ লাশ বুড়িগঙ্গায় কি শীতলক্ষ্যায় ভাসে,/ মনে হয়, স্বাধীনতা লখিন্দর যেন,/বেহুলা বিহীন,/ জলেরই ভেলায় ভাসমান,/ যখন শহরে ফাটে বোমা, হাতবোমা, অকস্মাৎ/ ফাটে ফৌজী ট্রাকের ভেতর,/ মনে হয়, স্বাধীনতা গর্জে ওঠে ক্রোধান্বিত দেবতার মতো।

‘তুমি বলেছিলে’ কবিতায় বর্বর হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে নিঃসংকোচে। নয়াবাজার, ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মসজিদ, মন্দির, মানচিত্র, পুরনো দলিল ইত্যাদি ঘাতকের হাত থেকে রেহাই পায়নি। একে-একে তারা সব ধ্বংস করেছে। ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শহর ছেড়ে পালাচ্ছে সবাই দিকবিদিক। বনপোড়া হরিণী যেমন বন থেকে পালায়, তেমনি নবজাতককে বুকে নিয়ে উ™£ান্ত জননী শহর ছেড়ে পালাচ্ছে।
দাউ-দাউ পুড়ে যাচ্ছে ঐ নয়াবাজার/ পুড়ছে দোকানপাট। কাঠ/ লোহালক্কড় স্তুপ মসজিদ এবং মন্দির/...
অদূরে গুলির শব্দ, রাস্তাচষে জঙ্গী জীপ/ আর্ত শব্দ সবখানে। আমাদের দু’জনের। মুখে আগুন/ খরতাপ। আলিঙ্গনে থরোথরো/ তুমি বলেছিলে।/ আমাকে বাঁচাও এই বর্বর আগুন থেকে, আমাকে বাঁচাও।
(‘তুমি বলেছিলে’)

যুদ্ধকালীন সময়ে একটি অতি পরিচিত নাম গেরিলা। যুদ্ধের সময় ছদ্মবেশ ধারণ করে শত্রু বিনাশে যারা স্বাধীনতার সপক্ষে কাজ করেছেন তাদের সাধারণত আমরা গেরিলা বলে জানি। এই গেরিলাও শামসুর রাহমানের কবিতায় বিষয়বস্তু হয়ে ধরা পড়েছে। কিন্তু এই গেরিলা দেখতে কেমন, সে কী ধরনের পোশাক-আশাক পরে চলাফেরা করে, নাকি মাথায় জটাজাল। কেউ কি তাকে দেখেনি? দেখে থাকলেও তাকে কেউ চিনতে পারেনি। আসলে এটা জটাজালধারী গেরিলা, আমাদের অপরিচিত কেউ নয়। সে আমাদেরই ভাই, আমাদেরই সন্তান। যেমন -
দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে/ কুলজি তোমার আতিপাতি। তোমার সন্ধানে ঘোরে/ জানু গুপ্তচর, সৈন্য পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন/ করে খোঁজে প্রতিঘরে। পারলে নীলিমা চিরে বের করতো/ তোমাকে ওরা। দিতো ডুব গহন পাতালে।/ তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর/ সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া,/ তুমি তো আমার ভাই, নতুন, সন্তান আমার। (‘গেরিলা’)

অনেকে প্রশ্নœ করে গেরিলা দেখতে কেমন। খুঁজে কুলুজি আতিপাতি অর্থাৎ গেরিলার ঠিকানা খোঁজে ঘাতকরা। জানু গুপ্তচররা ও সৈন্যরা পাড়ায়-পাড়ায় প্রতিঘরে গেরিলাদের খুঁজে বেড়ায়। প্রয়োজনে নীল আকাশ ভেদ করতে কিংবা পাতালে ডুব দিতেও শত্রুদের কুণ্ঠা নেই। অথচ সে আমাদেরই সন্তান, আমাদেরই ভাই। গেরিলা আর ভবিষ্যৎ হাত ধরাধরি করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘাতকদের বর্বরতা দেখে কবি শামসুর রহমান ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কবিতার পঙক্তিতে সেই ক্ষোভ ও ঘৃণা আরো তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থের ‘রক্তসেচ’ কবিতায় তা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ‘টিক্কার ইউনিফর্মে শিশুর মগজ/ যুবকের পাঁজরের গুঁড়ো।/নিয়াজীর টুপিতে রক্তের প্রস্রবণ/ ফরমান আলীর টাই-এর নীচে ঝুলন্ত তরুণী... তুমি কি তাদের কখনো করবে ক্ষমা?’ (‘রক্তসেচ’)।

মাতৃভূমি শামসুর রাহমানকে যে কবিতাগুচ্ছ উপহার দিয়েছে দুঃসময়ের মুখোমুখি ও ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো তারই স্বাক্ষর বহন করে। শাসকের অত্যাচার, সত্তরের প্রলয়ঙ্করী সর্বগ্রাসী জলোচ্ছ্বাস ও একাত্তরের রক্তোচ্ছ্বাস - এই তিন প্রকারের প্রেরণা কাজ করেছে তাঁর কবিতার মধ্যে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে ফলবান হচ্ছে রক্তাক্ত একাত্তর। ‘স্যামসন’ কবিতাটি শাসন, শোষণ ও নিপীড়নের চিত্র এবং তা ‘টেলেমেকাসে’র স্বগোত্র। ‘টেলেমেকাসে’ কবি যেমন ছদ্মবেশ ধারণ করে মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন তেমনি ‘স্যামসনে’ও মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু এরপরও এ-কবিতা যে মুখোশ ছিঁড়ে সহজেই বেরিয়ে পড়েছে তার ও মাতৃভূমির মুখ। একাত্তর, একাত্তরের স্মৃতি ও স্বাধীনতা-উত্তর নিজস্ব অভিজ্ঞতাজাত কবিতাগুচ্ছ - ‘স্বাধীনতা একটি বিদ্রোহী কবিতার নাম’, ‘বহু কিছু থেকে দু’টি’, ‘ম্যাজিক’, ‘বারবার ফিরে আসে’, ‘জাল’, ‘কি করে লুকাবে’, ‘হে বঙ্গ’ (দুঃসময়ের মুখোমুখি) ‘ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা’, ‘অস্থি’, ভীতিচিহ্নগুলি’, ‘এ কেমন বৈরী তুমি’, ‘মহররমী প্রহর’, ‘স্মৃতির পুরাণ’, ‘আমি তো মেলারই লোক’, ‘একদিন রাস্তায়’, ‘এই মেলা’ (ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা) এর মধ্যে কিছু কবিতায় একাত্তরের রক্তপাতের হৃদয়স্পর্শী বিবরণ দেওয়া হয়েছে স্বাধীনতা কামনার সঙ্গে। দুঃসময়ের মুখোমুখি ও ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যদ্বয়ের একশ্রেণির কবিতা যুদ্ধকালের চিত্র ও স্বাধীনতা-আকাঙ্খার শিহরণের বহিঃপ্রকাশ এবং অন্য আরেক শ্রেণির কবিতায় স্থান পেয়েছে যুদ্ধোত্তর দুঃস্বপ্ন ও উন্মত্ততা। যেমন - ‘অস্থি’ এবং ‘ভীতিচিহ্নগুলি’ কবিতায়। স্বাধীনতা শামসুর রাহমানের কাম্য ছিল; কিন্তু স্বাধীনতা পাওয়ার পর কবির মনে কী কোনো ক্ষোভের জন্ম হয়েছে? ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যগ্রন্থের রক্তপাত ও লাশময়তা থেকে কবি উঠে আসতে চেয়েছেন। কাঁটার পরিবর্তে তিনি চেয়েছেন গোলাপফুল এবং দাবি করেছেন ‘ছড়িয়ে দাও পদ্মকেশর বাংলাদেশ’।

দুঃসময়ের মুখোমুখি কাব্যগ্রন্থের ‘জাল’ কবিতায় হতাশা তীব্র হয়ে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন -খুব কালো জাল পড়েছিলো ঠিকই চতুর্দিকে, আমি/ আটকা পড়িনি ভাগ্যবলে। বোকা হবার মতন/ বেঁচে আছি অপ্রস্তÍত। মৃত্যুর প্রতীক্ষা সর্বক্ষণ/ জুড়ে রয় চেতনায়। মৃত্যু আতংকেরই অনুগামী।/ এখন তো বেঁচে থাকাটাই হাস্যকর ভয়ানক।/ কখন যে দৃষ্টি থেকে পৃথিবীর আলোক/ মুছে যাবে। দেহ থেকে তাপ। কাকের মতোই চোখ/ বন্ধ করে জীবন গচ্ছিত রাখি ফাটলে নিছক। (‘জাল’, দুঃসময়ের মুখোমুখি)

শামসুর রাহমান সমকালীনতাকে সময় নামক হিং¯্র পশু দ্বারা আক্রান্ত দেখেছেন। ফলে তাঁর প্রিয় ঢাকা শহর ও প্রিয় জন্মভূমি দাঁড়িয়েছে দুঃসময়ের মুখোমুখি। এই দুঃসময় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অসুস্থতারই ফসল। কবি শামসুর রাহমান ‘আত্মজৈবনিক’ কবিতায় চিত্রায়িত করেছেন ঘাতক সময়ের বিবরণ, যুদ্ধোত্তর দাঙ্গা ও মর্মাত্মিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহীনতা।- যৌবন দুর্ভিক্ষ বিদ্ধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ভাঙে দেশ,/ এদিকে নেতার কন্ঠে নির্ভেজাল স্বদেশী আকুতি/ ভাষা খোঁজে আদর্শের ভরাডুবি মহাযুদ্ধ শেষে/ মঞ্চ তৈরী, কে হবে নায়ক তবে? করি তার স্তুতি?

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি। অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পুনর্বাসিত হয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধা এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অপরদিকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দোসর, এদেশীয় স্বার্থান্বেষী এজেন্টরা যুদ্ধের সময় লুটপাট ও লুণ্ঠন করে রাতারাতি বড়লোক হয়েছেন এবং সগর্বে এরাই রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাচ্ছেন। তাই কবি ক্ষোভ ও দুঃখে শ্লেষ প্রকাশ করেছেন। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেছেন, তাঁকে যেন একজন তুখোড় রাজাকার বানিয়ে দেন। সিরাজ উদ দৌল্লার সঙ্গে মীরজাফরের যে-সম্পর্ক, মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে রাজাকারের সে-সম্পর্ক। কবি সেই ঘৃণিত রাজাকার হওয়ার বাসনা প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে আমাদের নষ্ট সময়কেই চিহ্নিত করেছেন তাঁর কবিতায়। দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে কাব্যগ্রন্থের ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ কবিতায় শামসুর রাহমান তাঁর ক্ষোভকে ব্যক্ত করেছেন এভাবে -
“হে পাক পরোয়ার দেগার, হে বিশ্বপালক
আপনি আমাকে লহমায়
একজন তুখোড় রাজাকার করে দিন। তা হলেই আমি
দীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায়
তেল ঢালতে পারবো অবিচল।
গরীবের গরিবী কায়েম রাখবো চিরদিন আর
মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে
ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দিগ্বিদিক আর সবার নাকের তলায়
একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো অহর্নিশ
কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো অবকাঠামো।”

এ ছাড়া বন্দী শিবির থেকে কাব্যগ্রন্থের ‘আমিত্মগোনে’, ‘জনৈক পাঠান সৈনিক’, ‘শমীবৃক্ষ’, ‘প্রতিটি অক্ষরে’, ‘উদ্বাস্তু’, ‘মৃতেরা’, ‘আমাদের মৃত্যু আসে’, ‘ধ্বস্ত দ্বারকায়’ ইত্যাদি কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ অনুষঙ্গ, যুদ্ধকালীন সময় ও যুদ্ধোত্তর সময়ের বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শামসুর রাহমান দেশত্যাগ করে পালিয়ে যাননি। তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। দেশের সাধারণ মানুষের জ্বালা, যন্ত্রণা, ক্ষোভ, ক্রোধ ও ঘৃণা প্রভৃতি তিনি নিজের করে নিয়েছিলেন এবং সেই চেতনার আলোকে তাঁর মুক্তিযুদ্ধের কবিতাগুলো রচিত হয়েছে।

বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে এই তুখোড় তরুণ কবি সেই বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রদর্শন করে কবিতা লিখে অংশগ্রহণ করেছিলেন আমাদের প্রথম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সেই জাতীয় চেতনারই বর্ধিত ও চূড়ান্ত পরিণতি। এই পর্বেও শামসুর রাহমান সমান সক্রিয় ছিলেন। গণআন্দোলন, স্বদেশ চেতনা, মধ্যবিত্তের পরাজয়, অভ্যুত্থান, যুদ্ধকালীন আর যুদ্ধোত্তর সময়ের অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞানকে তিনি মুদ্রিত করেছেন তাঁর কবিতায়। শামসুর রাহমান প্রথমদিকে ছিলেন রোম্যান্টিক-নারী ও প্রকৃতিতে নিবেদিত, শব্দে ও ছন্দে ঝংকৃত এবং জীবনানন্দে নিমজ্জিত। দ্বিতীয় গ্রন্থ থেকেই শামসুর রাহমান রোম্যান্টিক অবস্থান ছেড়ে দেশ-কাল-সমাজ-প্রতিবেশের দিকে যাত্রা করেন। পরিশেষে বলা যায়, শামসুর রাহমানের মুক্তিযুদ্ধ ভিক্তিক কবিতাগুলো আমাদের জাতীয় চেতনারই হীরকখচিত অংশ।

শামসুর রাহমান- দেশ ও কালের কবি:
কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছেন ‘ঢাকা শহরের কবি’ শামসুর রাহমানের কবিতায় ‘আসাদের শার্ট’ হয়ে ওঠে ‘বিদ্রোহের লাল পতাকা।’ মাওলানা ভাসানীর ‘সফেদ পাঞ্জাবি’ তাঁর কাছে শুধুই ‘শান্তির নিশান’ নয়। একাত্তরের ঢাকা তাঁর কাছে শুধু অবরুদ্ধ নগরী মাত্র নয়। ‘শামসুর রাহমানের কবিতায় তা শত্রু নিধনের সঙ্কল্পে দৃঢ়চিত্ত সাহসী মানুষের জনপদ’ (ইলিয়াস, মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা, সা. বা. সংখ্যা ১৯৯১ পৃ. ৫৯)।

ঢাকা শহরের আন্দোলন, উত্থান পতন রাজনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে শামসুর রাহমানের অস্তিত্বের মিশে যাওয়াকে ইলিয়াস খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে চিহ্নিত করেছেন যা প্রকারান্তরে শামসুর রাহমানের রাজনীতি সচেতনতা, দেশ ভাবনা, অন্যায় আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর আর কবির ভেতরে প্রোথিত আজন্ম স্বাধীনতার আকাঙ্খকেই স্পষ্ট করে তোলে। শামসুর রাহমানের কবিতায় প্রেম, আত্মমগ্নতা, দ্রোহ,স্মৃতিকাতরতা, নাগরিক মোহ খুব শিল্পিতভাবে জায়গা করে নিলেও দেশপ্রেম, দেশভাবনা, কাল ও জীবনভাবনা তার কবিতায় বারবার ফিরে ফিরে এসেছে। শামসুর রাহমানকে আন্দোলিত করেছে এদেশের সকল আন্দোলন সকল সংগ্রাম আর জনতার জাগরণ। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সশরীরে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। সেই আন্দোলনে আসাদের মৃত্যু তাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল লিখেছিলেন কালজয়ী সেই কবিতা ‘আসাদের শার্ট ’
“আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখন্ড বস্ত্র মানবিক;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।” (আসাদের শার্ট)

এই একই প্রেরণা, এই একই চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ও। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর কবি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি কিন্তু ছয়কোটি অবরুদ্ধ বাঙালির একজন হয়ে দেখে গেছেন স্বাধীনতার স্বপ্ন। পৈতৃক নিবাস পাহাড়তলীতে বসে একাত্তরে এপ্রিলে একই দিনে লেখলেন দুটো কবিতা স্বাধীনতা তুমি ও তোমাকে পাবার জন্য হে স্বাধীনতা । লিখলেন-
“স্বাধীনতা তুমি
রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা” (স্বাধীনতা তুমি )

‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতাটি এভাবে শুরু করে তিনি স্বাধীনতাকে এমন সব চিত্রকল্পের সঙ্গে, আমাদের চেনা জীবন, আমাদের প্রিয়জন, আমাদের রাজনীতি, আমাদের চেনা সংগ্রামের সঙ্গে এমনভাবে সম্পৃক্ত করলেন যে কবিতাটি স্বাধীনতা শব্দের প্রতিশব্দ আর আমাদের স্বাধীনতার আকাঙ্খার প্রতিরূপ হয়ে উঠল। স্বাধীনতার সেই অদম্য স্পৃহায় কবিতাটি তিনি শেষ করেছেন এইভাবে :
“স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান
বয়েসী বটের ঝিলিমিলি পাতা
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।”

স্বাধীনতার এই স্বপ্ন কবিকে প্রত্যয়ী করেছিল। রক্তে যে স্বাধীনতার ডাক, যে স্বাধীনতা রক্তক্ষয়ী, মায়ের কোল খালি করা, বধূর সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয়া, বোনের বুক থেকে ভাইকে কেড়ে নেয়া আর লক্ষ নারীর ইজ্জত হারানোর। স্বাধীনতা যে আসবেই এ বিষয়ে দ্বিধাহীন ছিলেন কবি-

“পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
জলন্ত ঘোষণার ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলে
নতুন নিশানা উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক
এই বাংলায়,
তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা” ( তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা )

দেশ, এই দেশের সংস্কতি সাহিত্য, জীবনযাত্রা, ঐতিহ্য ভালবাসতেন বলেই কবি ভালবাসতেন বাংলাভাষাকে, প্রাণের চেয়ে প্রিয় বর্ণমালাকে। বাংলা এবং বাংলাভাষা ছিল তার অস্তিত্বের গভীরে এই বর্ণমালাকে নিয়ে লেখা
তার উজ্জ্বল পঙক্তি-
“নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছ আমার সত্তায়।
মমতা নামের প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড়
ঘিরে রয় সর্বদাই। কালো রাত পোহানোর পরের প্রহরে
শিউলি-শৈশবে ‘পাখি সব করে রব’ ব’লে মদনমোহন
......
আজন্ম স্বপ্নের সাথি তুমি,
আমাকে স্বপ্নের সেতু দিয়েছিলে গ’ড়ে পলে পলে। (বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা )
বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে
রৌদ্র, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্না চন্দন। বাংলা ভাষা
উচ্চারিত হল অন্ধ বাউলের একতারা বাজে
উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর
বাঁকে-বাঁকে; নদীও নর্তকী হয়। যখন সকালে
নতুন শিক্ষার্থী লেখে তার বাল্যশিক্ষার অক্ষর।” (বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে)

শামসুর রাহমান স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেমন ইচ্ছে তেমন করে কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যখন পদদলিত, দেশ যখন শৃঙ্খলে আবদ্ধ, হায়েনারা যখন আবার চুষে খাচ্ছে আমাদের রক্ত তখন তার কলম থেমে থাকেনি তিনি তখন লিখলেন-

“উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়; মুক্তিযুদ্ধ
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।” (উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ)

এভাবে সময় কাল এবং দেশভাবনা থেকে কখনই বিচ্ছিন্ন থাকেননি তিনি। তাঁর কবিতায় বার বার উঠে এসেছে দেশপ্রেম ও দেশভাবনা। সামরিক শাসনে পিষ্ট দলিত বাংলাদেশকে দেখে বলেছেন,

“তুমি কি জল্লাদের হ্যাট-কোট-পরা শাঁসালো
বিদেশীকে দেখে
তোমার উরুদ্বয় ফাঁক করে দেবে নিমিষে?” (গুড মর্নিং বাংলাদেশ)

কবি এরপর অভিশাপ দিয়েছেন সেই সব রক্তখেকো হায়েনাদের-

“তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি।
আমার বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে” (অভিশাপ দিচ্ছি)

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ সেøাগান বুকে লিখে শহীদ হয়েছিল নূর হোসেন তাকে নিয়ে লিখেছেন,
“বাংলাদেশ
মনপোড়া হরিণীর মতো আর্তনাদ করে তার
বুক থেকে অবিরাম রক্ত ঝরতে থাকে ঝরতে থাকে।” (বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়)

আবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চেতনা আর ইতিহাস বিকৃতির কবলে পড়ে জাতি যখন দিশেহারা। যখন আবারও ধেয়ে আসছে অন্ধকার। এই অন্ধকারের বুক চিড়ে প্রতিবাদের মশাল হাতে এগিয়ে আসেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। তাঁকে সম্মান জানিয়ে কবি লিখেন,

“এই তিমরাবৃত প্রহরে দেখতে পেলাম
তোমার উত্তোলিত হাতে
নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে ফেরারি বসন্ত,
আর আমাদের ভবিষ্যৎ।” (‘শহীদ জননীকে নিবেদিত পঙক্তিমালা’)

তবে এই অবরুদ্ধ জীবন চারপাশের এই জটিল কুটিল জীবন, অসত্যের বেড়াজাল, অন্যায় আর অসাম্যের বিজয় এইসব তাকে নানাভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ। করলেও এবং তার কলমে বার বার ঘৃণা ও ক্ষোভ উদ্গীরিত হলেও শামসুর রাহমান ছিলেন আশাবাদী। তাই তিনি এই পঙ্কিল সমাজ থেকে আহরণ করতে চেয়েছেন গোলাপ-

“ঘাতক তুমি সরে দাঁড়াও, এবার আমি
লাশ নেবো না।
নই তো আমি মুদ্দোফরাস। জীবন থেকে
সোনার মেডেল,
শিউলিফোটা সকাল নেব।
ঘাতক তুমি বাদ সেধো না, এবার
আমি গোলাপ নেব।” ( ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা)

এইভাবে শামসুর রাহমান তাঁর সময়, সমসাময়িক রাজনীতি, দেশ, দেশের ভবিষ্যত সচেতন কবি ছিলেন। তাঁর লেখা ধারণ করেছে কাল, রাজনীতি, দেশপ্রেম, দেশভাবনা ও আত্মজাগরণ। এই জীবনবোধ দেশের জন্য মমতা ও প্রেম শামসুর রাহমানকে আবার পরিণত করেছিল বিশ্ব নাগরিকে। তার মধ্যে এসেছিল আন্তর্জাতিকতাবোধ। তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেন-

“আমার যখন ঘড়ির দুটো কাঁটার মতো
মিলি রাতের গভীর যামে,
তখন জানি ইতিহাসের ঘুরছে কাঁটা,
পড়ছে বোমা ভিয়েতমানে!”

উপসংহার:
কবি শামসুর রহমানের এই দেশপ্রেম, দেশভাবনা ও নিজের লেখা প্রসঙ্গে শামসুর রাহমানের নিজের উক্তি- ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমার জন্ম। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে আমি এক নবীন যুবক। বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়াবহতা আমি প্রত্যক্ষ করেছি। দেখেছি অগণন অসহায় মানুষের মুখ। দুুর্ভিক্ষের বিভীষিকাও আমার অভিজ্ঞতার বাইরে নয়। আমার কবিতায় আমি আমার কাল আর আমার স্বদেশকেই লিপিবদ্ধ করেছি। আমার সককাল যে-মহাকালের অংশ, তাকেও বিস্মৃত হইনি। আমার স্বদেশ যে-বিশ্বের একখন্ড জমিন, ধরতে চেষ্টা করেছি সেই বিপুল বিশ্বের অপার হাসি কান্নাকেও।’

শামসুর রাহমানের কবিতা তাই তাঁর স্বদেশকে ধারণ করে হয়ে উঠেছে স্বদেশের মুখ। এই মাটি ও মানুষকে ভালোবেসে শামসুর রাহমান তাই শেষ পর্যন্ত আশাবাদী থেকেছেন স্বপ্ন দেখেছেন সুন্দর দেশ আর সুন্দর মানুষের-
“মনে দ্বিধা, আতঙ্ক, নিরাশা
কিছুতেই কখনো দিও না ঠাঁই পা চালাও দ্রুত।”
আসুন, আমরা দ্রুত পা চালিয়ে যাই সূর্যোদয়ের পথে। (‘পরস্পর হাতে হাত রেখে’)



সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রিকা:
১। শামসুর রাহমান নিঃসঙ্গ শেরপা, হুমায়ুন আজাদ, বাংলা একাডেমি, ১৯৮৩।
২। বাংলাদেশের আধুনিক কাব্য পরিচয়, দীপ্তি ত্রিপাঠী, কলকাতা, ১৯৯৪।
৩। আধুনিক কবি ও কবিতা, হাসান হাফিজুর রাহমান, বাংলা একাডেমি, ১৯৭৩।
৪। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, আবুল হাসনাত-সম্পাদিত, সন্ধানী প্রকাশনী, ১৯৯১।
৫ বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার কবিতা : তুলনামূলক ধারা, মাসুদুজ্জামান, বাংলা একাডেমি, ১৯৯৩।
৬। পূর্ব বাংলার রাজনীতি-সংস্কৃতি ও কবিতা, সাঈদ উর রাহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৮৩।
৭। মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, রফিকুল ইসলাম, সাহিত্য পত্রিকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৮। বাংলাদেশের কবিতায় ব্যক্তি ও সমাজ, দিলারা হাফিজ, বাংলা একাডেমি, ২০০২।
৯। দৈনিক যায় যায় দিন, সাপ্লিমেন্টারী ম্যাগাজিন পলিটিকস ্ সোসাইটি, ২২ আগস্ট ২০০৬ সংখ্যা পৃষ্ঠা ৫ কলাম ৩

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৯:৫৪

প্রামানিক বলেছেন: ভাল লাগল।

৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:২০

মিটন আলম বলেছেন: পাঠ করার জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:২৪

মিটন আলম বলেছেন: ধন্যবাদ প্রামানিক

২| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:০৭

ডঃ এম এ আলী বলেছেন: শ্রদ্ধেয় কবির গৌরবময় জীবনালেক্ষ নিয়ে তথ্যনির্ভর
ও উল্লেখযোগ্য কবিতার উদ্ধৃতির সাবলিল বর্ণনা
লিখাটির সাথে কবিকেও নিয়ে গেছে অনেক উচ্চতায়।
ধন্যবাদ রইল লিখকের প্রতি সেসাথে কবিপ্রতি রইল
অকৃত্তিম ভালবাসা ।

৩০ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ১০:২২

মিটন আলম বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ ডাঃ এম এ আলী

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.