![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী একটি গণহত্যার সূচনা করেছিল, যা পরবর্তী ৯ মাস ধরে চলেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেই গণহত্যা শুরু করলেও পরে তাতে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারত থেকে আগত বিহারি সম্প্রদায়, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের নেতাকর্মীরা। জুলাই মাসের দিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পুলিশ আর রেঞ্জার এনে গঠন করেছিল ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস। সবাই মিলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ মাসে নির্বিচারে নিরীহ বাঙালি হত্যায় মেতে উঠেছিল। তাদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে সর্বোচ্চসংখ্যক বাঙালিদের হত্যা করে পর্যায়ক্রমে এ দেশে অবাঙালিদের এনে বসবাসের সুযোগ করে দিয়ে বাঙালিদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা। এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য সেই সময় রেলওয়েতে কর্মরত অবাঙালি কর্মচারী ও কর্মকর্তারা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে অবাঙালি রেল কর্মচারীদের কাছে একটি লিফলেটও বিলি করা হয় এই পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করে। একসময় রেল সদর দপ্তর ছিল চট্টগ্রামে এবং রেলের বেশির ভাগ কর্মচারী-কর্মকর্তা ছিল ভারত থেকে আসা অবাঙালি বিহারি। রেল বা সরকারের অন্যান্য সংস্থায় চাকরি দেওয়া তাদের পুনর্বসানেরই অংশ ছিল। এ ছাড়া পাটকল ও বন্দরের বেশির ভাগ শ্রমিকই ছিল অবাঙালি। পূর্ব বাংলায় ৯ মাস ধরে গণহত্যা পরিচালনার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী এই অবাঙালিদের বেশ কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছে। পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, এই বিহারি মোহাজেরদের জন্য বাঙালিরা ষাটের দশক পর্যন্ত ‘রিফিউজি ট্যাক্স’ আদায় করেছে। ট্রেনের টিকিট, বিদ্যুতের বিল, সিনেমার টিকিট, রেশন কার্ডে চাল ক্রয়ের সময়, পোস্ট অফিসে লেনদেনের সময়, এমনকি জমি ক্রয়-বিক্রয়ের সময়ও বাঙালিদের এই কর দিতে হয়েছে। আর এই অবাঙালি মোহাজেররাই ১৯৭১ সালের ৯ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে বাঙালি ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। অবশ্য তাদের মধ্যেও অনেক ব্যতিক্রম ছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জেনারেল জিয়াসহ যাঁরাই ক্ষমতায় এসেছেন তাঁরাই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের বাঙালিদের ওপর গণহত্যা চালানোর ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিয়েছেন। প্রথমে বলা শুরু হলো, ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর হত্যাকাণ্ড (গণহত্যা নয়) চালায় পাক বাহিনী অর্থাৎ পবিত্র বাহিনী। তাদের কোনো দেশ বা ঠিকানা নেই। এরপর পাক বাহিনীর পরিবর্তে হানাদার বাহিনী বলা শুরু হলো। নতুন প্রজন্ম জানল না কারা এই হানাদার বাহিনী। তা না জেনে এই ঢাকা শহরের কিছু উচ্চবিত্ত আধুনিক ললনা বাংলাদেশে পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা চলাকালে ঝাণ্ডা উড়িয়ে ঘোষণা করল তারা পাকিস্তানি ক্রিকেট খেলোয়াড় আফ্রিদিকে বিয়ে করতে চায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি তুলল আর কিছুর জন্য না হোক ইতিহাসের দায়বদ্ধতার কারণে এ প্রজন্মের সামনে একাত্তরের শত্রু-মিত্রের পরিচয় তুলে ধরতে হবে। বলতে হবে তারা যেই বাংলাদেশকে জানে বা চেনে তার জন্মের পেছনে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম আর কোটি কোটি মানুষের আত্মত্যাগ আছে। বলতে হবে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশে নিরীহ মানুষ হত্যা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এক ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করেছিল, যা পরবর্তী ৯ মাস চলেছিল। বাংলাদেশে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়, কারণ এই দিন রাতের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এই দিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর কাছে রমনা রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ করেছিল। অন্তত এই দুটি দিনে কিছুটা হলেও নতুন প্রজন্মের জানার সুযোগ হয় দিনগুলোর তাত্পর্য। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে তারা দেখতে পারে দিন দুটি কেন আমাদের ইতিহাসের অপরিহার্য অংশ। তার পরও নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের জাতীয় দিনগুলো সম্পর্কে অজ্ঞতা পর্বতসম। এটি তাদের দোষ নয়। এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও পারিবারিক সংস্কৃতির অবদান। এই অজ্ঞতা দূর করা ও নতুন প্রজন্মকে এসব দিনের তাত্পর্য বোঝাতে এক শ্রেণির মানুষ, যাঁরা বাংলাদেশ ও বাঙালিয়ানায় বিশ্বাস করেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, তাঁরা নিজের তাগিদে দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাতে একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম ইতিহাস থেকে ছিটকে না পড়ে। তাঁরা একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য সরকারকে বাধ্য করতে পেরেছেন এবং তার ফলে সেই যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোদাদের ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের ব্যবস্থা করে তাদের অপরাধের জন্য প্রাপ্য দাবি আদায় করতে পেরেছেন। নতুন প্রজন্ম জেনেছে, একাত্তরে কারা এ দেশের সূর্যসন্তানদের হত্যা করেছিল। সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম গঠন করে সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে সাধারণ মানুষকে বাংলাদেশের শত্রু-মিত্র চিনিয়ে দিতে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ২৫ মার্চ রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে জগন্নাথ হল পর্যন্ত মিছিল করে এসে গণকবরের পাশে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-কর্মচারীদের সমাধির পাশে এসে সম্মান জানিয়েছেন। নাম দিয়েছেন ‘আলোর মিছিল’। এতে সর্বস্তরের জনগণ শামিল হয়েছে। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মাণ করেছেন।
বাংলাদেশে পালিত বিভিন্ন জাতীয় দিবসের সঙ্গে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে চিহ্নিত করে তা রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করার দাবি অনেক দিন ধরেই চলছে। যেকোনো কারণেই হোক তা এত দিন সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। এখানে আরো উল্লেখ্য যে মার্চ বা ডিসেম্বর মাস এলে পাকিস্তানের মিডিয়া থেকে শুরু করে সে দেশের রাজনীতিবিদরা ইনিয়ে-বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন, একাত্তরে বাংলাদেশে কোনো অন্যায় যুদ্ধ বা গণহত্যা হয়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী শুধু দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য যতটুকু বল প্রয়োগ করার কথা, ততটুকুই করেছে। পাকিস্তান ভাঙার ভারতীয় ষড়যন্ত্রের ফসল হচ্ছে বাংলাদেশের জন্ম। প্রতিবছর ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি মিডিয়ায় এ সম্পর্কে বেশ কিছু আলোচনাও হয়। তাদের সর্বশেষ বালখিল্যতার ফসল হচ্ছে জনৈক ব্যবস্থাপনা পরামর্শদাতা জুনায়েদ আহমেদের তথাকথিত গবেষণামূলক গ্রন্থ Creation of Bangladesh-Myths Exploded. জুনায়েদ আহমেদ বলার চেষ্টা করেছেন বাংলাদেশের সৃষ্টি সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় অথবা লেখা হয় তা স্রেফ কল্পকাহিনি। একাত্তরে এ দেশে যে হত্যাকাণ্ডগুলো হয়েছে তা মূলত বাঙালিরাই করেছে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে অনেক ঐতিহাসিক মৃতদেহের ছবিও জুনায়েদ আহমেদের মতে, বাঙালিদের হাতে নিহত অবাঙালিদের ছবি। বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর সেটি নিয়ে বাংলাদেশের গবেষক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সবাই নানাভাবে তাঁদের তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একই সঙ্গে ২৫ মার্চকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা দিবস ঘোষণা করার দাবিটা আরো জোরালো হয়। একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির এক সভায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ অঙ্গীকার করেন তিনি সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করবেন, যা তিনি করেছেন এবং দাবি তুলেছেন ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হোক।
সদ্যসমাপ্ত সংসদ অধিবেশনের শেষ দিনে, গত শনিবার সংসদে জাসদের সংসদ সদস্য শিরিন আখতার একটি সূচনা বক্তব্য দিয়ে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করার প্রস্তাব করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে সংসদের ভেতরে কয়েকটি প্রজেক্টরের সাহায্যে কিছু ভিডিও ও স্থিরচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর প্রধানমন্ত্রী এক আবেগঘন নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে সবাইকে, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে সেই ভয়াল রাতের কথা বলেন। সংসদের ভেতর তখন পিনপতন নীরবতা। এরপর চার ঘণ্টা ধরে সংসদের অন্য সদস্যরা বক্তব্য দেন। সবশেষে লিখিত বক্তব্য দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের বক্তব্য যাঁরা শুনেছেন তাঁরা স্বীকার করবেন তাঁদের দুজনের বক্তব্য ছিল তাঁদের দেওয়া সেরা বক্তব্যগুলোর অন্যতম।
১৯৯২ সালে শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেত্রী। গোলাম আযমকে গণরোষ থেকে বাঁচানোর জন্য খালেদা জিয়ার নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদিকে গোলাম আযমের গণ-আদালতে ফাঁসির রায় ঘোষণার জের ধরে শহীদজননী জাহানারা ইমামসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ১৬ এপ্রিল শেখ হাসিনা সংসদে এক দীর্ঘ ভাষণে কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দরকার তার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। দাবি করেন ট্রাইব্যুনালে গোলাম আযমের বিচার করতে হবে। তিনি একাত্তরে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা তুলে ধরেন। বিএনপি সংসদ সদস্য ফরিদা হাসানকে লক্ষ্য করে বলেন, কিভাবে তাঁর স্বামী সৈয়দুল হাসানকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর মৃতদেহও পাওয়া যায়নি। শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষে ফরিদা হাসান সংসদের ট্রেজারির বেঞ্চ থেকে উঠে এসে শেখ হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলেন, ‘মা, এই কথাগুলো শোনার জন্য এত দিন বেঁচে ছিলাম।’ শনিবার শুধু শেখ হাসিনাই নয়, পুরো সংসদই ছিল অনন্য। সংসদে যদি বিএনপি থাকত, তাহলে সংসদের কিছু ফাইলপত্র ছিঁড়ত না অথবা আসন ভাঙত না, তা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় না। চার ঘণ্টা বিভিন্ন সংসদ সদস্যের প্রস্তাবের ওপর আলোচনার পর শিরিন আখতারের প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এখন থেকে বাংলাদেশে ২৫ মার্চ ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হবে।
এটি এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, একজন শেখ হাসিনা যদি প্রধানমন্ত্রী না থাকতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হতো না। বিশেষ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চিন্তাও করা যেত না। পদ্মার ওপর নিজস্ব অর্থায়নে সেতুও হয়তো স্বপ্নই থেকে যেত। সর্বোপরি ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা একটি অসম্ভব বিষয় হতো। তাঁর অনেক সমালোচকও এখন স্বীকার করেন শেখ হাসিনার তুলনা শেখ হাসিনা। এ কারণে তাঁকে ঘাতকদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য দলের নেতাকর্মীরা এখনো নিজেদের জীবন বাজি রাখতে কার্পণ্য করেন না। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় তিনি অনেক সময় বলেন, তিনি এখন ক্লান্ত। বলতে চাই, তাঁর সঙ্গে পথচলার সাথির অভাব নেই। ক্লান্ত হলে জাতির জন্য অশনিসংকেত হতে পারে। পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ পথ। আপনাকে অভিবাদন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিহাস আপনাকে অমর করে রাখুক।
©somewhere in net ltd.