![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পঞ্চাশের দশকের কথা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন ছিলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী। ভারতে তখন নেহরু জমানা। দিল্লিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শীর্ষ বৈঠক হবে। মোহাম্মদ আলী জাঁক করে বললেন, তিনি এবার দিল্লি জয় করে ফিরবেন। সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁর সুন্দরী দ্বিতীয় স্ত্রী আলেয়া সাদীকে। তাঁর সুন্দর চোখের কটাক্ষপাতে নেহরু সহজেই কাত হবেন। কাশ্মীর সমস্যা থেকে সিন্ধু অববাহিকায় (Indus basin) পানিবণ্টন সমস্যা—সব কিছু সম্পর্কে একটা মীমাংসা নিয়ে ফিরবেন মোহাম্মদ আলী।
দিল্লি বিমানবন্দরে ঘটল অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনা। বিমান থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় সুন্দরী আলেয়া সাদীর পা ফসকে তাঁর স্যান্ডেলের এক পাটি নিচে পড়ে যায়। পিআইএ বিমানের সিঁড়ির গোড়াতেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উচ্চ সরকারি কর্মকর্তাসহ দাঁড়িয়ে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরু। তিনি চট করে স্যান্ডেলটি ধরে ফেলেন এবং আলেয়া সাদীর পায়ে পরিয়ে দেন। ক্লিক ক্লিক করে হাজারটা ছবি উঠল। পাকিস্তান ও ভারতের সব বড় বড় কাগজে সেই ছবি ছাপা হলো। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী বললেন, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নয়, আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। নেহরু আমার বড় ভাই। দুই ভাই মিলে দুই দেশের সব সমস্যার সমাধান করে ফেলব।’
বিরাট প্রত্যাশা জেগেছিল তখন উপমহাদেশে। নেহরু ও মোহাম্মদ আলীর গলা জড়াজড়ি করে তোলা ছবিও ছাপা হয়েছিল কাগজে। কিন্তু হায় হতোস্মি! সেই বহু ঢাক পেটানো বৈঠক সফল হয়নি। পর্বত একটি মূষিকও প্রসব করেনি। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ছোট ভাই মূলত শূন্য হাতে ফিরে এসেছিলেন পাকিস্তানের তখনকার রাজধানী করাচিতে। লাহোরের একটি উর্দু দৈনিকে একটি কার্টুন ছাপা হয়েছিল, তাতে দেখানো হয়েছিল, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী স্ত্রী আলেয়া সাদীকে নিয়ে করাচি বিমানবন্দরে বিমান থেকে অবতরণ করছেন। তাঁদের হাতে একটি শূন্য থালা।
বহু বছর আগে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর ও বর্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের একটা পার্থক্য আছে। এই সফর নিয়ে বড় ঢাকঢোল পেটানো হয়নি। বিরাট প্রত্যাশা তৈরি করা হয়নি। বরং এই বৈঠকের সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশের কয়েকটি মহল সক্রিয় ও সরব। জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য ক্রমাগত প্রচার করা হচ্ছে, শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে তিস্তার পানি চুক্তিতে সই আদায় করতে পারবেন না; বরং ভারতের চাপে এমন এক সামরিক বা নিরাপত্তা চুক্তিতে সই দিয়ে আসবেন, যাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হবে।
এটা বাংলাদেশের ভারতবিরোধীদের প্রচার। আবার পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশিদেরও প্রচারণা; কিন্তু ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যে যে জটিলতা ছিল ও এখনো আছে, সেই জটিলতা বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মধ্যে নেই। এই সত্যটা এই প্রচার-প্রচারণায় উহ্য রাখা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করেছে ভারত এবং দুটি দেশের মধ্যে কাশ্মীর সমস্যা, খালের পানি সমস্যাসহ অনেক সমস্যা নিয়ে বিবাদ ও যুদ্ধ সেই স্বাধীনতা লাভের প্রথম দিন থেকে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে সমর্থন ও সাহায্য জুগিয়েছে ভারত। যুদ্ধের সময় এক কোটি বাংলাদেশিকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়েছে। ভারত বড় দেশ। তার যে আধিপত্যবাদী মনোভাব নেই, তা নয়। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে সেই আধিপত্যবাদী মনোভাব সে বাংলাদেশের ব্যাপারে দেখায়নি। বরং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চাওয়া মাত্র বাংলাদেশ থেকে কয়েক ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করেছে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে গঙ্গার ৪৪ হাজার কিউসেক পানি দিতে সম্মত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আমলেই ছিটমহল চুক্তি সম্পাদিত হয়। অবশ্য বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। এর কারণ আছে।
ইতিহাস বিকৃত করা সম্ভব। কিন্তু তার সত্য বেশি দিন চাপা দিয়ে রাখা যায় না। বাংলাদেশে বিএনপির নেতানেত্রীরা ও পাকিস্তানপন্থী এক শ্রেণির কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী অনবরত প্রচার করছেন, বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারত সব সময় শুধু সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি। ভারত বাংলাদেশে তাদের আধিপত্য চাপাতে চায়।
আধিপত্য চাপাতে চাওয়া এক কথা এবং তা চাপাতে পারা আরেক কথা। বঙ্গবন্ধুর প্রখর ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের মোকাবেলায় বাংলাদেশকে ভারত সমমর্যাদা দেখিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনে যথাসাধ্য সাহায্য জুগিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন ও তাঁর সরকার আরো কিছুকাল ক্ষমতায় থাকত, তাহলে ভারতের সঙ্গে যে অন্য সমস্যাগুলো ছিল তার সমাধান যে এত দিনে হয়ে যেত, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সমমর্যাদাভিত্তিক মৈত্রী ও সহযোগিতার স্থায়ী সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতো।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তা যে হলো না বরং বাংলাদেশের প্রতি ভারত ক্রমেই বিরূপ হয়ে উঠল, গঙ্গার পানির প্রতিশ্রুত ভাগ দিতে চাইল না, ছিটমহল চুক্তি ঝুলিয়ে রাখল, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিতে চাইল, সেখানে ক্রসফায়ার শুরু হলো, সে জন্য ভারত কি একা দায়ী? ব্রিটেনের বাম রাজনীতির তাত্ত্বিক জ্যাক ওয়াদিস বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ঘটনা শুধু সামরিক ক্যু নয়, এই ঘটনার মাধ্যমে পাকিস্তান তার ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয় এবং বাংলাদেশে তার আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তবে এবার প্রত্যক্ষ শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয় জেনে অনুগত সামরিক অফিসার ও রাজনীতিকদের দ্বারা গঠিত সরকারকে মিত্ররূপে গ্রহণ করে। এই সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য স্বয়ং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর কাছে জরুরি বার্তা পাঠান।’
এই নতুন সামরিক সরকার ও পরবর্তী স্বৈরাচারী সরকারগুলো পাকিস্তানের অনুকরণে প্রবল ভারতবিরোধী নীতি অনুসরণ শুরু করে। বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই শক্ত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী পার্বত্য গোষ্ঠীকে যুদ্ধের ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ দিতে থাকে। দুই বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ পাকিস্তান আমলের মতো বন্ধ করে দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানের আমলে ফারাক্কাবিরোধী লংমার্চের নামে ভারত সীমান্তের দিকে মিছিল পরিচালনা দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ততম করে তোলে।
পাকিস্তানের প্ররোচনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার শত্রুদের সহযোগিতায় গঠিত সরকারগুলো যে নীতি অনুসরণ করে, তা ছিল পাকিস্তানের ভারতবিরোধিতায় সম্পূরক নীতি। এই নীতির মোকাবেলায় বড় ও শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারত অবশ্যই তার আধিপত্যবাদী মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছে এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ছোট-বড় বিবাদগুলো ঝুলিয়ে রেখে দেশটিকে চাপের মুখে রাখার চেষ্টা করেছে।
বিএনপি-জামায়াত সরকার কখনো এই অবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করেনি। বরং বিএনপি নেত্রী কথায় কথায় ‘বাংলাদেশের এক-দশমাংশ ভারত গ্রাস করেছে’, ‘হিন্দুরা ভারত থেকে এসে আওয়ামী লীগকে ভোট দিচ্ছে’, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে’ ইত্যাদি দায়িত্বহীন কথাবার্তা বলে দুই দেশের সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটিয়েছেন। বিএনপি সরকার পাকিস্তানের হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে প্রক্সি ওয়ার চালাবে আর ভারতের শাসকরা (যে দলেরই হোক) তাদের গালে এসে চুমু খাবেন—এটা কি আশা করা যায়? আর এই আমলে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের অবন্ধুসুলভ নীতির উদাহরণ টেনে যেসব বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্ট বাংলাদেশকে ভারত কিছুই দেয়নি বলে এখন প্রচার চালাচ্ছেন, তাঁরা সব জেনেও না জানার ভান করছেন।
হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর অবস্থা বদলাতে থাকে। কোনো ছাড় না দিয়ে শুধু ভারত বিরোধিতার নীতি ত্যাগ করে হাসিনা সরকার পানিচুক্তি, পার্বত্য শান্তি চুক্তি, স্থল সীমান্ত চুক্তি, ছিটমহল ও সমুদ্র সীমানা নিয়ে বিরোধের মীমাংসা ইত্যাদি বহু কাজ করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও অসমতা দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থায় উন্নয়নসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে ভারত বিরাট সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে। ভারতকে ট্রানজিটের সুবিধা দেওয়া নিয়েও উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আখেরে দেখা যাবে এই চুক্তি দ্বারাও বাংলাদেশের উপকার ছাড়া ক্ষতি হয়নি।
বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ দিল্লির কংগ্রেস সরকারই গ্রহণ করেছিল। পশ্চিমবঙ্গের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটিকে তাঁর রাজ্যের স্বার্থ ও অধিকারের বিরাট ইস্যু বানিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চান বলে সমস্যাটি এখনো অমীমাংসিত রয়েছে। হাসিনা সরকার অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে সমস্যাটি সমাধানের চেষ্টা করছে। দিল্লির বর্তমান মোদি সরকারও এর সমাধান চায় এবং রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় স্বয়ং হাসিনার দিল্লি সফরের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নৈশভোজে ডেকে এই চুক্তি সম্পাদনে তাঁকে রাজি করানোর চেষ্টা করছেন।
আশা করা যায়, এবারের বৈঠকেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলেও চুক্তির খসড়া তৈরি হয়ে যাবে। অদূর ভবিষ্যতেই তা স্বাক্ষরিত হবে। ভারতের সঙ্গে দেনদরবার করে দাবি আদায়ের দক্ষতা শেখ হাসিনা বহুবার দেখিয়েছেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে লংমার্চ, হুমকি-ধমকি দিয়ে গঙ্গার এক ফোঁটা পানি আনতে পারেনি। হাসিনা ক্ষমতায় এসে কোনো হুমকি-ধমকি না দিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে ৩০ হাজার কিউসেক পানি পাওয়ার ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করতে পেরেছেন। তিস্তা চুক্তিও তাঁর সরকারই করতে পারবে। আর কোনো সরকারের দ্বারা তা সম্ভব হবে না।
বিএনপি ও দলটির সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা প্রচার করেন, ‘আওয়ামী লীগ ভারতের তাঁবেদার।’ তাঁবেদারি করলে বাংলাদেশের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার এত চুক্তি সম্পাদন হাসিনা সরকারের পক্ষে সম্ভব হতো না। বরং বিএনপিই বিজেপি সরকার ভারতে ক্ষমতায় আসার পর এই আশায় আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিল যে এই সরকার হাসিনা সরকারের প্রতি বিরূপতা দেখাবে এবং বিএনপিকে ক্ষমতায় বসাতে এগিয়ে আসবে। দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন হোক, তাতে বিএনপির কিছু যায়-আসে না। বিএনপির এই চক্রান্ত সফল হয়নি। মোদি সরকার ভারতের স্বার্থেই হাসিনা সরকারের দিকে মৈত্রী ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। বিএনপির অতি আশার গুড়ে ছাই পড়েছে।
আসন্ন দিল্লি বৈঠকের আগে বিএনপি ও ভারতবিদ্বেষী মহলটি তাদের প্রচারণার তূণ থেকে আরেকটি তীর নিক্ষেপ করেছে। বলা হচ্ছে, শেখ হাসিনা এবার দিল্লি গিয়ে ভারতের চাপে একটি সামরিক চুক্তি করে আসবেন, তাতে বাংলাদেশের সমূহ ক্ষতি হবে। ভারতের আধিপত্যের শেকলে বাঁধা পড়বে বাংলাদেশ। বাঘ আসার আগে যারা বাঘ বাঘ বলে মিথ্যা চিৎকার করে তাদের পরিণতি কী হয় রূপকথায় মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের গল্পে তার বর্ণনা আছে।
বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রকার সামরিক চুক্তির বিরোধী ছিলেন। পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি ও বাগদাদ চুক্তি পাকিস্তানে ও মধ্যপ্রাচ্যে কী সর্বনাশ ঘটিয়েছে, তা তিনি দেখেছেন। পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন স্বদেশে ফেরার আগেই ঢাকা-দিল্লি একটি ২৫ বছরমেয়াদি নিরাপত্তা চুক্তি সম্পাদনের ব্যবস্থা হয় তখনকার বিশেষ পরিস্থিতির প্রয়োজনে। কিন্তু এই চুক্তির একটি ধারাও কখনো কার্যকর হয়নি, এমনকি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সময়ও নয়। ভারত এই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী তখন বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে পারত। তারা তা করেনি। এবং তখন তা করা সম্ভবও ছিল না।
বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে সামরিক চুক্তিগুলো প্রায় অচল। মেডো ও সিয়াটো চুক্তিগুলোর পরিণতি কী ঘটেছে? ওয়ারশ চুক্তি বিলুপ্ত। এত শক্তিশালী ন্যাটোও এখন প্রায় অকেজো। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটো সম্পর্কে বিরক্ত। কোনো দেশে সামরিক হস্তক্ষেপ দ্বারাও কি সমস্যার সমাধান করা যায়? সমাধান করা গেলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে একক সুপার পাওয়ার আমেরিকাকে লেজে-গোবরে হতে হতো না।
সুতরাং সামরিক চুক্তি বা সামরিক হুমকি দ্বারা বাংলাদেশকে ভারত কবজা করে ফেলবে—এটা সহজ নয়। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা অবশ্যই এ সম্পর্কে সতর্ক আছেন এবং থাকবেন। তবে বর্তমানে সন্ত্রাসের যেমন বিশ্বায়ন ঘটেছে, তাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত সমঝোতা হতেই পারে। এ ধরনের সমঝোতা বিশ্বের বহু দেশের মধ্যে হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে হওয়া উচিত। এই সমঝোতায় পাকিস্তানকেও যুক্ত করা গেলে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক শান্তি নিশ্চিত হতো। কিন্তু পাকিস্তানে প্রকৃত গণতন্ত্র ফিরে না আসা পর্যন্ত তা সম্ভব নয়।
প্রতিরক্ষাসংক্রান্ত সমঝোতার অর্থ আসলে পরস্পরের মধ্যে তথ্যবিনিময়। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার জন্য সব বিষয়েই এই তথ্যবিনিময় প্রয়োজন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এই তথ্যবিনিময় চলছে। তাকে আরো কাঠামোগত রূপ দেওয়ার জন্য সমঝোতা চুক্তি হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আর ভারত থেকে সামরিক সরঞ্জাম কেনার ব্যবস্থা হলে তাতে অন্য দেশ থেকে তা কেনায় বাধা কোথায়? বাংলাদেশ রাশিয়া থেকে মিগ বিমান ও চীন থেকে সাবমেরিন কিনছে না? চিলে কান নিয়েছে বলে চিৎকার করার আগে কানটা যথাস্থনে আছে কি না তা দেখা দরকার।
বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর দিল্লি সফরের কাহিনি দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। তাঁর মতো শেখ হাসিনার শূন্য হাতে দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই। কারণ বাংলাদেশ ও ভারত পরস্পরের শত্রু দেশ নয়। ঢাকার হাসিনার সরকার ও দিল্লির মোদি সরকার পরস্পরের প্রতি আস্থাশীল এবং সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার কথাই সত্য হবে, ‘দেবে আর নেবে মেলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে।’
শেখ হাসিনায় ভারতযাত্রা অবশ্যই সার্থক ও সফল হবে।
©somewhere in net ltd.